পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করিতেছি

আমার মত শান্তির পথ

আমি চাই নিজের শান্তি, চাই দশের শান্তি, চাই বিশ্ব মানবের শান্তি। আর যেহেতু প্রত্যেক মানুষেরই ন্যায়সঙ্গতভাবে শান্তির পথ খুঁজিয়া বাহির করার এবং সেই পথে চলার অধিকার আছে, যতক্ষণ না তাহাতে অপরের শান্তি ব্যাহত হয়। সেহেতু আমি অনুরোধ করিতেছি, কোন ভাই বিনা কারণে আমাকে আমার মত প্রকাশ করিতে বাধা দিবেন না। আমি সরলভাবে বিশ্বাস করি, সকল মানুষের প্রকৃত শান্তি ও উন্নতির মূল একতার মধ্যে, একতার মূল এক জাতীয়তাবোধের মধ্যে এবং এক জাতীয়াবোধের মূল এক নীতি অবলম্বন করার মধ্যে। সুতরাং আমার ও আপনার তথা সমগ্র বিশ্ব মানবের শান্তির জন্য উক্ত তিনটি বিষয়ই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এক নীতি অবলম্বনকারী না হওয়া পর্যন্ত এক জাতি গঠিত হইতে পারে না। আবার এক জাতি গঠিত না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত একতা প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না, আর প্রকৃত একতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কখনো প্রকৃত শান্তি কখনও কায়েম হইতে পারে না।
কোন ভাই হয়ত প্রশ্ন করিতে পারেন, সমগ্র মানব জাতির পক্ষে এক নীতি অবলম্বনকারী হওয়া কি সম্ভবপর? যেহেতু কতক মানুষ স্রষ্টায় বিশ্বাসী আবার কতক স্রষ্টায় অবিশ্বাসী। আবার যাহারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী তাহাদের মধ্যেও বিভিন্ন মত অবলম্বনকারী বহু শ্রেণী বিভেদ রহিয়াছে। অথচ আমরা চাই সকল শ্রেণীর মানুষকে লইয়া একতা গঠন করিতে।
প্রশ্নকারী ভাইকে নীতিগতভাবে বিচারজ্ঞান লইয়া আমার বক্তব্য বুঝিয়া লইবার জন্য অনুরোধ করিতেছি।
বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মত থাকিবেই। কিন্তু কে ভুল বুঝিতেছে আর কে সঠিক বুঝিতেছে তাহা বিচার করিয়া দেখিতে হইবে এবং যাহার বুঝ ঠিক হইবে তাহার সঙ্গে ঐক্য গড়িতে হইবে।
আমি বিশ্বাস করি, সমস্ত মানুষ একই জাতীয়। তাহার প্রমাণ এই যে, আমি একজন মানুষ। আমার জন্ম যে প্রণালীতে হইয়াছে, পৃথিবীর সকল মানুষের জন্মও সেই প্রণালীতেই হইয়াছে। শৈশব কালে আমার যেমন দাঁত, দাড়ি-গোঁফ, জ্ঞান-বুদ্ধি, চলার শক্তি, বলার শক্তি প্রভৃতি কিছুই ছিলনা; বিশ্বের সকল মানুষেরও ঐ একই অবস্থা। আমার পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে এবং প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের পৃথক পৃথক শক্তি রহিয়াছে, বিশ্বের সকল মানুষের বেলায়ও তাহাই। আমার একটি মন আছে। পৃথিবীতে যত কিছু আছে Ñ তাহার কোন কোনটা মনের আকাক্সিক্ষত আবার কোন কোনটা মনের অনাকাক্সিক্ষত। যেমন, রোগ ও স্বাস্থ্য, দুর্গন্ধ ও সুগন্ধ ইত্যাদি। অতএব আমার মন যাহা পছন্দ করে, জগতের সকল মানুষের মন তাহাই পছন্দ করে। যেমন, স্বাস্থ্য ও সুগন্ধ। ইহাতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে বিশ্বমানব মূলত একই জাতীয়। অতএব আমি মুক্ত কণ্ঠে বলিতে চাই যে, হে বিশ্বমানব! আপনারা আমারই জাতীয় ভাই। আসুন, আমাদের সম্প্রদায়গত মতানৈক্য ভুলিয়া গিয়া এক জাতি গঠন করতঃ একতাবদ্ধ হইয়া যাই।
এখন হয়ত প্রশ্ন জাগিবে, সমগ্র মানুষ কি করিয়া এক নীতি পালনকারী হইবে? যেহেতু নীতি বলিতে প্রধানতঃ ধর্মকে বুঝান হইয়া থাকে; আর ধর্ম ধার্মিক ব্যক্তির নিকট তাহার জীবনের চাইতেও প্রিয় ও পবিত্র। আর পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্ম প্রচলিত থাকা কালীন নির্মল ও পূর্ণ একতা বা এক জাতীয়তাবোধ কিছুতেই কায়েম হইতে পারে না।
ইহার উত্তরে আমি বলিতে চাই, বিশ্বের সকল মানুষই স্বীকার করিবেন, ধর্ম মানেই শান্তি। যে নীতি পালন করিলে মানব জীবনের প্রকৃত শান্তি লাভ হয় উহাই ধর্ম। কাজেই সকল ধর্মেরই মূল যখন এক, তখন এক নীতি পালন করিতে আপত্তিরই বা কি কারণ থাকিতে পারে?
