আল্লাহর কলঙ্ক !
আল্লাহর কালাম বলছে, “আল্লাহু নুরুছ ছামাওয়াতে অল আরদ” – “আল্লাহ হলেন আসমান ও জমিনের আলো।”
আর সেই আল্লাহর কলঙ্ক!
হ্যাঁ স্বীকার করছি, কারো কারো কাছে কথাটা একটু খটমটে মনে হতে পারে বৈ কি। তাই বলে হঠাৎ করে মেরে বসবেন না যেন! তাতে কিন্তু আপনার হাত অবশ্যই কলঙ্কিত হবে। কারণ, আমি একটু ক্ষুদ্র মশা বৈ ত নই। আর মশা মারলে কার না হাত কলঙ্কিত হয়?
সে যাহোক, এবার তা হলে সেই কলঙ্কের কাহিনীই শোনা যাক।
আবহাওয়া দপ্তরের সংবাদ পরিবেশন করে বাংলাদেশ রেডিও জানাচ্ছে ঃ “আজ (১১ মার্চ, ১৯৮২) সুর্যোদয় হয়েছে সকাল ছ’টা বার মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হবে সন্ধ্যা ছ’টা পাঁচ মিনিটে।”
আপনারা কেউ কি ঘড়ি মিলিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন, বাংলাদেশ রেডিও মারফত আবহাওয়া দপ্তর যে সময় জানিয়েছে তা ঠিক কি অঠিক? যদিও বা কেউ মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন, তারা কি সব কিছু ঠিক ঠাক মত পেয়েছেন? অর্থাৎ আপনার হাতের ঘড়ি যে সময় বলছে, আবহাওয়া দপ্তর যে সময় দিয়েছে এবং সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত যে সময় হচ্ছে – এ তিনটা সময়ই কি এক ঠায় মিলে গেছে? যদি না মিলে, তখন আপনি কি করবেন?
তখন আপনি নিজের কানই বেশ করে মলতে থাকেন, তা নয় কি? অর্থাৎ আপনার হাতের ঘড়ির বলা সময়ই যে সত্য এবং সঠিক তা সত্য বলে প্রমাণ করার জন্য সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তকে মুহূর্তের জন্যও কি আগু-পিছু করতে পারবেন? বা আবহাওয়া দপ্তরের পরিবেশিত সময়কে ভুল বলে প্রমাণ করার ক্ষমতা কি আমাদের কারো আছে? সুতরাং সুবোধ বালকের মত নিজের কান মলে মলেই শুধরিয়ে নিতে হয় এবং তা-ই আমরা করে থাকি, তা নয় কি?
তা না হয় আমরা করলাম। কিন্তু ‘সূর্যোদয়’ এবং ‘সূর্যাস্ত’ – এ কথা দুটি কি আদতেই ঠিক?
আমরা সবাই জানি, আদতে সুর্য উঠেও না, ডুবেও না। বরং আমরা নিজেরাই একবার ডুবি আর একবার ভেসে উঠি। আমাদের নিজেদেরই ডুবা ও ভাসার কলঙ্কে সূর্যকে কলঙ্কিত করছি।
এ কলঙ্ক থেকে সূর্যকে কেউ কি মুক্তি দিতে পারবেন? আমরা জানি, যতদিন এই আকাশ এবং এই মাটি বিদ্যমান থাকবে, ততদিন সূর্যকে কেউ এ কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিতে পারবে না।
আমার আপনার জীবন নির্বাহের জন্যই সূর্যের এ কলঙ্ক স্বীকার করে নেয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই, যদিও আমরা জানি, আমাদের দেয়া কলঙ্ক থেকে সূর্য সম্পূর্ণ পবিত্র।
তদ্রƒপই আমরা প্রত্যেকেই বিশ্বাস করি। আল্লাহ নিরায়েব-নির্দোষ। তিনি নিরাকার। স্থান কাল এবং বস্তু (ঝঢ়ধপব, ঃরসব ধহফ সধঃঃবৎ) সব কিছুই আল্লাহর সৃষ্ট। সুতরাং এর কোন কিছুর দ্বারা আল্লাহকে সীমাবদ্ধ করা যায় না। আর এ তিনটি ছাড়া আমরা কোন জ্ঞানও লাভ করতে পারি না। অর্থাৎ এ তিনটির উর্ধ্বেও যে কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্ভব, তা একমাত্র অন্ধভাবে বিশ্বাস করে নেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
