পরম দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে

হযরত ইমাম মাহদী (আঃ)

(প্রথম পর্ব)

বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতির সভাপতি সাহেব প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানালেন, একবার এক মাদ্রাসার মোদারেসীনদের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আচ্ছা হুজুর সাহেবান! আপনারা কি বিশ্বাস করেন যে, হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) এই পৃথিবীতে আসবেন?”

তারা বললেন, “হ্যাঁ, আমরা একথা বিশ্বাস করি।” তাদের প্রতি আমার পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, তিনি কখন কি জন্য আসবেন?

তাদের উত্তর ছিল, মুসলমানদের চরম অধঃপতনের সময় ধর্মের সংস্কার করার জন্যই তিনি আসবেন। আমার পরবর্তী প্রশ্ন – তখন কি কোরান-হাদিস মুসলমানদের মধ্যে থাকবে না এবং এ সমস্ত শিক্ষা দেয়ার জন্য কি আলেম-ওলেমাবৃন্দ ও মাদ্রাসা থাকবে না?

তারা বললেন, হ্যাঁ, এসবই থাকবে। এরপর আমার প্রশ্ন -কোরান-হাদিস থাকবে, তা’ শিক্ষা দেয়ার জন্য আলেম-ওলেমাবৃন্দও থাকবেন, মাদ্রাসাও থাকবে। তা’হলে এসব থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের অধঃপতন কেন হবে এবং ধর্মের সংস্কারের জন্য তাঁর আগমনের প্রয়োজন কেন হবে?

এ প্রশ্ন শুনে হুজুর সাহেবানরা নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। এরপর তাদেরকে আরও প্রশ্ন করা হলো, আচ্ছা, ইমাম মাহদী (আঃ) আলেম হবেন, না বে-আলেম হবেন? তিনি যদি বে-আলেম হন, তাহলে এক সমস্যা। তা এই যে, বে-আলেম হয়ে তিনি কিভাবে আলেম ও আপামর জনসাধারণকে ধর্ম শিক্ষা দিবেন? আর তিনি যদি আলেম হন, তাহলে আরেক সমস্যা, তা এই যে, তিনি কোন মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করবেন? কারণ, তিনি হবেন সারা জাহানের মানুষের জন্য শিক্ষক ও পরিচালক। এ অবস্থায় তিনি যদি কোন সুন্নি মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করে আলেম হন, তা হলে শিয়া সম্প্রদায় কি তাঁকে নেতা বলে মান্য করবে? অথবা তিনি যদি কোন শিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করে আলেম হন, তাহলে সুন্নি সম্প্রদায়ের লোক কি তাঁকে নেতা বলে স্বীকার করবে? শিয়া-সুন্নি বাদ দিলেও আরেক সমস্যা দেখা দিবে। তা এই যে, মনে করুন, তিনি আপনাদের মাদ্রাসায়ই শিক্ষা লাভ করে আলেম হলেন, আপনারাই হলেন তাঁর শিক্ষা গুরু। আপনাদের কাছে আপনাদেরই মাদ্রাসায় পাঠ করে যখন তিনি বলবেন, “আপনারা সব ভ্রান্ত, আপনারা সব ভুল করে আসছেন এবং ভুল শিক্ষা দিচ্ছেন। আপনারা যদি সত্য সত্যই সঠিক পথ পেতে চান এবং পরকালে মুক্তি পেতে চান, তাহলে আমার আনুগত্য করুন, আমাকে নেতা বলে স্বীকার করুন।”

তারপর তাদেরকে বললাম, তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আপনারা কি তাঁকে নেতা বলে স্বীকার করে নিতে পারবেন? তখন কি আপনারা বলবেন না, “দেখেছ! কাল যাকে আমরা পড়িয়ে দিলাম, সেই কিনা আজ আমাদেরে বলছে ভ্রান্ত।” এমতাবস্থায় আপনারা কি তার বিরোধিতা না করে এক বাক্যে তাঁকে মেনে নিতে পারবেন?

এর উত্তরে হুজুর সাহেবানরা জানালেন, “কোরান-হাদিসে তো এসব বিষয়ের কোন উল্লেখ পাইনি। আর এ সব বিষয় আমরা কখনো চিন্তা-ভাবনা করিনি। এক্ষণে এ বিষয়ে সঠিকভাবে আমরা কিছু বলতে পারব না।”

এ বিষয়ে সঠিকভাবে কিছু বলতে তারা তাদের অপারগতা স্বীকার করেছেন সত্য, কিন্তু এ বিষয়ে সঠিকভাবে কিছু জানার যে প্রয়োজন আছে, বা তারা যে জানতে আগ্রহী, তাদের মুখাবয়ব দেখে তেমন কিছু বুঝা গেল না। যা বুঝা গেল তা এই যে, আমার মত একজন বে-আলেমের কাছে কোন কিছু শুনতে তারা মোটেও প্রস্তুত নন।

আহলে কিতাবীগণ ঐশী গ্রন্থের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এবং বস্তা বস্তা শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং তদসম্বন্ধে অধ্যাপনা করা সত্ত্বেও তারা যে কাফের ও মোশরেকে পরিণত হয়েছিল, পবিত্র কোরানে ইহা পাঠ করে কি আমাদের আলেম-ওলেমাবৃন্দের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল না? যদি তারা সতর্কই হবেন বা কি উচিত আর কি অনুচিত এ সম্বন্ধে যদি তাদের জ্ঞানই থাকত, তাহলে যুগে যুগে ধর্ম-সংস্কারকগণের আসার কি প্রয়োজন ছিল, আর হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) এরই বা আগমনের কি প্রয়োজন থাকতে পারে?

