বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রপতিগণের প্রতি আহ্বান

 

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি বাস্তব পরিকল্পনা

 

(গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ব্যক্তিগতভাবে লেখা অত্র চিঠিখানা গত ১২ জুলাই, ১৯৭৫খ্রিঃ তারিখে রেজিস্টার্ড ডাকযোগে পাঠানো হয়েছিল এবং তাঁর সচিবালয় হতে ১৪-৭-১৯৭৫ খ্রিঃ তারিখে স্বাক্ষরিত পত্র-প্রাপ্তির রশিদও ফেরত পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু উক্ত পত্র প্রাপ্তির এক মাস পরেই তিনি নিহত হন। এই পত্রের জবাব আর পাওয়া যায়নি।

উক্ত চিঠিখানার একটি অনুলিপি এবং ‘বিশ্ব শান্তির পরিকল্পনা’ শিরোনামে একটি প্রচার-পত্র সাবেক প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদের কাছে রেজিস্টার্ড ডাকযোগে ৪-৯-১৯৭৫ খ্রিঃ তারিখ পাঠানো হয়েছিল, তিনিও ৩-১১-১৯৭৫ খ্রিঃ তারিখে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অপসারিত হন। তাঁর কাছ থেকেও চিঠির কোন জবাব পাওয়া যায়নি।

অনুরূপ একটি চিঠি মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকেও লেখা হয়েছিল ১১-৯-১৯৭৯ খ্রিঃ তারিখে। শেষ পর্যন্ত তিনিও নিহত হন ৩০-০৫-১৯৮১ খ্রিঃ তারিখে এবং এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাঁর কাছ থেকেও কোন জবাব পাওয়া যায়নি। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে লেখা চিঠিখানা ‘শতাব্দীর সূর্য’ পত্রিকার অক্টোবর’ ৮০ সংকলনে প্রকাশ করা হয়েছে। ঙঘ ডঙজখউ চঊঅঈঊ শিরোনামে উক্ত চিঠিখানার একটি ইংরেজী সংস্করণও তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছিল।

সুতরাং পাঠক-পাঠিকাগণকে এ চিঠির বক্তব্য বিষয় যথাযথভাবে অনুধাবন করে দেখার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। – সম্পাদক)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

 

মহামান্য জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের বরাবরেষু,

শ্রদ্ধেয় বাবা,

আচ্ছালামু আলাইকুম। আপনার খেদমতে এই নগণ্য দাসের বিনীত প্রার্থনা এই যে- কিছুদিন হইতে আমার মনে একটা দুঃসহ যাতনা অনুভব করিতেছি, যাহা আপনার মত মহান ব্যক্তির নিকট জানান ব্যতীত কিছুতেই প্রশমিত হইতেছে না। আমি সরলভাবে বিশ্বাস করি, যেমনভাবে ছেলে আপন পিতার নিকট অকপটে মনোভাব ব্যক্ত করিয়া থাকে, তাহাতে যদি কোন ক্রুটিও হইয়া থাকে, পিতা তাহা ক্ষমার চক্ষে দেখিয়া থাকেন ও মঙ্গলের জন্য তাহাকে সংশোধন করিয়া থাকেন। তদ্রƒপ আমিও আশা করি, আমার লেখার ভিতর যদি কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় পিতা হিসাবে তাহা ক্ষমার নজরে দেখিবেন এবং এই নগণ্য ছেলেকে সংশোধনের ব্যবস্থা করিয়া দিবেন।

অতঃপর অধীনের নিবেদন এই-বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনে যে অশান্তি দেখা দিয়াছে কম-বেশী সকলেই ইহা অনুভব করিতে পারিতেছেন এবং ইহার প্রতিকার ও বিশ্বশান্তি কায়েমের জন্য চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ যে চেষ্টাও করিতেছেন ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। আমি সরলভাবে বিশ্বাস করি যে, এই ব্যাপারে কোন চিন্তা-ভাবনা করা আমার জন্য নি¯প্রয়োজন, যেহেতু আমার কোন যোগ্যতা বা বিদ্যা নাই। গরুর রাখালী করাই আমার কাজ। কিন্তু তবু আমার মনে এই ব্যাপারে একটা পরিকল্পনা জাগিয়া উঠিয়াছে, যদ্দরুন আপনাকে বিরক্ত করিতে বাধ্য হইয়াছি। যাহা হোক, এখন আমার পরিকল্পনাটা ব্যক্ত করিতেছি। অনুরোধ করি, দয়া করিয়া শেষ পর্যন্ত ইহা পড়িয়া দেখিবেন।

