পরম দয়ালু করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করছি
কঠিন সমস্যা ও তার সহজ সমাধান
যে কোন দেশবাসী বা যে কোন ভাষাভাষীই হোক, প্রত্যেকটি মানুষেরই কাম্যবস্তু জীবনের সুখ-শান্তি এবং সবাই বিশ্বাস করে একতাই সুখ-শান্তির মূল। কাজেই মানুষের মধ্যে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক-সর্বস্তরে যখন এই একতা ভঙ্গ হয় ও অনৈক্য জোরদার হয়ে উঠে, তখন স্বাভাবিকভাবেই মানব জাতির অধঃপতন ঘটে। যখন কোন জ্ঞানী মানব দরদী এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেন, তখন নিঃস্বার্থভাবে শুধুমাত্র মানব জাতির সেবা করার উদ্দেশ্যেই তাদের পুনর্গঠিত ও একতাবদ্ধ করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এরূপ একতাবদ্ধ হওয়ার পথে প্রবল বাধাঁর সৃষ্টি করে যা তা হল ধর্ম। কেননা, শুধু মুখের কথায় একতা সৃষ্টি হতে পারে না, বরং বহু মত ভেঙ্গেচুরে একমতে বিলীন হওয়াতেই একতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু বহুধর্ম মত ভেঙ্গে এক ধর্মমত কায়েম করার পক্ষে কেউ রাজী নয়। জ্ঞানী ব্যক্তি ইহাও বুঝতে পারেন যে, এক এক ভাষাভাষীর মধ্যে এক এক গুণ আছে যা অপর ভাষাভাষীর মধ্যে নেই। এক এক দেশবাসীর মধ্যে এক এক গুণ আছে যা অপর দেশবাসীর মধ্যে নেই। ঐরূপ এক এক মানুষের মধ্যে এক এক গুণ আছে যা’ অপর মানুষের মধ্যে নেই। অথচ সমগ্র গুণই একত্রিত হলে এবং উহা কাজে লাগাতে পারলে মানবজাতির মহা উপকার সাধিত হতে পারে। এই জন্যই বলা হয় ‘একতাই সুখের মূল’। জ্ঞানী ব্যক্তি ইহাও বুঝতে পারেন যে, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই এক মানুষ জাতি। সকলেরই জন্ম, জীবন যাপন ও মৃত্যু এক প্রণালীতেই হয়ে থাকে; অথচ আমি একজন মুসলমান-যদি আমি আমার এক হিন্দু ভাইয়ের সাথে মিলিত হতে চাই তবে সমাজ আমাকে রেহাই দেয় না। ঠিক তেমনিভাবে একজন হিন্দু যদি তার এক খ্রিস্টান ভাইয়ের সাথে উঠা-বসা, বিবাহ-শাদি ইত্যাদি করতে চায়, তবে হিন্দু সমাজও তাকে রেহাই দেয় না। তাহলে বিচারে দেখা যায় ধর্মই একতার অন্তরায়। অতএব মানব জাতির কাম্যবস্তু-জীবনের শান্তি যে একতার মধ্যে নিহিত তা হতে যা মানুষকে দূরে রাখে তা পালনীয় হতে পারে না, বরং তা বজর্নীয়। তাই জ্ঞানী, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিকগণ ধর্মবিহীন এক নতুন সমাজ গঠন করে মানুষকে একতাবদ্ধ করার জন্য এক নতুন ব্যবস্থা কায়েম করার পক্ষপাতি। তাই যে মানব-বন্ধু মানব সেবায় নেমেছিলেন, কিন্তু ধর্মাবলম্বীদের মতানৈক্যের দরুণ ধর্মকে মানব জাতির অধঃপতনের প্রধান কারণ মনে করে মানুষকে বাঁচাবার ও পুনর্গঠিত করার জন্য তিনি ধর্ম বিবর্জিত এক নতুন সমাজ ব্যবস্থার পত্তন করেন। ফলে, ধর্ম যে একতার পথে এক সমস্যা ছিল এই নতুন সমাজ ব্যবস্থা তার উপর আরও এক কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। যেহেতু তিনি জগতে কোন ধর্মের প্রতিই আস্থাবান নন। আর নবোদ্ভূত মতবাদের জন্য দায়ী-ধর্মে অনভিজ্ঞ সেই গোঁড়া ধর্মাবলম্বীগণ। কারণ, তাদের কাছে কেউ কোন প্রশ্ন করলে তার যুক্তিপূর্ণ উত্তর না দিয়ে শুধু বলে থাকে “আমাদের পূর্ব পূরুষ বা মুরুব্বিগণ এরূপ বলে গেছেন”।
