পরম করুণাময় ও দয়াময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করছি।

জবানবন্দী

কোরান-হাদিস মানে না! কি সাঙ্ঘাতিক কথা!!

কিন্তু দেখলে ত মনে হয় একদম সুফী সাব। কোরান-হাদিস মানে না – এ আবার কেমন কথা?

– সুফী সাব হলে কি হবে! তাদের বই পুস্তকে যে সব কথা লেখা আছে, সে সব সম্পূর্ণ কোরান বিরোধী, হাদিস বিরোধী। এ সব কথা বিশ¡াস করলে কেউ আর ঈমানদার থাকতে পারে না। এখন থেকে এর মূলোচ্ছেদ করতে না পারলে আমাদের ঈমান-আমল সব ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের সংস্পর্শে যে কেউ যাবে সে-ই পথভ্রষ্ট হয়ে বেঈমান-কাফের হয়ে যাবে। সুতরাং আমাদের ঈমান রক্ষার্থে আমাদের উচিত এর একটা বিহিত করা। আমাদের ঈমান-আমলের জন্য প্রয়োজন হলে এর বিরুদ্ধে আমাদের জেহাদ করতে হবে। কি ভাইয়েরা! এ কথায় আপনারা সব রাজী আছেন না?

– হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমরা সবাই রাজী আছি। আপনারা কেবল হুকুম করবেন, আমরা তাকে কতল করব। বই-পুস্তক সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেব। এই এলাকা থেকে তাকে সমূলে উৎখাত করব।

– আচ্ছা, কোরান-হাদিস বিরোধী এরা কি লিখেছে?

– কোরান-হাদিস বিরোধী অনেক কথাই লিখেছে। এর একটি হলঃ তারা বলে, হজরত ঈসা (আঃ) স্বাভাবিক ভাবেই মৃত্যুবরণ করেছেন (আস্তাগফেরুল্লাহ্)। অথচ পাক কালামে আল্লাহ্-পাক বলছেন যে, তারা তাঁকে হত্যাও করেনি, শূলেও দেয়নি। বরং তারা হজরত ঈছা (আঃ)-এরই মত অপর একজনকে হত্যা করেছে। এ বিষয়ে ইহুদীরা ঘোর সন্দেহের মধ্যে রয়েছে। তবে এটা নিশ্চিত যে, তারা তাঁকে হত্যা করেনি। বরং আল্লাহ্ তাঁকে সশরীরে তাঁর নিজের দিকে চৌথা আসমানে তুলে নিয়েছেন। এ হল কোরানের কথা!

আর হাদিস শরীফে আছে, হজরত মোহা¤মদ (দঃ) যখন মেরাজে গিয়েছিলেন, তখন হজরত ঈসা (আঃ)-এর সঙ্গে তিনি মুসাফাহা করেছিলেন। হাদিস শরীফে আরো আছে, উম্মতে মোহা¤মদীর উচ্চ মর্তবার কথা জানতে পেরে হজরত ঈসা (আঃ) শেষ নবীর একজন উ¤মত হওয়ার জন্য আল্লাহ্র দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন। নবীর দোয়া কখনো রদ হয় না। তাই আল্লাহ্-তায়ালা তাঁর এই দোয়া কবুল করেছেন। তাঁর এই দোয়ার বরকতেই আল্লাহ্ তাঁকে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। কিয়ামতের নজদিক, ইহুদী-নাছারাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ইমাম মাহ্দী (আঃ) যখন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে দামেস্কে পৌঁছবেন এবং আছর নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুত হবেন, তখন দুজন ফেরেস্তার কাঁধে ভর করে দামেস্কের মসজিদের পূর্ব দিকের মিনারার উপর নামবেন। মিনারা থেকে নামবার জন্য মুছল্লীগণকে মই দিতে বলবেন। মুছল্লীগণ মই দিলে তিনি নীচে নেমে এসে হজরত ইমাম মাহ্দী (আঃ)-এর সঙ্গে মুসাফাহা করবেন। হজরত ইমাম মাহ্দী (আঃ)-এর ঈমামতীতে তিনি আছর নামাজ পড়বেন।

তারপর দাজ্জাল আবির্ভূত হওয়ার সংবাদ প্রচার হলে হজরত ঈসা (আঃ) একটি ঘোড়া ও বর্শা দিতে বলবেন। তিনি আরো বলবেন যে, তিনি শুধু এই দাজ্জালকে বধ করার জন্যই আবির্ভূত হয়েছেন। তারপর হজরত ঈসা (আঃ) ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে বর্শা হাতে নিয়ে দাজ্জালের পশ্চাদ্ধাবন করবেন এবং তাকে বধ করবেন। এসবই সহি হাদিসের কথা!

তারপর সহি বোখারী শরীফে উল্লেখ আছে যে, হজরত রছুল করিম (সঃ) জীবনের শপথ করে বলেছেন যে, ঈসা ইবনে মরিয়ম অবশ্যই আসবেন। আর এরা বলতেছে, হজরত ঈসা (আঃ) দুহাজার বছর পূর্বেই মারা গেছেন (আস্তাগফেরুল্লাহ্)। তাদের একথা কি হাদিস বিরোধী নয়? আর ১৪শ’ বছর যাবত সুন্নাতুল জামাতের আলেম-ওলেমা, পীর-বুজুর্গ, ছলফে-ছালেহীনগণ হাদিস-কোরান দ্বারা যাঁর সশরীরে আকাশে জীবিত থাকার কথা প্রমাণ করে গেছেন এবং আপনারাও তা শুনে আসছেন, আর এখন তারা বলতেছে যে, তিনি মারা গেছেন। তা’হলে আর এরা কি ভাবে মুসলমান থাকতে পারে? নিশ্চয়ই এরা মুরতাদ হয়ে গেছেন। ইসলামের বিধান হলো মুরতাদকে হত্যা করা।

দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ্ তাঁর পাক কালামে বলতেছেন যে, হজরত মোহা¤মদ (দঃ) খাতামুন্নবী অর্থাৎ শেষ নবী। সহি হাদিসে আছে, হজরত রছুল করিম (দঃ) বলেছেন ঃ

“আনা খাতামান্নাবিয়্যিন, লা নবীয়া বাদী।”

অর্থাৎ, আমিই শেষ নবী। আমার পর আর কোন নবী নেই।

সুতরাং কোরান-হাদিস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণ হচ্ছে যে, আমাদের নবী হজরত মোহা¤মদ (দঃ)-এর পর আর কোন নবী নেই। আমাদের সুন্নাতুল জামাতের আলেম-বুজুর্গদের রায় হলো: হজরত মোহা¤মদ (দঃ)-কে যে ব্যক্তি শেষ নবী বলে বিশ¡াস না করবে, সে হবে কাফের। ইসলামী রাষ্ট্রে এরূপ কাফেরকে সরাসরি হত্যা করার বিধান। এরূপ কাফেরকে যে হত্যা করবে, আল্লাহ্র দরবারে তার জন্য অশেষ ছওয়াব। সুতরাং এরা যখন বলছে যে, এখনো নবুওত ও ওহীর দরজা খোলা আছে, (আস্তাগফেরুল্লাহ্) তা’হলে এরা কি এখনো কাফের হয়ে যায়নি? এরা কি হত্যার লায়েক নয়?

তৃতীয়তঃ তারা তাদের পুস্তকে লিখেছে যে, বর্তমানের ইসলাম নমরূদ-ফেরাউনের স্বার্থ হাসিলের ইসলাম। বর্তমানে আমরা যে ইসলাম পালন করছি, এটা কি ইসলাম নয়? আমাদের ইসলাম যদি প্রকৃত ইসলাম না হয়ে থাকবে, তাহলে আমাদের সঙ্গে তিনারা আবার নামাজ পড়ছেন কি ভাবে? আর আরবে যেখানে চুরি করলে এখনো হাত কেটে দেয়ার বিধান জারী আছে এবং ব্যভিচারের জন্য সঙ্গেছার করা হয়, সেখানেও কি ইসলাম নেই? তাহলে, বর্তমান বিশ্বের কোথাও ইসলাম নেই বা বর্তমান বিশ্বের ইসলামকে কি নমরূদ-ফেরাউনের ইসলাম বলা যায়?

চতুর্থতঃ হজরত ইমাম মাহ্দী (আঃ)-এর আগমন সম্বন্ধে আমাদের আলেম-ওলেমাগণ যা কিছু লিখেছেন বা যা কিছু বলেছেন, তা’ তারা বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থ থেকেই সংগ্রহ করেছেন। অথচ এরা বলছে এ সবই নাকি নাটক। (এই চতুর্থ অভিযোগটি মসজিদের ভিতর মুসল্লিগণের স¤মুখে উত্থাপিত হয়নি। বরং ব্যক্তিগতভাবে আলোচনায় উত্থাপিত হয়েছিল) এ ছাড়াও আমাদের আলেম-ওলেমাগণের বিরুদ্ধে এমন এমন কথা লিখেছে যা’ শুনলে অন্তর বিদ্ধ হয়ে যায়।

-এ ক’টিই হল আমার বিরুদ্ধে, শতাব্দীর সূর্য পত্রিকার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতির বিরুদ্ধে প্রধান প্রধান অভিযোগ।

এই অভিযোগের জবাব আমি আর কি দিব!

আমাকে ত আপনারা ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৮১ খ্রিঃ তারিখ দিবাগত রাত্র ১২-০৫ ঘটিকার সময় আপনাদের মসজিদের ভিতর আমার দু’জন সঙ্গীসহ আটকিয়ে রেখে, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে আপনাদের ডিকটেশন অনুযায়ী লিখে দিতে বাধ্য করলেন যে, ‘আমি উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর কোন জবাব দিতে পারি নাই।’

জবাব কি আমি কিছুই দিই নি?

সেদিন ক্ষীণ কণ্ঠে সংক্ষিপ্ত কথায় জবাব আমি যা দিয়েছি তা’ আপনাদের কাছে সন্তোষজনক না হতে পারে। তাই, ‘আমি কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারিনি’ এ কথা লিখিয়ে না নিয়ে, আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিলেন যে, ‘আমি কোন জবাব দিতে পারিনি।’

আমি বিশ¡াস করি, কিয়ামত অবশ্যই একদিন হবে। উক্ত তারিখে মসজিদের ভিতর কি ঘটেছে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ অবশ্যই তা পুনরুত্থান করবেন। সেদিন কি আপনারা সত্য ঘটনাটি এড়িয়ে যেতে পারবেন?

সে যা হোক, আপনাদের মোকাবিলায় বলিষ্ঠ কণ্ঠে কিছু বলার যথেষ্ট ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, সেদিন আমার কণ্ঠ কেন এত ক্ষীণ ও সংক্ষিপ্ত হয়েছিল, এর কারণ তৎক্ষণাৎ বুঝতে না পারলেও পরে আল্লাহ্ যা বুঝিয়েছেন তা-ই এখানে বলতে চেষ্টা করব।

আপনারা মহল্লার আলেম-ওলেমা। শত শত মহাল্লাবাসী আপনাদের পিছনেই নামাজ পড়েন এবং আপনাদেরই ওয়াজ-নছিহত ও হিতোপদেশ শ্রবণ করেন। এই হিসেবে আপনাদের উপর মহলা¬বাসীদের যথেষ্ট ভক্তি-শ্রদ্ধা রয়েছে। আমার কোন কথায় আপনাদের কোন ভুল-ত্রুটি যদি সে দিন ধরা পড়ে যেত, তা’হলে আপনাদের উপর মহল্লাবাসীদের ভক্তি-শ্রদ্ধা কি আর থাকত? থাকত না। এতে মহল্লায় দলাদলি ফেৎনা-ফাছাদ সৃষ্টি হত। আলেম-ওলেমাদের বদনাম হত। আল্লাহ্ ত চান না যে যথেষ্ট ভক্তি-শ্রদ্ধার পাত্র আলেম-ওলেমাগণ জনগণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হোন; আমি বা আমাদের সংগঠনেরও কেউ এরূপ চান না। তাই শুধু আপনাদেরই ইজ্জত রক্ষার্থে লজ্জা-অপমান, ভয়-ভীতি ও আপাতঃ পরাজয় বরণ করে নিতে সে দিন আল্লাহ্ আমাকে বাধ্য করেছিলেন। কারণ আমার মত না লায়েকের অপমান-লাঞ্ছনা হলে তাতে কিছু যায় আসে না; কিন্তু আপনাদের মত আলেম-ওলেমাদের সামান্যতম অপমান-লাঞ্ছনা হলে, তাতে ইসলাম ও মোসলেম সমাজেরই কলঙ্ক হত।

দ্বিতীয়তঃ আপনারা যেমন কোরান-হাদিস দেখিয়ে জনগণের কাছে আমাকে কতলযোগ্য বলে প্রমাণ করেছেন, আমিও যদি সঙ্গে সঙ্গে আপনাদেরকে কতলযোগ্য প্রমাণ করতাম, তাহলে মসজিদের ভিতর সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠত। এতে কি ইসলামের সুনাম খুব বৃদ্ধি পেত?

তৃতীয়তঃ আমরা শাস্ত্রকে অস্ত্র বলে মনে করি। দুজন অস্ত্রধারী ব্যক্তি পরস্পর পরস্পরকে হত্যা করার নিয়তে মোকাবিলা করলে, হন্তা ও হত্যাকারী উভয়েই যেমন সমান সমান অপরাধে অপরাধী হয়; শাস্ত্র নিয়ে বাহাছ-মুনাজারাকেও আমরা তদ্রƒপ অপরাধ মনে করি। তাই যে মুহূর্তে শাস্ত্র দিয়ে আমাকে আঘাত করলেন, সেই মুহূর্তে শাস্ত্র দিয়ে আপনাকে প্রতিঘাত করলে আপনি এবং আপনার অনুসারী বা ভক্তবৃন্দ কি সরল মনে আমার সে আঘাত সহ্য করতে পারতেন? তখন কি মসজিদের ভিতর হৈ-চৈ শুরু হয়ে যেত না? প্রকৃতপক্ষে আপনারা যখন কোরান-হাদিস দিয়ে আমাদের লেখাকে অসত্য বলে প্রমাণ করলেন, আমি আপনাদের কথার কোন প্রতিবাদ করিনি, কেবল কোরানের দু’একটি আয়াতের উল্লেখ করেছি মাত্র। এতেই আপনারা যেভাবে আমার প্রতি মার-মুখো হয়েছিলেন, আর যদি জোর গলায় আপনাদের কথার প্রতিবাদ করতাম তাহলে অবস্থাটা কেমন হত?

যাহোক, সেদিন সাংঘাতিক কিছু ঘটেনি বলেই ত আজো আমি মসজিদে এসে নামাজ পড়তে পারছি, পরস্পর পরস্পরকে সালাম করতে পারছি, মুসাফাহা করতে পারছি, আপনাকে আমার বাসায় আসতে বলতে পারছি এবং আপনার বাসায়ও যাওয়ার কথা বলতে সাহস পাচ্ছি। সেদিন যদিও আমি অপমানিত, লাঞ্ছিত ও পরাজিত হয়েছি কিন্তু এর ফলাফলটা কি খুব খারাপ হয়েছে? আর যদি সেদিন আপনারা প্রকাশ্য ভাবে পরাজিত হতেন, তাহলে ফলাফলটা কি সাঙ্ঘাতিক হত না? প্রকৃতপক্ষে আপনারা অপমানিত ও পরাজিত হন, এটাত আমার কাম্য নয়, বরং আমার ও আপনাদের মধো যে মতপার্থক্য রয়েছে আপোষ-আলোচনায় আমরা চাচ্ছি তা’ দূর করতে। আমি ত আপনাদের সঙ্গে শত্রুতা কামনা করি না, বরং আমি চাই আপনাদের সঙ্গে আমাদের খালেছ আত্মিক সম্বন্ধ।

এখন হয়ত বলতে পারেন যে, আপনাদেরকে পরাজিত করার কোন অস্ত্র বা দলিল আমার হাতে সেদিন যেমন ছিল না, আজও নেই। সুতরাং, আপানাদেরকে পরাজিত করার মত কোন অস্ত্র সেদিন যেমন আমরা প্রয়োগ করতে পারিনি, ভবিষ্যতেও পারব না।

আপনারা যাতে এরূপ ধারণা না করতে পারেন, সেজন্য আপনাদের উপরোল্লিখিত অভিযোগগুলোর পরিপ্রেক্ষিতেই আমার এ জবানবন্দী। পরিবেশ সুস্থ থাকলে সেদিন মসজিদে মুসল্লিগণের দরবারে এ জবানবন্দী আমি পেশ করতাম। আর এ জবানবন্দী পেশ করার জন্যই  আমি আপনাদের কাছে কিছু দিনের সময় চেয়ে নিয়েছিলাম। আমার জবাবের জন্য বেশ তাগিদও করেছিলেন। তাহলে এবার মনযোগ দিয়ে শুনুন।

ইমাম সাহেব! একদিন সকালে এ না-লায়েক জাহেলের বাসায় মেহরেবানী করে পদধুলি দিয়েছিলেন। অফিসে যাওয়ার ওজরে এ না-লায়েক সে সকালে আলোচনায় বসতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলাম। তবুও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি হাদিসের উদ্বৃতি বলেছিলাম যে, এক মোমিন  আর এক মোমিনের আয়না স্বরূপ। আমার কিছু ভুল-ত্রুটি যদি আপনার আয়নায় ধরা পড়ে এবং আপনি তা আমাকে বলে দেন, আর আমি ভুল-ত্রুটি স্বীকার করে নিয়ে সংশোধিত হয়ে যাই, তাহলে আপনি হবেন আমার প্রকৃত বন্ধু। কারণ, এ দুনিয়াই হচ্ছে সংশোধনের জায়গা। পরকালের সংশোধনের কোন সুযোগ নেই। তাই পরকালে ভুল-ত্রুটির জন্য পাকড়াও হওয়ার পরিবর্তে আপনার কথায় যদি ইহকালেই আমার সংশোধন হয়ে যায়, তাহলে সেটা কি আমার জন্য মহা উপকার হবে না? তদ্রƒপ আপনার বেলায়ও?

একথায় আপনিও সায় দিয়ে পরে আবার আসবেন বলে তখনকার মত চলে গিয়েছিলেন।

তারপর একদিন এশার নামাজের পর এ না-লায়েকের বাসায় এসেছিলেন। বেশ কতক্ষণ আলোচনা হল। আলোচনা শেষে, আরো পড়া-শুনা করে দেখতে হবে বলে সেদিনের মত চলে গিয়েছিলেন। তা নয় কি?

এরপর কি আমার দোষ-ত্রুটি সম্বন্ধে আলোচনা করতে আপনাকে আমি মানা করে দিয়েছিলাম? আমার যতদূর মনে পড়ে, যতবারই আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে, ততবারই আপনাকে আমার বাসায় আসার জন্য আহ্বান করেছিলাম। তাই না?

কিন্তু আমার সে আমন্ত্রন উপেক্ষা করে, আমার দোষ-ত্রুটির কথা আমাকে না বলে, প্রকাশ্যে জনগণের কাছে বলে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে তাদেরকে উত্তেজিত করলেন ইসলামের কোন বিধান বলে? আমার যে দোষের কথা বলে জনগণকে ক্ষেপিয়েছিলেন, আমি যদি সত্য সত্যই সেই দোষে দোষী হয়ে থাকি, তবুও কি আমার সেই দোষের কথা জনগণকে বলাতে ‘গীবত’ হবে না? আর যদি সে সব দোষে আমি দোষী না হয়ে থাকি, তাহলে কি আমার কল্পিত দোষের কথা মিথ্যা করে মানুষের কাছে বলাতে ‘বোহ্তান’ হবে না? এবং সমাজের মধ্যে ফেৎনা-ফাছাদ সৃষ্টিকারী হবেন না? আপনার এই ‘গীবত’ ও ‘বোহ্তান’-এত কথা সেদিন মুসল্লীগণের মধ্যে প্রকাশ করে দিলে তারা কি আপনার এই ভুল মেনে নিত? এবং আপনার এ ভুল প্রকাশ করে দিলে আমাকে কি তারা ছেড়ে দিত? ইমাম সাহেব! শুধু মাত্র প্রকাশ্য  সংঘর্ষ এড়াবার জন্যই আল্লাহ্-পাক আমাকে ধৈর্য ধরে আপনাদের জুলুম-অত্যাচার সহ্য করার তৌফিক দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয়তঃ ‘আমরা কোরান-হাদিস মানিনা’ – এই অভিযোগটা করলেন কিসের ভিত্তিতে? আমরা কি আমাদের কোন লেখায় বা কথায় কোন সময় এর বিন্দু-বিসর্গ আভাস-ইঙ্গিত ও দিয়েছি? আমরা ত বরং আমাদের লেখা ও কথার সমর্থনে কোরান-হাদিসের দলিলই পেশ করেছি। কোরান-হাদিস থেকে দলিল পেশ করাতেই কি আমরা কোরান-হাদিস অমান্যকারী প্রমাণিত হলাম? এরূপ ভাবে ‘রায়’ দেয়াকে কি কোন রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় বা নৈতিক বিধান সম্মত বলে প্রমাণ করতে পারবেন? আমাদের বিরুদ্ধে আপনাদের এই অভিযোগটি দেশের যে কোন বিচারালয়ে উত্থাপন করে আমাদের বিরুদ্ধে কোন কেস দায়ের করতে পারেন। এটাই হবে বিধি সম্মত। কিন্তু কোন আইনের আশ্রয় না নিয়ে, নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়েই কি আপনারা ইসলামিক বিধান চালু করতে চাচ্ছেন?

