পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করিতেছি।

তত্ত্ব জ্ঞানই সত্য জ্ঞান এবং একত্ব
জ্ঞানেই মানব জাতির পরিত্রাণ

বর্তমান জগত জ্ঞান -বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি সাধন করিয়াছে-সন্দেহ নাই। কিন্তু যেহেতু চিন্তাশীল বুদ্ধিমান শান্তিকামী মানুষ বিশ্বে শান্তি কায়েম করিবার জন্য এখনও বিভিন্ন স্থানে ‘শান্তি-বৈঠক’ করিয়া আসিতেছেন, ইহাতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, বিশ্বে এখনও যথার্থ শান্তি যাহাকে বলে তাহার অভাব রহিয়াছে। পৃথিবীতে পূর্ণ শান্তি কায়েম করিতে হইলে পূর্ণ একতার প্রয়োজন আছে এবং র্পূণ একতা কায়েম করিতে হইলে সকল প্রকার জাতিগত পার্থক্য দূরীভূত করিয়া বিশ্ব মানবগোষ্ঠীকে লইয়া এক জাতি গঠন করারও প্রয়োজন আছে। আবার এক জাতি গঠন করিতে হইলে বিশ্বের প্রচলিত বহু মত তত্ত্ব পরিত্যাগ করত বিশ্ববাসীদের কেবল একটি মাত্র মত অবলম্বন করিবারও বিশেষ প্রয়োজন রহিয়াছে। আর একথাও অতি সত্য যে এক মত অবলম্বন করিতে হইলে বিশ্ব মানবগোষ্ঠীকে একজন মাত্র নেতার অনুসরণ করিতে হইবে। সুতরাং বিশ্ব শান্তির মূলে যে উপাদানের অভাব রহিয়াছে তাহা হইল সেই বিশ্ব নেতারই অভাব। এখন প্রশ্ন, সেই বিশ্ব নেতার অভাব কে পূরণ করিবেন এবং বিশ্ব মানবের পক্ষে এক নীতি বা এক মত অবলম্বন করা কি সম্ভবপর? যাহা হোক এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করি।
মানব জাতির স্বভাব ধর্ম হইতেছে এক নীতি প্রতিপালন করা। জন্ম ও মৃত্যু প্রকৃতির বিধিবদ্ধ নিয়ম। অতীতে মানুষ জন্মের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে এবং মৃত্যুর মাধ্যমে বিলীন হইয়া গিয়াছে। বর্তমানেও ঐ নিয়ম বিদ্যমান এবং ভবিষতেও এই নিয়মই কার্যকর হইবে। প্রত্যেক প্রাণীই জীবনে এই নিয়ম মানিতে বাধ্য। যেমন, প্রত্যেক মানব সন্তানই মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করে, প্রত্যেক শিশুই দাঁত ছাড়া, জ্ঞান ছাড়া , চলার ও বলার শক্তি ছাড়া থাকিতে বাধ্যÑ কোথাও ইহার ব্যতিক্রম নাই। তারপর প্রত্যেক মানুষেরই পাঁচটি ইন্দ্রিয় এবং প্রতিটি ইন্দ্রিয়েরই ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি শক্তি রহিয়াছে। ইহা সমগ্র মানব জাতির জন্য একইরূপ। মানুষের জীবন সূর্যের অনুরূপ। সূর্য প্রভাতে প্রতাপবিহীন লোহিত আভা ধারণ করিয়া উদিত হয়, ক্রমশ উর্ধ্বাকাশে উঠিতে উঠিতে দ্বিপ্রহরে খরতাপ ও অত্যুজ্জ্বল কিরণ বিস্তার করিয়া চক্ষু ঝলসাইয়া দেয়। কিন্তু তারপর নিম্নাকাশে ঢলিয়া পড়িয়া সায়াহ্নে আবার সেই প্রতাপ ও প্রভাব বিহীন রক্তিম আভা ধারণ করিয়া অস্তমিত হইয়া বিলীন হইয়া যায়। ঠিক তেমনি মানব শিশুও গুণ ও প্রভাব বিহীন অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করে এবং আস্তে আস্তে জ্ঞান ও গুণে বিভূষিত হইতে হইতে যৌবনে পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। কেহ নরপতি, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক হয়, কেহ ধনকুবের, পাহলোয়ান হয় Ñ যাহাদের প্রভাব ও প্রতাপের সম্মুখে সাধারণ মানুষ চোখ তুলিয়া তাকাইতেও ভয় পায়। কিন্তু সেই প্রতাপশালী ব্যক্তিই একদিন যৌবন হারাইয়া বৃদ্ধ হয়, অবশেষে মৃত্যুশয্যায় পুনরায় শৈশবাবস্থায় পতিত হয়। তারপর একদিন মৃত্যুর মাধ্যমে জীবন সূর্য অস্তমিত হইয়া বিলীন হইয়া যায়। এই যে নিয়ম ইহা হইতে কি কোন ভাষাভাষী বা কোন দেশবাসী অব্যাহতি পায়? অতএব, জগদ্বাসী সকলেই এই প্রাকৃতিক নিয়ম বা স্বাভাবিক ধর্ম পালন করিয়া আসিতেছে।
এখন আমি অপর একটি তত্ত্ব আলোচনা করিতেছি। সমগ্র মানব জাতি একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী। যেমন, আমি না দেখিয়াও আমার জীবনের প্রতি বিশ্বাসী। জগতের সকল মানুষই নিজ নিজ জীবনের প্রতি বিশ্বাসী। আরও দেখুন, আমার জীবন আমার নিকট সব চাইতে প্রিয়। ঐরূপ সকল মানুষই নিজ নিজ জীবনকে সব চাইতে বেশী ভালবাসে। আরও দেখুন, প্রত্যেকের জীবনে শান্তি নির্ভর করে খাওয়া, পরা ও বাসস্থানের উপর এবং এইগুলি নির্ভর করে উপার্জনের উপর। সুতরাং যাহার উপার্জন যত বেশী, উক্ত তিন জিনিস তাহার তত উন্নত মানের হয় ও জীবনে শান্তি ও আনন্দ পায়। সুতরাং বেশী উপার্জনশীল ব্যক্তিকে সৌভাগ্যবান এবং কম উপার্জনশীল ব্যক্তিকে ভাগ্যহীন মনে করা হয়। কিন্তু এই উপার্জন, সঞ্চয়, খরচাদির ব্যাপারে মানুষ কোন বাঁধা-ধরা নিয়মের অধীন নয়। একমাত্র মানুষ ব্যতীত অপরাপর সকল জীবের খাওয়া-পরা-বাসস্থান ও উপার্জন সম্বন্ধে সৃষ্টির প্রথম হইতে যাহার জন্য যে নিয়ম বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে পৃথিবীর লয় হওয়া পর্যন্ত তাহাকে সেই বাঁধা-ধরা নিয়মের অধীনেই থাকিতে হইবে। এই কারণে মানুষ ব্যতীত অপর কোন জীবই তাহার অবস্থার বিন্দুমাত্রও উন্নতি করিতে পারে নাই বা পারিবেও না। একমাত্র মানব জাতিই সৃষ্টির প্রথম হইতে ক্রমান্বয়ে উন্নতি সাধন করিয়া আসিতেছে এবং তাহার আরও উন্নতির সম্ভাবনা রহিয়াছে। এই কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা।
এখন জানা দরকার যে মানুষ কি আপনা আপনিই সৃষ্টির সেরা হইতে পারিয়াছে না অপর কেউ তাহাকে এই শ্রেষ্ঠত্ব লাভের উপকরণ দান করিয়াছেন।
হে উন্নত যুগের মানুষ! আপনারা অবগত আছেনÑ ইহা অতি ধ্রুব সত্য যে, কোন কর্মই কর্তা ছাড়া হয়না। যেমন, এক খন্ড সাদা কাগজ। ইহাতে আমি একটি ‘ক’ লিখিলাম। উক্ত ‘ক’ একটি কর্ম। যে প্রণালীতে উহা লিখিলামÑউহা ক্রিয়া। আর আমি উক্ত ‘ক’ কর্মের কর্তা। তাহা হইলে দেখা যায় যে, আমার ইচ্ছায় ‘ক’ অস্তিত্ববান হইল এবং আমি ইচ্ছা করিলে এখনই ইহাকে মুছিয়া ফেলিতে পারি। সুতরাং আমার ইচ্ছার উপরই আমার কর্মের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব বা অনস্তিত্ব