কি এবং কেন?
_মোঃ বজলুর রশীদ
পরম দয়াময় ও করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে
একটা বাড়ি, একটা গাড়ি ও একটা নারী অনেকের জীবনের কাম্য বস্তু। কারো কারো ভাগ্যে এ সবের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও কাউকেই স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখা যায় না। আমরা প্রত্যেকেই ছুটে চলেছি নিত্য নতুন নেশায়। কোথায়? তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। এক আশার নিবৃত্তি হতে না হতে আর এক নতুন আশার পিছনে ধাওয়া করছি। কবি গুরুর ভাষায় তাই বলতে হচ্ছে –
“বাঁধি যারে ধরে তার মাঝে আর
রাগিনী খুঁজিয়া পাইনা,
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।”
এই চাওয়া ও পাওয়ার ভুলের আবর্তে পড়ে জীবন নিঃশেষ করে দেয়াই কি মানব- জীবনের কাম্য বস্তু? অনেককেই এ প্রশড়ব করেছি। উত্তর পেয়েছি, বুঝতে পেরেছি, দিগ্ভ্রান্ত পথিক আমরা সবাই। কিন্তু সত্যিই কি আমাদের জীবনের স্থির কোন লক্ষ্য নেই? লক্ষ্য অবশ্যই আছে, তবে সেদিকে আমরা কেউ যেতে চাইনে, চোখ বুঁজে আমরা তা এড়িয়ে যেতে চাই। কিন্তু আমরা না চাইলেই কি সত্যটা মিথ্যে হয়ে যাবে বা মিথ্যাই সত্যের স্থান দখল করে নিয়ে স্থায়ীভাবে শেকড় গেড়ে বসবে? ‘আফাহাসিবতুম আনড়বামা খালাকনাকুম আবাছাও ওয়া আনড়বাকুম এলাইনা লা তুরজাউন’- “তোমরা কি ভেবেছ আমি তোমাদেরে খামাখাই সৃষ্টি করেছি আর (জীবনের হিসাব নেয়ার জন্য) আমার কাছেই কি তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে না?” সুতরাং আমাদের লক্ষ্য সম্বন্ধে আমরা যতই উদাসীন থাকি না কেন, আমাদের লক্ষ্য কিন্তু স্থির হয়েই আছে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারলে কৈফিয়ত আমাদের অবশ্যই দিতে হবে।
আমাদের লক্ষ্য সম্বন্ধে আমরা এত উদাসীন কেন? এ লক্ষ্য বস্তুটি কি আমাদের জীবনের প্রয়োজনীয় কোন বস্তু নয়? বিশ্ব-বিধাতা কি মানব-স্বভাব ও আকাঙ্খার বিপরীত এমন কোন বস্তু জোর করে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন যে জন্য আমরা এর প্রতি এত নিষ্পৃহ? এ লক্ষ্য বস্তুটি অর্জনের চেষ্টা করার মধ্যে কি এমন কোন আনন্দ, শান্তি বা পরিতৃপ্তি নেই, যা নারী, গাড়ি বা বাড়ির মধ্যে পাওয়া যায়? তা হলে ত বলতে হয়, সৃষ্টিকর্তা আমাদের উপর জুলুম করেছেন; অর্থাৎ মানব মন যা চায় না তাই অন্বেষণ করার তাগিদ করে সৃষ্টিকর্তা আমাদের উপর অত্যাচার করেছেন (নাউযুবিল্লাহে মিন জালিক)। বিশ্ব- বিধাতা ত বার বার ঘোষণা করেছেন, ‘আমি জালেম নই’। তিনি যদি জালেম না হয়ে থাকেন, অবশ্যই তিনি তা নন, তা’হলে আমাদের জন্য তাঁর প্রদত্ত লক্ষ্য উপেক্ষা করে চলে আমরা নিজেরাই কি জালেমে পরিণত হচ্ছি না? এবং জালেমের জন্য নির্ধারিত যে শাস্তি আমরাই কি সেই শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত পাত্র নই? তবে হ্যাঁ, তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি অতি মেহেরবান। তাই তিনি তাঁর জালেমে বান্দাদের শাস্তি দেয়ার পূর্বে তাদেরকে সতর্ক করার জন্য এক একজন সতর্ককারী প্রেরণ করে থাকেন। বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ পৃথিবীতে তেমন একজন সতর্ককারীর আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করে নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আসনড়ব ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই সমিতি বিশ্ব-বাসী সবাইকে সাদর আহ্বান জানাচ্ছে। এবার আসুন, দেখা যাক, এই সমিতির উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং শিক্ষা কি এবং তা কতদূর যুক্তিসংগত ও কার্যকর।
মানবজাতির কাম্য বস্তু সম্বন্ধে সমিতির লক্ষ্য হল, ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি অর্জন। পরকালের মুক্তি বর্জিত শুধু ইহকালের শান্তি অথবা ইহকালের শান্তি বর্জিত শুধু পরকালের মুক্তি অর্জন সমিতির লক্ষ্য নয়। এখন যদি কেউ পরকালের মুক্তি সম্বন্ধে নিশ্চিত কোন ব্যবস্থা করে নিয়ে নারী, গাড়ি ও বাড়ির পেছনে দৌড়ায়, তাতে এ সমিতির বিশেষ কোন আপত্তি নেই। কিন্তু যদি কেউ পরকালের মুক্তি সম্বন্ধে নিশ্চিত কোন ব্যবস্থা না করেই নারী, গাড়ি ও বাড়ির পেছনে দৌড়ায় তাহলে বুঝব সে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকেই দৌড়াচ্ছে। এমন লোক তিনি যে কেউ হোক না কেন, যত উচ্চ শিক্ষা বা মর্যাদার দাবীই তিনি করুন না কেন বা তিনি যত বড় আদর্শবাদী নেতা বা রাষ্ট্র নায়কই হোন না কোন, তিনি সমাজের জন্য এক জঘণ্য আদর্শ। তেমন আদর্শ মানবের জন্য অনিবার্য ধবংসই ডেকে আনবে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে বর্তমান মানবসমাজ এ রোগেই বেশী আμান্ত এবং সমাজ এক অনিবার্য ধ্বংসের দিকেই দ্রুত ধাবিত হচ্ছে।
দ্বিতীয়তঃ এ সমিতি চাচ্ছে বিশ্ব মানবের ঐক্য। হয়ত প্রশড়ব করবেন, এ আবার কেমন কথা হল? বিশ্ব মানবের ঐক্য গড়া কি সম্ভবপর? তা’হলে শুনুন সমিতির পক্ষ থেকে এর পাল্টা প্রশড়ব আমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে ইহকালের শান্তি ও পরকারের মুক্তি চায় না? যদি আমাদের সকলের লক্ষ্য ও কাম্য বস্তু এক হয়ে থাকে, তাহলে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারব না কেন? যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারি তা হলে কি এ প্রমাণিত হবে না যে আমরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেছি? লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যাওয়া মানে সত্যিকার ভাবেই জালেমে পরিণত হওয়া, আর জালেমে পরিণত হওয়া মানে ধ্বংসের দিকেই আমাদের ছুটে যাওয়া; এবং আমাদের এ ধ্বংসের জন্য আমরাই দায়ী তা নয় কি? সুতরাং হে মানব জাতি, বিশ্ববাসীর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার কথা শুনে যারা একে অসম্ভব ও অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন, তারা একবার চিন্তা করে দেখুন, আপনারা কোন্ ধ্বংসের দিকে ছুটে চলেছেন। সুতরাং সাবধান! এ সেই সুমহান সত্ত্বারই সাবধান বাণী, এ সাবধান বাণী উপেক্ষা করে এড়িয়ে যেয়ে বেঁচে যাবার পথ চিরতরে রুদ্ধ।
তৃতীয়তঃ পূর্বেই উল্লেখ করেছি, সমিতি চাচ্ছে বিশ্ব মানবের ঐক্য। কিন্তু ‘ঐক্য ঐক্য’ বলে চেঁচালেই কি ঐক্য এসে যাবে? এর জন্য প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু নীতিমালা। কি এই নীতিমালা কে এর প্রণয়ন কর্তা আর কি-ইবা এর প্রয়োগ কৌশল। পৃথিবীতে নীতি উপদেশ আর উপদেশ দাতা ত কম নেই! কোন নীতি বা কোন নেতাকে অনুসরণ করে চললে বিশ্ব মানবের ঐক্য গড়া সম্ভব হবে? দুনিয়া জাহানে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? খেয়ে – ২৫৭ – পরে বাঁচতে হলে আমাদের কতকগুলো রাষ্ট্রীয় বিধান মেনে চলতেই হয়, তার জন্য স্বীকার করে নিতে হয় একজন রাষ্ট্রীয় নেতা। পক্ষান্তরে, মৃত্যুর পরের কথাও কমবেশী আমাদের চিন্তা করতে হয়, তখন কি একজন ধর্মীয় নেতার কথাও চিন্তা না করে থাকতে পারি? তা’হলে একই সঙ্গে আমরা দু’দুজন নেতাকে মেনে চলছি। এখন প্রশড়ব এ দু’জন নেতার মধ্যে বা এ দুজনের নীতিমালা বা মতের মধ্যে কি কোন সংঘাত বা বিরোধ নেই? সংঘাতের সময় আমরা কাকে বাদ দিয়ে কাকে মান্য করে চলি? উত্তর অতি সহজ, যে দিকে স্বার্থ দেখি সে দিকেই নিঃসন্দেহে ঝুঁকে পড়ি। তা হলে এতে কি স্রষ্টার পূজা হয়, না স্বার্থের পূজা হয়? সুতরাং এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে যে আমরা স্রষ্টার পূজা ছেড়ে স্বার্থের পূজা করে চলেছি, যদিও ধর্মের কিছু আবরণ গায়ে আঁটা থাকে। বর্তমান পৃথিবীতে এমন কোন দেশ আছে কি যেখানে রাষ্ট্রীয় বিধান পালন করলে ধর্মীয় বিধান পালিত হয়? বা ধর্মীয় বিধান পালন করলে রাষ্ট্রীয় বিধানও পালিত হয়? এক কথায় এমন কোন নেতা আছেন কি যাকে অনুসরণ করলে দ্বীন ও