তৃতীয়তঃ আমরা যে কথা বলছি, সে কথা কি আপনারা অন্য কোথাও কারও মুখে বা লেখায় শুনতে পান নি? আমাদেরও পূর্বে, যাদের মুখে বা লেখায় আমাদের অনুরূপ বক্তব্য শুনেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আপনার কি ব্যবস্থা নিয়েছেন?

তারা খুব সবল, তাই না? আপনাদের এলাকায় আমাকে একা, বৃদ্ধ ও জুবু-থুবু পেয়ে আপনাদের ইসলামী মহব্বত খুব জোরছে জোশ্ মেরে উঠেছে, তাই না? তা না হলে কি আর মর্দে মুমিন!

চতুর্থতঃ আপনারা কথায় কথায় সুন্নাতুল জামাতের দোহাই দিয়ে থাকেন। বর্তমান পৃথিবীতে এই সুন্নাতুল জামাত ক’টি আছে? আপনাদের এই জামাতের হেড অফিসটি কোথায়? কে এর কর্ণধার? কারা এর সভাসদবৃন্দ, আর কারাই বা এর ভক্তবৃন্দ? অভক্তদের বিরুদ্ধে কোন ‘রায়’ বা ‘ফতোয়া’ কার্যকর করার কি পদ্ধতি প্রণালী আছে, মেহেরবানী করে তা বলতে পারেন কি?

পঞ্চমতঃ মনে করুন, আপনাদের ধারণা অনুযায়ী কোরান-হাদিস মানতে আমরা ভুল করে ফেলেছি। এ জন্য আমরা কঠোর শাস্তি পাওয়ারই যোগ্য। আমাকে আপনাদের এলাকা থেকে সমূলে উৎখাত করাই যথোপযুক্ত ব্যবস্থা! কিন্তু আমরা ত এক সৃষ্টিকর্তাতেই বিশ¡াসী, নামাজ ত আপনাদের পিছনেই পড়ি, দেখতে-শুনতে ইহুদী-নাছারা বলে কেউ গাল দিতে পারবে না। কিন্তু কোরান-হাদিস, নবী-রছুল তো দূরের কথা, আল্লাহ্র অস্তিত্বই যারা স্বীকার করে না, ধর্মের কথা বললে যারা গুলি করে মারে বা পাগলা গারদে পুরে ইসলামী দেশগুলি একটা একটা করে দখল করে নিয়ে ইসলামের নাম-নিশানা মুছে ফেলে দিচ্ছে বা ইসলামের নামে অপসংস্কৃতি প্রচার করছে, আমাদের কর্তা ব্যক্তিদেরকে ইচ্ছা মত উঠাচ্ছে-নামাচ্ছে তাদেরকে উৎখাত করার কি ব্যবস্থা আপনারা নিয়েছেন? তাদের মোকাবিলা করার জন্য কোথায় আপনাদের এই সুন্নাতুল জামাত এবং আপনাদের এই ঈমানী জোশ্?

হ্যাঁ, আমরা জানি, এদের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য আপনাদেরও একটি অস্ত্র আছে। আপনারা তা অহরহ ব্যবহারও করছেন। কিন্তু আপনাদের এই অস্ত্রটি প্রতিপক্ষের গায়ে আঁচড় কাটাতো দূরে থাকুক, তা যে আপনাদের নিজেদেরকেই ছিন্ন-ভিন্ন করে দিচ্ছে। আপনারা এটা উপলব্ধি করতে না পারলেও তারা তা যথার্থভাবেই করেছে। এর প্রত্যক্ষ  প্রমাণ হলো, আপনাদের উপর তাদের প্রভুত্ব কায়েম। আল্লাহ্ বলেছেন, মুমিনদেরকে সাহায্য ও সাফল্য দান করাই আল্লাহ্র দায়িত্ব। আর আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? তথাকথিত মুসলমানদের উপর ইহুদি-নাছারা, মোশরেক-নাস্তিক এবং জড় ও বস্তুবাদীদেরই বিজয়।

তাহলে উপরোক্ত আল্লাহ্র কালামকে অমান্য করে কিভাবে বলতে পারি যে, আমরা বিশ¡াসী, অথচ পরাজিত ও লাঞ্ছিত? আল্লাহ্ বলছেন, ‘অলা তাহিনু অলা তাহ্জানু আন্তুমুল আলাউনা ইনকুন্তুম মুমিনিন।’

‘যদি তোমরা বিশ¡াসী হও, তাহলে তোমরাই হবে সর্বেসর্বা, তোমাদের জন্য থাকবে না কোন ভয়, কোন অপমান-লাঞ্ছনা।’ এরপরও আমরা কি ভাবে বলতে পারি যে, আমরা মোমেন, অথচ আমরা থাকব সর্বনিম্নে, আমরাই হব সবচাইতে বেশী অপামণিত ও লাঞ্ছিত?

এখনও যারা মুসলমানদের পরাজয়, অপমান, লাঞ্ছনা অনুভব করতে পারছেন না, আমরা কি এখনও বলব, দেখবার জন্য তাদের চোখ আছে, শোনবার জন্য কান আছে এবং উপলব্ধি করার জন্য তাদের অন্তঃকরণ আছে?

ইমাম সাহেব! আমার ও আপনার বুঝের মধ্যে কম-বেশী হতে পারে। আপনি যেমন বুঝেন, আমি হয়ত তেমন বুঝি না। আমি যা দেখি, আপনি হয়ত তা দেখেন না। আমাদের বুঝের মধ্যে কিছু গরমিল হলেই কি বুঝতে হবে, আমার বুঝের উর্ধ্বে যখন আর কোন বুঝ নেই, আমার জ্ঞানের বাইরে যখন আর কোন জ্ঞান নেই, তখন আমাদের প্রতিপক্ষ কাফের বেদ্বীন-মোশরেক-গোমরাহ্ বেদাতী না হয়ে কি আর পারে? এরূপ বুঝ বুঝেই না আপনারা ফতোয়ার অস্ত্র ব্যবহার করছেন? অথচ মহান আল্লাহ্ জানাচ্ছেন,

‘আসলে যে সব বিষয়ে তারা জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি, আর যে সব বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ এখনও তাদের কাছে পৌঁছায়নি  সে সব বিষয়কে তারা মিথ্যা বলেই জানল। সুতরাং তাদের আগেও জালিমদের পরিণাম কি দাঁড়িয়েছে, তাই কি তোমরা দেখতে চাও?’ (১০ঃ৩৯)

তাই অনুরোধ করছি, এই ফতোয়ার অস্ত্র আর ব্যবহার করবেন না। প্রতিপক্ষকে আঘাত করার মত ধার এ অস্ত্রের বিন্দু মাত্রও নেই বরং ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধেই এই অস্ত্র এটম বোমের চেয়েও মারাত্মক হয়। সুতরাং এই ফতোয়া ব্যবহার করে আর আত্মঘাতী হবেন না।

ষষ্ঠতঃ কোন প্রশ্ন বা সমস্যার সমাধান স্পষ্টভাবে কোরান-পাকে পাওয়া গেলেও তার সমর্থনে হাদিসের বয়ান থাকতে হবে – এ কার ফতোয়া? কোরানের পাঠ বুঝতে হলে সর্বতঃভাবে হাদিসও সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে – এটাই বা কার বা কোন জামাতের সিদ্ধান্ত? ‘হাদিস ছাড়া কোরান বুঝা যায়না’ – এর সমর্থনে কি কোন কোরান হাদিস আছে?

এ ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত এই যে,

১।      যার সমাধান কোরান দ্বারা স্প®ট প্রমাণিত হবে তার সমর্থনে হাদিসের অনে¡ষণ আমরা জরুরী মনে করি না। এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হলো, হাদিসের সমর্থন থাকে ভাল, না থাকলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই।

২।      হাদিসের অর্থ ঠিক রাখার জন্য কোরানের অর্থ ‘তাবিল’ করে বলার বা ভিন্ন রকম করার পক্ষপাতী আমরা নই। কোরানের পরিপন্থি কোন হাদিসকে সরাসরি অস্বীকার না করে যতদূর সম্ভব আমরা তার ‘তাবিল’ করার পক্ষপাতী। কিন্তু কোন প্রকারেই কোরানের অর্থ পরিবর্তন করা আমরা সমর্থন করি না। কোরানের অর্থ ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজন হলে আমরা হাদিসের বর্ণনা অস্বীকার করব।

৩।     সহিসিত্তায় বর্ণিত কোন হাদিস আভ্যন্তরীন কারণে ভুল প্রমাণিত হলে, আমরা তা ভুলই বলব। সহিসিত্তার বাইরেও কোন মৌজু হাদিসও যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তা-ও আমরা সত্য বলে গ্রহণ করব।

৪।      কোনক্রমেই আমরা হাদিসকে কোরানের উর্ধ্বে বা কোরানের সমতুল্য বলে গ্রহণ করব না। হাদিসকে আমরা দ্বিতীয় স্তরের দলিল রূপেই গণ্য করব। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা রছুল করিম (দঃ)-এর বাণীকে কম গুরুত্ব দিচ্ছি, বরং হজরত রছুলে করিম (দঃ)-এর সঙ্গে বর্ণনাকারী ও সংগ্রহকারীর স্তর ভেদের জন্য এরূপ পার্থক্য করছি। তা না হলে, বর্ণনাকারী ও সংগ্রহকারীও নবীর সমমর্যাদাভুক্ত হয়ে পড়েন।

৫।      যে সমস্ত ইমাম, মোজতাহেদ, মোহাদ্দেস, আলেম, ওলেমা, পীর-বুজুর্গ চলে গেছেন, তাদের কারো বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগও নেই, আবার তাদের কারো পক্ষে আমাদের অন্ধ-ভক্তি বা সমর্থনও নেই। তারা যা বলে গেছেন বা করে গেছেন, বিনা যুক্তি প্রমাণে তাদের সমস্ত কথা ও কাজকে অভ্রান্ত বা সত্য বলে গ্রহণ করতে আমরা বাধ্য নই। ধর্মীয় ব্যাপারে স্বীয় মত গঠন ও প্রকাশ করার অধিকার তাদের যেমন ছিল, তেমন অধিকার আমাদেরও আছে বলে আমরা মনে করি। অবশ্য তা আকলী ও নকলী দলিল দ্বারা সমর্থিত হতে হবে।

৬।     ‘ধর্মে কোন বাধ্যবাধকতা নেই’ – কোরানের এই বাণীকে আমরা সর্ব ধর্মাবলম্বীদের বেলায়ই প্রযোজ্য বলে মনে করি। কারো উপর আমাদের মত জোর করে চাপিয়ে দেয়ার পক্ষপাতী আমরা যেমন নই, তেমনি কেউ তার মত আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দিক, এরূপও আমরা চাই না।

উপরোক্ত সিদ্ধান্ত সমূহের উপর ভিত্তি করে এবার আমরা আমাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলির জবাব দিতে চেষ্টা করব এবং আমার মোর্শেদ কেবলার উছিলা করে আল্লাহ্র সাহাযা প্রার্থনা করি, তিনি যেন তাঁর এই গুনাহ্গার বান্দাকে যথাযথ উত্তর দানে সাহায্য করেন এবং ভুলকে ভুল বলে বুঝার ও তা পরিহার করার এবং সত্যকে সত্য বলে বুঝার এবং সর্বদা সত্যকে অনুসরণ করার তৌফিক দান করেন। আমিন!

আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, কোরান-হাদিস নিয়ে মুনাজারা করাকে আমরা অস্ত্র নিয়ে হানাহানি করার চেয়েও মারাত্মক অপরাধ বলে মনে করি। যেমন ধরুন, আপনারা বলেছেন, কোরানের এই শব্দের এই অর্থ, এই আয়াতের এই অর্থ এবং আপনাদের অর্থের সমর্থনে অমুক অমুক হাদিস দেখাচ্ছেন। পক্ষান্তরে আমিও বলব, কোরানের এই শব্দের এই অর্থ নয় বরং এই; এই আয়াতের এই অর্থ নয় বরং এই আয়াতের অর্থ হবে এই; এবং আমাদের অর্থের সমর্থনেও অমুক অমুক হাদিস উল্লেখ করব। তখন আপনি বলবেন আমার কোরান ভুল, আমার হাদিস ভুল। আমিও বলব, আপনার কোরান ভুল, আপনার হাদিস ভুল। তারপর আপনি বলবেন, আমি একজন অজ্ঞ-জাহেল-কাফের-বেদ্বীন-গোমরাহ্। আমিও আপনাকে বলব আপনি একজন অজ্ঞ-জাহেল-কাফের-বেদ্বীন-গোমরাহ্। এরপর আপনার প্রতি আমার কোন সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহানুভূতি থাকবে না। আমার প্রতিও আপনার কোন সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহানুভূতি থাকবে না। আপনার দুঃখ-কষ্টে আমার কোন দুঃখ-কষ্ট হবে না। আমার দুঃখ-কষ্টেও আপনার কোন দুঃখ-কষ্ট হবে না। আপনার অভাব অনটনে আমি এগিয়ে আসবনা, আমার অভাব অনটনেও অপনি এগিয়ে আসবেন না। এমনিভাবেই কি পরস্পর পরস্পরের প্রতি মানবাতাবোধ হারিয়ে বিশ্ব মুসলিম দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটনে, লজ্জা-অপমানে জর্জরিত হচ্ছে না? শেষ পর্যন্ত কেবল মাত্র কোনও রকমে টিকে থাকার জন্য অমুসলমানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে হাত পাততে হচ্ছে। সুতরাং পরস্পর পরস্পরের কোরান-হাদিসকে ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত না করে আসুন আমরা যুক্তির অতি সাধারণ ধারাকে অনুসরণ করে চলি; এবং আসুন দেখি, যুক্তির আলো আমাদেরকে কতদূর পথ চলতে সাহায্য করে। তবে আমাদের সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে; আমরা যেন কখনও কোরান দ্বারা বেঁধে দেয়া সীমাকে লঙ্ঘন না করি, তা না হলে নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহ্র দরবারে সীমালঙ্ঘনকারী হিসাবে গণ্য হয়ে যাব। সুতরাং আমরা সীমালঙ্ঘনকারী হওয়া থেকে বেঁচে থাকার জন্য সর্বদা আল্লাহ্র সাহায্য প্রার্থনা করি।

মনে করুন, ইংল্যান্ডের মহামান্যা রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে একটু বেশী ঘনিষ্ঠতা ও একটু বেশী উঠা-বসার জন্য তাঁরই এক ব্যক্তিগত ভৃত্য (তার নাম ধরুন, জনৈক জনের পুত্র গোমেজ)। এই গোমেজকে ইংল্যান্ডবাসীগণ রাণীর সিংহাসনের একজন অংশীদার হিসেবে গণ্য করতে লাগলো। এ অবস্থায় রাণী কি করবেন? এটা কি তাঁর জীবনের একটি কঠিন সমস্যা নয়? নিশ্চয়ই তিনি এর জোর প্রতিবাদ করবেন। কারণ, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তাঁর বৈধ সিংহাসনের অপর কেউ অবৈধভাবে অংশ দাবী করবে, জীবন থাকতে এমন দাবী তিনি কখনো মেনে নিতে পারেন না। সিংহাসনের উপর তাঁর বৈধ অধিকার রক্ষার্থে প্রয়োজন হলে সমগ্র সশস্ত্র বাহিনী প্রয়োগ করবেন, এটাই ন্যায় এবং এটাই স্বাভাবিক। তাই প্রথমেই সশস্ত্র বাহিনী প্রয়োগ না করে সিংহাসনের উপর তাঁর একচ্ছত্র অধিকারের দাবী প্রমাণ করার জন্য সর্বপ্রথম গোমেজকেই দেশবাসীর কাছে পাঠানো উচিত। কারণ, তাঁর সিংহাসনের উপর দেশবাসী যাকে অংশীদার হিসাবে গণ্য করছে, সে-ই যদি সিংহাসনের উপর তার দাবীর অবৈধতা স্বীকার করে নিয়ে স্বীয় অংশীদারিত্ব প্রত্যাহার করে নেয়, তা হলে তার পক্ষে জনগণের বলার আর কিছু থাকবে না। ধরে নিলাম, বিশেষ কোন কারণ বশতঃ জনগণের কাছে গোমেজকে তিনি পাঠালেন না, বরং তিনি তাঁর অপর এক অনুগত ভৃত্যকেই বিষয়টি বুঝাবার জন্য জনগণের কাছে পাঠালেন। কিন্তু দেখা গেল, এই ভৃত্যের কথায় জনগণ মোটেই কর্ণপাত করল না। বরং দিন-বা-দিন আরো অধিক সংখ্যায় রাণীর পাশে পাশে গোমেজকেও সিংহাসনের অংশীদার হিসাবে মান্য করতে লাগল। এমতাবস্থায় রাণীর কি করা উচিত। সিংহাসনের এই কঠিনতম সঙ্কটাবস্থায় গোমেজ যে সিংহাসনের অংশীদার নয় এবং সে নিজে সিংহাসনের কোন অংশও দাবী করে না তা জনগণকে বুঝাবার জন্য জনগণের কাছে কি স্বয়ং গোমেজকেই পাঠানো উচিত নয়?

কিন্তু কার্যতঃ দেখা গেল, রাণীর এই কঠিনতম সঙ্কট মুহূর্তেও তিনি গোমেজকে জনগণের কাছে পাঠালেন না। আরো আশ্চর্যের বিষয়, গোমেজকে তিনি এ বিষয়ে কোন কথাই বললেন না। অধিকন্তু, দুধ-কলা খাইয়ে তাকে রাণীর প্রাসাদেই পুষতে লাগলেন। আর গোমেজও রাণীর এ সঙ্কটের বিষয় নিয়ে কোনও সময় কোন চিন্তা-ভাবনা না করে দিব্যি আরামে রাজকীয় প্রসাদ ভোগ করতে লাগল। গোমেজের প্রতি রাণীর এরূপ ব্যবহারে কি প্রমাণ হচ্ছে না যে রাণী প্রকারান্তরে সিংহাসনের উপর গোমেজের অংশীদারিত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন?

সে যাহোক, এক সময় গোমেজ ঘুরে ফিরে দেশের হাল-চাল দেখল, জনগণ যে তাকে রাণীর সিংহাসনের অংশীদাররূপে এখনও গণ্য করছে তা-ও সে দেখল। তারপর রাণীর পক্ষে জনগণের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ-জেহাদ করল। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও সিংহাসনের অংশীদারিত্ব সম্বন্ধে রাণী গোমেজকে একটি কথাও বললেন না, তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও উত্থাপন করলেন না।

তারপর ধরুন কিয়ামত হয়ে গেল। তখন হঠাৎ এক সময় অন্য কোন প্রসঙ্গ উত্থাপন না করেই রাণী গোমেজকে ডেকে বললেন, ‘‘হে গোমেজ! তুমি কি আমার সিংহাসনের উপর আমার অধিকার অস্বীকার করে তোমার অধিকার মেনে নেওয়ার জন্য জনগণকে বলেছিলে?’’

বলুন ত, কিয়ামতের দিন গোমেজের বিরুদ্ধে রাণীর এরূপ অভিযোগ উত্থাপন করা কি ন্যায়সঙ্গত হবে, না জুলুম হবে? জনগণ যখন সত্য সত্যই গোমেজকে সিংহাসনের অংশীদাররূপে মান্য করছিল, সে সময় তাকে তাদের কাছে না পাঠিয়ে কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা কখনো ন্যয়সঙ্গত হতে পারে না।

সে যাহোক, রাণীর অভিযোগের জবাবে গোমেজও বলছে, ‘‘যে কথা বলার অধিকার আমার নেই, তেমন কথা আমি কখনো বলিনি, যদি আমি এরূপ কিছু বলেই থাকতাম তা হলে আপনি নিশ্চয়ই তা জানতেন। আর আমি যতদিন জীবিত ছিলাম, ততদিন ত জনগণকে ঠিকই দেখেছিলাম, অর্থাৎ তারা আমাকে আপনার সিংহাসনের অংশীদার মনে করেনি। তবে আমার মৃত্যুর পরে কি হয়েছে না হয়েছে তা আমি জানি না।’’

এখন বলুন ত, গোমেজ কি সত্য কথা বলেছে? সে রাণীর রাজত্ব ঘুরে-ফিরে দেখল, যারা তার পক্ষে মিথ্যা অধিকার দাবী করেছিল, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ-জেহাদ করল, অথচ সে বলতেছে যে, এ বিষয়ে সে কিছুই জানে না। গোমেজের এরূপ জবাব কি সত্যের বিরোধী নয়?

