পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করিতেছি।
যাহাকে মানিতে হয় তাহাকে প্রথম জানিতে হয়
যাহাকে মানিতে হয় তাহাকে প্রথম জানিতে হয়। সুতরাং আমরা যখন সৃষ্টিকর্তাকে মানিতে চাই তখন সর্ব প্রথম সৃষ্টিকর্তাকে জানা একান্ত দরকার। সৃষ্টিকর্তাকে জানার ব্যাপারে একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া হইতেছে। আপনি যে কোন রাষ্ট্রে বাস করুন না কেন সেই রাষ্ট্রের অবশ্যই একজন রাষ্ট্রপতি আছেন, ইহা আপনি অবশ্যই বিশ্বাস করেন। একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি যে একাধিক হইতে পারেন না- ইহাও আপনি বিশ্বাস করেন এবং রাষ্ট্রপতি যে কোন গাছ বা মূর্তি বা কোন ফটোগ্রাফ নয় বরং একজন জীবন্ত মানুষ- ইহাও আপনি বিশ্বাস করেন। শুধু এতটুকু বিশ্বাস দ্বারাই যে আপনি রাষ্ট্রপতিকে চিনিয়াছেন তাহা বলা যায় না। বরং তাহার কিছু গুণাগুণ সম্পর্কেও অবহিত থাকিতে হইবে। যেমন, রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ ক্ষমতাশলী ব্যক্তি, জনগণের কল্যাণকর সংবিধান রচনা করার পূর্ণ ক্ষমতা তাঁহার আছে এবং জনগণের স্বার্থে সংবিধানের যে কোন আইন বা ধারা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা রহিত করার অধিকারও তাঁহার আছে- এসবই বিশ্বাস করিতে হইবে। উদাহরণ স্বরূপ, গতকল্য যে পথে চলাচল বৈধ্য ছিল, কোন কারণ বশত আজ হয়ত সেইখানে ‘কারফিউ’ – চলাচল অবৈধ। ইহাও বিশ্বাস করিতে হইবে যে, উক্ত ক্ষমতা রক্ষা করার জন্য তাঁহাকে তিনটি গুণের অধিকারী হইতে হইবে। যথা – (১) পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্ঞান থাকিতে হইবে; (২) তাঁহার বাক শক্তি থাকিতে হইবে এবং (৩) দৃষ্টিশক্তিও থাকিতে হইবে। কারণ, উক্ত তিনটি গুণের যে কোন একটির অভাব হইলে তাঁহার পক্ষে রাষ্ট্রপতির পদ রক্ষা করা সম্ভব নয়। যে কোন জ্ঞানবান লোক ইহা বিশ্বাস করিতে বাধ্য।
এইবার চিন্তা করুন, এই পৃথিবীটা কতটুকু। সূর্যের তের লক্ষ ভাগের এক ভাগ যে পৃথিবী তাহার কেবল এক-চতুর্থাংশ স্থল ভাগ। এর মধ্যেই শত শত রাষ্ট্র। আর নাম মাত্র এক টুকরা জমির উপর ক্ষমতাসীন যে মালিক তাঁহাকেই যদি এতগুলি গুণের অধিকারী হইতে হয়, তাহা হইলে যিনি এই পৃথিবীর সম্পূর্ণ জল ও স্থল ভাগ, উর্ধ্বাকাশের চন্দ্র, সূর্য, অগণিত গ্রহ নক্ষত্র এবং দৃশ্য ও অদৃশ্য অসংখ্য জীব ও বস্তুর উপর ক্ষমতাসীন মালিক তাঁহার জন্য কি উক্ত গুণ তিনটি থাকা একান্ত প্রয়োজন হইবে না? তাই সৃষ্টিকর্তাকে মানিতে হইলে প্রথম আমাদের এক বাক্যে স্বীকার করিতে হইবে যে তিনি স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং সর্ব গুণের অধিকারী এক বাস্তব সত্তা।
রাষ্ট্রপতি ও বিশ্বপতির মধ্যে প্রভেদ কি? রাষ্ট্রপতি সসীম, যেহেতু তিনি জন্মের মাধ্যমে স্থায়ী হন এবং মৃত্যুর মাধ্যমে লয় প্রাপ্ত হন। আর বিশ্বপতি অসীম, যেহেতু তিনি জন্ম ও মৃত্যুর আওতার বাহিরে। যে কোন রাষ্ট্রপতি বা তিনি যে কেহ হোন, প্রত্যেকের জীবনই ধার করা ও অস্থায়ী। সুতরাং তাহার গুণাবলী ও ক্ষমতা সবই ধার করা এবং অস্থায়ী। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব তাঁহার নিজস্ব। কাজেই তাঁহার সমস্ত গুণাবলী ও ক্ষমতাই নিজস্ব ও চিরস্থায়ী। এইবার বিশেষভাবে লক্ষ্য করুন, যে কোন রাষ্ট্রপতিই হোন, তিনি তাহার এই সসীম রাষ্ট্র পরিচালনা করার সময়েও যদি বিকৃত মস্তিষ্ক হইয়া পড়েন, তাহা হইলে তিনি আর রাষ্ট্রপতি থাকিতে পারেন না। যদি অন্ধ হইয়া পড়েন তবুও না, যদি মূক বা বোবা হইয়া পড়েন তবুও রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করিতে বাধ্য। আর যদি মরিয়া যান তবে ত কোন কথাই নাই। যদি কোন রাজা-বাদশাহ্ মরিয়া গেলেও তাহার মূর্তি বা ফটোগ্রাফ দ্বারা রাজত্ব পরিচালনা করা সম্ভব হইত, তাহা হইলে কোটি কোটি রাজা-বাদশাহ্ বা রাষ্ট্রপতির জন্ম হইত না। পক্ষান্তরে, সৃষ্টিকর্তার যদি মৃত্যু হইত বা তাঁহার জ্ঞান লোপ পাইয়া যাইত বা তাঁহার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হইয়া যাইত অথবা তিনি বাকশক্তিহীন হইয়া মূক বা বোবা হইয়া যাইতেন তাহা হইলে সৃষ্টিকর্তার সিংহাসনেও কোটি কোটি সৃষ্টিকর্তা সমাসীন হইতেন।
সুতরাং সৃষ্টিকর্তা চিরস্থায়ী এবং তাঁহার জ্ঞানও চিরস্থায়ী, দৃষ্টিশক্তিও চিরস্থায়ী এবং বাক্শক্তিও চিরস্থায়ী; কখনও তাঁহার কথা বন্ধ হয় নাই, এখনও না, ভবিষ্যতেও বন্ধ হইবে না। সৃষ্টিকর্তা ইচ্ছাময়। তিনি যখন যাহা ইচ্ছা করেন তাহাই করিতে সক্ষম। সুতরাং যাহারা সৃষ্টিকর্তাকে মানে অথচ তাঁহার কোন গুণকে অমান্য করে তাহাদের সৃষ্টিকর্তা মানাতে ত্রুটি আছে।
মানুষ সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছামত চলিয়া তাঁহার প্রিয়পাত্র হইতে ইচ্ছা করে। অথচ সৃষ্টিকর্তা যদি নিজের ইচ্ছা মানুষকে না জানান, তাহা হইলে মানুষ কী করিয়া তাঁহার ইচ্ছা অবগত হইবেন? মনে করুন, রাষ্ট্রপতির সংবিধান থাকা সত্ত্বেও যদি কোন ব্যাপারে মতানৈক্য ঘটে তাহা হইলে কে ভুল বুঝিল আর কে ঠিক বুঝিল তাহা বুঝাইয়া দেওয়ার জন্য এবং জনগণের ঐক্য বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রপতিকে উপদেশ দিতে হয় এবং বিশেষ প্রয়োজন হইলে কোন কোন আইন রদবদলও করিতে হয়। এই বিশ্বাস যদি রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য হয়, তাহা হইলে বিশ্বপতির ব্যাপারে তাহা গ্রহণযোগ্য হইবে না কেন? খ্রিষ্টানদের এই বিশ্বাস আছে যে, “সৃষ্টিকর্তাকে কেহ জানিতে পারে না জ্ঞান দ্বারা বা কোন সাধনা দ্বারা অথবা তীর্থ গমন দ্বারা; তবে যদি সৃষ্টিকর্তা কাহাকেও নিজের বাক্য দ্বারা অবগত করান তবেই জানিতে পারে। যেমন তিনি পূর্বে মানুষের সাথে কথা কহিলেন, যথা নূহের সাথে, ইব্রাহীমের সাথে, মুছার সাথে। অবশেষে তিনি যীশুর সাথে কথা বলিয়া শেষ করিলেন। তাই আর তিনি কথা বলিতে পারিবেন না।” ইহাতে যে সৃষ্টিকর্তার উপর কত বড় দোষ চাপান হইতেছে তাহা তাহারা বুঝে নাই। যেহেতু যদি তিনি মূক বা বোবা হইয়া কথা বলা বন্ধ করেন, তাহা হইলে তাঁহার সৃষ্ট রাজ্যের গদিতে কি তিনি আর অধিষ্ঠিত থাকিতে পারেন? মুসলমানগণও বিশ্বাস করেন যে, সৃষ্টিকর্তাকে অর্থ দ্বারা, শক্তি দ্বারা অথবা ক্রন্দন দ্বারা ধরা যায় না, তবে যদি তিনি সকাশে আসিয়া ধরা দেন তবেই তাঁহাকে পাওয়া যায়। অতএব সৃষ্টিকর্তা যে সর্বদাই কথা বলিতে এবং স্বীয় ইচ্ছা ব্যক্ত করিতে পারেন ইহাই যথার্থ সত্য। ইতি –