পরম দয়াময় ও করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করছি

পথের দিশা

সমস্ত প্রশংসা ও পবিত্রতা একমাত্র আল্লাহর যিনি আমাকে অনস্তিত্বের নিঃসীম অন্ধকার থেকে অস্তিত্বের আলো দেখার সৌভাগ্য দান করেছেন। এর পর দরুদ ও সালাম আখেরী নবী মোহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অছাল্লামের উপর যাঁর অছিলায় সমগ্র সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করেছে। আমার মা বাপ কোরবান হোক আমার পীর ও মোর্শেদের চরণ তলে যাঁর বদৌলতে মহান আল্লাহ আমার মত এক পাপী গোনাহগারকে সত্য পথের সন্ধান দিয়েছেন। আমি শয়তানের প্ররোচনা ও প্রবঞ্চনা হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। পরম দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে আমার আদিষ্ট বিষয়টি বর্ণনা করতে ইচ্ছা করছি। আমি জানি, কোন কিছু করা বা প্রকাশ করার কোন ক্ষমতা আমার নেই। তাই আমি আল্লাহর দিকে মোতাওয়াজ্জিহ হচ্ছি এবং বক্তব্য বিষয়টি যথাযথভাবে প্রকাশার্থে কায়মনোবাক্যে তাঁরই দয়া ও সাহায্য প্রার্থনা করছি। আল্লাহুম্মা আমিন!

কোন এক সময়ে আমার মোর্শেদ সাহেব বলেছিলেন, “সাপের বিষে যে জর্জরিত সে কি পিঁপড়ার বা ভোলতার হুলের ব্যাথা কিছুমাত্র অনুভব করতে পারে? যে মৃত্যু যাতনায় কাতর সে আবার কোন বিয়োগ ব্যাথায় অধিকতর কাতর হতে পারে? যে কিয়ামতকে বিশ্বাস করে  নিয়েছে সে আবার কোন বিভীষিকার ভয়ে ভীত হতে পারে? ……..” একবার অতি শৈশবে এক শীতের সকালে সূর্যোদয় লক্ষ্য করছিলাম। হঠাৎ করে খেয়াল হল, একদিন এই সূর্য আর উঠবে না, পৃথিবীতে কোন জনপ্রাণী থাকবে না, আমি একাকী হয়ে পড়ব। এরূপ খেয়াল হতেই আমি খুব ভীত হয়ে পড়ি। দৌড়িয়ে যেয়ে মাকে বললাম, “মা আমার যেন কেমন ভয় ভয় লাগছে।” মা আমাকে কোলে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। মাকে আমার ভয়ের কারণ কিছুই বলতে পারিনি। এরপর রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে গেলেই ঐ কথা জাগত, একদিন সূর্য আর উঠবে না, দুনিয়াতে কোন জনপ্রাণী থাকবে না। জনপ্রাণী শূন্য এই পৃথিবীতে আমি একা কি ভাবে থাকব! এরূপ খেয়াল হতেই আমি খুব ভীত হয়ে পড়তাম। মাকে শুধু বলতাম, মা, আমার খুব ভয় লাগছে। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, আল্লাহ, আল্লাহ কর। তখন আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তাম। সুতরাং প্রলয় বিভীষিকার যে বীজ অতি শৈশবেই মনে উপ্ত হয়েছিল, তারই প্রভাবে পরবর্তীকালে কোন ঝড়-ঝাপটাই গায়ে তেমন লাগেনি। প্রসঙ্গক্রমে, এক হাটে আমি আমার মোর্শেদ সাহেবের এক হুকুমের বরখেলাফ করে বেয়াদবী করে বসি। সেজন্য হাটের মধ্যেই তিনি আমার দু’কান মলে দিয়ে গালে পিঠে ভীষণভাবে চড় থাপ্পর মারতে থাকেন। আমি তাঁর দু পা জড়িয়ে ধরে মাফ চাইতে থাকি। দিনের শেষে দু’জনে এক সঙ্গে খেতে বসেছি। তিনি আমার থালা দূরে ঠেলে দিয়ে তাঁরই থালে একত্র বসে খাওয়ার জন্য আমাকে ডাকলেন। আমি খেতে লাগলাম। তিনি বললেন, আপনার ঘৃণা পিত্তি বলতে কি কিছু নেই? আমি বললাম, আমার বলতে আর কি আছে? তাঁর দু’গ- বেয়ে অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়ল। দু’বাহু দিয়ে আমাকে বক্ষে জড়িয়ে ধরলেন। আমি ত সর্বদা ভীত সন্ত্রস্থ ছিলাম এই ভেবে যে কেমন করে আমার দ্বারা এমন বেয়াদবী হল। আমার এই বেয়াদবী তিনি মাফ করবেন কি না! অথচ আমার এই বেয়াদবী, আমার এই সদা ভীত ও সন্ত্রস্থ ভাবের বিনিময় মহান আল্লাহ কতই না উত্তমভাবে দান করলেন! আমি ভয় করছিলাম, তিনি আমার অপরাধ মাফ করবেন কি না, সে স্থলে তিনি আমাকে তাঁর বক্ষে স্থান দিলেন! এখানেই মনে পড়ে হযরত রছুলে মকবুল(দঃ) র হাদীস, “যার মুঠায় আমার জীবন, তাঁর শপথ! যদি তোমরা এমন হও যে পাপ তোমাদের হবেই না, তা হলে খোদা তোমাদেরে পৃথিবী হতে সরিয়ে দিয়ে তোমাদের স্থলে এমন এক জাতি প্রেরণ করবেন যারা পাপ করবে এবং খোদার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করতে থাকবে” [মোসলেম]। এই সত্যটিকে বুজুর্গানে দ্বীন এইভাবে ব্যক্ত করেছেন, ‘পাপীদের কাকুতি-মিনতি খোদার কাছে ভক্তদের তপস্যা হতেও প্রিয়।’ আমার উক্ত বেয়াদবীর কথা আমার মোর্শেদ সাহেব প্রায়ই মজলিশে উত্থাপন করে থাকেন। মোর্শেদ সাহেবের পবিত্র জবানে গোলামের বেয়াদবীর এমন প্রশংসা অবশ্যই আপাতঃ বেমানান; কিন্তু তখনই মনে পড়ে এ হাদিস, ‘যারা আল্লাহকে গোপনে স্মরণ করে, আল্লাহ ও তাদেরে গোপনে স্মরণ করেন; আর যারা আল্লাহকে প্রকাশ্য মজলিশে স্মরণ করে আল্লাহও তাদেরে তাদের চেয়েও উত্তম মজলিশে উল্লেখ করেন। …..’ আমি এক অতি না’লায়েক পাপী বান্দা। অথচ আল্লাহ এত উচ্চ ও এত মহান যে আমার ন্যায় ক্ষুদ্র কীটানুকীটের বেয়াদবীপূর্ণ একটি কাজকেও তিনি কত বড় প্রশংসাপূর্ণ কাজে পরিবর্তন করে মজলিশের মধ্যে প্রকাশ করে দিচ্ছেন! আল্লাহর কালাম, ‘ফাউলায়েকা ইয়ু বাদ্দেলুল্লাহু সাইয়্যেআতিহিম হাসানাত’ – অর্থাৎ এরাই ত সেই দল যাদের অন্যায় অপকর্ম আল্লাহ পূণ্য কাজে বদলে দেবেন” -কতইনা সত্য! আমার এ লেখাকে অনেকে হয়ত নির্লজ্জ আত্মপ্রচারূপে মনে করতে পারেন। কিন্তু আমি এটাকে এক নগণ্য বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত বা পুরষ্কার রূপে গণ্য করছি এবং এ ঘটনা প্রকাশের মাধ্যমে আমি তাঁর অসীম রহমতের কণা পরিমাণ শোকরিয়া আদায় করছি। যদি আমি ইহা প্রকাশ না করি, আমার ভয় হয়, না জানি তাঁর অকৃতজ্ঞ বান্দা রূপে পরিচিত হয়ে যাই। সে যাহোক, আমার মোর্শেদ সাহেব একদিন বলেছিলেন, “বীজ ধান অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঘরে রেখে দিলে একদিন এই ধান আপনা-আপনি নষ্ট হয়ে যাবে, আর না হয় পোঁকা মাকড়, পশু পাখী, কীট পতঙ্গে খেয়ে ফেলবে, তখন আর তা থেকে কোন ফসল পাওয়া যাবে না। বীজ-ধানের শাঁস ভাল থাকতেই তাকে মাটির নীচে কবর দিতে হয়। এক নির্দিষ্ট সময় কবরে থাকলে তাতে চারাগাছ হয়। যখন গাছ হয়ে যায় তখন বীজকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বীজ ধানটি আপনাকে সম্পূর্ণ ভাবে বিলীন করে দেয় বলেই একটি বীজ ধান কয়েকটি গাছে রূপান্তরিত হতে পারে এবং এক একটি গাছে শত শত ধান হয়। এমনিভাবে একটি ধান হাজার ধানে পরিণত হয়। কিন্তু বীজ ধানটি যদি আপন সত্ত্বাকে লয় হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইত তা’ হলে একটি ধানগাছও জন্ম হত না, শত শত ধানও উৎপন্ন হত না। পক্ষান্তরে, বীজ ধানটি আপন সত্ত্বাকে যতই টিকিয়ে রাখতে চাউক না কেন, ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, একদিন তার সত্ত্বা লয় হয়ে যাবেই। তা হলে এটাইত বুদ্ধিমানের কাজ যে, যে সত্ত্বা একদিন বিলীন হয়েই যাবে তাকে খালি খালি বিলীন হতে না দিয়ে হাজার ধানের মধ্যে বেঁচে থাকা। আমরা মানুষ। একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমি কিছু করি বা না করি চিরদিন আমি এ পৃথিবীতে থাকব না। সুতরাং আমাদের যখন একদিন চলেই যেতে হবে, তখন এমনি ভাবেই যাওয়া দরকার যেন আমার মধ্যে হাজার মানুষের জন্ম দিয়ে যেতে পারি। তখন আমি মরেও আর মরতে পারব না। তখনই আমার অমরত্ব লাভ হবে। আর এটা তখনই হতে পারে যখন আমি আমার জীবন থাকতেই মরতে পারি। জীবন থাকতে আবার কিভাবে মরা যায়? হ্যাঁ, জীবন থাকতে মরার অর্থ হলো আল্লাহর হুকুমের সম্মুখে ‘ফানি’ হয়ে যাওয়া। আমার মোর্শেদের এই অমূল্য শিক্ষা আমার এ নগণ্য লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করে যদি কোন একটি লোককেও জীবন দান করতে পারি, তা’হলে আমি যে তার মাঝে বেঁচে থাকতে পারব। এই আশাতেই আমাকে এক আধটু ‘আত্ম-প্রচার’ করতে হচ্ছে। এরূপ ‘আত্ম-প্রচারকে’ যদি কেউ অপরাধ বলে মনে করেন, তা হলে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা ছাড়া আর কি-ই-বা করতে পারি। আর আমি যদি অপরাধই না করব আল্লাহর কাছে মাফই বা চাইব কেন, আর তিনি ক্ষমাই বা করবেন কাকে, তাঁর ‘রাহমানুর-রাহিম’ নামই বা সার্থক হবে কিভাবে? আর আমি তাঁর প্রেম-ক্ষমা-ভালবাসাই বা বুঝব কি করে? সে যাহোক, স্বভাবতই এখানে আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগে, যার সহবতে গেলে এমনি ধরণের শিক্ষা এবং তালিমই পাওয়া যায়, তাঁকে গোমরাহ, বেদাতী, ইসলামদ্রোহী বলা কি ইনসাফের কাজ? যারা এরূপ করেছেন তারা কারা? তারা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের কেউ নন। অজ্ঞ-মূর্খ-জাহেলদের অন্তর্ভুক্ত কেউ নন। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কোন প-িত দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক বা রাজনিতিক নন। তবে তারা কারা? তা হলে শুনুন একটি ঘটনা। আমার মোর্শেদের বাড়ির কাছেই একটি মাদ্রাসা। মাদ্রাসার বড় মৌলানা সাহেব (সুপারিন্টে-েন্ট) আমাকে বড় ভালবাসতেন। তিনিই আমাকে এক স্কুলের শিক্ষকতা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার মাদ্রাসায় এনে নিয়োগ করেন। নানাভাবে আমার খ্বু প্রশংসাও করতে থাকেন। থাকা-খাওয়ার জন্য খুব ভাল দেখে একটি জায়গির ঠিক করে দেন। আমার মোর্শেদের সাথে তখনও পরিচয় হয়নি। একদিন লজিং বাড়িতে বসে আছি। তারপর নামাজের সময় হলে আযান দিয়ে নামাজ পড়ি। আমার সঙ্গে একজন আগন্তুক নামাজ পড়লেন। নামাজের শেষে আগন্তুক বললেন, “আপনাকে একটা কথা বলতে পারি কি?” আমি বললাম, কি কথা? বলুন।