আল্লাহর কোন আকার নেই। অথচ আকার হীন কোন কিছুর অস্তিত্ব কি আমরা কল্পনাও করতে পারি? সুতরাং দেহধারী ভৌতিক মানুষের কাছে আল্লাহর অস্তিত্ব যে ভাবেই আমরা প্রমাণ করতে চাই না কেন, যতক্ষণ না তাঁকে আমরা একটা ‘ভূতে’ রূপান্তরিত করতে পারি, ততক্ষণ আল্লাহ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অশ্বডিম্বের মতই নাম-সর্বস্ব একটি অবাস্তব অস্তিত্ব বৈ কিছুই নয়। অর্থাৎ সাধারণভাবে আল্লাহ সম্বন্ধে আমাদের প্রাথমিক জ্ঞান হল একটি অবাস্তব অস্তিত্বের শুধু একটি নাম মাত্র। তরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে সমগ্র জাগতিক জ্ঞান বুদ্ধি প্রয়োগ করে আল্লাহ সম্বন্ধে আমরা যে জ্ঞান লাভ করলাম তা’ একটা ‘ভূত’ মাত্র, অর্থাৎ স্রষ্টা আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের কল্পিত একটা রূপ মাত্র।
কিন্তু আল্লাহ হচ্ছেন স্বয়ং সক্ষম সর্বশক্তিমান বাস্তব অস্তিত্ববান এক ব্যক্তি। তিনি যখন যা ইচ্ছা করেন, তখনই তিনি তা’ করতে সক্ষম।
তা’হলে দেহধারী কোন ভৌতিক মানুষের কাছে কি তিনি আপন অস্তিত্বের সঠিক জ্ঞান দান করতে সক্ষম নন? তিনি যদি কোন মানুষের কাছে আপনার সত্যিকার পরিচয় না-ই দিতে পারবেন তা’হলে তা তার পরিবর্তে ভূতের পূজাই মানুষ করবে এবং এই ভূতের পূজাই চিরকাল পৃথিবীতে স্থায়ী থাকিবে। এক আল্লাহর পূজা কেউ আর কোন দিন করত না। কিন্তু তা’ত নয়। সময় সময় ভূতের পূজা খুব জোরছেই চলতে থাকে। সময় সময় এই ‘ভূত’ ভেঙ্গে নিরাকার খোদার পূজারও ব্যবস্থা হয়। মানুষ যখন এক আল্লাহর পূজা ছেড়ে ‘ভূত’ পূজার দিকেই বেশী ঝুঁকে পড়ে, তখনই তিনি এই ‘ভূত’ পূজার মূলোৎপাটনের ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু, কি তাঁর ব্যবস্থা?
তিনি সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে সপ্তম আসমান থেকে নেমে এসে মেঘের উপর দাঁড়িয়ে মনুষ্য পুত্রগণকে ডেকে বলবেন, “এই যে আমি এখানে তোমাদের সদা প্রভু। উপরের দিকে মুখ তুলে তাকাও, তোমাদের সদা প্রভুকে অবলোকন কর?”
অথবা তিনি কি আসমান থেকে আমাদের জন্য লেখা কেতাব পাঠিয়ে দিবেন?
আমাদের পূর্বেও ত অনেক কওম আল্লাহর এরূপ ভৌতিক প্রকাশ চেয়েছিল। কিন্তু তা কি তারা পেয়েছিল? হযরত মুছা(আঃ) এর কওম ত আল্লাহকে স্বচক্ষে না দেখা পর্যন্ত তার প্রতি ঈমান আনতেই অস্বীকার করে বেঁকে বসেছিল। তাদের ‘খাই’ মেটাবার জন্য আল্লাহ তাদেরকে পাহাড়ের দিকে তাকাতে বলেছিলেন। তারা পাহাড়ের দিকে তাকাতে পেরেছিল কি?
আহলে কিতাবীরা হযরত মোহাম্মদ (দঃ) এর কাছে চেয়েছিল যে, তার পিছে পিছে কেন একজন ফেরেস্তা এসে সাক্ষ্য দেয় না? অথবা আকাশ থেকে কেন একটা লেখা কেতাব তাদের চোখের উপর দিয়ে পাক খেতে খেতে নাজেল হয় না? এর জবাবে আল্লাহ জানিয়েছিলেন যে, ফেরেস্তা নাজেল হলে বেঁচে থাকার মত অবকাশও যে তারা পাবে না, ইত্যাদি।
তা’হলে ভূত ছাড়াবার কি ব্যবস্থা তিনি অতীতে করেছিলেন? বা মানুষের কাছে তাঁর বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণ করার কি ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন?
দেহধারী ভৌতিক মানুষের পক্ষে যে ব্যবস্থা বুঝা অতি সহজ এবং স্বাভাবিক, সে ব্যবস্থাই তিনি করেছিলেন। সেটা কোন ব্যবস্থা?
এটা ঠিক তদ্রƒপ এক ব্যবস্থা যেমন, পৃথিবীতে বসবাস করে সূর্যকে আমরা আমাদের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করতে দেখি। প্রকৃতপক্ষে, সূর্যের চারিদিকে আমরাই প্রদক্ষিণ করছি। আমরা সূর্যকে দেখি, কিন্তু আমরা তা’ মিথ্যার এক কলঙ্কের আড়াল দিয়ে দেখি।
শরীরী মানুষও আল্লাহকে দেখে, কিন্তু তা’ সে মিথ্যার এক কলঙ্কের আড়াল দিয়েই দেখে।
তা’ কেন?
