পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করিতেছি

কোন পথে খাঁটি শান্তি আসিবে

বর্তমান যুগের মানুষ ভীষণ অশান্তিতে কাল যাপন করিতেছেÑ ইহা সকলেই অনুভব করিতেছে। সকল মানুষেরই একমাত্র কাম্য জীবনের শান্তি। এই শান্তি কোন্ পথে পাওয়া যাইতে পারে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ ইহার বিষয়ে দুইটি পথ নির্দেশ করিতেছেন। তাহার একটি গণতন্ত্র এবং দ্বিতীয়টি সমাজতন্ত্র। আবার কাহারো মতে এই দুইটির সমন্বয় সাধনেই শান্তি আসিতে পারে। আবার কাহারো মতে এই দুইটি পরস্পর বিরোধী। সুতরাং ইহাদের সমন্বয় কখনো হইতে পারে না। এই দুইয়ের টানাপড়েনে সাধারণ মানুষ হইয়া পড়িয়াছে অসহায় ও দিশাহারা।
এখানে তাই আমি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করিতে ইচ্ছা করি।
গণতন্ত্রের উপকারিতা ঃ গণতন্ত্রে ব্যক্তি-স্বাধীনতা স্বীকৃত। এখানে যে কোন ব্যক্তি আপন মত প্রকাশ করিতে পারে। আবার অপর কোন ব্যক্তি বা মতের সমালোচনা বা বিরোধিতাও করিতে পারে। ইচ্ছামত দল গঠন করিতে পারে, আবার অপর দলের সমালোচনা বা বিরোধিতাও করিতে পারে। ইচ্ছা মত আন্দোলন করিতে পারে, আবার অপর কোন আন্দোলনের মোকাবেলাও করিতে পারে।
পক্ষান্তরে, সমাজতন্ত্রে ইহার সমস্তই বেআইনী বা নিষিদ্ধ। এই কারণেই উপরোল্লিখিত স্বাধীনতা লাভের জন্য মানুষ গণতন্ত্রকেই একমাত্র শান্তির উপায় ও পথরূপে বিবেচনা করিয়া থাকে। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করিলে দেখা যাইবে যে, গণতন্ত্রের এইরূপ স্বাধীনতায় মানুষের জীবন শান্তি আসিতে পারে না। কারণ, যখনই কোন বিজ্ঞ, জনহেতৈষী ও দূরদর্শী ব্যক্তি কোন জনকল্যাণমূলক মত প্রকাশ করিবেন, তখনই অপর কোন অজ্ঞ, অদূরদর্শী ব্যক্তি তাহার যুক্তিহীন সমালোচনা ও বিরোধিতার মাধ্যমে উক্ত জনকল্যাণমূলক মত বা পথটি বানচাল করিয়া দিতে পারে। ফলে সমাজে জনহিতকর কোন পরিকল্পনাই যথার্থভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ নাও হইতে পারে। অতএব এইরূপ অপকারিতাও গণতন্ত্রে বিদ্যমান।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের যুক্তিগত প্রয়োজনীয়তা ঃ এক সৃষ্টিকর্তাই মানুষ হইতে শুরু করিয়া জীব-জানোয়ার, পশু-পক্ষী সবকিছু সৃষ্টি করিয়াছেন। সকল জীবেরই খাওয়া-পরা ও বাসস্থানের প্রয়োজন রহিয়াছে। কিন্তু একমাত্র মানুষ ছাড়া আর সকল প্রাণীই অপরের সাহায্য ব্যতীত প্রাকৃতিক নিয়মে আপন আপন প্রয়োজন মিটাইয়া জীবন যাপন করিতে সক্ষম। যেমন, ব্যাঘ্রের গায়ের পশমই