আগন্তুক:      আমার লেখা একটি কিতাব আছে। মেহেরবানী করে যদি পড়ে দেখতেন?

আমি বললাম:       আমার ত বিদ্যে বুদ্ধি বেশী কিছু নেই। আমি আর কতটুকু দেখতে পারব? ঠিক আছে, যদি আপনি দেখাতে চান, দেবেন।

আগন্তুক:     কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।

আমি বললাম:       কিসের শর্ত?

আগন্তুক:      এ কিতাব পড়ার পর যদি কোথাও কোন ভুল-ভ্রান্তি দেখেন, আমাকে তা’ বলতে হবে। আর যদি সব ঠিক-ঠাক মতই পান, তা হলে তা সমর্থন করতে হবে।

আমি বললাম:       আমি আপনার কিতাব পড়ব। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যদি কোথাও ভুল দেখি, অবশ্যই আমি ভুলই বলব। যদি সারা দুনিয়ার সমস্ত মানুষও তাকে শুদ্ধ বলে, আমি তাকে ভুলই বলব। আর যদি আমি তা’ ঠিকই দেখি তা হলে সারা দুনিয়ার মানুষও এটাকে অঠিক বলে, আমি এটাকে ঠিকই বলব। আমার এ কথা শুনে তিনি খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তারপর বললেন, আমি অমন একটি লোকই চাই। আমি বললাম, আমিও এমন একটি লোক চাই। এরপর তিনি বললেন, আরও একটি শর্ত আছে। আপনি যদি এটাকে ঠিকঠাক মতই পান, আর এটাকে সমর্থন করেন, তা’হলে আপনার উপর কঠিন বিপদ চাপতে পারে। তখন কিন্তু আমাকে দোষারূপ করতে পারবেন না। আমি বললাম, কি রকম?

আগন্তুক:     আপনার মাদ্রাসার সকল শিক্ষকবৃন্দ ও আলেম-ওলেমাবৃন্দ আমার বিরোধী। আপনি এটাকে সমর্থন করলে, আপনার চাকরির উপর হামলা আসতে পারে।

তাঁর কথা শুনে আমার আরও একটু কৌতুহল জাগল এবং তাঁর লেখা কিতাব খানা পড়ার জন্য আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ি। আমি বললাম, ইনশাল্লাহ, আমি আপনার কিতাব পড়ব। আমাকে আগে পড়তে দিন। তিনি কিতাব পড়তে দিলেন। সবটা একবারে নয়। চৌষট্টি পাতার চার নম্বর এক্সারসাইজ বুকে পাঁচ খ-ে লেখা “মানব জাতির মুক্তির সন্ধান”। এক এক করে সব কয়টি খ- শেষ করলাম। ইসলামের পাঁচটি মূল বিষয়, আক্বিদা, আমল, মোয়ামালাত, মোয়াশারাত ও আখলাক সম্বন্ধে প্রাঞ্জল কথ্য ভাষায় লেখা। জায়গায় জায়গায় বানান ভুল ও সাধু চলিত ভাষার সংমিশ্রণ রয়েছে। প-িত ব্যক্তিদের কাছে এরকম ভুল সাঙ্ঘাতিক ভুল হিসাবেই ধর্তব্য। কিন্তু আমি কোন প-িত নই, আমার জন্য সাপে বর হল। আমি তাঁর সহজ সরল প্রকৃতির প্রতি আরও বেশী করে আকৃষ্ট হলাম। পড়া শেষ করার পর গিয়ে বললাম, আপনার কিতাবের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। কোন ভুল ভ্রান্তি আমার চোখে ধরা পড়েনি। অধিকন্তু, আপনার কিতাবে যে আহ্বান রয়েছে, সে আহ্বানে সাড়া দিতে প্রস্তুত। এখন বলুন আমাকে কি করতে হবে? তিনি বললেন, খুব ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করে দেখুন। এতে অনেক বিপদ আপদ আসতে পারে। সুতরাং আপনি আরও চিন্তা করুন।

আমি বললাম, আমি সর্বোতভাবে প্রস্তুত হয়েই এসেছি। আমাকে আপনি ‘বয়েত’ করুন। তিনি বললেন, চিন্তা-ভাবনা করে দেখার জন্য আপনাকে আরও এক সপ্তাহের সময় দেয়া হল। এ সময়ের মধ্যে আপনি ‘এস্তেখারা’ও করতে পারেন। এর পর যদি আপনার মন এদিকে ঝুঁকে, তখনই আসবেন।

এক সপ্তাহ পরে গিয়ে বললাম, আমি খুব গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি। আমার মন আল্লা-পাক এদিকেই ঝুঁকে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি আমাকে ‘বয়েত’ করুন। আল্লাহর রহমত হল। তিনি আমাকে বয়েত করলেন। এর কিছুদিন পর রমজানের ছুটিতে মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেল। সকল মোদার্রেসীনদের কাছ থেকে বিদায়  নিলাম। ঠিক করেছিলাম ছুটিতে বাড়ীতে থাকব। তারা সবাই তা জানতেন। সুপারিনটে-েন্ট সাহেবও বিদায় দিলেন। বাড়ীতে এসেই খেয়াল হল, দীর্ঘ ছুটি, বাড়ীতে বসে কি করব? বরং হুজুর কেবলা সাহেবের সহবতে থাকতে পারলে ছুটিটা যথাযথভাবে কাটবে। এরূপ মনে করেই হুজুর কেবলার কাছে চলে এলাম। তিনি থাকার অনুমতি দিলেন। তারপর হুজুর কেবলার অনুমতি নিয়ে দেখতে গেলাম বড় মৌলানা সাহেবকে। তিনি আমাকে দেখতে পেয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার? আপনি না রমজানে বাড়ীতে থাকবেন বলেছিলেন?

আমার উত্তর:         হ্যাঁ, বাড়িতে গিয়েছিলাম।

মৌলানা সাহেব:    চলে এসেছেন, এখন থাকবেন কোথায়? লজিং  বাড়িতে? (তিনি হয়ত ভাবছিলেন, তার বাড়িতেই থাকার আবদার করে বসি কি না!)