এবার আসুন দেখি, সুরা মায়েদার ১১৬ ও ১১৭ আয়াতে আল্লাহ্ কি বলছেন। পবিত্র কোরান বলে ঃ

১১৬: আল্লাহ্ যখন ইরশাদ করবেনঃ হে মরিয়মের ছেলে ঈসা! তুমি কি লোকজনকে বলেছ যে, আল্লাহ্কে ছাড়া আমাকে আর আমার মাকে উপাস্যরূপে মেনে নাও? তিনি বলবেন ঃ পরম পবিত্রতা শুধু আপনারই। আমার পক্ষে এ কথা মোটেই শোভা পেত না যে কথা বলার কোনও অধিকার আমার ছিল না তা-ই আমি বলব। আমি যদি বলেই থাকি, তা হলো ত আপনিই তা জানতেন। আমার মনে যা কিছু আছে, তাও আপনি জানেন। কিন্তু আমি তা মোটেই জানি না – যা কিছু আপনার অন্তরে রয়েছে। নিশ্চয়ই আপনি অপ্রকাশ্য সব কিছুই ভালো করে জানেন।

১১৭: আমি তাদেরকে এমন কোন কথা বলিনি যে কথা বলার জন্য আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছিল তা ছাড়া। আমি যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি তাদের খোঁজ-খবর নিয়েছি। তারপরে আপনি যখন আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলেন, তখন ত আপনিই তাদের নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আপনিই ত সব কিছুর খবর রাখছেন।

প্রচলিত বিশ¡াস এই যে, হজরত ঈসা (আঃ)-এর ৩৩ বছর বয়সের সময় আল্লাহ্ তাঁকে সশরীরে চৌথা আসমানে তাঁর নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। কিয়ামতের নজদিক হজরত ঈমাম মাহ্দী (আঃ)-এর সাহায্যার্থে এবং দাজ্জালকে বধ করার জন্য ফেরেস্তার কাঁধে ভর করে পৃথিবীতে নেমে আসবেন, বিয়ে-শাদী করবেন, সন্তানাদি হবে, ৪০ বছর রাজত্ব করার পর তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হবে। শেষ প্রলয় সংঘটিত হওয়ার পর বিচারের দিন আল্লাহ্ ও হজরত ঈসা (আঃ)-এর মধ্যে যে ছওয়াল-জওয়াব হবে সে খবরটাই উপরোক্তভাবে হজরত ঈসা (আঃ)-এর ‘চৌথা আসমানে’ উঠে যাওয়ার ছয়শত বছর পরে এবং এখন থেকে প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বে আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় হাবিবের মাধ্যমে জগদ্বাসীকে জানাচ্ছেন।

এখানে আরো উল্লেখ্য যে, হজরত ঈসা (আঃ)-এর ‘চৌথা আসমানে’ উঠে যাওয়ার পরে পরেই তাঁর ভক্ত-অনুসারীগণ তাঁর এবং তাঁর মায়ের প্রতি ঈশ¡রত্ব আরোপ করে এক ঈশ¡রের স্থলে তিন ঈশ¡রের পূজা শুরু করে।

অর্থাৎ নিজেদের ইচ্ছামত আল্লাহ্র সিংহাসন তিনজনের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়ে আল্লাহ্র অথর্বতা ও পঙ্গুত্ব প্রমাণ করেছে। অক্ষম-অসহায়-দুর্বল আল্লাহ্ তা-ই চেয়ে চেয়ে দেখছেন! আর তাঁর এক কালের ভৃত্য ঈসা-ইবনে মরিয়মকে ‘চৌথা আসমানে’ তুলে রেখে বেহেস্তের ফল-মেওয়া খাইয়ে পুষছেন, পাছে তাঁর বাকী অংশটুকুও খারিজ হয়ে যায়! কিয়ামতের নজদিক এই ঈসা ইবনে মরিয়মই ফেরেস্তার কাঁধে চড়ে পৃথিবীতে নেমে এসে দাজ্জাল বধ করবেন, ইমাম মাহ্দী (আঃ)-কে সাহায্য করবেন এবং পৃথিবীতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন।

এক আল্লাহ্র এক সিংহাসন তাঁরই এক দাস ও দাসীর মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়ে দোর্দ- প্রতাপে তিন ঈশ¡র পূজারীরা পৃথিবী শাসন করছে এবং প্রকাশ্য ভাবে তিন জনেরই পূজা-অর্চনা করে আসছে। আর ‘খাইরা উ¤মাতিন উখ্রেজাতি লিন্নাস’ – উ¤মতে মোহা¤মাদী আলেম-ওলেমা-পীর-বুজুর্গ-ছলফে-ছালেহীনদের দোহাই দিয়ে এখনো দাজ্জালের আবির্ভাব এবং তাকে বধ করার জন্য ‘চৌথা আসমান’ থেকে ঈসা ইবনে মরিয়মের অবতরণের জন্য অনাগত ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে আছে! এর চাইতেও দাজ্জালিয়াত আর কি হতে পারে?

সে যাহোক, ঈসা-পূজার বদৌলতে রোমান সভ্যতা যখন চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছে, তখনও আল্লাহ্ তাঁর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা এবং ঈসা-পূজার অসারতা প্রমাণের জন্য ‘চৌথা আসমান’ থেকে ঈসা ইবনে মরিয়মকে নামিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলেন না। তখনও তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপন না করে আল্লাহ্ তাঁকে স্বীয় প্রাসাদে রেখেই ফল-মেওয়া খাইয়ে পুষতে থাকেন। আর তারই পরিবর্তে তাঁর অপর এক ভৃত্যকে পাঠিয়ে দিলেন ঈসা-পূজার অসারতা প্রমাণের জন্য। এই ভৃত্য যথার্থভাবেই ঈসা-পূজার অসারতা প্রমাণ করলেন এবং ঈসায়ীদের উপর এক আল্লাহ্র সিংহাসন প্রতিষ্ঠা করলেন।

সময়ের পরিবর্তনে, আস্তে আস্তে আবার ঈসা-পূজার সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি পেতে পেতে বর্তমানে আবার তারা পৃথিবী শাসন করছে। উ¤মতে মোহা¤মদীই আজ দয়া ও করুণা মেগে তাদের দ্বারে দ্বারে ফিরছে।

আর, আল্লাহ্?

এখনও সেই ভৃত্যকে আপন দরবারে রেখে দুধ-কলা দিয়ে পুষছেন। এ সম্বদ্ধে তিনি তাকে একটি কথাও বলছেন না! এখনও তিনি তাঁর সিংহাসনের অখ-তা প্রমাণের জন্য ঈসা-পূজারীদের কাছে তাকে পাঠানোর কোন প্রয়োজন অনুভব করছেন না!

অর্থাৎ, আল্লাহ্ অংশীদারীত্বকে অমার্জনীয় মহা পাপ বলে ঘোষণা করা সত্ত্বেও ঈসায়ীদের বেলায় এ যেন কিছুই নয়। তাই আল্লাহ্ এ ব্যাপারে কোন গা করছেন না! মনে হচ্ছে, ‘ঈশ¡র পিতা, ঈশ¡র মাতা ও ঈশ¡র পুত্র’ ঈসায়ীদের এই তিন ঈশ¡র তত্ত্ব আল্লাহ্ প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন। তা না হলে এই ত্রিত্ববাদের যিনি উৎস তাকে এখনও স্বীয় দরবারে ধরে রাখার আর কি কারণ থাকতে পারে? কারণ, মানে, আল্লাহ্র সিংহাসনের অবস্থা এখনও তত সঙ্গীন হয়ে পড়েনি! ভবিষ্যতে কোনও একদিন ‘কানা দাজ্জাল’ এসে যখন আল্লাহ্র সিংহাসনটা পুরাপুরি একাই দখল করে নিবে, তখনই কেবল আল্লাহ্র চমক ভাঙ্গবে! কেবল তখনই তিনি চরম সঙ্গীন অবস্থায় পৌঁছবেন এবং তখনই কেবল তিনি এই সবেধন নীলমনি, অন্ধের যষ্ঠি, অঞ্চলের নিধি ঈসা ইবনে মরিয়মকে পাঠিয়ে দেবেন দাজ্জালের সঙ্গে লড়াই করে আল্লাহ্র সিংহাসন নিস্কণ্টক করার জন্য!

সে যাহোক, ভবিষ্যতে কোন একদিন চৌথা আসমান থেকে নেমে এসে হজরত ঈসা ইবনে মরিয়ম সত্য সত্যই যখন আল্লাহ্র এত বড় উপকারটাই করবেন, কিয়ামত পর্যন্ত চুপ-চাপ থাকার পর হঠাৎ এক সময় আল্লাহ্ এই ঈসা ইবনে মরিয়মের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উত্থাপন করে বলবেন, ‘‘হে ঈসা ইবনে মরিয়ম! তুমি কি আমাকে বাদ দিয়ে তোমার এবং তোমার মায়ের পূজা করার জন্য জনগণকে বলেছিলে?’’

এখানে কি প্রশ্ন উঠতে পারে না যে, এ কথাটা আল্লাহ্ তাঁকে কিয়ামতের দিন কেন জিজ্ঞাসা করবেন? তিনি যখন কিয়ামতের নজদিক আকাশ থেকে নেমে এসে পৃথিবীতে চল্লিশ বছর পর্যন্ত রাজত্ব করবেন, তখনও কি আল্লাহ্ এ বিষয়টি ফয়সালা করে নিতে পারবেন না? কিয়ামতের দিনের জন্য এ বিষয়টি তিনি ঝুলিয়ে রাখবেন কিসের জন্য?

সে যাহোক, এই অভিযোগের জবাবে হজরত ঈসা (আঃ)-ই বা কি ভাবে বলবেন যে, “হে খোদা! আমি ত এ বিষয়ে কিছুই জানি না। আর আমি যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি তাদেরকে সঠিক পথেই পেয়েছি। আমাকে তোমার কাছে তুলে নেয়ার পর তারা কি করেছে না করেছে সে খবর আমি জানি না। সে খবর তুমিই ভাল জান।’’

অর্থাৎ এখন থেকে দু’হাজার বছর পূর্বে আকাশে তুলে নেয়ার পর হতে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যা কিছু হয়েছে বা হবে এমন কি ঈসায়ীদের তিন ঈশ¡র পূজার বিষয়টিও কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার কাছে উত্থাপন না করা পর্যন্ত তিনি জানতে পারছেন না।

কিন্তু, কেন?

– কেন আবার! হজরত ঈসা (আঃ) কেবল মাত্র বনী ইসরাইলদের জন্য একজন রাছুল বই ত নন! তিনি আর কতটুকু জানবেন! যা জানার তার সব জ্ঞান ভা-ারের চাবি-কাঠি যে শেষ জামানার উ¤মতে মোহা¤মদীর আলেম-ওলেমাদের হাতে! দোজখ-বেহেশ্ত্, রহমত-গজব, ভাগ্য বিপর্যয়, সব কিছুর নিয়ন্ত্রক ত এখন তারাই! যাকে ইচ্ছা তাকে তারা বেহেশ্ত্ থেকে বের করে দিচ্ছেন, যাকে ইচ্ছা তাকে বেহেশ্তে ঢুকাচ্ছেন; যাকে ইচ্ছে তাকে নবীর মর্যাদা দান করছেন, আবার যাকে ইচ্ছে তাকে নবীর মর্যাদা থেকে নামিয়ে আনছেন, মৃতকে জেন্দা রাখছেন, আর যিনি জীবিত তাকে অস্বীকার করছেন।

বর্তমানে আল্লাহ্ তাঁর ফজল দান করতে পারবেন কি পারবেন না; কাকে ফজল দান করতে পারবেন, আর কাকে করতে পারবেন না; আল্লাহ্ তাঁর জ্ঞান-হিকমত কাকে কতটুকু দান করতে পারবেন, আর কতটুকু পারবেন না; নবুওত ও ওহীর কল্যাণ আল্লাহ্ কাউকে দান করতে পারবেন কি পারবেন না – এ সব ব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার এবং তা কার্যকরী করার অধিকার ত একমাত্র তাদেরই! তাদের অগোচরে যে-কেউ কিছু করবে, সে নির্ঘাত কাফের হবে, আর তার ভাগ্যে হবে চিরস্থায়ী জাহান্নাম!

আর এই জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্যই ত আমাদের প্রয়োজন উচ্চ মর্তবার! আবার আমাদের এই মর্তবা যেমন-তেমন উচ্চ হলে চলবে না! নবীর চেয়েও উচ্চ হতে হবে। তাই ধবধবে ঝলমলে আরবী আবা রুমাল শিরস্ত্রাণ পরিধান করে উঁচু মিম্বারে বসে সুললিত কন্ঠে অবলীলাক্রমে উ¤মতে মোহা¤মদীর শান্ বর্ণনা করছেন – আমাদের মত উ¤মত হওয়ার জন্য কত নবী-রছুল হায় আফসোস করে গত হয়ে গেছেন! কিন্তু কারো ভাগ্যে আমাদের এই নেয়ামত জুটলো না! সব শেষে হজরত ঈসা ইবনে মরিয়মের দোয়া আল্লাহ্ কবুল করলেন! উ¤মতে মোহা¤মদীর মর্যাদায় মর্যাদাবান করার জন্যই আল্লাহ্ তাঁকে সশরীরে তুলে নিয়ে চৌথা আসমানে স্বীয় দরবারে দু’হাজার বছর যাবত ঝুলিয়ে রাখছেন! কিয়ামতের নজদিক, পৃথিবীতে নেমে এসে উ¤মতে মোহা¤মদীর খাতায় নাম লিখিয়ে তিনি কলিজা ঠা-া করবেন!

হায়রে বেচারা ঈসা ইবনে মরিয়ম!

আল্লাহ্ তাঁকে একজন অন্যতম রাছুল বানালেন। আল্লাহ্র দরবারে তাঁকে হজরত আদম (আঃ) এর তূল্য করলেন। (৩ ঃ ৫৯) পবিত্র রুহ্ দিয়ে তাঁকে সাহায্য করলেন (২ ঃ ২৫৩)। আল্লাহ্ তাঁকে আপন কালেমায় আখ্যায়িত করলেন (৪ঃ১৭২)। দোলনায় থাকা অবস্থা থেকে তাঁকে মানুষের সঙ্গে কথা বলার শক্তি দিলেন, তাঁকে কিতাব-জ্ঞান-হিকমত তৌরাত, ইঞ্জিল শিক্ষা দিলেন। জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য করার শক্তি দিলেন (৫ঃ১১০) তাঁর অবস্থান স্থলকে সৌভাগ্য ম-িত; এবং তাঁর জ›ম, মৃত্যু ও উত্থান দিবসকে শান্তিময় বলে স্বয়ং আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিলেন (১৯ঃ৩১,৩৩)। তাঁর অনুসরণকারীগণকে তাঁর অস্বীকারকারীগণের উপর কিয়ামত পর্যন্ত প্রবল রাখার প্রতিশ্রুতি বহাল রাখলেন (৩ঃ৫৫)।

এত সব নেয়ামত পেয়েও তিনি খুশী হতে পারলেন না! শেষে একজন উ¤মতে মোহা¤মদী হওয়ার শখ তাঁর বাকী রয়ে গেল! তাই, একজন বিশিষ্ট নবী হওয়া সত্ত্বেও, একজন উম্মতের মর্যাদা লাভের লালসা তিনি ত্যাগ করতে পারলেন না!

অর্থাৎ পৃথিবীর আলো-বাতাস, ফল-মেওয়া, রূপ-ঐশ¡র্য ভোগ করার পরও পুনরায় মাতৃগর্ভের না-পাক রক্ত পান করার খায়েশ এখনও তিনি করছেন! তাই, এক সংকীর্ণ যোনীপথে পুনরায় মাতৃগর্ভে প্রবেশ করার অভিলাষ এখনও তিনি অন্তরে পুষছেন!

উম্মতে মোহা¤মদী আল্লাহ্র একজন অন্যতম রাছুলকে উম্মতের মর্তবায় চড়াবার আশায় দু’হাজার বছর পূর্বে সেই যে আকাশে তুলে রেখেছেন, এদিকে আল্লাহ্র সিংহাসন ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে গেলেও আকাশ থেকে তারা তাঁকে নামিয়ে আনার প্রয়োজন অনুভব করছেন না! ভবিষ্যতে কোন এক সময়ে নেমে এসে চল্লিশ বছর পৃথিবী শাসন করলেও কিয়ামতের দিন তাঁর বিরুদ্ধে আল্লাহ্র সিংহাসন ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হলে তিনি এসবের কোন খবরই বলতে পারবেন না!

যদি বলা হয়, কেন? তারা সাফ্ সাফ্ বলে দেন, ‘‘আল্লাহ্র কালাম সম্বন্ধে আবার ‘কেন’ কি? কোরান হাদিসের উপরে আবার কিসের যুক্তি? এই যুক্তি যুক্তি করেই ত আজ আমাদের এই দশা।’’

অর্থাৎ নাক-মুখ চেপে ধরে বাচ্চা শিশুদেরকে যে ভাবে তিক্ত ঔষধ গেলানো হয়, তেমনি ভাবে উ¤মতে মোহা¤মদীর আলেম-ওলেমাদের ‘কালামকেও’ নাক-কান-চোখ বুঁজে আমাদের গিলতে হবে! গিলতে না চাইলে, একদম জাহান্নামে নির্বাসন! আর জাহান্নামের ভয়ে ভয়েই ত তাদের ‘কালাম’ গিলতে গিলতে আজ আমরা এসে পৌঁছেছি এক ‘হাবিয়া’ দোজখে। আমাদের এই জ্বলুনী-পুড়নির কথা বলতে গেলেই ধেঁয়ে আসে তাদের বিদ্রƒপ-বাণ, জ্বালাও-পোড়াও-উৎখাত আন্দোলন।

সে যাহোক, অতীতের বুজুর্গ ইমাম ছলফে ছালেহীনগণের দোহাই দিয়ে আপনারা যখন ‘‘বার রাফায়াহুল্লাহু ইলাইহি’’ (৪ঃ১৫৮) আয়াতে চড়িয়ে (যদিও এখানে কোথাও আসমান শব্দটি নেই, বা আল্লাহ্ যে আসমানেই বসবাস করেন তারও কোন প্রমাণ তারা দিতে পারেননি, অথবা ‘আল্লাহ্ তাঁকে আসমানে তুলে নিয়েছেন’ এরূপ অর্থও যখন কোন তফ্ছীরকার করেননি) কিছু রেওয়ায়েত, কিছু দেরায়াৎ, কিছু ইঞ্জিল, আর কিছু কল্পনা মিশিয়ে মিক্সার বানিয়ে যে ভাবেই হোক ঈসা ইবনে মরিয়মকে চৌথা আসমানে যখন তুলেই ফেলেছেন, তখন আপনাদের জ্বালাও-পোড়াও-উৎখাত আন্দোলনের ভয়ে না হয় মেনেই নিলাম যে ঈসা ইবনে মরিয়ম ‘ভায়া চৌথা আসমান’ আল্লাহ্র কাছে চলে গেছেন, অর্থাৎ আল্লাহ্ তাঁর ‘রাফা’ বা উন্নীতকরণ সম্পন্ন করে ফেলেছেন।

কিন্তু আপনারা যখন বলেন যে তিনি আবার কিয়ামতের নজদিক মর্তের মাটিতে নেমে আসবেন, তখন আপনাদের বর্ণনার সাথে আল্লাহ্র কালামের তরতীব রক্ষা করা আমাদের পক্ষে আর সম্ভবপর হয়ে উঠে না। যেমন আল্লাহ্ বলেছেন,

‘‘ইজ কালাল্লাহু ইয়া ঈসা ইন্নি মুতাওফ্ফিকা অ রাফেউকা ইলায়্যা অ মুতাহ্হিরুকা মিনাল্লাজিনা কাফারু অ যায়িলুল্লাজিনাত্তা বাউকা ফাওকাল্লাজিনা কাফারু ইলা ইয়াওমেল কিয়ামাতে, ছু¤মা ইলায়্যা মারজিউকুম ফা আহ্কুমু বায়নাকুম ফিমা কুনতুম ফিহি তাখ্তালিফুন’’(৩ ঃ ৫৫)।

অর্থাৎ আল্লাহ্ যখন ইরশাদ করলেন ঃ

হে ঈসা! আমি তোমাকে ‘নিয়ে নেব’, আমার কাছে তুলে নেব, কাফিরদের মোকাবিলায় আমি পাক-পবিত্র করব; যারা অনুসরণ করছে তাদেরকে আমি কিয়ামত পর্যন্ত ‘কাফিরদের’ উপরে বিজয়ী রাখব। পরে অবশ্য আমার কাছে সবাইকে ফিরতে হবে। তখন ফয়সালা করব – যা নিয়ে তোমরা ঝগড়া করতে।

