পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করিতেছি

বিশ্ব সমাজ সংস্কার

আমি বিশ্বাস করি বিশ্ব মানব একই জাতীয়। এর প্রমাণ, প্রত্যেক মানব সন্তানই শিশুকালে চলার শক্তি, বলার শাক্তি ও জ্ঞান শক্তি থেকে বঞ্চিত থাকে। প্রত্যেকেরই পাঁচটি ইন্দ্রিয় ও একটি মন আছে। প্রত্যেকের মন একই রূপ বস্তু পছন্দ করে, যেমন, স্বাস্থ্য, সুগন্ধ ইত্যাদি এবং একইরূপ বস্তু না-পছন্দ করে যেমন, রোগ, দুর্গন্ধ ইত্যাদি।
আমি আরও বিশ্বাস করি, প্রতিটি মানুষেরই কাম্য বস্তু এক, তথা জীবনের শান্তি।
আমি আরও বিশ্বাস করি, জীবনের শান্তি অর্জনের পথ মাত্র একটি তা হল, একতা। আর একটি মাত্র মত বা পথ অনুসরণ করে চলা-ই হচ্ছে একতা কায়েমের একমাত্র উপায়।
আমি আরো বিশ্বাস করি, সকল শান্তিকামী চিন্তাশীল ব্যক্তি একান্তভাবে বিশ্বমানবের ঐক্য গড়ার পক্ষপাতী এবং তাদের ঐকান্তিক চেষ্টার বদৌলতেই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। যদিও জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত শান্তি যে কায়েম হয় নাই একথা আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। এখন প্রশ্ন, শান্তি কায়েম না হওয়ার কারণটা কি? উত্তর-বর্তমান বিশ্ব মানব প্রধানতঃ দু’টি বিপরীত বিশ্বাসে বিশ্বাসী। যতদিন পর্যন্ত এই বৈপরীত্যের মীমাংসা না হবে ততদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে মানব জাতির ভাগ্যে খাঁটি শান্তি কখনো জুটবেনা, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এক শ্রেণীর মানুষ বিশ্বাস করে, এই সৃষ্টির একজন স্রষ্টা আছেন, মৃত্যুর পর মানুষ পুনরায় জীবিত হবে, ভাল ও মন্দ কাজের জন্যে বিচার হবে এবং শান্তি বা শাস্তি ভোগ করতে হবে। অপর শ্রেণী এর ঘোর বিরোধী। প্রথম শ্রেণী ধর্মাবলম্বী, দ্বিতীয় শ্রেণী বস্তুবাদী। সুতরাং যতদিন এই দু’টি মত বিদ্যমান থাকবে, ততদিন শান্তির ডাক যতই ডাকা হোক শান্তি কখনো কায়েম হবে না, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আমি আরো বিশ্বাস করি, উক্ত দু’টো শ্রেণীই আমার ভাই। যেহেতু আমরা সবাই মানুষ জাতি এবং এ উভয় শ্রেণীতেই জ্ঞানী ও মানী ও নেতৃস্থানীয় মানুষ আছেন। কাজেই আমি কোন একটির পক্ষপাতী হয়ে অপর পক্ষের বিরূপ সমালোচনা করতে ইচ্ছা করি না। বরং উভয় পক্ষের বিরোধিতার মূল কারণটা তুলে ধরতে চাচ্ছি এবং উভয় শ্রেণীর দৃষ্টি আমার আলোচনার দিকে আকৃষ্ট করছি।
