(মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ খান)
ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানাধীন রামনাথপুর গ্রামের মরহুম আব্দুল কাদের খানের দ্বিতীয় পুত্র মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ খান । প্রমত্তা পদ্মানদীর তীরবর্তী গ্রাম্য চাষী পরিবার। সহজ সরল জীবন পদ্ধতি। মাঠে লাঙ্গল চাষ দ্বারা সোনার মাটিতে সোনার ফসল ফলানো, পদ্মার পলি বিধে․ত চারণক্ষেত্রে গরু চরানো, খাল-বিলের পর্যাপ্ত মাছ ধরা, সহজ-সরল-সুন্দর জীবন যাপনের উপকরণ সমূহসমৃদ্ধ গ্রাম্য পরিবার। গ্রামের আর পাঁচটা পরিবার থেকে এই খান পরিবার ছিল স্বতন্ত্র। সততা, নির্ভীকতা, ধর্মপরায়ণতা; আতিথেয়তা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিকার করা ছিল এই পরিবারের ক্সবশিষ্ট্য। সেই জন্য গরীব মধ্যবিত্ত পরিবারহলেও খান পরিবার ছিল গ্রামের অন্যান্য ধনী পরিবার সমূহ অপেক্ষা সমীহ মর্যাদার অধিকারী। ভারতবর্ষে পাঠান রাজত্ব স্থাপনের কালে যে সব বীর পাঠান যোদ্ধা সম্প্রদায় নদীর স্রোতের মত খাইবার পাস অতিক্রম করে এদেশে এসেছিল এবং পাঠান রাজত্বকালে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল কুসং¯‥ারে ছেয়ে যাওয়া সমাজ সং¯‥ারেআত্মনিয়োগ করতে, তাদেরই অবদান ছিল বাংলাদেশে পাঠানশাহী সুলতানদের গে․রবময় কীর্তিসমূহ। পরবর্তীকালে মুঘল রাজত্বস্থাপিত হলে পাঠানরা হৃত-গে․রব হয়ে পড়ে এবং শেরশাহ পুনরায় মুঘল বাদশাহ হুমায়ুনকে পরাজিত করে ভারতে পাঠান শাহীস্থাপন করেন। কিন্তু শেরশাহের উত্তর পুরুষরা হীনবল হয়ে বাদশাহ হুমায়ুনের কাছে পরাজিত হয়ে রাজ্যহারা হয়। তখন মুঘলশাহীরঅত্যাচারের কবল থেকে আত্মরক্ষার্থে বহু পাঠান পরিবার ভারতের প্রত্যন্ত প্রদেশ সমূহ বিহার, উড়িষ্যা ও বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকরে। সেই কারণেই দিল্লী ও উত্তর প্রদেশ অপেক্ষা বিহার, উড়িষ্যা ও বাংলাদেশে পাঠানদের সংখ্যাধিক্য দেখা যায়।মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ খানের পূর্ব পুরুষরা ঐরূপ একটি পরিবার, ফরিদপুর জেলার চে․দ্দরশিতে বসবাস স্থাপন করেন।কিন্তু ভারতে ইংরেজ রাজত্বকালে মুঘল পাঠান নির্বিশেষে মুসলিমদের উপর নেমে আসে নিপীড়ন। হিন্দুরা ইংরেজদের সঙ্গেসহযোগিতা করে মুসলিম নিপীড়নের কাজে এবং তারা ইংরেজী ভাষা শিক্ষা করে ইংরেজদের খয়েরখাঁ বনে যায়। সরকারী চাকরীবাকরীও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তারাই ভোগ করতে থাকে। মুসলিমরা ইংরেজদের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা করা ঘৃণ্য মনেকরে অর্থ‣নতিক ক্ষেত্রে ক্রমশঃ কোনঠাসা হতে হতে মাঠের চাষীতে পরিণত হয়। সেই সূত্রে আমাদের আলোচ্য খান পরিবার ও চাষীপরিবারে পরিণত হয়।কিন্তু তিতুমীর, শহীদ ক্সসয়দ আহমদ বেরেলভী প্রমুখরা যখন ইংরেজ সরকার ও হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার থেকে মুসলিমসম্প্রদায়কে রক্ষা করতে তথা দেশে পুনরায় মুসলিম রাজত্ব স্থাপনের স্বপ্নে দেশময় আন্দোলন গড়ে তোলেন তখন চে․দ্দরশির খানপরিবারের রফিজ খানও সে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে যখন ইংরেজরা হিন্দু জমিদারদের সহায়তায় সে আন্দোলন দমনকরতে সমর্থ হয় এবং আন্দোলনকারী মুসলিমদের উপর নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় তখন রফিজ খান সে নিপীড়নের কবল থেকেরক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে ফরিদপুর জেলা থেকে ঢাকা জেলায় চলে আসেন এবং গালিমপুর অঞ্চলে রামনাথপুরে বসতি স্থাপন করেন।