সে যাহোক, মুসলমান সমাজে হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) এর আগমন একটি সর্বজন স্বীকৃত বিষয় হওয়া সত্ত্বেও আলেম-ওলেমাবৃন্দও সঠিকভাবে বলতে পারছেন না তিনি কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন বা তাঁর শিক্ষক কে হবেন। প্রচলিত ধারার আলেম হলে যে সমস্যার উদ্ভব হবে বা আলেম না হলে যে সমস্যার উদ্ভব হবে- এ সমস্যার কি সমাধান, আমাদের আলেম সমাজ তারও কোন সঠিক উত্তর দিতে পারছেন না। কিন্তু, কেন? এই ‘কেন’ এর উত্তর দিতে গিয়ে অতীব দুঃখের সঙ্গে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, অতি নগণ্য সংখ্যক ব্যতীত গোটা মুসলিম সমাজটাই ভুলে গেছে তাদের নবী (দঃ)কে, ভুলে গেছে তাঁর কুনিয়াৎ ও আদর্শ, ভুলে গেছে কোরান ও ইসলামের মূল উৎসকে, ভুলে গেছে আল্লাহকে ও তাঁর জাত ও ছেফাতকে। যে সমস্যার সমাধান হযরত রাছুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লামের দিকে এক নজর তাকালেই পেতে পারি, সে দিকে না তাকিয়ে আমরা তাকাচ্ছি আমাদের নিজেদের জ্ঞান ও বুদ্ধির দিকে। তা হলে আমরা আর কিভাবে আমাদের সমস্যার সমাধান পাব?

আমরা আলেম বলতে যা বুঝি, সে ধারার আলেম ছিল ইহুদী-নাছারাগণ, সে ধারার আলেম হচ্ছেন আমাদের বর্তমান আলেম-ওলেমাবৃন্দও। ইহুদী-নাছারা আলেমবৃন্দ যেমন সমাধান দেয়ার পরিবর্তে শুধু সমস্যার পাহাড় সৃষ্টি করে করে ৭২ দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, তদ্রƒপ আমাদের আলেম সমাজও সমাধান দেয়ার পরিবর্তে একটার পর একটা সমস্যা সৃষ্টি করে করে গোটা মুসলিম সমাজটাকেই ৭৩ দলে বিভক্ত করে ফেলেছে। আর সমস্যার ঘুর্ণাবর্তে পড়ে নিজেরা ডুবে ডুবে মরছে, তদসঙ্গে সমগ্র মুসলিম সমাজটাকেও অতল সমুদ্রে ফেলে ডুবিয়ে মারছে।

এটা সর্বজন স্বীকৃত বিষয় যে হযরত রাছুলে করিম (দঃ) কোন মাদ্রাসায় পড়েননি। তিনি ছিলেন উম্মি বা নিরক্ষর,কিন্তু তিনি বে-আলেম ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম। কোন বিদ্যালয়ে পাঠ না করে কিভাবে তিনি শ্রেষ্ঠ আলেম হয়েছিলেন? উত্তর স্বয়ং আল্লাহ-পাকই তাঁর শিক্ষক ছিলেন।

হযরত রাছুলে করিম (দঃ) এর আবির্ভাবের পূর্বে ঐশী গ্রন্থ পাঠ ও তার চর্চা ও গবেষণা করার সমস্ত রেওয়াজ-পদ্ধতি প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও যে আল্লাহ একজন নিরক্ষর উম্মি লোককে প্রচলিত রেওয়াজ-পদ্ধতি বহির্ভূত এক পন্থায় সর্বশ্রেষ্ঠ আলেমে পরিণত করতে সক্ষম ছিলেন, সেই আল্লাহ এবং তাঁর সেই গুণ কি এখন আর অটুট নেই? তাহলে সর্বশেষ গ্রন্থধারী উম্মত যখন অতল সাগরে ডুবে ডুবে মরছে এই মুহ্যমান মানব জাতিকে উদ্ধারের জন্য এখন কি তিনি তাঁর সেই অপরিবর্তনীয় ধারায় তাঁরই এক গোলামকে প্রচলিত রেওয়াজ-পদ্ধতি বহির্ভূত এক পন্থায় আলেম বানাতে সক্ষম নন? এর উত্তরে সবাই এক বাক্যে বলবেন, “হ্যাঁ, এরূপ করতে আল্লাহ সর্বদাই সক্ষম, কিন্তু তিনি এরূপ আর করবেন না।”

এখানে আমাদের প্রশ্ন- আল্লাহ যে এরূপভাবে আর কাউকে আলেম বানাবেন না এর দলিল-প্রমাণটা কোথায়? বরং আল্লাহ-পাক পবিত্র কেরানে বলছেন, “তিনি যাকে ইচ্ছা হেকমত দান করে থাকেন, আর যাকে এই হেকমত দান করা হলো, তাকেই করা হলো উত্তম অফুরন্ত কল্যাণের অধিকারী, বস্তুতঃ জ্ঞানবান ব্যক্তিরা ব্যতীত অন্য কেউ ইহা উপলব্ধি করতে সক্ষম নয় (২ঃ২৬৯)।” আল্লাহ-পাক আরও বলেছেন, “এবং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা স্বীয় অনুগ্রহে মনোনীত করে থাকেন, এবং আল্লাহ হচ্ছেন মহাকল্যাণের অধিকারী” (২ঃ১০৫) ও (৩ঃ৭৪) এর পরও যদি কেউ বলতে চান যে, আল্লাহ আর কাউকে এরূপভাবে আলেম বানাবেন না বা এমনভাবে আর কাউকে মনোনীত করবেন না, তা হলে আমাদের জিজ্ঞাস্য, কোরান-পাকের এই আয়াত সমূহ আমরা  পাঠ করব কিসের আশায়? আমার বাপ দুনিয়ার বাদশাহ ছিলেন, ভাগ্য চক্রে আমি আজ পথের ফকির -অন্ন জুটে না। এখন যদি কেউ আমাকে দৈববাণী শোনায় যে, “তোমার বাপের বাদশাহী কিয়ামত পর্যন্ত আর কারো ভাগ্যে জুটবে না।” তা হলে এই দৈববাণী পাঠ করলেই কি আমার অন্ন জুটবে, আর বাপের বাদশাহীর কথা স্মরণ করলেই কি আমার সাফল্য ও পরিতৃপ্তি এসে যাবে? তখন কি ইচ্ছা হবে না যে, এরূপ দৈববাণী যে শোনায় তার কপালে জুতা মারি? যেখানে পরম করুণাময় আল্লাহ বলছেন, “লা তাকনাতু মের রাহমাতিল্লাহ” – আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না; তখন যদি কেউ ঐরূপ নৈরাশ্যজনক বাণী শোনায়, খোদার উপর খোদকারী করার জন্য সে-ত জুতা পেটা হবেই। আর হচ্ছেও তাই, অথচ শোধ-বোধহীন আমরা মোটেও টের পাচ্ছি না।