আমার উত্তর:         না, থাকব রামনাথপুর।

মৌলানা সাহেব:    রামনাথপুর? সেখানে কার বাড়িতে?

আমার উত্তর:         জনাব বরকত উল্লাহ খানের বাড়িতে।

মৌলানা সাহেব:    বরকতউল্লাহ মুন্সীর বাড়ীতে? সেখানে কি? আপনি কি তাঁর কিতাব দেখেছেন?

আমার উত্তর:         হ্যাঁ, দেখেছি।

মৌলানা সাহেব:    তা সমর্থন করেছেন?

আমার উত্তর:         হ্যাঁ, করেছি।

মৌলানা সাহেব:    তার কাছে বয়েত হয়েছেন।

আমার উত্তর:         হ্যাঁ, হয়েছি। আমার এ উত্তর শুনে মৌলানা সাহেবের শরীর ক্রোধে কাঁপতে লাগল। চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরুচ্ছিল। তার অবস্থা দেখে আমি বললাম, কেন কি হয়েছে?

মৌলানা সাহেব:    কেন, কি হয়েছে? আমি মনে করেছিলাম, আপনি একজন বুদ্ধিমান লোক। আপনি আমাদের সাথে কোন পরামর্শ না করেই তাঁর কাছে গেলেন, তার কিতাব পড়লেন, তার হাতে বয়েত হলেন?

আমার উত্তর:         কেন, এতে দোষটা কোথায়?

মৌলানা সাহেব:    আপনি একটা অজ্ঞ মূর্খ। বরকত উল্লাহ একটি জাহেল, আপনি একটা জাহেলের পিছনে পড়েছেন? সে একটা মোনাফেক। সে মানুষকে গোমরাহ করছে।

আমার উত্তর:         হুজুর! আমি ত যাহোক কিছু একটা লেখা-পড়া জানি। আমি যখন তাঁর কোন মোনাফেকি, গোমরাহি ধরতে পারলাম না, সে আরও লোককে গোমরাহ করবে। বরং আপনি চলুন, আপনি কেবল দেখিয়ে দেবেন কোথায় তার গোমরাহি। আমি তাঁকে কতল করব। জেল হয় ফাঁস হয় আমার হবে। আপনার কিছু হবে না। গোমরাহির পথ চিরতরে বন্ধ করে দেব।

মৌলানা সাহেব:    সে যা’ মনে লয় তাই থাক। ভাল থাকলে ভালই আছে, মন্দ থাকলে মন্দই। আমরা সকল আলেম তাঁর বিরোধী। আমরা তাকে ভাল জানি না। মাদ্রাসায় থাকতে হলে, সে পথ ছাড়তে হবে। আর সেখানে গেলে মাদ্রাসা ছাড়তে হবে।

এখন বলুন, মৌলানা সাহেবের এই কথায় কি প্রমাণ হয়? এটা কি ইনসাফের কথা হল, না ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী হল? সে যাহোক, রমজানের ছুটির পর যথারীতি মাদ্রাসার কাজ করে যেতে লাগলাম। সকল মোদার্রেসীন আমাকে নানাভাবে বুঝাতে লাগলেন, পীর যদি ধরতে হয়, আমাদের বলুন, এমন পীর দেখিয়ে দিব যেন আপনি এরোপ্লেনে চড়ে মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছতে পারেন; বরকত উল্লাহর ন্যায় অমন গরুর গাড়িতে চড়ে কি লাভ? এমন আরও কত শতভাবে আমাকে বুঝাতে লাগলেন। কিন্তু আমাকে অনড় দেখে চাকরির হুমকী দেখাতে লাগলেন। দুর্দিনে চাকরি ছাড়া আমি কিভাবে চলব! এ ভয়ও ত কম নয়। কিন্তু যে ভয় আল্লা-পাক অতি শৈশবেই দেখিয়ে রেখেছেন, যেমন প্রথম দিকেই উল্লেখ করেছি, সে ভয়ের  সামনে শিক্ষকতার চাকরি হারানোর ভয় কি একটা ভয়? চাকরি হারানোর হুমকি দিয়েও যখন আমাকে ঘুরাতে পারলেন না, তখন একদিন মাদ্রাসার অফিস কক্ষে সমস্ত শিক্ষকবৃন্দ একত্র হয়ে আমাকে নানাভাবে বুঝ পরামর্শ দিতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে শেষ পর্যন্ত মাদ্রাসার চাকরি থেকে আমাকে বরখাস্ত করে মাদ্রাসার বার করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে লজিংও ছেড়ে দিতে বললেন। লজিংও ছেড়ে দিলাম। বাধ্য হয়ে তখন মোর্শেদ কেবলার আস্তানাই আমাকে ঠাঁই করে নিতে হল। এখানে আরও একটা বিষয় উল্লেখ না করলে আল্লা-পাকের না-শুকরিয়া হয়ে যাবে। তা’ এই যে, শিক্ষকতা করা কালে আমি ছিলাম কেবলমাত্র মেট্রিক পাস। পরবর্তীকালে আমার মোর্শেদ কেবলার দোয়ার বরকতে বি.এ, ও ই.পি.সি.এস পাশ করা এবং বিভিন্ন দপ্তরে কাজ করার সুযোগ হয়। এখানে এ দীর্ঘ ঘটনা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য এই যে সমগ্র মুসলিম জাহানের ইসলাম সম্বন্ধে শিক্ষা-দীক্ষার পাদপীঠ হল এই মাদ্রাসা। ইসলামের পুনঃ জাগরণের জন্য মুসলিম জাহান স্বভাবতঃই একাগ্র চিত্তে তাকিয়ে আছে এই মাদ্রাসারই দিকে। অথচ সেই মাদ্রাসার অবস্থা এই। তা হলে তাদের পুনঃজাগরণের উপায় কি? আল্লাহ এবং তার রছুল(দঃ) কোথাও বলেছেন না কি, ইসলামের অধঃপতনের সময় এই মাদ্রাসাগুলোই তাদের পতন থেকে উদ্ধার করবে? এরূপ নির্দেশ কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। বরং আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু জানি তা এইঃ হজরত রছুলে মকবুল(দঃ)র আবির্ভাবের পূর্বেও তৌরাত, ইঞ্জিল, তালমুদ শিক্ষার জন্য বহু শিক্ষাগার ছিল। বড় বড় কিতাবের বহু বাহক তখনও বিদ্যমান ছিল। এই কিতাবের বাহকদেরকেই লক্ষ্য করে আল্লাহ-পাক বলেছেন ঃ মাছালুল্লাজিনা হুম্মেলুত তাওরাতা ছুম্মালাম ইয়াহ্ মিলুহা কামাছালিল হিমারি ইয়াহ্মেলু আসফারা। অর্থাৎ ‘যারা তৌরাত কিতাবের বাহক তাদের তুলনা করেছেন গর্দভের সঙ্গে। সে শুধু কিতাবের বোঝাই বহন করছে, কিন্তু কি বহন করছে সে তা মোটেও জানে না।’ আহলে কিতাবীদের অবস্থা যদি এরূপই না হবে, তা হলে মোহাম্মদ (দঃ)র আবির্ভাবের কি প্রয়োজন ছিল? আর মুসলমানদের মাদ্রাসা ও তাদের আলেমবৃন্দ যদি ঠিকই থাকবে তা’হলে রছুল মকবুল(দঃ) কে কেন এ কথা বলতে হবে -“ইন্নাল্লাহা ইয়াবয়াছু লেহাজিহিল উম্মাতা আলা রাসি কুল্লে মেয়াতে সিনাতেম মাইয়্যুজাদ্দেদু লাহা দিনাহা- অর্থাৎ এই উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শিরোভাগে নিশ্চয় আল্লাহ এক একজন মোজাদ্দেদ পাঠাবেন বিকার গ্রস্থ ইসলামের সংস্কারের জন্য।” মাদ্রাসা ও আলেম ওলেমাগণই যদি বিকারগ্রস্থ ইসলামের সংস্কারের জন্য যথেষ্ট হত, তা’ হলে আল্লাহকে বলতে হত না, “ইন্না নাহনু নাজ্জালনাজিকরা অ ইন্না লাহুলা হাফেজুন” – অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমিই ইহা (ইসলাম) প্রেরণ করেছি এবং আমিই ইহা রক্ষণাবেক্ষণ করব।” আল্লাহ বা তাঁর রছুল (দঃ) কখনও একথা বলেন নাই যে মাদ্রাসা এবং শিক্ষকবৃন্দই অধঃপতিত ইসলামকে পুনর্জীবিত করবে বা ইসলামের সংস্কার করবে। সুতরাং আল্লাহর পবিত্র কালাম ও রছুল করিম (দঃ) র পবিত্র বাণীকে উপেক্ষা করে আমরা যদি এখনও গর্দভের সঙ্গে তুলনীয় আ’হলে কিতাবীদের’ দিকেই পথ চেয়ে থাকি তা’হলে চেয়ে থাকাই সার হবে, পথের দিশা কোনদিনই মিলবে না। অধিকন্তু চেঙ্গীস খান, হালাকু খানদের ন্যায় দাজ্জাল ও ইয়াজুজ মাজুজদের চাবুকের কশাঘাত থেকে পিঠের খাল-বাকল রক্ষা করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। সুতরাং সময় খুব সংকীর্ণ, তাড়াতাড়ি ফিরুন, পথের দিশা লউন।

পথের দিশা সম্বন্ধে বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতি যে পরিকল্পনা পেশ করেছে তা’ অতি সুস্পষ্ট ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। সে সম্বন্ধে এখানে তাই কিছু কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।

 

পথের দিশা – (২)

 

বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতির একটি প্রস্তাব, ‘সমিতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়িত করার জন্য সর্বসাধারণের সহযোগিতায় বিশ্বের সকল ধর্ম ও মতের প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান প্রধান ব্যক্তিবর্গকে একত্র সমাবেশ করতঃ এক মহাসম্মেলনের ব্যবস্থা করা এই সমিতির প্রধান কর্ম (সংবিধানের ‘খ’ বিভাগের পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদ)। প্রশ্ন উঠেছে এটা কি করে সম্ভব যে বিশ্বের সমস্ত ধর্ম ও মতের লোক সাড়া দিয়ে এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে একত্র বসবে এবং সৃষ্টিকর্তার আসমানী মীমাংসা (সংবিধানের ‘গ’ বিভাগের পাঁচ নম্বর শর্ত) মেনে নেবে?