যাহোক, বর্তমান জমানা অতি কঠিন সমস্যাপূর্ণ। কারণ, কেউ কারো বুঝ নিতে রাজী নয়। এমনকি রাষ্ট্রীয় শক্তির দ্বারাও ধর্মের মীমাংসা করার উপায় নেই। কারণ, ধর্মের নেশায় যারা বেহুঁশ তাদের ক্ষমতার বলে হুকুম দিলে তারা প্রাণ দিতেও রাজী, কিন্তু আপন মত ত্যাগ করতে রাজী নয়। এই জন্যই এক শ্রেণীর লোক অনন্যোপায় হয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি অর্থাৎ প্রত্যেকের ধর্মই ঠিক রেখে নতুনভাবে সমাজ গড়ে একতাবদ্ধ করতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু যুক্তিবাদী জ্ঞানীগণের কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ আপনারা নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করে দেখবেন। ধরুন, নদীর চৌ-মোহনায় চারিদিকে গমনেচ্ছু চার খানা নৌকা ছেড়ে যদি বলা হয় তোমরা একত্র বহর বেঁধে থাকবে, তবে তা যেরূপ অসম্ভব, তথাকথিত চার মতাবলম্বীর মত ঠিক রেখে একতা কায়েম করা তদ্রƒপ অসম্ভব। এতে দেখা যায়, যে কোন পথে যাওয়া যাক না কেন একতাবদ্ধ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। পক্ষান্তরে, একতা ছাড়া মানব জীবনের শান্তি কায়েমেরও অন্য কোন পথ নেই। কাজেই ইহা কঠিন সমস্যাই বটে।
এবার আসুন ইহার কোন সমাধান আছে কিনা দেখা যাক।
এই সমস্যা সমাধানের দু’টো পথ আছে। এক-পৃথিবী হতে সকল ধর্ম উঠিয়ে দিয়ে ধর্মবিহীন এক নতুন সমাজ কায়েম করা। দুই-সকল ধর্মের প্রতিনিধিগণ একত্র বসে বিচার করে সঠিক ও অঠিক ধর্ম যাচাই করা এবং বিচারান্তে যাচাইকৃত সঠিক ধর্ম সকলে মিলে গ্রহণ করলে পর একতা কায়েম হতে পারে । কিন্তু প্রথমটি সম্পূর্ণ বন্ধ, যেহেতু ধর্ম মানেই হচ্ছে স্রষ্টার দেয়া মানুষের জন্য এক জীবন-বিধান। সুতরাং যতদিন জগতে মানুষ বেঁচে থাকবে ততদিন সেই জীবন-বিধান তথা তাঁর ধর্মও তিনি বিদ্যমান রাখবেন। তা উঠিয়ে দেবার ক্ষমতা কারো নেই। যেমন, পৃথিবীর জীবন স্বরূপ সূর্যকে স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন এবং যতদিন পৃথিবীতে জীবন বিদ্যমান থাকবে ততদিন সুর্যও থাকবে। সৃষ্টির কোন শক্তি নেই যে, এই সূর্যকে উঠিয়ে দিতে পারে। কাজেই দ্বিতীয় পথটিই খোলা আছে। অর্থাৎ ধর্মের বিচার করা। এখন প্রশ্ন হতে পারে ধর্মের বিচার করবেন কে? তার উত্তর এই, যার মধ্যে চারটি গুণ বিদ্যমান আছে তিনিই এই ধর্মের বিচার করতে পারবেন, অন্য