এই আয়াতের ‘ইন্নি মুতাওফ্ফিকা অ রাফেউকা’ শব্দ দুটি নিয়ে আমাদের তফছীরকারগণ ভীষণ সমস্যায় পড়ে গেছেন। শব্দ দুটি যদি পাশাপাশি না হত তা হলেও সমস্যাটা কোন রকমে এড়িয়ে পার হওয়া যেত। অথবা যদি রাফেউকা শব্দটি পরে না হয়ে আগে হত, তা হলে ত কোন সমস্যাই থাকত না। অথচ আল্লাহ্র কালাম, কোন রদবদলও তারা করতে পারছেন না। তাই শব্দ দুটির অবস্থান ত তারা আর পাল্টাতে পারছেন না, কিন্তু তাতে কি হয়েছে! অর্থের পরিবর্তন করতে ত কোন বাঁধা নেই। তাই এ কাজটি তারা অতি সহজভাবেই করছেন। যেমন, ‘মুতাওফ্ফিকা’ শব্দটির মূল হলো ‘ওফতুল’, অর্থ মৃত্যু বা পূর্ণতা লাভ; আর ‘রাফেউকা’ শব্দটির মূল হল ‘রাফউন’ অর্থ উন্নীতকরণ। আয়াতের মধ্যে ‘মুতাওফ্ফিকা’ শব্দটি ‘রাফেউকা’ শব্দের পূর্বে; অর্থাৎ হজরত ঈসা (আঃ)-এর ‘রাফার’ আগে হবে তাঁর ‘ওফাত’। আর সারা মুসলিম জাহান স্বীকার করে নিচ্ছে যে দুহাজার বছর পূর্বেই হজরত ঈসা (আঃ)-এর ‘রাফা’ বা ‘উন্নীতকরণ’ সম্পন্ন হয়ে গেছে। তাই এখানে যদি ‘ওফাতের’ সাধারণ অর্থ বা ‘মৃত্যুই’ করা হয়, তাহলে ত বুজুর্গ ইমাম ছলফে-ছালেহীনগণের দোহাই দিয়ে যে শিক্ষা দিয়ে আসছেন তা সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যায়! তাই তারা মুখ রক্ষার জন্য শেষরক্ষা হিসেবে যে অর্থ করেছেন আপনাদের অবগতির জন্য নিম্নে তার কটি নমুনা তুলে ধরছি ঃ

১।      ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রণীত তফছীরে লিখছেন ঃ

“হে ঈসা! আমি তোমার কাল পূর্ণ করিতেছি এবং আমার নিকট তোমাকে তুলিয়া লইতেছি।’’

আমরা সবাই স্বীকার করছি যে, দুহাজার বছর পূর্বেই হজরত ঈসা (আঃ)কে আল্লাহ্ তুলে নিয়েছেন, এতে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। এখন বাকী তাঁর কাল পূর্ণ করা, তা’ নয় কি? কিন্তু তাঁর ‘কাল পূর্ণ করার’ কথা ত আগে ব্যবহার করা হয়েছে; তা হলে আমাদের এ-ও স্বীকার করতে হচ্ছে যে, আল্লাহ্ হজরত ঈসা (আঃ) এর ‘কাল পূর্ণ’ করেছেন, তাঁকে নিজের কাছে তুলে নেয়ার পূর্বেই, তা নয় কি? এবার আসুন ‘কাল পূর্ণ’ করার অর্থ দ্বারা তারা কি বুঝাচ্ছেন। ‘ওফাত’ শব্দের সাধারণ অর্থ ‘মৃত্যু’, আরেক অর্থ ‘পূর্ণতা লাভ’। এখন বুলন ত হজরত ঈসা (আঃ) কে ‘আকাশে’ তুলে নেয়ার পূর্বে তিনি এমন কি কাজ করেছেন যাতে তাঁর জীবনের পূর্ণতা লাভ হয়েছে বলা যায়? মৃত্যু ছাড়া কি কেউ পূর্ণতা লাভ করতে পারে? সুতরাং তারা যে ভাবেই অর্থ করুন না কেন, হজরত ঈসা (আঃ)-এর ‘রাফা’ হওয়ার পূর্বেই যে তাঁর ‘ওফাত’ বা মৃত্যু হয়ে গেছে, উপরোক্ত তফছীরে কি তা-ই প্রমাণ হচ্ছে না? তাছাড়া কারো কাল পূর্ণ করা এবং তুলে লওয়ার মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে? সুতরাং তারা যেভাবে অর্থ করেছেন, তাতে ‘ওফাত’ এবং ‘রাফার’ একই অর্থ প্রকাশ পাচ্ছে। প্রকৃতই কি এ দুটি শব্দের একই অর্থ?

২।      হজরত মাওলানা আব্দুল হাকিম তফছীর করেছেন, ‘‘হে ঈসা! নিশ্চয় আমি তোমাকে আমার দিকে প্রতিগ্রহণ করিব ও তোমাকে উত্তোলন করিব ………’’। এখানেও ‘মুতাওফ্ফিকা’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘আমার দিকে প্রতিগ্রহণ করিব’। আল্লাহ্ কর্তৃক হজরত ঈসা (আঃ)-কে ‘প্রতিগ্রহণ করা এবং উত্তোলন করার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? যেখানে ‘ওফাতের’ মাধ্যমে প্রতিগ্রহণ বুঝায়, সেখানে ‘প্রতিগ্রহণ’ অর্থ ‘মৃত্যু’ বললে কি ভুল হবে? কিন্তু ‘মৃত্যু’ শব্দটি ব্যবহার করলে যে তারা ‘সুন্নাতুল জামাত’ থেকে বেরিয়ে পড়বেন, এই ভয়ই সর্বত্র বিরাজমান!

৩।     হজরত মাওলানা হাকিম আব্দুল মান্নান তফছীর করেছেন; ‘‘হে ঈসা! আমি তোমাকে নিয়ে নেব, আমার কাছে তুলে নেব …।’’ এখানেও সেই একই অবস্থা। ‘নিয়ে নেব’ আর ‘তুলে নেব’ শুধু পার্থক্য, অর্থাৎ ‘ওফাত’ ও ‘রাফা’ একই অর্থে ব্যবহƒত হচ্ছে।

৪।      সবার সাথে ব্যতিক্রম করে তফছীর করেছেন হজরত মাওলানা আকরাম খাঁ। তিনি তফছীর করেছেন ঃ “হে ঈসা! নিশ্চয় আমি তোমার মৃত্যু ঘটাইব এবং তোমাকে উন্নীত করিব আমার পানে ……।’’

সুতরাং উল্লিখিত আয়াতের তফছীর অনুযায়ী যদি আমরা সত্য সত্যই বিশ¡াস করি যে হজরত ঈসা (আঃ)-এর ‘রাফা’ বা উন্নীতকরণ সম্পন্ন হয়েছে, তখন উক্ত আয়াতের তরতীব অনুযায়ী আমাদের অবশ্যই বিশ¡াস করতে হবে যে তাঁর ‘উন্নীত করণের’ পূর্বেই তার ‘ওফাত’ বা মৃত্যুও হয়ে গেছে! আর যদি আমরা আল্লাহ্র কালামের তরতীব রক্ষা করতে না চাই, তা হলে সেটা ভিন্ন কথা। ভিন্ন ভিন্ন ভাবে যে যেরূপ চায়, সে সেরূপই করতে পারে। তাদের কারো সাথে আমাদের বাদ সাধবার কিছু নেই।

এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা এই যে, আমরা যদি ‘‘রাফায়াহুল্লাহু ইলাইহি’’ আয়াতের ‘রাফা’ শব্দের দ্বারা ‘আকাশে তুলে নেয়া’ অর্থ করতে চাই তা হলে ত কোন মু’মিনের কবর পৃথিবীর মাটিতে হওয়ার কথা নয়। যেমন আল্লাহ্ বলেছেন-

‘‘ইয়ার ফায়েল্লাহুল্লাজিনা আমানু মিনকুম’’ (ছুরা মুযাদিলা, রুকু ২, ১১ আয়াত) – তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছ, আল্লাহ্ তাদেরকে রাফা দেবেন। সুতরাং ‘রাফা’ শব্দ দ্বারা যদি ‘আকাশে উত্তোলন’ বুঝতে হয়, তা হলে কোন মু’মিনের পক্ষে কি পৃথিবীর মাটি পাওয়া সম্ভব?

তাহলে ‘রাফা’ শব্দের অর্থ কি হবে?

‘রাফা’ শব্দ দ্বারা আপনারা যে অর্থই করুন না কেন, আমরা এর দ্বারা বুঝি ‘মর্যাদা বুলন্দ’ করা। হজরত ঈসা (আঃ) এবং তাঁর মা সম্বন্ধে ইহুদীদের বিশ্বাস কত জঘণ্য, তা আর এখানে উল্লেখ না করলেও চলবে। তাদের বিশ¡াস মতে, হজরত ঈসা (আঃ)কে ত্রুুশে বিদ্ধ করে মারাই হল তাঁর উপযুক্ত শাস্তি। তাই তারা তাঁকে ত্রুুশে বিদ্ধ করে মারার জন্য ষড়যন্ত্র করে। ইহুদীদের এই ষড়যন্ত্রের বিষয় অনুভব করে হজরত ঈসা (আঃ) যখন ‘আল্লাহ্র ওয়াস্তে কে আছ আমার সাহায্যকারী’ বলে ডাকলেন, তখনই আল্লাহ্ তাঁকে আশ¡স্ত করে বললেন যে ইহুদীরা যত ষড়যন্ত্রই করুক না কেন আমিই হচ্ছি সর্বোত্তম কুশলী (৩ ঃ ৫৪)। নিশ্চয় আমি তাদের ষড়য›ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে অভিশপ্ত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে তোমাকে আমি ‘ওফাত’ দিব অর্থাৎ স্বাভাবিক মৃত্যু দিব। তারপর তোমাদের সম্বন্ধে তারা যে জঘণ্য আক্বিদা পোষণ করছে, তুমি তা মোটেও নও, বরং আমার দরবারে তোমাকে আমি ‘রাফা’ দিব অর্থাৎ বিশিষ্ট মর্যাদায় ভূষিত করব। আর তাদের দেওয়া সমস্ত অপবাদ থেকে তোমাকে পাক পবিত্র করব। আর আমার এ কথার সত্যতার নিদর্শন স্বরূপ তোমার অসুসরণকারীগণকে তোমার অস্বীকারকারীগণের উপর কিয়ামত পর্যন্ত প্রবল রাখব (৩ঃ৫৫)। সুতরাং ‘রাফার’ অর্থ কোন প্রকারেই আকাশে তুলে নেয়া নয় বরং মর্যাদা বুলন্দ করাই হচ্ছে এর যথার্থ অর্থ।

উল্লিখিত আয়াতে প্রথমে ‘ওফাত’ তারপর ‘রাফা’ শব্দ ব্যবহƒত হয়েছে। সুতরাং বিশ¡ মুসলিম যখন স্বীকার করে নিয়েছে যে হজরত ঈসা (আঃ) এর ‘রাফা’ হয়ে গেছে, তখন কোরান পাকের তরতীব অনুযায়ী তার ‘ওফাত’ও হয়ে গেছে একথা স্বীকার করে নিতে এত আপত্তি কেন?

আমাদের ‘মর্তবাবোধ’ যে খুব টন্টনে! উম্মতে মোহাম্মদীর মর্তবা যে নবীগণের মর্তবারও উর্দ্ধে, এটা প্রমাণ করা চাই ত! এখন যদি স্বীকার করে নেয়া হয় যে হজরত ঈসা (আঃ)-এর ‘ওফাত’ হয়ে গেছে, তা হলে ত তাঁকে আর হজরত  মোহা¤মদ (দঃ)-এর উম্মত বানানো যায় না এবং আমাদের মত মর্তবা লাভের জন্য পূর্বকালের নবীগণ যে সত্য সত্যই হায় আফসোস্ করে করে শেষ হয়ে গেছেন, তাও প্রমাণ করা যায় না! আর এ প্রমাণ করতে না পারলে উম্মতে মোহাম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়! কিন্তু তারা কি ভুলে যাচ্ছেন যে তাদের পূর্বেও একটা উ¤মত ছিল যাদেরকে লক্ষ্য করে আল্লাহ্ বলছেন,

‘‘ইয়া বানী ইস্রাইলাজ্কুরু নেয়মাতিয়াল্লাতি আন আমতু আলাইকুম অ আন্নিফাদ্দালতুকুম আলাল আলামিন।’

হে বানী ইস্রাইল! তোমরা আমার সে নেয়ামতগুলির কথা স¥রণ কর যা আমিই তোমাদেরকে দিয়েছিলাম। আমিই তোমাদেরকে সারা জাহানের উপর ‘ফজল’ দান করেছিলাম।’’ (২ ঃ ৪৭)

আল্লাহ্ আরও জানাচ্ছেন,

“অ ইজ কালা মুসা লিকাওমিহি ইয়া কাওমিজ কুরু নেয়মাতাল্লাহি আলাইকুম ইজ যায়ালা ফিকুম আম্বিয়া অ যায়ালা কুম মুলুকাও অ আতাকুম মা-লাম ইয়ুতি আহাদাম মিনাল আলামিন।’’

মুসা যখন তাঁর কওমকে বললেন ঃ হে আমার কওম! আল্লাহ্র নেয়ামত তোমরা স¥রণ কর। তিনি তোমাদের মধ্য থেকে নবীগণকে সৃ®িট করেছেন, আর তোমাদের মধ্য হতে বাদশাহ্ বানিয়েছেন। তিনি তোমাদেরকে এত সব দান করেছেন যা এই দুনিয়া জাহানে আর কাউকে দেয়া হয় নাই। (৫ ঃ ২০)

দুনিয়া জাহানে যাদের তুলনায় আর কাউকে নেয়ামত দেয়া হয়নি বলে আল্লাহ্ স্বয়ং আমাদেরকে স¥রণ করিয়ে দিচ্ছেন তাদের সঙ্গে আল্লাহ্ কিরূপ ব্যবহার করেছিলেন তা কি আপনারা সত্য সত্যই স¥রণে রাখছেন? একটু স¥রণ করে দেখুন না।

উ¤মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য একজন নবীকে যারা উম্মতের মর্যাদায় নামিয়ে আনতে চান, তাদের ঈমান না এরূপ যে তারা বলে ঃ ‘‘লানুফাররেকু বাইনা আহাদিমমিররুছুলিহি’’ আমরা রছুলগণের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না। (২ ঃ ২৮৫)।

আল্লাহ্ ত আরো জানাচ্ছেন, ‘‘যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাছুলগণকে অমান্য করে; আর যদি চায় যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাছুলগণের মধ্যে পার্থক্য সৃ®িট করা হোক; আর যদি বলে ঃ কাউকে আমরা মেনে চলব আর কাউকে আমরা অমান্য করব, আর যারা এ দুয়ের মাঝখানে কোনও পথ বের করে নিতে চায়; এরাইত সেই দল, যারা সত্যই কাফির। আমি কাফিরদের জন্যই ত চরম অপমানজনক সাজা তৈরী করে রেখেছি।’’

যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাছুলগণের উপর ঈমান এনেছে, আর তাদের মধ্যে কারুর ব্যাপারে কোন রকম পার্থক্য করেনি, এদেরকেই ত আমি শীঘ্রই তাদের পারিশ্রমিক দান করব। আল্লাহ্ ত ক্ষমাশীল দয়াময়।’’ (৪ ঃ ১৫০-১৫২)

এর পরও যারা উ¤মতে মোহা¤মদীর উচ্চ মর্তবার কথা বর্ণনা করতে যেয়ে আনন্দে সোহাগে উৎফুল্ল হয়ে হজরত ঈসা (আঃ)-কে নবীর মর্যাদা থেকে নামিয়ে এনে আমাদের মত উ¤মতের ‘উচু মর্তবায় উন্নীত’ করতে করতে আত্মহারা হয়ে পড়ছেন, তাদেরকে স¥রণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমাদের মর্তবার ‘উচ্চতা’ প্রমাণ করার জন্যেই আল্লাহ্ পাঠিয়েছিলেন চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লংকে, তাই না?

এতেও যখন আমাদের হারানো মর্যাদা ফিরে এল না, তখন আল্লাহ্ পাঠালেন পথভ্রষ্ট নাছারাদেরকে আমাদের উপর প্রভু বানিয়ে। দীর্ঘ দেড়শ-দুশ বছর তাদের গোলামী করলাম, কত অত্যাচার জুলুম ভোগ করলাম, এতেও আমাদের উচ্চ মর্তবা কমল না!

এরপর, আল্লাহ্র অস্তিত্বই যারা স্বীকার করে না, তাদেরকেই আল্লাহ্ পাঠালেন আমাদের বিরুদ্ধে। এক দিক থেকে চাব্কাতে চাব্কাতে আমাদের নাম নিশানা মুছে ফেলতে ফেলতে এক কোনায় এনে ঠেসে ধরেছে। সাহায্যের আশায় এখন একবার তাকাচ্ছি ডান দিকে – খাচ্ছি চপেটাঘাত আবার তাকাচ্ছি বাম দিকে – খাচ্ছি কান মলা। এতেও আমাদের মর্যাদা কমল না। চাব্কাতে চাব্কাতে আর কান মলতে মলতে তাদের হাতেই হয়ে গেল ব্যথা। তারা আর কত চাব্কাবে আর কত কান মলবে। তখন আমাদের মধ্য থেকেই দাঁড় করিয়ে দিলেন এক এক জনকে। এখন তাদের হয়ে এরাই আমাদেরকে চাব্কাচ্ছে আর কান মলছে।

এতেও উম্মতের শান বিন্দুমাত্রও কমেনি। এখনও বলছি, হজরত ঈসা (আঃ)-এর মত একজন অন্যতম নবী আমাদের মত উম্মত হওয়ার জন্য আসমান থেকে নেমে আসবেন।

আল্লাহ্ আর কি করবেন। সর্বশেষ, তিনি জীন-ইনসান-ফেরেশতা কুল মখলুকাতের অভিশাপ-প্রাপ্ত শক্ত-গ্রীব ইহুদীদেরকেই দাঁড় করিয়ে দিলেন আমাদের বিরুদ্ধে। ইহুদীদের এক ঠেঙ্গানিতেই নবীর চেয়েও উচ্চ মর্তবার দাবীদার আমাদের এই উ¤মতের মাজা গেল ভেঙ্গে। চলৎশক্তিহীন হয়ে রইলাম পড়ে। তারপর কত তেল। কত মালিশ। তবুও ভাঙ্গা মাজা আর সোজা হয় না। তারপর নাক-খৎ দাস-খৎ! তবুও মাজা সোজা করে দাঁড়াতে পারছি না। এখনও সেই একই কথা। নবীর চেয়েও উ¤মতের মর্তবা বেশী! আর আমাদের এই মর্তবা লাভের জন্য হজরত ঈসা (আঃ) আবার এই মর্তের মাটিতে নেমে আসবেন!!

সে যাহোক, উ¤মতে মোহা¤মদীর আলেম ওলেমাবৃন্দ যা কিছু করুন বা বলুন না কেন, আল্লাহ্র পাক কালামকে আমরা আহলে-কিতাবীদের মত পেছনে ফেলে রাখতে পারি না; তাই আল্লাহ্ যখন বলছেন,

‘‘অমা মুহা¤মাদুন ইল্লা রাছুল ক্বাদ খালাত মিন কাবলিহির রছুল’’

– মোহা¤মদ (দঃ) একজন রাছুল বই নন্, তাঁর পূর্ববর্তী আছুলগণ অতীত হয়ে গেছেন (৩ ঃ ৪৪); আল্লাহ্ মোহা¤মদ (দঃ)কে লক্ষ্য করে আরো বলছেন,

‘‘অ মা যায়ালনা লি বাশারিম মিন ক্বাবলিকাল খুলদা, অফা ইম্মিত্তা ফাহুমুল খালিদুন’’

আপনার পূর্বে ত কোন লোককে আমি চিরস্থায়ী জীবন দান করিনি; সুতরাং আপনি যদি মারা যান, তা হলে সে কি আর টিকে থাকবে? (২১ ঃ ৩৪);তখন আল্লাহ্র এই কালামের কোন ফাঁক-ফোকর আবিষ্কার করে, সে ফাঁক-ফোকর দিয়ে হযরত ঈসা (আঃ)-কে টেনে বের করে এনে চৌথা‘ আসমানে চালান দিয়ে সেখানে এখনো তাঁকে সশরীরে বর্তমান রেখে এবং কিয়ামতের নজদিক দাজ্জালের হাত থেকে আমাদেরকে উদ্ধারের জন্য আবার সেখান থেকে ফেরেশতার কাঁধে চড়িয়ে মর্তের মাটিতে নামিয়ে আনার আশায় অনন্তকাল ধরে ভবিষ্যতের পানে চেয়ে চেয়ে আমাদের অন্তর ও চক্ষু বিনাশ করতে আমরা সম্পূর্ণ অক্ষম।

সুতরাং আল্লাহ্ যখন বলেছেন যে হজরত মোহা¤মদ (দঃ)-এর পূর্ববর্তী রাছুলগণ অতীত হয়ে গেছেন এবং তিনি মারা গেলে তাঁর পূর্বের কেউ এখনও টিকে থাকা অসম্ভব বলে যখন স্বয়ং আলা¬হ্ই জানাচ্ছেন, তখন হজরত ঈসা (আঃ) হজরত মোহা¤মদ (দঃ)-এর পূর্ববর্তী একজন রাছুল হওয়ায়, তিনি যে স্বাভাবিক ভাবেই অতীত হয়ে গেছেন এবং এখন আর টিকে নেই এ বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ।

সুতরাং হজরত ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু হয়ে যাওয়া সম্বন্ধে উপরে বর্ণিত এতগুলি দলিল ও যুক্তি প্রমাণ জানা থাকা সত্ত্বেও আমরা যদি এখনো তাঁর সশরীরে আকাশে জীবিত থাকার উপর ঈমান রাখি, তাহলে কি আমরা কোরান-হাদিস মান্যকারী হব, না কোরান-হাদিস অমান্যকারী হব?