আমরা দেখলাম সতী-সাধ্বী ইমরানের স্ত্রী স্বীয় গর্ভস্থিত সন্তানকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করছেন। ভূমিষ্ট হওয়ার পরেই সন্তানটিকে আল্লাহর নবী হযরত যাকারিয়া (আঃ) এর তত্ত্বাবধানে আল্লাহর ঘরেই ছেড়ে দিলেন। যৌবন প্রাপ্তা হওয়া পর্যন্ত এই সন্তান পবিত্র নাম তপ্ জপ্ করছেন। তালা বন্ধ ঘরে থাকা অবস্থায়ও ভরণ-পোষণের জন্য তার কাছে আল্লাহর কাছ থেকে ফল-মেওয়া পৌঁছতে দেখলাম। কোন পুরুষ তাঁকে স্পর্শ করেনি বলে আল্লাহর নামে শপথ করতে দেখলাম। এত সব সত্ত্বেও আমরা কি তাকে কলঙ্কিত না করেই ছেড়ে দিয়েছিলাম?
যে সন্তানকে দোলনায় থাকা অবস্থা থেকে আমরা কথা বলতে শুনলাম; জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে ভাল করতে দেখলাম; সে সন্তানটিকে আমরা কি কলঙ্কিত না করেই ছেড়ে দিয়েছিলাম?
যে সন্তানটিকে আমরা চল্লিশটি বছর আমাদের মধ্যেই কাটাতে দেখলাম, কোন দিনে যাকে একটি মিথ্যা কথা বলতেও শুনলাম না, শৈশব থেকেই যাকে আমরা তার সততার জন্য ‘আল-আমিন’, ‘সত্যবাদী’ বলে খেতাব দিলাম, তাকে কি আমরা মিথ্যাবাদী, প্রবঞ্চক লম্পট, ধর্মত্যাগী, খোদাদ্রোহী প্রভৃতি অপবাদে কলঙ্কিত না করেই ছেড়ে দিয়েছিলাম?
এমনি ভাবেই না আমরা লক্ষাধিক নবী-রসুলকে মিথ্যা কলঙ্কে কলঙ্কিত করে ধর্মের ধ্বজা উচ্চে তুলে যাজক-পুরোহিত-মুফতী, ইমাম-পীর-বুজুর্গ সেজেছিলাম? আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদেরকে কলঙ্কিত করে এরূপ ধর্মগুরু সাজার বাসনাকে চিরতরে মিটিয়ে দিয়ে শয়তান কি আজকাল খুব সাধু সেজে নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়েছে? লক্ষাধিক নবী-রসুলের পবিত্র জীবন কার জন্যে কলঙ্কিত হয়েছিল? যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁরা আল্লাহর হুকুমেই মানুষকে আহ্বান করেছিলেন, ততক্ষণ কি তাদের নামে কোন কলঙ্ক হয়েছিল? সুতরাং যে মুহূর্ত থেকে তাদের কথার সঙ্গে এক আল্লাহর হুকুম যুক্ত হয়ে যায়, সে মুহূর্ত থেকেই তারা মিথ্যাবাদী ধর্মদ্রোহী, যাদুকর, প্রবঞ্চক প্রভৃতি মিথ্যা অপবাদে কলঙ্কিত হয়। অথচ এর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষের কাছে তারাই থাকেন নিষ্কলুষ-নিষ্কলঙ্ক।
এক আল্লাহর আহ্বান জানানোর জন্যই ত তাদের বিরুদ্ধে কলঙ্কের এই ঝড়। যুগ যুগ ধরে কত মানুষ আসছে-যাচ্ছে। তারা এক আল্লাহকেই ডাকছে এবং এক আল্লাহর কথাই বলছে, কেউ কেউ হয়ত তাঁর সাথে কিছু যোগ-বিয়োগও করছে। কই! তাদের নামে ত কেউ এমনিভাবে কলঙ্ক লেপন করছে না! কিন্তু যুগে যুগে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির নামে কেন এই কলঙ্ক? আর তাদের কারো নামে কি এই কলঙ্ক স্থায়ী হতে পেরেছে?
তাদেরকে দেয়া এই কলঙ্কের কাহিনীকেই না পরবর্তীকালে আমরা রূপে-রসে-ছন্দে-পয়ারে সাজিয়ে গীত ও গজল গাই?
লজ্জা হয় না, যখন তাদেরকে আমরা কলঙ্ক দেই?
লজ্জ হয় না, দু’দিন বাদেই যখন আমরা তাদের নামে আবার প্রশংসা-গীত গাই?
কি বলছেন?
আমরা ত কাউকে কোন কলঙ্ক দেইনি। আমরা ত সবার প্রশংসাই করছি?
– বেশ, তা’ হলে, “আমরা শুধু প্রশংসা-গীতই গাইব। কাউকে কোন কলঙ্কই আর দেব না।” এরূপ বলতে পারবেন কি?
– আমরা প্রশংসা-গীত করছিই। কলঙ্কের প্রশ্ন আবার কেন, যখন কেউ আর আসবেনই না?
