পরম দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করিতেছি
নাহ্মাদুহু অ নুছাল্লি আলা রাছুলিহিল করিম
ধর্ম পথে কতকগুলি সমস্যা ও তাহার সমাধান

১. তক্্দীর ও তদ্বীর সম্বন্ধে জটিলতা :
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে যে, সৃষ্টির প্রথম হইতে কেয়ামত পর্যন্ত যাহা কিছু হইবার তাহা লওহে মাহফুজে লেখা হইয়াছে, এখন আর নূতন কিছু হইবার নাই, কলমের কালি শুকাইয়া গিয়াছে।
আরও উক্ত হইয়াছে যে, যাহার জন্য যে কাজ যেভাবে করার আদেশ লেখা হইয়াছে উহার ব্যতিক্রম করিয়া কখনও কেহ কোন কাজ করিতে পারিবে না। আল্লাহপাক কোরআনে ফরমাইয়াছেন “মাইএহ্ দি”- আল আখের। অর্থাৎ আল্লাহ যাহাকে হেদায়েত করিবেন তাহাকে কেহই গোমরাহ করিতে পারিবে না। আর আল্লাহ যাহাকে গোমরাহ করিবেন তাহাকে কেহ হেদায়েত করিতে পারিবে না। এমনকি তক্দীরের লিখিত আদেশ ব্যতীত গাছের পাতাটি পর্যন্ত হেলে না। হাদিস শরীফে আরও বর্ণনা করা হইয়াছে যে, কেহই আপন আমল দ্বারা বেহেস্তে প্রবেশ করিতে পারিবে না, যাহাকে আল্লাহ মেহেরবানী করিয়া দিবেন সেই বেহেস্ত পাইবে।
যাহাহউক এই প্রকার কোরানের বাণী ও হাদিসের বাণী বহু আছে যদ্বারা বুঝা যায় যে, তক্দীর এড়াইয়া কাহারও কিছু করার ক্ষমতা নাই এবং এই তক্দীর মানার বিশেষ তাগিদও রহিয়াছে,- “অল কাদ্রে খায়রিহি অসাররিহি মিনাল্লাহে তায়ালা।” যে তক্দীর অমান্য করিবে সে বেঈমান হইবে এবং তক্দীর যে ঠিক তাহার প্রমাণ স্বরূপ বলা যাইতে পারে, যথা ঃ একটা সন্তানের জন্যে একটা লোকের বহু আকাক্সক্ষা; কিন্তু সন্তান হইতেছে না, অথচ তদ্বীরের কোন ত্রুটি সে করিতেছে না। একটা লোকের কেবলই কন্যা হয়, সে কত তদ্বীরই করিতেছে একটা পুত্র পাওয়ার জন্য; কিন্তু সকল চেষ্টা বিফল হইতেছে। বুঝা গেল, তক্দীর এড়াইয়া কিছুই করা যায় না। বিবাহ ব্যাপারেও দেখা যায় যে, একটা কন্যার বিবাহের জন্যে উভয় পক্ষই সম্মত হইল। দুই পক্ষে কথা-বার্তা, খাওয়া-খাদ্য, আদান-প্রদান সবকিছুই সম্পূর্ণ ঠিক ঠাক। কিন্তু বিবাহের সময় এমন কোন অনৈক্য ঘটে যে কারণে ঐ বিবাহ ভাঙ্গিয়া যায়। যাহার সাথে বিবাহের কখনো কল্পনাও করে নাই, হঠাৎ তাহার সাথে বিবাহ হইয়া যায়। মোটের উপর রাজত্ব ব্যাপারে, চাকুরী ব্যাপারে, বিবাহ ও সন্তানাদির ব্যাপারে এবং ব্যবসায় ও ধন উপার্জন ব্যাপারে এবং বিদ্যার্জন ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তদ্বীর করার পরও অভীষ্ট সিদ্ধি হইতেছে না। আবার বিনা চেষ্টায় হঠাৎ অভীষ্ট লাভ হইয়া যাইতেছে।
আবার হেদায়েতের ব্যাপারেও দেখা যায় আল্লাহ যাহার তক্দীরে যাহা লিখিয়াছেন তাহা হয়: দেখ, হজরত নূহ নবী আলায়হেছাল্লামের আপন পুত্র কেনান, সে নিজ পিতার উপদেশেও উপকৃত হইল না। আবু জাহেল, আবু লাহাব নিজ বংশের ও নিজ ভ্রাতুষ্পুত্র হজরত নবী করীম ছাল্লাল্লাহে আলায়হেছাল্লামের নছিহতেও হেদায়েত প্রাপ্ত হইল না। আবার হজরত বিল্লাল (রাঃ) এত মার খাওয়ার পরও ইসলাম ত্যাগ করিলেন না। বুঝা গেল যে, বিধির বিধান অলঙ্ঘনীয়। যাহা হউক এই পর্যন্ত যাহা বলা হইল ইহাতে বুঝা গেল যে তক্দীর সঠিক এবং আল্লাহর বিধান যাহা লেখা হইয়া গিয়াছে উহাই প্রকাশিত হয়, উহার বিপরীত শত চেষ্টায়ও কিছু হয় না। ইহা স্বপ্রমাণিত হইল।
এখন সন্দেহ হয় যে, যখন আল্লাহর লেখা তক্দীর অনুযায়ীই আমাদের কাজ হইবে, তখন মন্দ কাজের জন্য আমাকে দোষারোপ করা হয় কেন? আবার আল্লাহ বলেন আমি হাদী, যাকে আমি হেদায়েত করি সেই হেদায়েত পায়। তাহা হইলে আবার মানুষ হাদী হয় কি প্রকারে? আর যদি আল্লাহও হাদী হন এবং মানুষও হাদী হন, তবে ইহা ত শেরেকীর মতই হয়। কারণ যে কাজ আল্লাহর জন্য খাছ, উহা মানুষের উপর আরোপ করাকেই ত শেরেক বলে। আর যদি আমার কাজের জন্য আমাকেই দায়ী হইতে হয় তাহা হইলে তক্দীর বলিতে আর কি রহিল?
২. আল্লাহ বলেন, “মান আমেলা ছালেহান ফালিনাফ্ছিহে অমান আছায়া ফামালায়হা”- যে কেহ সৎ কাজ করিবে তাহার প্রতিফল সে ভোগ করিবে। আর যে কেহ অসৎ কাজ করিবে তাহার ফলও তাহার নফস ভোগ করিবে। অপর স্থানে বর্ণিত আছে, “মানুষ দুই হাতের দ্বারা যাহা করে তাহার ফলস্বরূপ এই বালা মুছিবত ভোগ করে।” হাদিস শরীফে ইহাও বর্ণিত আছে যে, “হে ফাতেমা তুমি নবী নন্দিনী বলিয়া গর্ব করিওনা, হাশরে ইহা প্রশ্ন হইবে না যে তেমার নছব কি বরং ইহাই প্রশ্ন হইবে যে তোমার আমল কি? বরং সৎ আমল দ্বারাই যে মানুষ অধঃপতন হইতে বাঁচে ও উন্নত হয়, উহার যথেষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান দেখা যায়। দেখ, এক গুষ্ঠীর লোক কেহই লেখা পড়া জানে না; আবার যদি সে বংশের কেহ বিদ্যালয়ে যায়, তবে বেশ বিদ্যা অর্জনও করিতে পারে। আবার দেখ, এক বংশের লোক তাহারা কখনও চাকুরী করে নাই এবং কেহই সারেং মিস্ত্রী বা অন্য কোন পদও অর্জন করে নাইÑ কিন্তু যদি ঐ বংশের কেহ বিদেশ গিয়া কাজ করে তবে কেহ সারেং কেহ মিস্ত্রী ইত্যাদি হইতে পারে এবং হইতেছেও। আবার দেখ যাহারা কোনদিন চেষ্টা তদ্বীর না করিয়া অলসভাবে বসিয়া থাকে তাহারা কোন দিক দিয়াই উন্নতি করিতে পারে না। কিন্তু যদি কেহ চেষ্টা করে তবে, বিদ্যা, বুদ্ধি, ধন ইত্যাদি উপার্জন করিতে পারে। আবার এক অঞ্চলে স্কুল, মাদ্রাসা কিছুই নাই, সেখানকার লোক মূর্খ, তাহাদের সকলের তকদীরে কি মূর্খতাই লিখিত হইয়াছে? আবার দেখ, যে এলাকায় কোন স্কুল, মাদ্রাসা গঠন করা হয়, ক্রমে ক্রমে সেখানে লোক শিক্ষিত হইতে থাকে, এই যে শিক্ষা বিস্তার করা ইহা কি তদ্বীর নয়? আবার দেখ, একজন সারেং তাহার আত্মীয়গণের অনেককে চাকুরী দিয়া জীবিকার উন্নতির ব্যবস্থা করিয়া দিতেছে। আবার একজন লোক কাজের উপযুক্ত অথচ উপযুক্ত সুপারিশকারী না পাওয়াতে কাজ পাইতেছে না। তাহা হইলে দেখা গেল যে তদ্বীর বা উছিলা ছাড়া কোন কাজই সমাধা হইতেছে না। আল্লাহও বলেছেন, “অবতাগু এলাইহেল অছিলা।” তাহা হইলে দেখা যায় যে চেষ্টার ফলেই মানুষ বিদ্বান হয়। চেষ্টা বা তদ্বীরের ফলেই মানুষ রাজত্ব বা ধন উপার্জন করে ইহা স্বপ্রমাণিত হইল।
এখন সন্দেহ হয় যে, যখন চেষ্টা ব্যতীত কোন কাজ সমাধা হয় না এবং এই চেষ্টা বা তদ্বীর করার তাগিদ কোরান এবং হাদিস এবং জাগতিক কার্যকলাপ দ্বারাও পাওয়া যায়, তখন আবার তক্দীর মানার অর্থ কি হইতে পারে? আবার যদি তক্দীরকে অবিশ্বাস করা হয় তবে খোদা ও রাসুলকে অবিশ্বাস করা হইল। তক্দীর মানার পক্ষেও খোদা ও রাসুলের বাণীর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। আবার তদ্বীর করার পক্ষেও খোদা ও রাসুলের বাণীর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। আবার দেখ, ধার্মিক লোকদের জন্য খোদা ও রাসুল হইতেছেন একমাত্র লক্ষ্যবস্তু। তাঁহাদের কোন কালাম যদি অবিশ্বাস করা হয় তাহা হইলেও কাফের হইবেই। যদি বলে যে খোদা ও রাসুলের কালামের মধ্যে একটু যুক্তির ত্রুটি আছে তবুও বেঈমান হইতে হইবে। এমন কি যদি পরস্পর দুইটা আদেশের মধ্যে কোন পরস্পর বিরোধী অর্থ মনে হয় তবে সেস্থানে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করতঃ চুপ থাকিতে হইবে। আর যদি এমন কোন তাবির করা যায় যদ্বারা অর্থ স্পষ্ট বুঝে আসে অথচ খোদা ও রাসুলের প্রতি অবহেলাত আসেই না বরং ভক্তি আরও বৃদ্ধি পায়, তবে তেমন অর্থ ব্যক্ত করা জায়েজ এবং ইহা ইসলামের মজবুতির কারণ হয়।
১ম প্রশ্নের উত্তর :
হে প্রশ্নকারী! তুমি বলেছ, তক্দীর এড়াইয়া কোন কিছু করা যায় না, তাহা ঠিক; কিন্তু তোমার জন্য নয়। দেখ, কেহ চুরি করিলে তাহাকে বিচারে শাস্তিও দেওয়া হয়, তুমি কি বলিতে পার যে তাহার শাস্তি দেওয়াটা নাহক হইতেছে; কেননা তাহার তক্দীরেই ঐ চুরি করা লেখা ছিল। এক ডাকাত কোন লোককে হত্যা করিয়া মালামাল লইয়া গেল। বিচারে ডাকাতকে প্রাণদ-ে দ-িত করা হইল। ইহাকি ন্যায় না অন্যায়? কোন গু-া লোক কাহারও ঝি, বৌকে হরণ করিয়া নিলে তাহাকে আইনত: শাস্তি দিতে হইবে, ইহাকি অন্যায় হইবে? এসমস্ত দুষ্টের দমন না করিলে জগতে শান্তি কায়েম থাকিতে পারে না, সেজন্য বিশৃঙ্খলা দূর করত: সুশৃঙ্খলভাবে জীবন-যাপন করার জন্য এসমস্ত আইন বলবত রাখিয়া দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করাই হইতেছে মানবতার বৈশিষ্ট্য।
তদ্রƒপ আল্লাহর তরফ হইতেও তোমার দেহের মধ্যে দুই বিপরীত পন্থী প্রবৃত্তি দিয়া তোমাকে দেহ রাজ্যের রক্ষক বা রাজা বানাইয়া দেওয়া হইয়াছে। যদি তুমি অসৎ প্রজাকে শাস্তি দিয়া সৎপ্রজাকে শান্তিতে রাখিতে পার, তাহা হইলে আসল রাজার কাছে গিয়া পুরষ্কার পাইবে। আর যদি বল তক্দীরেই এইরূপ ছিল, চেষ্টা করিয়া কি করিব? তবে আল্লাহও বলিবেন, আচ্ছা, দুনিয়াতে তুমি যে রাষ্ট্রে বাস করিয়াছ তথাকার রাজার প্রচারিত আইন মান্য করিয়া চলিতে বাধ্য ছিলে কিনা? আচ্ছা, তোমার ঘরে কেহ চুরি করিলে, তুমি চোরকে দোষারূপ করিয়া রাজার দরবারে বিচারপ্রার্থী হইয়াছিলে কিনা? রাজা বা রাজ প্রতিনিধি তোমার সুবিচার করিলে তুমি রাজাকে ধন্যবাদ দিতে কিনা? আর অপরাধীকে প্রশ্রয় দিয়া তোমার ক্ষতি করিলে তুমি রাজার নিন্দা করিতে কিনা? তেমনিভাবে তোমার অসৎ প্রজাকে প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে তোমার সৎ প্রজাবৃন্দ তোমার নিন্দাবাদ করিবে। তক্দীরের বিষয়ে তুমি কি জানিতে না যে আমি রেজেক দাতা ছিলাম? তবুও তুমি জীবিকার জন্য দেশ বিদেশ ঘুরিতে। আর কখনও ব্যবসায়, কখনও চাকুরি, কখনও কৃষি কাজ করিতে। যদি দুনিয়ার জীবিকার জন্য আমার আশ্বাস বাণীর উপরও তদ্বীর করা বন্ধ কর নাই, তবে আখিরাতের বেলায় কেন তদ্বীর করা বন্ধ করিয়াছিলে? ইহা তক্দীর মানা নয় বরং অলসতামাত্র। যদি বল যে, আল্লাহ যাহাদের নেক কাজ করিতে দেন তাহারাই নেক কাজ করে, আমাদেরে যাহা করিতে দিয়াছেন তাহা আমরা করিতেছি। ইহার উত্তরে আল্লাহ বলিবেন, আমি কাহাকেও কোটিপতি কাহাকেও লক্ষপতি কাহাকেও হাজারী বানাইয়াছিলাম। তোমরা কি তাহাদের সঙ্গে কখনও প্রতিযোগিতা করিতে চেষ্টা কর নাই এবং প্রতিযোগিতার অনেক ক্ষেত্রে কৃতকার্যও হও নাই? জগতের সকল ব্যাপারেই যেমন বুদ্ধি ও শক্তি থাকা পর্যন্ত মানুষ যেমন চেষ্টা-তদবীর করিতে কোন ত্রুটি করে না, তেমনি আখেরাতের বেলায়ও বুদ্ধি ও শক্তি থাকা পর্যন্ত কাজে বিরত থাকা যুক্তিযুক্ত নয়।
হে প্রশ্নকারী! তুমি আরও বলিয়াছ আল্লাহ হাদী, আবার মানুষ হাদী হইল কিভাবে? এই কথায় র্শেক হইবে কিনা?
উহার উত্তর শোন। র্শেক অর্থ ‘অংশীবাদ’। যে জিনিসের মালিক খোদা স্বয়ং তাহাতে অপর কাহারো মালিকানা স্বীকার করার নাম হইতেছে র্শেক। কিন্তু এই হেদায়েতের ব্যাপারে তদ্রƒপ কোন আকিদাই নাই। এ বিষয়টা বুঝাইতে একটা উপমা দেওয়া হইলÑ মনে কর, এক ব্যক্তি একখানা নৌকা বানাইল। যে ব্যক্তি টাকা খরচ করিয়া নৌকা বানাইল সেই নৌকার প্রকৃত মালিক। এই জন্যই সে বলে, আমি একখানা নৌকা গড়িতেছি বা গড়িয়াছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উক্ত মালিক নিজ হাতে কিছুই করে নাই, সমস্ত কাজ করিয়াছে মিস্ত্রি, এই কারণে মিস্ত্রিও বলে যে, আমি একখানা নৌকা গড়িয়াছি বা গড়িতেছি। ইহা সচরাচর সকলেই জানেন, তাই বলিয়া কেহ কি মিস্ত্রিকেও টাকাওয়ালার- অংশীদার হিসাবে উক্ত নৌকার মালিকানার শরীক বলিবে? এরূপই একজন একখানা ঘর দিতেছে বা দালান দিতেছে। উক্ত ব্যক্তিও বলিতেছে আমি একখানা ঘর বা দালান দিতেছি এবং উহার প্রস্তুতকারক মিস্ত্রিও বলে আমি একখানা ঘর বা দালান দিতেছি, তাই বলিয়া কেহই উক্ত মিস্ত্রিকে ঘর বা দালানের শরীক বলিবে না। আর উক্ত মালিককেও কেহ বলিতে পারে না যে তুমি নিজেত ঘরের কাজ কর নাই বা দালানের একটু কাজও কর নাই সকলই করিয়াছে কারিগর। এমতাবস্থায় তুমি কি আর বলিতে পার যে আমি দালান দিতেছি? এরূপ কেহই বলিবে না। অবশ্য যদি একটা নৌকার বা দালানের এক বা একাধিক মালিক বা শরীক থাকে, তাহা হইলে প্রত্যেকেই তার শরীক বা মালিকানা দাবী করিতে পারিবে।
এখানে ধনের মালিক যে বলিল, আমি একখানা নৌকা গড়িতেছি তাহা ঠিকই, যেহেতু তাহার ধনের দ্বারা সে নিজস্ব একটা জিনিস বানাইবে, সে হুকুম করিলে বহু মিস্ত্রি পাইতে পারে; সে যে রকম ঢঙের জিনিস বানাইতে চায় তাহাই প্রস্তুত করাইতে পারে। তাহা হইলে দেখা গেল যে, মালিক ও মিস্ত্রি দুজনেরই এখানে অংশ আছে, কিন্তু ধনের মালিকই প্রকৃত মালিক, মিস্ত্রি প্রকৃত মালিক হইতে পারে না; ধনের মালিক প্রকৃত মালিক এই হিসাবে, যেহেতু তিনি মাল-ছামান ও মিস্ত্রির মজুরীসহ সর্বপ্রকার খরচ নিজে বহন করিয়া জিনিসটা প্রস্তুত করাইলেন। আর মিস্ত্রি বানানেওয়ালা এই হিসাবে যে সে তাহার দক্ষতা দ্বারা বাড়ি বা নৌকা গড়িয়াছেন। মিস্ত্রি যদিও মালিক হয় নাই, কিন্তু বানানেওয়ালা হিসাবে তাহার নামটা একেবারে কাটা যায় না।