আমি বিশ্বাস করি, কাল তিনটি, যথা-অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত। মানুষ যেহেতু জন্ম ও মৃত্যুর অধীন, সেহেতু তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়টা তার বর্তমান কাল, জন্মের পূর্বের সময়টা অতীত কাল এবং মৃত্যুর পরের সময়টা ভবিষ্যত কাল। সুতরাং মানুষ বর্তমানে যা দেখে সে সম্বন্ধে সঠিক মন্তব্য করা তার পক্ষে সম্ভব, কিন্তু অতীতের কোন বিষয়ে সঠিক মন্তব্য করতে সে অক্ষম এবং ভবিষ্যতের বিষয়ও তদ্রƒপ। চিন্তা-গবেষণার সাহায্যে অথবা অপরের কথার উপর নির্ভর করে কোন মন্তব্য হয়ত করা যায, কিন্তু চিন্তা ভাবনা বা অপরের কথার উপর নির্ভর করে যে কোন মন্তব্যই করা হোক না কেন তাতে মতানৈক্য ঘটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে যুক্তিবিহীন কোন কিংবদন্তী বা বহুল প্রচলিত কোন প্রবাদ বাক্য কোন জ্ঞানী ব্যক্তিই গ্রহণ করতে চান না বা পারেন না। ঠিক এমনি রকম মানুষের জন্মের পূর্বের সৃষ্টি রহস্য এবং তার মৃত্যুর পরের মুক্তি রহস্য নিয়ে বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক এবং ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জটিলতম একটা মতবিরোধ বেঁধে আছে।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যদি এই উভয় শ্রেণীর মানুষ নিজ নিজ শান্তি ও মানব জাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে একটু পরমত সহিষ্ণু হয়ে একত্রে বসে তা’হলে অবশ্যই এই মতানৈক্যের মীমাংসা হতে পারে এবং পৃথিবীতে যথার্থ ঐক্য ও প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। আমি আরো বিশ্বাস করি যে এই উভয় মতাবলম্বীদের মধ্যেই কিছু ভুল বুঝাবুঝি বিদ্যমান রয়েছে। এই অধম লেখকের দৃষ্টিতে যতটা ভুল ধরা পড়েছে তা-ই আমি এখানে অকপটে ব্যক্ত করার ইচ্ছা করছি। আশা করি পাঠক ভাইয়েরা পরমত সহিষ্ণু হয়ে ইহা পাঠ করবেন এবং প্রকৃত ভাব উদ্ধার করতে চেষ্টা করবেন।
আপাততঃ সৃষ্টি রহস্য বাদ দিয়ে আমাদের বর্তমান জীবন রহস্য নিয়ে আলোচনা করাই আমি দরকার মনে করি। মানুষ যে জীবন নিয়ে বেঁচে আছে এই জীবন কি তার নিজস্ব? না অপর কেউ এই জীবন দান করেছেন? আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, কারো জীবন তার নিজস্ব নয়, জীবনদাতা অপর কেউ আছেন। এর প্রমাণ এই ঃ যদিও প্রতিটি মানুষই মা ও বাপের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু কোন নর বলতে পারে না কখন সন্তান হবে, কী সন্তান হবে বা কেমন হবে, তদ্রƒপ নারীও জানে না। যদিও মা গর্ভে ধারণ করে, কিন্তু প্রসবের মুহূর্তকাল পূর্বেও বলতে পারে না সে কি প্রসব করবে। এতে স্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে যে পিতা-মাতা জন্মদাতা হলেও জীবন দাতা হতে পারেন না। তারপর মানুষ স্বয়ং সে নিজের জীবনের মালিক নয়, তারও প্রমাণ এই যে, মানুষ জন্মাবার পর মুহূর্ত হতে সে চলমান রয়েছে এক নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে অর্থাৎ মৃত্যুর দিকে। পৃথিবীতে অতীতে বা বর্তমানে এমন কোন জ্ঞানী-গুণী