পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করছি

বিশ্ব শান্তির পরিকল্পনা

 

যখন আমরা সবাই শান্তি চাই তখন অবশ্যই জানা দরকার বিশ্বে অশান্তির মূল কারণটা কি। অশান্তির মূল কারণ হল পরস্পর মতানৈক্য। এ কারণেই আমরা যে কোন মতবাদীই হয়ে থাকি না কেন এবং আমাদের উপদেশ যত হিতকরই হোক না কেন ব্যাপকভাবে সকল মতবাদীর লোক তা শুনতে বা মানতে রাজি হয় না এবং ঐক্য গড়তেও সক্ষম হয় না। তাই বিশ্বে আজ যথাতথা বহু উপদেষ্টা উপদেশ বিতরণ করা সত্ত্বেও সমস্যা আমাদের বেড়েই চলেছে। যেমন, যে ক্ষেত্রে ধর্মমতাবলম্বী ও রাজনৈতিক মতবাদীদের মধ্যে মতানৈক্য বিদ্যমান সেখানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আয়োজিত কোন উপদেশপূর্ণ পরামর্শ সভায় ধর্মমতাবলম্বীগণের পক্ষে উপস্থিত হওয়া বা উপদেশ গ্রহণ করা নি®প্রয়োজন মনে করা হয়। অপরপক্ষে, ধর্মমতাবলম্বীগণের আয়োজিত কোন উপদেশপূর্ণ পরামর্শ সভায় কোন রাজনৈতিক নেতা বা নেতৃবৃন্দের পক্ষে উপস্থিত হওয়া বা উপদেশ গ্রহণ করাও নিষ্প্রয়োজন মনে করা হয়। আবার যেখানে ধর্মে ধর্মে মতবিরোধ, সেখানে এক ধর্মের উপদেশপূর্ণ ধর্মসভায় অন্য ধর্মাবলম্বীগণের পক্ষে উপস্থিত হওয়া বা উপদেশ গ্রহণ করা নি®প্রয়োজন মনে করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোন হিন্দুর পক্ষে মুসলমানদের আয়োজিত কোন ধর্ম সভায় বা কোন মুসলমানের পক্ষে খ্রিষ্টানদের আয়োজিত কোন ধর্ম সভায় উপস্থিত হওয়া বা উপদেশ গ্রহণ করা পাপ মনে করা হয়। আবার, যে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে পরস্পর মতবিরোধ বিদ্যমান, এমনকি যেখানে স্বমতাবলম্বীদের মধ্যেও পরস্পর বিরোধী শাখা-প্রশাখা রয়েছে, সেক্ষেত্রে কোন শাখা-প্রশাখার উপদেশই তার বিরোধী শাখা-প্রশাখার লোকগণ শুনতে বা মানতে রাজী হয় না। তাই বিশ্বে কোথাও শান্তি কায়েম হচ্ছে না।
আরো একটি বিষয় জানা দরকার, যে কোন মানুষ তিনি যত বড় জ্ঞানী ও সাধু লোকই হোন না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি তার উপদেশ কোন ভাষণের মাধ্যমে সর্ব সম্মুখে ব্যক্ত করতে না পারেন ততক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞানীগণ তা বিচারও করতে পারেন না বা সমর্থনও করতে পারেন না। কাজেই তা কার্যকরী বা বাস্তবায়িতও হতে পারে না। যাহোক, বর্তমান বিশ্বে যদি আমারা শান্তি কায়েম করতে চাই তাহলে আমাদের সকল মতানৈক্য ত্যাগ করতে হবে। সেজন্য আমাদের এমন এক ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে যার পরামর্শ বা উপদেশ হবে সর্বকালের সকল দেশের এবং সকল মানুষের জন্য সমান উপকারী এবং যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমেও এর বিশেষ প্রয়োজনীয়তা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।
এবার আসুন, উদাহরণস্বরূপ, প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দেখা যাক তা কিরূপ। এখন প্রত্যেক মানুষের কাছে আমার প্রশ্ন ঃ-
প্রশ্ন : আপনি কি শান্তি চান?
উত্তর : হ্যাঁ, অবশ্যই চাই।
প্রশ্ন : আপনি কি ব্যাপক শান্তি চান, না আংশিক শান্তি চান?