হযরত রাছুলে করিম (দঃ) কে আল্লাহ-পাক যেভাবে আলেম বানিয়েছিলেন, তেমনিভাবে তাঁর একজন গোলামকে আলেম বানাবেন – এ কথা মেনে নিতে আমাদের আলেম সমাজের আপত্তি কেন? এর উত্তর দেয়ার পূর্বে আরেকটা বিষয় খোলাশা করে নেয়া প্রয়োজন মনে করছি।

আচ্ছা ধরুণ, সত্য সত্যই ইমাম মাহদী (আঃ) এর আগমন হল। এখন পৃথিবীতে এমন কোন ওলী-দরবেশ, পীর-বুজুর্গ. মুহাদ্দেসীন, মুফাচ্ছেরীন, মৌলভী-মৌলানা থাকতে পারবেন কি যারা হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) এর আগমনের সংবাদ পেয়েও তাঁর হাতে বয়েত না করে বা তাঁর আনুগত্য স্বীকার না করেই হযরত রাছুলে করিম (দঃ) এর সুপারিশ ও আল্লাহর রেজামন্দী হাছেল করতে সক্ষম হবেন? এমন কেউ থাকতে পারবেন কি – তিনি যে কেউ হোন, হোন তিনি প্রখ্যাত মুহাদ্দেস, মুফাচ্ছের মুজতাহেদ, বা বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক, সাহিত্যিক বা বিখ্যাত পীর-বুজুর্গ, লক্ষ লক্ষ ভক্ত মুরীদদের তালিম-তালকীন দেনেওয়ালা বা অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য বা শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ, বুদ্ধিজীবী. আইনজীবী বা দিগবিজয়ী বীর, শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক বা ধর্মভীরু, সত্য-সাধক, পরহেজগার, মুছল্লী, মুত্তাকী বা মানব হিতৈষী, জন দরদী, দেশ প্রেমিক, শ্রেষ্ঠ দানশীল বা সৎকর্মশীল -যিনি হযরত ইমাম মাহদী(আঃ) কে অস্বীকার করবেন, অথচ আপন আপন বিচার-বুদ্ধি মত ঈমান পোষণ করে তপ-জপ,পূজা-পার্বন, দান-খয়রাত করে আল্লাহ ও তাঁর রাছুলের মহব্বত হাছেল করে পরকালে মুক্তির অধিকারী হতে পারবেন?

হযরত রাছুলে করিম (দঃ) কে অস্বীকার করে বা অমান্য করে কোন সৎকর্মশীল সাধু পুরুষই যেমন মুক্তির অধিকারী হতে পারে না, তেমনিভাবে কোন মানুষই – তিনি যত বড় সৎকর্মশীল সাধু পুরুষই হোন না কেন -হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) কে ও অস্বীকার বা অমান্য করে চলে কস্মিনকালেও আল্লাহ ও তাঁর রাছুলের মহব্বত লাভ করে মুক্তির অধিকারী হতে পারবে না। যেহেতু আল্লাহ-পাক বলেছেন, ইয়া আয়ুহাল্লাজিনা আমানু আতিউল্লাহা অ আতিউর রাছুলা ওয়ালিল আমরে মিনকুম – ওহে যারা ঈমান এনেছ শোন, তোমারা আনুগত্য কর আল্লাহর, তাঁর রাছুলের এবং (তাঁর পক্ষে নিয়োজিত) তোমাদের মধ্যস্থ (বর্তমান) আমীরের  (৪ঃ৫৯)। হযরত রাছুলে করিম (দঃ) ও বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার এতায়াত করে, নিশ্চয়ই সে আল্লাহর এতায়াত করে, যে ব্যক্তি আমার নাফরমানী করে নিশ্চয়ই সে আল্লাহর নাফরমানী করে, যে ব্যক্তি আমার আমীরের এতায়াত করে, নিশ্চয়ই সে আমার এতায়াত করে। যে ব্যক্তি আমার আমীরের নাফরমানী করে, নিশ্চয়ই সে আমার নাফরমানী করে।” (বুখারী, মোসলেম ও মেশকাত) আর হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) কে এতায়াত করা সম্বন্ধে হযরত রাছুলে করিম (দঃ) বিশেষভাবে তাগিদ করে গেছেন, যেমন তিনি বলেছেন, “আল্লাহর খলিফা মাহদীর প্রকাশ হওয়ার সংবাদ পাওয়া মাত্র তাঁর হাতে বয়েত করো, বরফের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়েও যদি যেতে হয়।” (ইবনে মাজা)