এরূপ প্রশ্ন কখনো উঠবেনা এটা আমরা কখনও চাইনি। বরং এ ধরণের প্রশ্ন না উঠাটাই ছিল অস্বাভাবিক। এ ধরণের প্রশ্ন না উঠলেই আমাদের সন্দেহ হত, আমাদের বক্তব্য কেউ বুঝতে পেরেছেন কিনা। সে যাহোক, সমস্ত প্রশংসা ও পবিত্রতা একমাত্র আল্লাহরই। উল্লিখিত প্রস্তাবটি জনসাধারণের কাছে পেশ করার পূর্বেই আল্লাহর অশেষ করুণায় আমাদের সমিতির সভাপতি জনাব মোঃ বরকত উল্লাহ খানের লিখিত কয়েকটি পুস্তিকা ছেপে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন, ‘মানব জাতির শান্তি কোন্ পথে’, ‘বিশ্ব শান্তির পরিকল্পনা’, ‘তত্ত্বজ্ঞানই সত্য জ্ঞান এবং একত্ব জ্ঞানই মানব জাতির পরিত্রাণ’, ‘জ্ঞানী ও অজ্ঞানের প্রভেদ’ প্রভৃতি। এসব পুস্তিকাবলীর বিভিন্ন প্রবন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে এ ধরণের প্রশ্নের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। আমরা পাঠকবর্গকে সেগুলো পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ করছি। উপস্থিত ক্ষেত্রে উল্লিখিত প্রশ্নের জবাব আমরা এভাবে দিতে চাচ্ছি যে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম ও মতের মানুষ বা তাদের প্রতিনিধিবর্গের কোন কোন বিষয়ে একত্র বসার সুযোগ কি বর্তমানে অনুপস্থিত? কোন কোন কারণে তারা কি কোথাও বর্তমানে একত্র বসছেন না? কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে তারা কি কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না বা সিদ্ধান্ত কার্যকরী করছেন না? জাতিসংঘের বাইরেও বিভিন্ন ধর্ম ও মতের লোক কি একত্র বসছেন না, যেমন, ‘বিশ্ব শান্তি সম্মেলন’, ‘বিশ্বধর্ম সভা’ প্রভৃতি? যারা একত্র বসছেন তারা বিভিন্ন ধর্ম ও মতের লোক, ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও জাতির লোক। কোন একটি বিষয়কে লক্ষ্য করে ঐকমত্য হয়ে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তারা একত্র বসছেন এবং তা কার্যকরী করারও ব্যবস্থা করেছেন। তা’ হলে যে সুযোগ ও সুবিধা পূর্ব কালের চেয়ে বর্তমানেই অধিকতর সহজ, তখন যে বিষয়ে মানুষ অকাতরে জীবন দিতেও প্রস্তুত, তেমন একটি বিষয়কে অর্থাৎ ধর্মকে ইস্যু করে ঐকমত্য হওয়ার জন্য একত্র বসার প্রস্তাবটিই কেবল এত অসম্ভব হয়ে দেখা দিল কোন্ কারণে? কারণ কি একটা? এ পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে যত প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি, সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দিতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে। এখানে আমরা মাত্র কয়েকটা প্রধান প্রশ্নেরই আলোচনা করার আশা রাখি।

প্রথমতঃ যে ধরণের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়ে থাকে তা এই: ধর্মের আবার কি হয়েছে যে নতুন করে এ সম্বন্ধে চিন্তা ভাবনা করতে হবে, বিশ্ববাসীকে একত্র করে সম্মেলন করতে হবে এবং নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে? আমরা কি ধর্ম বুঝিনা জানিনা বা মানিনা, আমরা কি ধর্ম পালন করছি না, এ সম্বন্ধে নূতন করে আবার কি শিখতে হবে? ধর্ম পালন করতে যেয়ে আমাদের কিছু ভুল ত্রুটি হয়ত হতে পারে; তা’ সংশোধনের জন্য ত ধর্ম শিক্ষার বিভিন্ন ব্যবস্থাও রয়েছে। সুতরাং ধর্ম ব্যাপারে সম্মেলন করার প্রয়োজন দেখা দিল কেন? ধর্ম ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কিছু কিছু মত পার্থক্য হয়ত থাকতে পারে; কিন্তু প্রত্যেকের মূল লক্ষ্য যখন এক, তখন যে যেভাবেই পারছে, ধর্ম পালন করে যাচ্ছে, যেমন কেউ শিক্ষা দিচ্ছে, কেউ শিখছে, কেউ কেউ ধর্ম পুস্তক ছাপাচ্ছে, কেউ কেউ ওয়াজ নছিহতের মাধ্যমে, কেউ কেউ বা দেশ বিদেশে মিশন প্রেরণ করে, কেউ কেউ ধন-সম্পদ খরচ করে ধর্মীয় কাজে সাহায্য ও সহযোগিতা করছে – এতে কি ধর্ম হচ্ছে না? আর ধর্মীয় বিভেদ? এ ত সৃষ্টির প্রথম থেকেই আছে, এ থাকবেই এর কোন মীমাংসা নেই বা হতে পারে না। আর সকল ধর্মের মূল কথা যখন একই তখন এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা বা কোনটা ঠিক, আর কোনটা অঠিক – এর মীমাংসা যখন এ পর্যন্ত কেউ করতে পারেননি, এমন কি স্বয়ং হজরত মোহাম্মদ (দঃ) ও করতে পারেননি, তখন সমস্ত ধর্মাবলম্বীদের এক করা বা এক বিশ্বাসের পতাকাতলে আনয়ন করার চেষ্টা করা বেহুদা -অবান্তর বই কিছুই নয়।

দ্বিতীয়তঃ ধর্ম বা ধর্মীয় কাজে ত কেউ বাঁধা দিচ্ছে না, যার ইচ্ছা সে সারাদিন মসজিদে বা মন্দিরে পড়ে থাকতে পারে, কেউ তাতে কোন আপত্তি করছে না। যার যত ইচ্ছা সে দান খয়রাত করতে পারে, যার যত ইচ্ছা তীর্থস্থান ভ্রমণ করতে পারে, যে যা বিশ্বাস করে তার বিশ্বাসের কথা সে যেভাবে চায় সে সেভাবেই প্রচার করতে পারে, কেউ তার কাজে হস্তক্ষেপ করছে না। যেখানে ধর্ম বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে, সেখানে এ ব্যাপারে আর অধিক কি প্রয়োজন? বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ যখন একত্র বসতে পারছে, ব্যবসায় বাণিজ্য করতে পারছে; পরস্পরকে বিশ্বাস করে লেনদেন করতে পারছে, দেশ শাসনে সকল ধর্মের লোক যখন সমান সুযোগই পাচ্ছে, এ ব্যাপারে যখন কেউ কারো প্রতি হিংসা বিদ্বেষ করছেনা, তখন আবার কোন উত্তম ব্যবস্থার জন্য ধর্মীয় সম্মেলন ডাকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে?

তৃতীয়তঃ যখন আমাদের মধ্যে ‘কমপ্লিট কোড অব লাইফ’ – পবিত্র ঐশ্বরিক গ্রন্থ বিদ্যমান, যে গ্রন্থে স্বয়ং আল্লাহ ঘোষণা করছেন, ‘আলইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বীনাকুম অ আতমামতু আলাইকুম নেয়ামতী ওয়া রাজিতু লাকুমুল ইসলাম দ্বীনা, – আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হলাম (৫ঃ৪); তখন পরিপূর্ণ একটি বিধান আমাদের মধ্যে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আমাদের আবার কোন বিধানের প্রত্যাগমনের দিকে চেয়ে থাকতে হবে? যখন হজরত মোহাম্মদ (দঃ) র পর আর কোন নবী নেই, ওহী আসার পথ চিরতরে রুদ্ধ, তখন আবার কার আগমন-প্রত্যাশার মন্ত্রণা দিয়ে সত্য ভ্রষ্ট করার চেষ্টা করছেন? বাপ-দাদা-চৌদ্দপুরুষ ধরে যে নবী ও আল্লাহর কালাম অনুসরণ করে ও যে ধর্ম-বিশ্বাস পোষণ করে আসছি, সে পথ থেকে দূরে সরে নেয়ার জন্যই কি এ পরিকল্পনা?