উত্তর : ব্যাপক শান্তি চাই। (শান্তির ব্যাপকতা বলতে কি বুঝায় সে সম্বন্ধে আমরা অনেকেই অনবিজ্ঞ। তাই ব্যাপক শান্তির উপাদান কি কি এখানে তা বলে দেয়া হচ্ছে। ব্যাপক শান্তির উপাদান ছয়টি; যথাঃ- (১) যৌবন, (২) স্বাস্থ্য, (৩) স্বচ্ছলতা, (৪) সৎসঙ্গিনী, (৫) সৎপরিবেশ ও (৬) স্বাধীনতা। এই ছয়টি উপাদানের এককালীন একত্র সমাবেশই ব্যাপক শান্তির মূল। আর এর যে কোন একটি বা একাধিক উপাদানের অভাব হলেই আংশিক শান্তি)
প্রশ্ন : আপনি কি শান্তি ক্ষণস্থায়ীভাবে ভোগের জন্য চান, না চিরস্থায়ীভাবে ভোগের জন্য চান?
উত্তর : অবশ্যই শান্তি যাতে চিরস্থায়ীভাবে ভোগ করা যায় তাই চাই।
তবে শুনুন, এ পৃথিবীতে কেউ চিরস্থায়ীভাবে থাকতে পারে না, কাজেই এখানকার শান্তি চিরস্থায়ী নয়। অতএব সবাইকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, আপনারা পৃথিবীর এই ক্ষণস্থায়ী শান্তির জন্য পাগল হবেন না। কারণ, উপরোক্ত ছয়টি উপাদানের একত্র এককালীন সমাবেশে যে পূর্ণ শান্তি, সে শান্তি কখনো কোন দেশের কোন রাজা বা প্রজা, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, ধনী বা দরিদ্র কেউ পায়নি; যদিও বা কেউ কিছু পায় তবে তা স্বপ্নের মত অতি ক্ষণস্থায়ীভাবে ভোগের পরই শেষ হয়ে যায়। হে মানুষ, আপনারা কি কেউ নিজ মতে টিকে থাকতে পারছেন? কখনও নয়। আমরা প্রত্যেকেই মৃত্যুর পর স্বধর্মস্থ বিরোধী শাখাবলম্বীদের সাথে একই স্থানে মিলিত হচ্ছি, যথাঃ- কবরস্থানে বা শ্মশানে। হে মানুষ, আপনারা কি ভেবেছেন কবরস্থান বা শ্মশানই আমাদের গন্তব্যস্থান? হে আমার প্রাণের ভাইয়েরা, আমি সত্য সত্য বলে দিচ্ছি, আমাদের সকলেরই গন্তব্য স্থান এক অর্থাৎ স্রষ্টার নিকট। তিনি আমাদের জীবন দাতা এবং তিনিই আমাদের জীবন গ্রহীতা। সর্ব কালের সকল দেশের সর্ব মতের সকল মানুষই তিনি একা সৃষ্টি করেছেন, তিনি একাই জীবিত রাখছেন এবং তিনি একাই মৃত্যুর মাধ্যমে সবাইকে তাঁর কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। হে মানুষ, আপনাদের আমি সত্য সত্য বলে দিচ্ছি, এ পৃথিবী ভোগের জায়গা নয়। ইহা ‘বুঝের’ জায়গা। এখানকার সুখ বা দুঃখ কোন কিছুই স্থায়ী নয়। যেমন কেউ স্বপ্ন দেখে যে ভীষণ তুফানে পড়ে তার নৌকা ডুবে গেল, বড় কষ্ট করে সে নিজে কূলে উঠল। জেগে দেখে সে আপন বিছানায় শুয়ে আছে। এ স্বপ্নটা ক্ষণিকের জন্য হলেও সে বুঝতে পারে বিপদ কাকে বলে। আবার, অনুরূপভাবে কেউ স্বপ্ন দেখে সে খুব আরামদায়ক বালাখানায় বহু বন্ধু-বান্ধবী পরিবেষ্টিত হয়ে এক বিরাট ভোজ সভায় নানা প্রকার উপাদেয় খানা খাচ্ছে। কিন্তু জেগে দেখে সে আপন বিছানায় শুয়ে আছে। তার এই স্বপ্ন-সুখ ক্ষণস্থায়ী হলেও সে বুঝতে পারে শান্তি কাকে বলে। হে আমার ভাইয়েরা, আমি সত্য সত্য বলে দিচ্ছি, আমাদের সবারই সৃষ্টিকর্তা একজন। তিনি আমাদের সবার মালিকও বটেন। তিনি মানুষকে ভোগের জন্য এ জগতে পাঠাননি। শুধুমাত্র ‘বুঝের’ জন্য মানুষকে এ জগতে পাঠিয়েছেন। হে মানুষ, আমি সত্য সত্য বলে দিচ্ছি, সৃষ্টিকর্তা দুটি জগত সৃষ্টি করেছেন, একটি মর জগত ও অপরটি অমর জগত। সুতরাং আমাদের সবাইকে সেই অমর জগতে বসবাস করতে হবে। তথায় দু’টি ঘর বা বাসস্থান রাখা হয়েছে-একটি সুখের ঘর এবং অপরটি দুঃখের। আপনি মানুষ একা, দু’ঘরে আপনি কিছুতেই যেতে পারবেন না। হয় দুঃখের ঘরে আপনাকে যেতে হবে, না হয় সুখের ঘরে আপনাকে যেতে হবে। কিন্তু সে ঘরেরও অবশ্যই একজন মালিক আছেন। যিনি আমাদের অতীতের মালিক, বর্তমানের মালিক এবং ভবিষ্যতেরও