যাঁর এতায়াত করার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাছুলের এত তাগিদ-সে মহাপুরুষ সম্বন্ধে আমাদের এত অবহেলা, এত অজ্ঞতা কেন? যার আনুগত্য করা না করার উপর আমার ঈমানদার হওয়া না হওয়া নির্ভর করছে, যাঁর আনুগত্য করা না করার উপর আমার মুক্তি বা শাস্তি নির্ভর করছে, যাঁর আনুগত্য করা না করার উপর আমার “হেজবুল্লাহ” বা “হেজবুশশয়তান” হওয়া নির্ভর করছে, যাঁর আনুগত্য করা না করার উপর আমার ইজ্জত লাভ বা বেইজ্জতি হওয়া নির্ভর করছে – তাঁর প্রকাশ বা বিকাশের পথে কেন এই ধুম্রজাল সৃষ্টি করা? আর কারা এই ধূম্রজাল সৃষ্টি করছে এবং কেন করছে? তারা ত ইহুদী-নাছারা নাস্তিক বা মোশরেকদের অন্তর্ভূক্ত কেউ নয়, তারা ত অজ্ঞ-জাহেল আপামর জনসাধারণদের অন্তর্ভুক্ত কেউ নয়। এরা সেই একই ধর্ম অভিজ্ঞ ‘আবুল হেকামের’ দল যারা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লামকে প্রস্তরাঘাতে রক্তাপ্লুত করেছিল, তাঁর দন্ত মোবারক শহীদ করেছিল, তাঁকে পিতৃ ভূমি থেকে বিতাড়িত করেছিল, এরা সেই একই নমরূদ-ফেরাউন-হাম্মান-কারুণের দল, যারা হযরত ইব্রাহিম(আঃ) কে অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করেছিল, হযরত মুছা (আঃ) কে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছিল এবং হযরত ঈসা (আঃ) কে শূলে দিয়েছিল। কিন্তু তারা যুগ যুগ ধরে একই ভুলের এমন পুনরাবৃত্তি কেন করছে?

এটার উত্তর সেই একই প্রশ্ন -আজাজিল কেন হযরত আদম (আঃ) কে সেজদা করতে অস্বীকার করেছিল? তাকে ত পূর্বাহ্নেই সংবাদ দেয়া হয়েছিল, “আমি দুনিয়া জাহানে আমার খলিফা প্রেরণ করতে যাচ্ছি।” এরপর জ্ঞানের পরীক্ষায় আদমের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও আজাজিল কেন আদমকে সেজদা করতে অস্বীকার করল? কারণ ত এই ছিল যে, আদমের মূল ছিল পুতিগন্ধময় ঘৃণিত মাটির সারাংশ মাত্র। আজাজিলের চক্ষে এটা ছিল অতিশয় নগণ্য বস্তু। সুতরাং এহেন ঘৃণিত বন্তু কি ভাবে আগুনের তৈরী আজাজিলের সেজদা পেতে পারে? অন্যদিকে পুত-পবিত্র ফেরেস্তাকুল  ছিল জ্ঞান-গরিমার ধারক ও বাহক আজাজিলেরই শিষ্যবর্গ। এমন শান-শওকতের মোয়াল্লেমগিরি লাভ করে আজাজিলের পক্ষে পুতিগন্ধময় ঘৃণিত মাটির তৈরী আদমকে সেজদা করা আর কিভাবে সম্ভব? আজাজিল ত কখনো বিশ্বাস করতে পারেনি যে, তার মত এমন গুণধরকে বাদ দিয়ে পূতিগন্ধময় ঘৃণিত মাটির তৈরী আদমকেই আল্লাহ তাঁর খলিফা নিযুক্ত করতে পারেন। পূতিগন্ধময় মাটির তৈরী বলেইত আদমের প্রতি তার এত অবহেলা, এত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য! সে আর কিভাবে এই আদমকে সেজদা করতে পারে?

হযরত মোহাম্মদ (দঃ) এর প্রারম্ভও ছিল আদি পিতা আদমের মতই অতিশয় নগণ্য, হেয়, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যপূর্ণ। তাইত অজস্র সম্মান প্রতিপত্তির অধিকারী কোরেশ দলপতি ‘আবুল হেকাম’ আর কিভাবে নিঃসম্বল, মাতৃ-পিতৃহীন দুর্বল এক মোহাম্মদকে আল্লাহর খলিফা রূপে মান্য করতে পারে। মোহাম্মদকে মান্য করতে গেলে যে ভক্ত-অনুচরদের উপর তার মোয়াল্লেমগিরি আর থাকে না। তাইত সারা জীবন শয়তানী স্বভাবের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হওয়ার ফলে দুনিয়া জাহানে প্রতিষ্ঠিত আল্লাহর খলিফা ‘মোহাম্মদ আদমকে’ অস্বীকার করে লানতের তওক কণ্ঠে ধারণ করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হল। এই ‘আদম শয়তান খেল’ শুধু হযরত আদম (আঃ) এবং মোহাম্মদ (দঃ) এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গাম্বরের প্রত্যেকের সঙ্গেই এই ‘আদম-শয়তান’ খেল চলে আসছে, কেয়ামত পর্যন্ত এই ‘খেল’ চলতেই থাকবে। যার চক্ষু আছে সে দেখে নিক, যার অন্তকরণ আছে সে বুঝে নিক। আর যারা ‘আদম-শয়তান খেল’ কে একটি অতীত ঘটনা মাত্র মনে করে আদম সন্তানের জন্য প্রদত্ত আল্লাহর এই সত্য সনাতন পরীক্ষাকে বুঝতে না পারছে তাদের কাছেই আল্লাহ হন অশ্বডিম্ব, নবুওত ও রেছালাতের রহমত তাদের জন্য বয়ে আনে অভিসম্পাৎ, ওহীর কল্যাণ হয় তাদের জন্য গলার ফাঁস, ঐশী গ্রন্থ হয় কেচ্ছা-কাহিনীপূর্ণ পুঁথি-পুস্তক মাত্র, আর প্রেরিত পুরুষের আবির্ভাব হয় তাদের জন্য রোজ কিয়ামত।