জন্মগ্রহণ করেননি যিনি নিজের জীবনকে মৃত্যুরূপ ধ্বংস হতে রক্ষা করতে পেরেছেন বা পারবেন। মধ্যকালীন জীবনেও মানুষ যে স্বাস্থ্য, যৌবন স্বচ্ছলতা কামনা করে তা পাওয়া সত্ত্বেও স্থায়ীভাবে কেউ তা ধরে রাখতে পারছে না। সুতরাং এই যুক্তি নামক দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি জ্ঞানের চক্ষে পরিধান করলে স্পষ্ট দেখা যাবে যে মানুষের জীবন দাতা অপর একজন আছেন এবং তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষ মৃত্যুরূপ ধ্বংসের দিকে চলতে বাধ্য হচ্ছে।
যাহোক, এখন অপর একটি দিক দেখাচ্ছি, যেমন ধরুন, ক্রিয়া, কর্ম ও কর্তা। কর্তা ছাড়া কোন কর্মই হতে পারে না। অনস্তিত্ব থেকে যা কিছু অস্তিত্ববান হয়, অবশ্যই তার একজন বানানেওয়ালা বা কর্তা আছে, এটা স্বীকার করতেই হবে। সুতরাং মানুষ এক সময় অস্তিত্বহীন ছিল, পরে অস্তিত্ববান হয়েছে। অতএব তার এজন কর্তা অবশ্যই আছেন।
মানুষ যে অস্তিত্ববিহীন ছিল তাহার প্রমাণ এই ঃ বীর্য হতে মানুষ সৃষ্ট, আবার মানুষ হতেই বীর্য সৃষ্টÑ ইহা সত্য। কিন্তু প্রথম কি ছিল? প্রথম কিছুই ছিল না। কারণ, যদি বলি প্রথম মানুষ ছিল তাহা হইলে প্রশ্ন উঠবে বীর্য ছাড়া মানুষ কিভাবে হলো? আর যদি বলি প্রথম বীর্য ছিল, তা হলেও প্রশ্ন হবে, মানুষ ছাড়া বীর্য কিভাবে হলো? ঠিক এই জ্ঞানের আলোতে দর্শন করলেও দেখা যাবে শুধু মানুষ কেন, বস্তু বলতে প্রথম কিছুই ছিল না। আরও যেমন বীজ ছাড়া গাছ হয় না, তেমনি গাছ ছাড়াও বীজ হয় না। অতএব আগে কিছুই ছিল না। কিন্তু যখন কিছুই ছিল না, তখনও এমন একজন ছিলেন যিনি সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সৃষ্টির স্রষ্টা ও মালিক। সেই মালিক কিন্তু অন্যের সৃষ্টি নহেন। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে তিনি সদা বিদ্যমান। তিনি বাস্তব ব্যক্তি, তিনি ছাড়া সবই রূপক। অতএব, পরিষ্কারভাবে বুঝা গেল যে বাস্তব ব্যক্তি হলেন স্রষ্টা এবং বাকী সব সৃষ্টিই রূপক।
আমি কোন ভাইয়ের মতের সমালোচনা করতে বা কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে ইহা লিখছি না। বরং প্রাণ ভরা দরদ নিয়ে ভাইদের সামনে হাজির হচ্ছি। আশা করি যদি আমার ভাইয়েরা ভুল ধরতে পারেন এবং তা সংশোধন করে ফেলেন তাহলেই পৃথিবীতে খাঁটি একতা কায়েম হতে পারে।
এখন ধর্মাবলম্বী ভাইদের মতের মধ্যে যে ভুল দেখা যাচ্ছে তা তুলে ধরছি, আশা করি কোন ভাই রাগ না করে পরমত সহিষ্ণু হয়ে ইহা পাঠ করবেন।