নির্ভর করে। এই যুক্তিমতে বিচার করিলে দেখা যায় যে, এই পৃথিবী যেন একখন্ড কাগজ, আর পৃথিবীর সমস্ত বস্তু ও জীব সকলই কর্ম; অর্থাৎ জন্ম দ্বারা অস্তিত্ববান হয়Ñ পূর্বে ছিলনা এবং মৃত্যু দ্বারা লয় হয়Ñপরে আর থাকে না। আরও দেখুন, কর্ম সসীম, অসীম হইতে পারে না এবং সে অক্ষম, সক্ষম হইতে পারে না। কিন্ত কর্তা অসীম, যেহেতু তিনি জন্ম ও মৃত্যুর উর্ধ্বে, তিনি সক্ষম। আর যিনি অসীম ও স্বয়ং সক্ষম এবং সর্ব কর্মের কর্তা, তিনি একক ও অদ্বিতীয়। তেমন সত্তা একাধিক হইতে পারে না। সুতরাং এই যে একত্ব জ্ঞান এই জ্ঞান ছাড়া মানুষ কখনও পরিত্রাণ পাইতে পারে না। এই যে তত্ত্ব জ্ঞান ও একত্ব জ্ঞান Ñ ইহা বুঝা এবং বুঝাইবার ক্ষমতা একমাত্র মানব জাতিকেই বিশ্ব স্রষ্টা দান করিয়াছেন। অপর প্রাণীর এই ক্ষমতা নাই। এখানে যে তত্ত্ব আলোচনা করা হইল, জ্ঞানবান মানুষ মাত্রই ইহা শুনিতে ও এই সত্য স্বীকার করিতে বাধ্য হইবেন। কিন্তু এই সত্য লইয়া যদি আমি একটি শিংধারী গরুকে বুঝাইতে চেষ্টা করি সে কখনো ইহা বুঝিবে না; বরং তাহার শিং দ্বারা সে আঘাত করিতে চাহিবে। তাই আমাদের স্বীকার করিতে হইবে যে, আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব লাভের মূলে রহিয়াছে স্রষ্টার এক বিশেষ দান যাহা তিনি অপর প্রাণীকে দান করেন নাই।
হে বিশ্ব মানব! আপনারা সত্য সত্য জানিয়া রাখুন যে, মানুষের দুইটি আত্মা আছে – একটি জীবাত্মা যাহা সকল জীবরেই আছে। ইহা মানুষেরও আছে। অপরটি পরমাত্মা, যাহা শুধু মাত্র মানুষকেই সৃষ্টিকর্তা দান করিয়াছেন। ইহাই সেই বিশেষ দান এবং এই কারণেই মানুষকে প্রাকৃতিক নিয়ম বা স্বাভাবিক ধর্মকে ডিঙ্গাইয়া একটি স্বতন্ত্র পরম ধর্ম পালন করিতে হয়।
এখন জানা দরকার যে, জীবধর্ম ও পরম ধর্মে প্রভেদ কি। প্রত্যেক জীবকেই একটা জ্ঞান দান করা হইয়াছে এবং প্রত্যেক জীবকেই ইন্দ্রিয় ও অঙ্গাদি দান করা হইয়াছে। ইন্দ্রিয় ও অঙ্গাদি পরিচালনার ক্ষমতা দেহস্থিত আত্মার হাতেই দান করা হইয়াছে। কিন্তু উক্ত জ্ঞান সসীম জাগতিক জ্ঞান। তাই এই সসীম জগতের সীমা ডিঙ্গাইয়া অসীম জগতের কোন সন্ধান সে লইতে পারে না। অতএব দেহস্থিত আত্মাকেই সে সব চাইতে প্রিয় মনে করে এবং তাহাকেই আরাধ্য হিসাবে গ্রহণ করিয়া থাকে। এই আত্মারই শান্তি ও পরিতৃপ্তির জন্য তাহার অধীনস্ত সমস্ত ইন্দ্রিয় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলিকে পরিচালিত করে। এক কথায়, এই দেহস্থিত জীবনটাই যেন জীবের উপাস্য, তাহার ইন্দ্রিয়সমূহ তাহার উপাসক। আর প্রত্যেকেই ভাল ভাল আহার্য, সুন্দর সুন্দর মজবুত বাসস্থান এবং আরামদায়ক পোষাক-পরিচ্ছদ পছন্দ করে। অতএব যাহার জীবনে উক্ত জিনিসগুলি যত বেশী উন্নত মানের হয় সে-ই নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করে। তার বিপরীত হইলে দুর্ভাগ্য বিবেচিত হয়। এখন বিচার্য বিষয় হইল যে, মানুষকে প্রথম