জানা দরকার যে, অশান্তির মূল কারণ হইল ঝগড়া, আর ঝগড়ার মূল কারণ হইল পরস্পর মতানৈক্য। কাজেই শান্তির মূল দাঁড়াইল উহার মীমাংসা। আরো জানা দরকার যে, মানব দেহের কোন অংশে রোগ হইলে কেবল সেই অঙ্গেরই চিকিৎসা করা হয় এবং তাহাতেই দেহ আরোগ্য হয়। কিন্তু যখন গোটা দেহটাই রোগাক্রান্ত হয়, তখন দেহের প্রাণকেন্দ্র হইতেই চিকিৎসা করিতে হয়। অনুরূপভাবেই বর্তমান বিশ্বে গোটা মানব সমাজের মধ্যেই এই মতানৈক্য জনিত ঝগড়া লাগিয়া রহিয়াছে। কাজেই গোটা বিশ্ব সমাজের প্রাণকেন্দ্র যে জাতিসংঘ সেখানেই এই মতানৈক্যের মীমাংসা করিতে হইবে। মানব সৃষ্টির পর হইতেই পরস্পর মতানৈক্য ছিল, আবার কখনো কখনো উহার মীমাংসাও হইয়াছে। এমনি ভাবেই বহু ব্যক্তির মতানৈক্য ভাঙ্গিয়া সমাজ গঠিত হইয়াছে, বহু সামাজিক মতানৈক্য ভাঙ্গিয়া রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে, আবার বহু রাষ্ট্রীয় মতানৈক্য ভাঙ্গিয়া একটি বৃহৎ সমাজ বা জাতিসংঘ গড়িয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তবুও একটা বড় রকমের মতানৈক্য লাগিয়াই আছে। এতদিনে উহার মীমাংসার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়াছে এবং মীমাংসার সুযোগও আসিয়া পৌঁছিয়াছে।

আমার ভক্তিভাজন পিতা! আমার প্রতি রাগ করিবেন না, আমি ক্ষমা চাহিতেছি, আমি সরলভাবে বিশ্বাস করি যে আসমান ও জমিনের অবশ্যই একজন মালিক আছেন। আমি সেই মালিকের ইঙ্গিতেই আপনাকে লিখিতেছি।

এখন জানা দরকার যে, সেই মতানৈক্য কিসের উপর। উহা হইল সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে। বর্তমান বিশ্বের এক শ্রেণীর লোক বিশ্বাস করে যে, সৃষ্টির একজন স্রষ্টা আছেন, অপর শ্রেণীর বিশ্বাস এই যে, বিশ্বের কোন স্রষ্টা নাই। আর ইহাও অতি সত্য যে দুই বিপরীত বিশ্বাসে বিশ্বাসী ব্যক্তির মধ্যে প্রকৃত বন্ধুত্ব বা ভ্রাতৃত্ব গড়িয়া উঠিতে পারে না যতক্ষণ না এক ব্যক্তির বিশ্বাস বা মত ত্যাগ করা হয়।

যাহা হোক, এই বিশ্বাসের মতানৈক্যই দ্বন্দ্বের মূল এবং ইহার শাখা-প্রশাখার মতানৈক্য আজ বিশ্বজোড়া বিরাজমান। যেমন, স্রষ্টা বিশ্বাসীগণের মধ্যেও সকলের মত এক নহে। যথাঃ হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান ইত্যাদি। আবার প্রতিটি বিশ্বাসী দলের মধ্যেও বিভিন্ন মতাবলম্বী শাখা-প্রশাখা রহিয়াছে। কাজেই বিশ্বজোড়া যে মতানৈক্য বিরাজমান তার মূলও একটাই। সুতরাং ঐ একটি মাত্র মতানৈক্যের মীমাংসা হইলেই বিশ্বে শান্তি আসিবে ইনশাআল্লাহ্।

এখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, উহার মীমাংসা করিবেন কে? যেহেতু উভয় দিকেই শক্তিশালী লোক বিদ্যমান আছে। ইহার উত্তরেও আমি বলিতেছি, শ্রদ্ধেয় জতির পিতা! আমি জানি যে আপনি হজরত মোহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লামের প্রতি বিশ্বাসী। হজরত মোহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লাম বলিয়াছেন “এক দিনের আদালত ষাট বৎসরের এবাদত।” সুতরাং সেই মীমাংসার ব্যাপারে আপনাকে শরিক হইতে অনুরোধ করিতেছি। হে পিতা! আমি সরলভাবে বিশ্বাস করি যে হজরত মোহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লাম সত্য ও শেষ নবী। আমি তাঁহার এক নগণ্য দাস। সেই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লামের উছিলায় ও তাঁহার প্রতাপশালী প্রভুর ইঙ্গিতেই আপনার মত মহৎ ব্যক্তিকে বিরক্ত করিতে সাহস করিয়াছি। অতএব আপনি সেই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লামের খাতিরে এই আলোচনার প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে মর্জি ফরমাইবেন। আমি বিশ্বাস করি, যদিও এক শ্রেীর লোক স্রষ্টায় অবিশ্বাসী, কিন্তু তাহারা একেবারে অজ্ঞ নয়। তাহাদের মধ্যে বহু বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক আছেন। কিন্তু তাহারা যে সন্দেহে পড়িয়াছেন তাহার মূলে রহিয়াছে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসীগণের মধ্যে বিরাজমান পরস্পর মতানৈক্য। কেননা, যখন কোন জ্ঞানবান লোক চিন্তা করেন যে, কর্তা ছাড়া কোন কর্ম হইতে পারে না, তখন স্বাভাবিক ভাবেই এই চিন্তাও জাগে যে, আমি কিভাবে অস্তিত্ববান হইলাম এবং আমারও একজন কর্তা আছেন কিনা? কিন্তু যখনই চিন্তা করেন যে, সেই স্রষ্টার সাথে সম্বন্ধকৃত হওয়ার পথ কোন্টি, তখনই তাহারা বিভ্রাটে পড়েন। যেহেতু বিশ্বে স্রষ্টা-বিশ্বাসী যত লোক আছেন সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেন যে সৃষ্টিকর্তা একক ও অদ্বিতীয়, অথচ সেই স্রষ্টার পথে চলিতে গিয়া একজন অপর জনকে পথভ্রষ্ট বা কু-আখ্যায় আখ্যায়িত করিয়া গালাগালি বর্ষণ করিয়া থাকে। এই সব দেখিয়াই জ্ঞানী লোকগণ স্রষ্টা-বিশ্বাসীগণের সাথে একমত হইতে পারিতেছেন না। কিন্তু বৈজ্ঞানিকগণ এমন পাগল নহেন যে, ন্যায় কথাটাও তাহারা বুঝিতে পারিবেন না। যাহা হোক, এখন আমি আল্লা-পাকের মর্জিতে একটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করিতেছি। বর্তমান বিশ্বে যদি আমরা শান্তি কায়েম করিতে চাই তাহা হইলে আমাদের সকল মতানৈক্য ত্যাগ করিতে হইবে। সেই জন্য আমাদিগকে এমন এক ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করিতে হইবে যাহার পরামর্শ হইবে সর্বকালের সকল দেশের ও সকল মানুষের জন্য সমান উপকারী এবং তাহা যুক্তি প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হইতে হইবে। যেমন-

প্রশ্ন – আপনি কি শান্তি চান?

উত্তর –   হ্যাঁ, অবশ্যই চাই।

প্রশ্ন – আপনি কি ব্যাপক শান্তি চান, না আংশিক শান্তি চান?

উত্তর –   ব্যাপক শান্তি চাই। (ব্যাপক শান্তির উপাদান ছয়টি; যথাঃ- (১) যৌবন, (২) স্বাস্থ্য, (৩) স্বচ্ছলতা, (৪) সৎসঙ্গিনী, (৫) সৎপরিবেশ ও (৬) স্বাধীনতা)

প্রশ্ন – আপনি কি শান্তি ক্ষণস্থায়ীভাবে ভোগের জন্য চান, না চিরস্থায়ীভাবে ভোগের জন্য চান?