দুনিয়া উভয় জগতের বিধান প্রতিপালিত হয়; অর্থাৎ ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি সুনিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে? আমি ত বলি নেই। তবে এমন কেউ আছেন বলে যদি কেউ মনে করেন, তা’হলে তাঁর উচিত আমাদের তাঁর সন্ধান দেয়া। প্রকৃত পক্ষে আমাদের জন্য এমন একটা নীতিমালা বা মত ও পথ থাকা উচিত যা মেনে চললে আমাদের ইহকালের শান্তিও কায়েম হবে এবং পরকালের মুক্তিও সুনিশ্চিত হবে। যখন আমরা একটি মাত্র নীতিমালা বা মত ও পথ মেনে চলতে যাব, তখন আমাদের একজন মাত্র নেতাকেই অনুসরণ করতে হবে। এক নেতার পরিবর্তে দু’জগতের জন্য দু’নেতার অনুসরণ করতে গেলেই আমাদের অবস্থাটা হবে এক নারীর দু’পতির মন যুগিয়ে চলার মত। কোন নারীর পক্ষেই যেমন দু’পতির মন যুগিয়ে চলা সম্ভব নয়, তদ্রƒপ কোন মানুষের পক্ষেই সুষ্ঠুভাবে দু’নেতার মন যুগিয়ে চলা সম্ভব নয়। তা’ করতে গেলেই লাগবে সংঘাত, হবে রক্তা-রক্তি। আর এখানেই হচ্ছে ‘শেরেকীর’ উৎপত্তি। প্রকৃতপক্ষে, দু’নেতার অনুসরণ করতে যেয়ে আমরা অবিসংবাদিতভাবে শেরেকীতে লিপ্ত হয়ে পড়ছি। সুতরাং বিশ্ব মানবের ঐক্য গড়তে হ’লে অবিসংবাদিতভাবে আমাদের একজন মাত্র নেতারই আনুগত্য ও অনুসরণ করতে হবে, যদি আমরা ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি পেতে চাই। অন্যথায় আমাদেরে শেরেকীর মহাপাপে জড়িত হতে হবে। জানি, এখানেও প্রশড়ব উঠবে, এটা কি সম্ভবপর যে বর্তমান পৃথিবীর পাঁচ শত কোটি, পনের-কুড়ি বছর পরে হাজারাধিক কোটি লোকের পক্ষে একজন মাত্র নেতাকে অনুসরণ করে চলা! এর উত্তর-
প্রথমতঃ বর্তমান পৃথিবীতে এমন অনেক রাষ্ট্র আছে যেখানে লোকসংখ্যা হাজারের কোটাও ছাড়ায়নি। কতক রাষ্ট্র আছে যেখানে মাত্র কয়েক লক্ষ লোকের বাস। এ সমস্ত দেশের লোকের কাছে কয়েক কোটি লোকের দেশের সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা অসম্ভব বলে মনে করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কয়েক কোটির স্থলে যেখানে প্রায় শত কোটি লোকের বাস সেখানেও একটি শাসন ব্যবস্থা রয়েছে। কয়েক হাজার লোকের দেশের জন্য যেমন একজন মাত্র নেতা বা রাষ্ট্র নায়কের আনুগত্য স্বীকার করে চলতে হচ্ছে; তেমনি শত কোটি লোকের দেশের জন্যও একজন মাত্র নেতা বা রাষ্ট্রনায়কের আনুগত্য স্বীকার করে চলতে হচ্ছে। আরও দেখা যাচ্ছে, বর্তমান বিশ্বে দু’ প্রধান শিবিরের মাত্র দু’জন নেতার পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ প্রভাব কম-বেশী কার্যকর হচ্ছে। আরও স্পষ্টভাবে, সমস্ত বিশ্বের – ২৫৮ – একটিমাত্র সংস্থার উপর আনুগত্য স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, যদিও বাস্তবে তা পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না। এই সংস্থাটিকে পুরোপুরি ক্ষমতা দিয়ে কার্যক্ষম করলে তার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার বাঁধাটা কোথায়?
দ্বিতীয়তঃ প্রাচীন কালে অশ্বই যেখানে একমাত্র দ্রুতগামী বাহন ছিল, সেখানে সুদূর গ্রীক থেকে পাক-ভারত (ভারতবর্ষ) পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার এবং সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা যদি সম্ভবপর হয়ে থাকে, তা’হলে বর্তমানের এই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির যুগে একজন মাত্র নেতার অধীনে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা সম্ভবপর না হওয়ার কারণ কি? এইত মাত্র কিছু কাল পূর্ব পর্যন্ত প্রবাদ বাক্য ‘বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না’ এটাই বা সম্ভবপর হয়েছিল কিভাবে?
তৃতীয়তঃ মানুষ হিসেবে আমাদের সকলের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যখন এক ও অভিনড়ব, অর্থাৎ আমরা সবাই যখন ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি চাই, আরো পরিষ্কার ভাবে, আমরা সবাই যখন আসছি একই জায়গা থেকে এবং আমাদের সবাইকে যেতেও হবে একই জায়গায়, তখন একই নেতার অধীনে একই নীতি পালন করে বিশ্ববাসীর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বাঁধাটা কোথায়?
কতকগুলো স্বতঃসিদ্ধ সত্য আছে যা মেনে নিলে বা স্বীকার করে নিলে শেষ পরিণতিতে একীভূত হওয়ার পূর্বেই অর্থাৎ এই মুহূর্ত থেকে অতি সহজেই আমরা একীভূত হতে পারি এবং উদ্দিষ্ট কাম্যবস্তু ও আমরা লাভ করতে পারি। এরূপ হওয়াই আমাদের জন্য স্বাভাবিক এবং আমরা যে বিবেক সম্পনড়ব ও বুদ্ধিমান মানুষ, তা’র যথার্থতা প্রমাণিত হবে। আর আমরা যদি এই স্বতঃসিদ্ধ সত্যগুলো অস্বীকার করি বা মেনে না নেই, তা’হলে সেটাই হবে আমাদের জন্য অস্বাভাবিক এবং বিবেক-বুদ্ধিহীন অমানুষের পরিচয়। আমাদের মধ্যে কে চায় বিবেক-বুদ্ধিহীন অমানুষ হতে এবং আমাদের যা আসল কাম্যবস্তু তা’ থেকে বঞ্চিত হতে?
এ লেখার প্রথম দিকেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমাদের জীবনের কাম্যবস্তু ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি। আমাদের মধ্যে যা’রা পরকাল বিশ্বাস করে না, তা’দের মধ্যেও এমন কেউ আছে কি, যে অন্ততঃ ইহকালের শান্তিও কামনা করে না? উত্তর অবশ্যই হবে ‘নেই’। তা’হলে শান্তির প্রশেড়ব জগদ্বাসী কারো দ্বিমত নেই। এখন সম্ভব- অসম্ভবের প্রশড়ব আপাততঃ বাদ দিয়ে বলুন, জগদ্বাসী সকলের একমত হওয়া বা এক পথ বা এক নীতি অবলম্বন করা কি শান্তির সহায়ক, না অসহায়ক? পৃথিবীতে এমন কেউ আছে কি যে একমত হওয়া বা এক পথ, এক নীতি অবলম্বন করে চলাকে শান্তির অসহায়ক মনে করবে? সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য যে ঐক্যই শান্তির সহায়ক। যদি কেউ এর বিপরীত মনে করে, তবে তা কি ভুল হবে না? জেনে-শুনে ভুল করা বা ভুলকে সমর্থন করা কি বিবেক-বুদ্ধিসম্পনড়ব মানুষের কাজ হবে? উত্তর, নিশ্চয় না। তা’হলে আমরা কি ঐক্যের বিপরীত মনোভাব পোষণ করে বিবেক-বুদ্ধিহীন অমানুষে পরিণত হওয়াকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করব? জেনে-শুনে আমরা কেউ এমন ভুল করে অমানুষ হতে চাইব না, তা’ নয় কি? পূর্বে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, একজন মানুষ কখনো একই সময়ে দু’জন নেতাকে সমভাবে মেনে চলতে পারে না, যেমন একজন স্ত্রী একই সময়ে দু’জন স্বামীকে খুশী করতে পারে না। যদি আমরা কেউ এরূপ করতে চাই, তা’হলে দু’জনের টানা-পোড়েনে আমাদের জীবন হয়ে যাবে দুর্বিসহ। বর্তমান বিশ্বে তা-ই চলছে। আমাদের অবস্থা তখন হবে ‘না ঘরকা না ঘাটকা’র মত। তা’হলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে জীবন যাপন করতে হ’লে একাধিক নেতার স্থলে আমাদের সবাইকে মাত্র একজন নেতাকেই অনুসরণ ও অনুকরণ করে চলতে হবে। এর বিপরীত হলে অনৈক্য-অশান্তিই সৃষ্টি হবে। বর্তমান বিশ্বে তা-ই চলছে। উপরোক্ত আলোচনা হ’তে আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি, কোন্ পথে চললে মনুষ্যত্ব অর্জিত হ’বে বা বজায় থাকবে, আর কোন্ পথে চললে মনুষ্যত্ব বর্জিত হ’বে বা অমনুষ্যত্ব বজায় থাকবে। বর্তমান পৃথিবীতে আমরা যত কোটি মানুষই থাকিনা কেন, এই নিরিখে প্রত্যেকেই নিজে নিজের বিচার করলে সে নিজেই বুঝতে পারবে, সে কোন্ শ্রেণীতে আছে। সে অতি সহজেই বুঝতে পারবে, সে কি মনুষ্য শ্রেণীতেই আছে, না অমানুষের শ্রেণীতে আছে। আমরা ত মনে করি, জগদ্বাসী আমরা সবাই মনুষ্য শ্রেণীতেই আছি, তবে অজ্ঞতাবশতঃই হোক বা অভ্যাসবশতঃই হোক মনুষ্যত্ব মাপার মাপ কাঠিটি না জানার কারণে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ অমানুষ শ্রেণীতে আছে; তা’হলেও এ শ্রেণীতে থাকার ইচ্ছা আমাদের মোটেও নেই এবং এ শ্রেণীর একজন হিসেবে পরিচিতিও হ’তে চাইনে, তা নয় কি? তবে আমরা এও জানি, (এখানেও প্রশড়ব হতে পারে যে,) উপরে সৎ ও অসতের, মানুষ ও অমানুষের যে ফর্মুলাটি দেয়া হয়েছে, এ ফর্মুলাটিই যে চুড়ান্ত, এর বাইরে অন্য কোন ফর্মুলা