পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করছি

অশান্তির জগতে শান্তির বার্তা

বর্তমান যুগ অশান্তির যুগ। সকল দেশবাসীই ভীষণ অশান্তিতে কাল যাপন করিতেছে। এই অশান্তি হইতে পরিত্রাণের উপায় কি?
আমার সকল ভাইদের জানা দরকার যে মানুষের কাম্য বস্তু দুইটি। প্রথমত-ইহকালের শান্তি, দ্বিতীয়ত-পরকালের মুক্তি। যখন এই দুইটি বস্তু হইতে মানুষ বঞ্চিত হয় তখনই পৃথিবীতে নামিয়া আসে অন্ধকার যুগ। এখন জানা দরকার যে, মানুষ কেন এই দুইটি বস্তু হইতে বঞ্চিত হয়। কোন রাষ্ট্রের সরকার যখন তার সমূহ শক্তি দ্বারা নাগরিকদের শান্তির ব্যবস্থা করে এবং নাগরিকগণও যখন ঐক্যবদ্ধভাবে রাষ্ট্রীয় আদেশ-নিষেধ পালন করিয়া সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করিতে থাকে, তখন সেই রাষ্ট্রের সকল মানুষই শান্তিতে জীবন কাটাইতে পারে। কিন্তু দেশে যখন কোন বিপ্লবীদল গজাইয়া উঠে এবং বেশ শক্তিশালী হইয়া সরকারকে উৎখাত করিতে চেষ্টা করে, তখন সরকারের সামনে দুইটি সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত-বিপ্লবীদল দমন করা, দ্বিতীয়ত-নাগরিকবৃন্দের শান্তির ব্যবস্থা করা। প্রথম সমস্যার মোকাবিলা করিতেই সরকারের শক্তি ও সামর্থ বেশী ব্যয় হইয়া থাকে। এই কারণেই দ্বিতীয় সমস্যাটির মোকাবিলা করিতে সরকারের শৈথিল্য দেখা যায়।
আমরা ইহাও জানি যে, সরকার-বিরোধী দলের লোকগণ কোন চোর-ডাকাত বা লুণ্ঠনকারী নহে, বরং সরকারের কোন কার্যকলাপ তাহাদের পছন্দ না হইলে তাহারা উহার বিরোধীতা করে। উদ্দেশ্য উক্ত সরকারের পরিবর্তে এক নূতন সরকার গঠন করা। সমস্যার এ সন্ধিক্ষণে বিশৃঙ্খলার সুযোগে রাষ্ট্রের এক শ্রেণীর দুষ্টলোক চুরি-ডাকাতি ও খুন-খারাবীর আশ্রয় নেয়। তাই এই সময়টা জনসাধারণের জন্য ভীষণ অশান্তিময়। এভাবেই দেশবাসী ইহকালের শান্তি হইতে বঞ্চিত হয়।

পরকালের মুক্তি হইতে বঞ্চিত হওয়ার কারণ
আমাদের জানা দরকার যে, ধর্মগুরুগণ যতদিন বিশ্বস্তভাবে ঐকমত্য পোষণ করিয়া ধর্ম পালন করেন এবং ধর্মোপদেশ দান করেন ততদিন সর্বসাধারণও তাহাদের অনুসৃত পথকে নিশ্চিত পরকালের মুক্তির পথ প্রত্যয় করিয়া থাকে এবং ধর্ম পালন করিয়াও প্রাণে শান্তি পায়। কিন্তু যখন ধর্মগুরুগণের মধ্যেই মতানৈক্য সৃষ্টি হয় এবং তাহারা সরল পথ ত্যাগ করিয়া কুটিলতা অবলম্বন করে, তখন তাহাদের উপদেশ বা তাহাদের অনুসৃত পথে যে পরকালের মুক্তি হইতে পারে এ বিষয়ে জনসাধারণের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ফলে ধর্ম পালন করিয়া প্রাণে নির্মল শান্তি পাওয়া যায় না। এই ভাবেই মানুষ পরকালের মুক্তি হইতে বঞ্চিত হয়।
যাহা হোক, আমার বক্তব্যের সারমর্ম হইল-এই পৃথিবীর যে কোন রাষ্ট্রে যখন রাজনৈতিক মতানৈক্য চরমে পৌঁছে তখন জনসাধারণের জীবনের শান্তি অন্তর্হিত হয় এবং তাহারা ভীষণ অশান্তিতে কাল কাটাইতে থাকে। আর যখন ধর্মনৈতিক মতানৈক্যও জোরদার হইয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা-প্রশাখায় পর্যবসিত হয়, তখন সর্বসাধারণ পরকালের মুক্তি তথা স্রষ্টার অনুগ্রহ হইতেই বঞ্চিত হয়। এমনি যুগই পৃথিবীর সবচাইতে অধঃপতনের যুগ। তখন পৃথিবীর কোথাও এমন কোন রাষ্ট্র থাকে না যেখানে সর্বসাধারণ রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক এই উভয় দিক দিয়াই ঐকমত্য পোষণ করিয়া চলে।