উত্তর –   অবশ্যই শান্তি যাহাতে চিরস্থায়ীভাবে ভোগ করা যায় তাহাই চাই।

তাহা হইলে শুনুন, এই পৃথিবীতে কেহই চিরস্থায়ীভাবে থাকিতে পারে না, কাজেই এখানকার শান্তি চিরস্থায়ী নয়। অতএব সৃষ্টিকর্তা জানাইতেছেন, “হে মানুষ! আমি দুইটি জগত সৃষ্টি করিয়াছি। একটি মর জগত ও অপরটি অমর জগত। সুতরাং সকল মানুষকেই একদিন সেই অমর জগতে বসবাস করিতে হইবে। তথায় দুইটি ঘর বা বাসস্থান রাখা হইয়াছে – একটি সুখের ঘর ও অপরটি দুঃখের ঘর। মানুষের কাম্য বস্তু যে ব্যাপক শান্তি তাহা সেই চিরস্থায়ী জগতের সুখের ঘরে রাখা হইয়াছে। বাধ্যগত ব্যক্তিদিগকেই সেখানে প্রবেশ করাইব।”

শ্রদ্ধেয় বাবা! আমাকে ক্ষমা করিবেন, যেহেতু আপনাকে বিরক্ত করিতেছি। কিন্তু ইহা আমি বিশ্ববাসীর মঙ্গলের জন্য বিশ্ববাসীর মালিকের আদেশেই লিখিতেছি।

এখানে একটি উপমা দিতেছি ঃ ধরুন, চারিজন মানুষ। তাহাদের গন্তব্যস্থল এক এবং তাহাদের কাম্য বস্তুও এক। তাহারা বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গন্তব্য স্থানের দিকে চলিতেছিল, কিন্তু পথিমধ্যে সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার রাত্রিতে পথের ব্যাপারে তাহাদের মধ্যে মতানৈক্য ঘটিল। তখন চারিজন চারিদিকে মুখ করিল। আর প্রত্যেকেই নিজেকে সঠিক ও অপরকে দিগ্ভ্রান্ত ভাবিতে লাগিল। এমতাবস্থায়, কেহই কাহাকেও ডাকিয়া আপনার সাথে মিলাইতে পারিবে না। কেননা, তাহাদের সঙ্গে অদৃশ্য একজন সাথী জুটিয়াছে। সে-ই প্রত্যেকের মন আপন আপন দিকে কঠিন করিয়া দিয়াছে, যাহাকে আমরা ‘দিয়াভুলা বা কানাওলা’ বলিয়া থাকি। যাহা হোক, বস্তি হইতে তখন এক ব্যক্তি বাহির হইয়া আসিল। তাহার হাতে একটা উজ্জ্বল বাতি ছিল। সে ওই চারিজনকে ডাকিয়া নিজের দিকে আনিল ও বাতির আলো দ্বারা পথের কিছু নিদর্শনও দেখাইল। তারপর সে নিজে পথ দেখাইয়া আগে আগে চলিল। এইভাবে তাহারা বিপদ হইতে রক্ষা পাইল।