পরিধানের বস্ত্র এবং তার থাবার নখই তার খাবার সংগ্রহ ও বাসস্থান তৈরীর বা গর্ত খুঁড়ার জন্য হাতিয়ারের প্রয়োজন মিটাইয়া থাকে। একটি বকের পালকই তার পরিধানের বস্ত্রতুল্য এবং উহার লম্বা ঠোঁটখানাই তার আহার সংগ্রহ ও বাসস্থান তৈরী করার প্রাকৃতিক হাতিয়ার। কিন্তু মানুষকে এইরূপ কোন প্রাকৃতিক হাতিয়ার দেওয়া হয় নাই যদ্দ¦ারা সে নিজে নিজেই তাহার সকল প্রয়োজন মিটাইয়া জীবন যাপন করিতে পারে। একজন মানুষের প্রয়োজন মিটাইবার জন্য কৃষক, শ্রমিক, তাঁতী, কামার, কুমার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, চিকিৎসার্থী, সুতার, জেলে প্রভৃতি সর্বশ্রেণীর মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন। কাজেই প্রত্যেকেই প্রত্যেককে হিতৈষী ও উপকারী মনে করিয়া, কখনো কাহাকেও ঘৃণ্য বা তুচ্ছরূপে মনে না করিয়া পরস্পর মিলয়া-মিশিয়া সমাজবদ্ধভাবে জীবন যাপন করিতে পারিলেই মানুষের জীবনে খাঁটি শান্তি আসিতে পারে। ইহা ছাড়া মিলিয়া-মিশিয়া সমাজবদ্ধভাবে জীবন যাপন করার আরও বিশেষ উপকারিতা রহিয়াছে। যেহেতু সৃষ্টিকর্তাই সকলের জীবিকা দান করিয়া থাকেন, কিন্তু মানুষ ছাড়া আর সকল প্রাণীর জীবিকা তিনি প্রাকৃতিক নিয়মে বণ্টন করিয়া থাকেন, যেহেতু স্রষ্টার ইচ্ছায় কেহ কিছু কম বা বেশী পাইলেও তাতে অপরের কোন ক্ষতি হয় না। কেননা প্রয়োজনের বেশী সংগ্রহ করিয়া দশটি প্রাণীর খাদ্যসম্ভার একার জন্য গুদামজাত করিয়া রাখিবার ক্ষমতা বা প্রবৃত্তি কোন প্রাণীরই নাই। কিন্তু মানুষের জীবিকা সংগ্রহ ও বণ্টনের ব্যবস্থা স্বতন্ত্র। একটি বক না খাইয়া থাকিলেও অপরের কাছে চাহিতে যায় না, অথবা একটি বকের সামনে দশ দিনের খাবার পড়িয়া থাকিলেও সে উহা সংগ্রহ ও গুদামজাত করিয়া রাখিতে জানে না। কিন্তু একটি মানুষ উপার্জনে অক্ষম হইলে অপরের সাহায্য ব্যতীত সে বাঁচিতেই পারে না। পক্ষান্তরে মানুষ এত কৌশলী যে হাজার হাজার মানুষের জীবিকা সে একাই সংগ্রহ করিয়া গুদামজাত করিয়া রাখিতে পারে। সুতরাং মানুষ যদি কোন নিয়মের অধীনে সমাজবদ্ধভাবে না চলে, তাহা হইলে উহা হইবে কতক মানুষের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক আবার কতকের জন্য বিশেষ অসুবিধাজনক। এই জন্যই সর্ব শ্রেণীর মানুষ লইয়া একটি সমাজ গঠনের বিশেষ প্রয়োজন রহিয়াছে। এইরূপ হইলে সমাজে এমন এক শ্রেণী থাকিবে, যাহারা হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের জীবিকা উপার্জন করিয়া আনিবে। আবার এমন এক শ্রেণীও থাকিবে যাহারা উক্ত