পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করিতেছি

ধর্মের বিচার

১। প্রশ্ন – সত্য ধর্ম কি?
উত্তর – সত্য ধর্ম স্রষ্টার আদেশ ও নিষেধ। যেমন ধরুন, একটা ইঞ্জিন। ইহা চলার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলী থাকে। নিয়মের ব্যতিক্রম হইলে ইহা সঠিকভাবে চলিবে না। আর ইঞ্জিন চলার নিয়মাবলী ইহার নির্মাতাই দিয়া থাকেন। তদ্রƒপ যিনি এই মানবজীবন দান করিয়াছেন, সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য মানুষের জীবন বিধানও তিনিই দিয়াছেন। এই জীবন-বিধানই মানবের জন্য অবশ্য পালনীয় সত্য ধর্ম।
সুতরাং জগতে যাহারা ধর্ম পালন করে, অথচ মানব-রচিত নিয়মাবলীকে ধর্ম রূপে বিশ্বাস করে তাহারা ভ্রান্ত। কেননা, মানব জীবনকে ইঞ্জিনের সঙ্গে তুলনা করা হইলেও উহা একটা জড় যন্ত্রই নহে। যেহেতু মানব সৃষ্টি করিবার পর তাহাকে জ্ঞান দান করা হইয়াছে এবং স্বাধীন কিছু ক্ষমতাও দেওয়া হইয়াছে। আবার খাওয়া পরা ও বাসস্থানের প্রয়োজন দ্বারা তাহাকে অধীন করিয়াও রাখা হইয়াছে। অধিকন্তু, প্রত্যেকটি মানুষকেই মৃত্যুর পর জীবিত করিয়া প্রশ্ন করা হইবে ঃ-
(ক) কে তোমাকে জগতে সৃষ্টি করিয়াছিল?
(খ) তোমার খাওয়া পরা ও বাসস্থান কে দান করিয়াছিল?
(গ) জগতে কাহার নির্দেশ মান্য করিয়া চলিয়াছিলে?
অতএব কারণেই মানুষ মাত্র সকলকেই সৃষ্টিকর্তার আদেশ নিষেধ তথা সত্য ধর্ম পালন করিতেই হইবে। ইহার মধ্যেই ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি নির্ধারিত।
২। প্রশ্ন – সত্য ধর্ম কোন প্রণালীতে আবির্ভূত হয়?
উত্তর – যে কোন একজন মানুষের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা তাঁহার বাণী মানব জগতে পোঁছাইয়া থাকেন। সৃষ্টিকর্তারই বাণী, উক্ত মাধ্যম ব্যক্তি উহার বাহন মাত্র। যেমনি, কখনও কোন মানুষের উপর জ্বিন আবির্ভূত হয়। তখন উক্ত জ্বিনগ্রস্ত ব্যক্তির মুখে যদিও বাক্য নিসৃত হয়, কিন্তু উহা জ্বিনেরই বাক্য- উক্ত ব্যক্তি জ্বিনের বাক্য বহনকারী মাত্র।
৩। প্রশ্ন – সত্য ধর্ম পৃথিবীতে কতদিন গ্রহণযোগ্য থাকে এবং কতদিন উহা নিষ্কলঙ্ক অবস্থায় বিদ্যমান থাকে?
উত্তর – সৃষ্টিকর্তার সত্য ধর্ম যে যুগে যে মাধ্যম ব্যক্তির দ্বারা জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাঁহার জীবিত কাল পর্যন্ত উহা পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক থাকে। যেহেতু ধর্ম তখন এক মতবাদের উপর কায়েম থাকে। উক্ত মাধ্যম ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাঁহার অনুসরণকারীগণ যতদিন পর্যন্ত আপোষে একজনের আনুগত্য স্বীকার করিয়া একই নিয়ন্ত্রণাধীনে চলিতে থাকে ততদিন পর্যন্তও সত্য ধর্ম গ্রহণযোগ্য ও নিষ্কলঙ্কই থাকে। কিন্তু যখন আপোষে মতানৈক্য ঘটে ও একাধিক মতবাদের সৃষ্টি হয় তখন হইতেই সত্য ধর্মে কলঙ্কের কালি লাগিতে থাকে। কারণ তখন ধর্মের কোন শাখা-প্রশাখাই সম্পূর্ণ নির্দোষ থাকে না, আবার কোন শাখা-প্রশাখাই সম্পূর্ণ দোষীও থাকে না। কাজেই তখন কোন শাখা পূর্ণ গ্রহণযোগ্য বা বর্জনযোগ্য তাহা বিবেচনা করা অত্যন্ত কঠিন হইয়া পড়ে। তখন ধর্মের অবস্থা চাউল-ডাউলে মিশ্রিত খিচুড়ি সাদৃশ্য হয়; ডাউলও বলা যায় না, যেহেতু চাউল আছে, আবার চাউলও বলা যায় না যেহেতু ডাউল আছে। কাজেই দীর্ঘকাল পরে উক্ত ধর্মের অনুসারীদের বংশধরগণের মধ্যে উহা গোত্রীয় ধর্ম বা পৈত্রিক ধর্ম রূপে প্রতিপালিত হইতে থাকে। তখন উহাকে আর সত্য ধর্ম বলা চলে না। এই একই কারণে পৃথিবীতে বহুবার বহু মাধ্যম দ্বারা সেই একই সৃষ্টিকর্তা তাঁহার একই সত্য ধর্ম জগতে আবির্ভূত করিয়াছেন এবং ধর্মের একই ধারা, অর্থাৎ নবাগত সত্য ধর্ম পূর্ববর্তী ধর্ম সমূহকে বাতিল করিয়া দেয়।