হইতেই যে তত্ত্ব জ্ঞান দ্বারা সৃষ্টির সেরা করিয়া সৃষ্টি করা হইয়াছে, সেই মানুষ যদি নিম্নস্তরে নামিয়া আসিয়া শুধু জৈব ধর্ম বা জীবধর্ম পালন করে, তাহা হইলে সেই মানুষ কি নরাকৃতি পশু হইবে না? মানব তাহার অর্জিত তত্ত্ব জ্ঞান দ্বারা নতুন জিনিসাদি আবিষ্কার করে- ইহা আপরাপর প্রাণী পারে না। মানুষ তত্ত্ব জ্ঞান দ্বারা বুঝিতে পারে যে, তাহাকে একতাবদ্ধভাবে বসবাস করিতে হইবে। নতুবা প্রাকৃতিক নিয়মে কখনও তাহার ভাগ্য পরিবর্তন করিয়া প্রাসাদের অধিকারী হইতে পারিবে না। এইরূপ জ্ঞান করিয়াই মানুষ সমাজ গঠন করতঃ একতাবদ্ধ হইয়া জীবন যাপন করিতে থাকে এবং পরবর্তী পর্যায়ে অল্প পরিসর সমাজ হইতে বিস্তৃততর সমাজ বা রাষ্ট্র গঠন করতঃ উন্নতি লাভ করিতে থাকে। এই তত্ত্ব জ্ঞান দ্বারাই মানুষ বুঝিতে পারে যে সমাজ গঠন করা ও কায়েম রাখার জন্য একজন সমাজপতির অবশ্য দরকার। তাই প্রতি সমাজে একজন সমাজপতি এবং প্রতি রাষ্ট্রে একজন রাষ্ট্রপতি থাকার ব্যবস্থাও রহিয়াছে। আজিকার সভ্য জগতে ইহার ব্যতিক্রম কোথাও পরিলক্ষিত হইবে না। কিন্তু মানুষের আশার নিবৃত্তি কিছুতেই হইতেছে না। বুঝা যায়, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত অনাদি অনন্ত, একক ও অদ্বিতীয়, মহাজ্ঞানী পরম প্রভু বিশ্ব স্রষ্টার নির্দেশিত সেই পরম ধর্ম পালন করিতে বাধ্য না হইবে ততদিন পর্যন্ত মানুষ প্রকৃত শান্তি কখনও পাইতে পারে না। এইবার শুনুন, বিশ্ব শান্তি কায়েমের পথে মানুষের প্রধান অন্তরায় কোথায়। জ্ঞানবান মানুষ জানেন যে, একাধিক মানুষ একত্র বসবাস করিতে গেলে কোন ব্যাপারে কখনও কখনও তাহাদের মধ্যে মত পার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক। তাই এমন একজন বলিষ্ঠ নেতার অধীনতা স্বীকার করিয়া চলা আবশ্যক যিনি এই মতানৈক্যের সঠিক মীমাংসা করিতে সক্ষম। আর যথার্থ মীমাংসাকারকের তিনটি বিশেষ গুণ থাকা একান্ত আবশ্যক। প্রথমতঃ অধীনস্তদিগকে আপনার স্নেহের সন্তানরূপে দেখা; দ্বিতীয়তঃ তাঁহার বিচার জ্ঞান থাকা, যেহেতু মতানৈক্যকারীদের মধ্যে কে সঠিক আর কে অঠিক মত প্রকাশ করিতেছে তাহা যুক্তি প্রমাণ দ্বারা সকলকে বুঝাইয়া দিতে সক্ষম হইতে হইবে। তৃতীয়তঃ সঠিক মত বলবৎ রাখিবার ও অঠিক মত মিটাইয়া দিবার জন্য সৎসাহস ও পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা। উক্ত তিন গুণ বিশিষ্ট নেতার দ্বারাই সুবিচার কায়েম হয়; আর সুবিচারই জগদ্বাসীর শান্তির মূল ধন। সুতরাং যখন সমাজে সুবিচারক নেতা থাকে না. তখন দেশে সুবিচার থাকে না, আর যখন সুবিচার থাকে না তখন শান্তিও থাকে না।