এমনি ধরণের আরও অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতে হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক প্রশ্নও ত রয়েছেই।

সে যাহোক, উত্তর দেয়ার ব্যাপারে আমাদের সভাপতি সাহেব সব সময়েই বলে থাকেন, “কোন প্রশ্নের জবাব দেয়ার যোগ্যতা আমার নেই। তবে আল্লাহ যদি আমাকে সাহায্য করেন তা হলেই উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব, নতুবা নহে। সুতরাং আমি আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমার পীর মুর্শিদের অছিলায় হযরত মোহাম্মদ (দঃ)র তোফায়েলে যথাযথ উত্তর দেয়ার তৌফিক দান করেন।” এ পর্যন্ত যত প্রশ্নের সম্মুখীন তিনি হয়েছেন, সর্বত্রই যথাযথ উত্তর দিতে সমর্থ হয়েছেন। সর্বত্রই দেখা গেছে প্রশ্নকর্তা শেষ পর্যন্ত হাত জোড় করে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, “হুজুর! আপনার কথার উপর আর কোন কথা হতে পারে না।”

আমি তাঁর অতি নগণ্য এক গোলাম। সুতরাং আমি এখানে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর আলোকে যে আলোচনা করতে চাচ্ছি তার অধিকাংশই প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে শোনা তাঁর কথারই পুনরাবৃত্তি। এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি উত্তমরূপে বর্ণনা করার তৌফিক চাচ্ছি। আমিন!

অতি সম্প্রতি একজন বুজুর্গ হাফেজ সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করতে যেয়ে আমার প্রত্যেকটি উদাহরণই হজরত রছুলে মকবুল (দঃ)র জীবন আলেখ্য থেকে উদ্ধৃতি করতেছিলাম। এতে তিনি বাঁধা দিয়ে বললেন, “দেখুন, কথায় কথায় রছুল(দঃ)কে টানবেন না।” এর উত্তরে আমি বলেছিলাম, “আমাদের কথায় ও কাজে তাঁকে বাদ দিয়ে চলব, আর আমরা সমাধান পেয়ে যাব? দেখুন হুজুর! তাঁকে বাদ দিয়ে কোন কথা বলা বা কোন প্রকার হস্ত-পদ সঞ্চালন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

এরপর তাঁর সঙ্গে আরো দীর্ঘক্ষণ আলাপ-আলোচনা হলেও এ বিষয়ে তিনি আর কোন কথা বলেননি। তিনি হয়ত আমার মধ্যে কোন বেয়াদবী লক্ষ্য করেই ঐরূপ নিষেধ করে থাকবেন। আমরা সবাই হুজুর ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লামের সঙ্গে যে কোন প্রকার বেয়াদবী করা হতে পানাহ চাই।

এখানে ঘটনাটির উল্লেখ করার কারণ এই যে, হজরত ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লাম হলেন, ‘উছওয়াতুন হাসানাত’ ‘সর্বোত্তম আদর্শ’। এখন যদি কেউ তাঁর উল্লেখে অস্বস্তি অনুভব করেন বা এরূপ করাকে বেয়াদবী মনে করেন তা’ হলে আমরা তাঁর পরিবর্তে আর কাকে উল্লেখ করতে পারি, মেহেরবানী করে তা বলে দিবেন কি?

এবার আসুন বক্তব্যের দিকে যাওয়া যাক। আচ্ছা আপনারা কি বলতে পারেন, বাবা হজরত আদম (আঃ)র মাধ্যমে যে ধর্মের বীজ এ পৃথিবীতে রোপিত হয়েছিল সে ধর্ম কি এ পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে কখনো সম্পূর্ণরূপে মুছে গিয়েছিল, যে জন্য তাঁর পরে লক্ষাধিক নবী রাছুলের আগমন হয়েছিল? উদাহরণ স্বরূপ কেবল এক জনের কথাই এখানে উল্লেখ করছি। হজরত নূহ (আঃ)র আবির্ভাবের পূর্বক্ষণে বা তাঁর নবুওতী জিন্দেগীতে তাঁর কওম কি কোন ধর্ম পালন করত না? তাঁর কওমের সঙ্গে তাঁর যে বিরোধ ঘটেছিল, তা কি একমাত্র ধর্মের কারণেই ছিল না? ধর্ম ছাড়া অন্য কোন ব্যবসায় বাণিজ্য নিয়ে তাঁর কওম তাঁর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করেনি। ঝগড়া-বিবাদ হয়েছিল একমাত্র ধর্মের কারণেই। সুতরাং ধর্ম নামে কওমে নূহ অর্থাৎ নূহ(আঃ)র আবির্ভাবের পূর্ব হতেই তাঁর কওম একটা ধর্ম মেনে আসছিল, এ ধর্মের সাথেই নূহ (আঃ)র প্রচারিত ধর্মের বিরোধ হওয়ায় তারা নূহ (আঃ)র সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করেছিল। সুতরাং কোন নবী রছুলই ধর্মহীন জগতে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে আসেননি। তবে তাঁদের সময় পৃথিবীতে যে ধর্ম থাকে তা’ অধর্মেরই নামান্তর। অথচ এই অধর্মের অনুসারীরাই বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের দোহাই দিয়ে নিজেদেরকেই একমাত্র সাচ্চা ধর্মের অনুসারী বলে মনে করে থাকে। এবং সত্য ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নবী-রাছুলগণকে মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, ঝগড়া-বিবাদের মূল কারণ বলে আখ্যায়িত করে। ধর্মের নামে অধর্মের দৌরাত্ম যখন পৃথিবীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে, তখনই সত্য ধর্মের বাহন হিসাবে নবী রছুলগণের আগমন হয়ে থাকে। অর্থাৎ মানুষ যখন অধর্মকেই একমাত্র সাচ্চা ধর্মরূপে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, তখনই এক একজন নবী রছুল আবির্ভূত হয়ে ধর্মের সত্যরূপ প্রকাশ করেন এবং তখনই শুরু হয় সত্য মিথ্যার লড়াই। সুতরাং পৃথিবী পৃষ্ঠ কখনো ধর্মশূন্য হয়ে পড়ে না। সবসময়ই পৃথিবীতে এক একটা ধর্ম থাকলেও সময় সময় তা অধর্মে পরিণত হয়, এ অধর্মের সংস্কারের জন্যই পৃথিবীতে লক্ষাধিক নবী-রছুলের আগমন হয়েছিল।

ধর্মের একটা মোহ আছে। ধর্মের নামে কোন একটা ‘লেবেল’ জড়াতে পারলে সহজ-সরল প্রকৃতির একদল লোক সে ‘লেবেলটাকেই’ ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গরূপে কোনও রকমে একবার মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে নিলে তার জন্য তারা সহজেই প্রাণ দিতে পারে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে শত সহস্র দলিল প্রমাণ দেখালেও সে ‘লেবেেেলর’ মোহ তারা সহজে ছাড়তে পারে না। অপর এক শ্রেণী আছে, প্রকৃতপক্ষে তারা কোন লেবেলের ধার না ধারলেও অতি সহজেই তারা নূতন নূতন লেবেলের উদ্ভাবন করতে পারে এবং ধর্মের ‘অকত্রিম বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক’ সেজে ‘মাতম’ সৃষ্টি করতে সিদ্ধহস্ত। সমাজ ও দেশের মধ্যে গণ্যমান্য, স্বচ্ছল, শিক্ষাদীক্ষায় বড় বড় তগমাধারী ও প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিবর্গের অনেকেই হচ্ছে এ দলের অন্তর্ভুক্ত। স্বার্থ হাছিলের জন্য এমন হীন কাজ নেই যা’ তারা না করতে পারে। তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে পা-িত্য ও বাগ্মীতার জোরে, কিংবদন্তী আকারে রক্ষিত অলৌকিক কেচ্ছাকাহিনীগুলো এবং সংশ্লিষ্ট মহাপূরুষ ও প্রেরিত পূরুষগণ ‘গড’ না হলেও ‘ডেমি গডের’ মর্যাদা নিয়ে সম্পূর্ণ হৃদয় সিংহাসন জুড়ে বসে। এই শ্রেণী এসব মহাপূরুষদের নামোল্লেখ মাত্র শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত করে। তাঁদের সম্পর্কিত কাহিনীগুলোর উল্লেখ মাত্র তাদের চক্ষুগুলো অশ্রুপাত করতে থাকে, হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়, কণ্ঠ ধরে যায়, স্বরভঙ্গ হয়; তাদের ভাবের উচ্ছাসে সরল সহজ মানুষ কোন কৃত্রিমতা খুঁজে পায় না; সুতরাং যা তারা শুনল বা দেখল তাদের কাছে এ-ই সত্য ও প্রকৃত ধর্ম। যিনি শুনালেন বা দেখালেন তিনিই হলেন প্রকৃত ধর্মগুরু। এ ভাব ও বিশ্বাসের মধ্যে বক্তার যে ‘ইমেজ’ সৃষ্টি হলো এই ‘ইমেজ’ ভাঙ্গে সাধ্য কার! এ যেন সম্মুখস্থ ‘খাবার থালা’ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে দূরে ঠেলে দিয়ে অতীত কালের কল্পিত ঐশ্বর্যের সুখ-স্বপ্নে বিভোর হয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করে মরার এক চিরন্তন আত্মঘাতী ফাঁদ। এ ফাঁদে ফেলেই চিরশত্রু শয়তান তার হিংসা চরিতার্থ করে। কিন্তু হায়! অতি অল্প সংখক ব্যতীত অধিকাংশ আদম সন্তানই তা’ বুঝে না।