জীবিকা ন্যায়সংগতভাবে সকলের মধ্যে বিতরণ করিবে, অথচ কেহ কাহারও প্রতি জুলুমও করিতে পারিবে না। যদি নিয়মবদ্ধ একটি সমাজ না থাকে তাহা হইলে মানুষ জীবনে খাঁটি শান্তি কখনও পাইতে পারে না। সমাজতন্ত্রের উপকারিতা বুঝিতে হইলে মানুষের জাতীয়তাবোধ জ্ঞান থাকা চাই। জাতীয়তাবোধহীন লোকের ধারণা মতে একটি কাক ও একটি বক এই দুইটি দুই জাতীয় জীব। এইরূপ কামার ও কুমার দুই জাতের মানুষ বা কৃষক ও তাঁতী দুই জাতের মানুষ। প্রকৃতপক্ষে কামার ও কুমার, কৃষক ও তাঁতী একই মানব জাতি। তবে পেশা হিসাবে পৃথক পৃথক শ্রেণী বলা যাইতে পারে। যাহা হউক, সমাজতন্ত্র বাস্তবায়িত করিতে হইলে সর্বপ্রথম একজন সমাজপতির বিশেষ প্রয়োজন। কেননা, সকল মানুষ একত্রিত হইতে চাহিলে এক জনকে কেন্দ্র করিয়া সকলে স্ব স্ব মত ত্যাগ করিয়া এক মতাবলম্বী হইতে হইবে। নতুবা সকলেই স্ব স্ব মতে বহাল থাকিলে কেহই জীবনে একতাবদ্ধ হইতে পারিবে না এবং প্রকৃত শান্তিও পাইতে পারে না। ইহার প্রমাণ এই যে, মনে করুন, একখানা নৌকা পানি হইতে ডাঙ্গায় তুলিতে হইলে কমপক্ষে দশজন লোকের প্রয়োজন। কিন্তু উক্ত দশজনের মধ্যে ‘মাদার’ দেওয়ার জন্য একজনকে নিযুক্ত করিতে হইবে। উক্ত ব্যক্তি যাহাকে যেভবে দাঁড়াইতে বলিবে প্রত্যেককে সেভাবেই দাঁড়াইতে হইবে, যাহাকে যেভাবে ধরিতে বলিবে তাহাকে সেইভাবে ধরিতে হইবে। সে যেভাবে ‘ডাক’ বা ‘বুলি’ বলিবে ও ইশারা দিবে বাকী নয়জনকে অবশ্যই তাহা পালন করিতে হইবে, এরূপ না হইলে দশ জনের স্থলে একশত জন হইলেও নৌকা ডাঙ্গায় তুলিতে পারিবে না। উহার কারণ হইল একজন দলপতি ছাড়া দলের শক্তি কার্যকরী হইতে পারে না। সুতরাং আমরা সমাজতন্ত্রের ফল স্বরূপ যে খাঁটি শান্তি লাভ করিতে ইচ্ছা করি, উহা তখনই লাভ হইতে পারে যখন সকল শ্রেণীর প্রত্যেকটি মানুষ এক ব্যক্তিকে সমাজপতি হিসাবে মানিয়া লইতে পারে। আর মানাও শুধু মাত্র মৌখিক মানা নয় বরং জান, মাল ও মান Ñ এই তিন জিনিস দ্বারা শক্তি অনুপাতে সমাজপতির সহযোগিতা করিতে হইবে। ইহাকেই নেতার আনুগত্য স্বীকার করা বলে। এক কথায় নিজের স্বাধীন ক্ষমতা তাহার কাছে সমর্পণ করিতে হইবে এবং তাহার উপর দৃঢ় বিশ্বাসও রাখিতে হইবে যে তিনি যে মঙ্গল কামনা করেন উহার মধ্যেই আমারও মঙ্গল জড়িত রহিয়াছে। কাজেই আমার পৃথক কোন চিন্তারই প্রয়োজন নাই। দ্বিতীয়তঃ সমাজপতিকে সাময়িকভাবে না বানাইয়া স্থায়ীভাবে বানাইতে হইবে। এরূপ না হইলে তাহার সুচিন্তিত কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বেই তাহার নেতৃত্বের আয়ুষ্কাল