বর্তমান বিশ্বে ক্ষুদ্রতম সমাজ হইতেছে ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং বৃহত্তম সমাজ হইতেছে জাতিসংঘ। সকল সামজেই সমাজপতি আছেন; কিন্তু সকল সমাজেই মতানৈক্যজনিত ঝগড়াও বিদ্যমান আছে। প্রমাণ স্বরূপ বলিতেছি, আমরা দুই ভাই। এক ভাই বিশ্বাস করে যে, এই পৃথিবীর একজন স্রষ্টা আছেন, মানুষ মৃত্যুর পর পুনরায় জীবত হইবে, এই পৃথিবীতে ভাল-মন্দ কাজের জন্য পরকালে বিচার দিতে হইবে, ভাল কাজের বিনিময়ে শান্তি ও মন্দ কাজের বিনিময়ে শাস্তি ভুগিতে হইবে ইত্যাদি। অপর ভাই এই মতের ঘোর বিরোধী। সে বলে, এই পৃথিবীর সকল কিছুই প্রাকৃতিক নিয়মে সৃষ্টি ও লয় হয়। মানুষও তাহাই। তবে মানুষ সাধনা ও পরিশ্রম করিয়া যে জ্ঞান অর্জন করে উক্ত জ্ঞান খাটাইয়া যে যত বেশী উন্নতি করিতে পারে সে তত বেশী শান্তির জীবন যাপন করিতে পারে এবং ইহাকেই সৌভাগ্য জ্ঞান করা হয়। আর যে অলস, পরিশ্রম করে না, জ্ঞান অর্জন করে না এবং কর্মের মাধ্যমে উন্নতি লাভ করিতে চেষ্টা করে না, সে অশান্তির জীবন যাপন করেÑইহাকেই তাহার দুর্ভাগ্য বলা হয়। সুতরাং এই জগতই মানবের কর্ম জীবন ও ফল ভোগের জীবন। মানবের পরকাল বা পুনর্জীবন বলিতে কিছু নাই। এইবার চিন্তা করিয়া দেখুন এবং বলুন, উক্ত দুই মতাবলম্বীর মধ্যে প্রকৃত ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব গড়িয়া উঠা কি সম্ভবপর? হে সভ্য জগতের জ্ঞানবান ভ্রাতৃবৃন্দ! আপনারা বলুন, উক্ত দুই বিপরীত বিশ্বাসে বিশ্বাসী মানুষ কি বর্তমান বিশ্বের সকল সমাজেই দেখা যায় না? তাহা হইলে এখন প্রশ্ন Ñউক্ত দুইটা মতই কি ঠিক? ইহা কখনও হইতে পারে না। নিশ্চয়ই ইহার একটি সঠিক এবং অপরটি অঠিক। আর এই মতানৈক্যের মীমাংসা করিবার দায়িত্ব সমাজপতির। সুতরাং সমাজপতি থাকিতেও যখন মীমাংসা হইতেছে না তখন বুঝিতে হইবে যে, কোন সমাজপতিরই সঠিক ও অঠিক মত নির্ণয় করিবার মত বিচার জ্ঞান নাই অথবা বিচার জ্ঞান থাকিলেও সঠিক মত বলবৎ রাখিয়া অঠিক মত মিটাইয়া দিবার মত সৎসাহস তাহাদের নাই। অতএব, মীমাংসা করিবার মত ক্ষমতা যাহার নাই সে সমাজপতি হওয়ার যোগ্য নহে।
যাহা হোক, উক্ত মতপার্থক্যের মীমাংসা কেন হইতেছে না, তাহার প্রধান কারণ এই যে, মানুষ চিন্তা করিয়া দেখে যে, সমস্ত বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করিয়া না চলিলে কোন দেশবাসীই শান্তিতে থাকিতে পারে না। কাজেই এক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি স্রষ্টা ও পরকালে বিশ্বাসী এবং অপর এক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি স্রষ্টা ও পরকালে অবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও দুইটি রাষ্ট্রই পরস্পর মৈত্রী ও বন্ধুত্ব কামনা করে। এখন যদি প্রথম জন দ্বিতীয় জনকে বলেন, আপনার মত অঠিক। সুতরাং আপনার অঠিক মত ও পথ ত্যাগ করুনÑ তাহা তিনি মানিবেন না। পক্ষান্তরে, যদি দ্বিতীয়জন প্রথমজনকে বলেন, আপনার মত অঠিক। সুতরাং আপনার অঠিক মত ও পথ ত্যাগ করুন-তাহা হইলে তিনিও তাহা মানিবেন না। আর এই কথাও ঠিক যে অধীনস্তদের মীমাংসা ত সমাজপতি বা নেতা করিতে পারেন। কিন্তু এইস্থলে দুইজনই উপরস্ত নেতা। এমতাবস্থায় তাহাদের মীমাংসা করিবেন