থাকতে পারে না, বা ফর্মুলাটি না মানলে আমরা অমানুষ শ্রেণীতে পড়ব, আর মানলেই সব সৎ ও সাধু হয়ে মনুষ্য শ্রেণীতে উন্নীত হব- এ ব্যাপারে চুড়ান্ত রায় ঘোষণা করার অধিকার আমাদেরকে কে দিয়েছে? এ সম্বন্ধে আমাদের একমাত্র বক্তব্য, তা’হলে এই যে, আপনারা দেখুন, রায় যা দেয়া হয়েছে, তা’ ঠিক কি অঠিক। রায়টা যদি ঠিক হয়েছে বলে মনে করেন, তা’হলে আপনার কি কর্তব্য তা’ আপনিই ঠিক করবেন। আর যদি রায়টা ভুল হয়েছে বলে মনে করেন, তা’হলে কি ভুল, কোথায় ভুল, কেন ভুল, তা’ আমাদেরকে জানিয়ে সংশোধন করা আপনাদের দায়িত্ব। শুধু তাই নয়, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে পদ্ধতিটা উপরে দেখানো হয়েছে, তা’র চেয়ে উত্তম আর কি পদ্ধতি আছে, সেটা দেখানোও আপনাদের দায়িত্ব। আমাদেরকে শুধু ভুল বলবেন, কিন্তু কেন ভুল, কোথায় ভুল, তা দেখাবেন না, বা শুদ্ধ কোনটা তাও দেখাবেন না, তা’হলে আপনার ‘ভুল’ বলাটাও যে ভুল এবং অহমিকাপূর্ণ তা’ই প্রমাণিত হ’বে না কি? আমরা যে ঐক্যের কথা বলছি, তা’ স্তুপীকৃত লৌহ শেকলের পরস্পর বিচ্ছিনড়ব রিং এর একত্র সমাবেশ করা নয়, বরং প্রত্যেকটি রিং এর সাথে প্রত্যেকটি রিং এরই পরস্পর আন্তঃবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। এরূপ তখনই হ’তে পারে, যখন আমার মত ও পথ এবং আপনার মত ও পথ একই মত ও পথ হ’বে এবং এই ঐকমত্যটি আমার এবং আপনার জীবনের চেয়েও বেশী মূল্যবান ও পবিত্র বলে গণ্য হ’বে। অর্থাৎ আমার বা আপনার জানমাল- ইজ্জত শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আমার ও আপনার মতের মধ্যে কোন পার্থক্য সৃষ্টি হ’বে না। যদি কখনো আমাদের মতের মধ্যে কোন পার্থক্য সৃষ্টি হয়, তখন একজন তা’র নিজের মত পরিত্যাগ করতঃ দ্বিতীয় জনের মতের সঙ্গে মত মিলিয়ে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য জীবন-পণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে। এরূপ একতা কায়েম করা সহজসাধ্য নয়। এরূপ একতা কায়েম করতে গেলে কোন কোন সময় নেমে আসবে জীবনের উপর দুর্বিসহ ক্লেশ-যাতনা, লজ্জা ও অপমান। তবুও মানব গোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থে আপন ব্যক্তিত্ব ও স্বার্থ নির্দিধায় বিসর্জন দেয়ার মত হৃদয়ের বল ও উদারতা থাকা অপরিহার্য। এরূপ হৃদয়বান মানুষ পাওয়া যদিও অকল্পনীয়, তবুও যে একেবারে নেই, তা’ নয়। এর যথেষ্ট উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাওয়া যায়। এর উদাহরণ দেখা যায় বিশ্বের বিস্ময়, শত শত গোত্র-বংশে বিভক্ত, অসভ্য, বর্বর, হিংস্র, স্বাধীনচেতা, মরু-সাইমুমের মত উচ্ছৃঙ্খলবিশৃক্স খল আরব বেদুইনদের কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় শৃঙ্খলিত ও ঐক্যবদ্ধ এক সুসভ্য জাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যে। হজরত মোহাম্মদ (দঃ)র অনুসারীদের মধ্যে যে মতানৈক্য বা মতবিরোধ হত না, তা’ মোটেও নয়। তা’দের পরস্পরের মধ্যে যত মতবিে রাধ হত না কেন, তা’দের বিরোধের বিষয় হজরত মোহাম্মদ (দঃ)র কাছে উত্থাপিত হওয়ার পর তিনি যে রায় দিতেন সে রায়ই ছিল চুড়ান্ত, বাদী-বিবাদী উভয়ের জন্য অকপট চিত্তে গ্রহণ ও পালনযোগ্য। এর অন্যথা হবার বিন্দুমাত্রও অবকাশ ছিল না। হজরত মোহাম্মদ (দঃ) ছিলেন তাদের মধ্যে চুড়ান্ত মীমাংসাকারক। তাই তা’র মতের উপর অনুসারীগণ আপন আপন স্বাধীন মত বিসর্জন দিয়ে তা’র সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। তা’দের পরস্পরের মধ্যকার বন্ধনও ছিল জীবনের চেয়েও পবিত্র ও প্রিয়। তাই তা’দের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল এক পেয়ালা পানি দিয়ে এক দল যুদ্ধাহত মুমূর্ষের তৃষ্ণা নিবারণ করা; তা’দের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল অঙ্গুলী সংকেত বংশপরম্পরায় রক্ষিত কৌলিন্যের দম্ভ পরিহার করে কৃতদাসের নেতৃত্বে জীবন উৎসর্গ করা, তা’দের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল অপরাজেয় সিপাহশালার হয়ে নিঃশঙ্কচিত্তে খলিফার নির্দেশ শিরোধার্য করে সামান্য সৈনিকের বেশে নেমে যাওয়া। এটা সম্ভব হয়েছিল, যেহেতু তা’রা এক মহা-মানবের সংস্পর্শে এসে তা’রাও হয়েছিলেন এক একজন মহৎ হৃদয়ের অধিকারী, বৃহত্তর স্বার্থে আপন আপন মত ও পথ ইজ্জত ও সম্পদ বিসর্জন দিয়ে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ‘অতাছিমু বিহাবলিল্লাহে জামিয়াও অলা তাফার্রাকু’- এর সত্য অনুসারী। সুতরাং গোত্র-বংশে শতধা বিভক্ত একটি অশিক্ষিত অসভ্য বর্বর উচ্ছৃঙ্খল হিংস্র জাতির পক্ষে যদি একজন মাত্র নেতার অধীনে এক মত-এক পথ অবলম্বন করে পৃথিবীর সুসভ্য সেরা জাতিতে পরিণত হওয়া অসম্ভব কিছু না হয়ে থাকে, তা’হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষা-সভ্যতা সংস্কৃতিতে চরম মার্গে উনড়বীত বর্তমান বিশ্ববাসীর পক্ষে তেমনিভাবে একজন নেতার অধীনে একমত একপথ অবলম্বন করে বিশ্ব ঐক্য গঠন করে বিশ্বশান্তি কায়েম করার প্রচেষ্টাকে অসম্ভব, অবাস্তব, অকার্যকর, উদ্ভট কল্পণা রূপে হাস্যস্পদ মনে করা ও উপেক্ষা করার পশ্চাতে কোন স্বতঃসিদ্ধ সত্য ও যুক্তি রয়েছে তা’ কেউ মেহেরবানী করে জানাবেন কি? এর পশ্চাতে অনেককে একথাও বলতে শুনা যায় যে, সৃষ্টির পর হ’তে পৃথিবীতে যা সম্ভব হয়নি, তা’ ভবিষ্যতে সম্ভব হতে পারে না। আসলে এটা কোন যুক্তিও নয় এবং কোন স্বতঃসিদ্ধ সত্যও নয়। আশা করি পাঠকদের অনেকেই অতি সহজে এ কথার অজস্র প্রতি উত্তর দিতে সক্ষম হবেন। এখানে আমি মাত্র দু’একটি নাম উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হচ্ছি। যেমন ধরুন, অতীতে কি চন্দ্রে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল? টেলিভিশন, ক্যামেরা, টেপরেকর্ডার আবিষ্কার, মানুষের আকাশে উড়া, মহাশূণ্যে স্কাইল্যাব স্থাপন, কৃত্রিম উপগ্রহের মাধমে বিশ্বের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন, রাডার, কম্পিউটার, মিসাইল, এমন আরো অজস্র বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির – ২৬১ – আবিষ্কার কোন অতীতে সম্ভবপর হয়েছিল? অতীতে এর একটিও যখন সম্ভবপর ছিলনা, এমন কি এর কোন একটির কল্পণাও কেউ কোনদিন করতে পারেনি, কিন্তু বর্তমানে আমরা যখন এ সবেরই অজস্র ব্যবহার সম্ভবপর দেখছি, তখন বিশ্ব মানবের ঐক্য ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার বেলায়ই কেবল এটিকে আমরা এক বাক্যে অসম্ভব, অবাস্তব ও উদ্ভট কল্পণা রূপে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছি কোন জ্ঞানে এবং কোন যুক্তিতে? সুতরাং অতীতে হয়নি বলে এখন তা’ হতে পারবে না এ যুক্তি আদৌ কোন যুক্তি হিসেবে বিবেচিত হ’তে পারে কি? বিশ্ব শান্তির পরিকল্পনাটিকে অসম্ভব, অবাস্তব, উদ্ভট কল্পণা বলে মনে করার পশ্চাতে আরও একটি কারণ হয়ত থাকতে পারে। তা’ হল এই যে, বর্তমান পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পনড়ব লেখক, চিন্তাবিদ, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, রাজনীতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের কারো মাধ্যমে এরূপ একটি পরিকল্পনা প্রকাশিত না হয়ে এমন লোকের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে যিনি যথার্থই একজন উম্মি, নিরক্ষর সদৃশ অতি সাধারণ গেঁয়ো লোক। সুতরাং উচ্চ শিক্ষিত প-িত বা বিশ্ব কাঁপানো মহা প্রভাব ও প্রতাপশালী নেতৃবৃন্দকে যদি তেমন একজন উম্মি লোকের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য জ্ঞান, বুদ্ধি, শক্তি খরচ করতে বলা হয়, তা’হলে তাদের এত বিদ্যা, বুদ্ধি, পা-িত্য, ঐশ্বর্য, শক্তি ও ক্ষমতার ইজ্জত আর থাকে কোথায়? তাই যতদিন প-িতের পা-িত্য বা শক্তের শক্তি অটুট থাকবে, ততদিন একজন উম্মি লোকের পরিকল্পনা- তা’ যত কল্যাণকর, হিতকর ও যু্িক্তসংগত হোক না কেন, তা’কে অসম্ভব, অবাস্তব, উদ্ভট