উল্লেখ্য, যে যুগে সত্য ধর্ম জগতে আবির্ভূত হয়, সেই যুগের চিহ্ন এই যে, তখন পৃথিবীতে কোথায়ও শান্তি থাকে না। তাহার কারণ হইল, সুনিয়ন্ত্রণাধীনে থাকার মধ্যেই মানব জাতির শান্তি, কিন্তু সেই সময় সুনিয়ন্ত্রকেরই অভাব থাকে। এক শ্রেণীর ধর্মগুরু জনসাধারণের নেতা হইতে চাহেন, কিন্তু তাহারা নিজেরা কাহারো আনুগত্য স্বীকার করেন না। তাহারা শুধু মুখের জোরে বলেন, “আমরা ধর্মশাস্ত্র অনুসরণ করি।” কিন্তু শাস্ত্র লইয়াই যে আপোষে ঝগড়া তাহার মীমাংসা করিতেই তাহারা অক্ষম। অপর পক্ষে চিন্তাশীল বৈজ্ঞানিক, দার্শনিকগণ স্বরচিত আইন-কানুন দ্বারা জন সাধারণকে নিয়ন্ত্রিত করিয়া জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করিতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তাহারা স্রষ্টার সত্য ধর্মের আনুগত্য স্বীকার করেন না। অথচ স্রষ্টার অদৃশ্য হস্তেই যে মানব জাতির শান্তি। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি শান্তি কায়েম না করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত জগতবাসীর পক্ষে শান্তি পাওয়ার অন্য উপায় নাই। তাই এমনি যুগেই সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে আসমানী মীমাংসার ব্যবস্থা করিয়া থাকেন।
উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা যাহা সাব্যস্ত হইল তাহা এই যে, উল্লিখিত যুগে সর্ব প্রথম একজন মীমাংসাকারকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করত: নিজেদের সমস্ত সমস্যাবলীর সমাধানের ভার তাঁহার উপর ছাড়িয়া দেওয়া এবং তাঁহার দেওয়া সমাধান বা মীমাংসাকে বিনা তর্কে পালন করার জন্য অঙ্গীকার করা। আমার বিশ্বাস, আসমানী মীমাংসার মূল ভাব এখন অনেকেই বুঝিতে পারিয়াছেন। সুতরাং
১। যে ধর্মে স্রষ্টাকে বিশ্বাস করে উহাই সত্য ধর্ম। সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস না করিয়া যত সুনীতিই পালন করা হউক না কেন তাহা বাতেল।
২। যে ধর্মে স্রষ্টাকে মান্য করে বটে কিন্তু মাধ্যম মান্য করে না, সেই ধর্মও বাতেল, যেহেতু মাধ্যম ব্যতীত কখনই স্রষ্টা আপনাকে জগদ্বাসীর কাছে প্রকাশ করেন না।
৩। যে ধর্মে মাধ্যম মান্য করে বটে কিন্তু মাধ্যম ও মালিকের মধ্যে প্রভেদ না বুঝিয়া উক্ত মাধ্যমকেই উপাস্য মান্য করে সে ধর্মও বাতেল। যেহেতু, তাহারা ভাবে যে, স্রষ্টা যখন অবতীর্ণ হইয়া তাঁহার মাধ্যমকে ব্যবহার করিয়াছেন, তখন উক্ত মাধ্যম ব্যক্তি ও স্রষ্টাতে প্রভেদ নাই; সুতরাং এই মতে যাহারা অবতারে বিশ্বাসী তাহাদের ধর্মও বাতেল।
৪। যাহারা একক ও অদ্বিতীয় স্রষ্টাতে বিশ্বাসী এবং মাধ্যমকেও বিশ্বাস করে ঠিক এই হিসাবে যেমন জ্বিনগ্রস্ত ব্যক্তি প্রকৃত জ্বিন হইয়া যায় না কিন্তুজ্বিনেরই প্রকাশক হইয়া থাকে; তদ্রƒপ উক্ত মাধ্যম প্রকৃত উপাস্য বা মালিক হইয়া যায় না, কিন্তু উপাস্য বা মালিকের প্রকাশক বা বিকাশস্থল হইয়া থাকেন। এই ধর্মই সত্য ধর্ম।
৫। যে ধর্ম জগতে সর্বশেষ আসে উহাই পালনীয় সত্য ধর্ম বাকী পূর্ববর্তী যাবতীয় ধর্ম যদিও এককালে সত্য ও পালনীয় ছিল, কিন্তু পরবর্তী কালে তাহা বাতেল হইতে বাধ্য। যেমন, সরকার একবার যে আদেশ জারী করেন, কোন বিশেষ প্রয়োজনে তাহা বাতেল, পরিবর্তন বা পরিবর্ধন ও করিতে পারেন বা তদ্স্থলে কোন নূতন আদেশও জারী করিতে পারেন। এরূপ করিবার অধিকার সরকারের অবশ্যই থাকে বা এরূপ অধিকার সরকার প্রয়োগও করিয়া থাকেন।

********