দেখ, কোনও ধনী লোক বিভিন্ন মিস্ত্রি দিয়া ১০/১২ খানা নৌকা গড়াইল, কিন্তু তবুও সেই ধনের মালিক কথায় কথায় বলিয়া থাকে যে, এইখানা অমুক মিস্ত্রির নৌকা, ওখানা অমুক মিস্ত্রির নৌকা। এরূপভাবেই এখানেও খোদাপাক তিনিই শাইয়েন কাদির, নিজেই সর্বৈব কর্তাÑহেদায়েতের মালিক, যে ছামান ও মূলধন এবং মিস্ত্রির মজুরীÑসব কিছু দিয়া একজন মিস্ত্রি স্বরূপ বান্দাকে নিয়োজিত করেন এবং তাহার দ্বারা হেদায়েত করাইয়া নেন এবং দয়া করিয়া সেই বান্দার নামকে নিজের নামের সঙ্গে জড়িত করিয়া হাদী বলিয়া বিঘোষিত করিয়া দেন।
প্রশ্ন করিতে পার যে, ধনী ব্যক্তি নৌকা তৈরীর মাল- সরঞ্জাম সবকিছু দিয়াছিল, তাহাত বুঝলাম। কিন্তু হেদায়েত কাজের মাল সরঞ্জাম কি? তবে শোন, যে মানুষ হাদী হইবেন তাহাকে জীবন লইয়া বাঁচিয়া থাকিতে হইবে। কাজেই, এই যে হায়াৎ ইহাই মূলধন। তারপর খাওয়া-খাদ্য Ñউহা পারিশ্রমিক। তারপর, যন্ত্রপাতি? প্রধান যন্ত্র হইল এলমে মারেফৎ। উহা না পাওয়া পর্যন্ত সে হাদী-ই হইতে পারে না। তারপর হিম্মত, তারপর ধৈর্য, তারপর তাওয়াক্কুল। এই কয়টি জিনিস ছাড়া কেহই মানুষদিগকে হেদায়েত করিতে পারে না। অথচ উহা খোদা পাকের দান ব্যতীত কেহ পাইতেও পারে না। বুঝা গেল যে, খোদাই আসল হাদী তাঁহার কোন শরীক নাই। আবার বান্দা খোদা প্রদত্ত জ্ঞান হিম্মত ও তাওয়াক্কুল বলে যে বান্দাদিগকে আল্লার রাস্তায় ডাকিয়া আনেন এবং এই কাজের মধ্যে যে সকল দুঃখ কষ্ট আসে তাহা ধৈর্য সহকারে বরণ করিয়া নেন, এই কারণে তাঁহাকে আদর্শ মানব বা পথ প্রদর্শক হাদী বলা হয়।
২য় প্রশ্নের উত্তর :
হে প্রশ্নকারী! তুমি বলিতে পার যে, যখন সকল কাজই চেষ্টা-তদ্বীর করিয়া করিতে হইবে তখন আর তক্দীর মানার এত তাগিদ কেন? তবে শোন, তুমি যেমন তক্দীর মানিয়া চেষ্টা ত্যাগ করিলে আল্লাহকেই দায়ী করা হইবে তাহা উপরের আলোচনায় ভালভাবেই বুঝিয়াছ। তদ্রƒপ তুমি যদি তদ্বীর করিয়া সকল কর্ম সমাধা করিয়া যাইতে পার এবং তক্দীরকে মোটেও পরোয়া না কর তাহা হইলে এই সংসারে হয়ত তোমার বিশেষ কোন সমস্যা নাও ঘটিতে পারে। কিন্তু আখেরাতে তোমার সামনে এমন জটিল সমস্যা উপস্থিত হইবে যাহা এড়াইয়া যাওয়া সম্ভব হইবে না। যদিও তুমি দুনিয়ায় সকল কাজ সুশৃঙ্খলভাবে করিয়া যাইতে পার এবং যদিও ধর্মের বিধানগুলি যথাযথভাবে প্রতিপালন করিয়া যাইতেছ; কিন্তু একমাত্র তক্দীর অমান্য বা তক্দীর সম্বন্ধে শৈথিল্য করার কারণে আখেরাতে ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হইতে হইবে।
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, কেয়ামতের দিন কোন এক আবেদকে বেহেস্তে নেওয়ার জন্য আল্লাহ ফেরেস্তাকে আদেশ দিবেন, হে ফেরেস্তা! আমার রহমতে এই বান্দাকে বেহেস্তে লইয়া যাও। উক্ত আবেদ মনে মনে দুঃখিত হইল, যেহেতু সে ভাবিতে লাগিল, আমি এত এবাদত বন্দেগী করিয়াছি সে সমস্তের কোন উল্লেখই নাই। তাহার মনোভাব বুঝিতে পারিয়া আল্লাহ ফেরেস্তাকে আদেশ দিলেন, “তাহাকে দোজখের দিকে লইয়া যাও”। যখন দোজখের গরম বাতাস দেহে লাগিতেছিল, আল্লাহর ইশারায় ফেরেস্তা তাহাকে থামাইয়া রাখিল। এদিকে সেই বান্দার পানি পিপাসা বাড়িয়া চলিল। খোদার হুকুমে ফেরেশতা এক গ্লাস পানি লইয়া হাজির হইল। আবেদ পানি চাহিলে, উত্তর করিল, ইহা বিক্রির জন্য, নেকীর বদলে বিক্রি হইবে। আবেদ এক এক করে সারাজীবনের সমস্ত নেকীর বদলেও পানি পায় না। অবশেষে সে বলিল আমার জীবনের সকল নেকী দিতেছি, আল্লার ওয়াস্তে পানি পান করাইয়া আমার প্রাণ বাঁচাও। ফেরেস্তা বলিল, যদি আল্লার নাম না লইতে তাহা হইলে তোমার সারা জীবনের নেকের বদলেও পানি পাইতে না। আল্লাহর হুকুমে এই আবেদকে প্রশ্ন করা হইল, “ওহে আবেদ! এক গ্লাস পানি পান করিলা সারা জীবনের নেকী দিয়া, এখন বল, বেহেস্তে যাইবে কি দিয়া? আর তোমার জীবনে যত নেকী অর্জন করিয়াছিলে যে পানি ও যে নেয়ামত খাইয়া, উহার মূল্য দিবে কি দিয়া?” আবেদ লজ্জিত হইয়া সেজদায় পড়িয়া গেল। খোদা তায়ালা আদেশ দিলেন, “যাও, আমি দয়া করিয়াই তোমার তক্দীরে বেহেস্ত লিখিয়াছিলাম; তাই আমার রহমতে তোমাকে বেহেস্তে স্থান দিতেছি। কিন্তু তুমি নিজে বিচার করিয়া দেখ কোন বান্দাই তাহার আমলের উপর দাবী করিয়া আমার কাছে কিছু পাইতে পারে না।
হে প্রশ্নকারী! তুমি হয়ত বলিতে পার যে, যখন কেবল আল্লাহর দয়া ব্যতীত কোন আমল দ্বারাই বেহেস্ত পাইব না, তখন আমিও সেই দয়ালু আল্লাহর কৃপার আশায় বুক বাঁধিয়া রহিলাম; নিশ্চয়ই আমার আমলের জন্য আল্লার কোন পরোয়া নাই, তিনি দয়া করিয়া আমাকেও বেহেস্তে দিবেন। উত্তরে আমি বলিব, নিশ্চয়ই শয়তান তোমাকে মুরীদ বানাইয়াছে। কারণ, তুমিও যে মানুষ, জগতের সকলেই সেইরূপ মানুষ। তোমাকে আল্লাহ যদি বিনা উছিলায় কেবল দয়া করিয়া বেহেস্ত দান করেন, তাহা হইলে সারাজাহানের সমন্ত মানুষকেই বিনা উছিলায় বেহেস্তে দিতে হয়। বলত, তাহা হইলে দোজখ বলিতে কোন কিছু নাই কি? যদি বল যে কতক লোক দোজখে যাইবে কিন্তু আমি খোদার কাছে বেহেস্তের আশা রাখি। তা’র উত্তরে আমি বলিব যে তোমার সৃষ্টির সময়ে কি খোদার সঙ্গে এমন কোন কথা হইয়াছিল যে আল্লাহ তোমাকে বেহেস্ত দিবেন আর অপর বান্দাদিগকে দোজখে দিবেন? যাহা হউক, তুমি যদি আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করিয়া কোন আমল না কর, তাহা হইলে তুমি নিশ্চয় দোজখী হইবে। “ঐ ভরসায় নাজাত পাইবে”Ñ এরূপ ভরসা কেবল ‘নফস’ ও ‘শয়তান’ই দিয়া থাকে। এই জন্য পথপ্রদর্শক ব্যতীত এই পথে চলা যায় না। তুমি যদি নিজে নিজে রাস্তা চলা আরম্ভ কর, তাহা হইলে এরূপ ভরসা দেখাইয়া তোমাকে কাজে বিরত রাখিবে, পরিণামে জাহান্নামে লইয়া যাইবে। যখন দেলে এইরূপ সন্দেহ উদয় হয়, তখন খেয়াল কর, আমাদের পীর ও মুর্শীদ কি কাজ করিতেন? যদি তিনি কঠোর পরিশ্রম করিয়া নামাজ রোজা ইত্যাদি আমল করিতেন, তাহা হইলে তুমি কি তাঁহাদের চেয়ে খোদার বেশী পেয়ারা হইলে যে, তোমার কিছুই করিতে হইবে না? নাকি পীর সাহেবের চাইতে তোমার জ্ঞান বেশি হইল যে এই মছলা তিনি বুঝেন নাই? এমনিভাবে নফসকে তিরষ্কার করিয়া কাজে লাগিয়া থাকিবে। কখনও অলসভাবে বসিয়া থাকিবে না। হে তরীকত পন্থী, এই পথ বড়ই সুক্ষ্ম খুবই সতর্ক হইয়া চলিতে হইবে।
তুমি যখন কাজে লাগিয়া যাইবে, তখন সহসা তোমার মনে জাগাইয়া দিবে, তুমি নামাজ পড়ছ, রোজা রাখছ, ধর্ম-কর্ম পালন করছ, আল্লাহ নিশ্চয় তোমাকে নাজাত দিবেন। যাহারা এসব করেন না তাহারা আল্লাহর অভিশাপে জাহান্নামে যাইবে। এভাবে শয়তান মনের ভিতর অহংকার ও উজব উদিত করিয়া মানুষকে ধ্বংস করে। তখনকার ব্যবস্থা হইল : যেকোন নেক কাজ করিয়া আল্লাহর দরগাহে তওবা করা। নামাজ পড়িয়া এই ভাবে তৌবা করা চাই যে, হে খোদা! যাহারা নামাজ পড়ে নাই, তাহারা আমার চাইতে ভাল, যেহেতু নামাজ সম্বন্ধে জ্ঞান যাহা আমাকে দিয়াছ, সেই জ্ঞান তাহারা পায় নাই। কিন্তু আমি যে তোমাকে জানার পরেও তোমার মহান দরবারে বেয়াদবী করিলাম, যদি তুমি নিজ দয়া গুণে আমাকে ক্ষমা না কর এবং এই অসম্পূর্ণ নামাজ কবুল না কর, তাহা হইলে এই নামাজই হয়ত আমাকে বিপদগ্রস্ত করিবে। তারপর আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করিবে, হে আল্লাহ এই নামাজ বা তেলাওয়াতে কোরআন ইত্যাদি যাহা বহু মানুষকে তুমি করিবার তৌফিক দেও নাই। দয়া করিয়া আমার মত নালায়েককে যে ইহা করিবার তৌফিক দিয়াছ, ইহা কেবলই তোমার মেহেরবাণী। নেহায়েত কাকুতি-মিনতি সহকারে মোনাজাত করিবে যে, “হে খোদা! যেমনিভাবে তুমি আমাকে ইহা করিবার তৌফিক দিয়াছ, তেমনিভাবে ইহা আরও বেশী বেশী করিবার তৌফিক দান কর। আর এই অধমের ভুল ত্রুটি প্রকাশ করিয়া আমাকে জাহান্নামী করিও না।”
এই জন্যই বলা হয় যে, আজিজীতে খোদা রাজী। দেখ, যদি কেহ মেহমানদারী করে, তবে যথাসম্ভব খেদমত ও খাওয়ার বন্দোবস্ত করে। তারপর খাওয়া শেষ হইলে কত করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে। একথা সকলেই জানেন যে খাওয়া ও খেদমতে যতটা সন্তুষ্ট না হইতে পারে, কিন্তু এই নম্র ব্যবহারে ইহার চাইতেও অনেক বেশী সন্তুষ্ট হইয়া থাকে। তাই বলিয়া মেহমানকে কোন প্রকার খায়-খেদমত না করিয়া ও খাওয়ার সুবন্দোবস্ত না করিয়া শুধু হাত জোড় করিলে মেহমান কখনও সন্তুষ্ট হইতে পারে না। তদ্রƒপ এখানেও যথা সম্ভব আমল দুরস্ত করিতেই হইবে। আবার নিজের অযোগ্যতাও প্রকাশ করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিতে হইবে। এবাদত ঠিকমত করিয়াও আজিজি না করাতে অহংকারী প্রকাশ পায়। আবার এবাদত না করিয়া শুধু নিজেকে নাচিজ ও অযোগ্য জ্ঞান করিলে, তাহাও বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। যথা: একদল মূর্খ ফকীর মারফতের দাবী করে, কিন্তু নামাজ রোজা কিছু করে না। তাহারা বলিয়া থাকে, আমরা নিজদিগকে নেহায়েৎ অযোগ্য বলিয়া মনে করি, এজন্য এইসব করিনা। প্রকৃতপক্ষে উহা শয়তানের ধোকা ছাড়া কিছুই নয়।
সন্দেহ :
পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে তার মধ্যে সত্য কেবলই একটা আর সকলই বাতেল। এখন প্রশ্ন: কোন্ ধর্ম নিরেট সত্য? যদি বল যে ইসলামই ঠিক, তদ্রƒপ অপর ধর্মাবলম্বীগণও বলিবে তাহাদের ধর্মও সঠিক। ইসলামের তরফ হইতে ইহার প্রাথমিক উত্তর এই যে পৃথিবী ও উহার যত জীবও পদার্থ আছে সকলের সৃষ্টিকর্তা একজন, তিনিই আল্লাহ। সুতরাং যাহারা একত্ববাদী হইয়া সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করে তাহারাই সঠিক পথে আছে। আর যাহারা অংশীবাদী হইয়া উপাসনা করে তাহারা পথভ্রষ্ট। অতএব বর্তমানে পৃথিবীতে ইসলাম ধর্ম ছাড়া আর যত ধর্ম প্রচলিত আছে সবার মধ্যেই অংশীবাদ দেখা যায়। কাজেই বলা যায় যে, ইসলামই নিরেট সত্য ধর্ম।
কিন্তু এখানে আমি প্রশ্ন করিব যে, এইরূপ একত্ববাদী প্রায় সকল ধর্মমতের মধ্যেই আছে। কেননা, প্রত্যেক ধর্মেরই যাহারা বিশেষজ্ঞ তাহারা ভালমতই বুঝিয়াছেন যে সৃষ্টির ব্যাপারে মহা প্রভু বিশ্বস্রষ্টা একাই মালিক। তবে পৃথিবীতে তাহার প্রকাশ বিকাশের ব্যাপারে তিনি কখনও কাহাকে প্রভাবান্বিত করিয়া তাহাদের মধ্যে নিজেকে গোপন রাখিয়া নিজেরই ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করিয়াছেন এবং ঐ সকল প্রভাবান্বিত ব্যক্তিগণ যে মহাপ্রভু বিশ্বস্রষ্টারই প্রতিনিধি এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন, উহার প্রমাণস্বরূপ প্রতিনিধি ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি অলৌকিক কিছু ক্ষমতা দেখাইয়াছেন। এই অলৌকিক ক্ষমতার নিদর্শন দেখিয়া লোক সকল তাহার ভক্ত হইয়া তাহার মধ্যবর্তীতায় সৃষ্টিকর্তার পূজা বা উপাসনা করিয়া আসিতেছে। তবে কতক অজ্ঞ লোক ঐ সকল নিগূঢ় তত্ত্ব বুঝিতে না পারিয়া ঐ সকল ক্ষমতাপ্রাপ্ত লোকদিগকেই আসল উপাস্য মনে করিতেছে। এজন্য সমস্ত ধর্মটাই অমূলক হইয়া যাইবে তাহা কি করিয়া হইতে পারে? অধিকন্তু যে ইসলাম জোরেশোরে একত্ববাদীত্বের দাবী করে, সেই ইসলাম ধর্মেও ত নানা মত প্রচলিত দেখা যায়। দেখ, ইসলামের কতক লোক বিপদে পড়িলে অনেক নবী-ওলীদের দোহাই দেয়। কতকলোক লম্বা চুল রাখিয়া নামাজ রোজা ত্যাগ করত: ফকিরী করিতেছে, কতক নেদায়ে গায়রুল্লাহ করিতেছে। কতক সোগলে বারজাখ করিতেছে। কতক ধ্যানে বসে, কাল্পনিক ছুরত ধরিয়া উহাকে আল্লাহতায়ালার ছুরতে মিছালী ভাবিতেছে। তাহাদিগকে কি বলিবে? তাহারা কি মুসলমান নয়? আবার একদল অপরদলকে গোমরাহ বেদাতি এবং মোশরেকও বলিতেছে। দেখা যায় যে, যাহাদিগকে মোশরেক বলা হয় তাহারাও দলিল দিয়া নিজদিগকে নির্দোষ প্রমাণ করিতেছে। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেকের বিশ্বাস মূর্তি পুজকদের মতই দেখা যায় অথচ তাহারা মুসলমান। গায়ের-মোকাল্লেদিনগণ মোকাল্লেদিনদিগকে বেদাতীদিগকে মোশরেকদিগের সঙ্গে তুলনা করিতেছে। আবার তাছাউফ ও মারেফত অস্বীকারকারীরা পীরালীকে বেদাতী এমনকি শেরেকীর সঙ্গে তুলনা করিয়া থাকে। যখন একমাত্র সত্য ধর্মের দাবিদার ইসলাম ধর্মের মধ্যেই এত দল ও মতবাদ বিদ্যমান, তখন তাহাদের নিকট যে অন্যান্য ধর্ম বাতেল ধর্ম বলিয়াই বিবেচিত হইবে তাহাতে আর বিচিত্র কি? কিন্তু তাই বলিয়া কেবল ইসলামের ডাকেই অন্য ধর্ম ত্যাগ করিয়া ইসলামকেই একমাত্র খাঁটি ধর্ম হিসাবে মানিয়া লইব তাহা হইতে পারে না। এই সমস্ত সন্দেহ মিটাইয়া সৃষ্টিকর্তার খাঁটি পরিচয় দিতে হইবে। যিনি সকল ধর্মাবলম্বীকে বুঝাইয়া সত্য আল্লাহর পরিচয় দিতে পারিবেন, তিনিই খাঁটি নায়েবে নবী হইবেন এবং তাহার অনুকরণেই এই উম্মতের অধঃপতন দূর হইবে।