এখানে আপনাদের জন্য একটি সুসংবাদ দিচ্ছি ঃ ‘বেদ্বীন’ কাদিয়ানীরা ১৯০৩ খৃষ্টাব্দ থেকে একটা চ্যালেঞ্জ দিয়ে আসছে। তা এই ঃ যদি কেউ কালাম-পাকের কোন আয়াত বা কোন মউজু হাদিসও দেখাতে পারেন যাতে হজরত ঈসা (আঃ)-এর সশরীরে আকাশে যাওয়া এবং পুনরায় আকাশ থেকে নাজেল হওয়ার কথা লেখা আছে, তা হলে তারা তাকে বিশ হাজার টাকা পুরস্কার দেবে। যদি কেউ এরূপ দেখাতে পারেন, তাহলে তারা তৌবা করবে এবং তাদের সমস্ত পুস্তক জ্বালিয়ে ফেলবে বলেও চ্যালেঞ্জে উল্লেখ করেছে।

এ চ্যালেঞ্জটা আপনারা একটু গ্রহণ করুন না। তারা তৌবা করুক বা না করুক, অন্ততঃ টাকাটা ত পাওয়া যাবে। আর যতদিন পর্যন্ত এই চ্যালেঞ্জ আপনারা গ্রহণ না করবেন, অন্ততঃ ততদিন পর্যন্ত কোন হৈ চৈ শোরগোল না করে একটু চুপ করে থাকতে পারবেন কি?

এবার আপনাদের দ্বিতীয় অভিযোগটি সম্বন্ধে আসা যাক।

প্রথমতঃ কোরান-পাকের সুরা আহ্যাবের একটি আয়াত, ‘‘মা কানা মুহা¤মাদান আবা আহাদিমর্মিরিজালিকুম অ লাকির রাছুলাল্লাহি অ খাতামান্নাবিয়্যিন’’ – মোহা¤মদ (দঃ) তোমাদের মধ্যস্থ কোন পুরুষের পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহ্র রাছুল এবং নবীগণের ‘খতম’। (৩৩ঃ৪০) দ্বিতীয়তঃ রাছুল করিম (দঃ)-এর বাণী – আনা খাতামান্নাবিয়্যিন লা নাবীয়া বা’দী’ – আমি নবীগণের ‘খতম’ ঃ আমার বা’দ কোন নবী নেই।

পাক কালামের উপরোক্ত আয়াত এবং নবী করিম (দঃ)-এর উপরোক্ত বাণী – এ দু’টিই হচ্ছে উ¤মতে মোহা¤মদীর চলার দুই ট্রাক (ঞৎধপশ)। রেল গাড়ী চলার ট্রাক এবং ইঞ্জিন পুরনো হওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া নষ্ট ও বিকল হয়ে যাওয়া সম্ভব এবং সময় সময় তা সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রয়োজন হলেও, উ¤মতে মোহা¤মদীর চলার ট্রাক কোন দিন পুরনো, নষ্ট বা বিকল হয়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই এবং তা’ সংস্কার ও পরিবর্তনেরও কোন প্রয়োজন  নেই।

অর্থাৎ হজরত ঈসা (আঃ)-এর চৌথা আসমানে গমন, সেখান থেকে নেমে আসা, হজরত ইমাম মাহ্দী (আঃ)-এর সঙ্গে মিলে মিশে ইহুদী-নাছারাদেরকে নিপাত করা এবং নয় হাত লম্বা গাধায় অরূঢ় দাজ্জাল বধ, প্রভৃতি সম্বন্ধে যেমনিভাবে আমরা নীল নক্সা তৈরী করে রেখেছি, তেমনিভাবে উ¤মতে মোহা¤মদী কিভাবে চলবে, কিভাবে হাশর-নশর হবে, কিয়ামতের দিন কিভাবে আমরা পূর্ববর্তী সমস্ত নবী রাছুল এবং উম্মতকে টপ্কিয়ে বেহেশতে পৌঁছে যাব, তারও একটা নীল নক্সা আমরা তৈরী করে রেখেছি। এই নীল নক্সার ব্যতিক্রম কোন কিছুই হতে পারবে না।

মানে, সর্বশক্তিমান বলে আল্লাহ্ যে একজন আছেন, তিনি না থাকলেও কোন ক্ষতি নেই। কারণ, কাকে কাফের, কাকে বেঈমান, কাকে দাজ্জাল, কাকে কাজ্জাব খেতাব দিতে হবে, আবার কাকে দোজখে, কাকে বেহেশতে দিতে হবে, নীল নক্সা অনুপাতে এর সব কিছুই আমরা করতে সক্ষম। সুতরাং শাইয়িন কাদির আল্লাহ্র প্রয়োজনটা কোথায়?

আর আল্লাহ্ যে বলেছেন, ‘ইন্নি আ’লামু মা’লা তা’লামুন’ – “নিশ্চয়ই আমি জানি যা তোমরা জান না” (২ঃ৩০)।

কালাম পাকের এই আয়াতটিই দেখছি এখন একদম সেকেলে হয়ে গেছে। শুধু এ-ই নয়, একটু সুক্ষ¥ দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে, সমগ্র কোরান পাককেই আমরা আউট ডেটেড্ করে রেখেছি। অথচ, এ কোরানের  মাহাত্ম্য প্রচারে আমরা এত উচ্চ-কণ্ঠ যে, ইস্রাফিলের শিঙ্গার হুঙ্কার ব্যতীত আমাদেরকে নিম্নকণ্ঠ করবে এমন সাধ্য কার!

রাজার ভা-ারে পর্যাপ্ত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও যদি প্রজা সাধারণ খেতে-পরতে না পায়, বা প্রজা সাধারণের এক শ্রেণী ফেলা-ছড়া করে খেয়েও শেষ করতে পারে না, আরেক শ্রেণী তাদের এঁটোও খেতে পায় না, তাহলে কি তেমন রাজাকে কেউ ন্যায় পরায়ণ, দয়ালু, প্রজাবৎসল বলে গণ্য করবে? নিশ্চয়ই না।

নবী-রাছুল বা নবুওত-রেছালত কি আল্লাহ্র অফুরন্ত ভা-ারের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বা নেয়ামত বই অন্য কিছু? আল্লাহ্-পাকের এ নেয়ামত বা পুরস্কারের দিকে লক্ষ্য করেই হজরত মুছা (আঃ) তাঁর কওমকে বলছেন ঃ “হে আমার কওম! তোমরা স¥রণ কর আল্লাহ্র নেয়ামতকে তিনি তোমাদের মধ্য থেকে নবীগণকে এবং বাদশাহ্গণকে বানিয়েছেন। তিনি তেমোদেরকে এত সব দান করেছেন দুনিয়া জাহানে যা আর কাউকে দেয়া হয়নি।’’(৫ঃ২০)

হজরত মুছা (আঃ)-এর পরও আল্লাহ্-পাক তাঁর কওমের মধ্য থেকে অনেক নবী এবং বাদশাহ্ বানিয়েছেন।

আর উ¤মতে মোহা¤মদীকে হজরত রাছুল করিম (দঃ)-এর মাধ্যমে স্বয়ং আল্লাহ্ প্রার্থনা শিখাচ্ছেন,

‘‘ইহ্দিনাছ ছিরাতল মুস্তাকিম ছিরাতল্লাজিনা আন আমতা আলইহিম।

আমাদেরকে সেই সোজা পথেই চালাও যে পথে চলে মানুষ তোমার পুরস্কার লাভ করেছে।’’

যে পথে চলে পূর্ববর্তী উ¤মত মহান আল্লাহ্র অফুরন্ত ভা-ারের শ্রেষ্ঠ নেয়ামত – নবী, ছিদ্দিক, শহীদ ও ছলেহীনদের মর্যাদা লাভে সমর্থ হয়েছিলেন; এক্ষণে আল্লাহ্ ও তাঁর রাছুল (দঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেক সেই পথে চলে দিনে পাঁচ ওয়াক্তে অন্ততঃ সতেরবার বাধ্যতামূলকভাবে সেই নেয়ামত প্রার্থনা করেও কি উ¤মতে মোহা¤মদীর আলেম-ওলেমাদের শিক্ষা মোতাবেক বিশ¡াস রাখতে হবে যে, সেই নেয়ামত লাভের পথ চিরতরে রুদ্ধ?

আল্লাহ্ ও তাঁর রাছুল (দঃ)-এর শিক্ষাকে অবিশ¡াস করে আলেম-ওলেমাদের শিক্ষাকে সত্য বলে মেনে নিতে পারলেই কি আমরা আল্লাহ্র দরবারে বিশ¡াসী বলে চিহ্নিত হব?

আর আল্লাহ্ ও তাঁর রাছুলের শিক্ষাকে  সত্য ও সঠিক বলে মেনে নিলে, আমরা কিভাবে বিশ¡াস করতে পারি যে, আল্লাহ্র ভা-ার – যে ভা-ারে পূর্ববর্তীকালে নবী, ছিদ্দিক, শহীদ ও ছলেহীনদের মর্তবা লাভের নেয়ামত ছিল, সেই ভা-ার এখন নিঃশেষ হয়ে গেছে?

হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-কে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী বলে স্বীকার করে নেয়া সত্ত্বেও যদি স্বীকার করতে হয়ে যে তাঁর উ¤মতের ভাগ্যে পূর্ববর্তী উ¤মতের ন্যায় আল্লাহ্র নেয়ামত আর জুটবে না, তাহলে তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী বলে প্রমাণ করার আর কি উপায় আছে?

এখন যদি আমরা বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে বিশ¡াস করি যে, আমাদের জন্য নবীও শেষ, নবুওতও শেষ এবং হযরত মোহা¤মদ (দঃ)-এর বাদ এ পর্যন্ত কেউ আসেনওনি, কিয়ামত পর্যন্ত আর কেউ আসবেনও না, তাহলে একটা কওম, একটা জাতি বা একটা উম্মতের পক্ষে এতিম হওয়ার জন্য এর চেয়ে দূর্ভাগ্যের কথা আর কি হতে পারে?

যদি বলা হয় যে, হজরত মোহা¤মদ (দঃ) হচ্ছেন হায়াতুন নবী বা জীবন্ত নবী এবং তিনিই আমাদের নেতা; তিনিই উম্মতে মোহাম্মদীকে চালাচ্ছেন, কিয়ামত পর্যন্ত তিনিই চালাবেন; তাহলে প্রশ্ন এই যে, তাঁর নবুওতী নেতৃত্বাধীন চলে চলেই কি আজ আমরা ইহুদী, নাছারা, নাস্তিক, মোশরেক প্রভৃতি জড় ও বস্তু পূজারীদের পদতলে স্থান পেয়েছি? হজরত মোহা¤মদ (দঃ)-এর নবুওত ও তাঁর নেতৃত্বকে অপমানিত করার জন্য এর চেয়ে বড় অপবাদ আর কি হতে পারে?

আবার যদি বলা হয় যে, উম্মতে মোহাম্মদীর আলেম-ওলেমা, পীর-বুজুর্গ, অলী-দরবেশগণই নবী করিম (দঃ) এর ওয়ারেছ হিসাবে আল্লাহর কালাম কোরান এবং রাসুল করিম (দঃ) এর পবিত্র বাণী আল-হাদিস মোতাবেক উম্মতে মোহাম্মদীকে শিক্ষা দিচ্ছেন এবং পরিচালনা করছেন, তাহলেও প্রশ্ন এই যে, কোরান-হাদিসের শিক্ষা লাভ করেই কি বর্তমানে আমরা ফেরকায় ফেরকায় বিভক্ত হয়ে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ফতোয়া বাজীতে লিপ্ত রয়েছি? হযরত নবী করিম (দঃ) এর ওয়ারেছদের যোগ্যতাকে হেয় প্রতিপন্ন এবং পবিত্র কোরান ও হাদিসের শিক্ষাকে অপবিত্র করার জন্য এর চাইতেও জঘণ্য ষড়যন্ত্র আর কি হতে পারে?

তাহলে, একটি কওম, একটি জাতি বা একটি উ¤মত হিসেবে আমাদের বর্তমান অবস্থা ও অবস্থান সম্বন্ধে আমরা কতটুকু সচেতন? এটা অতি উচ্চ স্তরের কথা। সুতরাং আমার মত নগণ্য গোনাহ্গারের পক্ষে কোন কথা বলা ‘হাতি-ঘোড়া গেল তল, ভেড়া বলে কত জল’-এর মতই হবে। তবুও, ফাঁসির আসামী যাচ্ছে-তাই বললেও যেমন সে তার দ-বৃদ্ধির আর কোন আশঙ্কা করে না, আমার অবস্থাও তদ্রƒপই প্রায়।

রবিউল আউয়াল আসলে নবী করিম (দঃ)-এর কীর্তন গাওয়ার ধুম-ধাম, রমজান আসলে হোটেল রেস্তোরাঁর দরজা-জানালায় পর্দা টানানো, আল-আকসা বা ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে কিছু হৈ চৈ বিক্ষোভ প্রদর্শন – এতটুকুই ত আমাদের চেতনা, তা নয় কি? আর ওয়াজ মাহ্ফিলে, ধর্মীয় সভা-অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তিটি থেকে শুরু করে লেন-বাইলেনের মসজিদের ইমাম সাহেব পর্যন্ত সবারই মুখে একই অমূল্য উপদেশ ঃ ‘‘আমাদের নবী করিম (দঃ)-এর আদর্শ এবং কোরান-হাদিসের শিক্ষাই সমস্ত সমস্যার সমাধান দিতে পারে।’’ – এওত আমাদের চেতনা।

কিন্তু এই অমূল্য উপদেশ বাণী গ্রহণ করে আমাদের অতলস্পর্শী সমস্যাবলীর সমাধান করতে কে বাঁধা দিচ্ছে? এক আল্লাহ্ ব্যতীত আবার কোন্ ‘ইলাহ্’ এসে আমাদের ঘাড়ের উপর চেপেছে, যে জন্য এ উপদেশ গ্রহণ করে আমরা কোন সমস্যাই সমাধান করতে পারছি না?

কোথায় কোন্ এক মসজিদের কিছু আস্তর খুলে ফেলা হয়েছে, বা কোথায় কোন্ কোরান শরীফ ছাপতে গিয়ে ভুলে-ভালে কোন মানুষের ছবির ছাপ লেগে গেছে, তা নিয়ে আমাদের হৈ চৈ শোরগোলের সীমা নেই। মনে হচ্ছে যেন এর চেয়ে সাঙ্ঘাতিক আর কোন কিছুই আমাদের ইসলামের ঘটেনি। আমাদের ইসলাম-চেতনা ত এ পর্যন্তই। ইসলামের শিক্ষা এবং আদর্শ কি এখানেই সীমাবদ্ধ? আর এখানেই কি নবী (দঃ), তাঁর উ¤মত এবং আল্লাহ্র দ্বীন-ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব?

বর্তমান বিশে¡ চল্লিশাধিক রাষ্ট্র আছে যেখানে মুসলমানগণই সংখ্যাগরিষ্ট এবং সেখানকার হর্তা-কর্তাও মুসলমানই। কই! কোথায় সেই ইসলামের সৌন্দর্য আর কোথায় ইসলামের সেই বল-বীর্য? রাম-রাজত্বের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে কোন গায়ের-হিন্দুকেই যেমন আর হিন্দু ধর্মে আকৃষ্ট করা সম্ভব নয়, ইসলামের অতীত গৌরব মাহাত্ম্য বর্ণনা করেও কোন অমুসলমানকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করাও তেমনি সুদূর পরাহত। কেউ কেউ হয়ত অতি সম্প্রতি সৌদি আরবে বা এদিক ওদিক কিছু লোকের ইসলাম গ্রহণের উদাহরণ দিতে পারেন। এর চাইতেও অধিক সংখ্যায় মুসলমান যে মিশনারীদের কল্যাণে খ্রিষ্টান হচ্ছে, সে খবর আমরা কতটুকু রাখি? বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে ইসলামী রাষ্ট্রে সে সব খবর সাধারণতঃ প্রকাশ করা হয় না। আর প্রকাশ্যে ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। কার্যতঃ ইসলামের বা কোরানের কোন্ বিধানটি দেশে চালু আছে? আর কোরান ও ইসলাম বিরোধী আইন যে দেশে দেশে চলছে, তা কি আমাদের চেতনায় আসছে?

সুতরাং হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী, নাছারা প্রভৃতি অতীত ধর্মগুলোর মতই ইসলামও যে বর্তমান আলেম-ওলেমা-পীর-বুজুর্গদের এত চেঁচামেচি সত্ত্বেও অতীত হয়ে যাচ্ছে, এ চেতনা কি আমাদের আছে?

আমাদের এ কথা শুনলেই আমার ভাইদের চৈতন্যোদয় হয়। তখন তারা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন ঃ “বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি কি শুনতে পান না?” মনে হচ্ছে যেন বিশ্বে কোথাও সকাল-সন্ধ্যায় মন্দিরে-গীর্জায় ঘণ্টা আর বাজে না, উলুধ্বনি আর হয় না। এ সবের কথা না হয় বাদই দিলাম। এখন যে রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, ট্রেনে-স্টীমারে-লঞ্চে সর্বত্রই তাল-লয়-মানে সপ্তসুরে ‘আযান’ শুনছি , এটা কি আমাদের আলেম-ওলেমাবৃন্দ মোটেও শুনতে পান না? আর বর্তমানে এই ‘আযান’ শুনার জন্যই না টেঁকের পয়সা খরচ করে মানুষ রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বলুন ত, কোন্ আযানের আকর্ষণটা বেশী?

পাপ ও পূণ্যের দোহাই দিয়ে দোযখের ভয় আর বেহেশতের আশার কথা শুনিয়ে জনতার এ গতি রোধ করবেন আপনারা? দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে পূণ্য অর্জনের বদলা মৃত্যুর পর বেহেশ্ত্ লাভের আশায় বসে থাকাকে তারা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার মতই অলীক কল্পনা বলে মনে করছে।

কি ভাবছেন?

তাদেরকে বেদ্বীন কাফের বলে দোযখে ঠেলে দিয়ে আপনারা সোজা বেহেশতে চলে যাবেন? তাদের সম্বন্ধে কি আল্লাহ্র কাছে বলবেন যে, ‘‘হে আল্লাহ্! আমরা তোমার কথা বলেছিলাম; কিন্তু আমাদের কথা তারা মোটেও বিশ্বাস করেনি; বরং অলীক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিয়েছে?’’

এর উত্তরে আল্লাহ্ যদি আপনাদেরকে বলেন, ‘‘আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোন্ আহ¡ানকারী এসেছিল যার আহ¡ানে সাড়া দিয়ে তোমরা বলেছিলে,

রাব্বানা ইন্নানা সামি’না মুনাদি আইউ নাদি লিল ঈমানে আন আমেনু বি রাব্বিকুম ফা আমান্না’’

হে আমাদের রব! নিশ্চয়ই আমরা শুনেছি একজন আহ¡ানকারী ঈমান আনার জন্য ডেকে বলেছে ঃ তোমরা তোমাদের প্রভুর উপরই ঈমান আন। অতঃপর আমরা ঈমান আনলাম?

আল্লাহ্র এই প্রশ্নের উত্তরে আপনারা কি বলবেন যে, “হে প্রভু! আপনার পক্ষ থেকে ত কোন আহ¡ানকারী আপনার উপর ঈমান আনার জন্য আহ¡ান করেননি?” নাকি বলবেন “হাঁ, আপনার প্রিয় হাবিব হজরত মোহা¤মদ (দঃ) আমাদের কাছে এসেছিলেন, এবং আপনার উপর ঈমান আনার জন্য আমাদেরকে বলেছিলেন, তাঁর আহ¡ানেই আমরা সাড়া দিয়েছিলাম?”