সুতরাং হযরত রাছুলে করিম (দঃ) কে আল্লাহ-পাক যে ভাবে আলেম বানিয়েছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে তাঁর একজন গোলামকে আল্লাহ-পাক আলেম বানাবেন – একথা স্বীকার করে নিলে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, সেই গোলামের সাথে আল্লাহ-পাকের খাস তাকার্রব হাছেল হয়েছে, আর খাস তাকার্রব তখনই স্থিরীকৃত বা নিশ্চিত (পড়হভরৎসবফ) হতে পারে, যখন আল্লাহ-পাক স্বয়ং স্বীয় বাণী বা ওহী দ্বারা কাউকে একথা জানিয়ে দেন, কিন্তু স্পষ্ট বাণী বা ওহী প্রাপ্ত হলেই কেউ নবী হয়ে যান না, যেমন- মরিয়ম বা হযরত মুছা (আঃ) এর মা ওহী লাভ করেছিলেন, অথচ তাঁরা কেউ নবী ছিলেন না। আল্লাহর নায়েব তখনই হতে পারে যখন তিনি কাউকে তাঁর নায়াবতের দায়িত্বভার অর্পণের ওহী প্রদান করেন, এর পূর্বে নয়। আর যাকে আল্লাহ তাঁর নায়েব নিযুক্ত করেন, দুনিয়ার বুকে তাঁর নায়াবৎ প্রতিষ্ঠা করা আনুষঙ্গিক সব কিছুই যেমন- জ্ঞান-বুদ্ধি, শক্তি-সামর্থও তাকে দান করে থাকেন। এ সম্বন্ধেই আল্লাহ পাক পবিত্র মহাগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে তিনি যাকে ইচ্ছা স্বীয় রহমতে মনোনীত করে থাকেন। আর যাকে তিনি মনোনীত করেন, তাকে তিনি এমন হেকমত দান করেন যা উত্তম ও অফুরন্ত কল্যাণ ব্যতীত কিছু নয়। সুতরাং আল্লাহ-পাক অধঃপতিত মানব জাতিকে উদ্ধারের জন্য হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) কে হযরত রাছুলে করিম (দঃ) এর মতই স্বীয় কল্যাণে ভূষিত করবেন – একথা মেনে নিলে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে হযরত রাছুলে করিম (দঃ) এর পরও নবুওত ও ওহীর দরজা বন্ধ হয়নি। আর নবুওত ও ওহীর দ্বার খোলা থাকা স্বীকার করে নিলে, যারা দীর্ঘদিন ধরে এই দ্বার বন্ধ বলে প্রচার করে আসছেন তাদের অবস্থাটা কেমন হবে? তারা যে নবুওত ও রেছালাতের ভ্রান্ত ধারণার বদৌলতে এই দীর্ঘ দিনে মানবের হৃদয় সিংহাসন দৃঢ়ভাবে দখল করে নিয়েছেন, নবুওত ও রেছালতের সত্য আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই যে সেই সিংহাসনের বেহেশত খানা থেকে তাদের নেমে যেতে হবে। এই ভয়েই ত ভ্রান্ত পীর-ফকির আলেম-ওলেমার দল নবুওত ও ওহী অবতীর্ণ হওয়ার কথা শুনা মাত্র হাউ কাউ করে প্রচার করতে থাকে যে, নবুওত ও ওহীর দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।

সুতরাং নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত প্রভাব-প্রতিপত্তি, মান-সম্মানের বেহেশত খানা হারানোর ভয়ে এবং তাদের এতদিনকার শিক্ষা ও প্রচার মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়ে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়েই নবুওত ও রেছালাতের প্রবাহমানতার বিরুদ্ধে তাদের এত আপত্তি এবং এই ধূম্রজাল সৃষ্টি করা। কিন্তু সবার ভুল এক সমান নয়। তাদের কারো ভুল হয়ে থাকে অজ্ঞানতাবশতঃ আবার কারো বা ভুল হয়ে থাকে ক্ষণিকের মোহের তাড়নায়। এদের মধ্যস্থ যারা আদম-স্বভাব প্রাপ্ত, ভুল ধরা পড়া মাত্র তারা অনুতপ্ত হয়ে অতি সহজেই খালেছ দিলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে থাকে এবং তারা আল্লাহর অফুরন্ত প্রেম, ক্ষমা ও ভালবাসা লাভ করে সৌভাগ্যম-িত হয়। আর এদের মধ্যস্থ যারা শয়তান-স্বভাব প্রাপ্ত, তারা নিজেদের ভুলটাকেই সত্যরূপে টিকিয়ে রাখার জন্য শয়তানের মতই কুট্ তর্কে লিপ্ত হয়। এই শ্রেণী কখনো সত্যের জ্যোতি লাভ করতে পারে না।

নবুওত ও ওহীর দরজা উন্মুক্ত থাকা বা বন্ধ থাকা সম্বন্ধে কোরান হাদিসের সূত্র ধরে পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক তর্ক বিতর্ক করা যেতে পারে। আমরা এরূপ তর্ক বিতর্কের মোটেও পক্ষপাতী নই। কারণ, তর্ক বিতর্ক দ্বারা সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছার পরিবর্তে কেবল দলাদলি এবং শত্রুতাই সৃষ্টি হতে পারে। তবুও এ পর্যন্ত কোরান-হাদিস থেকে যত সব উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে, আমরা এরও পক্ষপাতী ছিলাম না।