– ধরুন, আল্লাহর হুকুমে যদি কেউ এসেই পড়েন? আল্লাহর হুকুম ত আর আমাদের কারো মুখ পানে চেয়ে হবে না।
– না, না, কেউ আর আসতে পারে না। এরূপ আর হতেই পারে না।
– ধরুন, যদি এরূপ হয়েই যায়, তা’ হলে আপনাদের স্থির সিদ্ধান্ত, অবশ্যই আপনারা তাকে কলঙ্কিত করবেন, এ-ই ত?
সুতরাং অতীতে যারা কলঙ্কিত হয়েছিল, তাদের প্রশংসা-গীতই যখন আজ আমরা গাইছি, আর যারা কলঙ্কিত করেছিল তাদেরকে অভিশাপ দিচ্ছি; তদ্রƒপ আজ আবার আমরা যাদের কলঙ্ক গাইব, পরবর্তীতে তাদের প্রশংসা-গীত অবশ্যই আবার আমাদের গাইতে হবে, আর আজ আমরা যারা কলঙ্কিত করছি, তাদের উপরই পরবর্তীতে অভিশাপ হবে। এ-ই ত নিয়ম।
মাফ করবেন, একটু বেয়াদবী করছি। কেবল মাত্র একটা উপাখ্যান হিসেবেই বর্ণনা করছি। হাতের কাছে যত সব উপাখ্যান আছে, তার মধ্যে এ উপাখ্যানটিকেই বেশী উপযোগী মনে করছি, যদিও জানি, এ উপাখ্যানটির নায়ক-নায়িকার নাম শোনা মাত্র কেউ কেউ হয়ত, ‘তৌবা-আস্তাগফেরুল্লাহা’ পাঠ করবেন। অনেকেই হয়ত অনুযোগ করবেন যে, মুসলমানদের কেতাব-পুস্তকে কি এর মত কোন কাহিনী পাওয়া গেল না?
হ্যাঁ, আমার ‘খোরায়’ তথ্য এত থোড়া যে এর চাইতে উত্তম উপাখ্যান আপাততঃ আর কোন একটিকেও পাচ্ছি না। সে যাহোক, আমার এ গরীবী হালতের জন্য আবারও আমি মাফ চাচ্ছি।
আমরা যতটুকু জানি তা এই যে, শত শত বছরের সমাজ-ধর্ম-সংস্কারের মন্ত্র দিয়ে পুরোহিত ঠাকুর আয়ানের সঙ্গে রাধা সুন্দরীকে বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁশীর মোহনীয় সুরে কালো দেহের আড়ালে শ্রীকৃষ্ণের যে পৌরুষ শ্রীমতি রাধারাণী দেখতে পেয়েছিলেন তার তুলনায় আয়ানের পৌরুষ ছিল সমুদ্রগ্রাসী তৃষ্ণার সম্মুখে এক বিন্দু শিশিরের মত। রাধা সুন্দরী তাই শত শত বছরের প্রতিষ্ঠিত সমাজ-ধর্ম-সংস্কারের মোহ ত্যাগ করে আয়ানের সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়ে কৃষ্ণ-চরণে লুটিয়ে পড়ে অনন্ত প্রেমের তৃষ্ণা নিবারণের পথ খোঁজে পান।
সামাজিক দৃষ্টিতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-লীলা কলঙ্কের লীলা বৈ কিছু নয়। পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত কোন সমাজই তাদের এই লীলাকে স্বীকৃতি দিতে পারে না। তবুও আমরা দেখতে পাচ্ছি, হিন্দু সমাজ তাদের প্রেম-লীলার মাহাত্ম্য কীর্তনকে ধর্মের একটি অঙ্গ এবং মুক্তির একটি উপায় হিসাবে গণ্যমান্য করছে। আর গায়ের-হিন্দু মুসলমান সমাজ তাদেরকে ‘ছিঃ’ ‘ছিঃ’ করছে। তা’ হলে এর কোনটা ঠিক? মুসলমানদের ‘ছিঃ’ ‘ছিঃ’ করাই ন্যায়সঙ্গত না হিন্দুদের ‘মাহাত্ম্য কীর্তনই” সত্য? এটি একটি অতি প্রাচীন কাহিনী, এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কে যাওয়া যুক্তি সঙ্গত মনে করিনে।
মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, প্রত্যেক বস্তি ও সম্প্রদায়ের মধ্যেই সতর্ককারী ও সুসংবাদ দাতা প্রেরিত পুরুষ এসেছিলেন।
এই প্রেরিত পুরুষদের মধ্যে অতি অল্প সংখ্যকের নামই পবিত্র গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। তা’ হলে প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি হিন্দুস্থানে কোন প্রেরিত পুরুষ আসেন নি, এ কথা আমরা কোন মতেই মেনে নিতে পারছি না। এখানে কে কে এসেছিলেন, সে সম্বন্ধে আমরা যখন নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলার সাহস পাচ্ছি না, আর বৃহত্তর হিন্দু সমাজ যখন শ্রীকৃষ্ণকে একজন অবতার বলে মান্য করছে, তখন তার নামে প্রচারিত কোন ‘লীলার’ কথা শুনেই ‘ছিঃ’ ‘ছিঃ’ করাকে আমরা ন্যায় সঙ্গত বলে মনে করতে পারছি না, যেরূপ ভাবে ইহুদীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা ‘ছিঃ’ ‘ছিঃ’ করতে পারছি না হযরত ঈসা (আঃ) এর মাতা মরিয়ম সম্বন্ধে। মরিয়মের সতীত্ব সম্বন্ধে যেহেতু কোরানে উল্লেখ আছে, সেহেতু তাঁকে মেনে নেয়া আমাদের জন্য সহজ হয়েছে। মনে করুন, রাধা-কৃষ্ণের লীলার মত মরিয়মের ঘটনা যদি কোরানে উল্লেখ না থাকত, তা হলে তাকে সতী-সাধ্বী নারী হিসাবে মেনে নেয়া কি আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হত না, যেরূপ কঠিন হয়ে পড়েছিল বনী ইসরাইলদের পক্ষে?