যদি প্রথমোক্ত উত্তর দেয়া হয়, তাহলে আমরা হব মিথ্যাবাদী। কেননা, কোন আহ¡ানকারী আমাদের কাছে এসে আহ¡ান না করে থাকলে আমরা কি ভাবে বলছি যে, একজন আহ¡ানকারীকে ঈমান আনার জন্য আহ¡ান করতে নিশ্চয়ই আমরা শুনেছি? আর যদি দ্বিতীয় উত্তরও দেয়া হয়, তাহলেও আমরা মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হব। কেননা, হজরত রাছুলে করিম (দঃ) স্বয়ং আমাদের কাছে আহ¡ান করতে আসেন নি। তিনি স্বয়ং এসে যদি আমাদেরকে আহ¡ান করতেন, তাহলে আমরা আজ এত দল ও ফেরকায় বিভক্ত হয়ে যেতাম না, আর আমাদের এমন অধঃপতনও হত না।

সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজেরাই কোন আহ¡ানকারীর আহ¡ানে সাড়া দিয়ে ঈমান আনতে না পারছি, ততক্ষণ অপর কেউ আমাদের আহ¡ানে সাড়া দিতে না পারলে তাকে কি খুব একটা দোষ দেয়া যায়? আর তাকে কাফের বেদ্বীন বলে দোযখের দিকে ঠেলে দিয়ে আমাদের সোজাসুজি বেহেশতে চলে যাওয়ার আশা করা কি অলীক কল্পনা নয়?

এর পর কি বলবেন? চৌদ্দশ’ বছর ধরে আলেম-ওলেমা-পীর-বুজুর্গ-ইমাম-মোজতাহেদ-মোহাদ্দেছগণ কি তবে ভুল শিক্ষা দিয়ে এসেছেন? তারা কি করেছেন, না করেছেন, সে বিষয়ে আমাদেরকে দায়ী করা হবে না, আমাদের কাজের জন্যও তাদেরকে দায়ী করা হবে না। এ-ওত কোরানেরই শিক্ষা।

বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের দোহাই দিয়ে আমাদের পূর্বেও কত জাতি প্রেরিত পুরুষদেরকে অস্বীকার করে ধ্বংস হয়ে গেছে, এ বর্ণনা কি কোরান-পাকের মধ্যে আমরা পাইনি? আমাদের কাছে পবিত্র ঐশী গ্রন্থ মৌজুদ থাকা এবং রীতিমত তা পাঠ করা সত্ত্বেও যদি আমরা সচেতন না হই, তাহলে আমাদের গতির এই নিম্ন ধারা আর কি ভাবে পরিবর্তিত হবে?

আর হজরত রাছুলে করিম (দঃ)-এর পর আর কেউ আসেননি, আর আসবেনওনা – এটা কি সত্য কথা? তিনি কি বলেন নি, প্রতি শতাব্দীর শিরোভাগে এক একজন মোজাদ্দেদ প্রেরিত হবেন, ইমাম মাহ্দী (আঃ) আসবেন? তাঁরা সবাইত আল্লাহ্র প্রেরিত, মনোনীত বান্দা, তা নয় কি? কিন্তু তাঁদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিটা একটু ভিন্ন ধরণের, অর্থাৎ তাঁদেরকে নবী-রাছুলগণের চেয়ে একটু নীচু স্তরের মনে করি, তা নয় কি? তাঁদের প্রতি আমাদের ‘চাউনি’ যে ধরণেরই হোক না কেন, আল্লাহ্র রাছুল (দঃ) তাঁদেরকে বনী-ইসরাইল নবীগণের সম মর্যাদাভুক্ত বলেই জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আমরা তাদেরকে যে নজরেই দেখিনা কেন, মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাছুলগণের নিকট তাঁদের মর্যাদা বনী-ইসরাইল নবীগণের সমতুল্যই।

আর আল্লাহ-পাক বলছেন, “তোমরা যারা ঈমান এনেছ শোন! তোমরা সবাই আল্লাহর অনুগত হও, আর রাছুলেরও অনুগত হও, আর তোমাদের মধ্যে যারা ব্যবস্থাপক তাদেরও অনুগত হও। কোন বিষয়ে তোমরা যদি বিতর্কে লিপ্ত হও, তা হলে সে বিষয়ে আল্লাহর কাছে, তাঁর রাছুলের কাছেই রুজু কর, যদি তোমরা সত্যই আল্লাহর উপরে, আর কিয়ামত সম্পর্কে আস্থাবান হয়েই থাক। এ কাজত খুবই ভাল এর পরিণামও যে চমৎকার হবে” (৪ঃ৫৯)। “আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করছে: আপনার কাছে যা নাজেল হয়েছে আর আপনার আগেও যা নাজেল হয়েছিল, এ সবে তারা আস্থাবান। অথচ তারা নিজেদের সমস্যাদি নিয়ে শয়তানের কাছেই যায় সমাধানের জন্যে, কিন্তু তাকে অমান্য করার জন্যই হুকুম দেয়া হয়েছে। আসলে শয়তান ওদেরকে বিভ্রান্ত করে দূরেই সরিয়ে নিতে চায়” (৪ঃ৬০)।

প্রথমত: আমাদেরকে আল্লাহ্, তাঁর রাছুল ও তারপর রাছুলের আমীরকে এতায়াত করার হুকুম দেয়া হয়েছে। আমরা যদি কোন বিষয় মতভেদে পড়ি, তা হলে, তা’ আল্লাহ ও তাঁর রাছুলের দরবারেই রুজু করার নির্দেশ। বর্তমানে আমরা যে মত পার্থক্যে পড়েছি এর মীমাংসার জন্য এখন আমরা কার কাছে যাব? কার মীমাংসা আমরা সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিতে পারি? সে ব্যক্তিটি কে যার মীমাংসাকে সর্বোত্তম মীমাংসা বলে গ্রহণ করতে পারি এবং যার মীমাংসা মান্য করে চললে বিশ্ব মুসলিম ইহকালে শান্তি এবং পরকালে মুক্তিও পেতে পারে? অর্থাৎ বিশ্ব মুসলিম নেতৃত্ব দেবার জন্য কাকে সর্বোত্তম ব্যক্তি বলে গ্রহণ করতে পারে? বিশ্বের কথা না হয় বাদই দিলাম, অন্তত: বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে নেতৃত্ব দেবার জন্য আমরা কাকে উপযুক্ত বলে মান্য করতে পারি? এ প্রশ্নের সমাধান বিশ্বের কোন মুসলমান দিতে পারবেন কি? হ্যাঁ, এ সমস্যার সমাধানের জন্য আপনারা গণভোটের প্রস্তাব দিতে পারেন, তা’ আমরা মানি।

আল্লাহর হুকুমের বরখেলাপ করে আমরা যখন ফেরকায় ফেরকায় বিভক্ত হয়েই পড়েছি, আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য গণভোটের মাধ্যমে একজন ইসলামী নেতা নির্বাচন করার ব্যবস্থা না হয় একটা করেই দেখুন না! পারবেন কি? আর গণভোটের মাধ্যমে একজন নেতা নির্বাচিত হলেই কি সবাই তাকে মান্য করে চলবে? ধরুন, আটরশীর পীর সাহেব কেবলা নির্বাচিত হলেন। তাঁকে কি তাবলীগিরা, লালবাগ, শর্ষিনা বা অন্যান্য পীর সাহেব কেবলাগণ মান্য করে নিবেন? এ ব্যবস্থা আপনারা করতে পারবেন বলেও মনে হয় না; আর পারলেও তাকে সবাই মান্য করে চলবে বলে আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাদের বিশ্বাস অবিশ্বাসে কিছু যায়-আসে না। তবুও একটু চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? তবে এ সঙ্কট উত্তরণের জন্য আল্লাহর দিকে রুজু হতে আমাদের কি কোন দোষ আছে? তিনিই ত সকল বিষয়ের উত্তম ফয়সালাকারী।

জানি এখানেও আপনাদের আপত্তি আছে। আপনাদের আপত্তি হল, আল্লাহ কি ভাবে এর মীমাংসা করবেন? মনে হচ্ছে যেন, তিনি কিভাবে এর ব্যবস্থা করবেন, সে সম্বন্ধে আপনাদের সঙ্গে তাঁর শলা-পরামর্শ প্রয়োজন আছে; তা না হলে তাঁর ব্যবস্থা আপনারা মানবেন কেন? ঠিকই ত! আপনাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছু করলে, আপনারা আশংকা করছেন, আপনাদের তৈরী নীল নক্সা যে ভেস্তে যাবে। আপনাদের সকল শিক্ষা দীক্ষা যে মাঠে মারা যাবে। সুতরাং আল্লাহ যা-ই কিছু করুন না কেন, আপনারা তা ঠেকিয়ে রাখবেন, এ-ই ত? তা হলে আসুন, আপনারাও অপেক্ষা করুন; আমরাও অপেক্ষা করছি। দেখি, আল্লাহ কি ভাবে এর ফয়সালা করেন।

আর আল্লাহর ফয়সালা সম্বন্ধে আমরা যে বুঝ পেয়েছি তা’ অতি পুরাতন, অতি সহজ, অতি স্বাভাবিক, বহুবার সংঘটিত এবং বহুল আলোচিত একটা নিয়ম মাত্র। তা হল, আমাদের মধ্য থেকেই আমাদের জন্য একজন নেতা নির্বাচন। তবে এ নির্বাচন আমরা নিজেরা করতে গেলে, কারো পছন্দ হবে, আবার কারো পছন্দ হবে না; সেহেতু এ নির্বাচন হতে হবে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে। অর্থাৎ একজন প্রেরিত পূরুষের আবির্ভাব।

প্রেরিত পূরুষের আবির্ভাব হলেই যে বিশ্ববাসী সবাই একবাক্যে তাকে মেনে নিবে, তা-ও নয়। কারণ, শয়তান ত আর মরে যায়নি। সে ত প্রতিজ্ঞাই করেছে যে, সে আদম সন্তানদের সম্মুখে পশ্চাতে, ডানে বামে সকল দিকেই ওঁৎ পেতে থাকবে। আর আল্লাহও জানিয়ে দিয়েছেন যে, যারা তার অনুসরণ করবে এবং তাকেই বন্ধু বলে গ্রহণ করবে, তাদের দিয়েই দোজখ ভরে ফেলবেন। সুতরাং প্রেরিত পুরুষ আসলেই সবাই যে তাকে মেনে নিবে তা ত হতেই পারে না। তা হলে লাভটা কি?

লাভ এই যে তাঁর আগমনে মানুষ দু’টো ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। একটি দল তাঁকে বিশ্বাস করে নিয়ে তাঁর আনুগত্য করবে। অপর দলটি তাঁকে অবিশ্বাস করে বিরোধিতা করবে। সর্বশেষ, অবিশ্বাসী দলটিকে আল্লাহ ধ্বংস করে দেবেন, যেমনিভাবে তিনি ধ্বংস করেছেন, হযরত নূহ (আঃ) এর কওমকে, আদ ও ছামুদ জাতিকে। আর বিশ্বাসী দলটিকেই তিনি পৃথিবীর উত্তরাধিকারিত্ব দান করবেন। এ-ই ত হচ্ছে আল্লাহর চিরন্তন নিয়ম। আমরা ত এই নিয়মের কথাই বলছি। আমাদের এ কথাটি কি কোরান-হাদিস বিরোধী হল? এই নিয়মের কথাই না পবিত্র ঐশী গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে বারে বারে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন এবং আমাদেরকে সচেতন হতে বলেছেন? এতে যদি আমরা সচেতন না হই, তা হলে কি হবে সে কথাও ত তিনি আমাদেরকে বলে দিয়েছেন। আল্লাহ পরিষ্কারভাবে বলছেন, তিনি যদি ইচ্ছা করেন তা হলে তোমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। শোন, হে মানব জাতি! তিনি অন্যদেরকে নিয়ে আসবেন। আল্লাহ একাজটির ক্ষমতাও যে রাখেন (৩ঃ১৩৩)। আর আপনারা আল্লাহর ইচ্ছাকে ঠেকিয়ে রাখবেন? তা হলে শুনুন তিনি কি বলেছেন, “কোনও কাজ তোমাদের ইচ্ছায় হবে না। আর কিতাবীদের ইচ্ছা মতও কিছু হবার নয়। যে কেউ খারাপ কাজ করবে, তার বিনিময় সে পাবেই। সে ত আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সাহায্যকারী কিংবা বন্ধুরূপে পাবে না” (৪ঃ১২৩)।

তিনি কি বলছেন আরও একটু শুনুন, “ওহে কিতাবীগণ! তোমাদের কাছে আমার রাছুল এসেছেন, এখন ত তিনিই তোমাদের বুঝিয়ে বলছেন, রাছুলগণের আগমন শেষ হওয়ার পরে, যেন তোমরা বলতে না পার, আমাদের কাছে ত কোনও সুসংবাদদাতা আসেননি, কোন সতর্ককারী আসেন নি। এখনত তোমাদের কাছে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এসে পড়েছেন। আসলে আল্লাহ তায়ালাই ত সকল বিষয়ে শক্তির একমাত্র অধিকারী!” (৫ঃ১৯)

ভয়ের কোন কারণ নেই। এই আয়াত ত আর আপনাদেরকে লক্ষ্য করে নাজেল হয়নি! আহলে-কিতাবী ইহুদী-নাছারাদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ এই আয়াত নাজেল করেছেন! সুতরাং আপনাদের আর ভয়ের কারণ কি? আপনারা ত আর আহলে কিতাবী নন্। আপনাদের কাছে ত কোন কিতাব নাজেল হয়নি, আর কোন কিতাব আপনরা পাঠও করছেন না! তা হলে, আপনারা আর কিভাবে আহলে-কিতাবী হবেন? তবে এখানে আমাদের লক্ষ্য অন্য বিষয়।

এখানে বলা হচ্ছে যে রাছুলগণের আগমন শেষ হয়ে যাওয়ার পরও হযরত রাছুলে করিম (দঃ) কে আল্লাহ পাঠিয়েছেন যেন আহলে কিতাবীরা এই বলে কোন ওজর-আপত্তি পেশ করতে না পারে যে, “আমাদের কাছে ত কোন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী আসেন নি।” তা হলে, আমরাও কি এ ওজর পেশ করতে পারি না যে, “হে আল্লাহ! রাছুলগণের আগমন শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আহলে কিতাবীগণ যাতে কোন ওজর পেশ করতে না পারে সে জন্য একজন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী পাঠিয়েছিলেন। সেই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীর চলে যাওয়ার পরেও ত চৌদ্দশ বছর গত হয়ে গেছে। আর আজ মতভেদ, লজ্জা অপমান, অভাব অনটন, শেরেকী নাস্তিকতা ও জড়বাদ চারিদিক থেকে আমাদেরকে গিলে ফেলেছে। সর্বশেষ গ্রন্থধারীরাও এক একজন সূর্যের মতই জ্বল জ্বল করে জ্বলছে, কিন্তু তুমি এখন কোন দিকে কার সাথে আছ, তা’ত আমরা কিছুতেই ঠাওর করতে পারছি না। এখন যদি আমাদের কাছে কাউকে তুমি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী বানিয়ে না পাঠাও, তা হলে, খেয়াল-খুশী মত আমরা যা কিছু করি না কেন, আমাদেরকে তুমি কিন্তু কোন কৈফিয়ত তলব করতে পারবে না।”

হযরত ঈসা (আঃ) এর ছ’শ বছর পরেই হযরত রাছুলে করিম (দঃ) না আসলে যদি আহলে কিতাবীদের পক্ষ থেকে এইরূপ ওজর পেশ করার কারণ থাকতে পারত, তাহলে চৌদ্দশ বছর পরেও যদি আমাদের কাছে কেউ না আসেন, আমাদের পক্ষ থেকে কি এইরূপ ওজর পেশ করার অধিকতর কারণ থাকতে পারবে না? আর, আমরা যাতে এইরূপ ওজর পেশ করতে না পারি তিনি কি সেইরূপ ব্যবস্থা করবেন না, যেইরূপ ব্যবস্থা তিনি আহলে কিতাবীদের জন্য করেছিলেন? না কি আমাদের ওজর শুনে লা জওয়াব হয়ে থাকার ব্যবস্থাই তিনি পছন্দ করবেন? আল্লাহ পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন, “রাছুলগণ ত সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী যেন তাদের আসার পরে লোকজন আর আল্লাহর উপরে অভিযোগ তোলার মত সুযোগ না পায়। আল্লাহই ত পরাক্রমশালী ও পরম কুশলী” (৪ঃ১৬৫)।

বলুন ত, আমাদের এ আলোচনা কি কোরান-হাদিস বিরোধী হল, না যুক্তি বিরুদ্ধ হল? তা না হয়ে থাকলে আমাদের বিরুদ্ধে আপনারা এত ক্ষ্যাপা কেন?

উল্লিখিত আয়াত ছাড়াও কোরান পাকে আরও আয়াত রয়েছে। যেমন, আল্লাহ বলেছেন, “আহলে- কিতাবীদের মধ্যে কাফির ও মোশরেক, তারা কিছুতেই চায় না যে তোমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে তোমাদের কাছে কোন ভাল কথা নাজেল হোক। অথচ আল্লাহ যাকে খুশী নিজের কাছ থেকে বিশেষ ভাবে রহমত দান করেন। আল্লাহই হচ্ছেন মহাকল্যাণের অধিকারী” (২ঃ১০৫)।

আল্লাহ আরো বলেছেন, “কিতাবধারীদের মধ্যে একদল বলল, এসো তোমরা! মুসলমানদের কাছে যা নাজেল হয়েছে, তার উপর সকাল বেলা ঈমান আনি, আর বিকালে সবাই অস্বীকার করি। তখন হয়ত তারাও ফিরবে। কিন্তু কারোর সামনে বসেই ঈমান আনবে না, শুধু নিজেদের সঙ্গী সাথী ছাড়া। আপনি (হে মোহাম্মদ!) বলুন, নির্দেশ সে ত আল্লাহরই। এমন ধারা বলছ শুধু এই জন্যই ত যে তোমাদের কাছে যা এসেছে তেমন জিনিস আরেকজন কেন পাচ্ছে? কিংবা আর কোনও দল হয়ত তোমাদের পালনকর্তার কাছে তোমাদের তুলনায় বেশী সাফল্য লাভ করবে? আপনি (হে মোহাম্মদ) ‘ফজল’ – সে ত আল্লাহর ইখ্তিয়ারেই রয়েছে। যাকে খুশী তাকেই তিনি দান করেন। আল্লাহ বিশাল ব্যক্তির অধিকারী। তিনিই সব কিছু জানেন। যাকে খুশী তাঁর রহমত বিশেষভাবে দান করেন। আল্লাহ বিপুল ‘ফজলের’ অধিকারী” (৩ঃ৭২-৭৪)।

উদ্ধৃত আয়াতে ‘ফজল’ শব্দের অর্থ অনেক তফছীরকারকই ‘নবুওয়তের সম্পদ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

তা হলে, আল্লাহর ধন ভা-ার যে ‘ফজল’ শূণ্য এবং তা যে তিনি আর কাউকে দান করতে পারবেন না- এ কথাই কি তিনি পবিত্র কালামের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাচ্ছেন? বরং তাঁর রহমত ‘ফজল’ থেকে নিরাশ হতেই ত তিনি আমাদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

তা হলে, আল্লাহ আর কাউকে তাঁর নবুওয়তের ‘ফজল’ দান করবেন না- একথার উপর ঈমান রাখলেই কি আমরা কোরান-বিশ্বাসী ও কোরান মান্যকারী সাব্যস্ত হব?

মহান আল্লাহ আরো বলেছেন, “শয়তান তোমাদেরকে অভাবের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, আর বেহায়াপনার আদেশ দিচ্ছে। আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা ও ধন সম্পদের ওয়াদা দিচ্ছেন। আল্লাহ যাকে খুশী ‘হিকমত’ দান করেন। যাকে ‘হিকমত’ দান করা হয়েছে সে ত অনেক গুণের অধিকারী! তবে উপদেশ তারাই গ্রহণ করে যারা জ্ঞানী” (২ঃ ২৬৮-২৬৯)।

এই উদ্ধৃত আয়াতেও তফছীরকারকগণ ‘হিকমত’ শব্দের অর্থ নবুয়তী জ্ঞানের কথা বলেছেন।

ব্যক্তিগত এবং জাতিগতভাবে বর্তমান মুসলমানদের যে দৈন্য দশা, এর মূলে কি শয়তানের শিক্ষা এবং তার পথ অনুসরণ নয়? তা না হলে, আল্লাহ যেখানে ক্ষমা ও ধন সম্পদের ওয়াদা দিচ্ছেন, সেখানে আমরা কেন অশান্তি ও অভাব অনটনে ত্রাহি ত্রাহি করছি? আমরা যদি তাঁর প্রিয়তম উম্মতই হব, তা হলে তাঁর হেকমতের কোন একটা দিকই কি আমাদের ভাগ্যে জুটত না? বলুন ত, ‘খাইরা উম্মাতিন উখ্রে যাতি লিন্নাস’- বর্তমান বিশ্বে কোন্ ‘হিকমতের’ অধিকারী হতে পেরেছে? আমাদের জীবনের কোন দিকটি আছে যা ইহুদী নাছারা নাস্তিক মোশরেকদের ‘হিকমতের’ দান ছাড়া নির্বাহ হচ্ছে?