শেষ হইয়া যাইতে পারে। কাজেই স্থায়ীভাবে একজন সমাজপতি নিযুক্ত না হইলে সেই সমাজের কোন অর্থ হইতে পারে না। আবার তেমনভাবে একজন সমাজপতি মানাটাও খুব সহজ নয়। কারণ, এখানে চিন্তাশীল বুদ্ধিমান মানুষের মনে একটা প্রশ্ন জাগিতে পারে এবং এইরূপ প্রশ্ন জাগা যুক্তিসঙ্গতও বটে। যেমন, তেমন সমাজপতি হইবার উপযুক্ত কে যাহার হাতে আমার সমস্ত স্বাধীন ক্ষমতা সমর্পণ করিব? তিনি যদি আমাকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাইতে না পারেন, তাহা হইলে আমার অবস্থাটা কেমন হইবে? যেহেতু আত্মসমর্পণ করিবার পূর্বে যাচাই করিবার ক্ষমতা আছে, কিন্তু পরে কথা বলিবার অধিকার থাকিবে না। যেমন, একজন যাত্রীর গন্তব্যস্থল চট্টগ্রাম। আর প্লাটফর্মে যে গাড়ি লাগান আছে, তার গন্তব্যস্থল সিলেট। এই স্থলে বিনা যাচাইতে গাড়িতে উঠিলে যখন গাড়ি চলিতে থাকিবে তখন হাজার আফসোস করিলেও কোন কাজে আসিবে না। কারণ, গাড়িরও একটা গন্তব্যস্থল আছে। সুতরাং যদি গাড়ি ও যাত্রীর গন্তব্যস্থল এক হয়, তাহা হইলেই যাত্রাকালে যাত্রীর মনে আনন্দ থাকে। আর যদি গাড়ি ও যাত্রীর গন্তব্যস্থল বিপরীতমুখী হয়, তাহা হইলে যাত্রীর মনে যে দারুণ ব্যাথা লাগে তাহা কে না বুঝে? এখানে আরও একটা প্রশ্ন জাগিতে পারে; যথা, উক্ত সমাজপতির পদ কে অলঙ্কৃত করিবেন, কেহ কি আপন যোগ্যতা বলে উক্ত পদের দাবীদার হইবেন, আর সকলে তাহাকে মানিয়া লইবে? না কি সর্ব সাধারণ কোন এক ব্যক্তিকে উক্ত আসনে বসাইবে? এই দুইটা পন্থাই সমস্যাপূর্ণ। কারণ, সকল মানুষকে উপেক্ষা করিয়া কেহ নিজের যোগ্যতার দাবী করিলে তাহাকে গর্বিত ও অহঙ্কারী বলিয়া ধরা হইবে, যাহা মানুষের জন্য দূষণীয়। আর যদি দ্বিতীয় পন্থাটি অনুসরণ করা হয়, তাহাও ঠিক হইবে না, কারণ, সৃষ্টিগতভাবে বেশীর ভাগ মানুষই অজ্ঞ হয়। অতএব যদি বিশিষ্ট কিছু লোক দ্বারা নির্বাচিত হন, তাহা হইলে সাধারণ মানুষ নারাজ হইবে। আর যদি গণভোটে নির্বাচন হয়, তাহা হইলে অন্য যে কোন লোক প্রতিযোগিতা করিতে পারিবে। এইরূপ স্থলে ভোটাধিক্যের উপর যোগ্যতা নির্ভর করে; অথচ অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞ এবং অজ্ঞ লোকের ভোটই বেশী হইবে। শুধু ভোটাধিক্যের উপর নির্ভর করিলে তার ফলটা কেমন হয়, এ সম্বন্ধে আমার নিজের জীবনের একটা ঘটনা বর্ণনা করিতেছি। এক সময় প্রতিবেশী দুই ভাইসহ তিনজন পদ্মা নদীতে ইলিশ মাছ ধরিতে গেলাম। কিন্তু মাছ পাই নাই বলিয়া সন্ধ্যা রাত্রে বাড়ির দিকে যাত্রা করিলাম। বিলের পথ। মধ্য বিলে আসিয়া মাঝি ভাইয়া