সে যাহোক, আমরা আমাদের সভাপতি সাহেবের মতানুসারে বিশ্বাস করে নিয়েছি যে নবুওত ও ওহীর দরজা এখনো খোলা আছে এবং আমাদের এরূপ বিশ্বাসের উৎস হলেন স্বয়ং আল্লাহ। আর আলেম-ওলেমা বা পীর-বুজুর্গ – যারা নবুওত ও ওহীর দরজা বন্ধ বলে দাবী করছেন, তাদের দাবীর উৎস কি? তারা যদি সত্য সত্যই বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ তাদের পক্ষে আছেন, তাহলে মেহেরবাণী করে তাঁর থেকে জ্ঞাত হয়েই আমাদেরে তারা উপদেশ দিতে পারেন। রেছালাত ও ওহী বন্ধ থাকা সম্বন্ধে আল্লাহ থেকে তারা যদি কোন নির্দেশ পান এবং আমাদেরে তা জানানো হয়, তা হলে আমরা অবশ্যই আল্লাহর সেই নির্দেশ পালনে অগ্রগামী হব, যেহেতু আমরা সবাই আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্যই আদিষ্ট।

এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় যদি কেউ বলতে চান যে, আল্লাহ থেকে এরূপভাবে কোন নির্দেশ জ্ঞাত হওয়ার পথও খোলা নেই। এর উত্তরে আমরা বলব, হ্যাঁ, যারা মাটির মূর্তি বা মিথ্যা কল্পনাকে আল্লাহরূপে পূজা করে আসছেন তাদের পক্ষেই সম্ভব নয় ‘সেইরূপ কাল্পনিক আল্লাহ’ থেকে কিছু জানা। কেননা মিথ্যা কল্পনা বা মাটির মূর্তি থেকেই ওহী ও রেছালতের ধারা চিরতরে বন্ধ। এই মিথ্যা কল্পনা বা মাটির মূর্তিকে যারা আল্লাহ রূপে পূজা করে আসছে সেই মূর্তি থেকে কোন কিছু জ্ঞাত হওয়া তাদের পক্ষে আর কিভাবে সম্ভব? সুতরাং ‘কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী আসবে না’ – এরূপ সাফ জওয়াব দিয়ে দেয়াইত বুদ্ধিমানের কাজ!

সুতরাং তারা যেরূপ আল্লাহর পূজা করে আসছেন, ‘সেরূপ’ আল্লাহর পূজা করা আমাদের পক্ষে আর কি ভাবে সম্ভব? আমরা পূজা করি সেই আল্লাহরই, মোহাম্মদ, ইসা, মুছা, ইব্রাহিম (আঃ) যে আল্লাহর পূজা করতেন এবং যে আল্লাহ তাঁদের মাধ্যমে তাঁর চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী, চিরবিদ্যমান ও সর্বশক্তিমান থাকার নিদর্শন দেখিয়েছিলেন। তাই আমরা দরদভরা অন্তর দিয়ে আপনাদেরে অনুরোধ করছি, বাক ও শ্রবণ শক্তিহীন মাটির মূর্তি বা মিথ্যা কল্পনার পূজা ত্যাগ করুন। চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী সর্বশক্তিমান এক আল্লাহর পূজা করুন। কেবলমাত্র এক ও ওহেদ খোদাই আমাদের সমস্যার সমাধান এবং আমাদের জীবনের শান্তি ও মুক্তি দিতে সক্ষম। তিনি ছাড়া আর ত কেউ শান্তিদাতা ও মুক্তিদাতা নেই। আসুন, আমরা সবাই ঐকমত্য হয়ে এই আল্লাহরই সকাশ থেকে আমাদের সকল সমস্যার সমাধান প্রার্থনা করি। কেননা তিনিই হচ্ছেন উত্তম ফয়সালাকারী। মহীয়ান ও গরীয়ান আল্লাহ তাঁর পিয়ারা হাবিবের উছিলায় আমাদেরে সত্য ও সঠিক পথে পরিচালিত করুন এবং সত্যের উপর ছাবেত কদমে রাখুন! আমিন! অ আখেরে দাওয়ানা আনেল হামদুলিল্লাহে রাব্বুল আলামিন।

 

 

(দ্বিতীয় পর্ব)

 

হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) সম্বন্ধে আমাদের আলম-ওলেমাবৃন্দ-যে নেহায়েত অজ্ঞ তা মোটেও নয়। হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) সম্বন্ধে বেশ কটা ‘কিতাব’ বাজারে দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্য উল্লেখ্য হচ্ছে হযরত শাহ রফিউদ্দিন (রঃ) এর রচিত ‘আলামতে কেয়ামত’ এর অনুবাদ। একটি অনুবাদ করেছেন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, লালবাগ শাহী মসজিদের ইমাম ও খতিব বহু গ্রন্থের রচয়িতা, রেডিও বাংলাদেশের তফসীরকারক হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম। আর একটি অনুবাদ করেছেন জনাব কাজী গোলাম রহমান।

তাদের অনূদিত কিতাবে হযরত মাহদী (আঃ) এর নাম-ধাম পরিচয়, তাঁর বাপ-মা, গোত্র-বংশের পরিচয়, এমনকি তাঁর আকার-আকৃতি সম্বন্ধেও বর্ণনা রয়েছে। তিনি কোথায় কখন কিভাবে আবির্ভূত হবেন, তিনি কখন কোন মুহূর্তে কি কি করবেন, কে কে তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসবেন, কারা কখন তাঁর বিরোধিতা করবে, তাদের নাম-ধাম পরিচয় পর্যন্ত এসব কিতাবে রয়েছে। কোন সময় কোন যুদ্ধে তাঁর বিপর্যয় হবে, আবার কখন কোন যুদ্ধে তাঁর বিজয় হবে, তাঁর যোদ্ধা সংখ্যা কত হবে, তিনি কত বৎসর রাজত্ব করবেন, কতদিন জীবিত থাকবেন, কখন মারা যাবেন, এসব কিছুই আমাদের চিন্তাবিদগণ লিখে দিয়েছেন।

অর্থাৎ নাটক লেখা শেষ, মঞ্চও প্রস্তুত। এখন শুধু নায়কের আগমনের অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু নায়ক যদি আমাদের লেখা নাটকের সংলাপ ঠিক ঠিক মত আওড়াতে না পারেন? – নিশ্চয় তিনি আমাদের ‘চিন্তাবিদ পরিচালক’ সাহেবদের বিরাগভাজন হয়ে মঞ্চ থেকে আউট হয়ে যাবেন। তা নয় কি?