মালিকÑ তিনিই ঐ দু’ঘরেরও মালিক। সুতরাং মালিকের বিনা অনুমতিতে আমাদের কেউ কোন ঘরেই যেতে পারব না। হে আমার ভাইয়েরা, আমি সত্য সত্য বলে দিচ্ছি, আমি কারো বিরোধী নই বা জগতের কোন মানুষকেই আমার বিরোধী বলে মনেও করি না। অতএব আমি সকলের জন্য সৎ পরামর্শ দিচ্ছি, আপনারা বিচার করে দেখুন, যে মালিকের কাছে আমাদের সবাইকে যেতে হবে, কেবল তাঁর অনুমতিতেই উক্ত দু’ঘরের যে কোন একটি ঘরেই আমাদের যেতে হবে। এ কথা কে না বুঝেন যে তাঁর প্রিয়জনকেই তিনি সুখের ঘর দেবেন, আর বাধ্যগত ব্যক্তিই প্রিয়পাত্র হয়ে থাকেন। সুতরাং আমি সবাইকেই সেই স্রষ্টা ও মালিকের বাধ্যগত ও প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। আশা করি, এ পর্যন্ত যে উপদেশ বা পরামর্শ দেয়া হল এতে কোন দেশবাসী বা কোন মতবাদী বা কোন বিরোধীবাদী কেউ একথা বলতে পারবেন না যে, এ পরামর্শ কারো জন্য নিষ্প্রয়োজন। সুতরাং সবাইকে এ পরামর্শ গ্রহণ কারার জন্য অনুরোধ করছি। আর যদি কোন ভাই একে নি®প্রয়োজন বলে মনে করেন তবে এর চেয়ে প্রয়োজনীয় ও উপকারী পরামর্শ দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।
আমি আরও পরিষ্কারভাবে বলে দিচ্ছি, সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগ না করে, তাঁর আদেশ-নিষেধ না জেনে শুধুমাত্র নিজ খেয়াল খুশীমত চলে কেউ তাঁর বাধ্যগত ও প্রিয়পাত্র হতে পারে না। তাই তিনি যুগে যুগে এক একজন মানুষকে মনোনীত করে তার মাধ্যমে জগতবাসীকে সুশৃঙ্খল করে থাকেন। সর্ব সাধারণের জন্য এটা মালিকের পক্ষ থেকে এক বিশেষ দয়া। এ ব্যবস্থা ছাড়া পথহারা মানুষ কখনও পুনঃপথ পায় না। হে জ্ঞানী মানুষ, আপনারা ভালভাবেই জানেন যে, মালিকের ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধিকে মানা আর মালিককে মানা একই কথা। সুতরাং
যে পেয়েছে একজন, সে-ই পেয়েছে নিরঞ্জন,
যে পায় নাই একজন, সে পায় নাই নিরঞ্জন।
যে পেয়েছে এখানে, সে-ই পাবে সেখানে,
যে পায় নাই এখানে, সে পাবে না সেখানে।
প্রশ্ন : এখন আমি পুনরায় সকল ভাইদের কাছে এ প্রশ্নই করছি, এ যুগের সমস্যাবলী দূর করার জন্য সমস্ত মতানৈক্য ভেঙ্গে ঐক্য গড়ে পৃথিবীতে শান্তি কায়েম করার জন্য জগদ্বাসীর মালিক যিনি, তাঁর দয়া ও সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না?
উত্তর : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে।
প্রশ্ন : মালিকের সাহায্য ও দয়া পেতে হলে তাঁর কোন প্রিয় দাসের আবির্ভাব হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না?
উত্তর : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে।
যে ভাইয়েরা পৃথিবীতে শান্তি কায়েমের জন্য মালিকের পক্ষ থেকে তাঁর এক প্রিয় দাসের আবির্ভাব হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করছেন না, তারা এ পৃথিবীতে শান্তি কায়েম করার জন্য এর চেয়ে উত্তম আর কি পরামর্শ আছে আমাকে বলুন। আর যে ভাইয়েরা পৃথিবীতে শান্তি কায়েম করার জন্য মালিকের পক্ষ থেকে তাঁর এক প্রিয় দাসের আবির্ভাব হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করছেন ইহা কার্যকরী করার জন্য তাদের আমার সাথে সহযোগীতা করার জন্য অনুুরোধ করছি। ইতিÑ

তারিখ Ñ রোজ বুধবার,
৬ নভেম্বর, ১৯৭৪ খ্রিঃ সন।
১৯ কার্ত্তিক, ১৩৮১ বাং সন।

********