পরম দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করিতেছি

হকিকতে শরীয়ত

পবিত্র শরীয়তে মোহাম্মদীর মূল ৫টি, ১) কালেমা, ২) নামাজ, ৩) রোজা, ৪) যাকাত ও ৫) হজ্জ্ব।
হযরত নবী করিম ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম ফরমাইয়াছেন, যে পড়িয়াছে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” সে বেহেশতী। চিন্তার বিষয় যে কথাটুকুর কারণে চির সুখের সামগ্রী ও অনন্তকালের সুখের জীবন লাভ হইতে পারে উহার গুরুত্ব কত। অতএব প্রত্যেকটি মানুষেরই কর্তব্য উক্ত কালেমার গূঢ় তত্ত্ব বুঝা ও আমলে আনা।
বহু লোকই কালেমার উচ্চারণ ঠিকমত করিতে পারে না। ‘ইল্লাল্লাহ্র’ স্থলে ইল্লেল্লাহ পড়ে। আর যাহারা উচ্চারণ ঠিকমত করে, কিন্তু তাহারা উহার মানে মতলব বুঝেনা। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ মোহাম্মাদুর রাছুলুল্লাহ” অর্থ- এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নাই হযরত মোহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর রাছুল। যাহারা এই পর্যন্ত অর্থ শিক্ষা করিয়াই বসিয়া আছেন তাহারা অজ্ঞ। কালেমার জন্যই লক্ষ লক্ষ নবীর আগমন ও বহু ছহিফা এবং জব্বুর, তৌরাত, ইঞ্জিল ও কোরআন শরীফ আছমান হইতে নাজিল হইয়াছে। উহা কেবলই এতটুকু অর্থের উপর নির্ভর করিবার যোগ্য কথা নয়। শুধু তোতার মত বলিলেই চলিবে না যে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নাই। বরং সেই আল্লাহকে চেনা, তারপর সেই আল্লাহর সামনে বলিতে হইবে, হে প্রভু! তুমি ব্যতীত আর কেহ মালিক নাই। ইহা বুঝাইবার জন্য একটি উপমা দিতেছি। দৃশ্যমান জগতে যাহা কিছু দেখিতে পাই উহার প্রত্যেকটির সঙ্গেই কর্ম কর্তা ও ক্রিয়ার সংযোগ আছে। এই যে সাদা কাগজখানা, ইহা একটি শূণ্য বা খালি জিনিস। এখন আমি ইহাতে একটি ‘ক’ লিখিলাম। তাহা হইলে এই ‘ক’ টি কর্ম, আমি কর্তা ও লেখাটা ক্রিয়া। এইবার আসুন, আমাদের নিজেদের সাথে বিচার করিয়া কর্তা বাহির করি। আমি বর্তমানে আছি, আগে ছিলাম না এবং অন্যের ক্রিয়া ব্যতীত আমি হইতে পারি নাই। সুতরাং এই জগতটা যেন শূণ্য বা সাদা কাগজ সদৃশ, আর আমি সেই ‘ক’ সদৃশ কর্ম এবং এই শূণ্য জগতে আমাকে যিনি প্রতিষ্ঠিত করিলেন তিনিই আমার কর্তা, তিনিই আমার “আল্লাহ”। অতএব আমি যখন বিচার করতঃ এই সত্যে গিয়া পোঁছিতে পারিলাম যে নিশ্চয়ই আমার একজন কর্তা আছেন এবং তিনিই আমার মালিক বা ‘ইলাহ’ তখন আর অন্যের মুখে শুনিয়া অন্ধ বিশ্বাসের মত বলিব না যে এক খোদা ছাড়া আর কোন মাবুদ নাই, বরং তখন বিজ্ঞতার সহিত পড়িব, হে প্রভু! তুমিই আমার কর্তা বা মালিক। তুমি ছাড়া আর কেহ মাবুদ বা ‘ইলাহ’ নাই। এই পর্যন্ত বুঝিয়া যে পড়িবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ তাহার কালেমার তাছিরে ক্বলবে যে নূর পয়দা হইবে ও খোদার প্রতি ভক্তি ও মোহব্বত পয়দা হইবে তাহা শুধু মৌখিক কালেমা পাঠকারী কখনোই অনুভব করিতে পারিবে না।
এই পর্যন্ত কর্তার পরিচয় পাইয়াই যদি কেহ মনে করে যে আমার কালেমার মারেফত হাছেল হইয়া গিয়াছে সেও অজ্ঞ। কারণ, জ্ঞান ও নফ্স উভয়কেই খোদা পয়দা করিয়া মানব দেহে বাস করিতে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধের আদেশ দিয়াছেন। যতদিন মানব জীবিত থাকিবে ততদিন তাহারাও থাকিবে। কখনো জ্ঞান ‘নফছ্’কে দমন করিয়া নিজে বিকশিত হইবে। আবার কখনো ‘নফছ্’ প্রবল হইয়া জ্ঞানকে হার মানাইয়া নিজে বিকশিত হইবে। কাজেই মানুষ যতদিন রাস্তায় থাকিবে ততদিন যে কোন রকমের সত্যই অনুভব করুক না কেন সে কখনো পথভ্রষ্টতা হইতে নিশ্চিন্ত যেন না হয়, কেননা তাহার পিছনেই ‘নফছ্’ রহিয়াছে। তবে খোদা-পাকের দয়ায় মঞ্জিলে মকছুদে পোঁছিতে পারিলে অর্থাৎ বিচার জ্ঞান দ্বারা সারা জাহানের প্রভু যে একমাত্র আল্লাহ এই কথা যুক্তি প্রমাণ দিয়া বুঝিতে পারিলে এবং সে যে ধর্ম বা নীতির উপর চলিতেছে উহাই যে সারা জাহানের সমস্ত ধর্মনীতির উপর শ্রেষ্ঠ নীতি তাহা যুক্তি প্রমাণ দ্বারা জগদ্বাসীকে বুঝাইয়া দিতে পারিলে এবং তারপরেও খোদা পাকের তরফ হইতে গায়েবী মদদ পাইতে থাকিলে, তখন সে সারা জাহান হইতে মুখ ফিরাইয়া একমাত্র প্রভু আল্লাহ আহকামুল হাকিমিনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতঃ নিশ্চিন্ত হইতে পারিবে। তখন আর ‘নফছ’ তাহাকে পরাজিত করিতে পারিবে না। এই ইলাহই আমানত। এই আমানত সম্পূর্ণ ঠিক রাখিতে পারিলেই সে মোমেন এবং তাহারই স্থান বেহেশ্তে।
মেছাল স্বরূপ বলিতেছি, যখন তুমি ঐ পর্যন্ত ক্রিয়া, কর্ম ও কর্তার মেছাল বুঝিয়া খোদার সামনে ভক্তি সহকারে হাজির হইতেছ ও কালেমা পড়িতেছ তখন হঠাৎ ‘নফছ’ প্রবল হইয়া প্রশ্ন করিল, দেখ তুমি যে কর্তাকে উপাসনা করিতেছ তাহা তোমার জন্য ঠিক। কিন্তু তাই বলিয়া সারা জগতের সকলের জন্য একজনই কর্তা হইবেন এর প্রমাণ কি? তোমার মেছালে যে কর্তা ছাড়া কর্ম হয় না তাহা আমি মানিয়া লইলাম। কিন্তু বিভিন্ন কর্মের বিভিন্ন কর্তা থাকে। যেমন দেখ, এই ঘরখানা। ইহার বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন কর্তা আছে। টিনের কর্তা একজন, বেড়া বানানেওয়ালা অন্যজন। ঐরূপ বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন জীব-জানোয়ার বা পদার্থের বিভিন্ন কর্তা থাকাও ত অসম্ভব নয় যেমন দেখ, জগতে যত ধর্মাবলম্বী আছে প্রত্যেকেই আপন আপন উপাস্যের উপাসনা করিতেছে এবং তুমি যেমন ঘোর বিপদে বা বালা মুছিবতে আপন প্রভুর নামে প্রার্থনা করিয়া উপকার পাইতেছ, ঐরূপ সকল ধর্মের উপাসকগণ ত উপকৃত হইতেছে। তাহা হইলে কেমন করিয়া সারা জাহানের সব কিছুই তোমার এক কর্তারই কর্ম হইল? যে ব্যক্তি এই সন্দেহের উত্তর দিতে না পারিবে তাহার ঈমানের বল ক্রমশ: কমিতে থাকিবে এবং সে ‘নফছে’র তাবেদার বা অধীন হইয়া থাকিতে বাধ্য হইবে। সুতরাং তেমন কাঁচা ঈমানদারকে কোন পথ প্রদর্শকের অনুসরণ করা ফরজ।
অতএব উল্লিখিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হইলে প্রথমে একত্ব জ্ঞান হাছেল করিতে হইবে। একত্ব জ্ঞানের প্রভাবে তাহার বিচার জ্ঞান এমন প্রবল হইবে যে সে দৃঢ়তার সঙ্গে বলিয়া দিবে যে যিনি আমার কর্তা, তিনিই সারা জাহানের মানুষের কর্তা। শুধু মানুষেরই কর্তাই তিনি নহেন, বরং আসমান জমিন ও উভয়ের মধ্যে যতকিছু আছে সব কিছুরই কর্তা তিনি।
এই মোকামে পৌঁছিবার পর স্রষ্টা সম্বন্ধে তাহার কোন প্রকার সন্দেহ থাকিতে পারে না। সে নিঃসন্দেহে বলিবে আমিও যাহা সারা জাহানও তাহা। অর্থাৎ আমি যেমন কর্ম, কাহারও উপর আমার কোন কর্তৃত্ব নাই, ঐরূপ প্রত্যেকটি মানব দানব, জীব-জানোয়ার, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, চন্দ্র-সূর্য, জ্বিন-পরী, ফেরেশতা প্রত্যেকেই, এমন কি বালা-মুছিবত কলেরা, বসন্ত, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, ভুত-প্রেত কোন কিছুরই নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা কাহারও উপর কোন প্রকার কর্তৃত্ব নাই। সুতরাং সে জোড় গলায় বলিবে- ‘লা ইলাহা’ Ñকোন মাবুদ নাই, কোন কর্তা নাই; যাহা কিছু আছে প্রত্যেকেই আমার সমান। কাজেই আমার মাথা কাহারো সামনে নত হইতে পারে না। অতএব যে মুসলমান, যাহার মূলমন্ত্র ‘লা ইলাহা’ Ñসে সুদৃঢ় ইস্পাতের মত মজবুত হইয়া থাকিবেÑ না সে আগুন দেখিয়া টলিবে, না বান-বন্যা, ঘোর তুফান দেখিয়া দমিবে, না বালা-মুছিবত অভাব-অভিযোগ বা শত্রুর আক্রমন দেখিয়াই হেয় হইতে পারে? কখনও না, কাহারও সামনে নয়।
কিন্তু সেই একত্ব জ্ঞান কেমন বা কি করিয়া হাছিল করা যায় তাহা কোন কিতাবে লেখা যাইতে পারে না। উহা কেবল খোদা-পাকের খাস দান। ঐ এলেম দিয়া খোদা-পাক নবী ও নায়েবে-নবীগণকে সর্বসাধারণের উপর হেদায়েতের দায়িত্বভার অর্পন করেন।
কিন্তু নবীগণ তো ‘অহি’ দ্বারা জানেন। আর নায়েবে নবীদিগকে নবী অথবা উলিউল্লাদের মারফতে আল্লাহ-পাক দান করেন। কাজেই উহা হাছিলের জন্য আল্লাহর খাস-বান্দার তালাশ করা ও তাহাদের তাবেদারী করা দরকার। তাবেদারী ব্যতীত শুধু শুনিয়া তাহা হাছিল করা যাইবে না। আর আল্লাহ-পাক সর্বসাধারণকে তাহা কখনই জানান না এবং জানিবার দরকারও হয় না। যেমন রাজা বাদশাহ সকলকেই বানান না। আবার রাজা ছাড়া দুনিয়ায় শৃঙ্খলাও কায়েম থাকে না। এতটুকু বুঝিলেই যথেষ্ট।
যাহা হউক, সেই একত্বজ্ঞান হাছিল হইলেও ‘নফছ’ মাঝে মাঝে মনে নানা সন্দেহ উদ্রেক করে। নফ্ছ বুঝায়, আচ্ছা, কর্তা যে একজনই তাহাও মান্য করিলাম। কিন্তু একখানা চিঠি দেখিয়া আমরা বুঝিতে পারি যে ইহার একজন লেখক নিশ্চয় আছে, সেই ইহার কর্তা। কিন্তু সে এখন জীবিত আছে কিনা এবং থাকিলেও এখন কোথায় আছে তাহা জানা নাই। ঐরকম তোমার মালিক বা কর্তা, তিনিও এখন আছেন কিনা ও থাকিলেও এখন কোথায় আছেন তাহা জানিবার উপায় কি?
উপরের প্রশ্নের উত্তর দিতে হইলে ফানা ও বাকার জ্ঞান থাকা চাই। তারপরে মাইয়্যাতুল্লাহর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তারপর মেছাল ও মেছ্ল এর মধ্যে কি পার্থক্য উহারও জ্ঞান থাকা চাই। তারপর হাহুত, লাহুত, জাবারুত, মালাকুত ও নাছুত সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা চাই। যখন উপরোল্লিখিত সর্ব-প্রকার জ্ঞান হাছিল হয় তখন ‘লা ইলাহা’ শব্দের পূর্ণ হাকিকত বুঝে আসে এবং সেই মানুষকে প্রায়ই অহংকারীর মত দেখা যায়।
এই মোকামে থাকিয়া ‘লা ইলাহা’ পাঠকারীদের অবস্থা প্রায় নেচারীয়ানদের মত। কারণ নেচারীয়ানগণ যেমন কোন সৃষ্টিকর্তা মানে না, কাহারও সামনে নত হইতে চায় না, সর্বদা অদম্য সাহসে আপন কাজ করিয়া যায়। ঠিক ‘লা ইলাহা’ মোকামের তত্ত্বজ্ঞানীদের কাজকর্মও তদ্রƒপ, এমনকি কোন কোন ব্যাপারে তাহাদের চাইতেও আগে বড়িয়া যায়, যেমন মনছুর হাল্লাছের ‘আনাল হক’ দাবী। এই মোকামের একত্ববাদীগণ ধর্ম শাস্ত্রে অভিজ্ঞ সাধারণ আলেমদিগকে বোজদেল-দুর্বল-বিশ্বাসী ও কাপুরুষ বলিয়া ঘৃণার নজরে দেখেন এবং সাধারণ লোকেরা তাহাদের উচ্চ মোকামের বিষয় জানিতে না পারিয়া গোস্তাকীপূর্ণ আখ্যা দান করে, যেমন, পাগল, মজ্জুব, বেদাতি ও অজ্ঞ ইত্যাদি বলিয়া থাকে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাঁহাদের হৃদয়ে যে আলো আছে, তাহা সাধারণের হৃদয়ে নাই। ইহার প্রমাণ : দেখ দিনের বেলা সূর্যের আলো থাকে বলিয়া আমরা জংগলেও চলিতে পারি, কেননা, সাপ, বাঘ থাকিলে দূরে থাকিয়াও দেখা যায় এবং উহা হইতে আত্মরক্ষা করা যায়। আর অন্ধকার রাত্রে পরিষ্কার রাস্তা দিয়াও হাটিতে ভয় হয়- না জানি সাপের উপর পা ফেলি কিনা। অতএব যাহার হৃদয়ে প্রবল আলো থাকে তিনি কোন কিছুতে অযথা ভয় করিয়া দমিতে পারেন না। আর যাহার আলো নাই বা থাকিলেও মিটি মিটি করিয়া জ্বলে, কখনো দেখা যায়, কখনো দেখা যায় না, তেমন ব্যক্তি প্রত্যেক পদে পদে অযথা সন্দেহ করিবে।
যাহা হউক এই পর্যন্ত যাহা বলা হইল তাহা কেবল ‘লা ইলাহা’ Ñএর ব্যাখ্যা। কিন্তু কালেমার পূর্ণ অর্থ এখনও ব্যক্ত করা হয় নাই। যখন মানুষের সামনে ‘ইল্লাল্লাহু’র হাকিকত খোলে তখন সে জ্ঞানের দ্বারা বিচার করিয়া দেখিতে পায় যে যদিও সৃষ্টি জগতে কেহই আমার চেড়ে বড় নয়, যদিও কাহারো সম্মুখে আমার মস্তক অবনত হইতে দেই নাই, কিন্তু সৃষ্টিজগতের যিনি স্রষ্টা তাঁহার সামনে আমার কোনই অস্তিত্ব নাই। তাঁহার ইচ্ছা ব্যতীত আমার পক্ষে কোন কাজ করাত দূরের কথা- ইচ্ছা করারও ক্ষমতা নাই। স্বয়ং প্রভু বলেন, “অমা তাশাওনা ইল্লা আইয়্যাশায়াল্লাহু রাব্বুল আলামিন”। সুতরাং সেই সর্বশক্তিমান খোদার সামনে মস্তক অবনত করিতেই হইবে। যেহেতু মালিকের সামনে নতশীর হওয়া সরলভাবে ভক্তি দেওয়া বা সেজদা করা ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা, নিজ কাজ কর্মের ত্রুটি স্বীকার করা, অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা ও নিজের সম্পূর্ণ অক্ষমতা স্বীকার করিয়া সকল কর্মে প্রভুর নিকট সাহায্য চাওয়া- এসবই হইতেছে বন্দেগী। এই সকল কাজ ছাড়া কখনোই প্রভুর প্রিয়পাত্র হওয়া যায় না। আর প্রভুর প্রিয়পাত্র না হওয়া পর্যন্ত কখনোই কেহ কামালত হাছিল করিতে পারে না। অতএব কারণেই শরীয়তে মোহাম্মদীর দ্বিতীয় হুকুমটি হইতেছে নামাজ। যেহেতু নামাজের মধ্যে দাসত্ব স্বীকার করা, ত্রুটি স্বীকার করা, অহেদ খোদাকে প্রভু বলিয়া মান্য করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, সকল কর্মে সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি বিদ্যমান রহিয়াছে। সুতরাং যে ব্যক্তি সুষ্ঠুভাবে নামাজ আদায় করে তাহার কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ ছহিহ ও ঠিক হইয়াছে। আর যে নামাজ পড়েনা, শুধু কালেমা পড়ে এবং খোদাকে এক বলিয়া স্বীকার করে তাহার কালেমা পড়া সঠিক নয়। তেমন লোকের আখেরাতে নাজাত হইবে কিনা, সে বিচার খোদার দরবারে। তবে শরীয়তের বিচারে সে দোষী এবং তেমন লোক উম্মতে মোহাম্মদীর পথ প্রদর্শক হইতে পারে না।
এই পর্যন্ত যাহা বলা হইল তার সারমর্ম এই যে, যে ব্যক্তি মালিকের হুকুম নতশির হইয়া মান্য করে আর মালিক ভিন্ন অপর কাহারও পরোয়া করেনা সেই ব্যক্তি মোত্তাহেদ (কালেমাগো)। আর যেই ব্যক্তি কালেমা পড়ে কিন্তু প্রভুর সামনে নতশির হয় না, সে ভ্রান্ত এবং যে ব্যক্তি প্রভুর সামনে নতশির হয় (নামাজ পড়ে) আবার মালিক ছাড়া অপরের সামনেও নতশির হয়, হেয় হয় সেও ভ্রান্ত।
আরও একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন, কতক লোকের সন্দেহ হয় যে, পীর, ওলী, নবীদিগের সামনে নত হওয়া, তাহাদিগকে ভক্তি শ্রদ্ধা ও তাজিম করা এবং তাঁহাদের মন রক্ষার্থে (খুশী করিবার জন্য) জান ও মাল কোরবান করা তরীকত পন্থীদের একটি প্রচলিত নিয়ম। ইহাতে ত মালিকের সাথে সমকক্ষতা দেখা যায় যাহাকে শরীয়তের ভাষায় র্শিক বলে, অথচ তাঁহারাই পীর-মুর্শিদ, ওলী-দরবেশ আল্লাওয়ালা। এই সন্দেহে পড়িয়াই সাধারণ জাহেরী আলেমগণ পীর-মুর্শিদকে বেদয়াত ও গোমরাহি বলিতেছেন। ইহার যে হাকিকত তাহা ভাঙ্গিয়া বলার উপায় নাই। কারণ চিরকালই এই ভেদটি গোপনীয়। কিন্তু প্রকৃত ভেদ ত গোপন থাকে না। তবে অন্ধদের সামনে তাহা প্রকাশ পায় না। যেমন অন্ধকার রাত্রে জগতের সকল জিনিসেরই রং একমাত্র কাল বলিয়া বুঝা যায়। কিন্তু দিনের বেলা জগত বিভিন্ন রঙ্গে পরিপূর্ণ দেখা যায়।
উপরের সন্দেহের জন্য এতটুকু বলিতেছি যে, কোরান শরীফের মধ্যে স্বয়ং খোদা-পাক হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত খিজির (আঃ) এর ঘটনা বর্ণনা করিয়াছেন। ইহাত আলেমগণ সকলেই জানেন। আচ্ছা মানুষ খুন করা ও উপকারীর নৌকা ছিদ্র করা এই দুইটি ঘটনা সত্য কিনা? আচ্ছা, ঐ দুইটি কাজ যদি ভালই হইত তবে একজন জলিল-কদর পয়গম্বর হযরত মুসা নবী (আঃ) তাহা না পছন্দ করিয়াছেন কেন? আর উহা যে অন্যায় তাহাত হইতেই পারে না। কারণ খোদা-পাক আগেই খবর দিয়াছিলেন যে, হে মুসা, যাও আমার এক খাস বান্দার কাছে, তাহাকে আমার খাস এলেম দান করিয়াছি। যাহা হউক, আলেমগণত অবগত আছেন যে উম্মতে মোহাম্মদীর মধ্যে যাহারা মশহুর বুজুর্গ ছিলেন তাঁহারা বলিয়াছেন, ‘বান্দায়ে খাস কুনাদ লুতফে আমরা’।
গুফ্ তাইউ গুফতে আল্ল¬া বুয়াদ, গরচে আজ হলকুমে আবদুল্ল¬াহ্ বুয়াদ ॥
বান্দায়ে খোদা খোদা না বাশাদ, অলাকেন আজ খোদা জুদা না বাশাদ ॥
যাহা হউক, যে ব্যক্তি খোদা পাকের অহ্দানিয়াতের পরিচয় সুন্দররূপে নিজে বুঝিয়া অপরকে বুঝাইতে পারে, যাহার একত্বজ্ঞান এমন চরম সীমায় গিয়া পৌঁছিয়াছে যে, আকাশ হইতে পাতাল পর্যন্ত প্রত্যেকে দৃশ্য ও অদৃশ্য বস্তুর সৃষ্টিকর্তা একই প্রভু যাঁহার জাতে-পাক আল্লাহ এবং যে ব্যক্তি এতটুকু বলে যে খোদার ইচ্ছা ছাড়া আমার একটি নিঃশ্বাস ছাড়িবারও ক্ষমতা নাই আর যাহার এই বিশ্বাস হইয়াছে যে মুখের একটি কথা বাহির হওয়ার পর উহা ধরিয়া রাখিবার জন্য আল্লা-পাকের ফেরেশতা নিযুক্ত আছে, সেই মানুষ কেমন করিয়া খোদার বিরুদ্ধে নিজে শেরেক করিতে পারে এবং অপরকেই বা কেমনে র্শিক করিতে দিতে পারে? তবে নিশ্চয়ই ইহার কোন হাকিকত আছে। কাজেই সন্দেহ মিটাইতে হইলে তাঁহাদের ছহবতে থাকিতে হয় এবং শুধু কথায় নয় কার্যকলাপ দেখিয়া এবং তাঁহাদের আদেশ নিষেধ ভক্তি সহকারে পালন করিতে হয়। তখন আর কিছু বাকী থাকে না। নিজের ভিতরেই খোদার দয়ায় ও ঐ খাস বান্দার দোয়ায় এমন বুঝ হাছেল হয় যে দেলই তাহার কিতাব হইয়া যায়। আর যাহারা শুধু তর্ক-বিতর্ক করিয়া বুঝ হাছিল করিতে চায় তাহারা কখনোই বুঝ পায় না। যাহা হউক, প্রথম কালেমা তারপর নামাজ সর্বশ্রেষ্ঠ।
“আচ্ছালাতু ইমাদুদ্দিন।”
“কালেম পড়িয়া কর ঈমান মজবুত
এক্বিনের সাথে কর খোদাকে ছজুদ
খেয়ালের সাথে নামাজ যেবা পড়ে হামেহাল
তার’পরে বারি তালা রহেন খোসাল
খেয়ালের নামাজে কেহ পায় হজ্ব আরও জেহাদ
খেয়ালের নামাজে পায় কেহ জামাল আহাদ
নামাজ অমূল্য ধন তার করহ কদর
বাসনা থাকে যদি মনে বেহেশতে যাবার।”

পরম করুণাময় ও দয়াময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করিতেছি

ইন্নামাল আমালু বিন্নিয়াত

মানুষ যে কর্ম করে নিয়ত অনুযায়ী তার ফল পায়। সুতরাং প্রত্যেক কর্মীরই একান্ত কর্তব্য (ফরজ) এই যে সে যেন কোন কাজে লাগিবার পূর্বেই আপন উদ্দেশ্য ঠিক করিয়া লয়। তারপর কাজটি সমাধা করা বা না করা তাহা খোদার ইচ্ছা। কিন্তু কর্মের ফলটি সে নিশ্চয়ই পাইবে। এখন খুব মন দিয়া শ্রবণ করুন, আমি কি চাই এবং আমার উদ্দেশ্যই বা কি? আল্লাহ-পাক ফরমান, “হে মানুষ! তোমরা কি মনে কর যে আমি বিনা উদ্দেশ্যেই তোমাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছি এবং পুনরায় আমার কাছে ফিরিয়া আসিতে হইবে না?” অতএব আমরা যে বৃথা জীবন কাটাইতে আসিয়াছি তাহাও নয় এবং উদ্দেশ্য ঠিক করিয়া কাজ করিলে যে তার ফলটি মাঠে মারা যাইবে তাহাও নয়।
সুতরাং এমন একটি কাজ করিয়া যাওয়া দরকার যার সর্বোৎকৃষ্ট হওয়া সম্বন্ধে কাহারো কোন প্রতিবাদ বা সন্দেহ না থাকে। সুতরাং বহু চিন্তার পর খোদা-পাক যে সত্যটি জানাইয়াছেন তাহা এই- মানব জাতির কাম্য বস্তু দুইটি জিনিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি। এই দুইটি বস্তু ছাড়া আর কিছুই মানব জাতির উদ্দেশ্য হইতে পারে না। সুতরাং এমন একটি নীতি (রাস্তা) চয়ন করা দরকার, যে নীতিটি প্রতিপালন করিলে ইহজগতে শান্তি ও পরজগতে মুক্তি অনিবার্য এবং তার প্রমাণ সঙ্গে থাকা চাই। কেননা যুক্তি ছাড়া কোন কথা জ্ঞানীগণ কখনো স্বীকার করেন না। আবার শুধু বৈজ্ঞানিক যুক্তি থাকিলেই চলিবে না, কোরান হাদিসের সঙ্গেও মিল থাকিতে হইবে।
সার কথা এই যে, যুগ পরিবর্তন করিতে হইলে এমন একটি রাস্তা আঁকিতে হইবে যাহার একদিকে নকলি দলিল (কোরান ও হাদিস) এবং অপরদিকে আকলি দলিল (যুক্তি প্রমাণ) দ্বারা প্রমাণিত করিয়া দিবে যে ইহা সরল পথ- ইহাই রাহে মুস্তাকিম। এই পথের পথিক যে কেহ হইবে প্রত্যেকেরই ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি সুনিশ্চিত।
এখন আমার মূল উদ্দেশ্য এই যে, উপরে উল্লিখিত নীতিটি যাহার কাছে পাইব তাঁহার সাথে সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া আমি তাঁহার নির্দেশ মানিয়া কাজ করিব। আর যদি বলেন যে তেমন নীতি আমার জানা নাই তবে অন্ততঃপক্ষে এই গোলাম যে নীতিটা দেখাইতেছি তাহার ভিতর যোগদান করুন। মূল কথা, আমি সত্যের অনুসন্ধিৎসু, সত্য পাইলে কবুল করি, সত্য চাইলে দান করি। ইতি-
২ অগ্রহায়ণ, ১৩৬৩ বাংলা
ফকির মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ খান

পরম দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করিতেছি
জমানার লোকেরা কেন নবী ও নায়েবে-নবীদের সঙ্গে বেয়াদবী করিয়া থাকে?