চিরাচরিত প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম করে পুরুষের সঙ্গে যৌন মিলন ব্যতীত কোন মেয়ের সন্তান হতে পারে- এ কথা মেনে নেয়া বনী ইসরাইলদের জন্য অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষা ছিল, এ কথা স্বয়ং আল্লাহই উল্লেখ করেছেন। তা’ হলে চিরাচরিত সমাজ-সংস্কারের বিরুদ্ধে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-লীলা এবং কুমারী মরিয়মের সন্তান লাভ- এ দু’টির মধ্যে পার্থক্য কোথায়? কুমারী মরিয়মের সন্তান লাভকে যদি আমরা অতি সহজে মেনে নিতে পারি, তা’ হলে, রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-লীলাকে মেনে নেয়া কি অধিকতর সহজ নয়?
বিশ্বাস সম্বন্ধে পার্থক্য এই যে, একটির কথা কোরানে উল্লেখ আছে, অপরটির কথা কোরানে উল্লেখ নেই। এ-ই ত মাত্র পার্থক্য।
ধর্মীয় বিধি-বিধান মানুষ ইচ্ছা করলে পালনও করতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে ভঙ্গও করতে পারে। তাই সব সময়ই কিছু লোক ধর্মীয় বিধান পালন করে, আবার কিছু লোক তা’ ভঙ্গও করে। রাধা-কৃষ্ণের ব্যাপারে সমাজ-সংস্কারের বিধান ভঙ্গ করারই দৃষ্টান্ত পাচ্ছি। এরূপ সমাজ-সংস্কার ভঙ্গ করা কোন অস্বাভাবিক বিষয় মোটেও নয়। এরূপ সংস্কার ভঙ্গ করার উদাহরণ অহরহ পাচ্ছি।
আর একটি হল প্রাকৃতিক বিধান। এ বিধান ভঙ্গ করার ক্ষমতা একমাত্র স্রষ্টা ছাড়া আর কারোর নেই। কোন মানুষই প্রাকৃতিক বিধান ভাঙতে পারে না। কিন্তু মরিয়মের ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে যে, সেখানে প্রাকৃতিক বিধানই ভঙ্গ হচ্ছে। এরূপ প্রাকৃতিক বিধান ভঙ্গ করে কোন কিছু হওয়ার উপর বিশ্বাস করা যদি ধর্ম হতে পারে এবং তা যদি আমরা অতি সহজে মেনেও নিতে পারি, তা’ হলে, সমাজ-সংস্কারের বিধি-বিধান ভঙ্গ করে কোন কিছু হওয়ার উপর বিশ্বাস রাখলে- তা আর ধর্ম হতে পারবে না। এ কথা আমরা কিভাবে মেনে নিতে পারি?