‘উম্মতে মোহাম্মদী’ এখনও কিসের আস্ফালন করছে? বেহেশতের? মৃত্যুর পর সোজা বেহেশতে চলে যাবে- এই আশার আস্ফালন?

দুনিয়াতে আল্লাহ যাদেরকে ইজ্জত দিলেন না, মৃত্যুর পর আল্লাহ তাদেরকে দেবেন বেহেশত? আল্লাহ না বলেছেন, “আল ইজ্জাতু লিল্লাহি, অলি রাছুলিহি অলিল মু’মিনিনা”।

“ইজ্জত হলো আল্লাহর, তাঁর রাছুলের এবং মুমিনের জন্য”। অবশ্য বেহেশত দোজখের খবরদারী কোন বান্দাকে দেয়া হয়নি। যাকে ইচ্ছা তাকেই তিনি শাস্তিও দিতে পারেন, আবার যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি মাফও করতে পারেন, সকল বিষয়েই আল্লাহ সর্বশক্তিমান।

রাস্তার পাশে বসে যে ভিক্ষুকটি সারাদিন একইভাবে ‘আল্লা’ ‘আল্লা’ এবং ‘ছল্লে আলা ছাইয়্যেদেনা’ বলে যিক্র করছে- এর দ্বারা তার নিজের, তার জাতির বা তার ধর্মের কি কোন গৌরব বৃদ্ধি পাচ্ছে, না কমছে? সুতরাং ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে বয়ে বাদশার বদান্যতার প্রশংসা যতই করা হোক না কেন, তাতে বাদশার সম্মান কমে ছাড়া বাড়ে না। তদ্রƒপ লজ্জা-অপমান পরাজয়-লাঞ্ছনার বোঝা কাঁধে বয়ে শ্রেষ্ঠ নবীর ‘নাত’ আমরা যত উচ্চাঙ্গেই গাহি না কেন, তাতে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব কমে ছাড়া বাড়ে না। যদি সত্যিকার ভাবেই আমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করতে চাই, তা হলে সর্বাগ্রে আমাদের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে।

কিন্তু, কিরূপে?

পরম করুণাময় ও দয়াময়ের ফজল ও রহমত লাভ ব্যতীত শ্রেষ্ঠত্ব লাভের দ্বিতীয় কোন উপায় আছে বলে আমাদের জানা নেই। আর যখন ‘ফজল’ লাভের এই প্রার্থনা সর্বাগ্রেই আল্লাহ আমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে রেখেছেন এবং আমরা যখন সেই ফজল লাভের প্রার্থনা অহরহ পাঠও করছি; তখন যদি তিনি আমাদেরকে এই ফজল দান করেন, আর আমরা তা অস্বীকার করি, তা হলে আমরা মানবজাতির জন্য নির্ধারিত অভিসম্পাত লাভ করব না ত, শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান লাভ করব? লানতের ‘শ্রেষ্ঠ’-তওক্ কণ্ঠে বয়ে বেড়াচ্ছি, আর এটাকেই আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত বলে আস্ফালন করছি! শয়তান আর কাকে বলে! আল্লাহ তাকে অভিশাপ দিচ্ছেন। আর, জিদের বশে সে এই অভিশাপকেই কণ্ঠে ধারণ করে বয়ে বেড়ানোর জন্য কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ চাচ্ছে। কি অদ্ভুত শয়তানের এই মানষিকতা!

এবার আপনাদের দলিলটি যা দিয়ে আমাদেরকে কাফের বেদ্বীন হিসাবে হত্যার যোগ্য বলে প্রমাণ করছেন, তা‘ নিয়ে একটু আলোচনা করি।

সুরা আযহাবের উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ বলছেন, “মোহাম্মদ (দঃ) তোমাদের মধ্যস্থ কোন পুরুষের পিতা নন্, বরং তিনি আল্লাহর রাছুল এবং নবীগণের খতম”।

কেউ যদি আপনাকে বা আমাকে লক্ষ্য করে বলে যে, ‘বংশে বাতি দেবার মত তার কোন পুত্র সন্তান নেই’- এ কথার দ্বারা কি আমাদের কারো কোন সম্মান বৃদ্ধি পাবে? বরং এরূপ কথার দ্বারা আমার বা আপনার ‘লেজ-কাটা’ হওয়ার অপবাদই সাব্যস্ত হচ্ছে। আবু জাহেল, আবু লাহাব গং হযরত রাছুলে করিম (দঃ) কে এরূপ একটি অপবাদই দিয়েছিল, তা নয় কি? আয়াতের এই অংশে আবু জাহেল আবু লাহাবের দেয়া অপবাদটির আপাত: সত্যতা প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে দেখে, আল্লাহ এই অপবাদটির খ-ণার্থে ‘অলাকেন’ শব্দ ব্যবহার করে আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ জানাচ্ছেন যে, তিনি আল্লাহর রাছুল। কিন্তু এ কথার দ্বারাও পূর্ববর্তী অপবাদের পুরাপুরি খ-ণ হচ্ছে না, কারণ আল্লাহর রাছুল হলেও তাঁর পুত্র সন্তান থাকতে কোন বাঁধা নেই; কেননা, পূর্ববর্তী অনেক রাছুলেরই পুত্র সন্তান ছিল এবং কেউ কেউ নবীও হয়েছিলেন। তাই পরবর্তী অংশে আল্লাহ জানিয়ে দিলেন যে, মোহাম্মদ (দঃ) ‘খাতামান্নাবিয়্যিন’। এখানে যদি এ শব্দটির অর্থ ‘নবীগণের শেষ’ করা হয়, এতে হযরত মোহাম্মদ (দঃ) এর কি কোন গৌরব বাড়ল? একে ত তাঁর কোন পুত্র সন্তান নেই, দ্বিতীয়ত: তাঁর নবুয়তের সত্যতার তছদীককারী হিসেবে অন্য কোন নবীও আর আসবেন না, এরূপ কথা দ্বারা তাঁর গৌরব কিভাবে বৃদ্ধি পেল, তা’ত আমরা কোন যুক্তিতেই বুঝে উঠতে পারছি না। আর ‘এই বংশের অমুকেই শেষ’ এরূপ কথা বললে কি সে বংশের গৌরব খুব বেড়ে যায়? এরূপ কথা দ্বারা বরং তাকে সে বংশের দুর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ বলেই উল্লেখ করা যায়। তাছাড়া পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবীর সত্যতা সম্বন্ধে পরবর্তী নবী এসে তছদীক করার ওয়াদা প্রত্যেক নবী থেকেই আল্লাহ নিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে আমদের নবী করিম (দঃ) ও রয়েছেন (৩ঃ৮১)। এ হিসেবেই হযরত মোহাম্মদ (দঃ) হযরত ঈসা (আঃ) এর সত্যতা সম্বন্ধে তছদীক করেছেন। প্রত্যেক নবীর বেলায়ই এরূপ ঘটেছে। এখন যদি হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কে সর্বশেষ বলে স্বীকার করে নেয়া হয় তা’হলে তাঁর সত্যতা সম্বন্ধে তছদীক করার জন্য আর কোন নবী আসবেন না- একথাও স্বীকার করতে হবে। এরূপ কথার দ্বারা তাঁর সম্মান কিভাবে বাড়ল?

সুতরাং যে কথার দ্বারা তাঁর বিশেষত্ব কিছুই বৃদ্ধি পাচ্ছে না, আল্লাহ তায়ালা কি এমন কথাই এখানে উল্লেখ করেছেন? তা হলে হযরত মোহাম্মদ (দঃ) সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার দলিল কোথায়? হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কে পুত্র সন্তানহীন বলাতে বিরুদ্ধবাদীদের দাবী সাব্যস্থ হয়, আল্লাহর রাছুল বলাতে অন্যান্য রাছুলগণের উপর তাঁর বিন্দুমাত্র শ্রেষ্ঠত্বও প্রমাণ হচ্ছে না। এখন যদি তাঁকে ‘নবীগণের শেষ’ বলা হয়, তার দ্বারাও তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হচ্ছে না, কারণ, যার দ্বারা কোন কিছুর ‘শেষ হয়ে যাওয়া’ বুঝায়, তাকে বরং হতভাগ্যেরই কারণ বলা যায়।

সুতরাং আমাদের পীর বুজুর্গ আলেম-ওলেমাগণ চৌদ্দশ’ বছর ধরে হযরত রাছুলে করিম (দঃ) এর প্রতি এমন একটি ‘গুণ’ আরোপ করে আসছেন, যা তাঁর কোন গুণ প্রকাশ না করে প্রকারান্তরে তাঁর দোষই প্রকাশ করছে।

দ্বিতীয়ত: ‘খাতামুন’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ কোথাও ‘শেষ হওয়া’ আছে কিনা, আমার জানা নেই। তবে এ শব্দটির ব্যবহার কোরান পাকের মধ্যে অনেক জায়গায়ই আছে। কিন্তু কোন স্থলেই এই শব্দটির অর্থ ‘শেষ হওয়া’ বুঝায়নি, অন্যান্য স্থানে যে শব্দটির অর্থ ‘শেষ হওয়া’ বুঝায়নি, তখন এই একটি মাত্র জায়গায় এ শব্দটিকে আমরা কেন ‘শেষ হওয়া’ অর্থে ব্যবহার করব, যদি না তা’ দ্বারা তাঁর কোন শ্রেষ্ঠত্ব বা বিশেষত্ব প্রমাণ হয়? অভিধানে যেখানে ‘খাতামুন’ শব্দটির অর্থ ‘মোহর’ বা ‘সীল’ করা হয়েছে, তখন কোরান পাকের অন্যান্য জায়গায় ‘খাতামুন’ শব্দটির অর্থ যা করা হয়েছে, এখানে সেরূপ অর্থ করতে বাঁধাটি কোথায় এবং তা দ্বারা যদি তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বা বিশেষত্ব প্রতিপাদন করা যায়? হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কে সোজাসুজি নবী বা রাছুল বলাতে তাঁর কোনই বিশেষত্ব প্রকাশ পায় না, তাঁকে শেষ নবী বলাতেও তাঁর দোষ ছাড়া কোন গুণ প্রকাশ হচ্ছে না।  এ স্থলে যদি আমরা তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী বলি, তাতে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কোন কারণে তিনি শ্রেষ্ঠ, তা’ত জানা যাচ্ছে না। আর ‘খাতামুন’ শব্দের যথার্থ আভিধানিক অর্থটির প্রয়োগও এখানে হচ্ছে না। কারণ কোরান-পাকে ‘খাতামুন’ শব্দটির অর্থ সর্বত্রই মোহর হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে; তাই এখানেও সেই অর্থেই ব্যবহার করা শ্রেয়। অনেক তাফসীরকারকও এরূপই করেছেন, অর্থাৎ ‘খাতামান্নাবিয়্যিন’ অর্থ নবীগণের মোহর বা সীল।

নবীগণের মোহর বা সীল অর্থে আমরা সাধারণত: বুঝে থাকি যে, যে পথে নবী রাছুলগণ আসতেন, হযরত মোহাম্মদ (দঃ) আসার পর সে পথটিতে মোহর মারা হয়ে গেছে বা সে পথটি ‘সীল’ মেরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরূপ বুঝ থেকেই আমরা হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কে সর্বশেষ নবী হিসেবে অর্থ করেছি এবং অনেক তফসীরকারক এরূপ অর্থও করেছেন। তারপর, আমরা বুঝে নিয়েছি যে হযরত মোহাম্মদ (দঃ) যখন শেষ নবী, তাঁর পরে যখন আর কোন নবী আসবেন না, ওহী আর কি ভাবে আসবেন? সুতরাং চিরদিনের জন্য নবী ও ওহীর দরজা বন্ধ!

ব্যাস, মাঠ একদম ফাঁকা। এখন আমরা যা বলি বা যা করি, কে আর আমাদের কথা বা কাজের প্রতিবাদ করবে! আমাদের কথা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না মেনে কি জনগণের উপায় আছে! ঈমানদার হতে হলে আমাদের কথা তাদের শুনতেও হবে এবং আমাদের কথার উপর তাদের ঈমান-এক্বিনও রাখতে হবে। তা না হলে, তারা নির্ঘাত বেদ্বীন কাফের হবে, জাহান্নামের আগুনে আবাদুল আবাদ জ্বলতে হবে। এই জাহান্নামের আগুনের ভয়েই ত আজ আমরা তাদের কথাকে আল্লাহর কালামের মতই অভ্রান্ত সত্য বলে বিশ্বাস করে নিয়েছি। এক খোদার আসন নিয়ে হাজার জন হাজার দিকে টানাটানি করছি।

খোদা কি এখন অসহায় শক্তিহীন একজন অথর্বে পরিণত হয়ে গেছেন যে তিনি তাঁর সিংহাসন রক্ষার জন্য আর কিছুই করতে পারবেন না?

তিনি আর কি ভাবে তা করবেন! ওহীর দরজা যখন বন্ধ, তিনি ত তাঁর সিংহাসন রক্ষার অভিপ্রায়ও কারো কাছে আর ব্যক্ত করতে পারবেন না! এরূপ কেউ দাবী করলেই যে ইসলাম থেকে তার নাম খারিজ হয়ে যাবে। কি অদ্ভুত এই ফাঁদ! শয়তানের দল ভেবেছে, এই ফাঁদ দিয়েই আল্লাহর হেদায়েতের কল্যাণ থেকে আদম সন্তানকে চিরদিন বঞ্চিত রাখবে! কিন্তু শয়তানের দল কি জানে না, ‘আল্লাহু খায়রুল মাকেরীন’- “আল্লাহই সর্বোত্তম কুশলী”? তাই তিনি কৌশল করেছেন, শয়তানের সমস্ত ‘ধূম্রজাল’ ছিন্ন করে দুঃখী, তাপী, কাঙ্গাল, আশা-বঞ্চিত মানুষকে আবার তিনি গৌরব দান করবেন। সত্যের চির জ্যোতির্ময় আভায় জগদ্বাসীকে আবার তিনি উদ্ভাসিত করবেন। অফুরন্ত কল্যাণ-প্রেম-ক্ষমা ও ভালবাসায় মানবজাতিকে আবার তিনি মহিমান্বিত করবেন। কিন্তু, কিরূপে?

সর্বশেষ উম্মত ত আল্লাহর এই জ্যোতি ও কল্যাণের অভিলাষী নয়! তাদের কাছে যা আছে তা’ নিয়েই তারা সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত। তা’ হলে তারা আর কিভাবে আল্লাহর এই নেয়ামত লাভ করবে?

আর তাদের পূর্ববর্তী উম্মত? তারা ত নিস্পাপ ঈশ্বরের পুত্র! তাদের সমস্ত পাপ স্বীয় স্কন্ধে বহন করে নিয়ে ‘ঈশ্বরপুত্র’ তাদেরকে চিরদিনের জন্য পাপমুক্ত করে দিয়ে গেছেন! সুতরাং তাদেরও আল্লাহর এই জ্যোতি ও কল্যাণের আর কোন প্রয়োজন নেই! তাহলে তারা আর কিভাবে আল্লাহর এই নেয়ামত লাভ করবে?

আর তাদেরও পূর্ববর্তী উম্মত? তারাও ত তাদের চির-আকাক্সিক্ষত দুগ্ধ-মধু প্রবাহিত সাধের জেরুজালেম যিহোবার কল্যাণে ফিরে পেয়েছে। যিহোবার কল্যাণের ইচ্ছা করলেই তারা মধ্যপ্রাচ্যের যে কোন স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম। আর কি চাই! আল্লাহর জ্যোতি বা কল্যাণ আর অধিক তাদের কি প্রয়োজন! সুতরাং এই নেয়ামত আর কিভাবে তারা লাভ করবে?

আরেক দল তেত্রিশ কোটি দেবতার কল্যাণে এক লক্ষ আল্লাহর পূজারীকে হাতে কড়া দিতে পেরেছিল। এক আল্লাহর পূজারীরাই আজ তাদের সঙ্গে আপোষ রফায় ‘যুদ্ধ নয় চুক্তির’ জন্য ধ্যান দরবার করছে। এর চাইতে অধিক আর কি কল্যাণ তাদের প্রয়োজন? তা’ হলে তারা আর কিভাবে এই নেয়ামত লাভ করবে?

আরেক দল পূজা করছে, অথচ পূজ্য কি কেউ আছে-কি-নেই এই সন্দেহ-দোলায় দোল খাচ্ছে। ‘এতমিনান’ ত তাদের কাছে অনভিপ্রেত। তাহলে আল্লাহর এই নেয়ামতের প্রশস্তি তারা আর কি ভাবে লাভ করবে?

আরেক দল ভাবছে, তারা ত আল্লাহকে ঠেঙ্গাতে ঠেঙ্গাতে দেশ ছাড়া করেছেই; এখন তাকে কিভাবে পৃথিবী ছাড়া করা যায়, তারই পরিকল্পনা আঁটছে। সুতরাং তারা আর কিভাবে আল্লাহর এই নেয়ামত লাভ করবে?

পৃথিবীবাসী কেউ যখন তাঁর এই নেয়ামতের অভিলাষী নয়, তাই বলে আল্লাহ কি তাঁর এই নেয়ামত আকাশে তুলে নিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখবেন? মানুষ যখন সামান্য নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সিংহাসনের লোভে জীবনের মায়া ত্যাগ করতে পারে, সম্পদের লোভে ভাই ভাইকে হত্যা করতে পারে, আল্লাহর নেয়ামত কি এমন মূল্যহীন হয়ে পড়ল যে তা’ কেউ আকাক্সক্ষাই করবে না? আসলে আল্লাহর এই নেয়ামত যে কি তা’ আমরা মোটেও বুঝি না, বুঝতেও চেষ্টা করি না। বরং এই নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করাই আজ আমাদের ধর্মগুরুদের ধর্মের মূল প্রতিপাদ্য। তারা চাচ্ছেন নবুয়তকে কবর দিয়ে খাতামান্নাবিয়্যিনের কল্যাণ লাভ করতে! তাই ত আজ তাদের কণ্ঠে ঝুলছে আস্তিক-নাস্তিক, জীন্দিক-মোশরেক কুল মখলুকাতের লানত। আর এই লানতের উৎক্ষেপনকেই তারা বুঝছেন ‘ইসলামী জাগরণ’!

কিন্তু বন্ধুগণ! নবুয়তকে কবর দিয়ে খাতামুন্নবীকে জিন্দা রাখার চেষ্টা শয়তানী ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়।

ইমাম সাহেব! আপনি কি পারবেন প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের কাছে, রিগ্যানের কাছে, জাতিসংঘের কর্তা ব্যক্তিদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে? আপনারা কি পারবেন তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে? আপনারা কি পারবেন ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখাত হলে তাদের বিরুদ্ধে যথাবিহিত ব্যবস্থা নিতে? দুনিয়াতে এমন কেউ আছেন কি যিনি এই দায়িত্ব বহন করতে সক্ষম? সক্ষম কেউ থেকে থাকলে তিনি তার দায়িত্ব পালন করছেন না কেন? আমরা জানি এরূপ কেউ নেই। কারণ, নমরূদের মোকাবিলা করার জন্য যেমন একজন ইব্রাহীমের আবির্ভাবের প্রয়োজন হয়েছিল, ফেরাউনের মোকাবিলা করার জন্য যেমন একজন মুছার আবির্ভাবের প্রয়োজন হয়েছিল; প্রেসিডেন্ট রিগ্যান-ব্রেজনেভদের মোকাবিলা করার জন্যও তেমনি এক ব্যক্তির আশু প্রয়োজন। কিন্তু নবুয়তের দ্বার রুদ্ধ থাকলে তেমন ব্যক্তি আর কি ভাবে আসবেন? যদি তেমন ব্যক্তি আসতেই না পারবেন, তা হলে রিগ্যান-ব্রেজনেভদের মোকবিলা কে করবে? তবে কি দুনিয়ার বুকে চিরদিনের জন্য খাতামুন্নবীর উপরে তাদের প্রাধান্যকেই মেনে নিতে হবে? আর এতেই কি ‘ইন্নাদ্দিনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম’ হয়ে যাবে?