এমনি অশান্তির যুগে জগতে পুনঃ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, যিনি এই জগত ও জগদ্বাসীকে সৃষ্টি করিয়াছেন তিনি তাঁহার হস্ত প্রসার করা প্রয়োজন মনে করেন। ইহাকেই বলা হয় “আসমানী মীমাংসা”। যেহেতু স্রষ্টার মীমাংসা কাহারো জন্য অনুকূল আবার কাহারো জন্য প্রতিকূল হইতে পারে না। ইহা সকলের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। ধরুন, আমাদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা ধর্মনৈতিক সমস্যার মীমাংসার জন্য যদি বিদেশী কোন রাষ্ট্রের আদর্শ গ্রহণ করিতে চাওয়া হয়, তবে বর্তমান পৃথিবীর কোথাও এমন কোন নির্মল আদর্শবান রাষ্ট্র পাওয়া যাইবে না যার আদর্শ আমরা গ্রহণ করিতে পারি। আর যদি বাংলাদেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ মিলিত হইয়া এই দেশকে একটি আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত করিতে ইচ্ছা করেন, তবে ইহাও সম্ভবপর হইতেছে না। কারণ, সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ একত্র বসিয়া আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যাহার মত সর্বোত্তম বিবেচিত হইবে তাহার আনুগত্য স্বীকার করতঃ সকলে মিলিয়া মিশিয়া দেশের কাজ করিতেও রাজী হইতে পারিতেছেন না। পক্ষান্তরে, এদেশে যতগুলি ধর্মমত প্রচলিত আছে তার প্রত্যেকটি দলের নেতৃবৃন্দও একত্র বসিয়া যাহার ধর্মমত সর্বোত্তম বিবেচিত হইবে তাহার মতে মত মিলাইয়া ধর্ম পালন ও উপদেশ বিতরণ করিতে পারিতেছেন না। মীমাংসার জন্য এখন সকলেই সংঘর্ষে নামিয়াছেন, সংঘর্ষে যিনি জয়ী হইবেন, তিনিই উপযুক্ত বলিয়া প্রমাণিত হইবেন। কিন্ত এহেন সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে কাহারা? সেই বিশাল জনতা, দেশের সর্বসাধারণ। আর জয়ী হইয়া মজা লুটেন মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক লোক।
অতীতের বিপ্লব ও বিপ্লবী সংঘর্ষ হইতে কিছু মানুষের মনোবল বৃদ্ধি পাইয়াছে। তাহাদের নিকট কাহাকে মারা বা মৃত্যু বরণ করা খেলা সমতুল্য। কিন্তু বিগত বিপ্লব ও উহার ফলাফল বহু সরল প্রাণ চিন্তাশীল মানুষের প্রাণে বিশেষ ভাবনার সঞ্চার করিয়াছে। তাহারা যে কোন ধর্মমতই পোষণ করিয়া থাকুন না কেন আপন আপন মতে সেই একই সৃজনকর্তার সমীপে কাঁদিয়াছেন এবং এখনো কাঁদিতেছেন। যিনি বিপদের বন্ধু, যিনি সৃষ্টির ত্রাণকর্তা, যিনি সর্বোত্তম মীমাংসাকারক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তাঁহার বহু দাস-দাসীর হৃদয়ের এহেন আবেগপূর্ণ প্রার্থনা তিনি শুনিয়াছেন এবং এযুগের সমস্যাবলীর মীমাংসা কিরূপে হইতে পারে উহার একটি ব্যবস্থা এই অধমের হৃদয়ে জাগাইয়া দিয়াছেন।