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, মানুষের সৃষ্টি প্রণালী যেমন এক, তার জীবন প্রণালীও তেমনি এক। অতএব প্রণালী যখন এক, তখন তার স্রষ্টাও একজনই হওয়া সম্ভব, একাধিক হওয়া অসম্ভব। এই একজনই হচ্ছে সৃষ্ট রাজ্যের রাজা। এক রাজ্যে একাধিক রাজা থাকা যেমন অসম্ভব, তেমনিভাবে সৃষ্ট রাজ্যের স্রষ্টা বা রাজাও মাত্র একজনই হওয়া সম্ভব। সুতরাং মানব জাতির জীবনদাতা যিনি, মানব জাতির জীবন বিধান দাতাও তিনি ছাড়া আর কে হবেন? সুতরাং বিধানদাতা যখন একজন, তখন তার বিধান তথা ধর্ম মাত্র একটি হওয়াই স্বাভাবিক; একের অধিক মানুষের ধর্ম থাকতেই পারে না। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে শত শত ধর্ম ও মত বিদ্যমান দেখছি। প্রতিটি ধর্মেরই ধর্মগুরু আছেন। তারা ধর্ম শাস্ত্র দ্বারা মতানৈক্য জিইয়ে রাখতে সক্ষম, কিন্তু ঐক্য গড়তে অক্ষম। এর মূল কারণটা আমি তুলে ধরছি। যেমন ধরুন, একটি সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিকের হাতেই অস্ত্র আছে এবং তারা অস্ত্র চালনা করতেও সক্ষম; কিন্তু তবুও তাদের পরিচালনার জন্য একজন অস্ত্রধারী কমা-ারের একান্ত প্রয়োজন। নতুবা যার যার মতে অস্ত্র ব্যবহার করতে গেলে বিজয় ত দূরের কথা, তাদের ধ্বংসই অনিবার্য। আর ইহাও সত্য যে সরকারের বিনা অনুমতিতে কোন ব্যক্তি আপন যোগ্যতাবলে নিজে নিজেই কমা-ার সাজতে পারে না অথবা সেনাবাহিনীর মনঃপুত হলেও তারা নিজে থেকে কাউকে কমা-ার নিয়োগ করতে পারে না। কমা-ার নিয়োগের জন্য সম্পূর্ণভাবে সরকারের ইচ্ছার উপর নির্ভর করতে হয়। সরকার যাকে মনোনীত বা নিয়োজিত করবেন প্রতিটি সৈনিককে তার আনুগত্য স্বীকার করতেই হবে। নতুবা সেই সৈনিক হবে সরকার বিরোধী। ঠিক এই যুক্তি মতে বিচার করলে সহজেই বুঝতে পারবে যে, সৃষ্টিকর্তাই এই পৃথিবীবাসীর একচ্ছত্র মালিক বা রাজা। রাজ্যে যেমন সেনাবাহিনী না থাকলে সাধারণ মানুষ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যায়, আবার একজন কমান্ডার না থাকলে স্বয়ং সেনাবাহিনী উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যায়। আর ইহাও অতি সত্য যে সাধারণ মানুষ উচ্ছৃঙ্খল হলে রাজ্যের তত ক্ষতি হয় না যতটা ক্ষতি হয় সেনাবাহিনী উচ্ছৃঙ্খল হলে, যেহেতু তারা প্রত্যেকেই অস্ত্রধারী। ঠিক এই ধর্মরাজ্যে ধর্মশাস্ত্রধারী সেনাবাহিনী দ্বারা পৃথিবীর শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা হয়, কিন্তু যখন তাদের মধ্যে কোন পরিচালক থাকেন না এবং প্রত্যেকেই শাস্ত্র দ্বারা আপন আপন রায় বা মত প্রকাশ করতে থাকে এবং আপন মতের একটু বিরোধ হলেই বিরোধী মতবাদীকে কু-আখ্যায় আখ্যায়িত করে গালাগালি বর্ষণ করতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে যে মতানৈক্যজনিত ঝগড়া-বিচ্ছেদ ঘটে, উক্ত ঝগড়া-বিচ্ছেদের সংক্রামক ব্যাধিই ধীরে ধীরে বিশ্ব মানব সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। একেই বলা হয় অন্ধকার যুগ। ঠিক যেমন রাত্রির অন্ধকারে মানুষের মধ্যে