পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করিতেছি
আমি একজন বড় দোষী
‘আমি ভক্তি জানাই তাঁরে
যিনি সৃষ্টি করেছেন মোরে’
এই জগতে আমি একজন বড় দোষী। এই জগতে দোষ-গুণের বিচার আছে কি? বিচার করিলে হইতাম আমি খুশী? এই নৌকার মাল্লাগুলি বড় পাজি। তাহারা মানিতে চায় না মাঝি। আমি সদাই ভাবি. নৌকাটার উপায় হইবে কি? কখন না জানি হয় ইহার ভরাডুবি।
কেন আমি দোষী, তাহা শোন, ওগো জগদ্বাসী। এই যে আমার দেহ তরী, ইহা চালাইবার জন্য আমি হইলাম খোদ মহাজনের নিয়োজিত মাঝি। এই দেহের ইন্দ্রিয় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদি সকলেই আমার প্রিয় মাল্লা, তাই সবাইকে আমি ভালবাসি। কিন্তু ইহাদের হৃদয় এত সংকীর্ণ যে ইহারা প্রত্যেকেই প্রতেককে শত্রু মনে করে। তাই আমি এক ইন্দ্রিয়কে ভাল বলিলে অপর ইন্দ্রিয়ের কাছে হই দোষী। এক অঙ্গকে ভাল বলিলে অপর অঙ্গের কাছে দোষী হই। ইহারা এত অজ্ঞ যে তাহারা আপনার ব্যাপারে গর্ব করে, কিন্তু অপরকে ঘৃণা করে। চক্ষু বলে, আমি উত্তম, কর্ণ কিছু নয়, হস্ত বলে আমি উত্তম, পদ কিছু নয়। অথচ তাহারা চিন্তা করিয়া দেখে না যে, তাহাদের মূল কোথায়। বীর্য হইতে দেহ পয়দা এবং সেই দেহেরই যে এক এক ক্ষুদ্রাংশ তাহারা, এই খবরও তাহারা রাখে না। সুতরাং বিশ্ব মানবগোষ্ঠী যে একই দেহের বিভিন্ন অংশ এবং এই মানব দেহের শান্তির জন্য প্রতিটি মানুষেরই যে পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতা করার একান্ত প্রয়োজন আছে, তাহা তাহারা বুঝে। অথচ পরস্পর ভ্রাতৃত্ব গড়িয়া মানুষ বিশ্বের মধ্যে শান্তি স্থাপন করিতে পারিতেছে না। ইহার একমাত্র কারণ, এক দেশবাসী অপর দেশবাসীকে ঘৃণা করে। এক গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ অপর গোষ্ঠীভুক্ত মানুষকে হেয় মনে করে এবং এক মতবাদী অপর মতবাদীকে শত্রু মনে করে। ইহা হইতেছে এইরূপ অজ্ঞতা যেমন চক্ষু কর্ণকে ঘৃণা করে, মাথা পা’কে নিন্দা করে।
আমি জগতে দোষী এই জন্য যে, জগদ্বাসী সমস্ত মানুষকে আমি ভাই বলিয়া ডাকি। আমি হিন্দু বলিয়া প্রকাশিত হইলে অহিন্দুদের কাছে দোষী। খ্রিষ্টানরূপে প্রকাশিত হইলে অখ্রিষ্টানদের কাছে দোষী। মুসলিম বলিয়া প্রকাশিত হইলে অমুসলিমদের কাছে দোষী। যাহা হোক, আমি সবার কাছে দোষী। সেই জন্য আর চিন্তা করি না। আমি মুক্ত কণ্ঠে বলি, “হে জগদ্বাসী হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান আপনারা সকলেই আমার ভাই। আসুন একবার বিচারে বসি। হে ধর্মীয় সম্প্রদায়! আপনারা জানিয়া রাখুন (১) উপাসক, (২) উপাসনা ও (৩) উপাস্য Ñ এই তিনটির সমন্বয়েই ধর্ম। উপাসক ঐ ব্যক্তি যে নিজে অভাবগ্রস্থ বা অপরাধী অথবা যে প্রেমাণলে দগ্ধিভূত হইতেছে। আর উপাসনা হইল অভাব মুক্তির জন্য বার বার করজোড়ে সাহায্য প্রার্থনা করা বা স্বীয় মস্তক ভূলুণ্ঠিত করিয়া নিজের অপরাধ স্বীকার করিয়া বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করা অথবা প্রেম বিচ্ছেদে ছট্ফট্ করা; প্রেমিকার নাম বা গুণ উচ্চারণ করিয়া নিজের তাপিত হৃদয়কে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করা। উপাস্য হইলেন তিনি যিনি নিজে অভাবমুক্ত, কখনও যাহার কোন প্রকার অভাবের আশঙ্কাই নাই এবং সকল অভাবগ্রস্থের অভাবমোচন করার ক্ষমতা যাহার সর্বদা বিদ্যমান আছে এবং যিনি সকল প্রেমিকের প্রেমাস্পদ হইবার যোগ্য; আরও যিনি সকল অপরাধীকে ক্ষমা করিতে সক্ষম। সুতরাং ঐ তিন গুণ বিশিষ্ট সত্তাই উপাস্য হইতে পারেন। আর তেমন সত্তা কখনও সৃষ্ট বস্তু হইতে পারে না, বরং তাহাকে স্রষ্টা হইতে হইবে। যেহেতু সৃষ্ট মাত্রই উপাসক, কারণ সৃষ্ট জীব মাত্রই অভাবগ্রস্থ, কাজেই অভাব মুক্তির জন্য সে সাহায্য প্রার্থনা করিতে বাধ্য। অতএব মানুষ মাত্রই উপাসক, তাই সে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নিয়মে বিভিন্ন নামে উপাসনা করিতেছে। কিন্তু তাই বলিয়া উপাস্য কখনও বিভিন্ন হইতে পারে না।”
হে বিশ্বের মানুষ! আমি বারংবার বলিতেছি, স্রষ্টা আর সৃষ্ট এক নয়। স্রষ্টাই কর্তা, সৃষ্টি তাঁহার কর্ম। সৃষ্টি জন্ম ও মৃত্যুর আওতার ভিতরে। কিন্তু স্রষ্টা জন্ম ও মৃত্যুর আওতার বাহিরে। সুতরাং যাহারা জন্ম ও মৃত্যুর আওতার ভিতরে তাহারা সকলেই অভাবগ্রস্থ ও বিভিন্ন কারণে অপরাধী। আর যিনি জন্ম ও মৃত্যুর আওতার বাহিরে তিনিই কেবল অভাবমুক্ত ও নির্দোষ। তাঁহার নিজস্ব সত্তা লইয়া তিনি সদা বিদ্যমান। তিনিই সৃষ্ট রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি, তাঁহার কোন অংশীদার নাই বা তাঁহার সমকক্ষ কেহই নাই; সুতরাং বিশ্ব মানবের উপাস্য একমাত্র তিনিই। অতএব আমি বিশ্ববাসীর কাছে আপীল করিতেছি, যদি কোন ভাই এই বিচার ভুল প্রমাণ করিতে পারেন, তাহা হইলে, আপনাদের ভাই হিসেবে আমার ভুল বুঝাইয়া দিন। কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জ করিয়া বলিতেছি, আসমানের নীচে ও জমিনের উপরে এমন কোন মানুষ আছেন কি যিনি আমার উপরোক্ত সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণ করিতে পারেন। সুতরাং বিশ্ব-মানব সবাই এক জাতীয়, সবাই উপাসক এবং সকলেরই উপাস্য মাত্র একজন যিনি এই জগদ্বাসীকে সৃষ্টি করিয়াছেন। অতএব যে কোন রাজ্যের জনগণের মাননীয় রাজা যেমন একজন, তিনি একাধিক হইতেই পারেন না, তদ্রƒপ বিশ্ব মানব উপাসক এবং তাহাদের উপাস্য মাত্র একজন, তিনি একাধিক হইতেই পারেন না। আরও যেমন একটি রাজ্যে রাষ্ট্রীয় আইন বা নীতি একটাই থাকে, বিভিন্ন লোকের জন্য, বিভিন্ন স্থানের জন্য, বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য, ভিন্ন ভিন্ন আইন হইতেই পারে না, তদ্রƒপ ধর্মীয় রাজ্যের উপাস্য বা রাজার উপাসনা প্রণালীও একই হইবে একাধিক হইতেই পারে না। এখন বিচার সাপেক্ষ যে, বর্তমান বিশ্বের প্রচলিত ধর্মনীতির কোন্ নীতিটা সঠিক।
ইতিÑ
********