এই রফিজ খানই হলেন মোহাম্মদ বরকতউলরাহ খানের প্রপিতামহ। সেই থেকেই এই খান পরিবার সাধারণ গ্রাম্য চাষী পরিবার; কিন্তু কিছুটা স্বাতন্ত্র্য ম-িত।মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ খানের জন্ম তারিখ জানা নেই; তবে ১৩২৬ সালে যে প্রলংঙ্করী ঝড় সারা রাত্রি ব্যাপী সারাবাংলাদেশকে দলিত-মথিত করেছিল তখন তিনি ছিলেন ৫/৬ বছরের বালক। অর্থাৎ তার জন্ম সাল বাংলা ১৩২০/২১ মোতাবেকখ্রিষ্টীয় ১৯১১। সুতরাং তাঁর বর্তমান বয়স ৬৭/৬৮ বৎসর। কিন্তু এই বয়সেও তিনি খুব সুস্থ সবল ও কর্মক্ষম আছেন। সহজ-সরলকর্মঠজীবন যাপনে অভ্যস্ত একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তি তিনি। বংশগত ঐতিহ্য সহকারে তাঁর মনও পাঠানের মত বলিষ্ঠ ও ঋজু।পার্শ্ববর্তী গ্রাম সোনা হাজরায় ক্বারী মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেবের বাড়ীতে ছিল একটা খারিজি মাদ্রাসা। তাঁর বাল্য শিক্ষা ঐমাদ্রাসাতেই সম্পন্ন হয়। ক্বারী মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেব ছিলেন কামেল দরবেশ কিন্তু একটু পাগলাটে মেজাজের। সেই কারণেবরকত উল্লাহ খানের পিতা ছেলেকে মাদ্রাসায় যেতে দিতে চাননি; কিন্তু বালক বরকত উল্লাহ নিজের আগ্রহেই মাদ্রাসায় যেতে আরম্ভকরেন।মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন ক্বারী মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেবের জ‣নক আত্মীয়, ক্বারী মোজাফফর হোসেন ও শরিয়তউল্লাহ নামক একজন বয়¯‥ ছাত্র। ক্বারী মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেব ছিলেন মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও রক্ষণাবেক্ষণকারী। তিনি মাদ্রাসায়শিক্ষকতা করিতেন না। তাই বালক বরকত উল্লাহকে সাধারণতঃ পাগলা দরবেশ, ক্বারী ইসমাইল সাহেবের সামনে যেতে হত না। কিন্তু একদিন ঘটনাচক্রে তিনি ক্বারী ইসমাইল সাহেবের সামনে পড়ে গেলেন। ক্বারী সাহেব বালক বরকত উল্লাহকে দেখে তাঁর প্রতিসস্নেহ ব্যবহার করলেন, তাঁর পরিচয় নিলেন ও তার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। তাতে বালকের মন থেকে পাগলা দরবেশের প্রতিপোষিত কাল্পনিক ভীতি দূর হয়ে গেল। সেই থেকে তিনি ক্বারী মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেবের নেক নজরে পড়লেন।এই আবেদে কামেল, ক্বারী মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেবই মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ খানের দীক্ষা গুরু। বালক বরকত উল্লাহরবলিষ্ঠ মন ও উন্নত চরিত্রের পরিচয় পেয়ে তিনি কিছুদিনের ভিতর বালক বরকত উল্লাহকে নিজের পরিবারের একজন হিসাবে তাঁরবাড়ীতে থেকে মাদ্রাসায় পড়ালেখা করতে সুযোগ দিলেন। কিন্তু ক্বারী মোজাফফর হোসেন সাহেব কিছুদিন পরে উক্ত মাদ্রাসারশিক্ষকতার কাজ ছেড়ে চলে যান। ফলে মাদ্রাসাটি কিছুকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