কে? এইখানে যদিও এক পক্ষ সঠিক এবং অপর পক্ষ অঠিক এবং সঠিক পক্ষ যদি তাহার প্রতিপক্ষের অঠিক মত মিটাইয়া দিয়া তাহার নিজের সঠিক মত কায়েম রাখিতে চেষ্টা করেনÑ তাহা হইলে সেখানে লাগিবে যুদ্ধ। কাজেই এই মতানৈক্যের বিষয়বস্তু বাদ দিয়া তাহারা জাগতিক অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ও বৈষয়িক ব্যাপারে আলোচনা করিয়া বন্ধুত্ব কায়েম রাখিবার চেষ্টা করেন। এই ভাবেই পরস্পর বন্ধুত্ব গড়িয়া সারা বিশ্ববাসীর পক্ষে একত্র সম্মিলিত হওয়া আজ সম্ভবপর হইয়াছে। ইহাতে মানুষ আপন উদ্দেশ্য সফল করিবার পথে অনেক অগ্রগতি সাধন করিয়াছে সত্য, কিন্তু মানুষের মূল উদ্দেশ্য সফল হয় নাই। তাহার কারণ এই যে, দুই বিপরীত বিশ্বাসে বিশ্বাসী বা দুই বিপরীত মতবাদীর মধ্যে প্রকৃত বন্ধুত্ব কায়েম করিবার চেষ্টা করা আর দিন ও রাত্রিকে একীভূত করিবার চেষ্টা করা একই কথা। তাই মানুষ তথাকথিত বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব গড়িয়াও নির্মল আনন্দ বা পূর্ণ নিরাপত্তা বা প্রকৃত শান্তি পাইতেছে না।
‘মানুষ যাহা চায় তাহাই পায়, যদিও বিলম্ব হয়।’ অতএব মানুষ যখন খাঁটি শান্তিই চায়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই এই পৃথিবীতে খাঁটি শান্তি একদিন প্রতিষ্ঠিত হইবেÑসন্দেহ নাই। যদিও মতানৈক্যের মীমাংসা হইতেছে না, তবুও মীমাংসার সুযোগ ত হইতেছে। পূর্বে মানুষের যে সংকীর্ণ মনোভাব ছিল, যদ্দরুন এক মতে বিশ্বাসী মানুষ অপর মতে বিশ্বাসী মানুষদিগকে ছোঁয়াচে রুগীর ন্যায় মনে করিত, কিন্তু বর্তমানে সেইভাব দূর হইয়া গিয়াছে। এখন বিশ্বের সকল মতবাদী মানুষের একত্রে বসিবার ও আলোচনা করিবার পথ অনেকটা সুগম হইয়াছে। এই সকলই সেই বিশ্ব স্রষ্টা তাহার অদৃশ্য হস্তেই সম্ভবপর করিয়া তুলিয়াছেন। বিশ্বে যাহা ঘটিয়াছে বা যাহা ঘটিবেÑ সবই তাঁহার পরিকল্পিত। আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে তত্ব জ্ঞানই সত্য জ্ঞান, আর তত্ত্ববিদ মানুষ এক বাক্যে স্বীকার করিবেন যে কর্তা ছাড়া কোন কর্ম হয় না। সুতরাং মানুষ কর্ম এবং বিশ্ব স্রষ্টাই সবার কর্তা। সেই কর্তাই আমাদের বিশ্ব নেতার অভাব পূরণ করিতে সক্ষম। এই জন্যই বলা হয়, মানুষই মানুষকে শান্তি দিতে পারে যদি সবাই এক বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়, এক মতে মত মিলাইয়া এক পথে চলে। ধন-রতœ মানুষকে শান্তি দিতে পারে না। আবার মানুষই মানুষের অশান্তির প্রধান কারণ হয়, যদি বিরোধী মতবাদী হয়। যাহা হোক, ফল কথা এই যে, বিশ্ব মানবের নিজ নিজ পরিত্রাণের জন্য প্রত্যেককেই একত্ববাদী হইতে হইবে এবং পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য সকলকেই এক মতবাদী হইতে হইবে এবং ইহার জন্য একত্বজ্ঞানীকে নেতা মান্য করত তাঁহার অনুসারী হইতে হইবে।

১২ চৈত্র, ১৩৮৩ বাং সন।
২৬ মার্চ, ১৯৭৭ খ্রিষ্টীয়।

********