আর ধর্মীয় বা সমাজ সংস্কারের পরিবর্তন হওয়া ত অতিশয় স্বাভাবিক বিষয়। লক্ষাধিক প্রেরিত পুরুষ এসে ত এ কাজটিই করে গেছেন। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-লীলার মধ্যে আমরা পুরোহিত-ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত সংস্কার ভাঙ্গারই উদাহরণ পাচ্ছি।
হতে পারে, যুগ যুগ ধরে ধর্ম বা সংস্কার বসে নারী নির্যাতনের বিচিত্র ধরণের যে হাজারো ইতিহাস আমরা পড়ে আসছি, তারই কোন একটির ফলশ্রুতিতে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতা ‘পাপের ফল’ কন্যা সন্তানটিকে কোনও রকমে বিদায় করার জন্য অথর্ব বৃদ্ধ আয়ানের কাঁধেই সুন্দরী রূপবতী রাধারানীকে ছেড়ে দিতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল। আর দুধ-কলার লোভে পুরোহিত ঠাকুরই হয়ত কন্যার পছন্দ-অপছন্দের কোন তোয়াক্কা না করেই পবিত্র মন্ত্র পাঠ করে এই অসম বিয়েকেই ‘প্রভুত কল্যাণময়’ বলে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। নারী নির্যাতনের ‘কল’ এই ধর্ম ও সংস্কারের বিধি-বিধানকে পদাঘাত করে শ্রীমতি রাধারানী যদি নারীমুক্তির একটা পথ দেখাতে পারেন, তা’ হলে কি তাকে খুব একটা দোষ দেয়া যায়? তার প্রেম-লীলার অন্তঃস্থিত অসংখ্য কারণাদির মধ্যে এটিও একটি হতে পারে।
রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-লীলার মধ্যে লক্ষণীয় বিষয় এ-ও হতে পারে যে, মানুষের যে বাহ্যিক রূপ, এ তার আসল রূপ নয়। বাহ্যিক রূপের মোহে যে আকৃষ্ট হয়, প্রকৃতপক্ষে সে ক্ষতিগ্রস্তই হয়। বাহ্যিক রূপ-লাবণ্য, ধন-সম্পদের প্রতি মোহকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘এশকে মাজাজী’। এশকে মাজাজীর প্রাবল্যে মানুষ তার অমূল্য সম্পদ মানব জীবনকেই করে ধ্বংস। হযরত ইউসুফ (আঃ) এর রূপ লাবণ্যের প্রতি আজিজের স্ত্রী জুলেখার প্রাথমিক আকর্ষণ ছিল এরূপ এশকে মাজাজী। আর স্রষ্টাকে জানা এবং তাকে পাওয়ার জন্য মানুষ যে ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত এমনকি রাজত্ব এবং বাদশাহিয়াত পর্যন্ত ত্যাগ করে – স্রষ্টার প্রতি মানুষের এই আকর্ষণকে বলা হয় ‘এশকে হাকিকী”। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীমতি রাধার যে আকর্ষণ ছিল তা বাহ্যিক রূপ-লাবণ্যের জন্য ছিল না। কারণ, তার বাহ্যিক রূপ ছিল অত্যন্ত কালো এবং এ জন্য তার নামও ছিল ‘কালা’ বা কৃষ্ণ। সুতরাং তার বাহ্যিক রূপের প্রতি রাধার মোটেও আকর্ষণ ছিল না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের অভ্যন্তরে যে রূপ ছিল, তা’ত আর কারো দেখার উপায় ছিল না। তবে তার আভ্যন্তরীণ রূপ বাঁশীর সুরেই প্রকাশিত হয়েছিল। এই বাঁশীর সুরেই রাধারানী শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে এক ঐশ্বরিক রূপ দেখতে পেয়েছিলেন।
এই ঐশ্বরিক রূপের আকর্ষণেই রাধারানী দীর্ঘ দিনের প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে, লাজ-অপমান, কলঙ্ক-কালিমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এক ‘ঘর’ ভেঙ্গে আরেক ‘ঘর’ গড়েছিলেন। সুতরাং রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-লীলাকে আমরা যত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি না কেন, তা মোটেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা ছিঃ ছিঃ করার মত নয়।
কিন্তু আফসোসের বিষয়, আমাদের হিন্দু সমাজ চোখের পানি ফেলে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-কাহিনী শ্রবণ করেন সত্য, কিন্তু রাধারানী মেয়ে মানুষ হয়েও মানব স্বভাব বিরোধী সংস্কারকে ভঙ্গ করার যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বর্তমান হিন্দু সমাজ কি সত্য সত্যই সমাজ-সংস্কারের মোহ ভাঙতে পেরেছেন? নাম যতই পবিত্র হোক সংস্কারের বশবর্তী হয়ে, সে নাম আমরা যত পবিত্রতার সঙ্গেই স্মরণ করি না কেন, সেই পবিত্র নামের তপ্ জপ্ কোন দিনই আমাদেরকে মুক্তি দিতে পারে না। কারণ সময়ের গতিকে রোধ করা বা যা গত হয়ে গেছে পুনরায় তাকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা ত সত্য সত্যই মহাপ্রলয়কে ডেকে