ক্বারী মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেবের প্রচেষ্টায় পুনরায় মওলানা আরশাদ আলী ও মাস্টার মফিজুর রহমান মাদ্রাসার শিক্ষক নিযুক্ত হন এবং নূতন পর্যায়ে আরবী ফার্সীসহ বাংলা-ইংরেজীর তালিমের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু মাদ্রাসায় তিন বৎসরের অধিক কাল অধ্যয়ন করার সুযোগ বালক মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ খানের হয়নি। ক্সকশোরে পদার্পন করে পারিবারিক চাহিদা পূরণার্থে অর্থোপার্জনেরজন্য তাঁকে কোলকাতায় চলে যেতে হয়। কিন্তু বাল্যের এই তিন বৎসরের শিক্ষায় তাঁর জীবনে যে মহা শিক্ষার সূত্রপাত হয়, যে․বনেরপূর্ণতা প্রাপ্তির পূর্বে তিনি নিজেও তা বুঝতে পারেন নি।অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে তিনি কোলকাতায় যাবার কিছুকাল পরেই ১৯৩৯ খ্রিষ্টীয় সনের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধআরম্ভ হয়ে যায়। ১৯৩০ সন থেকে বিশ্বব্যাপী যে অর্থ‣নতিক মন্দা নেমে আসে এবং যে কারণে বালক বরকতউল্লাহর পড়ালেখা বন্ধকরতে হয়, ১৯৩৯ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়াতে বিশ্বব্যাপী সে অর্থ‣নতিক মন্দার বরফ গলতে আরম্ভ করে। ভারতের তদানীন্তনশাসক বৃটিশ জাতির সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান হোতা, জার্মানীর মহানায়ক এ্যাডলফহিটলারের প্রধান উদ্দেশ্য। ফলে হিটলারের আক্রমনের শিকার হিসাবেই বৃটিশ জাতিকে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়েপড়তে হয় এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রধানতম উপনিবেশ ভারতবর্ষে যুদ্ধের প্রভাব ভীষণভাবে পড়ে। তাতে করে ভারতের অর্থ‣নতিক মন্দাভাব দ্রুত কেটে যায় এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত চাকরী-বাকরীতে ভারতীয়দের অর্থ‣নতিক জীবনে তেজী ভাব দেখা দেয়। মোহাম্মদ বরকতউল্লাহ খান সেই সময়ে যুদ্ধের চাকুরী গ্রহণ করেন এবং তাঁকে মুম্বাইয়ের নাসিক চলে যেতে হয় চাকুরী উপলক্ষে।
কিন্তু কিছু দিনের ভিতর তিনি বুঝতে পারলেন, পরাধীন জাতির লোক হয়ে যুদ্ধের চাকুরীতে কোন শান্তি বা বীরত্বের মোহ নেই; শাসক জাতি বৃটিশের কৃতদাসের মত জীবন যাপন করতে হয়। তাই কিছুদিন পরে তিনি সে চাকুরী ছেড়ে মধ্যভারতের বরোদাস্টেটে এক কারখানায় চাকুরী নিয়ে বরোদা চলে যান। এই ভাবে ভারতের বহু স্থানে অবস্থান করার সুযোগ তাঁর জীবনে আসে এবংবাল্যে যে মহাশিক্ষার সূত্রপাত তাঁর জীবনে ঘটেছিল, কোন ¯‥ুল-কলেজে না পড়েও যে․বনের কর্ম-জীবনে, দেশ-বিদেশে ভ্রমনেরভেতর দিয়ে তাঁর সে মহাশিক্ষা উত্তরোত্তর বর্ধিত হতে থাকে।দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধ ছয় বৎসর ব্যাপী ইউরোপ-আফ্রিকা-এশিয়া মহাদেশত্রয় ব্যাপী ভীষণ মহা ধ্বংস সংঘটিত করে সমাপ্ত হল১৯৪৫ সনে হিটলারের পতন ও সুদূর প্রাচ্যে জাপানের আত্মসমর্পনের মাধ্যমে। কিন্তু হিটলার ধ্বংস হয়ে গেলেও ছয় বৎসরব্যাপী যেমহা তা-ব লীলা সংঘটিত করে গেল, তার ফলে যে সাম্রাজ্য থেকে সূর্য অস্ত যেতো না, সেই বৃটিশ সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে গেল।পৃথিবীর ছয় মহাদেশ ব্যাপী বিস্তৃত বৃটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশগুলি এক এক করে স্বাধীনতা অর্জন করতে লাগলো।