কেউ নয়। প্রথম গুণ- সমস্ত মানুষের উপর যার প্রভাব আছে। দ্বিতীয় গুণ-সমস্ত মানুষের উপর যার সমান দয়া আছে। তৃতীয় গুণ-সমস্ত জ্ঞানবানদের চেয়েও যার জ্ঞান অধিক এবং চতুর্থ গুণ-বিচার্য বিষয়ে যিনি পূর্বাপর সম্পূর্ণ অবগত আছেন। এই চারটি গুণ কেবল একজনেরই আছে তিনি সৃষ্টির স্রষ্টা। তিনি অনাদি-অনন্ত। তিনি নিজস্ব নিজত্বলয়ে সদা বিদ্যমান। তিনি ইচ্ছাময়, তিনি যা ইচ্ছা করেন তা করবেনই। সৃষ্টির সমস্ত শক্তি দ্বারাও তাঁর ইচ্ছা হতে তাঁকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না। আর তিনি যা ইচ্ছা করেন না সমস্ত সৃষ্টির চাপেও তাঁকে দিয়ে তা করাতে পারবে না। বর্তমান যুগ মানব জীবনের এক কঠিন সমস্যার যুগ। এই সমস্যার সহজ সমাধান কল্পে সমগ্র মানব জাতিকে একতাবদ্ধ করে জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি প্রস্তুতি নিয়েছেন। আর যেহেতু তিনি মাধ্যম ব্যতীত কোন কাজ করেন না, এই যুগের জন্য তাই তিনি সেই মাধ্যমও কায়েম করেছেন। সৃষ্টিকর্তার মীমাংসায় মানব জাতির কি উপকার হতে পারে তার চুম্বক সন্ধান “দুই বন্ধুর আলোচনা” নামক প্রবন্ধে প্রকাশ করা হয়েছে এবং সৃষ্টিকর্তার মীমাংসা কোন পদ্ধতিতে কার্যকরী হতে পারে তারও সহজ ও সরল ব্যবস্থা “অশান্তির জগতে শান্তির বার্তা” নামক প্রবন্ধে দেখান হয়েছে।
এখন আমি আমার সকল ভাইদের নিকট আমার প্রাণের দুঃখ বলছি। আমি বিশ্বাস করি জগতে যত মানুষ আছে তারা যে কোন ভাষাভাষী, যে কোন দেশবাসী বা যে কোন মতবাদী হোক না কেন সবাই আমার ভাই, যেহেতু সবাই মানুষ। আমরা একই পিতামাতার বংশোদ্ভূত এবং আমরা একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট জীব। স্রষ্টা আমাদেরকে একইরূপ বীর্য দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। একই নিয়মে মাতৃগর্ভে রেখেছেন। একই নিয়মে এই জগতে এনেছেন। একই নিয়মে শৈশব হতে যৌবনে, যৌবন হতে বার্দ্ধক্যে পরিণত করেছেন এবং একই নিয়মে সবার মৃত্যু ঘটাচ্ছেন। স্রষ্টার একই সূর্য সকলকে আলো দিচ্ছে, একই বাতাস সবার প্রাণ বাঁচাচ্ছে। আগুন, পানি, মাটি সকলের নিকট সমানভাবে উপকার পৌঁছাচ্ছে। মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ যে জ্ঞান তা সৃষ্টিকর্তা সকলের মধ্যেই বণ্টন করে দিচ্ছেন। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া জ্ঞান দ্বারা প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তি ভালভাবেই বুঝতে পারছেন যে একতা ছাড়া পৃথিবীতে মানব জাতির শান্তি ও উন্নতি লাভের দ্বিতীয় পথ নেই, কিন্তু দুঃখের বিষয় তবুও কেন একে অপরকে ভাই বলে ডাকতে ও ঐক্যবদ্ধ হতে পারছিনে। তাই সৃষ্টিকর্তা দয়াপরবশ হয়ে মানব জাতিকে ডেকে বলেছেন- ‘হে মানুষ, তোমরা পরস্পর ভাই ভাই, মিলে মিশে একতাবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন কর, যদি তোমরা শান্তির জীবন কাটাতে চাও। কিন্তু হে মানুষ, তোমাদের পিছনে রয়েছে চরম শত্রু শয়তান, সে তোমাদের শান্তি বরদাস্ত করতে পারে না’। সে একতার মূলকেই বানচাল করে আমাদেরে বিভ্রান্তিতে ফেলছে, যেমনি দুনিয়াতে কখনো কখনো পথিককে চলার পথে “দিয়াভুলা” বা “কানাওলা” বিপরীত পথে নিয়ে যায়। তেমনি জ্ঞানীগণও একতার পথে চলতে গেলে শয়তান তাদেরও ভুল পথে নিয়ে যায়। তাই একতা কায়েম করতে গিয়ে অনৈক্যের সৃষ্টি করে বসে। জ্ঞানীগণ ইহাও বুঝতে পারেন যে, একজনকে কেন্দ্র করেই একতা গঠন করা সম্ভব হয়। তাছাড়া একতা হতেই পারে না। কিন্তু সেই কেন্দ্রীভূত ব্যক্তি কে হবেন? তার যোগ্যতা যাচাই করবে কে? এই প্রশ্নটুকুর ছিদ্র পথেই শয়তান ঢুকে পড়ে। অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি নিজের যোগ্যতার দাবী করে তবে তা হবে অহংকারীর পরিচয়; আর যদি অন্যেরা যাচাই করতে চায় তবে সে স্থলে চলবে প্রতিযোগিতা। ফলে,যেমন যোগ্য ব্যক্তির কেন্দ্রীভূত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তদ্রƒপ অযোগ্য ব্যক্তিরও কেন্দ্রীভূত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই অনিশ্চিত পথেই শয়তানের প্রবেশ ঘটে। কারণ, শয়তানের ধোঁকায় পড়ে সাধারণ মানুষ অযোগ্যকেই যোগ্য বিবেচনা করে বসে, ফলে শয়তান হয় জয়যুক্ত। আর মানুষের জীবনে শান্তির পরিবর্তে অশান্তি বৃদ্ধি পায়। আর যদি যোগ্য ব্যক্তিও কেন্দ্রীভূত হয়, তবুও প্রতিযোগিতাকারীদেরে শয়তান তার দলের পিছনে এমনভাবে লাগায় যে পৃথিবীতে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। কেন্দ্রীভূত ব্যক্তির উপর তারা কখনও আস্থাবান হয়না বরং সর্বদা বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে রাখে। কাজেই সুকৌশলী সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা অতি কৌশলে মানুষের জন্য এমন পথ খুলে দেন যে পথে শয়তানের প্রবেশাধিকার নেই। অর্থাৎ এমনি কঠিন সমস্যার যুগে জীবিত মানুষদের মধ্য হতে তিনি কোন এক ব্যক্তিকে তার মাধ্যম বা প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। এবং তাঁর নিজস্ব জ্ঞান দ্বারা উক্ত প্রতিনিধিকে জ্ঞানবান করেন। অতঃপর তাঁর কিছু নির্দশন প্রদর্শন করে তাকে তাঁর উপর পূর্ণ বিশ্বাসী বানান এবং তার ইচ্ছা ও অভিপ্রায় তার কাছে ব্যক্ত করে সমগ্র মানব জাতিকে একতাবদ্ধ করার জন্য আদেশ দিয়ে থাকেন। সুতরাং উক্ত ব্যক্তি কখনো নিজের যোগ্যতার দাবী করতে পারেন না বা অহংকারীও হতে পারেন না । তাকে কারো যাচাই বা নির্বাচিত করারও অবকাশ নেই যাতে কোন প্রতিযোগিতা চলতে পারে। আর জনগণ তার স্বপক্ষে গেল কি বিপক্ষে গেল এ নিয়ে উক্ত ব্যক্তি দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হন