নৌকার মুখ ঘুরাইয়া দিল। তখন আমি বলিলাম, দেখুন ভাই, নৌকা ঘুরিয়া গিয়াছে। কিন্তু তিনি আমার কথা বিশ্বাস করিলেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন নৌকার ‘আগার’ মাল্লাকে। ‘আগার’ মাল্লা ভাইও বলিলেন, নৌকা ঠিকই আছে। বাঃ! আমি একা, আর তাহারা দুইজন। সুতরাং ভোটাধিক্য তাহাদেরই। কিন্তু আমি যুক্তি দেখাইয়া বলিতেছিলাম, আমরা যাইতেছিলাম পূর্ব দিকে। আর ঐ স্থানের পানি ছিল দক্ষিণবাহী। সুতরাং স্রোত যাইবে আমাদের বামদিক হইতে ডান দিকে। কিন্তু পানিতে হাত দিয়া দেখিলাম, স্রোত যাইতেছে ডান দিক হইতে বাম দিকে। অতএব পরিষ্কার বুঝা গেল নৌকা পশ্চিম দিকে চলিতেছে। কিন্তু এই যুক্তি তাহাদের মনঃপুত হইল না। তাহারা এই যুক্তি মানিল না। তাহারা সেভাবেই নৌকা বাহিয়া লোকালয়ে পৌঁছিয়া জিজ্ঞাসা করিলে লোকেরা জানাইল, এটা বিলের পশ্চিম পাড়। আবার নৌকা ঘুরাইয়া চলিলাম। কিন্তু মধ্য বিলে আসিয়া মাঝি ভাইয়া আবারও পূর্ববৎ নৌকার মুখ ঘুরাইয়া দিলেন। তখনও আমি বলিলাম, ভাই, নৌকা কিন্তু আবারও ঘুরিয়া গিয়াছে। তাহারা দুইজনেই বলিল, না, নৌকা ঘুরে নাই। তাহাদের মতেই তাহারা বাহিয়া চলিল। শেষে আমরা আবার সেই একই লোকালয়ে পৌঁছিলাম এবং জিজ্ঞাসা করাতে তাহারা বলিল, তোমাদের ‘কানাওলায় ’ ধরিয়াছে। যাহা হউক, আবার নৌকা ঘুরাইয়া পূর্ব দিকে চলিলাম। কিন্তু সেইস্থানে আসিয়া মাঝি ভাইয়া আবারও নৌকা ঘুরাইয়া দিলেন। ভোটে এইবারও আমি একা। তাই দুইজনের মত পাল্টাইয়া আমার মতে নৌকা চালাইতে পারিলাম না। অবশেষে সেই রাত্র আমরা বিলের মধ্যেই রাত্রি যাপন করিয়া পরের দিন সূর্য উঠার পর বাড়ির দিকে রওয়ানা করিলাম। যাহা হউক, উল্লিখিত দুইটি পথের একটিও সমাজপতি নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট নহে।
অতএব জানা দরকার যে, মানুষ কোন্ পথে চলিয়া সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করিতে পারে এবং আপন লক্ষ্যে পৌঁছিতে পারে। যেমনিভাবে চলতি পথে মানুষকে ‘কানাওলায়’ ধরিয়া পথভ্রষ্ট করিয়া থাকে, ঠিক তেমনিভাবেই জ্ঞানীদের জ্ঞানের পথেও ‘কানাওলা’ মানুষকে পথভ্রষ্ট করিয়া থাকে। তাই চিন্তাশীল ব্যক্তি মনে করে, “আমি সঠিক পথই পাইয়াছি। এই পথেই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিতে পারিব”। কিন্তু বাস্তবে সে বিপরীত দিকে চলিয়াছে। অথচ এই ভুলটাও সে নিজে নিজে ধরিতে বা বুঝিতে পারে না।
