পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করিতেছি
জাতির পিতা
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতা এই চার নীতির উপর ভিত্তি করিয়া গঠিত হইবে “মুজিব বাদ।”
এই দেশের সার্বভৌমত্ব সর্ব সাধারণের। জনগণ স্বাধীন ভাবে নির্বাচন করিয়া তাহাদের প্রতিনিধি বানাইবার ক্ষমতা রাখে। এই দেশের সর্ব শ্রেণীর লোককে একই নেতার নির্দেশমত চলিতে হইবে। এই দেশের নাগরিকগণকে একই বাঙালি জাতি বলিয়া পরিচয় দিতে হইবে। এই দেশের প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীগণ স্ব স্ব ধর্মানুযায়ী ধর্মানুষ্ঠান পালন ও প্রচার করিতে পারিবে।
জনগণ মিলিত হইয়া এক সমাজে বাস করিতে হইলে এক নেতার নির্দেশ মানা অবশ্য কর্তব্য। তাই যিনি সমাজপতি তিনিই জননেতার আখ্যা পান এবং তাহার প্রচেষ্টায় সর্ব ধর্মাবলম্বী ও সর্ব শ্রেণীর মানুষ এক জাতি বলিয়া নিজ দিগকে পরিচয় দেয়। উক্ত প্রচেষ্টমান ব্যক্তি এই নবগঠিত জাতির জনক বা পিতা আখ্যা পান। তাই যুক্তিসংগতভাবে শেখ মুজিবর রহমান জনগণের প্রিয় নেতা ও বাঙালি জাতির পিতা।
এখন আমার বক্তব্য ঃ যিনি আমাদের জননেতা ও জাতির পিতা আমি তাহাকে প্রাণ দিয়া ভালবাসবই। কিন্তু যদি সেই পিতার সামনে আমার মৃত্যু হয় তবে সেই পিতার দ্বারা আমার শবদেহের সৎকার হইবে কিনা? যেহেতু আমি হিন্দু এবং পিতা মুসলিম। এমন স্থলে সবাই বলিবে যে, হিন্দুর মৃত্যুকালে মুসলমানের সেখানে থাকা বা শ্মশানের কোন কাজ করিবার অধিকার নাই। এমনকি হিন্দুর আত্মার মুক্তির জন্যও মুসলিম পিতা আপন প্রভুর কাছে কোন প্রার্থনা করিতে পারিবেন না বা করিলেও তাহা অগ্রাহ্য হইবে। যেহেতু মুসলিমের প্রভু বলেন গাভীকে জবেহ্ করিয়া ভক্ষণ কর, আর হিন্দুর প্রভু বলেন, খবরদার! গাভীকে পূজা কর।
এই কারণেই হযরত নুহ নবী (আঃ) তাঁহার প্রভুর অবাধ্য নিজের পুত্রের জন্য প্রার্থনা করিয়া প্রভুর ধমক শুনিয়াছিলেন।
যদি বলা হয় যে পরকাল কিছুই নয়, উহা শুধু মানুষের অন্ধ বিশ্বাস। আমি বলিব, তবে কেন বৃথা ধর্ম পালন করা হয়? সকল ধর্মেই পূজা ধর্মানুষ্ঠান ইত্যাদি পালন করা হয় শুধুমাত্র পরকালে ফল পাইবার আশায়। নতুবা দুনিয়াতে ধর্মের ফল বিশেষ কিইবা পায়?
ধর্ম যে সত্য, পরকাল যে সত্য তার প্রমাণ সকল মতবাদী মানুষের নিকট হইতেই পাওয়া যায়। ধরুন, যে হিন্দু জীবনেও পূজা করে না বা পরকাল বিশ্বাস করে না, তবুও তাহার পিতা-মাতার মৃত্যু হইলে সে শবটা ফেলিয়া দেয় না। বরং ধর্ম অনুযায়ী অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শ্রাদ্ধক্রিয়া দ্বারা শুচি হইতে বাধ্য হয়।
অন্যদিকে একজন মুসলিম যে জীবনেও নামাজ-রোজা করে না বা পরকাল বিশ্বাস করে না, কিন্তু তাহার পিতা-মাতা বা আপনজন মারা গেলে গোছল, কাফন, জানাজা ও কবরস্থ না করিয়া মৃত দেহটা ফেলিয়া দিতে সে রাজি হয় না। এমনকি ফাতেহাখানি বা কোরানখানি করিতেও কেউ বিরত হয় না। ইহাতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ধর্ম সত্য, পরকাল সত্য। তাই সারা জীবন ধরিয়া অহংকারে যাহা অস্বীকার করিয়াছিল ঠিক মৃত্যুর ভয়াবহ অবস্থায় সেই অহংকার চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যায় ও সত্য স্বীকার করিতে আত্মা বাধ্য হয়।
যদি বলা হয় পরকাল কিছুই নয় শুধুমাত্র পৃথিবীর শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তাহাকে প্রিয় জননেতা ও জাতির পিতা হিসাবে মান্য করা হয়। তাহার উত্তরে আমি বলিতে চাই যে, প্রিয় নেতা ও শ্রদ্ধেয় পিতার নিকট হইতে মাত্র ৩/৪ মাইল তফাতে থাকিয়া আমার ঘরে ডাকাতের হাতে প্রাণ বিসর্জন দিতেছি, তখন পিতাকে হাজার স্মরণ করিয়াও কোন ফল হইতেছে না বা বাঁচিয়া থাকিয়া মানুষ এই সব দুর্ঘটনা জানাইয়াও নেতা ও পিতার দ্বারা কোন উপকার পাইতেছে না। তবু সেই নেতা ও পিতাকে প্রাণ দিয়া ভালবাসিতে পারি। আর যিনি ঊর্ধ ও অধঃ জগতের মালিক, যিনি সমস্ত মানুষের স্রষ্টা, সকলের ইহকাল ও পরকালের শান্তিদাতা তাঁহাকে মানা ও তাঁহার নির্দেশমত চলা ও তাঁহারই আদেশক্রমে সবার জন্য এক জাতি গঠন করা কেন সম্ভবপর হইবে না?
আমাদের বর্তমান অবস্থা এমন যেমন ভিতরে পঁচা ঘা, উপরে মলম লাগাইয়া শুধু হাত বুলাইয়া শান্তি দান স্বরূপ। ইহাতে রোগীর আরোগ্য লাভের মোটেও আশা নাই বরং জীবন নাশেরই আশঙ্কা রহিয়াছে। আমাদের মূল যে প্রভু বা স্রষ্টা বা মালিক যাহাই বলুননা কেন তিনি যে একক ও অদ্বিতীয়, আমরা সকল মানুষ তাঁহারই সৃষ্ট দাস-দাসী, তাঁহার সাথে মিলিত হইয়া এক জাতি গঠন করত: তাঁহারই নির্দেশে এক নীতি পালন করিয়া ইহকালের শান্তি ও পরকালের মুক্তি লাভ করিতে হইবে। সুতরাং এই ব্যাপারে যিনি অগ্রগণ্য হইবেন, তিনিই প্রিয় নেতা ও জাতির শ্রদ্ধেয় পিতা হইবেন। তাহার দ্বারা পৃথিবীতে শৃঙ্খলা আসিবে।
এই জাতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তিনি সকলের সাথী হইবেন এবং এই জাতির প্রত্যেকের আত্মার মুক্তির জন্য তিনি প্রভুর নিকট উকিল স্বরূপ হইবেন। (জনৈক হিন্দুর অভিমত)
********