মুসলমান সমাজে প্রায় সকলেই অবগত আছেন যে, এই জগতে যত নবী আসিয়াছেন প্রত্যেক নবীর সঙ্গেই তাঁহার জমানার লোকেরা বেয়াদবী করিয়াছে, উপহাস করিয়াছে এবং পাগল বলিয়া গালি দিয়াছে ও মারধরও করিয়াছে। কিন্তু একথাও সত্য যে নবীগণ পাগল ছিলেন না বরং তাহারা জগদ্বাসী সকলের জন্য শান্তি কায়েম করিবার নীতিই প্রচার করিয়া গিয়াছেন।
এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে ব্যক্তি পৃথিবীতে শান্তি কায়েম করিতে আসেন তাঁহার সঙ্গে এত দুশমনি করা কেন? কতক লোক না হয় অজ্ঞতাবশত: নবীর কথা বুঝিতে না পারিয়া বিরোধিতা করিতে পারে; কিন্তু জমানার সমস্ত লোকই যে অজ্ঞ হইবে, নবীর কথা যে কহই বুঝিবে না এ কেমন ব্যাপার? তাই নবীর সঙ্গে দুশমনি করার প্রকৃত রহস্য ব্যক্ত করিতেছি:
এই পৃথিবীর যিনি কর্তা, তাঁহার কুদরতি হাতেই এই পৃথিবীর উত্থান ও পতনের মূল চাবি। তবে সেই প্রভু নিজকে গোপন রাখিয়া কৌশলে জগতকে চালাইতেছেন। খোদা-পাক মানব জাতিকে তিনটি শক্তি দিয়াছেন, কিন্তু এই তিনটি শক্তি একত্র এক ব্যক্তিকে দান করেন নাই। এই তিনটি শক্তি যখন একত্র মিলিত হইয়া যায় তখনই পৃথিবীতে শান্তি কায়েম করা যায়।
এখন শ্রবণ করুন উহা কি? প্রথম- জ্ঞানশক্তি, দ্বিতীয়- ধনশক্তি ও তৃতীয়- জনশক্তি। এই তিনটি শক্তিই খোদাদাদ- ইহার কোন একটি বাদ দিয়া জগতে শান্তি স্থাপন করা যাইতে পারে না।
এখানে প্রশ্ন হইতে পারে যে এ তিনটি শক্তি একজনের হাতেই কেন দেননা? উত্তর এই যে, খোদা সকলকেই মোহতাজ বানাইয়া তাহার নিজ অক্ষমতা স্বীকার করাইয়া অপরকে দিয়া সাহায্য করাইয়া কার্য উদ্ধার করিয়া লন, যাহাতে বান্দা বুঝিতে পারে যে কোন কাজ করিয়া গর্ব করা যাইতে পারেনা, বরং শোকর আদায় করা দরকার যে প্রভু দয়া করিয়া এই কাজটি আমাকে দিয়া সমাধা করাইয়াছেন।
যাহা হউক, খোদা যাহাকে ধন দিয়াছেন তিনি হইলেন ধনী, কিন্তু সকল ধনীর কথাই যে সকলে মানিয়া চলে তাহা নয়, বরং অনেক ধনীকেই মাতবর, সরদার বা দাঙ্গাবাজ লোকের সহিত মিল দিয়া নত হইয়া থাকিতে হয়। আবার যাহাকে খোদা মাতব্বরী দিয়াছেন, তাহার তাবেদারগণ দাঙ্গা হাঙ্গামার সময়ে হুঙ্কার দিয়া শত শত লোক একত্র হইতেছে, হক-না-হক কাউকে খুন করিতেছে, কিন্তু তাই বলিয়া সকল স্থানেই যে ঐ দাঙ্গাবাজি চলিবে তাহা নয় এবং ঐ রকম গোয়ারকিপনা দ্বারা জগতে শান্তিও স্থাপিত হয় না; বরং ফেৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি হয়। আর এক শ্রেণীর লোক- খোদা তাহাদিগকে জ্ঞান শক্তি দান করিয়াছেন। সেই জ্ঞান বিএ, এমএ পাশ করা জ্ঞানও নয় বা উলা, টাইটেল পাশ করা জ্ঞানও নয় বরং উহা তত্ত্বজ্ঞান।
সুতরাং ধনী, মাতবর ও তত্ত্বজ্ঞানী এই তিন শ্রেণীর একত্র মিলন হইলে সমষ্টিগতভাবে যে একটি শক্তি হয়, সেই শক্তি দ্বারা খোদা-পাক জগতের মধ্যে সুবিচার কায়েম করিয়া দেন। সেই সুনীতিরই নাম “ইলাহী হুকুমত”- উহাই দ্বীনে শরীয়ত, উহাই জগত ও জগতবাসীর জন্য শান্তির উপকরণ।
ঐ তিনটি শক্তি একত্র মিলিত হইলে একটিকে কেন্দ্র করিয় অপর দুইটি তাহার সহিত মিলিতে হইবে। এই মিলনেরই নাম তাবেদারী। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের সাথেই তাহার ‘নফছ’ আছে। সেই ‘নফছ’ কখনো অপরের শ্রেষ্ঠত্ব পছন্দ করে না। নফছ্ সর্বদা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব পছন্দ করে।
যাহা হউক, উপরোল্লিখিত ঐ তিনটি শক্তিই দরকারী। এখন প্রশ্ন- কেন্দ্রে থাকিবে কে, আর তাবেদারী করিবে কাহারা? এই সমস্যার সমাধান করিবার জন্য খোদা-পাক ‘ইনসাফ’ নামক একটি শক্তি পয়দা করিয়া মানবকে দান করিয়াছেন। সুতরাং ‘ইনসাফ’ যাহা বলে তাহাই মানা মানুষের কর্তব্য।
অতএব ‘ইনসাফ’ বলিতেছে, দেখ হে মানুষ, তুমি যে ধন পাইয়াছ উহা অস্থায়ী এবং তুমি যে মাতব্বরী পাইয়াছ উহাও অস্থায়ী। কিন্তু যে বিচার জ্ঞান পাইয়াছে সেই বড় জিনিস পাইয়াছে; যেহেতু উহা স্থায়ী। সুতরাং তত্ত্বজ্ঞানীই হইবেন কেন্দ্রীভূত আর ধনী ও মাতবর সরদারগণ হইবে তাহার আজ্ঞাবহ। কাজেই, যখন নবীর জবানে ইনসাফের ভাষা জারী হইয়া সকলকে ডাকেন তাঁহার তাবেদারী করার জন্য, তখন নফ্ছ-পরস্ত ধনী ও মাতব্বরগণের গায়ে হিংসার আগুন জ্বলিয়া উঠে। সেইজন্য জানিয়া শুনিয়া নবীকে মিথ্যাবাদী, পাগল ইত্যাদি বলিয়া তাঁহাকে তাড়াইয়া দেয়। কিন্তু নবী স্পষ্টভাবে দেখেন যে এই কথাগুলি মানিলে মানবজাতির ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি নিশ্চয়ই হইবে, আর না মানিলে আখেরাতে চিরকালের জন্য শাস্তি ভুগিতে হইবে। কাজেই সমাজের এত তিরস্কার শুনিয়াও আবার তাহাদেরকে ডাকিতে থাকেন। এমনিভাবে বারংবার ডাকার কারণে বিদ্বেষবশত: নবীকে হয় মারে কিংবা সমাজবন্দী করে অথবা দেশ হইতে বিতাড়িত করে।
এখানে স্থূলবুদ্ধি বিশিষ্ট লোক প্রশ্ন করিতে পারে যে, প্রথম যখন বলিয়া দেখিল যে লোকেরা তাঁহাকে মানিতে চায় না তবুও কেন এত পীড়াপীড়ি করিতে যায় এবং নিজেকে বিপদগ্রস্থ করে? তার উত্তর এই যে, যখন কিয়ামত হইবে তখন খোদা-পাক আমভাবে বান্দাদিগকে ডাকিয়া বলিবেন, হে বান্দা বল, আমি কি জগতে শান্তি কায়েম করিবার জন্য আমার প্রতিনিধি পাঠাই নাই? বল, আমার আদেশ কতটুকু পালন করিয়াছ? তখন প্রত্যেক ভারপ্রাপ্ত নবী-রসুল ও মোজাদ্দেদ বা নায়েবে-নবীগণ খোদার সামনে বলিবেন, হ্যাঁ খোদা, আমি তোমার আদেশ পাইয়া তাহা পৌঁছাইতে গিয়াছিলাম, কিন্তু আমার কথা তোমার বান্দাগণ বিশ্বাস করে নাই; বরং আমাকে অপদস্থ করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছে। তখন খোদা-পাক প্রত্যেক বিদ্বেষকারীর নিকট হইতে নবী ও নায়েবে নবীর অপমানের প্রতিশোধ লইবেন এবং নবী ও নায়েবে নবীদিগকে যথেষ্ট পুরষ্কার দানে সুখী করিবেন। আর যদি পৃথিবীর সামান্য অপমান ও দুঃখ কষ্টকে ভয় করিয়া সত্য প্রচারে বিরত থাকেন তবে সেইদিন আল্লা-পাকের সামনে ভীষণ শাস্তি ভুগিতে হইবে ও লাঞ্ছিত হইতে হইবে।
এই বিশ্বাসজ্ঞান নবী ও রিফরমারদের পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান থাকে। কাজেই তাহারা সত্য প্রচারে এত পীড়াপীড়ি করেন। কারণ যদি বান্দাগণ কিছু কষ্ট করিয়াও শেষে এই সত্য বুঝিতে পারে এবং কবুল করে তবে দু’জাহানে তার ফল পাইবে। আর যদি মোটেও না মানে বরং মারধর করে বা তাড়াইয়া দেয় বা বয়কট করে তবে তাহাও নবীর জন্য তাঁহার সত্য প্রচারের দলিল হইবে।
যাহা হউক, নবীগণ যুক্তি ছাড়া কোন কথা বলেন না বরং প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিই জানেন যে জগতে কোন শাসন প্রণালী না থাকিলে জগতের মানুষ শান্তিতে থাকিতে পারে না এবং একথাও জানে যে একজন শাসনকর্তা না থাকিলে হুকুম জারি করিবে কে? তবে প্রচলিত শাসক নির্বাচনে ও নবী নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য আছে। সাধারণভাবে জগতে যে শাসন প্রণালী প্রচলিত আছে প্রধানত উহা রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র। রাজতন্ত্র মানে ওয়ারিশী সূত্রে রাজ সিংহাসন অধিকার করিয়া শাসন করা অথবা নিজ বাহুবলে কোন সিংহাসন দখল করিয়া নিজে গদিনশীন হইয়া শাসন কায়েম করা। আর গণতন্ত্র মানে হইল সর্বসাধারণ ভোট দিয়া আপন নেতা নির্বাচন করিয়া শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। কিন্তু ইলাহী শাসনতন্ত্রের ধারা অন্যরূপ। কারণ গণভোটের সময়ে প্রতিযোগিতা চলে। যে ব্যক্তি সাধারণ লোকদিগকে কিছু দিয়া নিজের দিকে আনিতে পারে সেই পাশ করিয়া থাকে। কিন্তু নবী ও সংস্কারকদের নীতি হইল এই যে তাঁহারা সর্বসাধারণকে যুক্তি দ্বারা বুঝাইয়া দেন যে, দেখ বর্তমান যুগের যে দুরবস্থা, ইহা হইতে রক্ষা পাইতে হইলে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য ছাড়া অন্য উপায় নাই এবং সৃষ্টিকর্তার সাহায্য পাইতে হইলে তাঁহার কোন খাস বান্দার মারফত ছাড়াও কোন সাহায্য পাওয়ার উপায় নাই। অতএব আমি যে ব্যবস্থা তোমাদের সামনে দেখাইতেছি উহা কি শান্তি স্থাপনের ব্যবস্থা নয়? যদি সত্যই তাহা হয় তাহা হইলে চিন্তা করিয়া দেখ এই ব্যবস্থা আমি পাইলাম কোথায়? যদি আমি নিজে চিন্তা করিয়া এই নীতি প্রণয়ন করিতাম তাহা হইলে তোমরাও ত এমন একটি নীতি প্রণয়ন করিতে পার। সুতরাং যখন তোমরা তাহা পারিতেছ না তখন বিশ্বাস কর যে ইহাই সেই সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত নীতি এবং আমি তাহার নীতির প্রচারক মাত্র। এবং ইহাও বলিয়া থাকেন যে শুধু মুখে মুখে বিশ্বাস করিলেই চলিবে না বরং জান, মাল ও ইজ্জত এই তিন জিনিস দিয়া আমার আজ্ঞাবহ দাস সাজিতে হইবে। আমার আদেশে জান দিতে হইবে, মাল দিতে হইবে এবং লোকের গালি শুনিয়াও ধৈর্য ধরিয়া থাকিতে হইবে। যদি তাহা কর তবে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে তোমাদিগকে শাসনভার দান করিবেন এবং পরকালে চিরসুখের স্থান বেহেশত দিবেন এবং স্বয়ং প্রভুর দিদার দেখাইবেন।

পরম দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করিতেছি

সমাজতন্ত্র

জানা দরকার যে মানুষকে জগতে খাঁটি শান্তির জীবন যাপন করিতে হইলে একটি খাঁটি সমাজতন্ত্রের বিশেষ প্রয়োজন। যেহেতু প্রত্যেক জীবেরই খাওয়া, পরা ও বাসস্থানের প্রয়োজন রহিয়াছে। কিন্তু মানুষ ছাড়া অন্য সব জীবেরই প্রয়োজন প্রাকৃতিক নিয়মে মিটানো হয়; যেমন একটি বাঘ- তার পশমই পরিধানের প্রয়োজন মিটায় এবং উহার থাবার নখই তাহার আহার সংগ্রহ ও গর্ত খুঁড়িবার হাতিয়ার। যেমন একটি বক- উহার পালকই তার পরিধানের বস্ত্র ও তার লম্বা ঠোঁটখানাই আহার সংগ্রহ ও বাসস্থান তৈরী করিবার প্রাকৃতিক হাতিয়ার। কিন্তু মানুষকে ঐরূপ প্রাকৃতিক কোন অস্ত্র দেওয়া হয় নাই। কাজেই একটি মানুষের প্রয়োজন মিটানোর জন্য শ্রমিক, তাঁতী, কামার, কুমার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, জেলে, ছুঁতার প্রভৃতি সর্বশ্রেণীর মানুষের সাহায্য নিতে হয়। সকল শ্রেণীর মানুষকেই একে অপরের হিতৈষী মনে করিতে হইবে ও মিলিয়া মিশিয়া সমাজবদ্ধভাবে বাস করিতে হইবে। নতুবা কোন শ্রেণী বা ব্যক্তিই খাঁটি শান্তিতে জীবন যাপন করিতে পারিবে না।
এখন জানা দরকার যে সমাজ গঠন করিতে হইলে প্রথমত: একজন সমাজপতি নিযুক্ত করিতে হইবে, নতুবা কাহার নির্দেশে সমাজ চলিবে? ইহার যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ, নদী হইতে একখানা নৌকা ডাঙ্গায় তুলিতে দশ জন লোকের দরকার, কিন্তু তার মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষা করিয়া একযোগ টান দিবার জন্য একজনকে ‘মাদার’ দিবার জন্য নিযুক্ত করিতে হইবে নতুবা যার যার মতে টানাটানি করিলে দশ জনের স্থলে একশত জন হইলেও কাজ হইবে না।
সুতরাং আমরা সমাজের সুফল তখনই ভোগ করিতে পারিব যখন সকল শ্রেণী ও ব্যক্তি আপন মত ত্যাগ করিয়া সমাজপতির নির্দেশ মানিয়া চলিব। সে মানা ত শুধু মৌখিক মানা নয় বরং জান, মাল ও মান এই তিন জিনিস দ্বারা শক্তি অনুপাতে সমাজপতির সহযোগিতা করিতে হইবে। ইহাকেই নেতার আনুগত্য স্বীকার করা বলে।
আরও জানা দরকার যে, সমাজপতি স্থায়ীভাবে নিযুক্ত করিতে হইবে, নতুবা তাঁহার কোন সুচিন্তিত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হইতে বিলম্ব হইতে পারে, ইত্যবসরে তাঁহার নেতৃত্বের আয়ুষ্কাল শেষ হইয়া যাইতে পারে। কাজেই উপরোক্ত ক্ষমতা বিশিষ্ট একজন সমাজপতি নিযুক্ত না হইলে সেই সমাজের কোন অর্থই হইতে পারে না। এখানে একটি প্রশ্ন জাগে, যেমন সমাজপতি হইবার উপযুক্ত কোন ব্যক্তি? যাহার হাতে আমার স্বাধীন ক্ষমতা সপিয়া দিব তিনি যদি আমাকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাইতে না পারেন তবে অবস্থাটা কেমন হইবে? কেননা আত্মসমর্পণ করিবার পূর্বেই যাচাই করিবার অধিকার আছে, কিন্তু পরে কথা বলিবার অধিকার থাকিবে না। যেমন, যাত্রী ও গাড়ি- প্রত্যেক গাড়ির একটি গন্তব্যস্থল আছে, আবার যাত্রীরও গন্তব্যস্থল আছে। অতএব যদি গাড়ির ও যাত্রীর গন্তব্যস্থল এক হয় তাহা হইলেই নিরাপদ, নতুবা বিপদ। ইহা ছাড়া আর একটি প্রশ্ন: তেমন সমাজপতি নির্বাচিত হইবে কোন প্রণালীতে? যদি কোন ব্যক্তি আপন বিদ্যা, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার বলে যোগ্যতার দাবী করেন তবে তাহা হইবে অহংকারের পরিচয়। আর যদি সর্বসাধারণের মতে নির্বাচিত হন তাহাতেও প্রতিযোগিতা চলিবে। ফলে ভোটাধিক্যের উপর নির্ভর করিয়া সমাজপতি মনোনীত হইবেন। যাহাতে ছলে বলে ও কৌশলে অনুপযুক্ত ব্যক্তিই নির্বাচিত হইতে পারে। কাজেই উল্লিখিত দুইটি প্রণালীই সমস্যাপূর্ণ। সুতরাং এই সমস্যা এড়াইয়া সঠিক শান্তির পথ পাইতে চাহিলে আমাদিগকে সেই সৃষ্টিকর্তার উপর আত্মসমর্পণ করিতে হইবে যিনি এক রং বিশিষ্ট এক বিন্দু বীর্য দ্বারা আমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি মানবজাতিকে ডাকিয়া বলিতেছেন, হে মানুষ, তুমি রাজা হইয়া থাক আর প্রজা হইয়া থাক, তোমার মূলে ঐ একই জিনিস। তুমি যে কোন ভাষাভাষী, যে কোন দেশবাসী হইয়া থাকনা কেন তোমার মূলে ঐ একই জিনিস। তুমি সুশ্রী বা বিশ্রী হও, লম্বা বা বেঁটে হও, বিজ্ঞ বা অজ্ঞ হও, বলিষ্ঠ বা দুর্বল হও, পূর্ণাঙ্গ বা অপূর্ণাঙ্গ হও, তোমার মূলেও ঐ একই জিনিস। তিনি আরও বলেন, হে মানুষ! তোমার জীবন ও মরণ আমার হাতে রহিয়াছে। আমার ইচ্ছা ছাড়া একটি নিঃশ্বাসের জন্যও জীবিত থাকার ক্ষমতা তোমার নাই। হে মানুষ, তোমার মঙ্গল ও অমঙ্গল আমার হাতে রাখিয়াছি। আমার ইচ্ছা ছাড়া তুমি কোন মঙ্গল লাভ করিতে পার না বা কোন অমঙ্গল হইতে বাঁচিতেও পার না। অতএব একমাত্র আমিই তোমার স্রষ্টা ও প্রভু। তোমরা আমারই দাস। সুতরাং দাসের জীবনের শান্তি ও মঙ্গল একমাত্র প্রভুর আদেশ পালনের মধ্যেই রহিয়াছে। সুতরাং সেই সৃষ্টিকর্তাই জগতে তাহাদিগকে ঐক্যবদ্ধভাবে চলিবার জন্য আদেশ দান করিয়াছেন ও বিচ্ছিন্ন হইতে নিষেধ করিয়াছেন। তাঁহার এই আদেশাবলীকেই মানব জাতির জন্য অবশ্য পালনীয় ধর্ম বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছে। এখন জানা দরকার যে সৃষ্টিকর্তার আদেশ তথা ধর্ম জগতে আবির্ভূত হয় কোন প্রণালীতে? যেহেতু সৃষ্টিকর্তা অদৃশ্য এবং তাঁহার আদেশও অদৃশ্য। উহা দৃশ্যমান মানব জগতে পৌঁছায় কি করে? তাই তিনি তাঁহার দাসদের মধ্য হইতে প্রয়োজন হইলে যে কোন ভাষাভাষী বা যে কোন দেশবাসী হইতে যে কোন শ্রেণী হইতে যে কোন শিক্ষায় শিক্ষিত বা অশিক্ষিতদের মধ্য হইতে একজনকে আপন করিয়া নেন ও আপন ঐশী শক্তির বলে আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া দেন ও উহা জগদ্বাসীকে পৌঁছাইতে আদেশ দেন। সুতরাং সৃষ্টিকর্তার আদেশক্রমে যখন উক্ত ব্যক্তি একটি মত প্রকাশ করেন। তখন এ ব্যক্তি হন ধর্ম প্রবর্তক ও তাঁহার প্রচারিত মতবাদকেই বলা হয় সত্য ধর্ম। অতএব উক্ত ব্যক্তিকে সমাজপতি মান্য করিয়া তাহার নিকট আত্মসমর্পণ করাকেই সৃষ্টিকর্তার নিকট আত্মসমর্পণ করা বলে। যেহেতু তিনি স্রষ্টারই প্রতিনিধি। আর যেহেতু প্রতিনিধির আদেশই প্রভুর আদেশ বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে।
অতএব বর্তমান সময়ের অধঃপতন হইতে বাঁচিতে চাহিলে ও জীবনে খাঁটি শান্তি পাইতে চাহিলে তেমন এক ব্যক্তির আশু প্রয়োজন।