ভারতবর্ষও স্বাধীনতা পেলো ১৯৪৭ সনে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত ইউনিয়ন নামে দুই স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় সত্বার আকারে।মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ খান তখন দেশে ফিরে এসে পূর্ব-পাকিস্তানের নারায়নগঞ্জে ইস্পাহানী জুট কোম্পানীর কারখানায় চাকুরী গ্রহণকরলেন।এ সময় হতেই তাঁর জীবনে বিরাট পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তিনি নির্জনতা পছন্দ করতেন; যখনই একাকী হতেন, গভীরচিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়তেন এবং প্রার্থনা ও কাঁদা-কাটায় লিপ্ত থাকতেন। তিনি যখন নিজের জীবন এবং এ দুনিয়ার অবিনশ্বরতাসম্বন্ধে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও পরিণতি কি, আর কিভাবেই বা তার মুক্তি হতে পারে এসব বিষয়ে কোন সুষ্ঠু সমাধানে পেঁ․ছতে নাপেরে অতি মাত্রায় ভীত-বিহ্বল হয়ে কোনও রকমে চাকুরী করে যাচ্ছিলেন, এমন সময়ে তিনি পেলেন মায়ের চিঠি, “বাবা, শীঘ্র চলেএস, তোমার সময় ঘনিয়ে এসেছে।” এমনিতেই তিনি ছিলেন চিন্তায় জর্জরিত। তার উপর মায়ের এমন চিঠি। তিনি চিঠির মর্ম কিছুইবুঝে উঠতে পারলেন না। সে যাহোক, মায়ের চিঠি পেয়েই এক মাসের ছুটি নিয়ে তিনি বাড়ী চলে এলেন। মাকে জিজ্ঞাসা করলেনচিঠির মর্ম। মা জানালেন, “বাবা, তুমি কিছু পাবে। যা-ই পাও তোমার বাকী তিন ভাইকেও কিছু দিও। তাদেরে বঞ্চিত করোনা।”
মায়ের কথা শুনে বরকত উল্লাহ খাঁন হেসে ফেললেন, “মা, আপনি কি মাটির নীচের কোন গাড়া-মাল-টালের কথা বলছেন? আমি তএসবে মোটেই বিশ্বাস করিনা।” মা তবুও জোর দিয়ে বললেন, “তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না? আমি বলছি, তুমি বিশ্বাসকর। অবশ্যই কিছু পাবে এবং তোমার চার ভাইয়ের মধ্যে তুমিই পাবে।” তখন বরকত উল্লাহ খান জিজ্ঞাসা করলেন, “মা, আপনিকি দেখেছেন বলুন।” মা তখন মরহুম শাহ সাহেব ক্বেবলার কথা জানালেন। এর পর জনাব খাঁন বললেন, “ঠিক আছে, যখন পাওয়াযায় তখনই দেখা যাবে।” এখানেই এ প্রসঙ্গ শেষ হল। তারপর এক মাসের ছুটি প্রায় শেষ হয়ে এল। আর মাত্র এক দিন বাকী। আজ শনিবার, ১লা শাওয়াল, ১৩৭০ হিজরী, ঈদুল ফিতর। বরকত উল্লাহ খান গেলেন ঈদের নামাজ পড়তে মরহুম শাহ্ শাহেব ক্বেবলার বাড়ীতে। নামাজ শেষে গেলেন হযরতশাহ্ ক্বেবলার মাযারে জেয়ারত করতে। অনেকক্ষণ ধরে দোয়া ও কাঁদা-কাটি করে বাড়ী চলে এলেন। পরদিন রবিবার, ২রা শাওয়াল,১৩৭০ হিজরী। আজই ছুটির শেষ দিন। চলে যেতে হবে চাকুরী স্থলে। যোহর নামাজ বাদ খাওয়া-দাওয়া শেষ করেছেন। এখনইকর্মস্থলে রওয়ানা হবেন। গাটরী বোচ্কা সব ‣তরী। তাঁর সঙ্গে তাঁর আপন দুই ভাই-একজন তাঁর আপন চাচাতো ভাই। চারজনইইস্পাহানীতে চাকুরী করেন। তারাও ক্সতরী। বিদায়ের পূর্বক্ষণে জনাব খাঁন মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন। কথা বলার মাঝখানেই তিনিএক অলে․কিক দৃশ্য দেখে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। কিন্তু কাউকে বললেন না একথা। শুধু বললেন, মা, আপনারা কি আমার কথাবুঝতে পারছেন? মা বললেন, কেন? কি হয়েছে? এটুকু শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বরকত উল্লাহ খাঁন অ‣চতণ্য হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পরতিনি ক্সচতণ্য লাভ করলেন। কিন্তু কে তাকে এমন করছে, তিনি কেন এমন হচ্ছেন, এর কিছুই তিনি এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না।