আনারই প্রচেষ্টা মাত্র। কেননা, অতীতকে পুনরুত্থিত করা একমাত্র মহাপ্রলয়ের পরেই সম্ভব, পূর্বে নয়। আর এ কাজটির দায়িত্ব একমাত্র স্রষ্টার হাতে নির্দিষ্ট রয়েছে। আর এ দিনটির জন্য আমাদেরকে তিনি প্রস্তুত থাকার জন্য বার বার তাগিদ করেছেন। অতীতের পবিত্র নাম এবং স্মৃতি রোমন্থন করে অতীতকে ফিরিয়ে আনা যদি সম্ভবই হত, তা হলে যুগে যুগে দেশে দেশে নূতন নূতন সভ্যতার উদ্ভব হত না, গুহাবাসী মানুষও কোন দিন আকাশচারী হতে পারত না। সুতরাং মুক্তির জন্য প্রয়োজন হল মোল্লা-পুরোহিত-ঠাকুরদের প্রতিষ্ঠিত মানব কল্যাণ বিরোধী জীর্ণ-শীর্ণ সংস্কারের বন্ধনকে রাধা-কৃষ্ণের মতই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।
মোল্লা-পুরোহিত-ঠাকুরদের প্রতিষ্ঠিত শত শত বৎসরের সংস্কার মানব সভ্যতার ক্রমোন্নতির ধারাকে পদে পদে প্রতিহত করা ছাড়া কখনো মুক্তি দিতে পারে না। অতীতের প্রতি তাদের এই অন্ধ মোহ, সংস্কারের এই বন্ধন, প্রাকৃতিক বিধি বিধানের মতই অত্যন্ত শক্ত ও কঠিন। তাই কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে এ বিধান ভঙ্গ বা সংস্কার করাও সম্ভব হয় না। যদিও মানুষ এ বন্ধনকে পছন্দ না করে পারে না, যেহেতু মন-মগজ তাদের সংস্কারাবদ্ধ, তাই কোথাও কোথাও এ বন্ধনকে প্রকাশ্যতঃ অস্বীকার না করলেও, কার্যত যথেষ্ট ওজর-আপত্তি ও নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আড়ালে এ বন্ধনকে তারা অহরহ ছিন্ন করতেও থাকে। সমাজ ব্যবস্থার এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় স্বয়ং স্রষ্টাকেই হস্তক্ষেপ করতে হয় এবং যুগে যুগে তা-ই তিনি করে আসছেন। তবে এ কাজটি যদিও তিনিই করেন, কিন্তু যেহেতু আমাদের চক্ষু তাঁকে দেখার ক্ষমতা রাখে না, তাই তিনি শ্রীকৃষ্ণের কালো দেহের আড়াল দিয়ে কলঙ্ক-কালিমা গায়ে মেখে মানুষের দৃষ্টি সীমায় আবির্ভূত হন। যাদের দৃষ্টি ক্ষীণ বা জ্ঞান-চক্ষু অন্ধ তারা শুধু তাঁর কলঙ্ক-কালিমাই দেখতে পায়। আর যার দৃষ্টি রাধারানীর ন্যায় তীক্ষè কালো দেহের আড়ালে কলঙ্ক-কালিমার অন্তরালে স্বীয় স্রষ্টার রূপই সে দেখতে পায়। তখন সে দুনিয়া জাহানের সমস্ত সম্পদ বৈভব মান-সম্মান এবং জীবনের মোহ ত্যাগ করে আসল রূপেই লীন হয়ে যায়। আসলে কলঙ্কিত বা কলঙ্কিনী তারা কেউ নন। তারা প্রত্যেকেই সূর্যের মতই নিষ্কলুষ এবং পবিত্র।
শত শত বৎসরের সংস্কারের অন্ধ মোহে পড়ে আমাদের নিজেদের অন্তরে যে কলঙ্কের আবরণ সৃষ্টি হয়, সূর্যের আলোকচ্ছটায় যখন সে কলঙ্ক ধরা পড়ে যায়, তখন লজ্জা, অপমান, ক্ষোভ এবং জিদের বশবর্তী হয়ে সে কলঙ্ক আমরা সংস্কারকের স্কন্ধেই চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু তা আর কতক্ষণ? সূর্যকে কলঙ্কিত করার ক্ষমতা কি কারো আছে? ইবলিশ শয়তান ও তার সঙ্গী-সাথী যারা নয়, প্রকৃতই যারা আদম সন্তান, ধীরে ধীরে নিজেদের কলঙ্ক তারা বুঝতে থাকে এবং অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হতে থাকে, আর বলতে থাকে, ‘রাব্বানা যালামনা আনফুছানা অইল্লাম তগফিরলানা অ তার হামনা লানা কুনান্না মিনাল খাছেরীন’ – “ওগো প্রভু আমাদের! আমরা আমাদের উপরই অত্যাচার করেছি, যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর এবং আমাদেরকে তুমি করুণা না কর, তা হলে নিশ্চয়ই আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের শামিল হয়ে যাব”।
সুতরাং আমাদের নিজেদের কলঙ্ককে ধুয়ে-মুছে সাফ করার জন্য স্বয়ং আল্লাহ যে ব্যবস্থা করেন, সে ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে আমরা ব্যবস্থাপককেই করি কলঙ্কিত। পরবর্তীকালে এই কলঙ্কের কাহিনী কীর্তনকেই আমরা নাম দেই ধর্ম। এই কলঙ্ক কীর্তনকে ধ্বংস করার জন্য আবার যখন আল্লাহ ব্যবস্থা করেন, তখনও আবার এর ব্যবস্থাপককে করি কলঙ্কিত, পরবর্তী কালে এই কলঙ্ক কীর্তনকেই আবার আমরা নাম দেই ধর্ম। এমনিভাবে কলঙ্ক করা এবং তার সংস্কারের কাহিনীই ত ধর্মের আদি-অন্ত ইতিহাস।
এই ইতিহাসের পাতাটা একটু খুলে ধরুন।
আর আপনার হাতে ঘড়িটার দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন ত, কটা বাজে।
সূর্যোদয়ের সময় হলো কি?