পরম দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করিতেছি

মানুষ কেন স্বাধীনতার জন্য এত পাগলপারা হয়

প্রশ্ন : মানুষ কেন স্বাধীনতার জন্য এত পাগলপারা হয়?
উত্তর : প্রত্যেক রাষ্ট্রেই দুই শ্রেণীর লোক থাকে, শাসক ও শাসিত। অতএব যদি কোন রাষ্ট্রে একাধিক জাতির লোক থাকে তবে যে জাতি শাসক থাকে তাহাদের জাতীয় ধর্মকে অক্ষুন্ন রাখিয়া পরে অপর জাতির ধর্ম ও জান-মালের নিরাপত্তা রক্ষা করে ও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বজায় রাখে। কিন্তু শাসিত জাতির কোন স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটিলে শাসক জাতির নিকট বিনীতভাবে অনুরোধ জানাইয়া নিজেদের স্বার্থ ফিরিয়া পাইবার ব্যবস্থা করিতে হয়। অর্থাৎ শাসিত জাতিকে সর্বদাই শাসক জাতির মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে হয়। কিন্তু শাসিত জাতি নিজেদের বা ব্যক্তি বিশেষের রাষ্ট্রগত কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা বা উক্ত পরিকল্পনাকে কার্যকর করিবার জন্য কোন আন্দোলন করিতে পারে না। উহা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ (বেআইনী)। কাজেই অসহনীয় অধীনতা হইতে মুক্ত হইবার জন্য মানুষ স্বাধীনতা চায়। সুতরাং পাকিস্তান অর্জনের মূলেও ঐ কারণই বিদ্যমান ছিল। যাহা হউক, এখন স্বাধীন নাগরিক হিসাবে আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তিরই পাকিস্তান ও পাকিস্তানবাসীর জন্য কল্যাাণকর যে কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা ও তাহা কার্যকরি করার জন্য প্রকাশ্য সভায় উহা বর্ণনা করিবার অধিকার আছে। এইরূপ করা কাহারো জন্য বেআইনি বা দূষণীয় হইবে না। চাই সে শাসকদের মধ্য হইতেই হউক অথবা শাসিতদের মধ্য হইতেই হউক। কেননা, এখনও আমরা শাসক ও শাসিত এই উভয় একই শ্রেণীতে আছি, যেহেতু আমরা একই জাতির অন্তর্ভূক্ত আমরা একাধিক জাতির নহি। আমরা একই জাতি মুসলমান এবং আমাদের একই ধর্ম ইসলাম। আমরা পরস্পর ভাই ভাই। আমাদের প্রত্যেক ভাইয়েরই মুসলমান জাতি ও ইসলাম ধর্মের উন্নতির পরিকল্পনা করিবার ও উপদেশ দিবার সমান সমান অধিকার আছে। এই ব্যাপারে কোন ভাষাভাষীর ভেদাভেদ নাই বা কোন শিক্ষারও ভেদাভেদ নাই যে কে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত আর কে আরবী শিক্ষায় শিক্ষিত বা ডিগ্রিরও ভেদাভেদ নাই যে কে কি পাশ। যাহার পরিকল্পনাটি আমাদের মুসলমান জাতির পক্ষে সর্বোচ্চ কল্যাণকর বিবেচিত হইবে তাহাই পাকিস্তানের আইনে গ্রহণযোগ্য হইবে।
আমরা মুসলমান। আমাদের পরিকল্পনা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে যাচাই করিতে হইবে। এই পরিকল্পনা ব্যক্তি হইতে শুরু করিয়া রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রত্যেকের জন্যই মহাকল্যাণজনক হওয়া চাই। উহা আংশিক কল্যাণজনক না হইয়া ব্যাপক কল্যাণজনক হওয়া চাই এবং উহা ক্ষণস্থায়ী কল্যাণকর না হইয়া চিরস্থায়ী কল্যাণকর হওয়া চাই। আমরা মুসলমান। আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে যে আমাদের মালিক এক আল্লাহ। আমাদের দেহের মালিক, রুহের মালিক, আসমান জমিনের মালিক, আমাদের খাওয়া-পরা ও বাসস্থান দিবার মালিক এক আল্লাহ। হায়াৎ ও মওতের মালিক তিনি, মওতের পর জিন্দা করিবার মালিকও তিনি। মৃত্যুর পর জিন্দা করিয়া হিসাব নিবেন ও তাঁহার আদেশ মান্যকারীদিগকে বেহেশত দান করিবেন ও তাঁহার আদেশ অমান্যকারীদিগকে জাহান্নামী করিবেন। তাহা হইলে দেখা গেল আমাদের ইহকাল ও পরকাল এই দুই জাহানের কল্যাণই প্রয়োজন। সুতরাং শুধু দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী স্বার্থের জন্য পরিকল্পনা করাও আংশিক পরিকল্পনা, আবার শুধু আখেরাতের স্বার্থের জন্য দুনিয়ার সকল স্বার্থ ত্যাগ করিয়া কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন করাও আংশিক পরিকল্পনা হইবে। অতএব সমগ্র মানব জাতির জন্য মহাকল্যাণকর প্রয়োজনীয় বস্তুটি হইতেছে ব্যাপক কল্যাণজনক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যাহা চিরস্থায়ীভাবে ভোগ করা যায়।
মানুষের জীবনের কাম্য বস্তু হইতেছে ছয়টি। যথা, (১) যৌবন, (২) স্বাস্থ্য, (৩) স্বচ্ছলতা, (৪) সৎসঙ্গিনী, (৫) সৎপরিবেশ ও (৬) স্বাধীনতা। এই ছয়টি বস্তু একসঙ্গে ভোগের ব্যবস্থা করিবার যে পরিকল্পনা উহাই সর্বোচ্চ কল্যাণজনক পরিকল্পনা। এখন জানা দরকার যে উক্ত ছয়টি বস্তু একত্র ভোগের স্থান এই দুনিয়া নয়। উহা ভোগের স্থান পরজগত বা আখেরাত। আর যাহারা আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস করেনা তাহারা মস্ত ভুলের মধ্যে রহিয়াছে। অতএব আমাদের পরিকল্পনা এই যে সকল ভাইয়েরা আখেরাতে অবিশ্বাসী তাহাদিগকে তাহাদের ভুলটা বুঝাইয়া দেওয়া ও যাহাতে প্রত্যেক ভাই নিজের মহা কল্যাণ হাছেল করিবার জন্য চেষ্টা করিতে পারে। এই পর্যন্ত ব্যক্তিগত পরিকল্পনা। কিন্তু জানা দরকার যে কোন কল্যাণজনক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যত কঠিন তার চাইতে বেশী কঠিন হইল উক্ত পরিকল্পনা জনসাধারণকে যুক্তি দ্বারা বুঝানো। এইজন্য দরকার হয় একটি জামাত বা সংগঠন। একটা সংগঠন বা সমিতি প্রতিষ্ঠা করতঃ উহা জনসমাজে পৌঁছানো যত কঠিন তাহার চাইতে বেশী কঠিন হইল উহা বাস্তবায়িত করা। এইজন্য দরকার হয় বিশেষ একটি রাষ্ট্র শক্তির। ইহা বুঝাইবার জন্য একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। যেমন স্বামী ও স্ত্রী লইয়া একটি সংসার। তেমনি শাসক ও শাসিতজন লইয়া হয় একটি রাষ্ট্র। যেমন স্বামী স্ত্রী একমত হইয়া চলিলে সংসার সুখের হয় এবং দ্বিমত হইয়া চলিলে সংসার দুঃখের হয়। ঠিক তদ্রƒপ শাসক ও শাসিতজন একমত হইয়া চলিলে রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ এবং তার বিপরীত হইলে রাষ্ট্র অশান্তিপূর্ণ হয়। আরও যেমন একটি সংসারে স্বামী যদি নেককার ও ঈমানদার হয় এবং স্ত্রী যদি বদকার ও বেঈমান হয়, সে স্থলে স্বামী বুঝাইয়া হউক বা গরম মেজাজ দেখাইয়া হউক স্ত্রীকে নেককার এবং নামাজ রোজার পাবন্দ করাইতে পারে যেহেতু সে শাসক। কিন্তু যদি স্ত্রী নেককার ও স্বামী বদকার ও বেনামাজী হয় তবে সেক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীকে অন্ততঃ অনুরোধ করিতে পারে এবং উপদেশ দিতে পারে। কিন্তু গরম মেজাজ দেখাইয়া স্ত্রী স্বামীকে নামাজী বানাইতে পারে না, যেহেতু স্ত্রী শাসিত। এই মেছাল অনুযায়ী যদি আমাদের শাসক শ্রেণী নামাজ পড়েন, আখেরাতে বিশ্বাসী হন এবং এই বিশ্বাস রাখিয়া এমনভাবে নেক আমল করেন যেন উপরোল্লিখিত ছয়টি জিনিস চিরস্থায়ীভাবে আখেরাতে আমাদের ভোগে আসে। তাহা যদি তাহারা সকলকে যুক্তি দ্বারা বুঝাইয়া দেন এবং নেক আমল করিবার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করেন এবং অমান্যকারীকে শাস্তি দেওয়ার বিধান ঘোষণা করেন তবে নিশ্চয়ই দেশময় সকলে তাহা পালন করিতে বাধ্য হইবে। যতদিন পর্যন্ত শাসক সম্প্রদায় উপদেষ্টা না হইবে ততদিন পর্যন্ত শাসিতদের উপদেশে বিশেষ কোন ফলাফল হইবে না। শাসিত সম্প্রদায়ের উপদেশে ব্যাপক উপকার কখনই হইতে পারে না। কারণ উপদেষ্টা দুই শ্রেণীর হয়। প্রথম শ্রেণী- যাহাদিগকে দাওয়াত দিয়া আনিয়া উপদেশ শুনিতে হয়। তাহাদিগকে যাহারা ইচ্ছা করেন দাওয়াত দিতে পারে এবং তাহারা যেখানে ইচ্ছা সেখানেই যাইবেন। এইরূপ দাওয়াতকারীগণ কখনো কাহারো উপদেশ গ্রহণ করিবার এবং তদনুযায়ী আমল করিবার উদ্দেশ্যে কাহাকেও দাওয়াত করেন না। কেননা, দাওয়াতকারীগণ দাওয়াত করেন কোন মানতের নিয়ত করিয়া, কেহবা শুধু নাম ধামের উদ্দেশ্যে আবার কেহ বা দাওয়াত করেন বিশেষ কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য। যেমন কোন ব্যাপারে চাঁদা আদায় করা।
উপদেষ্টাদের দ্বিতীয় শ্রেণী- তাহারা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে জন সাধারণকে ধর্ম-উপদেশ দান করেন এবং সেই মতে চলিবার জন্যও অনুপ্রাণিত করেন, ফলে কিছু সংখ্যক লোক ধর্ম পথ অবলম্বরন করেন। কিন্তু ইহাও আংশিক খেদমত। এইরূপ ধর্ম প্রচারে ব্যাপক খেদমত কখনো হইতে পারে না। কেননা, মনে করুন, আমাদের পাকিস্তানে যতগুলি থানা আছে তাদের কোন স্টাফকে ধর্ম-উপদেশ দ্বারা ধর্মপথে পরিচালিত করিতে পারিতেছেন না বা পারিবেনও না। তারপর কোন মহকুমার এসডিও সাহেব হইতে শুরু করিয়া তাহার স্টাফসমূহ এবং জেলার মেজিষ্ট্রেট সাহেব হইতে শুরু করিয়া তাহার স্টাফসমূহের কাহাকেও এইভাবে ধর্মপথে চালিত করিতে পারিতেছেন না। কোর্ট-কাছারীর হাকিম, উকিল, ব্যারিস্টার বা মোক্তার সাহেবদিগকেও পারিতেছেন না। এছাড়া, পাকিস্তানের ইপিআর ও মিলিটারি বিভাগে ত শাসিত জনসাধারণের প্রবেশেরই অধিকার নাই। অথচ তাহারা প্রত্যেকেই আমাদের মুসলমান ভাই, দারোগা, পুলিশও আমাদেরই ভাই, উকিল-মোক্তার, হাকিম সকলেই আমাদের ভাই। ইপিআর-মিলিটারি বিভাগের সকলেই আমাদের ভাই। সুতরাং আমাদের সেই ভাইয়েরা হয়ত না জানার কারণে বা অলসতার কারণে বা কোন চাপে পড়িয়াই হউক উপরোক্ত ছয়টি মূল্যবান জিনিস হইতে বঞ্চিত হইতেছেন। তাহা হইলে আমরা যদি সত্যিকার মুসলমান হইয়া থাকি এবং যদি আমরা শেষ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (দঃ) এর অনুসারী হইয়া থাকি তবে আমাদের অবশ্য কর্তব্য হইবে এই যে, আমাদের পাকিস্তানের যে কোন অংশের যে কোন ভাই-ই থাকুক না কেন, হউক সে শাসন বিভাগের বা হউক সে মিল-মালিক বা হউক সে সাধারণ মিল শ্রমিক বা হউক সে পাহাড়ী, জংলী, গারো বা হউক সে হিন্দু বা খ্রিষ্টান- প্রত্যেকেই আমাদের ভাই এবং প্রত্যেকেরই একই সৃষ্টিকর্তা। পঞ্চইন্দ্রিয় বিশিষ্ট প্রত্যেকটি মানুষের জন্য আল্লাহ-পাক উপরোক্ত ছয়টি জিনিস সহ চিরস্থায়ী বেহেশতের ওয়াদা করিয়াছেন এবং শয়তান যে মানুষদিগকে তাহাদের মহামূল্যবান কল্যাণ হইতে বঞ্চিত রাখিতেছে তাহা বুঝাইয়া দিবার জন্য এবং মানুষ সকল যাহাতে আপন স্বার্থ ফিরিয়া পাইতে পারে নবীদিগকে তার ব্যবস্থাপক হিসাবে জগতে প্রেরণ করেন। এখন এই আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হইতেছে যে আমাদের পাকিস্তানে ধর্ম উপদেশ বিতরণ বা ধর্মপ্রচার আংশিকভাবে চলিতেছে। যেহেতু উহা শাসিত জনগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অতএব পাকিস্তানের উক্ত আসনে এমন বিশেষ ব্যক্তির প্রয়োজন যিনি হইবেন (১) আল্লাহ, (২) ফেরেস্তা, (৩) কিতাব, (৪) রাসুল, (৫) কিয়ামত, (৬) তকদীর ও (৭) মৃত্যুর পর জিন্দা হইয়া বিচারান্তে মুক্তি বা শান্তি পাওয়া- এই সাত জিনিসে বিশ্বাসী এবং যিনি হইবেন নেককার এবং নামাজ রোজার পাবন্দ। তিনি তাঁহার সদস্যবৃন্দকে ইহা বুঝাইয়া দিবেন যে আসমান জমিনের মালিক আল্লাহ যিনি আমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন আমরা তাঁহারই দাস। সুতরাং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ আমরা নিজে পালন করিব এবং আল্লাহর বান্দাগণের মধ্যে তাঁহার আদেশ-নিষেধ পৌঁছাইয়া দিব। এই জন্যই আমরা এই মহাদায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছি। অতএব আমাদের মধ্যে কাহারো এ বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকা সম্পূর্ণ বেআইনী ও গর্হিত কাজ হইবে। তাহা হইলে এখন চিন্তা করিয়া দেখুন যদি প্রেসিডেন্ট বা প্রাইম মিনিস্টার তাঁহার ভাষণ দ্বারা তাহার সদস্যগণকে একবার হুঁশিয়ারী করিয়া দেন তবে কি তাহা কেহ অমান্য করিতে পারিবে? অতঃপর মিলিটারীদের সম্মুখে ভাষণ দিয়া জানাইয়া দেন যে, হে আমার প্রাণের ভাইয়েরা, আমরা প্রত্যেকেই আল্লাহর বান্দা। মৃত্যুর পর আমাদের সকলকেই আল্লাহর কাছে যাইতে হইবে এবং প্রত্যেককেই আমলের ফল ভোগ করিতে হইবে। অতএব আপনাদের নিজেদের মঙ্গলের জন্য নামাজ-রোজার পাবন্দ হউন। অতঃপর যখন কোর্ট-কাচারীতে বা অফিস আদালতে যাইবেন তখন বিচারপতি বা পরিচালকদিগকে বুঝাইয়া দিবেন যে হে আমার ভাইয়েরা, আপনারা এখানে যেমন বিচার আসনে বসিলে আসামীরা কাঁপিতে থাকে এই ভয়ে যে তাহাদের উপর না জানি কোন রকমের হুকুম হয়। ঠিক এমনই একদিন আমাদের সকলের মালিক আল্লাহ বিচারের আসনে বসিবেন এবং আমরা সকলেই হইব আসামী। অতএব আল্লাহকে ভয় করুন এবং নামাজ রোজার পাবন্দ হউন। মোট কথা যদি তাঁহারা প্রতিটি বিভাগে এইভাবে আদেশ ও উপদেশ দান করেন তবে নিশ্চয়ই প্রত্যেকটি পাকিস্তানি নামাজ রোজার পাবন্দ হইয়া যাইবেন- ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। একবার যদি শাসন বিভাগ এইরূপ দুরস্ত হইয়া যায় তবে শাসিত জনগণ আপনা আপনি দুরস্ত হইয়া যাইবে।
এখন খুব খেয়াল করুন, কেবলমাত্র এই মহা উপকারটির জন্যই নবী (আঃ) গণ রাষ্ট্র পরিচালকের ভার গ্রহণ করিতেন নতুবা দুনিয়ার সাথে তাঁহাদের আর কি সম্পর্ক ছিল? হুজুর পাক (দঃ) পবিত্র জবানে ফরমাইয়াছেন, দুনিয়া একটি শবদেহ স্বরূপ এবং যে উহা গ্রহণ করে সে কুকুর সমতুল্য। সুতরাং শাসন বিভাগের ধর্ম উপদেশই ব্যাপক উপকারী। আরো একটি কথা চিন্তা করিয়া দেখুন- যেমন একটি মটরগাড়ি তার চাকার সাহায্যে চলে, কিন্তু উহা সম্পূর্ণ নির্ভর করে ড্রাইভিং হুইল বা সুখানের উপর। ঠিক তেমনই একটি রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে শিক্ষা বিভাগটি হইল চাকার সমতুল্য এবং শাসন বিভাগটি তার সুখান স্বরূপ। যদি রাষ্ট্রপ্রধান আল্লাহর পথে চলেন তবে শিক্ষা বিভাগের ডাইরেক্টর, শিক্ষক, লেখক প্রভৃতি সকলেই আল্লাহর পথে শিক্ষা বিস্তার করিতে থাকিবেন। যাহা হউক, আমি বলি না যে শাসিতদের মধ্য হইতে যাহারা দ্বীন-প্রচার করিতেছেন বা দ্বীনের খেদমত করিতেছেন তাহারা কোন বৃথা কাজ করিতেছেন বরং আমি তাহাদের জন্য শুকুর গুজার। যেহেতু তাহারা দ্বীনকে সমূলে বিনাশ হইতে দেন নাই। তবে আল্লাহ-পাক এই গোলামকে যাহা দান করিয়াছেন তাহা চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি, বর্তমানে যদি আল্লাহ-পাকের গায়েবী মদদ না আসে তবে পাকিস্তান তথা সারা দুনিয়া হইতে ইসলাম মিটিয়া যাইবারই আশঙ্কা। কারণ বর্তমানে দ্বীনের খেদমতে যাহারা নিযুক্ত আছেন তাহাদের ঈমানের সুগন্ধ যতটুকু তার চেয়ে অহঙ্কার, পরশ্রীকাতরতা ও খোদপছন্দির দুর্গন্ধ অনেক বেশী। সভা সমিতিতে এবং লেখা লেখিতে ও আলাপ আলোচনায় দেখা যায় অমুকে কাফের, অমুকদল বেদাতি, অমুকদল গোমরাহ, কেহ ওহাবী, কেহ খারেজী, কেহ শিয়া, কেহ সুন্নি। বলিতে কি আমাদের ইসলাম ধর্মটা ঠিক হিন্দু ধর্মের মত হইয়া গিয়াছে। হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায় বিদ্যমান। এক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়ের জল গ্রহণ করা ও পাপ মনে করে। তাহাই ঢুকিয়াছে ইসলামে। কিন্তু আমি বলি, ইসলামের সাম্য বা ভ্রাতৃত্ব ইহা নয়। আমি মনে করি সারা দুনিয়ার মানুষই আল্লাহর বাগানের এক একটি ফুল। আমি চাই প্রত্যেকটি ফুল প্রেম ও প্রীতির সুতায় গাঁথিয়া একটি মালা গড়িতে। মালা গাঁথার ধারা হইল এই যে প্রথমে একটি সুতা লওয়া এবং তাহাতে এক একটি ফুল পরস্পর গ্রথিত করা। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের প্রত্যেকটি ভাইকে বুঝাইয়া এক খোদাতে বিশ্বাসী ও হযরত মোহাম্মদ (দঃ) এর অনুসারী করিতে হইবে। তাহা হইলে আমাদের দ্বীন ও দুনিয়ায় দু’জাহানের শান্তি ও মঙ্গল নছিব হইবে।
আমি আল্লাহর মর্জি জোর দিয়া বলিতেছি যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হইলে ইনশাআল্লাহ আপনাদের দুঃখ দুর্দশা দূর হইবে। দুনিয়াতে শান্তির জীবন লাভ হইবে। সকল ব্যাপারে গায়েবী মদদ পাইবেন এবং আখেরাতে ও নাজাত পাইবেন এবং আল্লাহর ওয়াদাকৃত বেহেশত লাভ হইবে।
আলোচ্য বিষয়ের সারমর্ম হইল এই যে, ইসলাম একটি বাস্তব সত্য ধর্ম- ইহা কোন কাল্পনিকের রচিত জিনিস নয়। সারা জাহানের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ-পাকই সব কিছুর মালিক। ইহা সরলভাবে যুক্তি দ্বারা সকল মানুষকে বুঝাইয়া দেওয়ারই নাম তবলীগ বা ইসলাম প্রচার। ধর্ম প্রচারকের জন্য খাওয়া পড়া ও বাসস্থানের দরকার। এই সমস্ত প্রয়োজন মিটাইবার জন্য ইসলাম ধর্ম প্রচার করিয়া শ্রোতাদের নিকট হইতে হয় অর্থ গ্রহণ করিতে হইবে নতুবা শুধু অর্থশালী ব্যক্তিদিগকেই ধর্ম প্রচারক সাজিতে হইবে, কিন্তু এই উভয়ই সংকীর্ণ পথ। কাজেই প্রশস্ত পথ হইতেছে এই প্রচার বিভাগটাকে সর্বোচ্চ সম্মানিত আসনে পৌঁছাইয়া দেওয়া এবং রাষ্ট্রের পক্ষ হইতে ইসলাম প্রচারের ব্যবস্থা করা এবং ইহাই হইতেছে আল্লাহ-পাকের আদেশ। এই ব্যবস্থার মধ্যেই মানুষের ব্যাপক কল্যাণ ও শান্তি নিহিত।
বর্তমান যুগে মানুষ যে অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়িয়াছে তাহার সমাধান ও এর মধ্যেই রহিয়াছে। কারণ বর্তমানে রাজনৈতিক বিভাগের ও প্রচার দপ্তর আছে। আবার ধর্মেরও প্রচারক ম-লী আছে। রাজনৈতিক প্রচারকদের ব্যয়ভার বহন করিতেছেন সরকার আর ধর্মের প্রচারকদের ব্যয়ভার বহন করিতেছেন সর্বসাধারণ বিভিন্ন চাঁদা, যাকাত-ফেতরা, কোরবানীর চামড়া ইত্যাদির মারফত। কিন্তু চিন্তা করিলে দেখা যায় যে, রাজনৈতিক বিভাগের সম্পূর্ণ খরচ ও বহন করিতেছেন সর্বসাধারণ। যেহেতু সরকারী খাজনা, ট্যাক্স ইত্যাদি সাধারণ লোকেরাই বহন করিয়া থাকে। কাজেই যতদিন পর্যন্ত সরকারী বিভাগ ও ধর্ম বিভাগ পৃথক পৃথক থাকিবে ততদিন পর্যন্ত অর্থনৈতিক সংকট থাকিবেই। অনেকের ভুল ধারণা এই যে রাজনীতির সাথে ধর্ম মিলিতে পারে না। তাছাড়া ধর্ম শিক্ষিত ব্যক্তিগণ রাজনীতির কি বুঝিবে? ইহা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কারণ, নৈতিক চরিত্র যাহাদের ভাল সর্বজাতীয় লোকই তাহাদিগকে ভালবাসেন। খোদা-পাকও তাহাদিগকে ভালবাসেন। আর চরিত্রবান হওয়ার শর্ত হইল খোদা ভীরুতা। মানুষ যে কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হউক না কেন খোদার প্রতি যাহার বিশ্বাস আছে এবং খোদাকে যে ভয় করে, সে কাহাকেও জুলুম করিতে পারে না, অন্যায় বিচার করিতে পারে না, ব্যভিচার করিতে পারে না, সুদ ঘুষ লইতে পারে না, পারে না সে আরাম আয়েশের মধ্যে গা ভাসাইয়া দিয়া পরকাল সম্বন্ধে উদাসীন থাকিতে। সুতরাং তেমন চরিত্রবান লোক আমাদের রাষ্ট্রনায়ক হইলে ইনশাআল্লাহ আমাদের উপর নামিয়া আসিবে আল্লাহ-পাকের রহমত।
গোনাহ্গার মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ খান
১৪ মাঘ, ১৩৭৭ বাংলা
২৮ জানুয়ারী, ১৯৭১ খ্রিষ্টিয়।