ইহার তাৎপর্য এই যে, সকল মানুষেরই গন্তব্য স্থান সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত। আর সকলেরই কাম্য বস্তু ব্যাপক শান্তিপূর্ণ সেই সুখের ঘর। কিন্তু পথ চলিতে যাইয়া কেহ এক ধর্মে বিশ্বাসী হয়। আবার কেহ অপর ধর্মে বিশ্বাসী হয়। আর প্রত্যেকেই আপনাকে সঠিক ও অপরকে দিগ্ভ্রান্ত মনে করিয়া থাকে। তাই কাহারো ডাকে কেহ সাড়া দিতে বা ঐক্য গড়িয়া চলিতে রাজী হইতে পারিতেছে না। এই জন্যই বর্তমান পৃথিবীতে অশান্তি বিরাজ করিতেছে। কাজেই এই যুগে ঐরূপ আলো বিশিষ্ট এক ব্যক্তির আশু প্রয়োজন। আর সেই আলো কোন অগ্নি বা বৈদ্যুতিক আলো নহে। বরং উহা হইতেছে অকাট্য যুক্তিপূর্ণ জ্ঞানের আলো। এই জ্ঞান মানুষ হইতে শিক্ষালব্ধ অর্জিত জ্ঞান নহে। বরং ইহা হইতেছে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ঐশ্বরিক জ্ঞান। যেমন তিনি বলিয়াছেন, ‘আল্লাহু নুরুচ্ছামা ওয়াতে অল্ আরদে’ – তিনি আসমান ও জমিনের আলো। এই কারণেই পৃথিবীবাসী গন্তব্য স্থান সম্বন্ধে যতবার মতানৈক্যজনিত ঝগড়ায় লিপ্ত হইয়াছে, ততবারই তিনি তাঁহার সেই নূরের আলো দ্বারা পৃথিবী হইতে এক একজন জীবিত মানুষকে নিযুক্ত করিয়াছেন এবং জগদ্বাসীর ঝগড়ার মীমাংসা করিয়া তাহাদিগকে একতাবদ্ধ করত গন্তব্য স্থানের সন্ধান দিতে আদেশ করিয়াছেন। যাহা হোক, পূর্বকালে যোগাযোগের অভাব হেতু জগত খ- খ- ছিল। তাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খ-ের জন্য বিভিন্ন মীমাংসাকারক নিযুক্ত করিয়াছেন। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবী যোগাযোগের দিক দিয়া এত উন্নতি লাভ করিয়াছে যে, সমস্ত জগতটা আজ এক সমাজের অন্তর্ভুক্ত হইয়া পড়িয়াছে, যেমন-জাতিসংঘ। বর্তমান পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নাই যাহা জাতিসংঘকে জানে না বা জাতিসংঘও যাহাদিগকে জানে না। বর্তমান জগতে যতগুলি প্রসিদ্ধ ধর্মমত প্রচলিত আছে তাহা জাতিসংঘের জানা আছে এবং ধর্মীয় মতানৈক্যজনিত যে ঝগড়াও  বিদ্যমান আছে তাহাও তাহাদের জানা আছে। অথচ এই ঝগড়া মিটাইবার ক্ষমতা জাতিসংঘ তথা পৃথিবীবাসীর আওতার বাহিরে। ইহার মীমাংসা করার ক্ষমতা একজনেরই আছে; তিনি হইলেন আসমান ও জমিনের মালিক। তিনিই আসমানী মীমাংসার প্রস্তুতি নিয়াছেন।

হে আমাদের জাতির পিতা! বাংলার নয়নমণি! আমার অপরাধ ক্ষমা করিবেন। আমি আপনাকে বহু বিরক্ত করিতেছি। বাবা, আমি সত্য বলিতেছি, এই লেখার পিছনে তাঁহারই ইঙ্গিত রহিয়াছে যাঁহার হাতে আমার জীবন ও মরণ এবং তাঁহার নিকটই আমাকে যাইতে হইবে। সুতরাং আমি তাঁহাকে ভয় করি। আমি সেই প্রতাপশালী আল্লাহ পাকের পক্ষ হইতে আসমানী মীমাংসার পদ্ধতি দেখাইতেছি। যথা –

বাংলাদেশের পক্ষ হইতে জাতিসংঘকে এইরূপ অনুরোধ করা যে জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ সদস্য রাষ্ট্রের বিশিষ্ট মতবাদীগণের মধ্য হইতে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণকে লইয়া একটা বিশেষ সভার আয়োজন করা। অতঃপর আসমানী মীমাংসা সম্বন্ধে নিম্নোক্ত আকারে স্বীকারোক্তি করা, যথা – “আমরা সকলেই স্বীকার করিতেছি যে, আমাদের সৃষ্টিকর্তা একজন এবং তিনিই আমাদিগকে অনস্তিত্ব হইতে অস্তিত্ববান করিয়াছেন। তিনিই মৃত্যু দ্বারা আমাদিগকে তাঁহার কাছে লইয়া যাইবেন। সুতরাং তাঁহার বাধ্যগত থাকা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। কাজেই তাঁহার মনোনীত মত ও পথে চলার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে যে মতপার্থক্য ঘটিয়াছে ইহার মীমাংসার জন্য তাঁহার পক্ষ হইতে যে ব্যক্তি আদেশপ্রাপ্ত হইয়াছেন বলিয়া আপন দাবী পেশ করিবেন আমরা বিনা দ্বিধায় তাঁহাকে মানিয়া লইব এবং তাঁহার পরামর্শ অনুসারে কাজ করিয়া ঐকমত্য গড়িয়া তুলিব।” এই স্বীকারোক্তি লিখিতভাবে রাখিতে হইবে যে, “তিনি (আদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তি) যে কোন দেশবাসী বা যে কোন মতবাদীই হউন না কেন আমরা তাঁহাকে গ্রহণ করিতে বাধ্য থাকিব। যেহেতু সৃষ্টিকর্তা যখন একজন তিনি একজনকেই নিযুক্ত করিবেন।”