আমি সরলভাবে বিশ্বাস করি যে, উপরে আসমান নীচে জমিন Ñ এই আসমান ও জমিনের অবশ্যই একজন স্রষ্টা আছেন। তিনি আমার ও আপনার তথা বিশ্বমানব সকলেরই মালিক। বিশ্বের রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেরই জীবনদাতা তিনি এবং জীবনের বিধান দাতাও তিনিই। আবার মৃত্যুর মাধ্যমে সকলের জীবন গ্রহণকারীও তিনিই। সুতরাং সেই বিশ্ব মালিককে কেন্দ্র করিয়া আমরা একতা গঠন করিতে পারি এবং ইহা খুবই সহজ ও সরল।
এখন হয়ত প্রশ্ন জাগিবে, সেই সৃষ্টিকর্তাকে কিভাবে কেন্দ্র করা যায়Ñ যেহেতু তিনি নিরাকার? ইহার উত্তরে আমি বলিতে চাই, যদিও সৃষ্টিকর্তা নিরাকার, তথাপি বিশ্বমানবকে উন্নতির পথে চালিত করিবার পূর্ণ ক্ষমতা তাঁহারই হাতে। তাহার প্রমাণ, আদিকাল হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত মানুষের যত পরিবর্তন ও উন্নতি হইয়াছে, ইহা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ দ্বারাই হইয়াছে। যাহাদিগকে আমরা আবিষ্কারক বলিয়া থাকি। তাহারাই হইতেছেন এই উন্নতি ও পরিবর্তনের মাধ্যম। কিন্তু একটু চিন্তা করিলেই বুঝা যাইবে যে এই আবিষ্কারকগণও তাহাদের নিজেদের অস্তিত্বের মালিক তাহারা নিজেরা নহেন। কাজেই তাহারা কিভাবে তাহাদের গুণের মালিক হইতে পারেন? অতএব ইহাই সত্য যে, সৃষ্টিকর্তা যখন মানব জাতির কোন মঙ্গল করিতে ইচ্ছা করেন, তখন তিনি সেই যুগে কতক মানুষকে সাধারণ মানুষ হইতে পৃথক করিয়া স্বতন্ত্র জ্ঞান ও গুণ প্রদান করেন। সেই যুগে তিনি মানুষকে যাহা দান করিতে চাহেন তদ্বিষয়ে তিনি তাহাদিগকে বাস্তব জ্ঞান ও উহা বাস্তবায়িত করার প্রণালীও শিক্ষা দিয়া থাকেন এবং অদৃশ্য হইতে তাহাদিগকে অনুপ্রাণিত করিয়া থাকেন যাহাতে তাহারা কঠিন বাধাকে উপেক্ষা করিয়া চলিতে পারেন। অবশেষে যখন তাহাদের আবিষ্কার বা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হইয়া যায় এবং জনগণ উহাকে উপকারী বস্তু হিসাবে সাদরে গ্রহণ করে তখন আবিষ্কারককে মৃত্যুর মাধ্যমে তাঁহার কাছে লইয়া যান। যাহা হোক, মানুষের বহুমুখী উন্নতির প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তাই বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন আবিষ্কারকেরও প্রয়োজন আছে। সেই জন্য তিনি কাউকে চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞান, কাউকে খনিজ সম্পদ বিষয়ক জ্ঞান, কাউকে যন্ত্রপাতি বিষয়ক জ্ঞান, কাউকে দ্রুতগামী যান বিষয়ক জ্ঞান প্রভৃতি বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন জ্ঞান দ্বারা জ্ঞানান্বিত করিয়া থাকেন। মানুষ উপলক্ষ্য মাত্র। প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকর্তারই কর্ম। তাই বলা হয় ‘যা করিবার বিশ্ব প্রভু আপনি সে করে, আপনি করিয়া কাম পরনাম ধরে।’
শান্তিকামী সকল মানুষই স্বীকার করিবেন যে, বিশ্বের সকল মানুষ এক মতবাদী ও এক নীতি পালনকারী হইলেই মানব জাতির প্রকৃত শান্তি ও উন্নতি হইতে পারে। তাহা হইলে সেই সৃষ্টিকর্তা কি এমন মানুষ সৃষ্টি করিবেন না, যে মানুষটি সৃষ্টিকর্তার পরিচয় দিয়া তাঁহারই ইঙ্গিতে মানব জাতিকে একতাবদ্ধ করিয়া স্রষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করিয়া দিতে পারেন?
কিন্তু সেই মানুষ পাইতে হইলে আমাদিগকে সরল হইতে হইবে। যেহেতু তিনি একজন বই একাধিক হইবেন না, তাঁহার একটি মাত্র মত থাকিবে। বর্তমান বিশ্বে শত শত মতবাদীর মানুষ আছে। এখন সকলের মত ত্যাগ করত: একজনের মতের সঙ্গে মত মিলান খুবই সহজ ও সম্ভবপর। তাই সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে উক্ত ব্যক্তিকে মান্য করিয়া তাঁহার মতে মত মিলাইয়া আমরা ঐক্য গঠন করিতে পারি এবং ইহাই হইবে স্রষ্টার মনোনীত পথ যাহা বিশ্ব মানবের সকলেরই কাম্য বস্তু। ইতি Ñ

৯ মাঘ, ১৩৮২ সাল
২৩ জানুয়ারী , ১৯৭৬ খ্রিষ্টীয়
রোজ – শুক্রবার।

********