পরম দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করিতেছি
ইসলাম ও মোসলেম

আল্লাহ-পাক কোরান মজিদে ফরমাইয়াছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামে মধ্যে পরিপূর্ণভাবে দাখেল হইয়া যাও।” সুতরাং এখানে বুঝা যাইতেছে যে মৌখিকভাবে ঈমান আনার পরও যে ইসলামের কথা বলিয়াছেন -ইহাতে কিছু ভেদ আছে। অপর এক আয়াতে আল্লাহ-পাক বলিয়াছেন, “খবরদার! তোমরা মরিও না মুসলমান না হইয়া।”
এক কবি বলিয়াছেন, “শেখ সুদি দরবেশ সুদি, আলেম মোসলমান নাম সুদি।” তাই এখন আমি কিছু লিখিতে চাই যে ইসলাম কি আর মোসলেম কে? সুতরাং এই প্রবন্ধের নাম হইবে “ইসলাম ও মোসলেম”।
হে পাঠক! জানিয়া রাখুন, ‘ইসলাম’ শব্দটি আরবী। উহা ‘ছালাম’ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। ‘ছালাম’ মানে শান্তি নিকেতন। যে জায়গায় শান্তি ব্যতিরেকে অশান্তির লেশ মাত্র নাই তাহাই হইল শান্তি নিকেতন বা ছালাম। এই জন্যই একটি বেহেশতের নামও ‘দারুচ্ছালাম’ রাখা হইয়াছে। সুতরাং ইসলাম মানে শান্তি নিকেতন। ইহাও বুঝা দরকার যে শান্তি নিকেতন কখন ও আপনা আপনি তৈয়ার হয় নাই। নিশ্চয়ই উহার প্রস্তুতকারক কেহ আছেনই আছেন।
আবার এ কথাও সত্য যে, যে পর্যন্ত কেহ মালিকের বশীভূত দাস না হয় এবং মালিকের হুকুম মানিয়া না চলে সে পর্যন্ত মালিক কখনও তাহাকে আশ্রয় দিবেন না। সুতরাং শান্তি ও আরাম উপভোগ করিবার মানসে যে কেহ শান্তি নিকেতনের মালিক আল্লাহ-আহকামুল হাকিমিনের সামনে আত্মসমর্পণ করিয়া তাঁহার বশীভূত দাস হইয়া তাঁহার আইন বা নিয়মাবলী মানিয়া চলিবে সেই হইবে মোছলেম।
এই জগতে বহু মেছাল, যেমন চাকর ও মনিব। মনিব সক্ষম; চাকর অক্ষম। তাই চাকরের উচিত সে যেন মনিবের মন যোগাইয়া চলে, তবেই তাহার শান্তি। নতুবা মনিব তাহাকে তাড়াইয়া দিবে। আরও দেখুন, যেমন স্বামী ও স্ত্রী। স্বামী সক্ষম, স্ত্রী অক্ষম। তাই স্ত্রীর কর্তব্য সে যেন স্বামীর হুকুম প্রতিপালন করিতে বিন্দুমাত্রও ত্রুটি না করে। তবেই সে সুখে স্বামীর ঘরে কাল কাটাইতে পারিবে। নতুবা স্বামী তাহাকে কষ্ট দিবে বা তাড়াইয়া দিবে। এইরূপভাবে চিন্তা করিলে দেখা যাইবে যে অক্ষমের জন্য সক্ষমের কাছে আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত বা বশীভূত না হওয়া পর্যন্ত শান্তিতে বাস করিতেই পারে না। অতএব এই কায়দা অনুযায়ী দেখা যাইতেছে যে, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার মত সর্বশক্তিমান অপর কেহ নাই, সুতরাং সমস্ত সৃষ্ট জীবের জন্য শান্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় এই যে সে যেন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ-পাকের বশীভূত দাস সাজে ও তাঁহার নির্ধারিত নিয়ম মানিয়া চলে। তবেই সে পাইবে শান্তি এবং সে হইবে মোসলেম ও তাহার বাসস্থান হইবে শান্তিময়।
আরও দেখুন, মোসলেম দুই প্রকার। প্রথমত: বাধ্যতামূলক বা গায়ের এখ্তেয়ারী মোসলেম। দ্বিতীয়ত: ইচ্ছাধীন বা এখ্তেয়ারী মোসলেম।
বাধ্যতামূলকভাবে আল্লাহর সৃষ্টজীব বা পদার্থ, মাটি, দানব, আকাশ-পাতাল এবং জলচর ও স্থলচর সমস্তই বাধ্যতামূলকভাবে মোসলেম। এখন আমি যুক্তিযুক্তভাবে প্রমাণ করিয়া দিতেছি যে আকাশ, পাতাল, জলচর ও স্থলচর প্রভৃতি কি প্রকারে মোসলেম। আমি পূর্বেই বলিয়াছি যে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম মানিয়া চলাকেই মোসলেম বা বশীভূত দাস বলে। ইহা প্রত্যেকেই মানিতে বাধ্য। সুতরাং আসমান মোসলেম ও আল্লাহ-পাকের বশীভূত দাস। তার প্রমাণ এই যে, কোটি কোটি বৎসর ব্যাপীয়া আসমান স্থিরভাবে উপরে দ-ায়মান রহিয়াছে, কখনও ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে না বা কেহ ইহার মেরামতও করিতেছে না। সে আপন মনিবের হুকুমে মওজুদ আছে। তারপর চন্দ্র, সেও মোসলেম। কেননা, চন্দ্র আপন প্রতিপালকের দাসত্বের পরিচয় দিয়া সর্বদা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। চাঁদ যখন উদিত হয় তখন সারা দুনিয়ার মানব শক্তি একত্র হইয়াও যদি বাঁধা প্রদান করে তাহাকে ফিরাইতে পারিবে না। আবার যখন সেই চাঁদ ক্ষয় হইয়া লুকাইয়া যায় তখনও সমস্ত শক্তি দিয়া তাহাকে আটকাইয়া রাখিতে পারে না। অথচ চন্দ্র যে নিজে সক্ষম কোন বস্তু তাহাও নহে। যদি সে সক্ষম হইত তবে সে কেন এইরূপভাবে কোটি কোটি বৎসর ধরিয়া ঘুরিয়া ফিরিতেছে? কেন সে কখনো পূর্ণ হয় আবার কখনো ক্ষয় হয় এবং সে চায় কি? নিশ্চয়ই তাহার নিজস্ব ক্ষমতা থাকিলে তাহার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব প্রকাশ না করিয়া থাকিত না। ইহাতে বুঝা যাইতেছে যে, সে সৃষ্টিকর্তার একান্ত বশীভূত দাস, তাই মনিবের হুকুমে পাহারা দিয়া যাইতেছে এবং আল্লাহ যে তাহার মনিব ইহার দলিল আসমানী কিতাব কোরান শরীফ। তারপর, সূর্য। সেও খোদা-পাকের বশীভূত দাস। সে খোদার নির্ধারিত আইন মানিয়া চলিতেছে। যখন সূর্য উদয় হয় তখন সারা জাহানের কেহও উহাকে ফিরাইয়া একটি পল বা অনুপলও বিলম্ব করিতে পারিবে না। আবার যখন অস্ত যায় তখনও কাহারও ক্ষমতা নাই যে একটু বিলম্ব করাইতে পারে। অথচ সূর্য ও নিজস্ব ক্ষমতা রাখে না। যদি সূর্যের কিছুমাত্র স্বাধীন ক্ষমতা থাকিত তবে সে কেন নিজের ব্যক্তিত্ব দেখাইতেছে না? সুতরাং সুর্য ও মোসলেম। এমনিভাবেই, বৃষ্টি-বাদল, ঝড়, বিদ্যুত, ঋতু সকলেই নির্ধারিত নিয়মের বশীভূত হইয়া চলিতেছে এবং সৃষ্টিকর্তার দাসত্বের প্রমাণ দিয়া যাইতেছে। সুতরাং সমস্তই মোসলেম। তারপর দেখুন পৃথিবীর অবস্থা। এখানে যত রকম জীব আছে সকলই নির্ধারিত নিয়মের অধীন হইয়া চলিতেছে। দেখুন, নর ও মাদীর মিলনে প্রত্যেক জীবের সৃষ্টি হইতেছে, কোথাও কেহ তদবিপরীত কিছু দেখিতে পাইবে না এবং সর্বপ্রকার জীবই মাদীর গর্ভজাত হইয়া থাকে। কোথাও তার বিপরীত অর্থাৎ নরের গর্ভজাত হইতে দেখিবে না। সুতরাং যখন এই নিয়ম এড়াইয়া কেহই চলিতে পারে না তখন সকলেই নিয়মের অধীন বা দাস এবং এই নিয়মের নির্ধারণ কর্তাই হইতেছেন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। কাজেই সকল জীবই আল্লাহর আইন মান্যকারী দাস এবং সকলেই বাধ্যতামূলক মোসলেম।
তারপর নদ-নদীও সর্বদা খোদার নিয়ম মানিয়া চলিতেছে। আর দেখা যায় নদীতে জোয়ার-ভাঁটা হয়। জোয়ারের সময় সর্বদা পানি বৃদ্ধি পায় ও ভাঁটার সময় পানি হ্রাস পাইতেছে। কেহ এই নিয়ম বন্ধ করিতে পারিতেছে না। আরও দেখুন, কোন নদীতে মিঠা পানি আবার কোন নদীতে নোনা পানি। কখনও নোনা নদীতে মিঠা পানি হয় না আর মিঠা নদীতে কখনও নোনা পানি হয় না। যদিও দুই নদীর পানি মিলিতভাবে প্রবাহিত হইয়া থাকে। কিন্তু নদী যে নিজে কোন ক্ষমতাবান বস্তু তাহাও নয়। কেননা, নদী মানুষের সম্মুখ দিয়াই প্রবাহিত হইয়া থাকে। সে কেন একই নিয়মে এত বৎসর ধরিয়া প্রবাহিত হইতেছে, সে কি চায় তাহা আজও কাহাকেও জানাইতে পারে নাই। সে যে খোদারই দাস এবং তাঁহারই প্রদত্ত নিয়মে কর্তব্য কাজ করিয়া যাইতেছে ইহারই দলিল প্রমাণ এই যে নদীও বাধ্যতামূলক মোসলেম।
তারপর নদী মধ্যস্থ বালুচরগুলিও খোদার অমোঘ বিধান মানিয়া চলিতেছে। দেখুন, যে নদীগর্ভে রেনু রেনু বালুকণা পড়িয়া মস্ত চর গঠিত হইতেছে, ঐ নদীর পাড়েই আবার কত দালান কোঠা ভাঙ্গিয়া চুড়িয়া মিসমার হইতেছে। যেখানে পানির এত শক্তি যে মজবুত দালান ও টিকিয়া থাকিতে পারে না, তাহাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া নদী গর্ভে বিলীন করিয়া দিতেছে। আবার সেই নদীর মাঝখানেই একটার উপর একটা বালুকণা পড়িয়া চর সৃষ্টি হইতেছে। অথচ বালুকণাগুলি পরস্পর সংযুক্ত নহে। এখানে কি কেহ বলিবে যে পানির স্রোত নাই বা বালুকণার শক্তি খুব বেশী- কখনোই নয়। তবে মানিতে হইবে যে নদী ও বালুকণা উভয়ই মোসলেম বা দাস, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ-পাকের দাসত্বের পরিচয় দিয়া যাইতেছে।
তারপর গাছ-পালা বৃক্ষলতা। যখন হইতে মানুষ সৃষ্টি হইয়াছে তখন হইতে দেখিতেছে গাছপালা ফুল ফল একই নিয়মে চলিতেছে। যেমন, তাল গাছে বেল হয় না, তালই হয়। আম গাছে কলা হয় না, আমই হয়। আবার তেতুল কখনো মিষ্ট হয় না, টকই হয়। মরিচ কখনো তিক্ত হয়না, ঝালই হয়। অর্থাৎ একই মাটিতে পয়দা, তাদের একই আহার্য, তবুও বিভিন্ন গাছের ফলে বিভিন্ন রকম স্বাদ ও গন্ধ এবং যে ফলে যে স্বাদ ও গন্ধ নির্ধারিত তাহা এড়াইয়া অন্য প্রকৃতি ধারণ করিতে পারিতেছে না। সুতরাং বৃক্ষলতা গাছ গাছালি সমূদয়ই বাধ্যতামূলক মোসলেম।
এখন আমি সংক্ষেপে মানব দেহের মোসলেম হওয়ার দলিল প্রমাণ দিতেছি। সারা জাহানের সকলই যে মোসলেম তাহার সংক্ষিপ্ত প্রমাণ দেওয়া হইয়াছে। বিস্তারিত লিখিতে গেলে মস্ত বড় পুস্তক-কিতাব হইয়া যাইবে। আকলমান্দ্ যাহারা তাহাদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। দেখ, ওহে মানব! তুমি যে কোন জাতি বা ধর্মাবলম্বী হইয়া থাক না কেন, তোমার সর্বাঙ্গই মোসলেম এখন তুমি মুখে স্বীকার কর বা না কর।
সারাজগতের সমস্ত সন্তানই মায়ের পেট হইতে পয়দা হয় এবং তুমিও ঐ একই নিয়ম পালন করিয়া ভুমিষ্ঠ হইয়াছ। সুতরাং তোমার পয়দায়েস হিসাবে তুমি নির্ধারিত নিয়ম মান্যকারী দাস বা মোসলেম।
তারপর প্রত্যেক সন্তানই ভুমিষ্ঠ হইয়া মায়ের স্তন্য পান করে- তাহা তুমি পালন করিয়াছ। সুতরাং এই নিয়ম পালনকারী দাস হিসাবেও তুমি মোসলেম। তারপর প্রত্যেক সন্তানই প্রথমাবস্থায় বাকশক্তিহীন বা বোবা থাকে। পরে মা-বাপ বা প্রতিপালনকারীর ভাষা ব্যবহার করিতে শিখে। এই নির্ধারিত নিয়মও তুমি এড়াইতে পার নাই, সুতরাং বাক শক্তির ব্যাপারেও তুমি নিয়মের বশীভূত দাস বা বাধ্যতামূলক মোসলেম। তারপর প্রত্যেক সন্তানকেই সৃষ্টিকর্তা পাঁচটি ইন্দ্রিয় দান করিয়াছেন, যথা: (১) চোখে দেখে, (২) কানে শুনে, (৩) নাকে শুকে, (৪) জিহ্বা দিয়া স্বাদ গ্রহণ করে ও (৫) ত্বক দ্বারা অনুভব করে। তাহা ছাড়া এক ইন্দ্রিয়ের কাজ অপর ইন্দ্রিয় করিতে পারে না। তুমিও ঐ একই নিয়মের বশীভূত দাস বা বাধ্যতামূলক মোসলেম।
তারপর দেখ, প্রত্যেক মানুষকেই পা দিয়াছেন হাটিবার জন্য, কেহ কি হাত দিয়া হাটিতে পারে? হাত দিয়াছেন কাজ করিবার জন্য, কেহ কি পা দিয়া হাতের কাজ করিতে পারে? মস্তিষ্ক দিয়াছেন চিন্তা করতঃ ভাল মন্দ বিচার বিবেচনা করিবার জন্যই, কেহ কি অপর কোন ইন্দ্রিয় দ্বারা চিন্তা-ভাবনা করিতে পারে? কখনো নয়। তুমিও এই নিয়ম মানিয়া চলিতেছ, সুতরাং তুমিও বাধ্যতামূলক মোসলেম। তোমার সর্ব শরীর সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত নিয়মের অধীন হইয়া চলিতেছে। দেখ, যখনই তোমার নিদ্রা আসে তোমার সর্বদেহে অবসন্নতা আসিয়া তোমা হইতে সমস্ত ক্ষমতা ছিনাইয়া লইয়া যায়, আর তুমি মৃতবৎ পড়িয়া থাক। আর ও দেখ, তুমি সুস্থ দেহে বসিয়া আছ, হঠাৎ তোমার পেটে বা অন্য কোন অঙ্গের ব্যাথা উপস্থিত হইলে তুমি বুঝিতে পার না তাহা কোথা হইতে আসিল। তারপর আরও দেখ কখনো কখনো মানুষের অর্ধাঙ্গ (বিকলাঙ্গ) ব্যামার হইয়া কোন কোন অঙ্গ মৃত হইয়া যায়। অর্থাৎ কাজের অযোগ্য হইয়া যায়। যেমন কাহারও হাত অবশ হইয়া যায়, কাহারো বা চক্ষু কানা বা অন্ধ হইয়া যায়, কাহারও বা পা অবশ হইয়া যায়, অথচ সে নিজেও বুঝিতে পারে না যে সে কেন এমন হইল বা সে এমন করিল যে ইহা কেহ চিকিৎসা করিয়াও ভাল করিতে পারে না। সুতরাং আমাদের সর্ব অঙ্গই সেই সৃষ্টিকর্তার বিধান মান্য করিয়া চলিতেছে এবং তোমার সর্বশরীরও ঐ বিধান মান্যকারী দাস। সুতরাং তোমার সর্বশরীর মোসলমান এবং সকল জাতীয় মানুষই বিধিবদ্ধ নিয়মের ভিতর একইভাবে চলিয়া থাকে, যদিও মুখের দাবীতে কেহ এমন কেহ তেমন দাবী করে।
আরও দেখুন, কোন স্ত্রীলোকেরই দাড়ি নাই। কারণ সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত নিয়ম এই যে স্ত্রীলোকের দাড়ি হইবে না। সুতরাং সকল জাতীয় স্ত্রীলোকই এই কানুন মান্যকারী মোসলেম। আল্লাহ-পাক নির্ধারিত করিয়া দিয়াছেন যে পুরুষ মানুষের মুখে দাড়ি হইবে। তুমি রাখ বা নাই রাখ, কিন্তু দাড়ি ত হইতেছে। তাহা ত আর এড়াইতে পারিতেছ না। যাহারা দাড়ি রাখে না যদি তাহাদের হাতে দাড়ি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করিয়া দেওয়ার শক্তি থাকিত তবে নিশ্চয়ই সে ব্যবস্থা তাহারা অবশ্যই করিত। তার প্রমাণ এই যে, একমাত্র দাড়ি কামাইবার জন্য যতসব যন্ত্র আবিষ্কার হইয়াছে তাহা বোধ হয় কোটি কোটি টাকারও বেশী হইবে। কিন্তু দাড়ি গজানো বন্ধ করার কোনই ঔষধ বা যন্ত্র আবিষ্কার করিতে পারিতেছে না। যখন একটা না পছন্দের জিনিস তোমার অঙ্গের মধ্যে গজাইয়া উঠিয়া তোমার স্বাধীন ক্ষমতা লোপ করিয়া তোমাকে পরাধীনতা স্বীকার করাইতেছে। এখনও কি বলিতে পার যে তুমি নির্ধারিত নিয়মের বশীভূত দাস নও? নিশ্চয় তুমি বশীভূত দাস এবং এই যুক্তি অনুযায়ী তুমি বাধ্যতামূলক মোসলেম।
এই পর্যন্ত আল্লাহর ফজল ও করমে যুক্তিযুক্তভাবে প্রমাণিত হইল যে আসমান, জমিন ও উভয়ের মধ্যস্থিত সমস্ত জীব-জানোয়ার নদী-নালা, গাছ-পালা, সকলই বাধ্যতামূলক মোসলেম এবং সকল জাতীয় মানব শরীরও বেএখতেয়ারীভাবে মোসলেম। যেহেতু সকলেই নির্ধারিত নিয়ম প্রতিপালন করিয়া চলিতেছে।
এখন বাকী রহিল এখতেয়ারী মোসলেম বা ইচ্ছাধীনভাবে মোসলেম কে তার পরিচয় দেওয়া।
হে পাঠক! জানিয়া রাখা দরকার যে, প্রত্যেক জীবেরই প্রাণ আছে, কিন্তু মানুষের আছে দুইটি প্রাণ। জীবের প্রাণকে বলে জীবাত্মা, তাহা মানবের আছে। কিন্তু মানব শরীরে ঐ জীবাত্মা ছাড়া আরও একটি আত্মা থাকে তার নাম হইল পরমাত্মা। সুতরাং সেই জীবাত্মা ও পরমাত্মার সন্ধান লইয়া যে মনব উভয় আত্মাকে সৃষ্টিকর্তার বশীভূত দাস বানাইয়া চলিতে পারে সেই হইবে কামেল মোসলমান এবং সেই মানবের ভাগ্যেই আল্লাহ-পাকের শান্তি নিকেতনের অফুরন্ত আরাম ও আয়েশ ঘটিবে। আর যে মানব পরমাত্মার খবর না লইয়া কেবল জীবাত্মার বশীভূত হইয়া কাল কাটাইবে তাহারা প্রকৃতপক্ষে দোজখের ভীষণ আযাব ভুগিবে। স্বয়ং খোদা- পাক বলিয়াছেন আমি কতক জ্বীন ও ইনসান পয়দা করিয়াছি তাহারা জাহান্নামের ইন্ধন হইবে। তাহাদের চিহ্ণ কি? তাহাদের দিল দিয়াছি, ভালমন্দ বুঝে নাই, চক্ষু দিয়াছি ভাল রাস্তা দেখে নাই, কান দিয়াছি ভাল কথা শুনে নাই, তাহারা যেমন চতুষ্পদ জানোয়ার। বরং জানোয়ার ত ভালই, তাহা হইতেও নিকৃষ্ট। যেহেতু তাহারা গাফেল (কোরআন)। এই মর্মেই হুজুরে পুরনূর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লাম ফরমাইয়াছেন; “যে চিনিয়াছে নফ্সকে সে চিনিয়াছে খোদাকে”।
যাহা হউক সেই পরমাত্মার তত্ত্ব মানবের নিকট হইতে পাওয়া অসম্ভব। তার সার্বিক সন্ধান কেবল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহই ভাল জানেন। সেই জন্য দয়া করিয়া আল্লাহ যুগে যুগে নবী বা রাসুল পাঠাইয়াছেন। কোন আকাশবাসী রাসুল হইয়া আসেন নাই বরং মানব জাতির মধ্য হইতেই আবশ্যকবোধে একজনকে বাছাই করিয়া নিয়াছেন এবং তাহাকে আল্লাহ-পাকের তরফ হইতে সৃষ্টিকর্তার মারেফৎ বা পরিচয় এবং মানবাত্মার পরিচিতি জ্ঞান বা এলেম দান করিয়াছেন এবং সেই নবী আল্লাহর খলিফা পদে নিযুক্ত হইয়া খোদা প্রদত্ত এলেম জগদ্বাসীকে শিক্ষা দিয়াছেন। যে কোন মানবই সেই নবীর নিকট হইতে শিক্ষা লাভ করিয়াছেন তিনিই সঠিক পরিচয় পাইয়াছেন। আর যাহারা সেই নবীর শিক্ষা গ্রহণ করে নাই তাহারা কখনই পরমাত্মার খবর পায় নাই বা পাইতেও পারে না। আর যে পরমাত্মার খবরই পায় নাই সে খোদার পরিচয় আর কি পাইবে? জীবাত্মার ও পরমাত্মার প্রভেদ কি এবং এই বিষয়ে কিঞ্চিৎ আভাস:
জীবাত্মার প্রভাবে প্রাণীরা যে সকল কাজ করে প্রত্যেক মানবও প্রায় তাহাই করে। যথা: কাম ভাবের উদয় হইলেই একটি নর পশু ও একটি মাদা পশুকে ব্যবহার করে এবং উহার প্রভাবে বাচ্চা পয়দা হয়। এই খাছলাত মানব জাতির মধ্যেও আছে। ক্রোধ হইলে একটি জীব অপর জীবকে আঘাত করে- ইহা মানবের মধ্যেও বিদ্যমান। আর ক্ষুধা লাগিলে আহার করার প্রবৃত্তি হয়। এই ব্যাপারে পশু পাখীর যে নিয়ম মানবেরও ঐ একই নিয়ম। এই সকল জিনিসের মধ্যে মানব ও জানোয়ারের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। তবে পরমাত্মার প্রভাবে মানব যাহা হাছেল করে তাহা হইল অতীত ও ভবিষ্যত এবং দুইটি জিনিসের দ্বারা উপকৃত হওয়া। উহা কোন জীবই পায় নাই। কারণ গত বৎসর কি কাজ করাতে ক্ষতিগ্রস্থ হইয়াছিলাম তাহা স্মরণ রাখিয়া আগামী বৎসর তদবিপরীত কোন কাজ করা- ইহা মানব ছাড়া অপর জীব পারে না। মনে কর, গেল বৎসর বীজধানে রৌদ্র কম দেওয়াতে উহা ঠিকমত গজায় নাই। উহা দেখিয়া এইবার হুঁশিয়ার হইয়া থাকিল যে এইবার যেন বেশী রৌদ্র দেয়।
আরও দেখ, মৌসুমের সময়ে প্রত্যেক জিনিস সস্তা থাকে এবং গায়ের-মৌসুমে মঙ্গা হয়। এই সকল জানিয়া মানুষ সাধ্যমত জিনিসপত্র মৌসুমের সময় ক্রয় করিয়া রাখে। ফলে গায়ের-মৌসুমে লাভবান হয়। কিন্তু একটা গরুকে একদিন বা দুইদিন ক্ষুধার্ত রাখিবার পর যদি অন্ততঃ দুই দিনের পরিমাণ ঘাস তার সামনে দেওয়া হয় তবে সে কতক খাইয়া আর কতকের মধ্যে লেদাইয়া চেনাইয়া নষ্ট করিয়া রাখিবে। সে মোটেই ভাবিবে না আগামীকাল আমি কি খাইব?
আরও দেখ একটা মানুষের সন্তান অসুস্থ হইলে যদি সে নিজে কিছু জানে তবে সেই ব্যবস্থা করে, নতুবা তাড়াতাড়ি অপর কেহকে দেখাইয়া তাহার রোগের প্রতিকার করায়। কিন্তু একটি জানোয়ারের বাচ্চার কোন অসুখ হইলে সে কিছুই করিতে জানে না- সে জ্ঞান তাহার নাই।
সুতরাং মানব ও জানোয়ারের মধ্যে বহু পার্থক্য বিদ্যমান আছে। এই যে জ্ঞান যদ্বারা মানুষ অতীতে যে বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হইয়াছে ভবিষ্যতে তাহা হইতে বাঁচিয়া থাকিতে পারে। এই জ্ঞানই মানুষকে জানোয়ার হইতে পৃথক করিয়া দিয়াছে। আরও দেখ, জানোয়ার হইতে মানবকে কতকগুলি শক্তি স্বতন্ত্র করিয়া দিয়াছেন। যেমন, গরুর হাম্বা হাম্বা রব। চিরকালই সে ঐ এক বুলি ছাড়া অন্য বুলি বলিতে পারে না। একটি কুকুর একটি বিড়ালের বুলি আওড়াইতে পারে না। একিট ঘোড়া একটি ছাগলের বুলি আওড়াইতে পারে না। এমন কি পাতি কাক একটি দাঁড় কাকের বুলি আওড়াইতে পারে না। এই সকল ব্যাপারে সকল জীব নির্ধারিত নিয়মের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে বন্দী আছে। কিন্তু একটি মানুষকে স্বাধীন ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছে। সে যে কোন বেশ ধারণ করিতে পারে। যে কোন জীবের বুলি মুখে আওড়াইতে পারে এবং এই স্বতন্ত্র ক্ষমতার কারণেই স্বতন্ত্র নিয়মও নির্ধারিত হইয়াছে।
মনে কর, কুকুর যদি ঘেউ ঘেউ করে তবে উহাই কুকুরের তসবিহ পড়া হইবে। একটি বিড়াল যদি মেও মেও করে তবে উহাই বিড়ালের তসবিহ পড়া হইবে। একটি কাক যদি কা-কা করে তবে উহাই তাহার তসবিহ হইবে, কেননা, সে বাধ্যতামূলকভাবে ঐ শব্দের মধ্যেই আবদ্ধ আছে। কিন্তু একটি মানুষ জগতের সকলজীব বা জানোয়ারের বুলি আওড়াইলে ও তাহার তসবিহ পড়া হইবে না বরং ঐসব তাহার জবানের অপব্যয় হিসাবে ধরা হইবে। কিন্তু মানবের তসবিহ তখনই হইবে যখন সে আপন নবীর বাতান বুলি আওড়াইবে।
এবার দেখ মানুষ এমন স্বাধীন ক্ষমতা রাখে যে সে ইচ্ছা করিলে নবীর কথা মান্য করিয়া চলিতে পারে আবার ইচ্ছা না হইলে নবীর বিরুদ্ধেও চলিতে পারে। অবশ্য নবী ভাল ও মন্দ বুঝাইয়া দিতে পারেন। কিন্তু জানার পরে মানা বা অমান্য করা মানুষের ইচ্ছাধীন, এখানে নবীর নীতি পালন করাইবার জন্য মানবের উপর কোন প্রাকৃতিক নিয়ম নির্ধারিত নাই। কবি বলিয়াছেন, “যাহার ইচ্ছা হয় চলিয়া আসুক, যাহার ইচ্ছা হয় চলিয়া যাউক, ধরপাকড় বা দারোয়ান বা প্রতিবন্ধক এখানে নাই।” অতএব, যে স্বাধীন ক্ষমতা দিয়া মানুষকে প্রত্যেক জীবের উপর প্রাধান্য দান করিয়াছেন, উক্ত ক্ষমতার মালিকই হইতেছে পরমাত্মা এবং ঐ পরমাত্মা মানব দেহে থাকিয়া ‘আনানিয়াতের’ দাবী করে। যেমন ‘ইহা আমার নিজস্ব জিনিস’, ‘তুমি আমার অধীনস্থ’, ‘আমি তোমার মালিক’ এবং ইহারই নাম ‘নফসে নাতেক’। যাহা হউক এই পরমাত্মার সাহায্যে সে জ্ঞানবলে ইহলোকে বহু উন্নতি সাধন করিতে পারে এবং করিতেছে। ইহা আমরা স্বচক্ষে দেখিতেছি। এই পরমাত্মার জ্ঞানবলে কেহ ইহকালের উন্নতির জন্য চেষ্টা ও সাধনা করিবে সেই কম বেশী কিছু উন্নতি করিতে পারে।
কিন্তু উর্ধ্ব লোকের উন্নতি সাধন করার ক্ষমতা মানবদেহের পরমাত্মার ক্ষমতার বাহিরে। যদি উর্ধ্বলোকের সংবাদ বা তথাকার রহস্য জানার ক্ষমতা মনবদেহে থাকিত তাহা হইলে বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিকগণ উড়োজাহাজ দিয়া আকাশ পর্যন্ত পৌঁছিতে পারিত এবং তথাকার খবর জগতে আনিত। কিন্তু তাহা কি তাহারা পারিতেছে? কখনো নয়। আকাশ ও আকাশবাসীদের সমস্ত সংবাদ স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লহা-পাক দয়া করিয়া কোন কোন মনবকে জানাইয়া থাকেন এবং তিনিই আল্লাহ-পাকের প্রেরিত পুরুষ বা নবী ও রসুল। সুতরাং প্রকৃত শান্তি নিকেতন বা বেহেশত অবস্থিত উর্ধ্বলোকে। আর একথাও সকলেই জানেন যে প্রত্যেক জায়গায়ই যাইবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পথ ঘাট থাকে এবং প্রত্যেক রাষ্ট্রেই বাস করিবার জন্য কতকগুলি শর্ত থাকে। এই সমস্ত শর্তপালনকারী তথায় সুখে বাস করে আর শর্ত অমান্যকারী গ্রেফতার হইয়া কারাবাসী হয়। অতএব প্রত্যেক মানুষই একবার সেই উর্ধ্বলোকে পৌঁছিবে এবং সেখানে গিয়া নিজেকে যাহাতে সভ্য ও সুশিক্ষিত বলিয়া পরিচয় দিতে পারে এবং যাহাতে আকাশবাসীদের সামনে অসভ্য বর্বর সাজিতে না হয় সেই শিক্ষা দান করিতেই নবী আসেন। সুতরাং নবীর শিক্ষা প্রণালী বা নীতিকেই বলে শরীয়ত বা দ্বীন ইসলাম।
অতএব মনব জাতির মধ্য হইতে যাহারা জামানার নবীর শরীয়ত স্বেচ্ছায় মান্য করেন তাহারাই ‘মোমেন’ আর যাহারা স্বেচ্ছায় নবীর শরীয়ত অমান্যকারী হয় তাহারাই ‘কাফের’।
সুতরাং আখেরী জামানার শেষে পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লাম। যাহারা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে মান্য করে ও হুজুরকে নবী হিসাবে মান্য করে অর্থাৎ কালেমা পড়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ তাহারা মোমেন এবং এই মোমেনদিগকেই খোদা বলিয়াছেন যে তোমরা পরিপূর্ণভাবে মোসলমান হও। বর্তমান জগতে মোমেন আছে বটে কিন্তু মোসলমান খুব কম। কারণ আজকালকার মোসলমানগণ কেবল মুখে বলে যে আমাদের ধর্ম ইসলাম এবং আমরা মুসলমান জাতি। আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, আমাদের রাসুল হযরত মোহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লাম। আমরা মনে করি যে খোদার কাছে বেহেশত, আমরা খোদার বান্দা, খোদাকে মানিলে তিনি বেহেশত দিবেন। খোদার কাছে যে বেহেশত এবং তিনিই যে দিবেন ইহাত ঠিক। কিন্তু তাহার শর্ত আছে। মনে কর, একজনের কন্যা আছে। তুমি বিবাহ করিতে ইচ্ছুক; সেও দিতে রাজী। শুধু এই ইচ্ছা ও রাজীতেই কি ঐ কন্যা তোমার স্ত্রী হইবে? বা তুমি তাহার স্বামী হইতে পারিবে? অথবা কোন লোক তাহার বাড়ি বিক্রয় করিতে ইচ্ছুক আর তুমি খরিদ করিতে রাজী। বলত, এই রাজী ও ইচ্ছাতেই কি তুমি ঐ বাড়ির মালিক হইতে পারিবে? হ্যাঁ, তুমি যদি ‘শরা’ অনুযায়ী মোহর দান করতঃ বিবাহের অলঙ্কারাদি দিয়া কন্যার অলি হইতে বিবাহ রেজিষ্ট্রি করিতে পার তবে অবশ্যই ঐ কন্যা তোমার স্ত্রী হইবে। অথবা যদি ঐ বাড়ির মূল্য প্রদান করিয়া সরকারী অফিস হইতে রেজিষ্ট্রি করিয়া লইতে পার তবে তুমি হইবে ঐ বাড়ির মালিক। ঐ রকম বেহেশেত ও তথাকার যাবতীয় জিনিস দান করিবেন বান্দাকে। কিন্তু তাহার মূল্য হইতেছে ‘শরীয়তে নববী’ যে ব্যক্তি নবীর পূর্ণ হুকুম মান্য করিয়াছেন তিনিই বেহেস্তে প্রবেশ করিয়াছেন। এই জগতে যে এই নির্ধারিত নিয়ম মানিয়া চলিবে তাহারই জন্য রহিয়াছে চিরসুখের স্থান শান্তি নিকেতন বা বেহেস্ত।