কল্পণারূপে উড়িয়ে দেয়া যথার্থ যুক্তিসংগতই বটে! সুতরাং এমন একটি পরিকল্পনা এত সহজেই বাস্তবায়িত হ’বে মনে করা নির্বুদ্ধিতারই পরিচায়ক! আর যিনি এমন একটি পরিকল্পনার উদ্ভাবক, তিনি একজন নির্বোধ বই তো নয়! “এত এত চিন্তাবিদ, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, রাজনীতিক, কুটনীতিক, এত এত শক্তি, সামর্থ ও সম্পদ ব্যয় করেও বিশ্ব শান্তি কায়েম করতে যেয়ে এক একজন হিমসিম খাচ্ছেন, সেখানে কিনা একজন সহায়সম্ব লহীন দূর্বল, অশিক্ষিত লোক বিশ্বশান্তি কায়েমের জন্য তাঁর পিছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে! তাঁ’র মত এমন একজন নগণ্য লোকের পক্ষে বিশ্বশান্তি কায়েমের প্রচেষ্টা করা পাগলামী বই ত নয়! সুতরাং তাঁ’র পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণ অসম্ভব ও অবাস্তব! হ্যাঁ, এটা একটি যুক্তি বটে! কিন্তু এ যুক্তি যারা দেখাচ্ছেন তা’রা যত পা-িত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির দাবীই করুন না কেন, মনে হচ্ছে, অতীত ইতিহাসের পাঠ তা’রা সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন। তা’দের এমন ধারা যুক্তি কিন্তু এই প্র ম শোনা যাচ্ছে না। যদিও সর্বক্ষেত্রে অতীতকে আমরা পদাঘাত করে বহু দূরে ঝেড়ে-মুছে সাফ করে দিয়ে আসছি, এই একটি ব্যাপারে কিন্তু অতীত ঐতিহ্যকে আমাদের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরে থাকতে বিন্দুমাত্রও লজ্জা বোধ করছি না; বরং বর্তমান সভ্যতার বাহকদের মুখে অতীত কথা ও বাগধারার এমন পূর্ণাঙ্গ পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করলে সত্য সত্যই বিস্ময়বোধ না করে পারা যায় না। অথচ এটা এমন একটি ঘটনা যা পৃথিবী পৃষ্ঠে এত এত বার সংঘটিত হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববাসী প্রতিবারই বার বার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করছে। আমরা না অত্যাধুনিক সভ্যতার ধারক ও বাহকরূপে পশ্চাতে থু ু ছিটিয়ে প্রাচীনতার নাম-গন্ধ সব মুছে ফেলে দিতে গর্ব অনুভব করছি? অথচ কি বৃদ্ধ, কি যুবা, কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত সবারই অন্তরে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে সেই একই প্রাচীন বুলি, হাস্য-বিদ্রƒপের সেই আদিম হিংস্রতা। এরই নাম কি আধুনিকতা? আমাদের ভুলেরও এরূপ পুনরাবৃত্তি হ’তে দেখেই বিশ্বপ্রভু বলছেন, “ইয়া হাস্রাতান আলাল এবাদ, মাইয়াতিহিম মির রাছুলেন ইল্লা কানু বিহি ইয়ায্তাহ্ জেউন” – “বান্দাদের জন্য আফসোস! এমন কোন মহামানব (প্রেরিত পুরুষ) আসেননি যা’র সঙ্গে তার জামানার লোকেরা হাস্য-বিদ্রুপ না করেছে।” এখানেও হয়ত অনেকে বলবেন, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই যখন বান্দাদের ব্যবহারে আফসোস করেছেন, তখন আপনি আর কি করবেন? হাঁ, আমাদের করার কিছু না থাকলেও, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনিও কি কিছু করতে পারবেন না? বরং বান্দাদের জন্য আফসোস করেই কি তিনি তার কর্তব্য সমাধা করেছেন? তার আফসোসের মূল কারণ ত এই যে, এতভাবে বলা কওয়া সত্ত্বেও শেষ পরিণতি সম্বন্ধে তারা মোটেও সতর্ক হচ্ছে না। তারা কি দেখতে পাচ্ছে না নূহের কওমের সঙ্গে, আদ জাতি, ছামুদ জাতির সঙ্গে, নমরুদ-ফেরাউনের সঙ্গে, লুতের কওম, শোয়াইবের কওমের সঙ্গে আমি কিরূপ ব্যবহার করেছি? অতীতে এ সমস্ত জাতিদের সঙ্গে আমি যেরূপ ব্যবহার করেছি তা থেকে তোমাদের কি শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত নয়? তা থেকে তোমরা যদি কোন শিক্ষাই গ্রহণ না করে সেই একই পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে চাও, তাহলে তোমাদের জন্য আফসোস করা ছাড়া আর কি করার আছে? হাঁ, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে শুধু আফসোস আর আফসোস!
যাহোক, উপরোক্ত দীর্ঘ আলোচনার সারসংক্ষেপ এই যে, ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি অর্জনই মানুষের কাম্য বস্তু, একতা হলো ঈপ্সিত শান্তির প্রম ও প্রধান উপাদান এবং একজন মাত্র নেতার অধীনে এক মত এক পথ অনুসরণ করাই হলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যথার্থ উপায়। সুতরাং শান্তি ও মুক্তির মূল হচ্ছে ব্যক্তি ও সমষ্টিগতভাবে একজন মাত্র নেতার আনুগত্য স্বীকার করে চলা। বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতি এ সত্য মেনে নিয়ে সংগঠিত হয়েছে এবং বিশ্ববাসী সবাইকে এ সত্যের দিকে আহ্বান জানাচ্ছে। কোন সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টিতে যদি এ সত্যের মধ্যে কোন প্রকার ভুল আছে বলে ধরা পড়ে বা এ সত্যের উর্ধ্বে আরো কোন সত্য আছে বলে তাদের জানা থাকে, মেহেরবাণী করে আমাদের তা জানানোর জন্য বিশেষ অনুরোধ রইল।
আলোচ্য বিষয়টি পূর্ণভাবে হৃদয়াঙ্গম করার উপায় হিসেবে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। বর্তমান পৃথিবীতে প্রধানত দু’শ্রেণীর লোক দেখা যায়, এক শ্রেণী সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী, অপর শ্রেণী সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী। সৃষ্টিকর্তায় যারা অবিশ্বাসী তাদের প্রসংগ আপাততঃ বাদ দিয়ে অন্ততঃ যারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী, তাদের নিয়ে কিছু আলোচনা করছি। আমরা যারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী, সৃষ্টিকর্তার সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান ও ধারণা কতটুকু? সৃষ্টিকর্তার পূর্ণ পরিচয় জানা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না হলেও যে বিশ্বাসের বলে আমরা নিজেদেরকে বিশ্বাসীরূপে প্রকাশ করছি, সে সম্বন্ধে অন্ততঃ একটা সুষ্ঠু ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক। যেমন ধরুন, আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, অবিভাজ্য, অতুলনীয়, অপরিবর্তনশীল, চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী, স্বয়ং-সক্ষম, স্বয়ং-সম্পূর্ণ, ইচ্ছাময়, বাস্তব এক ব্যক্তি। তিনি অসৃষ্ট সবকিছুই তারই সৃষ্ট। বিশ্ব রাজ্যের তিনি একমাত্র রাজাধিরাজ, যাকে ইচ্ছা তিনি রাজত্ব দান করেন যা’হতে ইচ্ছা করেন রাজত্ব কেড়ে নেন। যাকে ইচ্ছা তিনি ইজ্জত দান করেন, যা’হতে ইচ্ছা করেন ইজ্জত কেড়ে নেন। তার হাতেই সমস্ত মঙ্গল, সবকিছুর উপরেই তার অপ্রতিহত ক্ষমতা সর্বদা বিদ্যমান। তিনি রাতকে দিবসে, এবং দিবসকে রাতে পরিবর্তিত করেন; তিনি জীবিতকে মৃত এবং মৃতকে জীবিত করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা বেসুমার রুজি দান করেন। তিনি যার কাছে ইচ্ছা করেন স্বীয় ইচ্ছা বা অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে পারেন। যাকে ইচ্ছা করেন তাকেই মনোনীত করতে পারেন। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন তাকেই স্বীয় শক্তি থেকে আহ্বানকারী, শুভসংবাদাদাতা ও ভয়প্রদর্শনকারী নিযুক্ত করতে পারেন। যাকে ইচ্ছা তাকেই তিনি গুঢ়-তত্ত্ব, জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তাঁর মনোনীত বান্দাই দুনিয়ার বুকে তাঁ’র প্রিয়তম বান্দা। এই প্রিয়তম বান্দাই দুনিয়ার বুকে তাঁ’র স্থলাভিষিক্ত। এই বান্দার আনুগত্যই সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য এবং এই বান্দার প্রতি অস্বীকৃতিই সৃষ্টিকর্তার প্রতি অস্বীকৃতি। এই বান্দার প্রিয়পাত্র হওয়াই সৃষ্টিকর্তার প্রিয়পাত্র হওয়া এবং এই বান্দার প্রতি শত্রুতাই সৃষ্টিকর্তার প্রতি শত্রুতা। সৃষ্টিকর্তা যেমন এক, তাঁ’র মনোনীত বান্দাও এক যুগে একজনই হয়ে থাকেন, একাধিক হ’তে পারেন না। একাধিক হ’তে গেলেই লাগবে সংঘাত, সৃষ্টি হ’বে বিবাদ-বিসম্বাদ। জগদ্বাসী যখন ভিনড়ব ভিনড়ব মত পোষণ করে ভিনড়ব ভিনড়ব দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে, সৃষ্টিকর্তা তখনই তাঁ’র পক্ষ থেকে জগদ্বাসীদের মধ্য হ’তে একজনকে মনোনীত করে একমত ও একপথের উপর জগদ্বাসীদের ঐক্যবদ্ধ করে থাকেন। মানব সৃষ্টির পর হ’তেই এই বিধান তিনি কায়েম করে আসছেন, এখনও এই বিধানই কার্যকর, ভবিষ্যতেও এই বিধানই কার্যকর থাকবে। বর্তমান যুগে এক শ্রেণী যদিও এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী, কিন্তু তাঁ’কে পাওয়ার পথ সম্বন্ধে বিশ্বাসীদের মধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পরস্পরের মত ও পথ পরস্পরের মত ও পথের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং পরস্পর ঘোর বিরোধে লিপ্ত; অথচ তারা প্রত্যেকেই দাবী করছে, তারা এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী এবং তারা প্রত্যেকেই সৃষ্টিকর্তার প্রিয়পাত্র, অথচ পরস্পর পরস্পরকে পথভ্রষ্ট গোমরাহ বলছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে এক অভিনড়ব। সত্যের সাথে সত্যের কোন বিরোধ থাকতে পারে না। অথচ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, সত্যের দাবী করে প্রত্যেকে পরস্পর ঘোর বিরোধে লিপ্ত; সুতরাং এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে যে এরা প্রত্যেকে সত্যচ্যুত। অর্থাৎ যদিও তারা এক স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী বলে দাবী করছে, কিন্তু তারা ‘যেরূপ’ স্রষ্টায় বিশ্বাসী ‘সেরূপ’ স্রষ্টার অস্তিত্ব কি যথার্থই বিদ্যমান আছে? স্রষ্টা সম্বন্ধে আমরা যে যেরূপ কল্পণা বা ধারণা করছি, স্রষ্টা কি আমাদের কল্পণা বা ধারণার অনুরূপই? অন্ধের হস্তী দর্শন আংশিক সত্যের অনুরূপ হলেও যেহেতু হস্তী ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য, বিভাজ্য প্রাণী; তা’ সত্ত্বেও যখন উক্ত দর্শন পূর্ণ সত্যের বিরোধী, তখন অতীন্দ্রিয়, অবিভাজ্য, অশরীরি স্রষ্টা সম্বন্ধে আমাদের সকল কল্পণা ও ধারণা কিরূপে সত্যাশ্রয়ী হ’তে পারে যতক্ষণ না তিনি স্বয়ং তাঁর পরিচয় কাউকে জ্ঞাপন করান? এরূপ লক্ষ্য করেই তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয় কল্পণা সত্যের স্থান পূর্ণ করতে পারে না’ ‘কোন কোন কল্পণা পাপ’, ‘তারা শুধু কল্পণার অনুসরণ করছে’, ইত্যাদি। অলীক কল্পণাকেই সত্য খোদারূপে মান্য করে চলছি বলেই আমাদের এক এক জনের জন্য এক এক ‘খোদা’ সৃষ্ট হয়ে আজ বিশ্বে কোটি কোটি মানুষের জন্য কোটি কোটি স্রষ্টা ‘এক স্রষ্টার’ স্থান দখল করে নিয়েছে এবং মানুষ পরস্পর বিরোধে লিপ্ত রয়েছে। সুতরাং স্রষ্টা সম্বন্ধে আমাদের বিশ্বাস কোন অংশেই নাস্তিকতার উর্ধ্বে নয়, এবং যতদিন আমরা এরূপ বিশ্বাসের উপর থাকব ততদিন নাস্তিকতাই আমাদের উপর প্রবল হয়ে থাকবে এবং তাদের হাতে জুলুম, অত্যাচার ভোগ করতে হবে। সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে তথাকথিত বিশ্বাসীদের উপর এ এক কঠোর পরীক্ষা; কারণ নাস্তিকতা উদ্ভবের মূলে বিশ্বাসীদের ভুলই সর্বাংশে দায়ী। এবং তাদের হাতে আমাদের এ শাস্তি, ‘আমাদের হস্ত যা অর্জন করেছে তা’রই প্রতিফল’। সুতরাং নাস্তিকতার জুলুম অত্যাচার হতে বাঁচার জন্যে, নিজেদের ভুলের সংশোধনের জন্যে এবং এক সৃষ্টিকর্তার সানিড়বধ্যে পৌঁছার জন্যে একমত ও একপথ অবলম্বন করে এক নেতার আনুগত্য স্বীকার করে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়াই কি বিশ্বাসীদের সর্ব প্রম ও সর্বপ্রধান কর্তব্য নয়? এটাকে যদি সর্ব প্রম ও সর্বপ্রধান কর্তব্য বলে কেউ মনে না করেন তা’হলে তা’ কি মেহেরবাণী করে সে সম্বন্ধে আমাদের জানানোর অনুরোধ রইল। তা’রপর বর্তমানের ন্যায় মহা দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার সময়ে সৃষ্টিকর্তা অতীতে যে ব্যবস্থা করেছিলেন, তিনি যদি অতীতের ন্যায় তেমনি অপরিবর্তনীয় শক্তি, ক্ষমতা, জ্ঞান ও গুণের অধিকারী হয়ে থাকেন, অবশ্য আমরা তা’ বিশ্বাস করি, কারণ আমরা প্রত্যক্ষ করছি বাল্য, কৈশোর, যৌবন, বার্দ্ধক্য ও মৃত্যুর পরও জীবন থেমে নেই। মৃত্যুর পরও দেখা যায় নব নব জন্ম মৃত্যুর সকল যাতনা ও ক্লেশকে মুছে ফেলে দিয়ে হাসির নূতন ফোয়ারা উৎসারিত করছে। পর্যায়μমে বাল্য, কৈশোর, যৌবন, বার্দ্ধক্য ও মৃত্যু, মৃত্যুর পর আবার জন্ম, চির- জীবন্ত, চির-অমলিন, চির-সুন্দর, চির-সত্য এক বাস্তব ব্যক্তির সদা বিদ্যমানতাই প্রমাণ করছে। তেমনি এক বসন্তেই বর্ষ শেষ হয়ে যাচ্ছে না, বসন্তের পর পরেই আসছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত ও শীত এবং শীতের শেষে আবার বসন্ত; বসন্তের পরে গ্রীষ্ম, বর্ষা পর্যায়μমে আবার বসন্ত। তখন আমরা কিভাবে বলতে পারি এক বসন্তের আগমনে ও শেষে আর কোন বসন্ত আসবে না; আমরা এক সূর্যের অস্তায়নে নিশীথ রাতের অন্ধকার দেখে কিভাবে বলতে পারি সূর্য আর উদিত হবে না, এ অন্ধকার আর দূরীভূত হবে না? বরং এরূপ বলাই ত স্বাভাবিক যে নিশীথ রাতের অন্ধকারের পর আলো-ঝলমল আর এক দিবসের সূচনায় সূর্যের পুনরোদয় অত্যাসনড়ব। হ্যাঁ, সূর্যের পুনরোদয় সম্বন্ধে আমরা তখনই নিরাশ হ’তে পারি যখন আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করব যে এ সবের নিয়ন্ত্রক যিনি তিনি তাঁ’র নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন, তিনি তাঁর বিধান পরিবর্তন করে ফেলেছেন অথবা তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। যদি আমাদের কেউ শীতের মৃত্যু-যাতনা ভোগের পর আর কোন বসন্ত আসবে না বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে থাকেন, তা’হলে এরূপ বিশ্বাস, শক্তি-সামর্থহীন এক অথর্ব মৃত সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেই বিশ্বাস স্থাপন করা হ’বে না কি? স্রষ্টার প্রতি এরূপ বিশ্বাস কি আমাদের স্রষ্টা পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হ’বে? বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতি মৃত্যুর পর আর এক নূতন জীবনের, শীতের পর আর এক নূতন বসন্তের, নিশীথ রাতের ঘোর অন্ধকারের পর পূর্ণ দীপ্তিময় আর এক সূর্যের পুনরাবির্ভাবে বিশ্বাসী; যেহেতু, এই সমিতি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী, সর্বশক্তি ও সর্বগুণের অধিকারী, অনাদি, অনন্ত, অসীম, চির- অমর অপরবির্তনশীল এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষে মানুষে মতানৈক্যজনিত ঝগড়া-বিবাদের, হিংসা-বিদ্বেষের বিশ্ব-বিধ্বংসী প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের যে তান্ডবলীলা চলছে, তা’ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ মত ও পথকে একমাত্র সত্য বলে আঁকড়ে থাকি এবং আমাদের মতের সত্যতা ও যথার্থতা প্রমান করার জন্য বস্তা বস্তা শাস্ত্র-গ্রন্থ স্তুপীকৃত করি এবং তা’র মাধ্যমে একটা সুষ্ঠু ফয়সালায় পৌঁছতে চেষ্টা করি, তা’হলে কোনও দিন কি সত্য ও মিথ্যা নির্ণয়ের ব্যাপারে কোন সুষ্ঠু মীমাংসায় পৌঁছা সম্ভব হ’বে? না, তা’ হ’বে না। তা’হলে কিভাবে তা’ সম্ভব? এর একমাত্র সুষ্ঠু সমাধান হতে পারে যদি আমরা চির-জীবন্ত সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার দিকে প্রত্যাবর্তন করি এবং তিনি যদি মেহেরবাণী করে এর মীমাংসার একটা ব্যবস্থা করে দেন তা হলে। তিনি কিভাবে এর মীমাংসা করবেন? অতীতে তিনি যেভাবে মীমাংসা করেছেন, বর্তমানেও তিনি সেভাবেই করবেন। অর্থাৎ, আমাদের মধ্য হতে তিনি যে কাউকে পছন্দ করবেন, তাকে তিনি আপন বাণী প্রদান করে মনোনীত করবেন। বাণীপ্রাপ্ত এই মনোনীত ব্যক্তিই হবেন বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ পৃথিবীর একমাত্র ফয়সালাকারী। তিনি কিভাবে এর ফয়সালা করবেন? বাণী প্রাপ্ত মনোনীত ব্যক্তি হলেন জামানার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার প্রিয়তম ব্যক্তি। এই ব্যক্তির আনুগত্য স্বীকার করাই সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য