অতঃপর জাতিসংঘ হইতে একটা সময় সীমা নির্ধারণ কয়িা জানাইয়া দিতে হইবে যে, এমনি দাবীদার ব্যক্তি তিনি যেখানেই থাকুন না কেন তাহাকে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই দাবী পেশ করিতে অনুরোধ করা। উক্ত মেয়াদ পর্যন্ত কাগজ, বেতার ও টেলিভিশন মারফত এই সংবাদ প্রচার করিতে থাকা। যদি কেহ এই নির্দিষ্ট সময়ের পরে দাবী পেশ করে তবে তাহা অগ্রাহ্য করা। তারপর উক্ত দাবীদারদের সত্যতা প্রমাণের জন্য নিম্নলিখিত শর্তগুলি প্রয়োগ করা, যথা ঃ- (১) তাহার বয়স ৪০ (চল্লিশ) বৎসরের কম হইবে না, (২) সৃষ্টিকর্তার পরিচয় দিতে হইবে, (৩) উক্ত প্রত্যাদেশ অন্ততঃ ১২ (বার) বৎসর পূর্ব হইতে পাইয়া থাকিবেন এবং এই সময়ের মধ্যে কি কি কালচার করিয়াছেন তাহা দেখাইতে হইবে, (৪) প্রত্যাদেশ প্রাপ্তির পূর্ব হইতে তাঁহার উপর কোন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটিয়াছে কি না তাহা জানাইতে হইবে, (৫) তাহাকে সত্যবাদী বলিয়া পরিচিত হইতে হইবে, (৬) তাহাকে চরিত্রবান বলিয়া পরিচিত হইতে হইবে এবং (৭) তাহাকে জ্ঞানবান বলিয়া পরিচিত হইতে হইবে।

আর একথাও অতি সত্য যে উপরোক্ত চিহ্ন বিশিষ্ট মানুষ সৃষ্টিকর্তার খাস দয়া ও ইচ্ছা ব্যতীত সাধনার বলে কেহ হইতে পারে না। এখন আমি আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিনের পক্ষ হইতে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, যদি উপরোল্লিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তবে ইনশাল্লাহ সেই মানুষও পাইবেন এবং ইনশাল্লাহ বিশ্বে শান্তিও কায়েম হইবে। সঙ্গে সঙ্গে এই কথাও ঘোষণা করা হইতেছে যে ইহা কার্যকরি না করা পর্যন্ত পৃথিবীতে খাঁটি শান্তি কায়েম হওয়া অসম্ভব। যাহা হোক, এই ব্যাপারে যদি বিস্তারিত কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করেন তাহা হইলে আপনার অনুমতি পাইলে এই নগণ্য দাস আপনার খেদমতে হাজির হইতে আগ্রহী।

এখন আমার শেষ বক্তব্য, শ্রদ্ধেয় জাতির পিতা! আমার মনোভাব আপনার নিকট ব্যক্ত করা হইল। এখন ইহা কার্যকরি করার ব্যাপারে আপনার বিবেচনার জন্য পেশ করিলাম।

আরজ ইতি –

তারিখ, ঢাকা,                     বিনীত নিবেদক –

২ আষাঢ়, ১৩৮২ বাং                   মোঃ বরকত উল্লাহ খান

১৭ জুন, ১৯৭৫ খ্রিঃ                      গ্রাম-রামনাথপুর

ইস্যু করার তারিখ                   ডাকঘর-গালিমপুর

১২ জুলাই, ১৯৭৫খ্রিঃ                     থানা-নবাবগঞ্জ