যাহা হউক, মানুষমাত্র প্রত্যেকেরই লক্ষ্যস্থল এক। তাহা হইলÑ জীবনের শান্তি লাভ ও অশান্তি হইতে পরিত্রাণ। কিন্তু মানুষ চিন্তা করে না যে, এই শান্তি দিবে কে? মানুষ শান্তি চায়, কিন্তু শান্তিকর্তাকেই চায় না। জ্ঞানীগণ শান্তির পথ নির্ণয় করিয়া দেখায়। কিন্তু শান্তিকর্তার সান্নিধ্যে পৌঁছার কোন পথ নির্ণয় করিয়া দেখায় না। ইহাকে জ্ঞানের পথে ‘কানাওলা’ ধরা বলে।
মানুষের জীবনের শান্তি একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই দিতে পারেন। আর কেহ পারে না। কারণ, মানুষ স্বয়ং সক্ষম নয়, সে স্বয়ং অক্ষম। সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক মানুষকে একটি ‘মন’ দিয়াছেন এবং জগতে যত জিনিস আছে তাহার কোনটা মনের আকাঙ্খিত, আবার কোনটা মনের অনাকাঙ্খিত। যেমন, স্বাস্থ্য, স্বচ্ছলতা, সুগন্ধ প্রভৃতি প্রত্যেকটি মানুষের আকাঙ্খিত। আবার রোগ, অভাব, দুর্গন্ধ প্রভৃতিও প্রত্যেকটি মানুষের অনাকাঙ্খিত। উহাদের একটি মঙ্গল ও অপরটি অমঙ্গল। একটু চিন্তা করিয়া দেখিলে দেখা যাইবে যে, জগতের কোন মানুষই নিজ ক্ষমতাবলে কোন মঙ্গল অর্জন করিতে পারে না বা কোন অমঙ্গল হইতে নিজ ক্ষমতাবলে বাঁচিতেও পারে না। কাজেই সৃষ্টিকর্তা যদি দয়া করিয়া কোন ব্যক্তিকে নেতা নিযুক্ত করিয়া দেন, তাহা হইলেই আমাদের সকল সমস্যা দূর হইতে পারে। যেহেতু প্রভুকে সকলেই ভালবাসে। যে প্রভু আমাদিগকে অনস্তিত্ব হইতে অস্তিত্ববান করিয়াছেন, আবার যিনি অস্তিত্ব মিটাইয়া দিবেন, তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি অল্পকে অনেক করিতে পারেন, আবার অনেককে অল্পও করিতে পারেন। এই বিশ্বাস সকলেরই আছে। সুতরাং তাঁহার উপর আত্মসমর্পণ করিতে কাহারও আপত্তি থাকিতে পারে না এবং প্রভুর খাতিরে তাঁহার প্রতিনিধিকেও মান্য করিতে হয়। কেননা প্রতিনিধিকে মানা আর প্রভুকে মানা একই কথা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এই যুগের অধঃপতন হইতে বাঁচাইবার জন্য নিশ্চয় প্রভু তাঁহার কোন প্রতিনিধি নিযুক্ত করিয়াছেন। আমি বিশেষভাবে বাংলাদেশের জনগণ ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ করিতেছি, আপনারা আমার লিখিত “দুই বন্ধুর আলোচনা” নামক প্রবন্ধ এবং বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে লিখিত আমার চিঠির পরামর্শ অনুযায়ী একটি মহাসম্মেলন অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা অনুধাবন করিতে চেষ্টা করুন এবং এই কাজে সর্বোতভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করিতে আগাইয়া আসুন। মহান প্রভু আমাদের সকলের সহায় হউন। আমিন!

********