গন্তব্যস্থানে পৌঁছার পথ নিয়ে বিরোধ বাঁধে, যদিও গন্তব্যস্থান সকলেরই এক। এই বিরোধ ততক্ষণ পর্যন্ত চলতে থাকে যতক্ষণ না পুনঃ সূর্য উদয় হয়ে সকল মতানৈক্য মিটে গিয়ে সবার গন্তব্যপথ আবার এক হয়ে যায়। যা হোক, আমি বিশ্বাস করি যে, বর্তমান সময়ে বস্তুবাদী ভাইদের সঙ্গে ধর্মাবলম্বী ভাইদের যে মতবিরোধ, তার মূল কারণও ঐ একটাই, যেহেতু ধর্মপথে ঐকমত্য নেই। কিন্তু জীবনের শান্তি লাভ উভয়েরই গন্তব্যস্থান, আর ঐকমত্যই সেই গন্তব্যস্থানে পৌঁছার একমাত্র পথ। (৩/২/৮৭ বাং ঃ ১৭/৫/৮০ খ্রিষ্টীয়, ২ রজব ১৪০০ হিজরী)
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ধর্মই মানব জাতির শান্তি ও উন্নতির একমাত্র উপকরণ। ধর্ম যথা শান্তি তথা। কিন্তু জানা দরকার ধর্ম কাকে বলে।
ধর্মের দুটো অংশ । প্রথম বিশ্বাস, দ্বিতীয় সৎকর্ম। সুতরাং, বিশ্বাস বিহীন যত বড় সৎ কর্মই হোক না কেন তা দ্বারা পৃথিবীতে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। পক্ষান্তরে, যত বড় বিশ্বাসীই হোক না কোন সৎকর্ম ছাড়া পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতে পারে না।
এখন জানা দরকার যে, কিসের প্রতি বিশ্বাস করতে হবে। প্রথমত বিশ্বাস করতে হবে যে, সৃষ্টির অবশ্যই একজন স্রষ্টা আছেন। দ্বিতীয়ত বিশ্বাস করতে হবে, তিনি মানব জাতির বিশেষ প্রয়োজনে পরিস্থিতি বিশেষে যে কোন ভাষাভাষী, যে কোন দেশবাসী বা যে কোন গোত্র-বংশ হতে এক এক জন মানুষকে সমগ্র মানব জাতির কল্যাণার্থে মনোনীত করে প্রেরণ করে থাকেন এবং তাকে ঐশ্বরিক জ্ঞানে জ্ঞানবান করেন; যেহেতু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা কি বা তার আদেশ ও নিষেধ কি Ñ এসব কেউ আপন বিদ্যা, বুদ্ধি বা কোন সাধনা বা গবেষণার বলে জানতে পারে না। উক্ত মনোনীত বা প্রেরিত মানুষটিই হন মহামানব। অতএব উক্ত মহামানবকে বিশ্বাস করেই মহান প্রভুকে বিশ্বাস করতে হয়। উক্ত মহামানবের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ মেনে চলাই সদাচারী বলে পরিগণিত হবার একমাত্র উপায়। কাজেই তার অনুসরণকারীগণ হন সৎকর্মী এবং তার বিরোধীগণ হয় অসৎকর্মী। যেহেতু তার আদেশ-নিষেধই স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ এবং তার আনুগত্যই স্রষ্টার আনুগত্য। যেমন, কমান্ডার সরকার মনোনীত এবং তার (কমান্ডারের) আনুগত্যই সরকারের আনুগত্য বলে পরিগণিত হয়। আরো বিশ্বাস করতে হবে যে, সৃষ্টিকর্তা চিরস্থায়ী এবং তিনি সর্বগুণের অধিকারী এবং ইচ্ছাময়। আরও বিশ্বাস করতে হবে যে, আসমান ও জমিন এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে, দৃশ্যমান বা অদৃশ্য সব তারই সৃষ্ট এবং সব জিনিসের উপরই তাঁর অপ্রতিহত ক্ষমতা সর্বদা বিদ্যমান। উপরে ও নীঁচে যাহা কিছু সৃষ্টি হয় বা লয় হয় তাঁর ইচ্ছায়ই হয়। আরও বিশ্বাস করতে হবে যে, তাঁর জ্ঞান অসীম-চিরস্থায়ী। তার দর্শন শক্তিও চিরস্থায়ী, তার বাক শক্তিও সর্বদা বিদ্যমান। অতএব যখন ইচ্ছা এবং যে কোন মানুষের সাথে ইচ্ছা কথা বলতে ও আপন ইচ্ছা ব্যক্ত করতে তিনি সর্বদা সক্ষম।