আল্লাহ আপনার খলিফারূপে বিশ্ববাসীর হেদায়েতের জন্য ইমাম করে পাঠাবেন যাকে সেই ইমাম কোন নামে, কোন রূপে, কোন দেশে, কোন আকারে আবির্ভূত হবেন, কোন ‘পোজে’ কি সংলাপ করবেন, কোন কোন পার্ট প্লে করবেন তার বর্ণনা দিচ্ছেন আমাদের ইসলামী চিন্তাবিদগণ। পূর্ণ নাটকটাই যখন লিখে ফেলতে পারলেন, তখন তাঁর আর প্রয়োজনটা কোথায়? এখন আপনাদেরই একজন মঞ্চে আবির্ভূত হয়ে অভিনয়টা সেরে ফেলতে বাঁধাটা কোথায়?

হযরত রাছুলে করিম (দঃ) বলেছেন, ‘আল-এলমু হেজাবু আকবর’- এলেমই হচ্ছে সবচেড়ে বড় পর্দা। আমাদের আলেম-ওলেমা পীর-বুজুর্গ, মাশায়েখগণ নিশ্চয়ই জবরদস্ত এলেমের অধিকারী। আমাদের চোখের সামনে কত ঘটনা ঘটছে, তারই বর্ণনা দিতে যেয়ে একই ঘটনার বর্ণনা হাজার জন হাজার রকমে দিচ্ছেন। তাদের বর্ণনা থেকে সঠিক-অঠিক বাছাই করা কত কঠিন বিষয়। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ কুলীন বংশে জন্ম গ্রহণ করলেন, তাঁরই জিন্দেগানীতে এক এক করে ৬৩টি জন্মদিন পার হয়ে গেল। কত ভক্ত অনুচর তাঁর পবিত্র জীবনের খুঁটি-নাটি কত কিছু হুবহু ধরে রাখলেন। তারই উপর ভিত্তি করে ছহিছেত্তা হাদিস সংকলিত হল। অথচ আজও ঐকমত্য হয়ে কেউ বর্ণনা করতে পারছেন না কোন তারিখে সেই মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল, ঠিক কত বৎসর বয়সে কোন মাসে কোন তারিখে তাঁর উপর প্রথম ওহী নাজেল হয়েছিল। চল্লিশ বৎসর বয়সে যদি তাঁর উপর ওহী নাজেল হয়ে থাকে, তাহলে প্রথম ওহী রবিউল আউয়াল মাসে না হয়ে রমজান মাসে কেন হবে, প্রভৃতি অনেক বিষয়েই আমাদের জবরদস্ত আলেম-ওলেমাদের মধ্যেই বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। এই মত পার্থক্যের কোন সুরাহা তারা করতে পারছেন না। আর ভবিষ্যতের একটি বিষয় নিয়ে তা কখন কিরূপে হবে সে সব বিষয়ে এমন নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা জবরদস্ত ‘রব’ না হলে কি সম্ভব? সুতরাং এ সমস্ত বর্ণনাকারীগণ শুধু আলেম নন তারা আজ ‘রব’ও। আপামর জনসাধারণ তাদের এ সমস্ত বর্ণনাগুলোকে সত্য আল্লাহর বর্ণনার মতই সত্য ও সঠিক বলেই বিশ্বাস করে রেখেছে। তাই জনগণের কাছে আমাদের এই চিন্তাবিদগণের স্থান কোন অংশেই ‘রব’ এর চেয়ে কম নয়। এ সমস্ত রবদের পরিচয় জানতে হলে ‘শতাব্দীর সূর্য’ পত্রিকার এপ্রিল/মে’ ১৯৮১ সংখ্যা পাঠ করতে অনুরোধ করছি। হযরত রাছুলে করিম (দঃ) স্বয়ং বলেছেন যে, আমি ভবিষ্যত জানিনে। এমন কি সম্মুখস্থ দেওয়ালের অপরদিকে কি তাও আমি জানিনে, তবে আল্লাহ যে বিষয়ে অবগতি দান করেন, তার অতিরিক্ত আমি জ্ঞাত নই। তা হলে আমাদের আলেম-ওলেমাবৃন্দ কিরূপে হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) সম্বন্ধে এত কিছু লিখে ফেলতে পারলেন?

এখানে হয়ত বলতে পারেন যে, উল্লিখিত গ্রন্থে নতুন করে কিছু বলা হয়নি। যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে তা বরং বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করেই লেখা হয়েছে। হাদিস গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া নিশ্চয় দোষের কিছু নয়। এর উত্তরে আমরা বলতে চাই যে, হাদিসের বরাত দিয়ে এ সমস্ত বর্ণনা করার উদ্দেশ্যটা কি? উদ্দেশ্য ত জনগণকে জ্ঞান দান করা, তা নয় কি?

আপনাদের উদ্দেশ্যটা মহৎ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে আমাদের বিশ্বাস, হাদিসের বরাত দিয়ে আপনারা যা বর্ণনা করেছেন, তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বুঝে-শুনেই বর্ণনা করেছেন, তা নয় কি?