চৌদ্দ’শ বছর পূর্বে যে সূর্য অস্ত গিয়েছে, তার উদয়ের সময় হলো কি? তার কিছু রক্তিমাভা দেখতে পাচ্ছেন কি?
কি বলছেন, ‘হ্যাঁ’?
তা হলে ত রাধারানীর কলঙ্কের শাড়িটা আপনাকেও পরতে হবে।
কি, ‘না’ বলছেন?
তা হলে কলঙ্কের শাড়িটা আমাকেই আপনার পরিয়ে দিতে হবে।
কি, ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলতে পারছেন না? তা হলে, ঢ়বৎভবপঃ ফবধভ ফঁসন ধহফ নষরহফ?
আর, আপনাদের সম্পর্কেই আল্লাহ বলছেন, “ছুম্মুম বুকমুন উমইয়ুন ফাহুম লা ইয়ার যিউন – এরাই মুক বধির ও অন্ধ – তাই তারা কিছুই শুনে না, কিছুই বুঝে না, কিছুই দেখে না”।
‘আবহাওয়া দপ্তরের’ পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী ঠিক সময় মতই সূর্য উঠছে, ডুবছে, আবার উঠছে। কিন্তু আমরা যে সে দিকে মুক বধির ও অন্ধ হয়ে থাকাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছি। পাছে আমাদের কলঙ্ক প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং আমরা লজ্জা পাই।
অথচ আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) নিজের ‘কলঙ্কের’ কথা স্মরণ করে করে কত কান্না-কাটি করেছেন। এ কাহিনী বলে বেড়াতে আমাদের কোন লজ্জা হয় না। শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ (দঃ) দিনে সত্তর বার তওবা করে কান্না-কাটি করতেন। এ কাহিনী বলে বেড়াতেও আমাদের কোন লজ্জা হয় না। সেখানে আমরা এমন পাক-পবিত্র ফেরেস্তা হয়ে গেলাম যে, প্রেরিত পুরুষের আগমন বার্তা শুনা মাত্রই চেঁচিয়ে উঠি, ‘না, না। আপনি কি এমন কাউকে পাঠাবেন, যে না কি দুনিয়াতে ‘কলঙ্ক’ করে বেড়াবে। আমরাইত আপনার পাক-পবিত্র বান্দা। আমরাই আপনার পাক নাম তপ্ জপ্ করছি”। অর্থাৎ আমরা মোটেও কলঙ্কজনক কোন কিছু করছি না। আল্লাহ কাউকে পাঠালেই, সে এসে দুনিয়াতে ফেৎনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে। তাই তার আগমনের সম্ভাবনার কথা শুনলেই আমরা নির্দ্বিধায় বলে দেই, “না, না। সে সময় এখনও আসেনি। দুনিয়াতে কত সুখ শান্তি এখনও বিরাজ করছে। আর আমরা যখন আছি, তখন তার আসার প্রয়োজনটা কোথায়”? মানে, প্রেরিত পুরুষের আগমনের প্রয়োজন পীর-বুজুর্গ পুরোহিত ঠাকুরগণ সৃষ্টির আদি থেকে এ পর্যন্ত কোন দিনই অনুভব করেন নি, এখনও করছেন না, ভবিষ্যতেও করবেন না। তারা কোন দিন প্রয়োজন অনুভব না করলেও, প্রেরিত পুরুষের আগমন কি আল্লাহ বন্ধ করে রেখেছিলেন?
সুতরাং কলঙ্ক ত আল্লহরই, তিনি কেন পীর বুজুর্গ যাজক পুরোহিত ঠাকুরদের মুখের দিকে চেয়ে প্রেরিত পুরুষের আগমন ঠেকিয়ে রাখছেন না। তাঁকে যদি আমরা কোন কলঙ্কই না দেব তা’হলে তিনি কেন বলবেন, “ইয়া হাছরাতান আলাল ইবাদ মাইয়্যাতিহিম মির রাছুলেন ইল্লা কানু বিহি ইয়াছতাহযিউন”- আমার বান্দাদের জন্য আফসোস! আমি এমন কোনও রাছুল পাঠাইনি যার সঙ্গে মানুষেরা ঠাট্টা বিদ্রƒপ না করেছে।
সুতরাং প্রেরিত পুরুষের আগমন বার্তা শোনা মাত্র আমরা যে কলঙ্ক দেই, এ কলঙ্ক প্রেরিত পুরুষকে দেওয়া হয় না। প্রকৃতপক্ষে এ কলঙ্ক আল্লাহকেই দেয়া হয়।
সুতরাং কলঙ্ক ত আল্লহরই, তিনি কেন মোল্লা পুরোহিত ঠাকুরদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রেরিত পুরুষ পাঠান!