হয়ত প্রশ্ন উঠতে পারে, সৃষ্টিকর্তা সকল মানুষের কাছে আপন ইচ্ছা ব্যক্ত করেন না কেন? উত্তরÑ যদি কারো সাথে তিনি কথা না বলেন, তাহলে সকল মানুষই যেমন স্রষ্টার ইচ্ছা সম্বন্ধে অজ্ঞ ও সবাই সমান সমান হতে বাধ্য,তদ্রƒপ যদি সকল মানুষের সাথেই তিনি কথা বলেন ও স্বীয় ইচ্ছা ব্যক্ত করেন তাহলেও সব মানুষই এক সমান হতে বাধ্য। সবাই সমান সমান হলে কে আর কার আনুগত্য করবে? অর্থাৎ কেউ কারো আনুগত্য করবে না। আর ইহা অতি সত্য কথা যে, একজনকে কেন্দ্র না করে মানব জাতির ঐক্য গড়ার অন্য কোন পথ নাই। অতএব কারণে সুকৌশলী মহাজ্ঞানী সৃষ্টিকর্তা মানব জাতির মহা উপকারার্থে এরূপ ব্যবস্থা করে থাকেন। অর্থাৎ একজনকেই মনোনীত করে প্রেরণ করে থাকেন।
আরো প্রশ্ন হতে পারেÑপৃথিবীতে মহামানব কি একজনই এসেছেন, না বহু? উত্তর- বহু মহামানব এসেছেন। কিন্তু একই যুগে স্রষ্টার মনোনীত ও ভারপ্রাপ্ত মহামানব একের অধিক ছিলেন না। কারণ, এক সময়ে যেমন একাধিক কমান্ডার থাকতেই পারে না, তদ্রƒপ একই সময়ে একাধিক মহামানব থাকাও অসম্ভব।
আরো প্রশ্ন, যেমন, সৃষ্টিকর্তার মনোনীত মহামানব দ্বারা যে ধর্মনীতি (শান্তির নীতি) পৃথিবীতে জারি করা হয়, সেই নীতি দ্বারা পৃথিবীবাসী চিরস্থায়ীভাবে শান্তিতে জীবন কাটাইতে পারে না কেন?
তার উত্তরÑ যে কোন মহামানব হউন, তিনি মরণশীল। কাজেই একই জীবনে চেষ্টার মাধমে তিনি যে একতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করে যান, তার মৃত্যুর পর যতদিন পর্যন্ত তার অনুসারীগণ একতা কায়েম রেখে উক্ত নীতি পালন করবেন, ততদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে শান্তি বিদ্যমান থাকে। কিন্তু মহামানব যেহেতু প্রভুর মনোনীত, তার প্রচেষ্টায় যে দল গঠিত হয়, সে দলের দলপতি তিনিই থাকেন, সেহেতু তার মতের বিরোধীতা করে কেউ তার জীবদ্দশায় কোন শাখা বা উপদল গঠন করতে পারে না। কেননা, মহামানবের মতের বিরোধ স্বয়ং মহাপ্রভুরই ইচ্ছার বিরোধ। কিন্তু মহামানবের অনুসারীগণ সৎ ও মহৎ হয়ে থাকেন, তা হলেও তারা প্রভুর মনোনীত মহামানব নয়। অতএব তাদের মধ্যে একতা বহাল রাখতে হলেও একজন নেতার দরকার। কাজেই উক্ত নেতা নির্বাচনের ভার উক্ত দলের উপরই বর্তে। কেননা, দল বহাল না রেখে যদি প্রত্যেকেই যার যার মতে ধর্ম পালন করতে থাকে ও অন্যদেরে সৎ উপদেশ দেয় তবুও ধর্ম বা শান্তি টিকিয়ে রাখতে পারবে না। প্রত্যেক মহামানব তার অনুসারীদের নিম্নরূপে উপদেশ দিয়েছেন