না। যেহেতু তিনি কোন স্বার্থ অনুসন্ধান করেন না। তিনি ত নিজেকে সৃষ্টিকর্তার দাস বলে পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। জ্ঞানবান লোক ভালভাবেই বুঝতে পারেন-মালিকের আদেশ আর তার ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজারের আদেশ বিভিন্ন হয় না, রাজাদেশ ও রাজ প্রতিনিধির আদেশ বিভিন্ন হয় না; কিন্তু তাই বলে ম্যানেজারও মালিক হয়ে যায় না বা রাজপ্রতিনিধিও রাজা হয়ে যায় না। তদ্রƒপ স্রষ্টার আদেশ ও আদেশপ্রাপ্ত দাসের আদেশ বিভিন্ন হয় না এবং দাসও স্রষ্টা হয়ে যায় না।
এখন আমি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সব ভাইয়ের কাছে বিনীত ভাবে জানাচ্ছি- এই যুগে এর চেয়ে কোন উত্তম ও সহজ পথ যদি কারো জানা থাকে তবে আপনাদের ভাই হিসাবে আমাকে ডাকুন, নতুবা আপনাদেরকে ভাই হিসাবে আমি ডাকছি। এখন হয় আপনারা আমাকে ডাকুন নতুবা আমার ডাকে সাড়া দিন। যদি চুপ করে থাকেন তবে একেত জীবনে একতা কায়েম করতে পারবেন না, যা শান্তি ও উন্নতির মূল। দ্বিতীয়তঃ মৃত্যুর পর যখন আমাদের প্রত্যেক ভাইকে আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও মালিকের নিকট উপস্থিত হতে হবে তখন আমি মালিকের কাছে এ-ই বলব যে, আমার ভাইয়েরা আমাকে বিশ্বাস করে নাই। এখন কেউ যদি প্রশ্ন করে যে, এ কি সত্য যে সৃষ্টিকর্তা কোন মানুষের সাথে কথা বলেন বা কোন আদেশ উপদেশ দান করেন? তার উত্তরে আমি বলব, পূর্বকাল থেকে যে সৃষ্টিকর্তার নাম ও তাঁর আদেশ-নিষেধ তথা ধর্মকে বিশ্বাস করে আসছেন তা কি বাস্তব সত্য, না কি রূপক ও অমূলক প্রবাদ বাক্য মাত্র, যেমন বলা হয় ‘ঘোড়ার ডিম’ যা একটি অমূলক অস্তিত্ববিহীন বস্তুর নাম মাত্র? যদি পূর্বে এমনই কঠিন সমস্যার সমাধান তিনি নিজে থেকে করে থাকেন, তবে তাঁর সেই দয়া থেকে এই যুগের মানুষকে কেন বঞ্চিত করবেন, যেহেতু সৃষ্টিকর্তার সত্তা ও তাঁর গুণাবলী অপরিবর্তনীয়?
যাহোক, এত যুক্তিপূর্ণ কথা শুনার পরও যদি কেউ অবিশ্বাস করে তবে অবিশ্বাসীদের ভাগ্যে কোন মঙ্গল নেই-এটাই সত্য বলে মানতে হবে। জগতে কোন মানুষকে বিশ্বাস না করে কেউ স্রষ্টায় বিশ্বাসী হতে পারে না এবং কোন মানুষকে বিশ্বাস না করে জগতে কেউ কোন উন্নতিও করতে পারে না। যেমন-আবিষ্কারকের প্রতি বিশ্বাস না করলে জগতে কোন নতুন জিনিস আবিষ্কৃত হত না, মানুষও উন্নত জাতি হতে পারত না। এমন কি জগতের আদান-প্রদান, চাকুরী-মজুরী সব কিছুই বিশ্বাসের উপর চলছে। এক মাস পর মনিব মজুরীর টাকা দিবে-এই বিশ্বাসেই চাকর মজুরী খাটছে। অথচ সেই মনিব কখনো কখনো মিথ্যা বলতে পারে বা তার চরিত্র খারাপ বা সে কম জ্ঞানীও হতে পারে। তবুও তাকে বিশ্বাস করা চলে! আর যে মানুষটি সত্যবাদী, চরিত্রবান ও জ্ঞানবান, তারপর তিনি