এখানে যে আলোচনাটুকু করা হলো, অনেকেই হয়ত এতে বিরক্তি বোধ করছেন। আমার এরূপ ধারণার কারণ হলো একটি ঘটনা। একবার আমাদের সভাপতির সঙ্গে তবলীগ জামাতের একজন আমীর সাহেবের অফিস চেম্বারে কিছু আলোচনা হয়। (তিনি তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন) আমাদের সভাপতি সাহেব একটি প্রবন্ধ পাঠ করে শুনাচ্ছিলেন। সে প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল ‘জমানার লোকেরা কেন নবী ও নায়েবে নবীদের সঙ্গে বিরোধীতা করিয়া থাকে।’ আলোচনার মাঝখানে আমীর সাহেব একটু অধৈর্য হয়ে বললেন, “এত নবী রছুলদের ব্যাপার?” অর্থাৎ পৃথিবীতে যখন কোন নবী-রছুল আর আসবেন না, তখন তাঁদের সঙ্গে “জমানার লোক কেন বিরোধিতা করে” – এ কাহিনী শুনে কি লাভ? এটাই ছিল তার মনোভাব। আর আমি এখানে নূহ নবী (আঃ) রই উল্লেখ করছি। এখানে পাঠক বর্গও হয়ত অধৈর্য হয়ে বলতে পারে, নবী-রছুলের পর্ব যখন শেষ হয়ে গেছে, তখন তাঁদের সম্পর্কিত কাহিনী শুনে কি লাভ? এ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে আমরাও কিন্তু বলতে পারি, নবী রছুলের ঘটনা ব্যতীত অন্য কারো ঘটনা যখন পবিত্র মহাগ্রন্থে বর্ণনা করা হয়নি, তখন এ গ্রন্থ পাঠ করে কি লাভ? অতীত কালের নবী রছুলদের কেচ্ছা-কাহিনী মনে করেই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণী ও পবিত্র মহাগ্রন্থের মধ্যে মনের খোরাক পান না, তাই এর প্রতি কোন আকর্ষণও অনুভব করেন না। আর এক শ্রেণী যারা এ পবিত্র মহাগ্রন্থ কণ্ঠস্থ বা শিক্ষা করছেন বা শিক্ষা দিচ্ছেন তারাও এর মধ্যে অতীত কাহিনী ছাড়া আর কিছুর সন্ধান পাননি বা দিতে পারছেন না। তাই আমাদের বর্ণনা বা আলোচনায় নবী রছুলের উল্লেখ শুনে তারা অধৈর্য না হয়ে পারেন না। কাহিনী ছাড়া অন্য কোন সন্ধান যে তারা মোটেও দেন না, তা নয়, কিন্তু যা দেন, বাস্তবের সাথে তার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। মিল খুঁজে না পাওয়ায় তাদের কথা বা উপদেশ যেমন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে, তদ্রƒপ গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন তারা নিজেরা, তৎসঙ্গে পবিত্র মহাগ্রন্থও। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়! এ অধঃপতন তারা মোটেও অনুভব করছেন না। অনুভব করতে পারছেন না বলেই পরস্পর ‘ফতোয়ার’ ঢিল এখনও ছোড়াছুড়ি করছেন, ‘হাতল বিহীন তরবারী’ নিয়ে ‘এটম বম্বের’ সাথে লড়বার জন্য তেড়ে আসেন।

সে যাহোক, আপনারা কি কেউ বলতে পারেন, সর্বশেষ নবী (দঃ) পর্যন্ত যত নবী রছুল এসেছেন তাঁদের কোন একজনের আগমনের জন্যও কি তাঁর কওম অপেক্ষা করেছিল? তিনি আসা মাত্র তাঁর কওম কি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেছিল? পূর্বোল্লিখিত তিন স্তরে বর্ণিত প্রশ্নগুলোর মত প্রশ্ন কি তাঁর কওম তাঁকে করেনি? সুতরাং পূর্বোল্লিখিত প্রশ্নগুলোর জবাব কোরান যা দিয়েছে, আমাদের জবাবও তাই, এর বাইরে কিছু নয়।

সে যাহোক, বিশ্ববাসী সকলেরই বিশ্বাস, ধর্ম পালনের উদ্দেশ্য হল শান্তি, কল্যাণ বা মঙ্গল লাভ করা। এখন আমরা যদি এমন কিছু প্রতিপালন করি যা আমাদেরে শান্তি, কল্যাণ বা মঙ্গল প্রদান করতে অক্ষম, বরং তা অমঙ্গলই সৃষ্টি করে, তা’হলে তা কখনো ধর্মরূপে পালিত হওয়ার যোগ্য হতে পারে কি? এর প্রতিবাদে কেউ হয়ত বলতে পারেন যে, ধর্ম পালন করলে ইহকালে শান্তি বা মঙ্গল লাভ না হলেও পরকালে অবশ্যই তা লাভ হবে। এ কথা কিছু অন্ধভক্ত ও গোঁড়া প্রকৃতির কিছু লোক মেনে নিলেও প্রত্যক্ষদর্শী যুক্তিবাদীরা কখনো মেনে নিবে না এবং ধর্মও কেউ পালন করতে এগিয়ে আসবে না, তা নয় কি? এবং বর্তমানে আমরা কি তা’ প্রত্যক্ষ করছি না? পৃথিবীবাসী বর্তমানে যখন চরম অশান্তি ও অমঙ্গলই ভোগ করছে, এখন যদি কেউ বলে যে ধর্মের আবার কি হয়েছে যে নূতন করে এ সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে, বা আমরা কি ধর্ম পালন করছিনা বা জানিনা বা মানিনা? তাদের কাছে আমাদের দাবী, ধর্মের যদি কিছু না-ই হয়ে থাকবে এবং ধর্ম যখন জানেন-শুনেন, পালনও করছেন, তা হলে ধর্ম পালনের যে মূল উদ্দেশ্য – শান্তি ও কল্যাণ লাভ, তা আমাদের প্রদান করুন। তা দিতে পারবেন কি? আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি আপনারা তা পারবেন না। বরং ঐ কথাই বলবেন পূর্বে যা উল্লেখ করেছি, অর্থাৎ ধর্ম পালন করলে ইহকালে কিছু না পেলেও পরকালে দ্বিগুণ, চতুর্গুণ বা সত্তরগুণ পাওয়া যাবে। কই! আপনাদের এই আশ্বাসে কে আসছে? দু’এক জন এদিকে আসলেও তার চৌদ্দগুণ সিনেমা হলের সামনে দ্বিগুণ তিনগুণ মূল্য দিয়ে উলঙ্গ নৃত্য দেখার জন্যে ব্ল্যাকে টিকেট কিনে আপনাদের আশ্বাস বাণীকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখাচ্ছে, তা নয় কি? আর না হয়ত বলবেন, আমরা যথাযথভাবে ধর্ম পালন করতেছিনা, বা কেউ কেউ পালন করলেও অধিকাংশ লোকই ধর্ম মানছেনা বা পালন করছে না। এ জন্যই আমরা এ অশান্তি ভোগ করছি। তা হলেত আমাদের কথাতেই এসে গেলেন অর্থাৎ আমরা ধর্ম পালন করছিনা।