মাপ্ করবেন, আমি একজন নেহায়েত অজ্ঞ। তাই আপনাদের অনেক উদ্ধৃতিরই তাৎপর্য ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বুঝে উঠতে পারিনি। তাই আপনাদের কাছে জানতে চাচ্ছি মাত্র। মেহেরবানী করে যদি ‘এই জাহেলের’ কোন বেয়াদবী না ধরেন, তাহলে জিজ্ঞাসা করতে চাই, হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) এর হাতে বয়েত নেয়ার সময় যে “হাজা খলিফাতুল্লাহ” বলে “আসমানী শব্দটি” আসবে বলে আপনাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন, এ শব্দটির উৎস কি? অর্থাৎ এ শব্দটি কে করবেন? এ শব্দটি কি কোন জ্বীন-পরী, দেও-দানব বা কোন মানবের কণ্ঠ থেকে উৎসারিত হবে, না কোন ফেরেস্তার কণ্ঠ থেকে, না শয়তানের কণ্ঠ থেকে আসবে, না নিছক হাওয়া থেকে আসবে, না স্বয়ং আল্লাহর সকাশ থেকে আসবে? স্বয়ং আল্লাহর সকাশ থেকে না আসলে, এরূপ আসমানী শব্দের কোন মূল্য আছে কি? ধরে নিলাম, এই আসমানী শব্দটি আল্লাহর সকাশ থেকেই আসবে। তা হলে মেহেরবানী করে বলুন, মানুষের কাছে আল্লাহর সকাশ থেকে বাণী আসার পথটি কি? এবং পবিত্র কোরানে এ সম্বন্ধে কি উল্লেখ আছে? এই অধম জাহেলের যতটুকু জানা আছে তা এই যে, পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলেছেন, “ওহী ব্যতীত আল্লাহ নশ্বর মানবের সাথে কথা বলেন না, অথবা পর্দার পশ্চাৎ হতে অথবা তিনি রাছুল প্রেরণ করেন এবং তিনি যা ইচ্ছা করেন তা তার উপর অবতীর্ণ করেন। নিশ্চয়ই তিনি মহান ও মহাজ্ঞানী।” (৪২ঃ৫১) তা হলে উল্লিখিত আসমানী শব্দটাকে ওহী বলে ধরে নিতে পারি কি? কিন্তু একই সঙ্গে একাধিক ব্যক্তির উপর ওহী অবতীর্ণ হওয়ার নজির এই অধম জাহেলের জানা নেই। তা হলে এটা কোন ধরণের ওহী এবং এর গূঢ় তাৎপর্যটি কি, তা আপনাদের কাছ থেকে জানতে পারলে বাধিত হব।

উক্ত গ্রন্থে আরও উল্লেখ আছে, হযরত ইসা(আঃ) দু’জন ফেরেস্তার কাঁধে ভর করে দামেস্কের মসজিদের মিনারের উপর নামবেন। এই দু’জন ফেরেস্তার কাঁধে ভর করে ইছা(আঃ) এর অবতরণ কারা দর্শন করবেন? এর দর্শকবৃন্দ কি ফেরেস্তাদেরকে দেখতে পাবেন? যদি কেউ দর্শন করতেই না পারবেন, তা হলে আমরা কিভাবে বুঝব যে, তিনি দু’জন ফেরেস্তার কাঁধে ভর করে অবতরণ করেছেন? আরও উল্লেখ আছে, ইছা (আঃ) এর পুনরাগমনের পর তাঁর উপর ওহী অবতীর্ণ হবে। কিন্তু কিরূপে? আপনাদের কিতাবের প্রথম পৃষ্ঠায়ই না উল্লেখ করেছেন যে নবুওত, রেছালাত, ওহী ও আসমানী খবর অবতীর্ণ হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে? তা হলে আবার কিভাবে হযরত মাহদী (আঃ) এর সময় ‘আসমানী শব্দ’ এবং হযরত ইছা(আঃ) এর উপর ওহী অবতীর্ণ হবে? আর নবুওত ও রেছালতের পথ বন্ধ থাকলে ইছা (আঃ) আবার কিভাবে আসবেন?

তাছাড়া উক্ত গ্রন্থে এমন আরো অনেক বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে যা এ অধম জাহেলের দৃষ্টিতে স্ববিরোধী ও বিভ্রান্তিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। দাজ্জাল ও ইয়াজুজ মাজুজ সম্বন্ধেও যে সমস্ত বর্ণনা রয়েছে, সে গুলোতেও আমার বুঝের অগম্য অনেক কিছুই রয়েছে। এখানে সে সমস্তের বর্ণনা করতে গেলে এ লেখা অনেক লম্বা হয়ে যাবে। তাই পাঠকদের বিরক্তি উৎপাদন না করে এখানেই শেষ করতে চাচ্ছি। তবে শেষ করার পূর্বে আমরা আপনাদের লেখা বই পুস্তকগুলির বহুল সংশোধনেরই প্রস্তাব দিতাম। কিন্তু দেখলাম, আপনাদের বই পুস্তকগুলির অবস্থা ঠিক ‘লোম্বার’ তৈরী কম্বলের মত। কম্বলের ‘লোম্বা’ বাছলে যেমন কম্বল থাকে না, তেমনি আপনাদের এই সমস্ত বইয়ের সংশোধন করতে গেলে আর বই থাকবে না। তা হলে আর কি করা যায়? যা করা হয়ে গেছে তা ত আর কখনো ফিরিয়ে আনা যাবে না। সুতরাং এ ব্যাপারে আর অধিক অগ্রসর না হয়ে এ পর্যন্তই উক্ত কাজের সমাপ্তি টেনে আসুন আমরা আমাদের কৃত ভুলের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। নিশ্চয়ই আল্লাহ গাফুরুর রাহিম। তিনি বান্দাদের ভুলের জন্য শাস্তি প্রদান করেন না যদি না কেউ ভুল জানার পরও ভুলের উপর আড় করে থাকে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্য ও সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমিন!a