স্বীকার করা; এবং তাঁর আনুগত্য অস্বীকার করাই সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য অস্বীকার করা। আমরা যদি সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য স্বীকারকারী প্রিয় ব্যক্তি হতে চাই, তাহলে আমাদের এই ব্যক্তিরই আনুগত্য স্বীকার করতে হবে। মনুষ্য জাতির মধ্যে যারা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নেবে তারাই হবে স্রষ্টার দলভুক্ত সত্যের অনুসারী, আর যারা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করবে না, তারা হবে স্রষ্টার শত্রু দলভুক্ত- মিথ্যার অনুসারী। এভাবে যখন সত্য ও মিথ্যা পৃ ক হয়ে যাবে, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা তাঁর শত্রুদলকে পদানত করে সত্যকে বিজয় দান করবেন। বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতি বর্তমান শীতের মৃত্যু-যাতনার অবসানে পূর্ণ-যৌবনের প্রতীক আর এক বসন্তেরই পুনরাগমন প্রতীক্ষা করছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতির পরিকল্পনাটি বিশ্ব সংস্থার মাধ্যমে কিভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে, সমিতির সভাপতি বাংলাদেশের মহামান্য প্রেসিডেন্টকে লেখা তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিতে একটা নমুনা দিয়েছেন। পরবর্তীকালে সে চিঠিখানা “ঙঘ ডঙজখউ চঊঅঈঊ” শিরোনামে প্রকাশ করা হয়েছে। পূর্ববর্তী লেখার প্রারম্ভে সম্পাদকীয় মন্তব্যে এটা উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া সমিতির সংবিধান বা গঠনতন্ত্রেও সে বিষয় সবিশেষ বর্ণনা দেয় হয়েছে। আগ্রহী পাঠকগণকে সমিতির কার্যালয় বা সমিতির সদস্যবৃন্দদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে তা’ পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ করছি। কেউ ইচ্ছা করলে ডাক যোগেও তা’ পেতে পারেন।
বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতি যে পরিকল্পনা পেশ করেছে সে পরিকল্পনার সঙ্গে যারা একমত, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দেশ নির্বিশেষে তারা এ সমিতির সভ্য হতে পারেন। আর যারা এর সঙ্গে একমত নন, কেন তারা একমত হতে পারছেন না বা এর চেয়ে উত্তম কোন পরিকল্পনা সম্বন্ধে যদি তারা অবহিত থাকেন, তা’ হলে সে সম্বন্ধে এ সমিতিকে অবহিত করা তাদের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করি। এ সমিতির সর্বশেষ কথা হল, হয় আপনি এ সমিতিতে যোগদান করুন আর না হয় এর চেয়ে উত্তম একটি পরিকল্পনা পেশ করুন; অর্থাৎ হয় ডাকুন আর না হয় ডাকে সাড়া দিন-এছাড়া এর আর কোন বিকল্প আছে বলে এ সমিতি বিশ্বাস করে না।
এ প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি সম্ভাব্য প্রশ্ন এখানে আলোচনা করার প্রয়োজন অনুভব করি। প্রমতঃ এই মুহূর্তে স্রষ্টার মনোনীত ব্যক্তির আবির্ভাব কি সত্য সত্যই অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে? এর জবাবে আমাদের পাল্টা প্রশ্ন, বর্তমান পৃথিবী কি শান্তিপূর্ণ না অশান্তিপূর্ণ? পৃথিবীর বর্তমান সময়কে যারা শান্তিপূর্ণ বলে মনে করছেন তাদের প্রসঙ্গ টেনে আপাততঃ তাদের শান্তি আমরা ব্যাহত করতে চাইনে। তবে যারা বর্তমান সময়কে অত্যন্ত অশান্তিপূর্ণ মনে করছেন তারা এ অশান্তির মূল কারণ ও এর সুষ্ঠু সমাধান সম্বন্ধে কি ধারণা পোষণ করছেন তাদের কাছ থেকে আমরা তা জানার আগ্রহ প্রকাশ করছি। পক্ষান্তরে, এ সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা তা সর্বসাধারণের অবগতির জন্যে এখানে প্রকাশ করছি। আমাদের এ ধারণায় বা বিশ্বাসে যদি কোন দোষ-ত্রুটি কারো চোখে ধরা পড়ে তা জানিয়ে আমাদেরকে সংশোধন করার সনির্বন্ধ অনুরোধ রইল। আমাদের ভুল-ত্রুটি ধরা পড়া সত্ত্বেও যদি আমাদের তা জানানো না হয় তাহলে আমাদের সেই ভুল করে যাওয়ার জন্য অংশত আপনারাও দায়ী হবেন বলে আমরা মনে করছি। তবুও সর্ব অবস্থায় আমাদের ভুল ত্রুটির জন্য আমরা সর্বদা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং সকল প্রকার ভুল-ত্রুটি থেকে বেঁচে থাকার জন্য একমাত্র তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করছি। সে যাহোক, আমরা মনে করছি বর্তমান পৃথিবীর অশান্তিপূর্ণ অবস্থার মূল কারণ হল পরস্পর মত পার্থক্য। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মনৈতিক প্রভৃতি বিভিনড়ব ক্ষেত্রে বিভিনড়ব প্রকার মতপার্থক্য রয়েছে। সকল প্রকার মতপার্থক্যের মধ্যে ধর্মনৈতিক মতপার্থক্যকেই আমরা একমাত্র মূল কারণ বলে মনে করছি। আমাদের বিশ্বাস ধর্মনৈতিক মতপার্থক্য দূর করতে পারলেই সকল সমস্যার সমাধান আপনা আপনিই হয়ে যাবে। কিভাবে ধর্মীয় মতপার্থক্য দূর করা যায়? এর একটি উপায় এ হতে পারে যদি বিশ্বের সমস্ত ধর্মের নেতৃবৃন্দ একত্রে বসে একজন জ্ঞানী ও বয়োবৃদ্ধ লোককে নেতারূপে নির্বাচিত করে নেয়, সর্বব্যাপারে তার নির্দেশ মেনে চলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় এবং সে মতে চলে। যেমন ধরুন, খ্রিষ্টীয় সমাজের মহামান্য পোপ, মুসলমানদের মহামান্য কোন মুফতি বা কোন ইমাম, হিন্দু সমাজের কোন প্রখ্যাত পন্ডিত বা ধর্মগুরু এরূপ যে কোন একজনকে যদি সর্বসম্মতিμমে বিশ্ববাসী মেনে নেয় এবং এরূপ নির্বাচিত ব্যক্তিও যদি বিশ্ববাসীকে সঠিক পথে পরিচালনা করে বিশ্ব স্রষ্টার কাছে বিশ্ববাসীর মুক্তির কোন ব্যবস্থা দিতে পারবেন বলে নিজেকে যোগ্য ও সক্ষম মনে করেন, তাহলে বিনা দ্বিধায় আমরাও তাকে নেতারূপে স্বীকার করে নেব এবং তদসঙ্গে বিশ্ব প্রভুর পক্ষ থেকে কোন ব্যক্তির আবির্ভাব প্রয়োজনীয়তার প্রস্তাব আমরা প্রত্যাহার করব। কিন্তু বিশ্বের সমস্ত ধর্মাবলম্বীদের পক্ষে এরূপভাবে ঐকমত্য হওয়া কি সম্ভবপর? যদি এইরূপ হওয়া সম্ভবপর বলেই কেউ মনে করে থাকেন তাহলে একত্র বসে এরূপ একটা মীমাংসা করেই ফেলুন না কেন? কিন্তু এরূপ হবার নয় বলেই ত ধর্মের যিনি মূল মালিক অর্থাৎ ধর্ম যিনি প্রেরণ করেছেন এবং ধর্মের রক্ষণাবেক্ষণের ভার যার উপর ন্যস্ত একমাত্র তাঁরই দিকে আমরা প্রত্যাবর্তনের কথা বলছি। ধর্ম তো এমন নয় যে আমি বা আপনি যা উত্তম বলে মনে করব তাই ধর্ম হয়ে যাবে বা অমুক হুজুরে এমন বলেছেন, অমুক হুজুরে এমন ব্যাখ্যা করেছেন, সুতরাং অমুক হুজুরে যা বলেছেন তাই সত্যিকারের ধর্ম আর সব বাতেল ধর্ম তো এমন কিছুও নয়। ধর্মের প্রেরক বলেছেন, ‘ইনড়বা নাহনু নাজ্জালনাজ জিকরা অইনড়বাল্লাহু লাহাফিজুন’- অর্থাৎ “আমি ইহা প্রেরণ করেছি এবং আমি ইহা রক্ষা করব”। আমি বলছি, আমারটা ঠিক আপনি বলছেন আপনারটাই ঠিক, আসলে যে কোনটা ঠিক তা যখন আমরা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারছি না, তখন সঠিক দিক নির্ণয় করতে সক্ষম যিনি তারই দিকে আমাদের প্রত্যাবর্তন করা উচিত নয় কি? তিনি কি আমাদের সঠিক দিক নির্দেশ দিতে সক্ষম নন? অবশ্যই তিনি সক্ষম। তাহলে তিনি যে দিক নির্দেশ দিবেন সেটাই হবে আসল, সঠিক পথ ও যথার্থ ধর্ম, তদ্ব্যতীত সমূদয়ই নকল ও বাতেল। তিনি কিভাবে দিকনির্দেশ দান করবেন? পূর্বকালে যেরূপভাবে করেছেন এখনও তেমনিভাবেই করবেন। পূর্বে তিনি কিভাবে করেছেন? তার আগে বলুন, হজরত নূহ(আঃ), হজরত ইব্রাহিম(আঃ), হজরত মুসা(আঃ), হজরত ইসা(আঃ) সত্যবাদী এবং তাদের দাবী সত্য ছিল কিনা? উত্তর অবশ্যই হ্যাঁ। অর্থাৎ তারা সবাই ছিলেন সত্যবাদী এবং তাদের প্রত্যেকের দাবীই ছিল সত্য। তাদের জমানায় যারা তাদেরকে অস্বীকার করে বিরোধিতা করেছিল, তারা সবাই ছিল মিথ্যাবাদী, বাতেল। সুতরাং তাদের মাধ্যমে সত্য ও মিথ্যা, আসল ও নকল পার্থক্য করা সম্ভবপর হয়েছিল। যারা তাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে তাদেরকে অনুসরণ করেছিল, তারাই ছিল যথার্থ জ্ঞানবান, বুদ্ধিমান এবং মুক্তির অধিকারী। আর যারা তাদেরকে অবিশ্বাস করেছিল তারাই ছিল মূর্খ, জাহেল ও অভিশপ্ত। এ সম্বন্ধে