পরম দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করিতেছি
ইসলাম সমাজ সংস্কার সমিতি

১২ চৈত্র, ১৩৬০ বাংলা,
২৬ মার্চ, ১৯৫৩ খ্রিষ্টিয়
রোজ- বৃহস্পতিবার
অদ্য পরম দয়ালু আল্লাহ তায়ালার তরফ হইতে এই গোলামের ক্বালবে ইসলাম সমাজের উন্নতির প্রতি যে একটি পথ বাতান ইহল তাহাই লিখিতে বসিলাম। আয় রহিম ও করিম খোদা! তোমার এই নগণ্য দাসের এই প্রস্তাবটি নিজ দয়াগুণে কবুল কর ও সমাজকে ভালভাবে বুঝাইবার তৌফিক আতা ফরমাও ও সমাজিদের এই সত্য রাস্তাটি বুঝিবার জ্ঞান শক্তি আতা ফরমাও। আমিন! আল্লাহুম্মা আমিন!!
বর্তমানে ইসলাম সমাজের যে শোচনীয় অবস্থা ইহার আশু প্রতিকার বা শীঘ্র সংস্কার না হইলে অতি শীঘ্রই ইসলাম তথা পাকিস্তানের টিকিয়া থাকা দুষ্কর। অতএব সকলে মিলিয়া নিম্ন লিখিত প্রণালীতে সমাজের উন্নতি করা একান্ত জরুরী।
এই সমিতির মুলনীতি হইবে এই, যথা: হুজুরে পুর নূর রসুলে মকবুল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লাম সর্বপ্রথম এই সত্য পথের অনুসন্ধান পাইয়া আরবের অত্যাচারী-অবিচারীদিগের ভিতর সত্য প্রচার করিয়াছিলেন। সেইরূপ সেই নিয়মে আমাদেরও এই সত্যকে প্রকাশ করিতে হইবে। খেয়াল করিলে দেখা যায় যে, উন্নতির মূল হইল একতাবদ্ধ হইয়া সমাজ গঠন করা আর অবনতির মূল হইল অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা।
প্রথম কথা এই: আমাদের সুখ দুঃখ দেওয়ার মালিক এক আল্লাহ উন্নতি অবনতি করিবার মালিকও এক আল্লাহই। অতএব সেই আল্লাহর নিকট না পৌঁছা পর্যন্ত কখনোই দুঃখ দূর হয় না এবং সুখীও হইতে পারি না। বান্দা আল্লাহ পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছিতে পারে? তাই স্বয়ং আল্লাহ-পাক দয়া করিয়া খাস বান্দা হযরত মোহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লামকে মনোনীত করিয়া তাঁহার মারফতে নিজের রাজী না-রাজীর পরিচয় দিয়া পৃথিবীর লোকদিগকে শান্তির পথ দেখাই দিলেন এবং নবুওত খতম হওয়ার পরেও নায়াবত বাকী রাখিয়াছেন। আল্লাহ-পাক যুগে যুগে এক একজন খাস বান্দা পয়দা করেন এবং তাহার মারফতে মানুষদিগকে শান্তির পথ বাতান। যাহারা সেই বান্দাকে পথ প্রদর্শক হিসাবে মানিয়া চলেন তাহারা নিশ্চয়ই শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করিয়া আখেরাতে শান্তি নিকেতন বেহেস্তে পৌঁছিতে পারিবেন।
এখন এই খাস বান্দার পরিচয় কি?
প্রথম : এলম থাকা, দ্বিতীয় : তাকওয়াগীর হওয়া, তৃতীয় : তারেকে দুনিয়া রাগেবে আখেরাত হওয়া, চতুর্থ : কোন কামেল পীরের ফায়েজ প্রাপ্ত হওয়া, পঞ্চম : তাহার কাছে যাহারা আসিবে তাহাদের কাহারো প্রতি কোন পক্ষপাতিত্ব না করিয়া বরং ন্যায় কথা মুখের উপর বলিয়া দেওয়া।
কামেলের পচিয় আরো দুইটি : যথা, আল্লাহ-পাকের পূর্ণ পরিচয় যুক্তি সহকারে বুঝাইয়া দেওয়া। দ্বিতীয়ত : তিনি হইবেন হক-পরস্ত। আপন পর সবাইকে সমান জানিবেন। অতএব যখন তেমনি লোক পাওয়া যাইবে তখন তাহার একান্ত আনুগত্য স্বীকার করিলেই আল্লাহ-পাকের আনুগত্য স্বীকার করা হইবে; তাঁহার রাজীই আল্লাহর রাজী এবং তাঁহার না-রাজীই আল্লাহর না-রাজী।
গুফ্ তাইউ গুফতে আল্ল¬া বুয়াদ, গরচে আজ হলকুমে আবদুল্ল¬াহ্ বুয়াদ ॥
বান্দায়ে খোদা খোদা না বাশাদ, অলাকেন আজ খোদা জুদা না বাশাদ ॥

“গাছ কভু ফুল নয়, ফুল কভু গাছ নয়,
গাছ বিহনে কভু ফুল ফুটে না,
এই ভেদ সবে বুঝে না।
ফুল কভু মধু নয়, মধু কভু ফুল নয়,
ফুল বিহনে কভু মধু হয় না,
এই ভেদ সবে বুঝে না।
ফুলেতে মধু হয়, মৌমাছি তা খুঁজে লয়,
মৌমাছি বিহনে মধু অন্যে চিনে না,
এই ভেদ সবে বুঝে না ॥”

ইসলাম সমাজ সংস্কার সমিতির নিয়মাবলী :
আমি খালেছ আল্লাহর ওয়াস্তে স্বেচ্ছায় নিম্নলিখিত শর্তগুলি পালনার্থে এই সমিতিতে যোগদান করিলাম :
আকাশ পাতালের সৃষ্টিকর্তা কেবলমাত্র এক আল্লাহ। আমি তাঁহার উপর ঈমান আনিলাম। তাঁহার হুকুম জারী হইয়াছে হযরত মোহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লাম হইতে। অতএব আমি হুজুরের উপর ঈমান আনিয়া পড়িলাম, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। ইসলামের মূল জিনিস হইল ৫টি, যথা- কালেমা, নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ্জ্ব- এইগুলি আমি মানিয়া লইলাম।
১। সর্বপ্রথম আমি কলেমা নিজে পড়িব এবং আমার স্ত্রী-পুত্র পরিবারের সকলকে শিখাইব।
২। আজ হইতেই আমি নামাজ পড়িতে থাকিব এবং পরিবারের সকলকে নামাজ পড়াইব।
৩। নিজের ও পরিবারের সকলের নামাজের ছুরা, দোয়া ও কালেমাগুলি এই সমিতির কোন হুকুম প্রাপ্ত লোকের নিকট শুনাইতে হইবে।
৪। নিজের স্ত্রী পুত্র যদি কালেমা নামাজ শিখিতে বা পড়িতে স্বীকার না করে তবে প্রথম নিজের সাধ্যমত বুঝাইয়া যদি মানাইতে না পারে তাহা হইলে হয় সমিতির হুকুমপ্রাপ্ত কাউকে দিয়া অথবা স্বয়ং ‘ছদরের’ নিকট জানাইয়া তাহাদের এছলাহের ব্যবস্থা করিতে হইবে। যদি স্বয়ং ‘ছদর’ তাহাদের অবস্থা দেখিয়া ‘নিজের ফেরাছতের দ্বারা’ জানিতে পারেন যে এই স্ত্রী বা এই ছেলে তাহাকে ত্যাগ করিতে হইবে, তখন খোদা ও রাসুলের মোহব্বতের পরিচয় দিয়া স্ত্রীকে তালাক দিতে হইবে। ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করিতে হইবে। কিন্তু নিজে নিজে কখনই ঐরূপ করিবে না।
৫। পাড়াপড়শী বা দেশী বিদেশী কাহারও সাথে ঝগড়া করিতে পারিবে না। যদি কেহ গালি দেয় তবে তাহার উত্তরে গালি ও দিতে পারিবে না। যদি কেহ অনর্থকই মারে তবে সমিতির ছদরকে জানাইতে হইবে। তিনি যদি পুনরায় তাহাকে উক্ত ব্যক্তির নিকট ক্ষমা চাহিতে বলেন তবে বিনা বাক্যব্যয়ে তাহা মানিতে হইবে।
৬। সমিতির মেম্বারকে নিজের মার পেটের ভাইয়ের মত জানিতে হইবে। একজনের দুঃখের জন্য সকলকেই দুঃখিত হইতে হইবে।
৭। প্রত্যেকটি মেম্বারকে এই খেয়াল রাখিতে হইবে যে আমার জীবনে যত কষ্টই আসুক না কেন তাহা আমি খোদা ও রাসুলের মোহব্বতে সহ্য করিব, কাহাকেও আমার দুঃখ জানাইয়া দুঃখিত করিব না।
৮। প্রত্যেকটি সদস্যকে ছদরের পূর্ণ তাবেদারী করিয়া চলিতে হইবে। তিনি যদি বলেন যে অমুকের সাথে বা অমুক দলের সাথে লড়াই করিতে হইবে তখন তখনই তাহাকে তজ্জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে।
৯। এই সমতিরি আলেম ব্যতীত সমিতির বিরোধী কোন আলেমের সাথে উঠা বসা তর্ক-বিতর্ক করিতে পারিবে না এবং দাওযাত ও দিতে পারিবে না।
১০। খোদার কছম করিয়া এই অঙ্গীকার করিতে হইবে যে, আমার দ্বীনি বা দুনিয়াবী যে কোন কাজ করিতে হয় তাহা এই সমিতিরি ইমাম বা ইমামের হুকুম প্রাপ্ত ব্যক্তির আদেশ অনুযায়ী করিব।
আমি স্বেচ্ছায় রাজী-খুশীতে দ্বীন ও দুনিয়ার শান্তির জন্য উপরে লিখিত দশটি শর্ত মানিয়া এই সমিতির সদস্যভুক্ত হইলাম।
দস্তখত