তিনি ত অসুস্থ নন বা পূর্বে কখনও তাঁর এমন অবস্থা ঘটেনি। অথচ আজ এমন হল কেন? তিনি এর কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না।এমনিভাবে কিছুক্ষণ পর্যন্ত একবার হুশ একবার বেহুশ অবস্থায় কাটানোর পর শেষে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে বুঝতে পারলেনএর কারণ। তারপর মাকে বললেন, মা আপনি যে সম্পদের কথা বলেছিলেন তা ঠিকই। তবে তা কোন পার্থিব সম্পদ নয়, আল্লাপাকআমাকে দুই জাহানের সম্পদ এনায়েৎ করলেন।” মা বললেন, আমি তা তাসদিক করলাম। মা-ই হলেন তাঁর উপর প্রথমবিশ্বাসী। ইতোমধ্যে আশে পাশে বাড়ীর, গ্রামের অনেক লোকই তাঁর অবস্থার কথা শুনে এসে হাজির হয়েছিল। দেশবাসী সবাই তাঁরএঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল। তাঁর এই ভাব যোহর থেকে আছর পর্যন্ত বহাল থাকে। কিন্তু চাকুরী করতে হলে যে তাঁকে আজই যেতেহয়। তিনি জানালেন, অনান্য সবাই যেন চাকুরীতে চলে যায়। আজ তাঁর যাওয়া হবে না। তাঁকে পাঁচ দিন মাযারে থাকতে হবে। তিনমাযারে চলে গেলেন। পাঁচ দিন সেখানে তিনি ছিলেন। সেখানে মরহুম শাহ্ সাহেব ক্বেবলা সাহেবের ফরজন্দ বেটা-বেটী, মাদ্রাসারশিক্ষক আলেম ওলেমাবৃন্দ এবং শাহ সাহেব ক্বেবলা সাহেবের ভক্তবৃন্দ সবাই তাঁর এই ঘটনার কথা জানতে পারলেন। পাঁচ দিন পরতিনি চাকুরীতে যোগদান করলেন।
এদিন থেকেই শুরু হল তাঁর নূতন জীবন। তাঁর আসল কাজ প্রভুর নির্দেশ পালন ও বিপথগামী মানুষদেরে সত্যের দিকে
আহ্বান। আর একাজে প্রথম বাঁধ সাধলেন তাঁরই আপন ছোট ভাই। তিনি তাঁকে বারংবার সাবধান করা সত্ত্বেও সাবধান হলেন না।
অতি সত্বরই তাকে এর পরিণতি ভোগ করতে হল। সে ভাই কারখানায় এক এক্সিডেন্টে গুরুতরভাবে আহত হন এবং ঢাকা
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। আর তার পরিচর্যার জন্য কোম্পানী থেকে জনাব খাঁনকেই নিয়োজিতকরা হয়। দীর্ঘদিন থাকতে হয় এই হাসপাতালে। পরিচর্যার ফাঁকে ফাঁকে যে সময় পেতেন তার সবটুকু তিনি কাটাতেন হাসপাতালেরমসজিদে। এই সময়ই তিনি লিখেন তাঁর প্রধান গ্রন্থ “মানব জাতির মুক্তির সন্ধান”।
পূবেই উল্লেখ করা হয়েছে, এক গ্রাম্য খারেজী মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত জনাব খাঁন লেখা পড়া করেছেন। অথচ এই
গ্রন্থখানি তিনি এমন এক সময়ে লিখেছেন যখন তিনি নিয়োজিত ছিলেন মুমূর্ষ এক ভাইয়ের পরিচর্যায়, লোকজন ও সাহায্যকারী বইপুস্তকহতে সম্পূর্ণ বিছিন্ন হয়ে। আর এটি এমনি এক গ্রন্থ যে গ্রন্থে জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সামান্য অক্ষরজ্ঞান বিশিষ্ট যে কোনলোক আনায়াসে পেতে পারে নিশ্চিত মুক্তির সন্ধান।সে যাহোক, অনেক দিন রোগ ভোগের পর ভাই সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি চলে এলেন কোম্পানীর কাজে। কিন্তু দুই মনিবেরকাজ তিনি আর বেশীদিন করে যেতে পারলেন না। ১৯৫৪ সনের ২রা ডিসেম্বর চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে চলে এলেন গ্রামের বাড়ীতে।