এখানে স্বভাবতঃই প্রশ্ন উঠবে, আমরা ধর্ম পালন করছি না কেন? ধর্মে মানুষ কোন শান্তি, কোন মঙ্গল বা আনন্দ পাচ্ছেনা বলেই মানুষ ধর্ম পালন করছে না। মানুষ কি এমন অবুঝ যে এমন একটি কাজ যাতে মঙ্গল, শান্তি এবং আনন্দ আছে, অথচ তা করবে না? কথায় আছে, পাগলেও আপন বুঝ বুঝে। পাগল নয়, অথচ আপনার কল্যাণজনক কাজ সে করবে না, এ কখনও হতে পারে না। আমরা ধর্মকে কল্যাণজনক মনে করি, অথচ আমরা তা পালন করি না! কথাটা কেমন হেঁয়ালীপূর্ণ নয় কি? প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে ধর্ম হয়ে পড়েছে আচার বা অনুষ্ঠান সর্বস্ব। কেউ ইচ্ছা করলে, এ আচার পালন করতে পারে, আর কেউ ইচ্ছ না করলে, সে নাও করতে পারে। ধর্মের প্রতি এ অনীহা কেন? কারণ শুধু আচারে কোন প্রাণ থাকেনা। আসলে ধর্ম তার ‘রূহ’ হারিয়ে ফেলেছে। এ জন্যই ‘রূহ’ ছাড়া শুধু দেহের প্রতি কেউ কোন আকর্ষণ অনুভব করছে না। ধর্ম কেন তার ‘রূহ’ হারিয়ে ফেলেছে? কেন হারাবে না? পূর্ববর্তী সকল ধর্মের প-িত ব্যক্তিগণের নিকট ‘রুহুল কুদ্স্’, ছিলেন শত্রু তুল্য। তাদের কাছে উপেক্ষিত হয়ে শেষে এই ‘রুহুল কুদ্স্’ এসেছিলেন হজরত রছুলে মকবুল (দঃ)র কাছে এবং তাঁর মাধ্যমেই ইসলাম ধর্ম লাভ করল পূর্ণতা। সেই ‘রুহুল কুদ্স্’ এর আবির্ভাব আবার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তথাকথিত ইসলাম অনুসারীদের কাছে। যে ধর্মে রুহুল কুদ্সের আবির্ভাব নিষিদ্ধ ছিল, সে ধর্মে আবার ‘রূহ’ আসবে কোত্থেকে? এ জন্যই যদিও আমরা একটা ধর্ম স্বীকার করি, সে ধর্মে জবরদস্তী ছাড়া না আছে কোন কল্যাণ, আর না আছে কোন প্রাণ। অথচ আল্লাহ পাক পবিত্র গ্রন্থে পরিষ্কার ভাবে ঘোষণা করছেন, ‘তানাজ্জালুল মালাইকাতু অর রুহু ফিহা বেএজনি রাব্বি হিম মিন কুল্লি আমরিন ছালামুন হিয়া হাত্তা মাতলাইল ফাজরে – সেই রাতে ফেরেশতাগণ ও ‘রুহ’ তাদেরই প্রভুর অনুমতিক্রমে সব কাজের ব্যবস্থা ঠিক করার জন্য নাজেল হন। ভোর বেলার আগমন পর্যন্ত এতে শান্তি কল্যাণ। (৯৭ঃ৪-৫) আরও হা-মীম। ওয়াল কিতাবিল মুবিন, ইন্না আনজালানাহু ফি লাইলাতিম মবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুনজিরিন। ফিহা ইউফরাকু কুল্লু আমরিন হাকিম। আমরাম মিন্ ইনদিনা, ইন্না কুন্না মুরসিলিন। রাহমাতাম মির রাব্বিকা, ইন্নাহু হুয়াস সামিউল আলিম – অর্থাৎ হা-মীম! শপথ এই সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিই তা’ এক মহান রাতে নাজিল করেছি। আমিই ত সতর্ককারী। সেই রাতে প্রত্যেকটি তথ্যপূর্ণ বিষয় বৈশিষ্ট্যম-িত করা হয়; আমার সকাশে, আমারই নির্দেশে। নিশ্চয়ই আমিই প্রত্যাদেশ প্রেরণ করে থাকি। আপনার প্রভুর রহমত স্বরূপ। নিশ্চয় তিনি সব কিছু শুনেন এবং জানেন। (৪৪ঃ১-৬) প্রতি বৎসর সেই মহিমান্বিত রজনী – ‘দিবস’ উদযাপন করি, অথচ সেই রজনীর কল্যাণ বাহকের জন্য দ্বার করে রাখি রুদ্ধ! আর স্পষ্টভাবে তিনি ঘোষণা করছেন, “রাফিউদদারাজাতে জুল আরশে, ইউলকির রুহামিন আমরিহী আলা মাইয়্যাশাউ মিন ইবাদিহী লেইউনজেরা ইয়াওমাত তালাক – অর্থাৎ সুউচ্চ-মহান মর্যাদার মালিক, মহান আরশের মালিক, নিজ ইচ্ছামত বান্দাদের মধ্যে যাঁর কাছে খুশী তাঁর নির্দেশ সহ ‘রুহ’কে পাঠিয়ে থাকেন – যেন এই ‘তালাকের দিন, সম্বন্ধে সতর্ক করেন।’ (৪০ঃ১৫) আরও যেমন, ইউনাজ্জেলুল মালাইকাতু বিররুহে মিন আমরিহী আলা মাইয়্যাশাউ মিন এবাদিহী আলআনজিরু আন্নাহু লাইলাহা ইল্লাআনা ফাত্তাকুন অর্থাৎ তিনি ফেরেস্তাদেরকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার কাছে খুশী ‘রুহ’ দিয়ে পাঠিয়ে থাকেন (এই বলে যে) আপনি মানুষদেরকে সতর্ক করুন – আমি ছাড়া আর ত কোনও মাবুদ নেই, সুতরাং তোমরা আমাকেই ভয় কর। (১৬ঃ২)

উদ্ধৃত আয়াতগুলোর বক্তব্যে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কাল নির্দেশক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলোকে যদি কেউ কেবল হযরত রছুলে মকবুল (দঃ) এবং তাঁর সময়সীমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও কার্যকর বলে বুঝাতে চান এবং তাঁর সময়সীমার বাইরে না আনতে চান তা’হলে ত এই মহাগ্রন্থকে অতীত কালের গ্রন্থ হিসাবেই বুঝতে হবে এবং বর্তমানে ইহাকে অকার্যকর বলেই মনে করতে হবে, তা’ নয় কি? তা হলে এ গ্রন্থকে ‘চিরন্তন আল্লাহর কালাম বলে চেঁচামেচি করে কি লাভ? তৌরাত ইঞ্জিলের মত এটাকেও পরিত্যক্ত বলে মনে করতে হবে, তা’ নয় কি? (নাউজুবিল্লাহ) আর বর্তমানের সঙ্গে একে সংশ্লিষ্ট ও কার্যকর বলে মনে করলে উদ্ধৃত আয়াত গুলোতে যে ফেরেস্তা, রুহ এর অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলা হয়েছে তাঁরা কোথায় অবতীর্ণ হবেন? পাহাড়ে, জঙ্গলে, সাগরে অথবা মরুভূমিতে বা একমাত্র মানুষ ছাড়া অন্যান্য সব জীব-জানোয়ারের ঘাড়ে? সুতরাং যে ‘দিল’ বিশ্বাসই করতে পারবে না যে মানুষের উপর ‘রুহুল কুদ্স্’ এর আবির্ভাব হতে পারে, সে ‘দিল’ কি ভাবে ‘রুহুল কুদ্স্’ থেকে অংশ লাভ করবে? আর কি ভাবেই বা তার ‘দিল’ জেন্দা হবে? আপনারা কি ভেবেছেন, ‘রুহুল কুদ্স্’ এর জন্য ‘দিলের’ দরজা চিরতরে রুদ্ধ করে রেখে সারা রাত গগণ বিদীর্ণ করে ‘আল্লাহু’ আল্লাহু’ করলেই ক্বলব জেন্দা বা পাক-ছাফ হয়ে যাবে? এতে পরিশ্রান্ত হয়ে অবচেতন মনে রং-বেরঙ্গের কিছু খাব-খেয়াল হয়ত দেখতে পারেন। কিন্তু চির জীবন্ত, চির সুন্দর, চির অমলিন, চির অমর যে জীবন, সে জীবনের সুবাস সারা জিন্দেগীতেও জুটবেনা -যতদিন না আল্লাহর ‘রহমত’ বহনকারী ‘রুহুল কুদ্স্’ এর জন্য দিলের দরজা খুলে দেবে। ‘রুহুল কুদ্স্’ এর আবির্ভাবের পথ বন্ধ রাখলে আর কি ক্ষতি হতে পারে তা’ চিন্তা করে দেখেছেন কি? ‘রুহুল কুদ্স্’ হলেন আল্লাহর বাণী বাহক পবিত্র আত্মা। আর ‘বাণী’ হল বান্দাদের কাছে তাঁর অভিপ্রায় বা ইচ্ছা ব্যক্ত করার মাধ্যম। যদি আমরা মনে করি যে আল্লাহর বাণী আর কেউ লাভ করতে পারবে না, তা হলে কি প্রশ্ন উঠবে না যে আল্লাহর ‘কালাম’ বা বাণীর ভা-ার কি নিঃশেষ হয়ে গেছে, তিনি কি ইচ্ছা-অভিপ্রায় শূন্য হয়ে জীবনহীন এক অথর্বে পরিণত হয়ে গেছেন, অর্থাৎ তাঁর গুণ পরিবর্তন হয়ে গেছে? (নাউজুবিল্লাহ) অথচ তিনি বলছেন, “অলাও আন্না মা ফিল আরদে মিন সাজারাতিন আকলামুউ ওয়াল বাহরু ইয়ামুদ্দুহু মিম্ বাদিহী সাবয়াতু আবহুরিম মা নাফিদাত কালেমাতুল্লাহা ইন্নাল্লাহা আজিজুন হাকিম” – অর্থাৎ সারা দুনিয়ার বুকে যত গাছ পালা রয়েছে, তা’ যদি কলমে পরিণত হয় আর সাগর যদি তাঁর কালি হয় এর সঙ্গে আরো সাত সাগর যুক্ত হলেও তা ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু আল্লাহর কালাম ফুরোবে না।” (৩১ঃ২৭)

আল্লাহর ইচ্ছা বা অভিপ্রায় আছে অথচ তা’ আর তিনি প্রকাশ করতে পারবেন না; তাঁর শক্তি আছে, অথচ তা’ প্রয়োগ করবেন না; তাঁর অফুরন্ত বাণী আছে, অথচ তা’ আর কারো কাছে পাঠাবেন না, তিনি দুনিয়ার মানুষের দুর্দশা দেখবেন কান্না-কাটি শুনবেন, অথচ তাদের উদ্ধারের জন্য কাউকে পাঠাবেন না’ তাঁর ভা-ারে অফুরন্ত ‘রহমত’ আছে, অথচ তা’ তিনি পাঠাবেন না; এমন নির্দয় নিষ্ঠুর নির্বাক অথর্ব প্রস্তরবৎ ‘আল্লাহর’ পূজা করলেই কি আমাদের ধর্মানুষ্ঠানে প্রাণ এসে যাবে? সুতরাং আমরা যেমন তাঁকে বিশ্বাস করি, তার অধিক তিনি আর আমাদেরে কি দেবেন? “মৃত আল্লাহর” কাছে মৃত পঁচা লাশের দুর্গন্ধ ছাড়া আর কি পাওয়া যাবে? আর এই দুর্গন্ধেই আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস আজ রুদ্ধ হয়ে আসছে না কি? সুতরাং এবার চিন্তা করে দেখুন, ধর্মের কি হয়েছে এবং ধর্মের দিকে মানুষ কেন আসছে না, বা ধর্ম কেন আমাদেরে অশান্তি অমঙ্গল থেকে উদ্ধার করতে পারছে না?