আলেম ও পীর সাহেবদের জন্য দুইটি অতিরিক্ত শর্ত :
১। যদি কোন আলেম কোন দ্বীনি (যেমন মাদ্রাসায় পড়ান বা ওয়াজ নছিহত করেন) কাজে লিপ্ত থাকেন বা দুনিয়াবী (যেমন চিকিৎসা বা ঝার, ফুঁক ইত্যাদি) কাজে লিপ্ত থাকেন তবে তেমন আলেমকে যদি ইমাম কোন মোছলেহাতের জন্য ঐ সকল কাজ ত্যাগ করিতে বলেন তবে তাহা মান্য করিতে হইবে এবং কোন পীর সাহেবকে যদি মোছলেহাতের জন্য মুরীদ করিতে মানা করেন তবে তাহাকে সেই হুকুম মান্য করিতেই হইবে।
২। যদি কোন পীর সাহেবকে কোন মাদ্রাসার কাজে লাগিতে বলেন তবে তাহাকে তাহাই করিতে হইবে। যদি কোন আলেম যিনি পীরালী করেন না যদি ইমাম তাহাকে মুরীদ করিবার কর্মভার লইতে হুকুম দেন তবে তাহাকে তাহাই মান্য করিয়া উক্ত কাজে লাগিতে হইবে।
এই দুইটি অতিরিক্ত শর্ত স্বীকার করিয়া আলেম ও পীর সাহেবদিগকে সদস্যভুক্ত হইতে হইবে।

পরম দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করিতেছি

আমাদের দায়িত্ব

বর্তমান জামানার অবস্থা কোথাও শান্তি নাই, দিন দিন অশান্তি বাড়িয়াই চলিয়াছে- সবাই ইহা জানেন। কিন্তু ইহার কারণ কি? চিন্তা করিলে দেখা যায়- ইহার একমাত্র কারণ আমাদের কৃত অন্যায়-অপরাধসমূহ।
বর্তমান জামানায় জগতে তিন শ্রেণীর মানুষ আছে, প্রথম : মুর্খ জাহেল, দ্বিতীয়: নব্য শিক্ষিত ও তৃতীয়: ধর্ম শিক্ষিত আলেম। খুব গভীরভাবে চিন্তার পর দেখা গিয়াছে যে এই তিন শ্রেণীর প্রত্যেকেই খোদা-পাকের পাক দরবারে দোষী। কেবল আল্লাহ-পাকের কিছু খাস বান্দা এই জগতে এখনও বাকী আছেন যাঁহাদের উপর খোদার খাস রহমত রহিয়াছে। তাঁহাদের উছিলায়ই জগত কায়েম আছে। যাহা হউক, যদিও জগদ্বাসী সকলেই দোষী, কিন্তু সকলের দোষ সমান নয়। মনে করুন, কোন ব্যক্তি আত্মহত্যা করিতেছে, অপর ব্যক্তি তাহা দেখিতেছে কিন্তু ফিরাইবার চেষ্টা করিতেছে না। তৃতীয় জন শুধু মুখে মানা করিয়াই ক্ষান্ত, কিন্তু অপর কেহকে ডাকিয়া শক্তি প্রয়োগে তাহার জীবন বাঁচাইতে চেষ্টা করিতেছে না। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রীয় আইনে সকলেই দোষী হইবে।
এইরূপ বর্তমান জামানায় এক শ্রেণীত পাপকুলে ডুবিয়া আত্মহত্যা করিতেছে, আর এক শ্রেণী তাহাদিগকে ফিরাইবার চেষ্টা করিতেছে না। উদাহরণ স্বরুপ, পিতা সৎ কাজ করে, পুত্র পাপী; মাতবর ভাল, পাতাইত পাপী, স্বমী, স্ত্রী ও বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে ঐ একই নিয়ম। বরং তাহাদের সহযোগিতা করিতেছে। তাহারা নিজেরা যদিও ভাল কাজ করেন তবুও অপরকে হালাকত হইতে বাঁচাইতে চেষ্টা না করিবার কারণে খোদার কাছে দোষী হইতেছে। তৃতীয় শ্রেণী তাহাদের কেহ ওয়াজ নছিহত করিতেছেন, কেহ মাদ্রাসায় পড়াইতেছেন, কেহ বই পুস্তক লিখিয়া সমাজে ধর্মকথা প্রচার করিতেছেন। কিন্তু এই শ্রেণীর লোক ও খোদার দরবারে অব্যাহতি পাইবে না। এখানে একটি কথা খুব খেয়াল রাখিবেন। মনে করিবেন না যে আমি ওয়াজ করা ও মাদ্রাসা বা বই পুস্তক লেখাকে বৃথা কাজ ও গোনাহের কাজ মনে করিতেছি। বরং তাহাদের কাজগুলিও উত্তম ও নেকের কাজ। তাহা হইলে তাহারা খোদার কাছে কেন দায়ী হইবেন?
তাহারা খোদার কাছে এইজন্য দায়ী হইবেন যে তাহাদের একক শক্তি অনুযায়ী কাজ করিয়া কেন তাহারা বলিতেছেন যে, “আমাদের পৌছান দরকার তাহা করিলাম”? কিন্তু একতাবদ্ধ হইয়া সমবেত শক্তি দ্বারা কেন তাহারা শান্তি কায়েম করিবার চেষ্টা করিতেছে না।
হে আলেম সমাজ! আপনারা যদি বলেন যে, ‘কুনতুম খায়রা’ তবে এই কথাও জানা দরকার যে, সেই কোরআনে আল্লাহ-পাক বলিতেছেন, ‘অ তাছিমু বেহাবলিল্লাহে’ আপনারা যদি নবী করিম ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লামের এই হাদিস বলেন যে, ‘বাল্লাগু ওয়া আন্নি’ তবে অপর হাদিসেই দেখুন ‘আল জামাতুন রাহমাতুন’ ইত্যাদি।
এখানে সাধারণ লোকদিগকে সাবধান করিতেছি, খবরদার! আপনারা কেহ আলেমদের উপর দোষ চাপাইয়া খুশী হইবেন না। মনে করুন, একজন খুব জেদ করিয়া বলিল, “আমি নিজের জীবন নিজে দিয়া হইলেও তোমাদেরে বাঁধাইয়া শাস্তি দিব”। এই ক্ষেত্রে সবাই বুঝিতে পারেন যে, তাহার মত বোকা আর নাই। সে বেকুব এই কথাটা বুঝে না যে তাহারা না হয় কিছু শাস্তি ভোগ করিবে, আর আমি ত আত্মহত্যাকারী মহাপাপী হইয়া চিরদিনের শাস্তি মাথায় লইতেছি। এইরূপ সাধারণ লোকের বুঝা দরকার যে আলেমগণ যদিও আমলের ত্রুটির কারণে খোদার কাছে দায়ী হন, তবুও কেহত ধম্কি খাইয়াই মাফ পাইবেন। আর কতক কিছু শাস্তি পাইবে যার যার আমল ও এখলাছের ত্রুটির দরুন। কিন্তু যাহাদের ইমান বা আকিদা ঠিক আছে, তাহারা আখের নাজাত পাইবেন। কেননা, ঈমান বা আকিদা যার দুরস্ত আছে তাহাকে নিশ্চয়ই আল্লাহ-পাক নাজাত দিবেন। তবে আমল খারাপ থাকিলে পাপ পরিমাণ শাস্তির পর অথবা উপযুক্ত সুপারিশকারীর সাহায্যে নাজাত পাইবেন।
আর যাহার ঈমান বা আকিদাই দুরস্ত নাই তাহার নাজাত কখনোই হইবে না। সুতরাং সাধারণ জাহেল হইয়া আলেমদের উপর দোষারূপ করা মস্ত অন্যায়।
এখন আমি আলেমগণের প্রতি বিশেষভাবে আরজ করিতেছি, আপনারা ইনসাফের সহিত বলুন ত খোদাপাক কি শুধু পেট লইয়া বাঁচিবার জন্য আর আপন পরিবার লইয়া খাইয়া পড়িয়া বাঁচিবার জন্যই এই অমূল্যধন এলেম দান করিয়াছেন? চিন্তা করিয়া দেখুন, খোদা-পাক বলিয়াছেন, ‘ইজ ক্বালা রাব্বুকা … … ফিল আরদে খলিফা’ এই খলিফা মানে প্রতিনিধি। সুতরাং জগতে একদল লোক এমন হইবেন যাহারা ‘ইলাহী হুকুমত’ কায়েম করিয়া খোদার আদেশেই খোদার প্রবর্তিত আদেশ নিষেধ জারি করিবেন।
বর্তমান জগতে যতগুলি ইসলামী রাষ্ট্র আছে তাহাদের কোথাও সেই রকম খালেছ ইলাহী হুকুমত কায়েম নাই। সেই জন্যই খোদা-পাকের কুদরতে অসম্ভবকে সম্ভব করিয়া দেখাইলেন, অর্থাৎ পাকিস্তান কায়েম করিয়া দিলেন। যাহারা খাঁটি আলেম তাঁহারা অবশ্যই জানেন যে কেয়ামতের আগে একবার এই জগতে দ্বীনে হক সমগ্র দুনিয়াতে জারী হইবে। সুতরাং এই পাকিস্তানই তাহার সূচনা এবং কিয়ামতও অতি নিকটবর্তী। যাহা হউক, সেই সুনিশ্চিত দিন আসিবে। এই পৃথিবীতে শান্তির বাতাস বহিবে। কিন্তু তাহা আপনা আপনি আসিবে না। সেই মেহমানকে অভ্যর্থনা করিয়া আনিতে হইবে। বহু লোককে ত্যাগ স্বীকার করিতে হইবে, অনেক সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে হইবে। তবেই খোদার ফজলে সেই সুদিন আসিবে, কুদিন ঘুচিবে। কারণ, খোদাপাক সকল কাজই কৌশলে করেন, সেই হেকমত সাধারণ লোকের বুঝার শক্তি নাই। দেখ, খোদা হযরত মুসা নবী (আঃ) কে বলিয়াছিলেন যে তোমাকে শ্যামদেশ দান করিব, কিন্তু তোমার লোকসহ যুদ্ধ করিতে হইবে। কিন্তু মুসা নবীর সহচরগহণ হিম্মত করিল না এবং শ্যামদেশ ও হস্তগত হইল না। পক্ষান্তরে তিয়া নামক ময়দানে ৫০ বৎসর ছালওয়া ও মান্না খাইয়া কাটাইল।
এখন খেয়াল করুন, হুকুমত মানে কি? হুকুমত মানে ত ঐ আইন বা শাসন বিভাগ যাহার উদ্দেশ্য হইল যুক্তিসঙ্গত নিয়ম কানুন প্রণয়ন করা ও তাহা বুদ্ধিমান দিগকে যুক্তি দ্বারা বুঝাইয়া দেওয়া ও নির্বুদ্ধিমান গোঁয়ার প্রকৃতির লোকদিগকে বল প্রয়োগে মানিতে বাধ্য করা, অর্থাৎ বেইনসাফ দূর করা ও ইনসাফ কায়েম করা।
বর্তমান জগতে দুনিয়াবী রাজত্ব কায়েম আছে এবং সর্বসাধারণ যে কোন রাষ্ট্রেই বাস করুক না কেন তথাকার রাষ্ট্রীয় আইন মানিয়া চলিতেছে। কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপারে সকল রাষ্ট্রই স্বেচ্ছাচারীভাবে চলিতেছে। যাহা হউক, ধর্মীয় আইন প্রণয়ন করা ও সর্বসাধারণকে ধর্ম প্রতিপালন করার জন্য বাধ্য করণের ভার কেবল আলেমগণের উপর নির্ভর করে। আলেমগণ যদি এই দায়িত্বপূর্ণ কাজ সমাধা করিয়া যাইতে পারেন তাহা হইলে ইহকালেও ইমাম বা নেতার পদপ্রাপ্ত হইবেন, আর পরজগতেও সকলের অগ্রণী হইয়া খোদার কাছে অসীম সম্মান পাইবেন। আর যদি তাহা না করিয়া কেবল গা-ভাসাইয়া দিয়া কাল কাটাইয়া যাইতে থাকেন তাহা হইলে পরকালে সর্বসাধারণের জন্যও দায়ী হইতে হইবে। এমন কি জগতে যত বিধর্মী, কাফের, মুশরেক আছে তাহাদের জন্যও আলেমদিগকে জবাবদিহি করিতে হইবে।
এই কথাটা বুঝাইবার জন্য একটা উপমা দিতেছি:-
মনে করুন, একজন লোক দশ টাকা লইয়া ব্যবসায় করে এবং অপর একটি লোক এক হাজার টাকা লইয়া ব্যবসায় করে। এই অবস্থায় যদি কোন একজনের মূলধন খোয়ানী যায় তাহা হইলে বেশী লোকসান হইবে বেশী টাকা ওয়ালার। আবার লাভ হইলেও বেশী লাভ হইবে বেশী টাকা ওয়ালার। আর দেখুন, একটি নৌকা চালাইলে তাহাতে যে সকলের কর্তা বা মাঝি হয় তাহার ভাগ কিছু বেশী থাকে। আবার তঞ্চকতা করিলে মহাজনের কাছে মাঝিই বেশী দায়ী হইবে। ঐ রকমই প্রত্যেক বিভাগের যিনি ভারপ্রাপ্ত তাহার সম্মানও বেশী আবার অবহেলার জন্য ক্ষতিগ্রস্থও হয় বেশী। যাহা হউক, এই পর্যন্ত কেবল কথাই বলিলাম, কিন্তু কথায় কোন ফল হয় না, কাজ করিতে হয়।
হে ভাই, মুসলমান! আপনারা শুভ সংবাদ গ্রহণ করুন, নিরাশ হইবেন না। এই গোলাম সত্য কথা বলিতেছে এই জামানায় লোকদের মধ্যে যাহারা ধার্মিক বলিয়া পরিচিত যেমন, কেহ মুন্সী, মৌলভী, মৌলানা বা পীর সাজিয়া মোসলেম সমাজে বিচরণ করিতেছেন, তাহাদের মধ্যেই কতক ধোঁকাবাজ, কতক ফাসেক এমনকি কতক লোকত আস্ত শয়তানের প্রতিনিধিও আছেন। তবে যে পর্যন্ত এই সমাজ হইতে সত্য মিথ্যা পৃথক না হইবে, সে পর্যন্ত শত চেষ্টায়ও জগতে শান্তি কায়েম হইবে না। এখন বলিতে পারেন যে কিরূপে চিনিব কে সত্যের উপর আছে আর কে মিথ্যার মধ্যে?
তাহার উত্তরে বলিব, যে ব্যক্তি এইরূপ প্রশ্ন করিবে সে অজ্ঞ, অজ্ঞদের সাথে আলোচনার সময় এখন নয়। কিন্তু এখন শুধু আলেমদিগকে বলিব, আশা করি তাহারা এ বিষয়টা বুঝিতে পারিবেন। আচ্ছা বলুন, জগতে নবী আসিতেন কেন? তাঁহারা খোদারই নায়েব বা প্রতিনিধি হিসাবে জগতে আল্লাহর আইন জারি করিতে আসিতেন। আচ্ছা, নবীর পরে জগতে সেই খেলাফত কায়েম রাখিবেন কাহারা? আলেমগণ। “আলওয়ামাও” কিন্তু যে আলেম দ্বারা জগতে নবীর দ্বীন জারি থাকিবে সেই আলেমেরে চিহ্ন কি? প্রত্যেকেরই একটা যোগ্যতা থাকা চাই। অযোগ্যতা লইয়া কাজ করিতে যাওয়া নেহায়েত অন্যায়। বিশেষভাবে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, এলেমের উপর ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি নির্ভর করে। উহা শুধু উলা পাশ বা টাইটেল পাশের এলেম নয়। কেননা, কোন নবী কখনও উলা বা টাইটেল পাশ করা আলেম ছিলেন না। দেখুন, উছুল, ফেকা, নহু, ছরফ, মনতেক, তাওয়ারীখ ইত্যাদি পড়িয়া যে আলেম হয় উহা দ্বারা ভাষাজ্ঞান বা বৈষয়িক জ্ঞান পরিপক্ক হয়। তারপর এজমা, কেয়াস, ফেকাহ, হাদিস, তফসির পড়িয়া যে জ্ঞান হয় উহার দ্বারা ধর্মের হাকিকত বুঝিবার জ্ঞান বাকী থাকে। তাহার দলিল স্বরূপ বলিতেছি, ‘অ এছ আলুনাকা আনির রূহ’, যে এলেমের উপর দো-জাহানের মঙ্গল নির্ভর করে উহার মূল চারটি এলেম:
প্রথম : দেহ ও রুহের তত্ত্বমূলক এলেম।
দ্বিতীয় : সৃষ্টিকর্তার ছেফাত ও জাত সম্বন্ধে এলেম।
তৃতীয় : তক্দীর ও তদ্বীর সম্বন্ধে বিশদ জ্ঞান।
চতুর্থ : পরকাল সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান।
এই চারিটি এলেম হইতেছে সমস্ত এলেমের উছুল। খোদার ফজলে উহা হাছেল হইলে, তাহার আর কোন সন্দেহ বাকী থাকিবে না। শরীয়ত কি? নামাজ, রোজা, জাকাত, হজ্জ্ব কেন? ঈমানের স্থান সর্বপ্রথম কেন? বেহেস্ত ও দোজখ সত্য কিনা? জেহাদ করিতে হয় কেন? এই সমস্ত প্রশ্নের হাকিকতই তখন খুলিয়া যাইবে। সুতরাং তেমন ব্যক্তি যদিও মানবীয় ছুরতে সর্ব সাধারণের মত এই জগতে চলাফেরা করেন, তবুও তাহারা জিন্দা অপর মানুষ মুর্দা। তাহারা জাগ্রত অপর মানুষ নিদ্রিত। তাহারা চক্ষুওয়ালা অপর মানুষ অন্ধ। ইহা আমার কথা নহে। কোরানেই আল্লাহ পাক এইরূপ বলিয়াছেন।
পুনশ্চ:
আপনারা ইনসাফের সাথে বলুন দেখি, উপরোল্লিখিত গুণের আলেম ব্যতীত নায়েবে নবীর কাজ কিরূপে চালাইবেন? কাজেই এই দুর্দিনে তেমন আলেমের তালাশ করা একান্ত কর্তব্য। এই কারণে আমি সকল ভাইকে ডাকি, আপনারাও আমার ভাই, যদি আপনি ও তেমন লোকের সন্ধান পাইয়া থাকেন তাহা হইলে আমাকে ডাকেন, আমি আপনার সাথী হইব। এখন আমার বক্তব্য বিষয় এই যে, আমি কাহাকেও বলিতেছি না আপনারা আমার কথামতই চলিবেন বা আমার কাছে মুরীদ হইতে হইবে। আমি তওবা করি এমন পীরালীকে আমি চুরালী তুল্য মনে করি। অবশ্য আমি সবাইকে ডাকি কাজ করিবার জন্য। আমি আলেম ভাইদিগকে বন্ধু হিসাবে ডাকি। আপনারা মনে করিবেন না যে কাহারও জন্য কথা বলা নিষেধ আছে। এখন পরামর্শের সময়। আপনি হয়ত আমার চাইতে ভাল কোন বিষয়ে গবেষণা করিতেছেন, আমি আপনার মনের খবর জানি না। যখন আলাপ হইবে তখন আমি আপনার সহযোগিত করিব। আর যদি আমার কথা ঠিক মনে করেন তবে আপনি আমার সহযোগিতা করিবেন। যাহারা আলেম নহেন তাহারা হয়ত বলিতে পারেন যে এখন আমাদের কোন কাজের দরকার নাই। তাহা নহে। বরং সবাইকেই যোগাযোগ রক্ষা করিয়া কাজ করিতে হইবে। এখানে একটি সন্দেহ ভাঙ্গিয়া দিতেছি, কোন কোন ভাই বলিয়া থাকেন যে যাহারা কিছু জানে তাহারা জবান খুলে না। ইহার দলিল কি? কিন্তু ভাইদের চক্ষে যে শয়তান পট্টি পড়াইয়া দিয়াছে তাহা তাহারা টের পায় নাই। আচ্ছা, যদি এই সমস্ত তত্ত্বপূর্ণ জ্ঞানের কথা জগতে জ্ঞানীরাই প্রচার না করিয়া জবান বন্ধ করিয়া থাকিতেন তাহা হইলে এই পর্যন্ত জ্ঞানচর্চা জগতে বাকী থাকিত কিরূপে? তবে কি বর্তমান জমানার পান্দে নামা-আত্তার মছনবীয়ে-রোম, গুলিস্তা-বুস্তায়ে-শাদী এইসব তাহাদের নাম দিয়া অপর লোকেরা লিখিয়াছেন বা আকাশের ফেরেস্তারা লিখিয়া গিয়াছেন?
যাহা হউক, আজ পাঁচ বৎসর চলিয়াছে- এই চিন্তা লইয়া আমি পাগল পারা হইয়া ফিরিতেছি। ইহার মধ্যে যে সকল আলেমবৃন্দের সহিত আলোচনা হইয়াছে তাহাদের মধ্যে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন উক্তি পাইয়াছি। কেহ বলেন, “আপনার কথাগুলি একেবারেই ঠিক, তবে প্রথম প্রথম সকলে প্রহণ করিতে চাইবে না।” বলুন ত ইহা কি তাহাদের ঠিক উক্তি? অপরে গ্রহণ করে বা না করে তাহা দিয়া আমি কি করিব? যখন একটা সরল পথের সন্ধান আমি পাইলাম, তখন সর্বপ্রথম আমিই এই পথের পথিক হইব। পরে আমার দেখাদেখি অপর ভাইয়েরা আসিবে ইহাই ত জ্ঞানীর উক্তি।
কেহ বলিয়াছেন, “দেখুন, আপনার কথা যে একেবারেই হক তাহাতে কোন সন্দেহ নাই, তবে কথা এই যে আপনিত তেমন কোন আলেম নহেন। তাই আলেমরা আপনার কথা মানিতে চাহিবে না।” আরও বললেন, ‘দেখুন, খোদা-পাক যদি কোন জিনিস কাউকে দান করেন উপযুক্ত লোক না হইলে তাহা বিকেনা’। কেহ বলিয়াছেন, “আপনার কথা ঠিকই, তবে ইহার মধ্যে রিয়া প্রকাশ পাইতেছে।” কেহ বলিয়াছেন, “কথা আপনার ঠিকই, তবে আমরা কিছু কেরামত দেখিলে বিশ্বাস করিব।” এরূপই হইল বর্তমান জগতের অবস্থা।