আমাদের কারো কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে কি? নিশ্চয়ই এ বিষয়ে আমাদের কোন দ্বিধা- দ্বন্দ্ব নেই। তাহলে বর্তমানে আমরা যে পরস্পর ভীষণ মতপার্থক্য রোগে ভুগছি তখন পূর্বকালের ন্যায় সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে একজন মনোনীত ব্যক্তির আবির্ভাবই কি আমাদের এই কঠিন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রোগ থেকে উদ্ধারের একমাত্র উপায় নয়? এবং ইহা কি আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী নয়? ইহা যদি অত্যন্ত জরুরী না হয়ে থাকে তাহলে এর চেয়ে জরুরী আর কি হতে পারে? এখন যদি কেউ বলেন যে, হজরত মোহাম্মদ (সঃ)র পর আর কারো আবির্ভাব হওয়ার পথ খোলা নেই; যদি কেউ এরূপ হওয়ার দাবী করে তাহলে সে হবে মিথ্যাবাদী এবং আমরা তার কথায় বিশ্বাস করব না। এর জবাবে তেমন ব্যক্তি আবির্ভাব হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট দলিল প্রমাণ আমাদের হাতে থাকা সত্ত্বেও এক্ষণে আমরা সেদিকে যেতে চাইনা। আমরা শুধু বলব, যারা কোন ব্যক্তির আবির্ভাব বিশ্বাস করতে না চান, তারা না করবেন। তবে তাদের কাছে আমাদের একমাত্র অনুরোধ, বর্তমানে সমগ্র মানব জাতি যে ধর্মনৈতিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে, এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করার জন্য তাদের কাছে কি উপায় আছে মেহেরবাণী করে আমাদেরকে কেবল তাই জানাবেন। যতদিন পর্যন্ত আমাদেরকে সঠিক উপায় বাতলিয়ে না দিবেন অন্তত ততদিন পর্যন্ত আমাদের কাজে আপনারা কোন বাঁধ সাধবেন না, এটাই আমাদের একান্ত অনুরোধ।
এখানে আরও একটা প্রশ্নব উঠতে পারে যে, তেমন এক ব্যক্তির আবির্ভাব হলেই কি বিশ্ববাসী সর্বসম্মতিμমে তাকে মেনে নিবে? এর উত্তর অতি সহজ। পূর্বকালের মহামানবদেরও যেমন সর্বসম্মতিμমে সকলে মেনে নেয়নি এখনো নিবে না। সর্বসম্মতিμমে মেনে না নিলেও ইহা পরিষ্কাররূপে প্রমাণিত হবে যে, সৃষ্টিকর্তার মনোনীত এক বান্দা এসেছিলেন, কিছু লোক তাকে মেনে নিয়েছিল অধিকাংশ লোকই তাকে মেনে নেয়নি। যারা তাকে মেনে নিয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে তারাই সৃষ্টিকর্তাকে মেনে নিয়েছিল। সুতরাং তারাই সৃষ্টিকর্তার প্রিয়পাত্র এবং তারাই মুক্তির অধিকারী। আর যারা তাকে মেনে নেয়নি, প্রকৃতপক্ষে তারা সৃষ্টিকর্তাকেও মেনে নেয়নি। সৃষ্টিকর্তাকে যথার্থভাবে মেনে না নেওয়ার কারণে তারা তার প্রিয়পাত্রও হতে পারেনি। সুতরাং তারাই অভিশপ্ত, তারাই জগতে অশান্তি সৃষ্টিকারী এবং তারাই জাহান্নামী। এরূপভাবেই সত্য ও মিথ্যার একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। এর উপর যদি বিশ্বপ্রভু আরো একটু দয়া করেন এবং বিশ্বাসীদেরকে জগতের বুকে ক্ষমতা দান করেন এবং অবিশ্বাসীদের পদানত করে দেন, এরূপ তিনি অনায়েশেই সদা সর্বদা করতে সক্ষম, তাহলে এটা হবে বিশ্বাসীদের উপরি লাভ। এরূপভাবে ফয়সালা সৃষ্টিকর্তার মনোনীত ব্যক্তির আবির্ভাবের মাধ্যমেই হতে পারে; মানুষের নির্বাচিত নেতার মাধ্যমে এরূপ ফয়সালা কখনো হতে পারে না। বর্তমানে এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে আমরা তাই এরূপ ফয়সালারই পক্ষপাতী এবং মহীয়ান ও গরীয়ান আল্লাহর কাছে এরূপ আশা করেই তার পক্ষ থেকে একজন মনোনীত বান্দার আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, কেউ আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত হয়ে থাকলে তিনি তার দাবী প্রকাশ্যে ঘোষণা না করে জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে চাওয়ার কারণ কি? উত্তর পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি জামানার মধ্যে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়তম ব্যক্তি। এই মনোনীত ব্যক্তিকে অনুসরণ করাই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে অনুসরণ করা। আর উক্ত মনোনীত ব্যক্তিকে অস্বীকার বা অবিশ্বাস করা মানেই আল্লাহকে অস্বীকার বা অবিশ্বাস করা। সুতরাং উক্ত ব্যক্তির ঘোষণা আমাদের কর্ণে পৌঁছা মাত্র আমাদের অবশ্য কর্তব্য হবে নির্দিধায় তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার আনুগত্য স্বীকার করা, যদি আমরা সৃষ্টিকর্তার প্রিয়পাত্র হতে চাই। সৃষ্টরাজ্যে এমন কেউ আছেন কি যে উক্ত মনোনীত ব্যক্তির আহ্বান শুনার পরও তাকে অস্বীকার করে প্রকারান্তরে স্রষ্টাকেই অস্বীকার করতে চাইবে? না, তা কেউ চাইবে না। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? অনেক কাল পূর্ব হতেই ইমাম মাহদী (আঃ) আবির্ভাব হওয়ার কথা শুনে আসছি। এখনো অনেক জায়গায় এক একজন ইমাম মাহদীর দাবীদারের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। যিনি ইমাম মাহদী তিনি আবার জামানার মোজাদ্দেদও। সুতরাং যিনি মোজাদ্দেদ হওয়ার দাবী করছেন, প্রকারান্তরে তিনি জামানার ইমাম হওয়ারও দাবী করছেন। কিন্তু মোজাদ্দেদ বা ইমাম এক জামানায় মাত্র একজনই হতে পারেন, কখনোই একাধিক হতে পারেন না। অথচ ঢাকার আশে পাশেই প্রায় ডজন খানেক মোজাদ্দেদ ও ইমাম মাহদী হওয়ার সংবাদ আছে। যখন আমাদের উপর অবশ্য কর্তব্য এই যে জামানার ইমামের আহ্বানের সংবাদ পাওয়া মাত্র তার হাতে বয়েত গ্রহণ করা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা কি তাদের কারো হাতে বয়েত গ্রহণ করছি বা কখনো তা করার ইচ্ছা করছি? না। কেন না? যেহেতু তাদের দাবীর সত্যতায় যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অবশ্য কেউ কেউ যে তাদের মান্য করছে না এমন নয়। প্রত্যেক দাবীদারেরই কমবেশী সমর্থক আছে। তা সত্ত্বেও যখন একজনের স্থলে দশজন দাবীদার হয়ে গেছে তখন সহজেই বুঝা যাচ্ছে তাদের মধ্যে একজনের দাবী সত্য হলেও বাকী নয়জনের দাবীই মিথ্যা। দশজনের মধ্যে যখন নয়জনই মিথ্যা দাবীদার তখন তাদের মধ্য হতে একজন সত্য দাবীদারকে বেছে বের করা সাধারণ লোকের পক্ষে খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু কঠিন বলে যদি আমরা নয়জন মিথ্যা দাবীদারকেও একজন সত্য দাবীদারের সমান তুল্য জ্ঞান করে দশজনকেই সমান ভাবে মান্য করে চলি, তাহলে আমরা হব বেইনসাফগার-জালেম। তদ্রƒপ নয়জন মিথ্যাবাদীর সঙ্গে একজন সত্যবাদীকেও মিথ্যাবাদীর সমান জ্ঞান করে সবাইকে অস্বীকার করি, তাহলেও আমরা হব বেইনসাফগার-জালেম। আমরা যদি সত্য সত্যই ইনসাফ কায়েম করতে চাই তাহলে আমাদেরকে এমন একটি পন্থা বের করতে হবে যাতে অতি সহজেই সত্য হতে মিথ্যা পৃ ক করা যায়। ধর্ম সম্বন্ধে যখন আমাদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে তখন মতপার্থক্য দূর করার জন্য বর্তমান পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তার প্রিয়পাত্র, মনোনীত, মোজাদ্দেদ, জামানার ইমাম প্রভৃতি হওয়ার যত দাবীদারই থাকুক না কেন আমরা চাচ্ছি, শুধু ইসলামের মধ্যেই নয়, বিশ্বের সকল ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে, একটি মীমাংসায় পৌছতে, যাতে আমাদের সকলের মধ্যে একই সৃষ্টিকর্তার তাছার্রফ পয়দা হয়, যেহেতু আমরা সবাই যখন একই স্রষ্টার সৃষ্ট জীব। সুতরাং জামানার ইমাম, মোজাদ্দেদ বা মাহদী হওয়ার সকল দাবীদারগণেরই উচিত একত্রে বসে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি মীমাংসায় আসা। উক্ত মীমাংসার জন্য আমাদের কোথায় বসা উচিত? মনে করুন বাংলাদেশে দশজন মোজাদ্দেদের দাবীদার পাওয়া গেল। এদেশেরই এক স্থানে এ দশজন দাবীদার একত্রে বসে আপোসের মাধ্যমে একজনকে ইমাম নিযুক্ত করা হল, আর বাকী নয়জন উক্ত নির্বাচিত ইমামের আনুগত্য স্বীকার করে নিল। এখন উক্ত ইমামের নির্দেশ মত বাংলাদেশের নাগরিকগণ চলতে লাগল। বাংলাদেশের বাইরে অন্যান্য প্রত্যেক দেশেই এরূপ একজন করে ইমাম নিযুক্ত করা হল। এখন প্রশড়ব হল, ভিনড়ব ভিনড়ব দেশের ভিনড়ব ভিনড়ব ইমামের মত ও পথ কি এক হবে? না, তা