ঃ তোমরা দু’ব্যক্তিও যদি ‘সফরে’ যাও, তবুও একজনকে নেতা মান্য করে অপরজন তার অনুসরণ করে চলবে; নতুবা নিরাপদে চলতে পারবে না। ধর্ম পথে মহৎ ব্যক্তিদের প্রতি মহামানবগণের আরো উপদেশ ঃ যদি ধর্ম সংক্রান্ত কোন বিষয়ে তোমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে মতবিরোধ ঘটে, তাহলে এ উভয়ের মধ্যে ধর্ম গুরু বা মহামানবের সঙ্গে যার সংশ্রব কাল অধিক বা মহামানব যাকে বেশী প্রিয় জানতেন, তার মতের অনুসরণ কর। যদি ধর্ম শান্ত্র সম্বন্ধে মত বিরোধ ঘটে, সেখানে সৎ ও মহৎ ব্যক্তির কর্তব্য এরূপ, যথা- মীমাংসার জন্য তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া বা দলবল ও ছল কৌশল দ্বারা বিজয় লাভের চেষ্টা করাকে মহা অপরাধ জানা। বরং উভয় ব্যক্তির অবশ্য কর্তব্য এই যে, তারা নির্জনে পবিত্র মনে বিশ্ব প্রভুর সামনে এরূপ প্রার্থনা করবে, “হে আমাদের প্রভু, আমি তোমার প্রেরিত মহামানবকে বিশ্বাস করেছি, এক্ষণে তার প্রদর্শিত নীতি সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে যে মতবিরোধ ঘটেছে, এ ব্যাপারে যদি আমার মত তোমার মনঃপুত হয়ে থাকে, তাহলে আমার ভাইয়ের মন এদিকে ফিরিয়ে দাও। আর যদি আমার ভাইয়ের মত তোমার নিকট গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে, তাহলে আমার মন তার দিকে ফিরিয়ে দাও। হে আমাদের প্রভু, নিশ্চয়ই তুমি মানব মনের মালিক”। ইহাতেও যদি কারও মন কোন দিকে না ফিরে, তাহলে দ্বিতীয় ব্যবস্থা এই যে, সরলভাবে এক ভাই অপর ভাইয়ের হাত ধরে বলবে, “হে আমার ভাই, যদিও আমি বিশ্বাস করি যে আমার ‘বুঝ’ সঠিক, তথাপি আপনার মন যখন ফিরছে না, আর আমাদের দুই ভাইয়ের মতবিরোধের কারণে আমাদের মহামানবের প্রতিষ্ঠিত ঐক্য ভেঙ্গে যাক ইহাও যখন আমি পছন্দ করি না, তখন আমাদের ঐক্য বহাল রাখার জন্য আমার মত বিসর্জন দিয়ে আমি স্বেচ্ছায় আপনার আনুগত্য স্বীকার করছি।”
উপরোক্ত দু’টি লক্ষণ হল সৎ ও মহৎ ব্যক্তিদের। সুতরাং যতদিন একজন মহামানবের পর তার অনুসারীদের মধ্যে উক্ত লক্ষণযুক্ত মহৎ মানুষ বিদ্যমান থাকেন ততদিন পৃথিবীতে শান্তি বিরাজমান থাকে। আর দ্বিতীয় মহামানব প্রেরণ করার কোন প্রয়োজনও হয় না।
জানা দরকার যে, পূর্বকাল হতে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় যে সকল মহামানব প্রেরিত হয়েছেন, তার দু’টি কারণÑপ্রথমত, পৃথিবীতে যোগাযোগের অভাব হেতু মহামানবের বাণী নিজের ভাষায় সমগ্র পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, কোন মহামানবের অনুসারীগণই স্থায়ীভাবে ঐক্য বজায় রেখে মহামানবের নীতি প্রচার করতে পারেননি। বিলম্ব হলেও তারা মতানৈক্যে জড়িত হয়ে পড়েছেন। তাই পুনরায় ধর্মীয় ঐক্য গড়ার জন্য অপর মহামানব প্রেরিত হয়েছেন।