অতঃপর বিশ্ববাসী সকল ভাইয়ের নিকট আমার বক্তব্য-আপনারা আমার ভাই। আপনাদের সুখে আমার সুখ এবং আপনাদের দুঃখে আমার দুঃখ। এই পৃথিবীতে যত ধর্মাবলম্বী আছে, তাহারা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে যে, আমাদের জীবনের শান্তি ও পরজগতের মুক্তি দাতা একজনই, একাধিক নয়। তিনিই উর্ধ্বজগত ও অধঃজগত সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনিই এই উভয় জগতের মালিক। তিনিই সমগ্র মানব জাতির একচ্ছত্র অধিপতি। অতএব আমার অনুরোধ -আপনারা তাঁহারই সাহায্যে আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতঃ এই পৃথিবীকে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ বাসস্থানে পরিণত করুন।

উহা কি প্রকারে হইতে পারে তাহার পদ্ধতি
বিশ্বের সকল দেশের সরকার ও জনসাধারণের প্রতিনিধিবর্গের সম্মিলিত এক বিশ্ব সম্মেলনের আয়োজন করা। উক্ত সভায় রাজনৈতিক সকল দলের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। সকল দেশের সমস্ত ধর্মমতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণকেও উক্ত সভায় উপস্থিত থাকিতে হইবে। এছাড়া প্রত্যেক মতবাদীগণের মধ্য হইতেও চিন্তাশীল, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী প্রভৃতি সকলকেই সে সভায় উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা। অতঃপর আসমানী মীমাংসা সম্বন্ধে নিম্নরূপ স্বীকারোক্তি করা, যথাঃ -“আমরা সকলেই স্বীকার করিতেছি যে, আমাদের সৃষ্টিকর্তা একজন। তিনি আমাদিগকে অনস্তিত্ব হইতে অস্তিত্ববান করিয়াছেন, তিনিই আমাদিগকে জীবিত রাখিতেছেন এবং তাঁহারই আদেশে আমাদের প্রাণ ত্যাগ করিতে হয়। অতএব তাঁহারই আদেশ-নিষেধ পালন করা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। কাজেই তাঁহার পক্ষ হইতে যে ব্যক্তি আমাদের কাছে নির্বাচিত বা আদেশ প্রাপ্ত হইয়া আসিবেন তাঁহার মীমাংসা আমরা বিনা দ্বিধায় মান্য করিয়া চলিব এবং তাঁহার সহযোগিতা করিয়া ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করিব এবং এ পৃথিবীকে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ বাসস্থানরূপে গড়িয়া তুলিব”। এই অঙ্গীকার লিখিতভাবে রাখিতে হইবে যে, উক্ত নির্বাচিত ব্যক্তি তিনি যে কোন ধর্মাবলম্বীই হউন না কেন তাঁহাকে আমি গ্রহণ করিতে বাধ্য থাকিব। যেহেতু স্রষ্টা যখন একজন, তিনি একজনকেই নিযুক্ত করিবেন। আমরা শত শত মতবাদী আছি বলিয়া নির্বাচিত ব্যক্তি কখনো একাধিক হইতে পারেন না। অতঃপর একটা সময়সীমা নির্ধারিত করিয়া দিয়া সরকারীভাবে ঘোষনা করিয়া জানাইয়া দিতে হইবে যে, এমনি দাবিদার ব্যক্তি তিনি যেখানেই থাকুন না কেন তাহাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাহার দাবি পেশ করিতে অনুরোধ করা। উক্ত মেয়াদ পর্যন্ত কাগজ, বেতার ও টেলিভিশন প্রভৃতি সকল প্রচার যন্ত্রের মাধ্যমে উক্ত ঘোষণা প্রচার করিতে থাকা। যদি এই নির্দিষ্ট সময়ের পর কেহ দাবি করেন তবে তাহা আগ্রাহ্য হইবে।