কখনো হবে না। তাহলে মতপার্থক্য তো থেকেই যাবে। মতপার্থক্য থাকলে সংঘর্ষ অনিবার্য। মতপার্থক্য ও সংঘর্ষ যদি থেকেই যায় তাহলে সমস্যার আর সমাধান হল কোথায়? সুতরাং মতপার্থক্য দূর করতে হলে এমন একটি স্থান বেছে নিতে হবে যেখানে বিশ্বের সমস্ত মতের লোক একত্র বসতে পারে এবং সেখানে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সারা বিশ্বের উপর সে সিদ্ধান্তই কার্যকর করা সম্ভব হবে। তাহলে বর্তমানে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও, জাতিসংঘই কি একমাত্র নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ স্থান নয়, যেখানে এর সুষ্ঠু মীমাংসা হতে পারে? জাতিসংঘের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা, যাচাই করার আহ্বান পৌছার সঙ্গে সঙ্গে একমাত্র যিনি সত্যিকার দাবীদার তিনি ব্যতীত আর সবাই এই পরিকল্পনার বিরোধীতা করতে শুরু করবে। তারা এই পরিকল্পনাকে অসম্ভব, অবাস্তব, উদ্ভট বলে আখ্যায়িত করে মীমাংসার জন্য কখনো একত্র বসতে চাইবে না। বিশ্বমানব যখন যথার্থই মতপার্থক্যজনিত ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত রয়েছে, তখন তার একটা সুষ্ঠু মীমাংসার জন্য যারা নানা অজুহাত দেখিয়ে একত্র বসতে চায়না তারা আবার জামানার ইমাম, মোজাদ্দেদ বা মাহদী হবার দাবী করেন কোন সত্যের বলে? সুতরাং, যে সমস্ত ইমাম, মোজাদ্দেদ ,মাহদী পাদ্রী, পুরোহিতের দাবীদার উল্লিখিত পরিকল্পনার বিরোধিতা করবে তখন আর কারো বুঝতে কষ্ট হবে না যে, তারা মিথ্যা দাবীদার। সুতরাং, এ পরিকল্পনার বিরোধীতা করার মাধ্যমে এক শ্রেণীর দাবীদার প্রমেই মিথ্যা ও বাতেল প্রমাণিত হয়ে যাবে। সুতরাং জাতিসংঘের মাধ্যমে মতপার্থক্যের মীমাংসা করার প্রস্তাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আসল ও নকল পার্থক্য করার চাবি-কাঠি। অতএব জাতিসংঘই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার মনোনীত ব্যক্তির আবির্ভাব বা প্রকাশিত হওয়ার উপযুক্ত, নিরপেক্ষ, নির্ভরযোগ্য এবং কার্যকর স্থান। অবশ্য যদি কেউ জাতিসংঘের চেয়েও উপয্ক্তু স্থান অন্য কোথাও আছে বলে মনে করেন, তাহলে তা বিবেচনা করে দেখার জন্য পেশ করতে পারেন।
তৃতীয়ঃ আমাদের এই পরিকল্পনা জাতিসংঘ পর্যন্ত আদৌ পৌঁছতে পারবে কি? আমাদের পরিকল্পনাটি যদি বিশেষ কোন জাতি, ধর্ম বা অঞ্চলের স্বার্থ বিশেষকে কেন্দ্র করে রচিত হত অথবা মানবের কোন কল্যাণবিরোধী হত, তাহলে জাতিসংঘ পর্যন্ত তা পৌঁছানো সম্বন্ধে কোন প্রকার সন্দেহ থাকত। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস এই যে, আমাদের পরিকল্পনাটি সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের জন্যই রচিত হয়েছে এবং জাতিসংঘ মানব জাতির কল্যাণের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাহলে আমাদের এই দাবী জাতিসংঘ পর্যন্ত পোঁছতে এবং জাতিসংঘ কর্তৃক মেনে নিতে বাধাটা কোথায়? মানব কল্যাণকর কোন পরিকল্পনা যদি জাতিসংঘ কর্তৃক বিবেচিত না হওয়ার সম্ভাবনাই থেকে থাকে তাহলে এমন একটি সংঘ টিকে থাকার কি যুক্তি থাকতে পারে? সুতরাং আমাদের বিশ্বাস জাতিসংঘকে টিকে থাকার জন্য হলেও আমাদের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করার বিষয়টি জাতিসংঘের কর্তৃপক্ষের বিবেচনা করে দেখা উচিত। প্রসঙ্গμমে একটি ঐতিহাসিক সত্যের দিকে জাতিসংঘের কর্তা ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো তাদের আবিষ্কৃত মমি। মমি আবিষ্কৃত হয়েছিল মিশরের সর্বশেষ ফেরাউ দ্বিতীয় রামেসিসের মৃত্যুর কয়েক হাজার বৎসর পূর্বে। রামেসিসের দেহাবশেষ মমিকৃত হওয়ার পর পরই মমি তৈরীর জ্ঞান আস্তে আস্তে লোপ পেয়ে যায়। বর্তমান বিজ্ঞানের বলে এতকিছু আবিষ্কার করা সম্ভবপর হলেও মমি তৈরীর জ্ঞান আর ফিরে পাওয়া যায় নি। এর কারণ কি? বনী- ইসরাইলিদের কঠোর দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে, তাদের ছেলেদের হত্যা করে, মেয়েদের জীবিত রেখে ভোগ করত দুর্দা- প্রতাপশালী সবচেয়ে বড় খোদার দাবীদার যে ফেরাউ, এক জ্বলন্ত নিদর্শন হিসেবে তার দেহাবশেষের পরিণতি জগতবাসীকে দেখাবার উদ্দেশ্যে মহানিয়ন্ত্রক সৃষ্টিকর্তা মমি তৈরীর জ্ঞান মিশরবাসীকে শিক্ষা দিয়েছিলেন কয়েক হাজার বৎসর পূর্ব হতেই। যেদিন সে উদ্দেশ্য সম্পনড়ব হয়ে গেল তার পর থেকেই সেই জ্ঞান বিদ্যমান রাখা তিনি প্রয়োজন মনে করেন নি। তাই উক্ত জ্ঞান বিশ্ব বাসীর কাছ থেকে তিনি তুলে নিয়ে গেলেন। তদ্রƒপ জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূলেও রয়েছে সৃষ্টিকর্তার এক মহান উদ্দেশ্য। যতদিন পর্যন্ত সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত না হবে ততদিন পর্যন্ত জাতিসংঘ নানা পরিবর্তন-বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকবে। যেদিন তার সে অভিপ্রায় পূর্ণরূপে বাস্তাবায়িত হবে সেদিন জাতিসংঘের অস্তিত্ব অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতির পরিকল্পনাটি পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের জন্যই সৃষ্টিকর্তা জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা সম্ভব করেছেন। সুতরাং জাতিসংঘ পর্যন্ত এ পরিকল্পনাটি পৌঁছতে পারবে কি পারবে না, এ সম্বন্ধে কারো মনে কোন প্রশড়ব উত্থিত হওয়া বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকার বিন্দুমাত্র অবকাশ আছে বলেও আমরা মনে করি না। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতির পরিকল্পনাটি অচিরেই জাতিসংঘে উত্থিত হওয়ার সুযোগ লাভ করবে, ইনশাল্লাহা। আর প্রকৃত বিশ্বাসী তো সে-ই, যে ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখেই চিনে নিতে পারে। অবজ্ঞাত, অখ্যাত হাবসী μীতদান বেলাল, খাব্বাব, আম্মার, জায়েদের মত অসহায় দুর্বলগণই ভক্ত ছিলেন যে মোহাম্মদের (সঃ), কে বিশ্বাস করতে পেরেছিল যে, এই মোহাম্মদ (সঃ)ই একদিন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ মহামানবরূপে বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করবেন এবং অসহায় দুর্বল ভক্তগণই এই বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হবেন? হজরত মোহাম্মদ (সঃ) এর মধ্যে যে মহামহীরুহের বীজ সুপ্ত ছিল কয়জন তা প্রত্যক্ষ করে তার কথা বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন? যারা পেরেছিলেন তারাই কি প্রকৃত বিশ্বাসী এবং বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্য ও সভ্যতার বুনিয়াদ ছিলেন না? সুতরাং বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি আহ্বায়ক সমিতির পরিকল্পনার মূলে যে সেইরূপ একটা সম্ভাবনা নেই বা অবজ্ঞাত, অখ্যাত, অসহায় দুর্বলগণই একদিন বিশ্ব সাম্রাজ্যের কর্ণধাররূপে খ্যাতি লাভ করবেন না তা কি কেউ জোর দিয়ে বলতে পারেন? সত্যের প্রকাশ ও বিকাশ চিরকাল তো এমনিভাবেই হয়ে আসছে। সুতরাং সমিতির পরিকল্পনাটি বিশ্ব সংস্থায় স্থান পেতে পারে কিনা বা আদৌ সেখানে উত্থাপিত হবে কিনা এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহপোষণ করা তো সৃষ্টিকর্তার কুদরতকেই অস্বীকার করা, তাঁর কুদরতকে অস্বীকার করা প্রকারান্তরে সৃষ্টিকর্তাকেই অবিশ্বাস করা। আর অবিশ্বাসীদের জন্যই তো রয়েছে নমরুদ ফেরাউনের মত ভয়াবহ পরিণতিসমূহ। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের যত শীঘ্র বোধোদয় হবে ততই মঙ্গল; আর যত বিলম্ব হবে বিশ্ববাসীর জন্য ততই অমঙ্গল।
বিশ্ববাসীর সকলের জন্য আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত, কল্যাণ ও সুপথ প্রার্থনা করে নিবন্ধটি এখানেই শেষ করছি। এই নিবন্ধটির উপর ভবিষ্যতে যদি কোন বাদ-প্রতিবাদ উত্থিত হয় তাহলে সে সম্বন্ধে ভবিষ্যতে আরো কিছু আলোচনা করার আশা রাখি, ইনশাআল্লাহ। অ-আখেরে দাওয়ানা আনেল হামদু লিল্লাহে রাব্বিল আলামিন।
*********