ফলের স্বাদ ভোগ করতে চাইলে ফলের অশরীরী স্বাধ ও গন্ধ ধারণ করার জন্য ফলের বীচি ও ছিলকার আবরণ যুক্ত একটা আধার থাকতে হবে। আধার বিহীন ফলের স্বাদ ও গন্ধ চির জীবন সাধনা করলেও পাওয়া যাবে না। তদ্রƒপ আল্লাহর ‘রহমত’ পেতে হলে ‘রহমত’ ধারণ করিবার জন্যও একটা আধারের দরকার। এই জন্যই হজরত রছুলে মকবুল(দঃ) কে সম্বোধন করে আল্লাহ বলেছেন, “অমা আরছালনাকা ইল্লা রাহমাতুল্লিল আলামিন- অর্থাৎ নিশ্চয়ই সারা বিশ্বের জন্য ‘রহমত’ ব্যতীত আপনাকে পাঠাইনি।” হজরত রছুলে মকবুল (দঃ) হলেন বিশ্ববাসীদের জন্য রহমতের আধার, ভা-ার বা বাহন।

যতদিন নবী রছুল জীবিত থাকেন ততদিন তাঁরাই হন এই ‘রহমতের’ বাহন। তাঁদের অবর্তমানে তাঁদের যোগ্য খলিফা বা আল্লাহ যাঁকে খুশী তাঁর ইচ্ছা মত নবীর নায়েব নির্বাচিত করে নবুওতের দায়িত্ব ও কার্য পরিচালনা ও রক্ষণা বেক্ষণ করেন এবং তাঁর মাধমে জগদ্বাসী আল্লাহর ‘রহমত’ বা শান্তি ও কল্যাণ লাভ করে থাকে।

আল্লাহর দরবারে মুমিনদের চারটি শ্রেণী আছে – নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সালেহ্। মানব রাজ্যেও চারটি শ্রেণী আছে, যেমন, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। প্রত্যেকটি শ্রেণীতেও দক্ষ, অদক্ষ, নূতন, পুরাতন, জৈষ্ঠ-কনিষ্ঠ প্রভৃতি উপবিভাগ আছে, মর্যাদারও কিছু তারতম্য আছে। মানবের প্রতিটি রাজ্যে একটি রাজ সিংহাসন আছে। রাজ সিংহাসনে যিনি আরোহন করেন, প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হলেও তিনি এমন কতক বৈশিষ্ট্য মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী হন যা অন্যান্য প্রথম শ্রেণী নাগরিকদের থাকে না। সিংহাসনে আরোহন করার জন্য প্রথম শ্রেণীর কোন নাগরিক না থাকলেও সিংহাসন কখনো শূন্য থাকে না। সিংহাসনে যিনিই আরোহন করেন, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হলেও তিনি সিংহাসন রক্ষা ও সুষ্ঠুভাবে রাজ্য পরিচালনা করার জন্য প্রথম শ্রেণীর মতই সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকারী হন। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর চেয়েও বেশী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হলেও তার এরূপ কার্যকে কেউ অন্যায় বা অপরাধ বলে গণ্য করে না। বরং ক্ষেত্র ও সময় বিশেষে উপযুক্ত শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগ না করলেই তার দোষ বা অপরাধের কারণ হয়। আল্লাহর ধর্মীয় রাজ্যের বিধান কি অন্য রকম? বর্তমানে কোন নবী নেই। ধর্মরাজ্য পরিচালনা করার জন্য নবীর সেই সিংহাসন কি শূন্য রাখা হয়েছে? ধর্মরাজ্য পরিচালনা করার জন্য আল্লাহর ভা-ারে কি উপযুক্ত লোকের অভাব হয়ে গেল? এর উত্তরে হয়ত বলবেন, আল ওলামাও অরাছেতুল আম্বিয়া – অর্থাৎ আলেম-গণই হচ্ছেন আম্বিয়া(আঃ) গণের ওয়ারেছ। নবী (দঃ) র কোন সম্পদের ওয়ারেছ হলেন আলেমগণ? নবী (দঃ) কি কোন পার্থিব ধন-সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন যে আলেমগণ তার ওয়ারেছ হওয়ার দাবী করছেন? নবী (দঃ) কি পুঁথিগত বিদ্যার অধিকারী ছিলেন যা তিনি আলেমদের জন্য রেখে গেছেন? নবী (দঃ) কোন সম্পদের অধিকারী ছিলেন, উত্তরাধীকার সূত্রে আলেমগণ যার দাবী করতে পারেন? তা হলে দেখা যাচ্ছে নবী (দঃ) এমন কোন পার্থিব সম্পদ রেখে যাননি, যা আলেমগণ যথার্থভাবেই দাবী করতে পারেন। একজন সাধরণ মানুষ যে পার্থিব সম্পদ রেখে যায়, অপর একজন সাধারণ মানুষ উত্তরাধিকার সুত্রে যথার্থভাবেই তা দাবী করতে পারে। নবী (দঃ) এরূপ কোন সম্পদ রেখে যাননি যার মিরাছ আমাদের তথাকথিত আলেমবৃন্দ দাবী করতে পারেন। এখানে আমাদের যা দেখা দরকার তা’ হল, নবী(দঃ) এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে কতটুকু পার্থক্য তা’ নির্ণয় করা। কোরানে হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে, কুল ইন্নামা আনা বাশারুম মেছলুকুম ইউহা এলাইয়া – বল, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ, তবে আমার নিকট ওহী আসে। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সাধারণ মানুষ এবং নবী (দঃ) র মধ্যে পার্থক্যকারী ফেক্টরটি হল ওহী পাওয়া এবং না পাওয়ার মধ্যে। এখন যদি কেউ নবী (দঃ)র ওয়ারেছ হওয়ার দাবী করেন, অথচ ওহী লাভের সম্ভাবনাকেই অস্বীকার করেন, তা’হলে তারা কি যথার্থই নবী (দঃ)র ওয়ারেছ হতে পেরেছেন? এই প্রশ্নটির জবাবের ভার আপাততঃ আমরা পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিলাম। আশা করি, তারাই এ ব্যাপারে সুষ্ঠু মীমাংসায় পৌছতে সক্ষম হবেন। পাঠকদের উপর আরও একটি বিষয় ছেড়ে দিচ্ছি, ধর্মীয় ব্যাপারে অর্থাৎ যে বিষয়ের উপর আমাদের অনন্ত জীবনের সুখ শান্তি, মুক্তি বা শাস্তি নির্ভরশীল, তেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা যাদের উপর এতকাল সর্বতোভাবে নির্ভর করে আসছি, তারা কি আমাদেরে পবিত্র কোরানের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে, না কোরান থেকে দূরে সরে নিয়ে যাচ্ছে আপনারা তাও একটু চিন্তা করে দেখবেন।

উপসংহারে এসে আমাদের একথা স্বীকার করতে হচ্ছে যে ধর্মের এমন একটা কিছু ঘটে গেছে, যে জন্য এ সম্বন্ধে আমাদের নূতনভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে এবং তা’ শুধু আমি বা আপনি করলেই সমাধান হবে না, বরং জগদ্বাসী সবাইকে নিয়েই এ সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। আমাকে অতিশয় দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে আমাদের ধর্মীয় সমাজ পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে মোটেই খেয়াল করছেন না বা খেয়াল রাখার কোন প্রয়োজনও অনুভব করছেন না। পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ, ধর্মের স্তম্ভ, প্রভৃতির উপর কি ও কোন ধরণের হামলা এসেছে তার বিস্তারিত ও প্রত্যক্ষ ঘটনা সম্বন্ধে তারা মোটেও ওয়াকিবহাল নন। দূর থেকে লোক পরম্পরায় যা শুনেন, তাকে ভিত্তি করে দূর থেকেই গালি গালাজ আর ফতোয়ার ঢিল ছোড়াছুড়ি করেন। প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য তারা মোটেও তকলিফ স্বীকার করতে চান না।

সে যাহোক, বিশ্বের সকল ধর্ম ও মতের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিগণকে একত্র সমাবেশ করতঃ এক মহাসম্মেলনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাবটি কি এখনও অমূলক অবাস্তব অবান্তর অপ্রয়োজনীয় কোন একটা পদক্ষেপ বলে মনে করছেন? তা’ মোটেও নয়। এ পদক্ষেপ একটি মৃত দেহে প্রাণ সঞ্চার করার পদক্ষেপ; এ পদক্ষেপ একটি মৃত জাতির দেহে প্রাণ সঞ্চার করার পদক্ষেপ। এ পদক্ষেপ মৃত বিশ্বে প্রাণ সঞ্চার করার পদক্ষেপ। আমাদের এ পদক্ষেপ যতই ক্ষুদ্র তুচ্ছ প্রতীয়মান হোক না কেন, এই ক্ষুদ্র তুচ্ছ পদক্ষেপের মধ্যেই রয়েছে একটি ক্ষুদ্র বীজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রকা- বটবৃক্ষের সম্ভাবনার মত একটি বিরাট সম্ভাবনা। সুতরাং সম্ভাবনা দেখেই যিনি চিনে নিতে পারেন তিনিই ত হচ্ছেন প্রকৃত বিশ্বাসী। অতএব এরূপ প্রকৃত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্যই রইল বিশ্ববাসী সকলের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বশান্তি আহ্বায়ক সমিতির উদাত্ত আহ্বান। আল্লাহ-পাক আমাদের সবাইকে তাঁর সত্য পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন!

অমা আলাইনা ইল্লাল বালাগ।

(প্রবন্ধের এ অংশটুকু ৭ নভেম্বর, ১৯৮০ ইং তারিখে সমিতির ঢাকাস্থ শাখা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত পাক্ষিক মজলিশে পাঠ করা হয়।)