স্রষ্টাতেও অটল বিশ্বাসী এবং স্রষ্টার আদেশ ক্রমেই মানুষকে মঙ্গলের দিকে ডেকে থাকেন অথচ তাকে বিশ্বাস করা যায় না! তাকে অবিশ্বাস করবে একমাত্র অতি দুর্ভাগা অধঃপতিতজন ছাড়া আর কে? মানুষ দেখা যায়, কিন্তু ভাগ্য কেউ দেখে না, তাই কে সৌভাগ্যবান আর কে দুর্ভাগা তা ধরা যায় না। সেই জন্যই এমনি কঠিন যুগে স্রষ্টার বিধান প্রকাশক দাসের ডাকে কেউ কেউ বিশ্বাস করে কেউ কেউ করে না। যারা বিশ্বাস করে তারা সৌভাগ্যবান আর যারা অবিশ্বাস করে তারা দুর্ভাগা সাব্যস্ত হয়। অতঃপর জগতের মানুষ বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী-এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যায়। তখন আর বিভিন্ন ধর্মের আর কোন সমস্যাই থাকে না, থাকে শুধু মাত্র দুইটি শ্রেণী- বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী। বিশ্বাসীগণ স্রষ্টার দল ও অবিশ্বাসীরা শয়তানের দল বলে পরিগণিত হয়। তাই এই দুই দলে সংঘর্ষ হওয়াও স্বাভাবিক। সংঘর্ষের সময় দলপতির প্রতি ভক্তি ও অটল বিশ্বাস রাখা এবং বিপদে ধৈর্য ধারণ করা অপরিহার্য কর্তব্য। সুতরাং স্রষ্টার পক্ষ হতে যিনি আহ্বান করেন, রূপক হিসাবে তিনিই স্রষ্টার স্থলাভিষিক্ত দলপতি। কাজেই তার আদেশ-নিষেধ জান, মাল ও মান দিয়ে পালন করা ও তার প্রতি অটল ভক্তি ও বিশ্বাস রাখা একান্ত জরুরী। এ শুধু সৃষ্টিকর্তার হেকমতি পরীক্ষা মাত্র, তবে বিশ্বাসীগণের পেছনে স্রষ্টার সাহায্য প্রবল বেগে বাতাসের ন্যায় এসে পৌঁছে এবং তাঁরই সাহায্যে বিশ্বাসীগণ জয়যুক্ত হয়। পক্ষান্তরে, অবিশ্বাসীদের দলপতি যে, সে রূপক হিসেবে শয়তানের স্থলাভিষিক্ত হয়। তাই অবিশ্বাসীরা স্রষ্টার শত্রুদলে পরিণত হয় এবং সৃষ্টিকর্তা তার শত্রুদলকে ধরাধামে নানাবিধ অপমানজনক অবস্থায় ফেলে শাস্তি দিয়ে নাস্তানাবুদ করে থাকেন। আর বিশ্বাসীদেরে জয়যুক্ত করে পৃথিবীতে এক নতুন জাতি হিসেবে কায়েম করেন।
কাজেই এখন আমার সকল ভাইয়ের কাছে আমি আবেদন করছি, আপনারা এই যুগের আহ্বানকারীকে বিশ্বাস করুন এবং আমাদের সকলেরই যিনি মালিক ও স্রষ্টা তাঁর দলভুক্ত হোন-ইহাই নিরাপদ এবং তার বিপরীত কঠিন বিপদ। ইহা আমি সেই মালিকের পক্ষ থেকে অবগত হয়ে বলছি যাঁর হাতে আমার জীবন। যতক্ষণ তিনি আমাকে রক্ষা করবেন ততক্ষণ সৃষ্টির কোন শক্তি নেই যে আমার ক্ষতি করতে পারে। আর তিনি যদি আমাকে কোন বিপদে ফেলেন তবে সৃষ্টির কোন শক্তি নেই যে আমাকে বিন্দুমাত্রও উপকার করতে পারে। অতএব আমি সেই একক ও অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তাতেই বিশ্বাসী ও তাঁরই সাহায্য সর্বদা কামনা করি। সকল বিশ্বাসীগণের জন্যও তাঁর সাহায্য কামনা করি। হে মহান প্রভু, তুমি এই দাসের প্রার্থনা কবুল কর। ইতি –
তারিখ – ১১ আষাঢ়, ১৩৮০ বাং
২৬ জুন, ১৯৭৩ খ্রিঃ।