উক্ত দাবিদারের দাবি থাকিবে যে, “আমি এই যুগের সমস্যাবলী সমাধানের জন্য সৃষ্টিকর্তা হইতে প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হইয়াছি”। কিন্তু উক্ত দাবিদারের জন্য নিম্নলিখিত শর্তগুলি থাকিবে। যথা – (১) তাহার বয়স চল্লিশ (৪০) বছরের কম হইবে না। (২) স্রষ্টা সম্বন্ধে পরিচয় দিতে হইবে। (৩) প্রত্যাদেশ অন্ততঃ বার (১২) বৎসর পূর্ব হইতে পাইয়া থাকিবেন এবং এই সময়ের মধ্যে প্রত্যাদেশ বিষয়ে কি কি কালচার করিয়া আসিয়াছেন, তাহাও দেখাইতে হইবে। (৪) প্রত্যাদেশ প্রাপ্তির পূর্ব হইতে তাহার উপর কি কি অবস্থা ঘটিয়াছে তাহার কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে হইবে। (৫) প্রত্যাদেশ প্রাপ্তিকালে তাহার সম্মুখে অপর কোন লোক উপস্থিত ছিল কি না, থাকিলে তাহারা এ বিষয়ে কতটুকু সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে পারে তাহার বর্ণনা দেওয়া। (৬) উক্ত দাবিদারের পরিচিত দেশবাসীগণকে তাঁহার প্রতি তিনটি গুণের বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে হইবে। এই গুণ তিনটি হইল – (ক) তাহার সত্যবাদিতা সম্বন্ধে, (খ) চরিত্রবান হওয়া সম্বন্ধে এবং (গ) তাহার জ্ঞানবান হওয়া সম্বন্ধে।
সুতরাং উক্ত ব্যক্তিকে মান্য করা প্রকারান্তরে সৃষ্টিকর্তাকেই মান্য করা হইবে। আর তাহাকে অস্বীকার করা প্রকারান্তরে সৃষ্টিকর্তাকেই অস্বীকার করা হইবে।
এখন একথা জানানোর পর কেহ যদি মনে করেন যে, উহা কি সম্ভবপর? তাহার উত্তর এই যে, যাহা সর্বসাধারনের জন্য মঙ্গলজনক তাহার জন্য সর্বসাধারণকেই চেষ্টা করিতে হইবে। সকলেই যদি এই দাবি তুলে যে, আমরা “সৃষ্টিকর্তার মীমাংসা চাই”, তবে তাহা কেন সম্ভব হইবে না? ইহাত কোন সরকার বিরোধী প্রচারণা নয় যে তাহারা নারাজ হইবে। বরং ইহা সকলের জন্যই মঙ্গলজনক হইবে। আমি স্পষ্টভাবে বলিয়া দিতেছি যে, ইহা এমনি একটি মীমাংসা হইবে, যাহা এই যুগের কোন ধর্মগুরুও করিতে পারিবেন না বা কোন রাজনৈতিক নেতাও ইহার চাইতে উত্তম মীমাংসা করিতে পারিবেন না। যেহেতু সকল রাজার রাজা যিনি, যিনি আসমান-জমিনের মালিক ইহা তাঁহারই মীমাংসা এবং এই মীমাংসায় থাকিবে তাঁহারই সাহায্য এবং দয়া। এখন যদি কোন ভাই প্রশ্ন করেন যে, এমন সভার আয়োজন করার পর উক্ত শর্তসহ কোন লোক যদি দাবিদার না হন, তবে এরূপ সভা করার সকল আয়োজন বৃথা যাইবে। এই প্রশ্নের উত্তরে এই অধম অঙ্গীকার করিতেছি যে, আপনারা সে সভার আয়োজন করুন এবং সভার পূর্ব হইতে শেষ পর্যন্ত আমাকে আপনাদের নিকট জামানত রাখিতেছি। যদি উক্ত মানুষ সভাস্থলে উপস্থিত না হন তাহা হইলে সর্বসম্মুখে আমাকে হত্যা করিতে পারিবেন। তাহাতে আমার পক্ষ হইতে কাহারো কোন প্রকার কৈফিয়ত চলিবে না। পক্ষান্তরে, ইহাও জানাইয়া দেওয়া হইতেছে যে, যদি ইহা কার্যকরী করিতে কেহ অবহেলা করেন এবং এই ঘোষণাকে অবিশ্বাস করেন, তবে ইহার জন্য যাহা করা দরকার তাহা তিনিই করিবেন, যিনি আমাদের সকলের মালিক। আমিত তাঁহার পক্ষ হইতে সংবাদ পৌঁছাইবার জন্য একজন দাস মাত্র। ইতি –

৯ পৌষ, ১৩৭৯ বাংলা সন,
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭২ খ্রিঃ।

********