সুতরাং দুনিয়াতে কিয়ামত পর্যন্ত নমরূদ-ফেরাউন যেমন আসতে থাকবে, তাদের মোকাবিলা করার জন্য তেমনি ইব্রাহিম-মুছাও আসতে থাকবেন, কিন্তু তিনি যে কেউ হোন, মোহাম্মদী মোহর বা সীল ব্যবহার করা ব্যতীত স্বতন্ত্রভাবে তিনি আর ইব্রাহীমী, মুছায়ী, ঈসায়ী বা অন্য কোন নূতন নামে আসতে পারবেন না। তিনি যত বড়ই হোন, বা তিনি যত সাফল্যই অর্জন করুন, হজরত মোহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লামের মোহর, ছাপ বা নিশানাই তাঁকে বহন করতে হবে, অর্থাৎ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাছুলুল্লাহ’ কালেমারই অধীন তাকে থাকতে হবে।

অর্থাৎ হযরত মোহাম্মদ (দঃ) সাধারণ মানুষের মত কোন সাধারণ পুত্র সন্তানদের পিতা নন, বরং তিনি নিজে আল্লাহর একজন রাছুল, কিন্তু তিনি সাধারণ রাছুলও নন, তিনি নবীগনের পিতা।

এখন যদি নবী আর না আসতে পারেন এবং তাঁকে পিতা মনে না করেন, তা হলে তাঁর যে কোন পুত্র সন্তান নেই, একথার খ-ণ কি ভাবে হবে? আর যদি কোন নবী এসে তাঁকে পিতা মনে করেন, এতে কি হযরত মোহাম্মদ (দঃ) এর মান মর্যাদা কমে যাবে, না বৃদ্ধি পাবে? তিনি এসে যদি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন উম্মতে মোহাম্মদীকে সুসংগঠিত করেন এবং মান-মর্যাদায় পৌঁছিয়ে দেন, তা হলে কি ইসলাম বা উম্মতে মোহাম্মদীর খুব ক্ষতি হবে? এতে কি ইসলাম, মোহাম্মদ আল্লাহ বা করো বিরুদ্ধে মানহানিকর কিছু বলা হল?

আমাদের একথার সমর্থনে দলিল? আপনারা বিশ্বাস করুন বা না করুন, আপাততঃ আপনারা মনে করে নিন যে এখনও প্রেরিত পূরুষ আসতে পারেন, তারপর আপনি পবিত্র মহাগ্রন্থখানি খুলে ধরুন এবং পড়তে থাকুন। আমার ত মনে হয়, এ গ্রন্থের প্রতি পাতায় পাতায় রাছুল আসা, তাঁকে অমান্য করা এবং শেষে লজ্জা অপমান ও লাঞ্ছনা ভোগ করে করে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এবং বিশ্বাসীদের জন্য সাফল্য, বিজয় এবং পুরষ্কার প্রদান করা, প্রভৃতি প্রসঙ্গই বর্ণনা করা হয়েছে। কোন রাছুল যখন আর আসবেনই না, তখন অতীতকালে কে একজন এসেছিলেন, তাঁকে কারা বিশ্বাস করেছিল, তাদের কে পুরষ্কার পেল, আর কে শাস্তি পেল- এ কাহিনী শুনে আমার কি লাভ বা ক্ষতি হবে, যদি আমার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন আহ্বানকারী না-ই আসবেন এবং তাঁকে বিশ্বাস করার জন্য এ কাহিনী থেকে প্রেরণা লাভের কোন উদ্দেশ্যই না থাকবে? কিছু অতীত কাহিনী শোনা এবং ‘ছোবানাল্লাহু’ বলার জন্যই কি এটাকে আমরা পবিত্র মহাগ্রন্থ বলে পাঠ করব এবং চুমু খাব? এই কি এই মহাগ্রন্থের সারবস্তু? আর বিনা বাক্য ব্যয়ে আলেম-ওলেমা, পীর-পুরোহিতদের কথা ও কাজকে অভ্রান্ত ও সত্য বলে মেনে নেয়াই কি এই কিতাবের শিক্ষা? কিন্তু আল্লাহর কোরান ত এর বিরুদ্ধেই বলেছে, যেমন, আল্লাহ বলেছেন, তারা ত আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের পীর পুরোহিতকেই রবের আসনে বসিয়ে রেখেছে’ – (৯ঃ৩১) আরো, কিতাব পড়ে পড়ে মুশরেক, কাফের ও গর্দভ হওয়ার বর্ণনা কি আপনারা পাননি? এরা কারা? কেবল ইহুদী-নাছারাই এ অপবাদের অংশীদার? আপনারা কি আসমানী কিতাব পড়ছেন না? কিতাবধারী কি আপনারাও নন? কিতাব পড়া সত্ত্বেও ইহুদী নাছারাদের মত আপনাদেরও কাফের মোশরেক ও গর্দভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই? এ অপবাদ থেকে আপনাদেরকে সুরক্ষিত রাখবেন বলে আল্লাহ আপনাদের সাথে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছেন এবং এ সম্বন্ধে আপনারা কি চিন্তা ভাবনা করার বিন্দুমাত্র প্রয়োজনও অনুভব করছেন না?

আপনাদের কাজ-কারবার সম্বন্ধে কেউ কিছু বললেই আপনারা তাকে কোরান-হাদিস বিরোধী, ধর্মদ্রোহী খোদাদ্রোহী বলে হৈ-চৈ সোরগোল শুরু করে দেন। সহজ-সরল মুছল্লীদেরকে তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলেন। ধর্ম রক্ষা এবং ধর্ম পালন করার সোল অথরিটি কেবলমাত্র আপনারাই? অথচ প্রকাশ্যেই যারা কোরান হাদিস মানে না, খোদার অস্তিত্ব স্বীকার করেনা, বরং ধর্মবলাম্বীদেরকে সমূলে ধ্বংস করাই যাদের লক্ষ্য, তাদের বিরুদ্ধে কোথায় আপনাদের হৈ-চৈ সোরগোল? দেশে কি কোরান বিরোধী, হাদিস বিরোধী, ধর্ম বিরোধী কোনকিছু হচ্ছে না? এ সবের বিরুদ্ধে আপনারা কি করছেন? এর নামই কি আপনাদের ইসলামী জিন্দেগানী এবং এ-ই কি আপনাদের সুন্নাতুল জামাতের ব্যবস্থা?

আপনারা আমাদের কাছে দলিল চাচ্ছেন। আলমাহদু থেকে শুরু করে অন্নাছ পর্যন্ত সমগ্র কোরনই আমাদের দলিল। যদি আপনাদের কারো পক্ষে সম্ভবপর হয়, কোরান-পাক থেকে একটি আয়াত উদ্ধৃত করে দেখিয়ে দিন যে আমরা তার বিরোধিতা করছি। যদি দেখাতে পারেন, তাহলে অবশ্যই আমরা তওবা করব।

আমাদের কাছে কোন দলিল চাওয়ার পূর্বে, আমরা মনে করি আপনাদের নিজেদের দলিলগুলো মিলিয়ে নেয়া উচিত। আপনারা সবাই ঐকমত্য ত? বিশ্বের সকল উম্মতে মোহাম্মদী আপনাদের দলিলগুলো মানে ত? আপনাদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই ত? মতপার্থক্য না থাকলে ৭৩ দল কি করে, কোত্থেকে হল? এ পার্থক্য কি কিছুই নয়? আল্লাহপাক না বলেছেন, “তোমরা ফেরকায় ফেরকায় বিভক্ত হয়ে যেও না?” ৭৩টি দলের মধ্যে যখন কেবল একটি দলই নাজী ফেরকা আর বাদ বাকী সকল দলই জাহান্নামী, তখন আপনারা কি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারেন, কোন দলটি নাজী ফেরকার ভুক্ত, আর কোন দলগুলো জাহান্নামী? এ দলগুলোর কেউ কি বলছে, ‘আমরাই জাহান্নামী’? যখন সবাই আপন দলটিকে একমাত্র নাজী ফেরকাভুক্ত বলে মনে করছে, আর বাদ বাকী দলগুলোকে জাহান্নামী মনে করছে তখন আমরা কোন দলটিকে নাজী ফেরকা মনে করব? আর কোন দলের অনুসারী হব? আমার বিবেচনা অনুযায়ী যে কোন একটি দলের অন্তর্ভুক্ত হলেই কি আমার মুক্তি সুনিশ্চিত হবে? বা আপনাদের মত অনুযায়ী চললেই আপনারা আমার মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারবেন? আমি ত জানি, আপনাদের নিজেদের মুক্তির সম্বন্ধেই আপনারা নিশ্চিত নন। তখন আপনারা কিভাবে অপরকে পথ দেখাবেন? এমতাবস্থায় আমরা কিভাবে আপনাদের অনুসারী হতে পারি? বা আপনাদেরকে নেতা মান্য করতে পারি?

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) নিজে মুক্তির অন্বেষায় একবার তারকাকে, একবার চন্দ্রকে, একবার সূর্যকে রব মনে করেছিলেন কিন্তু স্বয়ং রব যখন তাকে পথ দেখালেন, কেবল তখনই তিনি তার দিকে রুজু হলেন এবং রবের সন্ধান পেলেন। আমরাও তেমনি রবের অন্বেষায় আপনাদের এক এক জনের দিকে রুজু হয়েছিলম, কিন্তু কি পেলাম? তারা প্রত্যেকেই ‘গউছুল আজম’, প্রত্যেকেই ‘সুলতানুল আউলিয়া’, প্রত্যেকেই ‘পীরে মোকাম্মেল’, প্রত্যেকেই ‘অদ্বিতীয় ইসলামী চিন্তাবিদ’, প্রত্যেকেই ‘মোহাক্কেক বুজুর্গ ইমাম-আলেম-মুফতী’, প্রত্যেকেই ‘মোজাদ্দেদে জমান’, প্রত্যেকেই ‘শাহানশাহে শরীয়ত-তরিকত-হকিকত-মারফত’। এখন আমরা কাকে রেখে কাকে ধরি? যখন আমাদের এত রাজা, এত শাহানশাহ্, তখন ‘খাজনা’ আমরা কাকে দিব? যে কাউকে দিলেই মুক্তি আমার হবে ত?

এর উত্তরে আপনারা বলে থাকেন, “না না তার আর ক্যামনে হবে? আপনারা দেখবেন কোরান-হাদিস। কোরান-হাদিস মোতাবেক যাকে পাবেন, তাকেই ‘খাজনা’ দিবেন। তাহলেই মুক্তির সম্ভাবনা আছে।”

-হ্যাঁ, আমরা কোরান-হাদিস দেখেছি। কোরান-হাদিসের আলোকেই ইব্রাহীম (আঃ) -এর মত আমরাও আপনাদের কাউকে তারকার মত, কাউকে চন্দ্রের মত, আবার কাউকে সূর্যের মত রব মনে করেছি। কিন্তু আসলে আপনারা কেউ রব নন। তাই ত আমরা সবার থেকে মুখ ফিরিয়ে এক রবের দিকেই মুখ করেছি। পরম করুণাময় করুণানিধান এক রবই আমাদেরকে পথ দেখাচ্ছেন। স্বয়ং রব যাদের পথের দিশারি, তাদের পথ হারাবার আবার ভয় কি? সুতরাং ডর-ভয়, লাজ-অপমান আর নেই। এক রবের ‘কলঙ্কেই’ আমরা ‘কলঙ্কিত’। কারো দেয়া কলঙ্কে আর আমাদের বিন্দুমাত্র ভয়ও নেই।

আপনারা আমাদের কাছে দলিল চাচ্ছেন। দলিল কি দেখানো হয়নি? দলিল থাকা সত্ত্বেও সহজ সরল নিরীহ মালিক কি কোন সময় তার স্বত্ব থেকে বেদখল হয়ে যায়না? বৈধ দলিল থাকা সত্বেও কি তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় না? তুখোড় উকিলের বাক্-চাতুর্যে বৈধ দলিলও মিথ্যা-জাল প্রমাণিত হয়ে কোন কোন সময় মালিকই তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না? আমাদের অবস্থা কি তদ্রƒপ নয়?

আপনারাই বলেছেন, এ পৃথিবীতে এক লক্ষ বা দু’লক্ষ নবী রাছুল এসেছেন। এত সংখ্যক নবী রাছুল আসার কেন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল? এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই ত তাঁরা এসেছিলেন, তা নয়কি? যখনই আল্লাহর সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ হত তখনই আল্লাহ তাদেরকে পাঠাতেন। এই নবী রাছুলগণই হচ্ছেন জীবন্ত আল্লাহর এক একটি জীবন্ত আয়াত বা প্রতীক, খলিফা বা প্রতিনিধি। কিন্তু এই প্রতীকই যাতে আবার আল্লাহর বাস্তব স্বত্বার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে চির জীবন্ত, চির অমর হয়ে তাঁর সার্বভৌমত্বকে খর্ব করতে না পারে, তাই প্রত্যেকের জন্যই একটি কাল বা সময়কে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে! এমন কেউ নেই যে আল্লাহর এই ‘আযালকে’ এক মুহূর্ত আগে বা পরে করতে পারে। এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘লি লিকুল্লি উম্মাতেন আযাল’- “প্রত্যেক উম্মতের জন্যই একটি কাল নির্দিষ্ট রয়েছে। যখন তা এসে যায় কেউ এই সীমাকে একদ- আগুপিছ করতে পারে না” (১০ঃ৪৯)। খাতামুন্নবী (দঃ) – এর উম্মত আল্লাহর এই বিধানকে মিথ্যা প্রমাণ করে আবার কোন আল্লাহর বিধান কায়েম করতে চাচ্ছেন? হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কি আল্লাহর এই বিধানকে পরিবর্তন করার শিক্ষাই আমাদেরকে দিয়ে গেছেন?

না। – বরং প্রভুর নামে তিনি যা পাঠ করার জন্য- আদিষ্ট হয়েছিলেন, সমবেতভাবে তা-ই পাঠ করে প্রভুর অনুগ্রহ ও পুরষ্কার প্রার্থনা করার শিক্ষাই ত তিনি আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। সুতরাং নবী (দঃ) আমাদের জন্য এমন একটি পথই নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন যে পথে চললে আমরা পুরষ্কার-প্রাপ্তদের দলভুক্ত হতে পারি।

তাই আমি আবারও বলছি, ‘আলহামদু’ থেকে শুরু করে ‘অন্নাছ’ পর্যন্ত সমগ্র কোরানই আমাদের দলিল। এই পবিত্র গ্রন্থের যে কোন আয়াত উদ্ধৃত করে আমাদের দাবীর সত্যতা প্রমাণ করতে পারব ইনশাল্লাহ। তবুও এখানে মাত্র আর দুটি আয়াত উদ্ধৃত করে এ প্রসঙ্গ শেষ করার ইচ্ছা রাখি। সুরা আরাফের চতুর্থ রুকুর ৩৫ ও ৪৬ আয়াতদ্বয়ে হযরত রাছুলে করিম (দঃ) এর কণ্ঠে আল্লাহ মনুষ্য জাতিকে ডেকে বলেছেন, “হে বনি আদম! তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট যখন রসুলগণ অবশ্যই আসবেন, তোমাদের নিকট আমার নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করবেন, তখন যারা ত্বাকওয়া অবলম্বন করবে এবং এছলাহ করবে, তাদের জন্য ভয় নেই এবং কোন দুঃখ থাকবে না। কিন্তু যারা আমার নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করবে এবং অহংকারের সঙ্গে পীঠ ফিরিয়ে থাকবে তারাই হবে অগ্নির অধিবাসী। সেখানেই তাদের বাসস্থান।”

এখানে কি আদম সন্তানদের কাছে ভবিষ্যতে রছুলগণ আসা এবং মান্য করার জন্য স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হচ্ছে না?

এখানে যদি কেউ রোজে আজলে দুনিয়ার জিন্দেগানীতে বনি আদমের কাছে প্রেরিত রসুলগণকে অনুসরণ করার কথা বর্ণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করতে চান, তাহলে এ কথা দ্বারা ভবিষ্যতে কোন রসুল আসার পথ বন্ধ করা যায় না। কারণ, তাদের কথা অনুযায়ী রোজে আজেলে নবীগণকে অনুসরণ করা সম্বন্ধে আমাদেরকে সতর্ক করা হচ্ছিল তখন আমরা নিশ্চিতভাবেই আমাদের ভবিষ্যত জীবনে সাক্ষাত লাভ করার কথাই বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম এবং সেই নবীকে অনুসরণ করার ওয়াদা করেছিলাম। এখন আমাদের এই দুনিয়ার জিন্দেগানীতে সত্য সত্যই যদি কোন নবীর সাক্ষাত লাভ না হয় এবং তাকে বিশ্বাস ও অনুসরণ করার কোন প্রশ্নই না উঠে, তাহলে রোজে আজলে প্রদত্ত ওয়াদার কোন মূল্য থাকে কি? এবং সেই দিনের সতর্কীকরণ অনুষ্ঠানটি কি আল্লাহর একটি বেহুদা কাজ বলে প্রমাণিত হচ্ছে না?

সুতরাং কোরান পাককে অমান্য না করে আমাদের দাবীকে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবেন কি? এটা বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতির পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ। যে কেউ আমাদের এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারেন। তবে কি জবরদস্তি, হৈ-চৈ সোরগোলের মাধ্যমে আমাদের মোকাবিলা করতে চান? যা কিছু আপনারা করুন না কেন আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের পক্ষে আছেন; এবং নিশ্চয়ই আল্লাহর বিরোধিতা করে কেউ কোন দিন বিজয়ী হতে পারেনি, আর পারবেও না।

এবার ‘লা নবীয়া বা’দী’ প্রসঙ্গে দু’একটি কথা বলছি। ‘বা’দ’ শব্দটি কোরান পাকের অনেক জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটির অর্থ কোথাও ‘পরে’, কোথাও ‘অনুপস্থিতিতে’, কোথাও ‘ছাড়া’, কোথাও ‘ব্যতীত’ প্রভৃতি বিভিন্ন অর্থে বিভিন্ন জায়গায় অর্থ করা হয়েছে। উল্লিখিত হাদিসে উক্ত শব্দটির অর্থ আমরা “আমি ছাড়া” “আমি ব্যতীত” বা “আমার অনুপস্থিতিতে কোন নবী নেই” বুঝেছি। ‘আমার পরে কোনদিনও আর কোন নবী আসবেন না’ – প্রত্যক্ষ কোরানের শিক্ষা-বিরুদ্ধ এরূপ অর্থ গ্রহণ করতে আমরা সাহস পাচ্ছি না বলে আমরা দুঃখিত।

হযরত রাছুলে করিম(দঃ) -এর পর ত্রিশজন মিথ্যা নবীর আবির্ভাব হওয়ার প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য এই যে, আল্লাহ যাকে নবী বানাবেন না তেমন ব্যক্তি কখনো নবী দাবী করে টিকে থাকতে পারবে না। আর সত্য সত্যই আল্লাহ যাকে নবী বানাবেন, তাকে কেউ মুছে ফেলবেন এ-ও সম্ভব হবে না। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ পাকই বলেছেন, “আর তিনি [মোহাম্মদ (দঃ)] যদি আমার সম্পর্কে কোন কথা বানিয়ে বলতেন, তাহলে আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম। তারপরে তাঁর গলার রগ অবশ্যই কেটে ফেলতাম।” (৬৯ঃ৪৪-৪৬)

এখন বলুন ত, আল্লাহর সম্বন্ধে কোন কথা বানিয়ে বললে হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কেও স্বয়ং আল্লাহ তার ডান হাত ধরে ফেলতেন এবং তাঁর গলার রগ অবশ্যই কেটে দিতেন বলে সতর্ক করে দিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ যদি কাউকে প্রেরিত পূরুষ না বানান, আর যদি সে আল্লাহর একজন প্রেরিত পূরুষ বলে দাবী করে, তাহলে আল্লাহ কি তাকে ছেড়ে দিবেন? না, তা কখনো হতে পারে না। সুতরাং কেউ কোন দাবী পেশ করলেই, সঙ্গে সঙ্গে তাকে অবিশ্বাস না করে ধৈর্য সহকারে তার কিছু কথা শুনা অবশ্য কর্তব্য। হতে পারে আল্লাহ তাকে মনোনীত করে নিয়েছেন। আর যদি সে প্রকৃতই মনোনীত না হয়ে থাকে, তা হলে স্বয়ং আল্লাহই তাকে উৎখাত করার ব্যবস্থা করবেন; সে জন্য আমাদেরকে ত্রস্ত-ব্যস্ত হতে হবে না। ত্রস্ত-ব্যস্ততা শয়তানেরই স্বভাব।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে শয়তানের প্ররোচনা হতে রক্ষা করুন (আমিন)।

সে যাহোক প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমার জবানবন্দী যদি বাস্তবিকই সত্য ও সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আপনাদের তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ দুটিও সম্পূর্ণ খ-ণযোগ্য বলেই মনে করি। লেখার কলেবর অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এ দুটি অভিযোগকে গৌণ বলে মনে করে এখানেই সমাপ্ত করছি!

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর নূরের সাহায্যে পথ চলার সাহায্য করুন। আমিন!

অমা আলাইনা ইল্লালা বালাগ। অ আখেরে দাওয়ানা আনেল হামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামিন!