হাজা রাব্বী
সর্ব প্রথম আল্লাহ্র প্রশংসা এবং তাঁর রাছুলের উপর দরূদ ও সালাম পাঠ করছি। অতঃপর শয়তানের প্ররোচনা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ্র আশ্রয় প্রার্থনা করে তাঁর রহমান ও রহিম নাম নিয়ে আরম্ভ করছি।
আল্লাহ্ তাঁর কালামে বলেছেন ঃ
১। স¥রণ কর, ইবরাহীম যখন তার পিতা আজরকে বলেছিল, ‘আপনি কি মূর্তিকে ‘ইলাহ্’ রূপে গ্রহণ করেছেন? আমি তো আপনাকে এবং আপনার কওমকে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখছি।’ (৬ঃ৭৪)
২। এইভাবে ইবরাহীমকে আমার আকাশ-লী ও পৃথিবীর রহস্যসমূহ দেখাই যাতে সে নিশ্চিত বিশ¡াসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। (৬ঃ৭৫)
৩। অতঃপর রাতের অন্ধকার যখন তাকে আচ্ছন্ন করল, তখন সে একটি তারা দেখে বলল, ‘হাজা রাব্বী’- এই আমার রব। অতঃপর যখন তা অস্ত গেল, তখন সে বলল, যা অস্ত যায় তা আমি ভালবাসি না। (৬ঃ৭৬)
৪। অতঃপর যখন সে চন্দ্রকে উদয় হতে দেখল, তখন সে বলল, ‘হাজা রাব্বী’ এ-ই আমার রব। যখন এ-ও অস্ত গেল, তখন সে বলল, ‘আমার রব আমাকে সঠিক পথ না দেখালে আবশ্যই আমি পথভ্রষ্টদের শামিল হয়ে যাব’। (৬ঃ৭৭)
৫। অতঃপর যখন সে সূর্যকে উঠতে দেখল, তখন সে বলল, ‘হাজা রাব্বী, হাজা আকবর’ এ-ই আমার রব, এ-ই সব চেয়ে বড়। যখন এ-ও অস্ত গেল, তখন সে বলল, ‘হে আমার কওম যা তোমরা শরীক কর তা হতে আমি মুক্ত।’ (৬ঃ৭৮)
৬। ‘আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁরই দিকে মুখ করছি যিনি আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মোশরেকদের দলভুক্ত নই।’ (৬ঃ৭৯)
সুরা আনআমের ৯ম রুকুর ৬টি আয়াতের তফসীর।
কিছুদিন পূর্বে (১৩-৮-৮২ খ্রি: তারিখ) একজন মৌলনা সাহেবকে (যিনি প্রতি শুক্রবার সুদূর ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা শহরের বাণিজ্যিক এলাকার এক মসজিদে খুতবার পূর্বে কিছু সময় তক্রীর করার জন্য তশ্রীফ এনে থাকেন) আলোচনা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘‘হুজুর! হজরত ইব্রাহীম (আঃ) কত বৎসর বয়সে বা তাঁর জীবনের কোন্ সময়ে একবার তারকাকে, একবার চন্দ্রকে, আরেকবার সূর্যকে ‘হাজা রাব্বী’ বলেছিলেন? তিনি যে বয়সে বা যে সময়েই ‘হাজা রাব্বী’ বলে থাকুন না কেন, এরূপ বলার পূর্বে কি তিনি কোন দিন চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে দেখতে পাননি? যদি দেখেই থাকবেন, তাহলে হঠাৎ একদিন বা এক এক রাত্রে এসবের এক একটিকে ‘হাজা রাব্বী’ বলার কারণ কি? আর যে সময় তিনি তারকাকে রব বলে ধরে নিয়েছিলেন এর পূর্বে কি তারকার চেয়ে উজ্জ্বলতর চন্দ্রকে দেখেননি? বা যখন চন্দ্রকে রব ধরে নিয়েছিলেন এর পূর্বে কি তারও চেয়ে উজ্জলতর সূর্যকে দেখেননি? আর যে রাত্রে তিনি একটি তারকাকে রব ধরে নিয়েছিলেন, সে রাত্রে কি আকাশে আর কোন তারকা উঠেনি? বা যখন তিনি………..
আমার প্রশ্ন শেষ না হতেই তিনি জবাব দিতে শুরু করলেন। তিনি জানালেন, ‘দেখুন, এ হল হজরত ইবরাহীম (আঃ) সম্বন্ধে অতীত কেচ্ছা কাহিনী। তিনি কখন কাকে কি ভেবেছিলেন তা’কি করে বলব? তাঁর মনে যখন যেরূপ খেয়াল হয়েছিল, অর্থাৎ যখন তাঁর মনে তারার কথা খেয়াল হয়েছিল, তখন হয়ত তারাকেই রব মনে করেছিলেন। আবার যখন চন্দ্রের কথা খেয়াল হল তখন হয়ত চন্দ্রকেই রব মনে করেছিলেন। আর হাজার হাজার বছর পূর্বে ইবরাহীম (আঃ) কখন কোন্ খেয়ালে কি মনে করেছিলেন, এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার এমন কি দরকার পড়ল? এ নিয়ে আমি কখনো চিন্তা-ভাবনা করি নাই, আর এর মধ্যে চিন্তা ভাবনা করার মত প্রয়োজনীয় কিছু আছে বলে মনে করি না। আপনি যদি কোন কিছু জানতে চান তাহলে আল্লাহ্কেই জিজ্ঞাসা করুন, তাঁর কাছ থেকেই জেনে নিন।’
আমি অতি না-লায়েক পাপী গোনাহ্গার। আরবী ভাষায় আমার কোন জ্ঞান নেই। (এজন্য মাঝে মাঝে বড় আফ্সোস্ হয়) তাই নিজেকে একজন অজ্ঞানী-জাহেল বলেই মনে করি এবং আলেম ওলেমা পীর বুজুর্গদের দরবারে অতিশয় ভয়-ভীতি নিয়েই বসি (যদি কখনো বসবার মত সময় হয়)। পারতপক্ষে কাউকে কোন প্রশ্ন করি না; কিন্তু কোন বিষয়ে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উদয় হলে, সন্দেহ ভঞ্জনের জন্য সুযোগ সুবিধা পেলে দু’একটা প্রশ্ন হয়ত কাউকে করি। তাই মনের মধ্যে যখন উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর পশ্চাতে একটি দ্বন্দ্ব বেশ কিছুদিন যাবৎ তোলপাড় করতেছিল, তখন প্রবল আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে অত্যন্ত ভয়-ভীতির সঙ্গে মৌলানা সাহেবকেই যথার্থ অথরিটি (অঁঃযড়ৎরঃু) মনে করে প্রশ্নগুলো করেছিলাম।
কিন্তু জবাব তিনি যা দিয়েছেন তাতে আমি মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারিনি। কারণ, কোরানের মাধ্যমে আল্লাহ্-পাক আমাদেরকে ‘পুরাণ কাহিনী’ শোনাচ্ছেন একেবারে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এবং বিনা প্রয়োজনে? কোরানের কোথাও উদ্দেশ্যহীন ও অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা আছে বলে বিশ¡াস করলে আল্লাহ্ এবং তাঁর কিতাবের মর্যাদা কি অক্ষুণœ থাকবে? আল্লাহ্ ও তাঁর কিতাবের প্রতি এরূপ বিশ¡াস কিরূপে আমাদেরকে মর্যাদা-সম্পন্ন করবে, আর আল্লাহ্ই বা কিরূপে আমাদের উপর রাজী-খুশী থাকতে পারেন? আমাদের প্রতি তাঁর না-রাজীর কোন আলামতই কি এখনও আমরা দেখতে পাচ্ছি না?
সে যাহোক, এবার আসুন, উদ্ধৃত আয়াতগুলোর প্রতি একটু চোখ বুলিয়ে নিই।
উদ্ধৃত আয়াতের প্রথমেই আল্লাহ্ বলেছেন ‘অইজ্’ অর্থাৎ (স¥রণ কর) যখন…….। একটি উদ্দেশ্যহীন ও অপ্রয়োজনীয় ঘটনাকে স¥রণ করার জন্যই কি আল্লাহ্ আমাদেরকে নির্দেশ করছেন? আল্লাহ্ যখন বলছেন ‘স¥রণ কর’, তখন হজরত মৌলানা সাহেব এ ঘটনাকে যত উদ্দেশ্যহীন ও অপ্রয়োজনীয় পুরাণ কেচ্ছা-কাহিনী বলেই মনে করুন না কেন, আমরা কিন্তু মৌলানা সাহেবের এ জবাবটিকে কোরানের শিক্ষা ও নীতি-বিরুদ্ধ বলেই মনে করছি।
তাই বলে, মৌলানা সাহেবের বিরুদ্ধে আমরা কোন অভিযোগ আনছি না বা কারো দরবারে তার বিরুদ্ধে কোন কেস্ও দায়ের করছি না।
তবে এখানে বিষয়টি উল্লেখের অন্য একটি কারণ আছে। নায়েবে নবী বা ওয়ারেছুতুল আম্বিয়া রূপে অশেষ ভক্তি ও শ্রদ্ধার অধিকারী এমন একজনের মুখে আল্লাহ্র কালাম সম্বন্ধে এমন ধরণের কথা সত্য সত্যই শোনা যাবে কি না, এ বিষয়ে আমার মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ ছিল। এই সন্দেহ ভঞ্জনের জন্যই ভূমিকা স্বরূপ মৌলানা সাহেবকে প্রশ্নগুলো করেছিলাম।
আমার মোর্শেদ কেবলার উছিলায় পরম দয়াময় আল্লাহ্ আমাকে যে বুঝ দিয়েছেন, সে বুঝের একটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ অনে¡ষণ করছিলাম। মৌলানা সাহেবের জবাবের মধ্যে আমার সেই বুঝের একটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেল মাত্র।
সে বুঝটা কি?
তা হলো, উদ্ধৃত ৩, ৪ ও ৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হজরত ইবরাহীম (আঃ) এর চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব বলা সম্পর্কিত একটি বুঝ।
হজরত ইবরাহীম (আঃ) যাকে রব বলেছিলেন, তা কি সত্য-সত্যই আসমানের চন্দ্র-সূর্য-তারকা ছিল, বা কোন্ অর্থে এই ‘রব’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
তফ্ছীর গ্রন্থে আমরা যা দেখে আসছি এবং আলেম ওলেমাদের মুখে আমরা যা শুনে আসছি তা অবিকল একই। অর্থাৎ আল্লাহ্কে খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত তিনি আসমানের চন্দ্র-সূর্য-তারকাকেই রব মনে করেছিলেন। একে একে যখন সে সব অস্ত গেল, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে এদের একটিও তাঁর রব হতে পারে না। এর পরই এগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি এক আল্লাহ্র দিকে মুখ করেন এবং যথার্থ আল্লাহ্র সন্ধান পান ও শেরেকী থেকে বেঁচে যান। কোরান পাকের এই আয়াত সম্বন্ধে মোটামুটি এ-ই হল আমাদের শিক্ষা এবং বিশ¡াস। আভিধানিক অর্থে আয়াতত্রয়ের প্রকাশ্য তফ্ছীর এ-ই।
প্রিয় পাঠক! একটু পূর্বে এ সম্বন্ধে হজরত মৌলানা সাহেবের অভিমত শুনেছেন। এখন আপনারাও একটু চিন্তা-ভাবনা করুন।
এবার আমাদের ধারণার কথাও শুনুন।
প্রথমতঃ কোরান-পাক থেকে উদ্ধৃত সংশ্লিষ্ট ৩টি আয়াতই আবার একটু আলোচনা করে দেখি।
কোরানে উল্লেখ আছে, রাতের আঁধার যখন তাকে আচ্ছন্ন করল, তখন একটি তারকাকে দেখে বলল, ‘এ-ই আমার রব’। অতঃপর যখন তা অস্ত গেল, তখন সে বলল, যা অস্ত যায় আমি তা ভালবাসি না।
এই উদ্ধৃতি থেকে বুঝা যাচ্ছে, রাতের অন্ধকারে তারকা দেখা তাঁর জীবনে এই প্রথম ঘটনা। এই তারকা দেখার পর তিনি ভাবতে পারেননি যে এটি আবার অস্তও যেতে পারে। যখন সত্য সত্যই তারকাটি অস্ত গেল, কেবল তখনই তাঁর বোধোদয় হল যে, আকাশের তারকা আবার ডুবেও যেতে পারে।
এছাড়াও আরো প্রশ্ন হলো, উল্লেখিত আয়াতে এক বচনে একটি তারকারই উল্লেখ রয়েছে। এতে বুঝা যাচ্ছে, যে রাত্রে হজরত ইবরাহীম (আঃ) তারকাকে রব ধরে নিয়েছিেিলন, সে রাত্রে আকাশে আর কোন তারকার উদয় হয়নি।
এ হল তারকা দেখার সাধারণ পরিপ্রেক্ষিত।
এর পরের বর্ণনা হল, অতঃপর যখন সে চন্দ্রকে উদয় হতে দেখল, তখন সে বলল, ‘এ-ই আমার রব।’ যখন এ-ও অস্ত গেল, তখন সে বলল ‘আমার রব আমাকে সঠিক পথ না দেখালে অবশ্যই আমি পথভ্রষ্টদের শামিল হয়ে যাব।’
এখানেও, চন্দ্রের উদয় হওয়া এবং অস্ত যাওয়া তাঁর জীবনে এই প্রথম দেখা। এর পূর্বে চন্দ্র সম্বন্ধে কোন জ্ঞান তিনি লাভ করতে পারেননি। চন্দ্র সম্বন্ধে পূর্ব-জ্ঞান থাকলে, চন্দ্রকে বাদ দিয়ে তারকা দেখেই ‘হাজা রাব্বী’ বলতে পারতেন কি?
সূর্য সম্বন্ধেও ঠিক একই পরিপ্রেক্ষিত। অর্থাৎ বর্ণনানুযায়ী, অতঃপর যখন তিনি সূর্যকে উদয় হতে দেখলেন, তখন তিনি মনে করতে পারেননি, এত উজ্জ্বল সূর্যও আবার অস্ত যেতে পারে। কিন্তু সত্য সত্যই সূর্য যখন অস্ত গেল কেবল তখনই তিনি বুঝতে পারলেন যে এ-ও তাঁর রব হতে পারে না।
সূর্য সম্বন্ধে পূর্ব-জ্ঞান থাকলে তিনি কিভাবে সূর্যের কথা চিন্তা-ভাবনা না করেই একরাত্রে তারকাকে আরেক রাত্রে চন্দ্রকে রব বলতে পারেন? বুঝ-জ্ঞান সম্পন্ন কোন লোকের কথা বাদ দিয়ে, চন্দ্র-সূর্য তারকার উদয়-অস্ত সম্বন্ধে এরূপ জ্ঞান একটা ন্যাংটা ছেলেরও থাকতে পারে কি? তখন চন্দ্র-সূর্য-তারকার উদয়-অস্ত সম্বন্ধীয় একটা ন্যাংটা ছেলের জ্ঞানও হজরত ইবরাহীম (আঃ)এর ছিল না, তা কি আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারি?
এ হল এক দিকের বিচার। অপর একটা দিকের বিচারও একটু দেখুন।
এক আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে রব বা ইলাহ্ ধরা সম্পূর্ণ শেরেকী, তা যে কোন সময়ের জন্যই হোক না কেন। উদ্বৃত আয়াতের বর্ণনানুযায়ী, দু রাত এবং এক দিন, মোটামুটি ৩৬ ঘণ্টা সময় হজরত ইবরাহীম (আঃ) এক আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব ধরেছিলেন। অর্থাৎ প্রায় ৩৬ ঘণ্টাকাল হজরত ইবরাহীম (আঃ) শেরেকীতে লিপ্ত ছিলেন – কশ্মিনকালেও আমরা একথা মনে স্থান দিতে পারি কি? কিন্তু কোরানের প্রকাশ্য আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করলে, আমরা কোন মতেই এই অভিযোগ খ-ন করতে পারি কি? অবশ্য অনেকেই বলবেন যে, হজরত ইবরাহীম (আঃ) প্রাথমিক জীবনে অল্প সময়ের জন্য না হয় একটু ভুল করেই ফেলেছিলেন, এতে মহাভারত এমন কি অশুদ্ধ হয়ে গেল?
হজরত ইবরাহীম (আঃ) এর মত নবীর বেলায় যদি মুহূর্তকালের জন্যও শেরেকীর ভুল স্বীকার করে নেয়া হয়, তা হলে মহাভারত অবশ্যই অশুদ্ধ হবে। কারণ, তা হলে কোন মোশরেকের কাছেই এক ইলাহ্র দাওয়াত দিতে পারা যাবে না। মোশরেক তখন যুক্তি দেখাবে হজরত ইবরাহীম (আঃ) যদি এক আল্লাহ্কে খুঁজতে খুঁজতে চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব ধরে শেরেকী করার পরও আল্লাহ্র একজন পিয়ারা নবী হতে পারেন, তা হলে আমরাও না হয় একটু শেরেকী করলাম; শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্কে তো আমরা পেতেও পারি, যেমন ইবরাহীম (আঃ) পেয়েছিলেন; যেহেতু আমাদের পূজা-পার্বণের উদ্দেশ্য তো একমাত্র তিনিই।
দ্বিতীয়ত: তিনি যে এই ভুলটা করেছিলেন, এর স্বীকৃতি কোরানের কোথাও আছে কি? হজরত আদম (আঃ) ভুল করে ফেলেছিলেন, তার জন্য তিনি কত তওবা, কত কান্নাকাটি করলেন, তারপর আল্লাহ্ তাঁকে মাফ্ করলেন। এ বর্ণনা কোরানের একাধিক জায়গায়ই আছে। আর হজরত ইবরাহীম (আঃ) শেরেকীর মত মহাপাপে লিপ্ত ছিলেন, তার জন্য তিনি কোন তওবা বা কান্নাকাটি করেছিলেন এর দলিল-প্রমাণ কি কোথাও আছে?
এখানে কেউ হয়ত বলতে পারেন যে চন্দ্র-সূর্য তারকার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহর দিকে মুখ করাই তাঁর তওবা।
কিন্তু এই আল্লাহ্কে তিনি কোন্ সময় কিভাবে কোন্ দিকে দেখতে পেলেন যে তিনি তাঁর দিকে মুখ করতে পারলেন? আভিধানিক অর্থ অনুযায়ী এতক্ষণ ত তিনি চন্দ্র-সূর্য তারকাকেই রব বলতে পাগল। আল্লাহর খোঁজ ত তিনি এখনও পাননি। এ জন্যই ত তিনি চন্দ্র-সূর্য তারকাকেই রব ধরে বসেছিলেন। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি স্বয়ং আল্লাহ তাঁর সামনে এসে হাজির হলেন, আর তিনি আল্লাহকে দেখতে পেয়েই চন্দ্র-সূর্য-তারকার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাঁর দিকে মুখ করলেন? সাধারণ বিশ্বাস মতে, এতক্ষণ ত তিনি আল্লাহকে খুঁজছিলেন। সূর্য অস্ত যাওয়ার পরক্ষণেই যে তিনি আল্লাহকে পেয়ে গেলেন এ বর্ণনা কি এখানে আছে?
বরং সূর্য অস্ত যাওয়ার পরক্ষণেই তিনি তাঁর কওমকে ডেকে বলছেন ঃ তোমরা যা শরীক করছ তা থেকে আমি মুক্ত। আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁরই দিকে মুখ করছি যিনি আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মোশরেকদের দলভুক্ত নই।
অর্থাৎ তিনি শেরেকীর অপরাধে অপরাধী করছেন তাঁর কওমকে, নিজেকে নয়। নিজেকে এ অপরাধ থেকে মুক্ত বলে এবং মোশরেকদের দলভুক্ত নন বলেই বর্ণনা রয়েছে। তাই শেরেকীর পাপ থেকে তওবা করার বর্ণনা এখানে নেই। এখানে যা আছে তা হল শেরেকী যারা করছে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহ্র দিকে একনিষ্ঠভাবে মুখ করা এবং মোশরেকদের দলভুক্ত নন বলে তাঁর সাফাইয়ের বর্ণনা। সুতরাং এখানে আল্লাহ্র দিকে মুখ করার অর্থ কোন মতেই শেরেকীর পাপ থেকে তওবা করা বুঝায় না।
সুতরাং তিনি যে মুহূর্তকালের জন্য হলেও শেরেকী করেছিলেন এবং এ শেরেকী থেকে তওবা করেছিলেন এর দলিল-প্রমাণ কোথাও পাওয়া যাবে না।
অধিকন্তু, আল্লাহ্-পাক বলেছেন, ‘ইন্নাশ শিরকা লাজুল্মুন আজিম’ – নিশ্চয় শিরক্ মহা পাপ। যে র্শিক করবে সে সবচেয়ে বড় জালেম। স্বয়ং আল্লাহ্-পাকই বলছেন – জালেমকে আল্লাহ্ পথ দেখান না। যাকে আল্লাহ্ পথ দেখান না, সে আবার পথ প্রদর্শক হবে কি ভাবে? তা ছাড়া কোন মানুষ যেমন ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, তেমনি কোন নবী-রছুলও ভুলের ঊর্র্ধ্বে নন। তাঁরাও ভুল করেন। কোরান-পাকে আল্লাহ্ হজরত রছুলে করিম (দঃ)কে লক্ষ্য করে একাধিকবার বলেছেন, ‘আপনি নিজের ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’(৪০-৫৫) কিন্তু নবী-রছুল কোনও সময় কোন ভুল-ত্রুটি করলেও নবুওত লাভের আগে বা পরে কোন সময়ই তাঁরা কোন শেরেকীর মত মহাপাপে লিপ্ত হতে পারেন না। স্বয়ং আল্লাহ্-পাকই তাদেরকে শেরেকীর পাপ থেকে পাক পবিত্র রাখেন। সুতরাং ইবরাহীম (আঃ) কোন সময় মুহূর্তকালের জন্যও শেরেকী করেননি।
এবার আসুন তরতীব অনুযায়ী উদ্ধৃত আয়াতগুলোর তফ্ছীর আবার একটু দেখে নিই।
উদ্ধৃত ১ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে: স¥রণ কর, ইবরাহীম যখন তার বাপ আজরকে বলল, ‘আপনি কি মূর্তিকে ‘‘ইলাহ্’’ রূপে গ্রহণ করেছেন? আমি তো আপনাকে এবং আপনার কওমকে স্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যেই দেখছি।’
উদ্ধৃত ২ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে: ‘এইভাবে আমরা ইবরাহীমকে আকাশম-লী এবং পৃথিবীর রহস্য সমূহ দেখাই যাহাতে সে নিশ্চিত বিশ¡াসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’
উপরোক্ত ২টি আয়াতের বর্ণনার পরেই আসছে চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব ধরার বর্ণনা। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব ধরার বর্ণনা প্রথমেই উল্লেখ করা হয়নি। সর্ব প্রথম যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল যথার্থ ইলাহ্র পরিবর্তে মূর্তিকে পূজা করা নিয়ে বাপ ও কওমের চিরাচরিত বিশ¡াসের বিরুদ্ধে জীবনের উপর ঝুঁকি নিয়ে হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর উপদেশ প্রদান। বাপ ও কওমের বিরুদ্ধে হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর উপদেশ প্রদান সম্বন্ধে সুরা মারয়াম, শোয়ারা, আন্কাবুত, আচ্ছাফ্ফাতী, যুখরুফী, মুমতাহীনা, প্রভৃতি সুরার বিভিন্ন আয়াতে রয়েছে। অনুগ্রহ করে পাঠকগণ তা দেখে নিতে পারেন।
সুরা মারয়ামের ৪৬ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে, হজরত ইবরাহীম (আঃ) যদি তাঁর পথ থেকে না ফিরেন, তাহলে পাথর মেরে শেষ করে দেওয়ার বাপের হুমকী।
জীবনের উপর এরূপ ঝুঁকি নিয়ে হজরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর বাপ ও কওমের চিরাচরিত ধর্ম বিশ¡াসের বিরুদ্ধে এক ইলাহ্র সারবত্তা, মূর্তি পূজার অসারতা এবং তাদের স্পষ্ট বিপথগামীতা সম্বন্ধে যখন যুক্তি-তর্ক পেশ করছেন, তখনও কি আমাদের মনে করতে হবে যে এক ইলাহ্র পরিচয় হজরত ইবরাহীম (আঃ) তখনও জানতে পারেননি? আরো, তাঁর কওমের বিরুদ্ধে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতার অভিযোগ করে নিজেই আবার আকাশের চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব ধরে ভুল করা কি তাঁর পক্ষে সম্ভব?
অধিকন্তু এর পরের আয়াতে আল্লাহ্-পাক জানাচ্ছেন যে, ‘‘এইভাবে ইবরাহীমকে আমরা আকাশ-ম-লী এবং পৃথিবীর রহস্য সমূহ দেখাই যাহাতে সে নিশ্চিত বিশ¡াসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’’ এরপরও কি আমাদের মনে করতে হবে যে, আকাশ-ম-লী ও পৃথিবীর পরিচালন-ব্যবস্থা বা রহস্য সমূহ দেখে নিশ্চিত বিশ¡াসীদের দলভুক্ত হওয়ার পরও আকাশের চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব ধরে ইলাহ্ রূপে গ্রহণ করার মত ভুল-ত্রুটি সম্বন্ধে জ্ঞান বুদ্ধি তখনও তাঁর হয়নি, সে জন্য তিনি অন্ধকার রাত্রে চন্দ্র-তারকাকে উঠতে দেখেই ‘হাজা রাব্বী’, ‘হাজা রাব্বী’ বলে ডাকতে শুরু করে দিলেন?
এরপরও, চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে ‘হাজা রাব্বী’, ‘হাজা রাব্বী’ বলে ডেকে তিনি যে ভুল করলেন, এই ভুলের স্বীকৃতি এবং এর জন্য অনুশোচনা করার উল্লেখ কোথাও নেই। বরং এই ভুলের জন্য তিনি তাঁর কওমকেই দোষারোপ করছেন এবং তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহ্র দিকে মুখ করারই উল্লেখ রয়েছে।
সুতরাং কোরান এবং যুক্তি তর্কের মাধ্যমে আমরা কোন মতেই প্রমাণ করতে পারছি না যে, আভিধানিক প্রকাশ্য অর্থ অনুযায়ী হজরত ইবরাহীম (আঃ) সত্য সত্যই আকাশের চন্দ্র-সূর্য-তারকাকেই রব বা ইলাহ্ ধরে নিয়েছিলেন।
তবে কোরান-পাকে যখন উল্লেখ আছে, তখন আমাদের অবশ্যই বিশ¡াস করতে হবে যে, যে কাউকে হোক বা যে অর্থেই হোক কিছু সময়ের জন্য হলেও কাউকে না কাউকে তিনি রব ধরেছিলেন। তা হলে আকাশের চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব ধরার বিকল্প কি হতে পারে, সে সম্বন্ধে আমাদের কোন চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন আছে কি? এখানে হয়ত কেউ বলতে পারেন যে হাজার হাজার বছর পূর্বে কাকে তিনি কি বলেছিলেন, তা জানা কি সত্য সত্যই খুব জরুরী হয়ে পড়েছে? তা জানতে না পারলে কি আমাদের খুব একটি ক্ষতি হয়ে যাবে?
ইবরাহীম (আঃ) এর রবই যদি মোহা¤মদ (দঃ) এর রব হয়ে থাকেন আর আমরা যদি ইবরাহীম (আঃ)-এর মিল্লাতেরই অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবী করি এবং তাঁর রবকেই আমরা রব হিসাবে ধরতে চাই, তা হলে রব রূপে যা ইবরাহীম (আঃ) কে ধোকা দিতে চেয়েছিল এবং আল্লাহ্র সাথে যাকে শরীক করা থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করেছিলেন, সেই রবের পরিচয় জানা কি আমাদের জন্য জরুরী নয়, যাতে আমরাও সেই রবের ধোঁকা থেকে বাঁচতে পারি এবং এক সত্য রবের দিকে মুখ করতে পারি?
এখানে অনেক ভাই হয়ত মনে করতে পারেন যে, রব হিসাবে আমরা তো এক আল্লাহ্কেই স্বীকার করি এবং মান্যও করি। কোন মিথ্যা রবই আমাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে না এবং কোন মিথ্যা রবের পূজাও আমরা করছি না। সুতরাং মিথ্যা রব সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করার কোন প্রয়োজনও আমাদের নেই।
কিন্তু আমার কথা হলো, আপনারা ধৈর্য সহকারে এই আলোচনাটা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ইনশাল্লাহ্ তার পরেই বুঝা যাবে আমরা কে কোন্ রবের পূজা করছি।
কোরানে উল্লিখিত আয়াতের তরতীব অনুযায়ী উপরে যে আলোচনা হয়েছে তাতে স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে যে চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব ধরার পূর্বেই ইলাহ্ বা সত্য রব সম্বন্ধে হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর পূর্ণ জ্ঞান ছিল।
এ প্রসঙ্গে উপরে দেখানো হয়েছে যে, বাপ ও তাঁর কওমের সঙ্গে যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে তা এক ইলাহ্র এবাদত এবং মূর্তি পূজা সম্পর্কিত ছিল। এ ছাড়া, নিশ্চিত বিশ¡াসীদের দলভুক্ত করার জন্য আল্লাহ্ তাঁকে আসমান-জমিনের রহস্য সমূহ দেখিয়েছেন চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব ধরার পূর্বেই।
অধিকন্তু, সুরা মারয়ামের ৪৩ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে যে, মূর্তি পূজার অসারতা সম্বন্ধে বাপকে উপদেশ-দান উপলক্ষে হজরত ইবরাহীম (আঃ) বলছেন, ‘হে আমার পিতা! এমন একটি তথ্যের খবর আমার কাছে এসেছে যা আপনার কাছে আসেনি। সুতরাং আমারই পথে আপনি এগিয়ে আসুন, আমিই আপনাকে সরল পথ দেখাব।’ তার কাছে কোন তথ্যের খবর আসা এবং সরল পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে বাপকে তাঁর অনুসরণ করার অনুরোধ করা, প্রভৃতি বর্ণনা হতেও প্রমাণিত হচ্ছে যে চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব ধরার পূর্বেই ইলাহ্ সম্বন্ধে তাঁর পূর্ণ জ্ঞান ছিল। রব বা ইলাহ্ সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান থাকা কালে তিনি আবার কিরূপে চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে ইলাহ্ মনে করতে পারেন? সুতরাং তিনি যাকে রব ধরে নিয়েছিলেন, নিশ্চয়ই তা আকাশের চন্দ্র-সূর্য-তারকা ব্যতীত অন্য কিছু হবে। আর সে যা-ই হোক এক আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে ইলাহ্ অর্থে রব ধরা প্রকাশ্য র্শিক। সুতরাং যাকেই তিনি রব বলে থাকুন না কেন, ইলাহ্ অর্থে কাউকে তিনি রব ধরেন নি।
তা হলে এখন আমাদেরকে দেখতে হবে চন্দ্র-সূর্য-তারকা এবং রবের বিকল্প কি হতে পারে। আরো দেখতে হবে এরূপ বিকল্প অর্থ করার সমর্থনে কোন দলিল-প্রমাণ আছে কিনা।
এক্ষণে আমরা বিকল্প গ্রহণের সমর্থনে দলিল-প্রমাণ সম্বন্ধে আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ্।
সুরা আল ইমরানের ১ম রুকুর ৭ম আয়াতে আল্লাহ বলছেন:
‘‘এই কিতাব – যাহার কতক আয়াত হইতেছে মোহ্কাম, সেগুলি হইতেছে কিতাবের মূলাধার (স্বরূপ); এবং আর কতকগুলি হইতেছে মোতাশাবেহ্, ফলে যাহাদের অন্তরে আছে অসরলতা, তাহারা অনুসরণ করিয়া থাকে তাহার মধ্য হইতে মোতাশাবেহ আয়াতগুলির বিপর্যয় ঘটাইবার মতলবে এবং (অসঙ্গত) তাৎপর্য বাহির করার উদ্দেশ্যে, অথচ তাহার তাভীল কেহই জানিতে পারে না – আল্লাহ্ ব্যতীত এবং জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুনিপুণ ব্যক্তিগণ ব্যতীত, তাহারা বলে, আমরা ঈমান আনিয়াছি কেতাবে; [মোহকাম ও মোতাশাবেহ্] সমস্তই সমাগত হইয়াছে আমাদের প্রভু পরওয়ারদেগারের হুজুর হইতে, বস্তুত সুষ্ঠু বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন লোকেরা ব্যতীত আর কেহই উপদেশ গ্রহণ করে না।’’ (তাফ্ছীর মৌলানা মোহা¤মদ আকরাম খাঁ)
দ্বিতীয় তাফ্ছীর – তিনি আপনার কাছে কিতাব নাজিল করেছেন, তার একাংশ হচ্ছে আদেশ সূচক আয়াতের শামিল। আর তা-ই হচ্ছে কিতাবের মূল অংশ। অপর অংশ হচ্ছে রূপক ও বিবিধ অর্থে পরিপূর্ণ আয়াতসমূহ। সুতরাং যাদের মনে কুটিলতা রয়েছে তারাই বিবিধ অর্থপূর্ণ অংশ নিয়ে মেতে উঠে – ফিতনা-ফাসাদের খোঁজে, সে সবের বিবরণের খোঁজে। অথচ সে সবের বিবরণ একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানে না। যারা সত্যিকার জ্ঞান-সাধক তারা বলে ঃ আমাদের পালনকর্তার কাছ থেকে এসেছে। উপদেশ ত শুধু তারাই গ্রহণ করে যারা সত্যিকার জ্ঞানী। (তাফ্ছীর-মৌলানা হাকীম আব্দুল মান্নান – তাজ কোম্পানীর ছাপা)।
উপরোক্ত উদ্ধৃতি হতে জানা যাচ্ছে যে কোরানে দু’শ্রেণীর আয়াত আছে। এক শ্রেণীর আয়াত সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আরেক শ্রেণীর আয়াত রূপক। একশ্রেণীর আলেম তাফ্ছীর করেছেন যে, রূপক শ্রেণীর আয়াতের ব্যাখ্যা একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানে না। আরেক শ্রেণীর আলেম তাফ্ছীর করেছেন যে, রূপক শ্রেণীর আয়াতের ব্যাখ্যা কেউ জানে না আল্লাহ্ ব্যতীত এবং জ্ঞনে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুনিপুণ ব্যক্তিগণ ব্যতীত।
মোহ্কাম এবং মোতাশাবেহ আয়াত সম্বন্ধে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বেশ দীর্ঘ। আমি এখানে দীর্ঘ আলোচনায় যেতে চাই না। অতি সংক্ষেপে কেবল কয়েকটি প্রমাণ পত্র পেশ করে এ প্রসঙ্গ শেষ করব ইনশাল্লাহ্।
সুরা হুদের প্রথম আয়াতে বলা হচ্ছে: এই যে কেতাব (কোরাণ) মোহ্কাম করা হয়েছে এর আয়াতগুলোকে পুনরায় বিশদরূপে বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলোকে প্রজ্ঞাময় সর্ববেত্তার (আলা¬হ্র) তরফ হতে।
সুরা যোমারের ২৩ আয়াতে বলা হয়েছে: আলা¬াহ্ নাজিল করেছেন উৎকৃষ্টতর বাণী (অর্থাৎ) এই কিতাবকে যা হচ্ছে (মোতাশাবেহ্ বা) পরস্পর সদৃশ ও পুনঃ পুনঃ বর্ণিত। (৩৯ঃ২৩)
প্রথম আয়াতে বলা হচ্ছে যে, কোরানের আয়াতগুলো সবই হচ্ছে মোহ্কাম এবং অন্যত্র – সেই মোহ্কাম আয়াতগুলোর তাফ্ছীর এবং বিশদ বিবরণ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে সমগ্র কোরাণ মজিদকেই মোতাশাবেহ্ বলা হয়েছে। এই আয়াত দু‘টি হতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, মোহ্্কাম ও মোতাশাবেহ্ বলে কোরাণের আয়াতগুলোকে দু‘টি স্বতন্ত্র ও পরস্পর বিপরীত শ্রেণীতে বিভক্ত করা কোনও মতেই সঙ্গত হতে পারে না।
সুরা হা-মী-ম সেজদার প্রথম কয়েক আয়াতে বলা হচ্ছে হে, করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহ্র তরফ হতে নাজিল করা হলো এ কিতাব, যার আয়াতগুলো বর্ণিত হয়েছে সুস্পষ্টভাবে আরবী ভাষায় প্রকাশিত কোরাণরূপে, বিদ্বান সমাজের জন্য। এই আয়াত হতে এবং এই শ্রেণীর বহু আয়াত হতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে কোরানের আয়াতগুলো আরবীতে সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় নাজিল করা হয়েছে যেন মানুষ তা বুঝতে পারে। সুতরাং তার কতকগুলো আয়াতকে সকল মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণ অবোধ্য বলে নির্ধারিত করে রাখলে, কোরানের এ সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করতে হবে। আর যে আয়াতের মর্ম আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন মানুষের পক্ষেই জানা সম্ভব নয়, তেমন আয়াত আল্লাহ্ নাজিল করেছেন কি আমাদের সঙ্গে হাসি-মশ্করা করার জন্যে? সুতরাং আমাদের একশ্রেণীর তাফ্ছীরকার এবং আলেম-ওলামা কোরান-পাকের কিছু কিছু আয়াতের এমন অর্থ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে রেখেছেন যা ডেমোক্লিসের তরবারীর (ঝড়িৎফ ড়ভ উধসড়পষবং) মত সর্বদা আমাদের ঘাড়ের উপর ঝুলছে। একটু এদিক ওদিক হলেই আর রক্ষা নেই! যে কোন মুহূর্তে পড়ে তা আমাদের দেহ থেকে মাথাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে! এই ভয় এবং ভীতিতে আড়ষ্ট হয়ে থাকতে থাকতে আমাদের মন-মেজাজ এমন বিগ্ড়ে গেছে যে বেঈমান, কাফের হয়ে যাওয়ার ভয়ে সহজ সরল স্বাভাবিক বিষয়টিকেও আমরা সন্দেহের চোখে না দেখে পারি না।
সে যাহোক উদ্ধৃত আয়াতের তাফ্ছীরের এক অংশে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এক শ্রেণীর তাফ্ছীরকার এবং ওয়ায়েজীনদের জন্য একটি শাণিত অস্ত্র রয়েছে এবং তা তারা যে কোন মুহূর্তে আমাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে পারেন। তা হল এই ঃ সুতরাং যাদের মনে কুটিলতা রয়েছে তারাই অর্থপূর্ণ অংশ নিয়ে মেতে উঠে ফিতনা-ফাসাদের খোঁজে, সে সবের বিবরণের খোঁজে। অথচ সে সবের বিবরণ এক মাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানে না।……
উদ্ধৃত আয়াতের এই অংশটুকু দেখিয়ে তারা অনায়াসে প্রমাণ করতে পারবেন যে, বিপর্যয় ঘটাবার মতলবে আমরা মোতাশাবেহ্ আয়াতের বিকৃত অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছি এবং ‘মনগড়া’ অর্থ বের করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার তালে আছি। এই অভিযোগ তারা অনায়াসে আমাদের বিরুদ্ধে আনতে পারেন।
এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য হল ঃ স্বয়ং আল্লাহ-পাক যেখানে বলছেন যে কিতাবের একাংশ আয়াত হচ্ছে রূপক ও দ্ব্যর্থবোধক, সেখানে সহজ আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করলে কি যথার্থ তাৎপর্য পাওয়া যাবে? আর এই দ্ব্যর্থবোধক রূপক আয়াতের যথার্থ অর্থ যদি আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ জানতেই না পারবে, তা হলে এসব আয়াত নাজিল করার কি প্রয়োজন থাকতে পারে?
আর রূপক অর্থ প্রহণ না করে আমরা যদি এর সরল আভিধানিক অর্থই গ্রহণ করি, তাহলে সরল আভিধানিক অর্থে হজরত ইবরাহীম (আঃ) যে একজন অজ্ঞ-জাহেল ও মোশরেক ছিলেন, এ কথাকেই মেনে নিতে হবে না কি? প্রকাশ্য আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করে হজরত ইবরাহীম (আঃ)-কে একজন অজ্ঞ-জাহেল এবং মোশরেক প্রমাণ করাই কি বুদ্ধিমানের কাজ?
সুতরাং আভিধানিক অর্থ গ্রহণ করলে যেখানে হজরত ইবরাহীম (আঃ)-কে একজন অজ্ঞ-জাহেল এবং মোশরেক বানাতে হয়, সেখানে সংশ্লিষ্ট আয়াতটির বিকল্প রূপক অর্থ গ্রহণ করাই কি যুক্তি সঙ্গত নয়? হজরত ইবরাহীম (আঃ) এর মত একজন জলিল-কদর নবীর ইজ্জত স¤মান অক্ষুণœ রাখার জন্যই আমরা সংশ্লিষ্ট আয়াতের প্রকাশ্য আভিধানিক অর্থ পরিত্যাগ করে আল্লাহ্র কালামের দলিল মোতাবেক রূপক অর্থ গ্রহণ করতে আমরা ন্যায়ত বাধ্য হচ্ছি।
সে যাহোক, এবার ‘রব’ শব্দটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। ‘রব’ বলতে আমরা সাধারণত এক আল্লাহ্কেই বুঝি। ইহা আল্লাহ্র একটি গুণবাচক নাম। বাংলায় একাধিক অর্থে ইহা ব্যবহৃত হয়, যেমন, প্রভু, মালিক, প্রতিপালক, মনিব, জগদীশ¡র, পরামর্শদাতা, অভিভাবক, মুরুব্বী, বিশ¡পালক, অধিপতি প্রভৃতি। ইঞ্জিল বা বাইবেলে ধর্মযাজক, পুরোহিতদের জন্য ‘রাব্বী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আর কোরান-পাকে আল্লাহ্ বলেন, “তারা ত আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে নিজেদের পীর-পুরোহিতদেরকেই ‘রব’ ধরে রেখেছে।” (৯ঃ৩২) সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রভু, মনিব, মুরুব্বী, পরামর্শদাতা বা অভিভাবক শব্দগুলো প্রধান অর্থে এক আল্লাহ্কে বুঝালেও এ শব্দগুলো কোন কোন মানুষের বেলায়ও ব্যবহৃত হয়। ইংরেজিতে রবের অর্থ ‘লর্ড’ শব্দ দ্বারা এক সৃষ্টিকর্তাকে বুঝালেও কোন কোন মানুষের বেলায়ও এর প্রয়োগ হয়ে থাকে। আর নমরূদ, ফিরাউনের বেলায় স্রষ্টা হিসাবে ‘রব’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি; বরং দেশের মধ্যে দ–মু-ের প্রধানতম কর্তা হিসাবেই ব্যবহৃত হয়েছে। সার কথা হল, (চবৎংড়হ রহ ধঁঃযড়ৎরঃু) অর্থাৎ যে যেই বিষয়ে ক্ষমতাবান সে-ই সে বিষয়ের ‘রব’। দেশ শাসনের ব্যাপারে যে ক্ষমতাবান, সে-ই দেশের ‘রব’- প্রভু বা মালিক। এ হিসাবেই নমরূদ ফেরাউন ‘রব’ দাবী করেছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে যারা ক্ষমতাবান ধর্মীয় ক্ষেত্রে তারাই ‘রব’। তাদেরকে আল্লাহ্র ন্যায় পূজা করা না হলেও তাদের আদেশ-নিষেধকে আল্লাহ্র কালামের মতই পালনীয় সত্য বলে গ্রহণ করা হয় এবং আল্লাহ্র প্রতিভূ হিসাবে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা হয়।
এবার দেখা যাক মানুষের পক্ষে চন্দ্র-সূর্য-তারকা হওয়ার কি দলিল প্রমাণ আছে।
স্বয়ং আল্লাহ্ হজরত রাছুলে করিম (দঃ)-কে বলেছেন ‘ছিরাযাম মুনিরা’ – উজ্জ্বল সূর্য। আর হজরত রাছুলে করিম (দঃ) সাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘আছহাবীকা নুজুমে’ আমার সাহাবাগণ আকাশের নক্ষত্র। আর হজরত ইউসুফ (আঃ) চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে স্বপ্নে তাঁকে সেজদা করতে দেখেছিলেন। বাস্তবে এই চন্দ্র-সূর্য-তারকা ছিল তাঁরই বাবা-মা এবং ভাইয়েরা।
সুতরাং মর্তের কোন কোন মানুষই কোন কোন সময় রূপকে আকাশের চাঁদ-তারা-সুরুজ হয়ে যায় এর প্রমাণ কোরান-হাদিস থেকেই পাওয়া গেল।
কোরাণের মূল ভাব অনুযায়ী আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে হজরত ইবরাহীম (আঃ) রব ধরে নিয়েছিলেন তাঁর জীবনে তাদের আবির্ভাব ছিল কতকটা আকসি¥ক। এই চন্দ্র-সূর্য-তারকার উদয়-অস্ত সম্বন্ধে তাঁর কোন পূর্ব জ্ঞান ছিল না। তাঁর সমস্যা সঙ্কুল অন্ধকারময় জীবনে প্রথম যে তারকার আবির্ভাব ঘটে, তা দেখে তিনি ভাবতে পারেননি এরও চেয়ে উজ্জ্বলতর আলোময় আরো কিছু আছে বা অতিসত্বরই এই আলো লোপ পেয়ে যেতে পারে।
এখন আমরা অতি সহজেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, যে চন্দ্র-সূর্য-তরকাকে হজরত ইবরাহীম (আঃ) রব ধরেছিলেন, তা আকাশের চন্দ্র-সূর্য-তারকা ছিল না, কারণ হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর মত একজন নবী তো দূরের কথা এমন কোন মানুষই নেই যার আকাশের চন্দ্র-সূর্য-তারকার আলোর স্তর ভেদ এবং তাদের উদয়-অস্ত সম্বন্ধে কোন জ্ঞান না আছে।
একটু পূর্বে আমরা এ-ও দেখেছি যে জ্ঞান-বুদ্ধি প্রভাব ক্ষমতার ক্রমানুসারে মানুষই চন্দ্র-সূর্য-তারকার সঙ্গে তুলনীয় হয় এবং এক একজন মানুষই সমাজ ধর্ম এবং কালের উপর এক একটি চন্দ্র-সূর্য-তারকার প্রভাব বিস্তার করে।
আর আমাদের প্রত্যক্ষ দর্শন হলঃ অন্ধকার রাত্রে তারকার আলোই আমাদেরকে পথের দিশা দেয়। কিন্তু চন্দ্রোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই এই তারকার আলো মøান হয়ে যায়। আর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই চন্দ্র ও তারকা উভয়েরই আলো সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়।
মানব জাতির ভাগ্যাকাশে এই সূর্যোদয় হল নবী-রাছুলের আবির্ভাব। কিন্তু এই সূর্যের আবির্ভাব বড় প্রহেলিকাময়। ঘন ঘোর কালো মেঘ এবং প্রবল ঝড় ঝঞ্ঝার আড়ালে উর্ধ্বাকাশে তাঁদের আগমন যখন সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়, নিম্নাকাশে তখন পূর্ববর্তী নবীর পরিত্যক্ত আলোক রশ্মির রেশ ধরে উদ্ভব হয় কিছু নকল চন্দ্র, সূর্য ও তারকার। এই নকল চন্দ্র-সূর্য-তারকার আতশ্বাজির আলোচ্ছটায় ধর্মভীরু মানুষ দিশেহারা হয়ে দিক-বিদিক ছুটতে থাকে। একবার যাকে সে আলো ভেবে গ্রহণ করে, পরক্ষণেই দেখে তা দুর্গন্ধময় ঘৃণ্য বিষ্ঠা। তখন সে হতাশায় পড়ে ভেঙ্গে। ধর্মের প্রতি জ›েম তার প্রচন্ড ঘৃণা। এভাবেই জ›ম হয় পরিপূর্ণ নাস্তিকের।
এবার আসুন দেখা যাক ‘হাজা রাব্বী’ সংক্রান্ত আয়াতটির প্রকাশ্য আভিধানিক অর্থের বিকল্প রূপক কি হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট আয়াতটির প্রথমেই বলা হচ্ছে, ‘অতঃপর রাতের অন্ধকার যখন তাকে আচ্ছন্ন করল, তখন সে একটি তারা দেখে বলল…।’
মানুষ যখন অন্ধকারে পড়ে তখনই আলোর প্রয়োজন হয় এবং আলোর অনে¡ষণ করে। এমন কোন মানুষ নেই যার উপর রাতের আঁধার আপতিত না হয়। রাতের আঁধার প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই অন্তর্হিত হয়। এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার কারো কোন কিছু নেই। রাতের অন্ধকারে মানুষ নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে এবং চলেও। এই রাতের অন্ধকারের চেয়েও আরেকটি গাঢ়তর অন্ধকার আছে যা মানুষকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়। তখন সে আর কোন কাজকর্মে অগ্রসর হতে পারে না। কি করবে তা আর ভেবে পায় না। চোখে-মুখে তখন সে অন্ধকার দেখে। এ অবস্থায় যখন কেউ পড়ে, তখন এটাও তার জন্য রাতের অন্ধকার। অন্যান্য অন্ধকারের সঙ্গে আমাদের কারো পরিচয় না ঘটে থাকলেও ‘আইয়্যামে জাহেলিয়াত’ শব্দ দুটির সঙ্গে আমরা বেশ পরিচিত। এর অর্থ আমরা বুঝি ‘অন্ধকারময় যুগ’। এই অন্ধকার শুধু রাতের বেলায়ই থাকে না। দিবস-রজনী সর্বক্ষণই এই অন্ধকার কোন কোন সময় মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ধর্মীয় জগতেও একটা অন্ধকার আছে। এই অন্ধকারে পতিত হলে মানুষ ধর্মের সারবত্তা হারিয়ে ফেলে। তখন বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান এবং বাপ-দাদার নামে অনেক কুসংস্কার সমাজে চলতে থাকে। তখন অধর্মই ধর্ম নামে আখ্যায়িত হয়। আর কেউ এই অধর্মের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করতে গেলেই সে হয় ধর্মদ্রোহী, মিথ্যাবাদী, কাফের-বেঈমান। মানুষ তখন করতে থাকে শেরেকী, অথচ বলতে গেলেই ফল হয় উল্টো, হতে হয় মোশ্রেক। এটাই হলো সবচেয়ে বড় জুলুম। নবী রছুলগণের জীবনে সবচেয়ে বড় অন্ধকার হলো এই জুলুম।
সংশ্লিষ্ট আয়াতটির পূর্ববর্তী আয়াতেই দেখতে পাচ্ছি যে হজরত ইবরাহীম (আঃ)-কে আকাশম-লী এবং পৃথিবীর পরিচালন ব্যবস্থা বা আসমান-জমিনের রহস্য সমূহ দেখানো হয় যাতে তিনি নিশ্চিত বিশ¡াসীদের শামিল হতে পারেন। অর্থাৎ এক আল্লাহ্র দিকে কওমকে পরিচালনা করার দায়িত্বভার সম্বন্ধেই তিনি অন্যান্য নিশ্চিত বিশ¡াসীদের অর্থাৎ নবী-রছুলগণের দলভুক্ত হন।
একদিকে হেদায়েতের কঠোর দায়িত্বভার, অপর দিকে পাথর মেরে শেষ করে দেওয়ার বাপের কঠোর হুমকী। এই অবস্থাটাই ছিল রাতের আঁধার যা তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আর এই অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসার জন্যই তিনি খুঁজছিলেন আলো। কিন্তু এই আলো তিনি কোথায় পাবেন? আপন বাপই যেখানে প্রধান বৈরী, সেখানে তিনি আর কার কাছে আলো লাভের আশা করতে পারেন? এ অবস্থায় তিনি স্বাভাবিক ভাবেই প্রভাবশালী ক্ষমতাবান লোকের সাহায্য সমর্থন কামনা করছিলেন। অর্থাৎ উপযুক্ত মুরব্বী খুঁজছিলেন যারা নাকি তাঁকে অথরিটি সহকারে সাহায্য সমর্থন করতে পারে।
হজরত ইবরাহীম (আঃ) ভেবেছিলেন, দ্বীন নিয়ে যাদের কাজ-কারবার তাঁরাই তাঁকে সাহায্য সমর্থন করতে এগিয়ে আসবে। তাই তিনি সর্বপ্রথম মোল্লা-মৌলভী-ধর্মগুরু-প-িত-পুরোহিত-ঠাকুর ও ইমাম সাহেবদেরকেই দ্বীনের দাওয়াতের জন্য বেছে নেন। যেহেতু, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এবং পূজা পার্বণে মানুষ তাদের আদেশ-উপদেশ দিল-প্রাণ দিয়ে শুনে এবং পালন করতে চেষ্টা করে। সমাজের উপর তাদের এই প্রভাব প্রতিপত্তি দেখেই তিনি মনে করেছিলেন যে নিশ্চয়ই তারা ধর্ম বিষয়ে বুঝ-জ্ঞান যুক্তিতে যর্থার্থ ক্ষমতা বা অথরিটি এবং তাদের সাহায্য সমর্থনের মধ্যে তারকার ন্যায় প্রভাব সম্পন্ন মুরুব্বী লাভের সম্ভাবনাকে লক্ষ করেই বলেছিলেন, হাজা রাব্বী এই আমার রব বা মুরুব্বী। তিনি তখনো ভাবতে পারেননি যে এই ধর্মাচার্যরাই সর্বপ্রথম তাকে প্রত্যাখ্যান করবে। অর্থাৎ তাঁর ন্যায় প্রভাব প্রতিপত্তিহীন নিঃসহায় এক ব্যক্তির ধর্ম বিশ¡াসের স¤মুখে তারা পথভ্রষ্ট প্রমাণিত হবে বা নিষ্প্রভ হয়ে যাবে – একথা তিনি তখনো মনে করতে পারেন নি।
কিন্তু এই রব বা মুরুব্বীরা যখন তাঁর ধর্ম বিশ¡াসকে স্বীকার ও গ্রহণ করার পরিবর্তে তাঁকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল, তখনই তিনি বুঝতে পারলেন যে বুঝ-জ্ঞান-যুক্তিতে এতক্ষণ যাদেরকে তিনি উজ্জ্বল তারকা সদৃশ্য অথরিটি মনে করেছিলেন, আসলে তারা গোমরাহীর অন্ধকার ব্যতীত কিছু নয়। এভাবেই তারকা সদৃশ্য মুরুব্বী লাভের আশা তাঁর জীবন থেকে অস্তমিত হয়ে গেল। আল্লাহ্র দ্বীনকে যে অস্বীকার করে তাকে তিনি আর কি ভাবে আলবাসতে পারেন? তাই তিনি বলছেন, যা অস্ত যায় আমি তা ভালবাসি না। ‘আকাশের তারকাকে আমি ভালবাসি না’ – একথা বলার কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে কি?
এরপর তিনি তাকালেন এদের চেয়েও উচ্চ শ্রেণীর আলেম ওলামা পীর বুজুর্গ সাধু সন্ন্যাসী যারা দেশের মধ্যে বিশি®ট স¤মান ও মর্যাদার অধিকারী এবং হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক যাদেরকে শিরের তাজ জ্ঞানে জান-মাল-ইজ্জত দিয়ে সেবা করে আসছে – তাদের দিকে। মানুষের উপর প্রতিষ্ঠিত তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি তাঁর কাছে পূর্বে-দেখা তারকার চাইতে উজ্জ্বলতর চন্দ্রের প্রভাবের মতই প্রতিভাত হয়েছিল। তিনি ভাবলেন, এরা ত আর রুটি-রুজির জন্য মানুষের দান খয়রাত ও চাঁদার মুখাপেক্ষী নয়। নিশ্চয়ই এরা আল্লাহ্র সত্য দ্বীনের ডাকে সাড়া দিবে এবং তাঁকে সাহায্য সমর্থন করতে এগিয়ে আসবে। যথার্থ মুরুব্বী পাওয়ার আশায় এদেরকে লক্ষ করেই তিনি বলেছিলেন, হাজা রাব্বী – এই আমার রব বা মুরুব্বী। এদের সম্বন্ধেও তিনি তখনো ভাবতে পারেননি যে এরাও তাঁর ধর্মবিশ¡াসের স¤মুখে গোমরাহ্ প্রতিপন্ন হবে বা নিষ্প্রভ হয়ে অস্ত যাবে।
কিন্তু এরাও যখন তাঁর ধর্ম-বিশ¡াসকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করল এবং ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল, তখনই তিনি অনুভব করলেন, হায়! হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ আল্লাহ্কে পাওয়ার আশায় জান-মাল-ইজ্জত দিয়ে যাদেরকে অনুসরণ করছে, তারাও আল্লাহ্র দ্বীনকে বুঝতে পারছে না। তারাও আল্লাহ্র আহ¡ানকে চিনতে পারছে না। অর্থাৎ চন্দ্র সদৃশ উজ্জ্বল অথরিটি হিসাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ যাদেরকে মুরুব্বী মেনে আসছিল, প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন নিঃস্ব নিঃসম্বল ইবরাহীমের ধর্ম বিশ¡াসের স¤মুখে তারাও নিষ্প্রভ হয়ে অস্ত গেল। এর পরই তিনি বুঝতে পারলেন যে এদের প্রভাব প্রতিপত্তির স¤মুখে আমার ধর্ম বিশ¡াসকে কেউ সমর্থন করছে না দেখে লক্ষ লক্ষ মানুষের মিছিল দেখে আমিও যদি তাদের দিকে ঝুঁকে পড়ি, তাহলে নিশ্চয়ই আমি পথভ্রষ্টদের শামিল হয়ে পড়ব। এ অবস্থায় যদি আল্লাহ্ আমাকে পথ না দেখান অর্থাৎ সত্য পথের উপর ছাবেত কদমে না রাখেন, তাহলে নিশ্চয়ই আমি পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ব। লক্ষ লক্ষ লোকের মিছিলে শামিল হয়ে কিভাবে সহজ সরল মানুষ বিপথগামী হচ্ছে, এরূপ দৃষ্টান্তের কি অভাব আছে?
এরপর তিনি ভাবলেন, আলেম-ওলেমা-পীর-বুজুর্গ-সাধু-সন্ন্যাসীর দল হয়ত নমরূদের অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে বা তার বিরাগ-ভাজন হওয়ার ভয়েই আল্লাহ্র সত্য দ্বীনকে গ্রহণ করতে সাহস পাচ্ছে না। তখন তিনি তাকালেন নমরূদের দিকে। কিন্তু নমরূদের দরবারে যাওয়া ত এত সহজ ব্যাপার নয়। তাই তিনি এমন এক ঘটনার অবতারণা করলেন যার জন্য লোকজনই তাঁকে ধরে নিয়ে গেল নমরূদের দরবারে। নমরুদের প্রভাব প্রতিপত্তিই তাঁর কাছে সূর্যের প্রভাবরূপে প্রতিভাত হয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন, যে ব্যক্তি দুর্দ- প্রতাপে একটা দেশ শাসন করছে, যুক্তির আলোকে দ্বীনকে পেশ করতে পারলে সে হয়ত তা ঠেলে দিতে পারবে না। তখন সে-ই হবে আমার প্রধান মুরুব্বী। যেহেতু, এ-ই হচ্ছে দেশের মধ্যে প্রধানতম ব্যক্তি। একে লক্ষ করেই তিনি বলেছিলেন, ‘হাজা রাব্বী, হাজা আকবর’। একটা দেশ চালাতে যে জ্ঞান-বুদ্ধির প্রয়োজন, তেমন জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন বাদশাহ্ নমরূদ সমস্ত যুক্তি-বুদ্ধি-জ্ঞানকে পদাঘাত করে সত্য আল্লাহ্র আহ¡ানকে অস্বীকার করবে অর্থাৎ সত্য জ্যোতির স¤মুখে সে-ও অস্ত যাবে, হজরত ইবরাহীম (আঃ) তখনও তা বুঝতে পারেননি।
নমরূদের সঙ্গে তাঁর যুক্তি তর্কের বিবরণ এবং তার ফলাফল কোরান-পাকের মধ্যেই রয়েছে। আশা করি এখানে তা উল্লেখ না করলেও চলবে। যুক্তি তর্কে হেরে গিয়েও নমরূদ যখন তাঁর আহ¡ানকে অস্বীকার করল, মুরুব্বী লাভের সর্বশেষ ভরসাটিও তাঁর জীবন থেকে অস্তমিত হয়ে গেল। অর্থাৎ তিনি যে জ্যোতি লাভ করেছেন তার স¤মুখে সূর্য সদৃশ নমরূদের জ্যোতিও নিষ্প্রভ হয়ে গেল। তখনই তিনি তাঁর কওমকে ডেকে বললেন, হে আমার কওম! তোমরা (আল্লাহ্র সঙ্গে) যা শরীক করছ, (অর্থাৎ রবের ন্যায় যাদেরকে মান্য করে আসছ) তা থেকে আমি মুক্ত। (অর্থাৎ তাদের নিকট আল্লাহ্র সত্য দ্বীনকে পৌঁছানোর যে দ্বায়িত্ব আমার উপর ছিল এবার আমি তা থেকে মুক্ত)। আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁরই দিকে মুখ করছি যিনি আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। প্রভাব-শক্তি দেখে কোন মানুষকে ইলাহ্ মান্য করে আমি তোমাদের মত মোশরেকদের দলভুক্ত হতে পারি না। অর্থাৎ আমি মোশরেকদের দলভুক্ত নই।
হজরত ইবরাহীম (আঃ) আকাশের চন্দ্র-সূর্য-তারকাকে রব ধরেছিলেন, না মানুষের মধ্যস্থ কাউকে রব ধরেছিলেন এ নিয়ে এতক্ষণ যা আলোচনা করা হলো, তা একটু হের-ফের করে অতীত কেচ্ছা-কাহিনীর বর্ণনা বই কিছু নয়। অতীত কেচ্ছা-কাহিনীর এরূপ চর্বিত-চর্বণের জন্য কোরান নাজিল হয়নি। মনোমুগ্ধকর রসালো ভাষায় মানুষকে কিছুক্ষণের জন্য মাতিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে কেচ্ছা-কাহিনী বর্ণনা, তা’ সে যে কোন মহাপুরুষেরই হোক, তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, যদি না তা থেকে কোন জ্যোতি লাভ করা মকসুদ হয়ে থাকে। কোরানের অপর নাম ফোরকান – পার্থক্যকারী জ্ঞান-ভা-ার। সত্য থেকে মিথ্যা, অন্ধকার থেকে আলো পার্থক্যকারী জ্ঞানভা-ার হলো এই কোরান। মানুষকে সত্য ও সঠিক পথ দেখানোর জন্যই আল্লাহ্্-পাক এই মহাগ্রন্থ নাজিল করেছেন। হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর যে ঘটনাটি এখানে আলোচনা করা হলো, এই আলোচনা যদি এখানেই শেষ করা হয়, তাহলে এ আলোচনাটুকুও নিছক কেচ্ছা-কাহিনী বর্ণনারই শামিল হবে। আর নিছক কেচ্ছা-কাহিনী শুনানোর জন্যই এ কাহিনীটি উল্লেখ করা হয়নি।
আজর ও তার কওম যখন এক আল্লাহ্র পূজা বাদ দিয়ে নকল চন্দ্র-সূর্য-তারকার ভূত পূজায় ষোল আনা মেতে উঠেছিল তখনই আল্লাহ্-পাক তাঁর চিরন্তন বিধান অনুযায়ী ভূত পূজার মূলোৎপাটনের জন্য হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে প্রেরণ করেন। তিনি এই ভূত ভেঙ্গে এক আল্লাহ্র খালেছ আরাধনার জন্যই নির্মাণ করেন কাবা ঘর। কালক্রমে দেখা গেল, এ কাবা ঘরেই হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর মূর্তিও অন্যান্য মূর্তির সঙ্গে পূজিত হয়ে আসছে। কালের কি নির্মম পরিহাস! যিনি এককালে ভূতের বিরুদ্ধে জেহাদ করলেন, আরেককালে তাঁকেই আবার ভূতে রূপান্তরিত করে মানুষ তাকে পূজা করে আসছে। সে যাহোক সর্বশেষ হজরত মোহা¤মদ (দঃ) এসে সেই ভূতের পূজা থেকে ইবরাহীম (আঃ)-এর তৈরী আল্লাহ্র ঘরকে পাক-পবিত্র করেন সত্য, কিন্তু আল্লাহ্র তৈরী কাবা ঘর আজ আবার মোহা¤মদ (দঃ)-এর ভূতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
১। ‘তুমি না এলে দুনিয়ায়, আঁধারে ডুবিত সবই।’
– অর্থাৎ হজরত মোহা¤মদ (দঃ) দুনিয়াতে তশ্রীফ আনার পূর্ব পর্যন্ত দুনিয়া আঁধারে নিমজ্জিত ছিল। তাহলে, হজরত ঈসা, মুসা, ইবরাহীম, নূহ, আদম এবং অন্যান্য লক্ষাধিক আম্বিয়া (আঃ)গণ কি দুনিয়াতে শুধু অন্ধকারই এনেছিলেন? তাছাড়া আল্লাহ্ যে বলছেন,
‘আল্লাহু নূরুছ ছামাওয়াছে অল আরদ্’-
আল্লাহ্ই হচ্ছেন আসমান-জমিনের আলো। হজরত মোহা¤মদ (দঃ)-এর অবর্তমানে অর্থাৎ তাঁর আগমনের পূর্বে আসমান-জমিনে কি আল্লাহ্র এ নূরের কোন কমতি ছিল?
২। ‘হজরত মোহা¤মদ (দঃ)-এর উপর যে ব্যক্তি একবার দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ্ তার উপর দশ বার দরূদ পাঠ করবেন।’
তাইতো দেখা যাচ্ছে, ওয়াক্ত মত নামাজ না পড়লেও দরূদের অজিফা ঠিক ঠিকই আদায় করা হয়। আর, আমাদের এক একবার দরূদ পাঠের পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহ্র দশ দশবার দরূদ পাঠের বরকত লাভ করেই কি মুসলমানদের আজ এই অবস্থা? দেখে-শুনে আল্লাহ্র এমন দরূদ পাঠের অসার ফজিলত লাভের ইচ্ছা কি কেউ করবে?
৩। ‘মেরাজে আল্লাহ্র দরবারে পৌঁছে হজরত মোহা¤মদ (দঃ) আল্লাহ্কে দেখতে পাননি; কারণ মোহা¤মদ (দঃ)-এর জন্য স্বয়ং আল্লাহ্-পাকই নামাজে ব্যস্ত ছিলেন।’
স্বয়ং আল্লাহ্ যার জন্য নামাজ পড়তে পারেন, তাঁকে বাদ দিয়ে আমরা আল্লাহ্র নামাজ পড়ব কোন যুক্তিতে? এজন্যই বুঝি আল্লাহ্র নামাজের প্রতি আমাদের এত অনিহা।
৪। ‘হজরত মোহা¤মদ (দঃ)-এর জন্য আঠারো হাজার মখলুকাত সৃষ্টি করা হয়েছে।’
তিনি তো জন্মের পূর্বে ছিলেন না, ওফাতের পরে আর নেই। তাহলে, তাঁর এই জীবন সীমার বাইরে এই আঠারো হাজার মখলুকাত এখনও টিকে আছে কার জন্যে? না, না ভুল বলছি। তিনি আউয়ালে নবী, তিনি আখেরী নবী! অর্থাৎ তাঁর পূর্বে কেউ জ›মগ্রহণ করেননি, তাঁর পরেও কেউ আর মরবে না!! অর্থাৎ তিনি পূর্বেও ছিলেন, এখনও আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন!!! তাহলে বর্তমানে আল্লাহ্ আছেন কোথায়? দ্বিতীয়তঃ হিন্দুদের মতে স্বয়ং ভগবানই দেবকীর গর্ভে শ্রীকৃষ্ণের রূপ নিয়ে মর্তের মাটিতে অবতরণ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণই যখন স্বয়ং ভগবান, তখন তিনি আর কিভাবে মৃত্যুবরণ করবেন। তাই তিনি আদিতেও ছিলেন, বর্তমানেও আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। তদ্রƒপ হিন্দুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আপনারাও কি বলতে চাচ্ছেন যে, স্বয়ং আল্লাহ্-পাকই মুহা¤মদ (দঃ)-এর রূপ নিয়ে আমেনার গর্ভে জ›ম গ্রহণ করেছেন? তাই তিনি আর কি ভাবে মরবেন! তিনি তো আর আমাদের মত মানুষ নন!! তিনিও স্বয়ং – !!!
অথচ আল্লাহ্ বলেছেন – সব কিছুই যে আল্লাহ্র জন্য আসমান জমিনে যা কিছু রয়েছে।(৪ঃ৩১)
৫। ‘মুছা নবী কোহেতুরে মুর্ছা যায়, আমার নবী আরশে যাইয়া কথা কয়।’
হজরত মুহা¤মদ (দঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে যেয়ে ‘খাইরা উ¤মাতিন’ কিভাবে অন্যান্য নবী-রছুলগণকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে! আমরা খালি মাঠে গোল দিতে খুব উস্তাদ! এখন যদি কেহ বলে যে, হজরত মুছা (আঃ) তো দূরের কথা, তাঁরই শরিয়তের একজন ‘আধনা নবী’ হজরত যাকারিয়া (আঃ) বা হজরত ইয়াহ্ইয়া (আঃ)-এর মত নবীর কথা উল্লেখ না করলে তো মুহা¤মদ (দঃ)-এর নবুওতই পূর্ণ হত না, অথচ তাঁদের নবুওতের জন্য মুহা¤মদ (দঃ)-এর উল্লেখের প্রয়োজনই হয়নি! আর আল্লাহ্-পাক জানাচ্ছেন, লা-নুফার্রেকু বাইনা আহাদিম মির রছুলিহী – আমরা তাঁর রছুলগণের মধ্যে কোন পার্থকা করি না।
৬। রোজ হাশরে সমস্ত নবী-রছুলই বলবেন, ‘ইয়া নাফছী! ইয়া নাফছী!’ কেবল মাত্র আমাদের নবী হজরত মুহা¤মদ (দঃ) বলবেন ‘ইয়া উ¤মাতি! ইয়া উ¤মাতি!’
অথচ আল্লাহ্ বলছেন, ‘মান্ জাল্লাজী ইয়াশ্ফাও ইন্দাহু ইল্লা বিইজনিহী’ – ‘কারো জন্য কেউ তাঁর কাছে সুপারিশ করতে পারবে না তাঁর অনুমতি বাতিরেকে।’ এর অর্থ কি এই যে, হজরত মুহা¤মদ (দঃ) আল্লাহ্র অনুমতি ছাড়াই ‘ইয়া উ¤মাতি! ইয়া উ¤মাতি!’ বলে সুপারিশ করতে শুরু করবেন, আর অন্যান্য নবী-রছুলগণ সুপারিশ করার অনুমতি পাওয়ার পরও ‘ইয়া নাফছী! ইয়া নাফছী!’ করবেন?
৭। হাশরের দিন পূর্ব জমানার উ¤মত যখন অভিযোগ আনবে যে, তাদের নবী-রছুল তাদের কাছে দী¡নের দাওয়াত পৌঁছাননি, আর পূর্ববর্তী সমস্ত নবী-রছুল যখন আসামী হয়ে হাশরের মাঠে এদিক-ওদিক ছুটা-ছুটি করবেন, তখন ‘খাইরা উ¤মাতীন’ মানে উ¤মতে মুহা¤মাদী সেই সমস্ত নবী-রছুলের পক্ষে সাক্ষী দিয়ে তাঁদেরকে অভিযোগ থেকে পাক-পবিত্র করবেন।
অর্থাৎ বাপেরও জ›েমর পূর্বে দাদা কি করেছেন না করেছেন, তার সাক্ষী হবে নাতী। এমন বিচারক না হলে সাধে কি আল্লাহ্ তাদের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা চিরদিনের জন্য ছিনিয়ে নিয়েছেন?
অথচ আল্লাহ্ বলেছেনঃ (আরবী) একদিন সমস্ত উ¤মাতের মধ্য থেকেই এক একজন সাক্ষী দাঁড় করাব। (১৬ঃ৮৪)
৮। কোরান ও হাদিসের মধ্যে কোনটার কি মর্যাদা এ সম্বন্ধে আমাদের এক ইমাম সাহেব যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা-ই এখানে তুলে দেয়া হচ্ছে –
আমরা নাকি কোরান মানি না, হাদিস মানি না। তাই আমাদেরকে একবার আসামীর কাঠ-গড়ায় দাঁড় করিয়ে শত শত মুছল্লী-মুত্তাকীদের সামনে ইমাম সাহেব বোখারী শরীফের মাযেযার কাহিনী বর্ণনা করে আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন –
‘এটা বহু পরীক্ষিত বিষয় যে, কোন এলাকায় বা মহল্লায় বালা-মুছিবত, আজাব-গজব নাজিল হলে কোরান শরীফ খতম করে ছোয়াব রেছানী করেও বালা-মুছিবত, আজাব-গজব থেকে রেহাই পাওয়া যায়নি। কিন্তু বোখারী শরীফ খতম করে দোয়া করায় আল্লাহ্-পাক বোখারী শরীফের উসিলায় সে জায়গার বালা-মুছিবত, আজাব-গজব মাফ করে দিয়েছেন। (সোবহানাল্লাহ্)’
শীতলা দেবীর চরণে ভোগ দিয়ে বসন্তের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার শিক্ষার চাইতে মাননীয় ইমাম সাহেবের শিক্ষা কি উর্ধ্বে?
এই সন্দর্ভের প্রথম দিকে দেখেছেন, আল্লাহ্র কালাম কোরান শরীফের প্রতি একজন মাননীয় মাওলানা সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বশেষ দেখলেন একজন মাননীয় ইমাম সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গি। এই দুজনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মূলত কোন প্রভেদ আছে কি?
কোরানের প্রতি তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা যে কম, তা নয়। বরং কোরান ব্যবহার করতে তারা ভুল করছেন। সাধারণ মানুষের ভুল হলে নায়েবে-নবী বা ওয়ারেসাতুল আম্বিয়া – আলেম-ওলেমা, পীর-বুজুর্গগণই তাদের ভুল শোধরানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু নায়েবে-নবী বা ওয়ারেসাতুল আম্বিয়া – আলেম-ওলেমা, পীর-বুজর্গদের ভুল হলে, তাদের ভুল কে শোধরাবে? তারা তো কেউ কারো চেয়ে কম নন! কে কাকে শোধরাবেন, কে কাকে মানবেন! তারা সবাই সমান সমান! অর্থাৎ মনে-প্রানে একদম সমাজতান্ত্রিক! কেউ কাকে আগেও চলতে দিতে চান না, কেউ কারো পিছনেও চলতে চান না। তারা সবাই তখন চলেন পাশা-পাশি, লাগে কৈন্যাকৈন্যি,তারপর ধস্তা-ধস্তি। তাদের এই কৈন্যাকৈন্যি এবং ধস্তা-ধস্তি থেকে বাঁচানোর জন্যই প্রয়োজন হয় আল্লাহ্র খাস রহমত স্বরূপ মনোনীত ও প্রেরিত এক খাস বান্দার আবির্ভাব। আল্লাহ্র মনোনীত ও প্রেরিত খাস বান্দার আবির্ভাব হলো তথাকথিত নায়েবে-নবী, ওয়ারেছুতুল আম্বিয়া – আলেম-ওলামা, পীর-বুজর্গগণের জন্য এক কেয়ামত। কারণ, তিনারা দীর্ঘদিন ধরে পূরুষানুক্রমে যে শিক্ষা পেয়ে ও দিয়ে আসছেন, যার উপর ভিত্তি করে তারা ঈমান-আমলের সৌধ গড়ে তুলেছেন এবং যার জন্যে সমাজে ও দেশে চন্দ্র-সূর্য-তারকার ন্যায় স¤মান প্রতিপত্তি লাভ করে আসছেন, প্রেরিত পুরুষের আবির্ভাবের ফলে তাদের সেই শিক্ষা ও ঈমান-আমলের মধ্যে যখন ভুল-ভ্রান্তি ধরা পড়ে যায়, তা আর তারা সহ্য করে মেনে নিতে পারেন না। তখন তারা প্রেরিত পুরুষের প্রকাশ ও বিকাশের পথে সৃষ্টি করেন কাল মেঘ ও ঝড়-ঝঞ্ঝা। এতেও তারা করে বিরাট ভুল। কারণ, এই কাল মেঘ ও ঝড়-ঝঞ্ঝাই আবার গজব হয়ে নেমে এসে পড়ে তাদের উপরে। তারা তখন হয়ে যান দৃষ্টি শক্তিহীন। উত্থান দিবসে তাদেরই উত্থান হয় ততোধিক অন্ধ হয়ে।
কিন্তু ‘ভুল’ শব্দটা তাদের জন্য বড় এ্যালার্জিক। অন্যের ব্যাপারে অসংখ্য ভুল ধরার যথেষ্ঠ দক্ষতা থাকা সত্বেও নিজদের ভুল ধরার ব্যাপারে তারা বড় ভুল করেন। আর কেউ যদি তাদের এই ভুলটা ধরিয়ে দিতে চান, তাহলেই যেন মাথায় বজ্রাঘাত হয়। কোরান দিয়ে, হাদিস দিয়ে, উসুল-ফেকাহ্ দিয়ে প্রমাণ করে ছাড়বেন তারা কোন ভুল করেননি। যেমনি ভাবে ‘মুয়াল্লেমুল মালাইকা’ আদমকে সিজদা না করার পক্ষে আল্লাহ্র কাছে যুক্তি-তর্ক পেশ করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চেয়েছিল, তেমনি ভাবে তিনারাও নিজেদের ভুলটাকেই শুদ্ধ প্রমাণ করার জন্য অসংখ্য যুক্তি-তর্ক পেশ করে নিজেদেরকে পাক-পবিত্র ফেরেশতার সমতুল্যই প্রমাণ করে ছাড়েন।
দ্বিতীয়তঃ তিনারা যা জানেন না তা জানার জন্য কখনোই তারা বলবেন না যে, ‘ভাই, এই বিষয়টা ত আমি জানি না। আপনি কি জানেন? মেহেরবানী করে একটু বলুন না!’ কারণ, এতে তাদের জ্ঞান-ভান্ডারের অপর্যাপ্ততা প্রমাণিত হয়ে গিয়ে লজ্জিত ও অপমানিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে!
-প্রতক্ষ্য প্রমাণ চান?
এর প্রমাণ সংগ্রহের জন্য ইনশাআল্লাহ্ বেশি দূর যেতে হবে না। পাঠকগণও অতি সহজেই এর প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আমাদের বিশ¡াস। এ লেখায় তাদের যে ভুল-ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, পাঠকগণ নিজেরাই তাদেরকে তা জিজ্ঞাসা করে প্রত্যক্ষ প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ¡াস। তা হলে এবার একটু চেষ্টা করে দেখবেন কি এবং ফলাফলটা আমাদেরকে জানাতে পারবেন কি?
আমরা অতি সাধারণ মানুষ। ধর্মীয় ভাষা আরবী এবং আমাদের মূল ধর্মীয় গ্রন্থ কোরান-হাদিস সম্বন্ধে বলতে গেলে আমরা অজ্ঞ জাহেল। অন্যান্য দুনিয়াদারীর ব্যাপারে কড়া-গ-ায় হিসাব বুঝলেও, আল্লাহ্র দ্বীন ও তাঁর কালাম সম্বন্ধে আমাদের দিল একেবারে প্রশান্ত মহাসাগর। মৌলভী মৌলানা সাহেবদের পাহাড় পর্বতের মত উঁচু উঁচু ভারী ভারী কথা গুলো হজম করতেও আমাদের দিলে-জানে কোন বাতাস লাগে না।
কারণ, আমাদের ধারণায় তারা আল্লাহ্র দ্বীন ও কালাম সম্বন্ধে যথার্থ অথরিটি বা ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তারা যা কিছু বলুন, তা নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র কালাম, নয়ত রছুলের বাণী। তাদের কথায় কোন সন্দেহ পোষণ করা মানে আল্লাহ্র কলাম বা রছুলের বাণীর প্রতি সন্দেহ পোষণ করা। আল্লাহ্র কালাম বা রছুলের বাণীর প্রতি কোন সন্দেহ পোষণ করা মানেই ত ছরাছর কাফের-বেদ্বীন হয়ে আবাদুল আবাদ জাহান্নামের আগুনে জ্বলা। সুতরাং তাদের কোন কথায় কিছু মাত্র ‘উঃ! আঃ!’ করা মানেই-ত আল্লাহ্-দ্রোহী, ধর্ম-দ্রোহী, রছুল-অমান্যকারী হওয়া। আমরা যত বড় পাপী গোনাহ্গার হইনা কেন এবং আমাদের ঈমান-আমলে যত দোষ-ত্রুটিই থাকুক না কেন, কোন অবস্থাতেই আমরা আল্লাহ্র কালাম ও রছুলের বাণীকে অস্বীকার ও অবজ্ঞা করতে পারি না। ঠিক তদ্রƒপ আমাদের এই আলেম-ওলেমা, পীর-বুজুর্গ ইমাম সাহেবদের কথাকেও কোন সময় অস্বীকার বা অবজ্ঞা করতে পারে না। তা হলে তাদের স্থানটা কোথায়? আল্লাহ্ যে বলেছেন, ‘তারা তাদের পীর-পুরোহিতদেরকে রবের আসনে বসিয়ে রেখেছে’ – আল্লাহ্র এই সিদ্ধান্তটিকে আমরা কোন সন্দেহ করতে পারি কি?
সুতরাং আমাদের আলেম-ওলেমা পীর-বুজুর্গ-মুফতী-ইমাম সাহেবদের অবস্থানটা ঠিক সেই রবের আসনে, যে আসনে হজরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর কওমের পাদ্রী-প-িত-ঠাকুর-পুরোহিত-পীর-বুজুর্গ-মুফতী-ইমাম সাহেবদেরকে দেখে চন্দ্র-সূর্য-তারকা সদৃশ রব বা অথরিটি মনে করেিেছলেন। হজরত ইবরাহীম (আঃ) যেমন তাঁর কওমের চন্দ্র-সূর্য-তারকার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আসমান-জমিনের সৃষ্টিকর্তা এক রবের দিকে মুখ করেন এবং মোশরেকদের প্রভাব-বলয় থেকে মুক্তি লাভ করেন, তেমনি আমরাও যদি শেরেকীর প্রভাব কু-ুলী থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই – তা হলে আমাদেরকেও চন্দ্র-সূর্য-তারকা সদৃশ পাদ্রী-প-িত-ঠাকুর-পুরোহিত-পীর-বুজুর্গ-মুফতী-ইমাম সাহেবগণ, যারা আজ এক রবের সিংহাসন দখল করে আছেন – তাদের প্রভাব-কু-ুলী থেকে মুখ ফিরিয়ে আসমান-জমিনের মালিক এক রবের দিকেই মুখ করতে হবে।
কিন্তু, কিরূপে?
‘হাজা রাব্বী’র পর্দা এত কঠিন, এত দৃঢ় ও এত বিস্তৃত যে অতি অল্প সংখ্যক ব্যতীত অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই তা ভেদ করা অত্যন্ত দূরুহ ব্যাপার।
কারণ, চন্দ্র-সূর্য-তারকা সদৃশ ‘রবগণ’ আখেরী নবী হজরত মোহামদ (দঃ)-এর নামে যে ভুত গত ১৪শ বছর যাবৎ একটু একটু করে নানা বর্ণে, গন্ধে ও আকারে মনোমুগ্ধকর করে সাজিয়ে রেখেছেন, – যার গুটি কণা মাত্র উপরে উল্লেখ করা হয়েছে – এ লেখা পাঠ করে অতি সহজেই সে ভুতের মায়া কেউ ত্যাগ করতে ইচ্ছা করবে বা সক্ষম হবে।
আজর ও তার কওম যুগ যুগ ধরে যে ঠাকুর-দেবতাদের ‘নূরাণী চেহারা’ ধ্যান করে করে ঈমান ও আমলের সৌধ গড়ে তুলেছিল, এক ইবরাহীমের কথায় সেই সৌধ ভেঙ্গে দিয়ে সেদিক থেকে মুখ ফিরানো তাদের জন্য যেমন ছিল কিয়ামতের এক ভয়াবহ বিভীষিকা, তেমনিভাবে যুগ যুগ ধরে আলেম-ওলেমা-পীর-বুজুর্গগণের চরণ-সেবা করে এফ্রাদ ও তফ্রীদের মাধ্যমে হজরত মোহা¤মদ (দঃ)-এর পবিত্র নামের দোহাই দিয়ে কালে কালে দিনে দিনে আমরা যে মোহা¤মদী ভুত তৈরী করে অন্তর-মন দিয়ে পূজা করে আসছি, এক্ষণে সেই আলেম-ওলেমা-পীর-বুজুর্গদের বিপক্ষে যেয়ে সেই ভুতের মায়া ত্যাগ করে সেদিক থেকে মুখ ফিরানোও আমাদের জন্য কিয়ামতের এক বিভীষিকা বৈ কিছু নয়।
এই বিভীষিকার এক দিকে হজরত ইবরাহীব (আঃ)-এর ‘কুঠার’ এবং অপরদিকে নমরূদের অগ্নিকু-। কিন্তু কার বাঁজুতে এমন তাক্দ আছে যে ইবরাহীম ছাড়া হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ‘কুঠার’ ব্যবহার করতে পারবে? তাই ইবরাহীমী ভুত ছাড়াবার জন্য ১৪শ বছর পূর্বে যেমন মোহা¤মদ (দঃ)-এর আবির্ভাব, তেমনি মোহা¤মদী ভুত ছাড়াবার জন্যও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আরেক ইবরাহীমের আবির্ভাব।
কিন্তু যতদিন পর্যন্ত আমাদের পাদ্রী-পুরোহিত-ঠাকুর-প-িত-আলেম-ওলেমা-পীর-বুজুর্গগণ চন্দ্র-সূর্য-তারকার ন্যায় এক রবের আসন দখল করে থাকবে, মানুষের ভাগ্যাকাশে ততদিন ইবরাহীমী সূর্যের আবির্ভাব কতকটা ঘন কালো মেঘ ও ঝড়-ঝঞ্ঝায়ই আচ্ছন্ন থাকবে। কিন্তু নমরূদের অগ্নিকু-ও যেমন হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর আবির্ভাব ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি, তখন আলেম-ওলেমা-পীর-বুজুর্গদের সৃষ্ট কালো মেঘ ও ঝড়-ঝঞ্ঝা আর কিভাবে ইবরাহীমী সূর্যের আবির্ভাব ঠেকিয়ে রাখবে? এ সম্বন্ধেই আল্লাহ.-পাক বলছেন, ‘তারা ত চায় নিজেদের মুখের ফুৎকারেই আল্লাহ্র নূরকে নিভিয়ে ফেলবে। কিন্তু আল্লাহ্ তার বিপরীত করলেন, যেন তাঁর নূর পরিপূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করতে পারে, যদিও তা কাফিরদের মনে খারাপই লাগছে।’। (৯ ঃ ৩২)
এখন বলুনত ‘হাজা রাব্বী’ সংক্রান্ত কোরান-পাকের বর্ণনাটি কি উদ্দেশ্যহীন ও অপ্রয়োজনীয় একটি অতীত কেচ্ছা-কাহিনী মাত্র? যার মুখে ধর্মকথা শোনার জন্য সহস্র সহস্র লোক সপ্তাহের এ দিনটির (শুক্রবারের তক্রীর শোনার জন্য) অপেক্ষা করে থাকেন, তিনি কি তাদের জন্য চন্দ্র-সূর্য না হোন, একটি তারকা তুল্যও নন? তিনি যদি তারকা তুল্য ‘রাব্বীও’ না হবেন, তা হলে এত লোকের স¤মুখে দ্বীন সম্বন্ধে কথা বলার সাহস তিনি কোথায় পেলেন? তিনি কি কখনো মনে করতে পারেন যে, শ্রোতারা তার চেয়ে বেশী জ্ঞানী এবং তার চেয়ে বড় অথরিটি? এবং শ্রোতাদের স¤মুখে জ্ঞানের পরীক্ষা দেয়ার জন্যই কি তিনি তক্রীর করে থাকেন? বরং শ্রোতাদেরকে কিছু জ্ঞান দান করাই কি তার উদ্দেশ্য নয়? তা হলে তিনিও যে একজন ‘রাব্বী’ বা ধর্মের একজন অথরিটি এতে কোন সন্দেহ আছে কি?
শ্রোতারা যেখানে ধর্মীয় গ্রন্থ কোরান হাদিস সম্বন্ধে একজন যথার্থ অথরিটি মনে করে তার ধর্মীয় আদেশ-নিষেধ একান্ত মনে শ্রবণ করেন ও যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করেন, সেখানে ঐশী গ্রন্থ সম্বন্ধে তার যে অভিমত আমরা পেয়েছি, তা কি যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য? আল্লাহ্র কালাম সম্বন্ধে যার এরূপ ধারণা, তিনি আবার কিরূপে ধর্মের একজন অথরিটি হতে পারেন বা আমরা কিরূপে তাকে অথরিটি মান্য করতে পারি? বস্তুত তাকেই আমরা মেনে চলেছি।
তিনারা যে অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য ধর্মের কথাও বলেন, যা প্রয়োজনীয় তাকে অপ্রয়োজনীয় রূপে এবং যা অপ্রয়োজনীয় তাকে প্রয়োজনীয় রূপে জনগণের কাছে বর্ণনা করে থাকেন, একথা না তারা নিজেরা বুঝেন, না তার ভক্তরা বুঝেন। ঠিক যেভাবে আজর ও তার কওম চন্দ্র-সূর্য-তারকার ভূত পূজা করে আসছিল, আমরাও ঠিক তেমনিভাবেই চন্দ্র-সূর্য-তারকার ভূতই পূজা করে আসছি। আর ভাবছি আমরা ত এক আল্লাহ্রই পূজা করছি। এমনিভাবেই, যা আল্লাহ্র কথা নয়, এসব মৌলবী-মৌলানা, আলেম-ওলেমা-পীর-বুজুর্গদের নির্দেশ মত, তাকেই আল্লাহ্র কথা রূপে মান্য করে আল্লাহ্র সঙ্গে শেরেকী করছি।
মনে করুন, তিনি কোন কথা বললেন এবং আমরা তা সত্য বলে পালন করলাম, কারণ ধর্মীয় ব্যাপারে তার কোন আদেশ-উপদেশ অসত্য হতে পারে, তা ত আমরা ভাবতেও পারি না। তারপর ধরুন, কিয়ামত হয়ে গেল। হজরত মৌলানা সাহেবের যে কথাটি সত্য বলে পালন করেছিলাম, আল্লাহ্র বিচারে তা অসত্য প্রমাণিত হল। তখন আমাদের অবস্থাটা কেমন হবে? তখন কি হজরত মৌলানা সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে আল্লাহ্ তা মাফ করে দেবেন? হজরত মৌলানা সাহেব কি আমাদেরকে এমন ভরসা দিতে পারেন? আমরা জানি, এমন কথা বলার অথরিটি আল্লাহ্-পাক তাকে দেননি। তখনকার অবস্থা সম্বন্ধে আল্লাহ্ বলছেন, ‘আর তোমাদের জন্য কোনও সুপারিশকারীকে তো আমি তোমাদের সাথে দেখছি না – যাদেরকে তোমরা নিজেদের সুপারিশকারী ও আমার শরীক বলে ভাবতে। আজকে তোমাদের মধ্যেকার সব রকমের যোগ-সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। আর তোমরা যে সব দাবী করতে, তাও যে মিথ্যা প্রমাণিত হল।’(৬ঃ৯৫)
আল্লাহ্ আরো বলছেন, ‘‘মানুষের মধ্যে যারা আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে শরীক করছে, আর তাদেরকে ঠিক আল্লাহ্র মতই ভালবাসছে – যারা ঈমানদার তারা ত আল্লাহ্কেই সবার চাইতে বেশী ভালবাসে। হায়! জালিমরা যদি ভেবে দেখত! যখন তারা আজাব সামনেই দেখতে পাবে – শক্তি সেত আল্লাহ্রই সবটুকু। আর আল্লাহ্র আজাব বড়ই কঠিন।’’(২ঃ১৬৫)
তারা যখন আজাব দেখে বিমুখ হবে – যাদেরকে অনুসরণ করত তাদেরই উপরে, যারা অনুসরণ করেছে তাদের উপরেও – সবার সাথে সকল রকম যোগ সম্পর্ক তখন ছিন্ন হবে।(২ঃ১৬৬) অনুসরণকারীরা বলবে, “হায়! আমরা যদি ফিরে যেতে পারতাম, তা হলো আমরাও ঠিক তেমনি তাদের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করতাম, ঠিক যেমন এখন তারা আমাদের সাথে কোনও সম্পর্ক রাখল না। এমন করেই আল্লাহ্ তাদের কাজকর্ম বিফল করে তাদেরই সামনে তুলে ধরবেন – যেন তারা মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে – দোযখ থেকে তারা কোনও দিন বের হবার মত নয়।”(২ঃ১৬৭)
সেদিনের অবস্থা এই হবে যে, ধর্ম সম্বন্ধে ভুল বা মিথ্যা শিক্ষা দেওয়াতে না-ত মৌলানা সাহেব বাঁচতে পারবেন, না-ত যারা তাকে মান্য করছে তারা বাঁচতে পারবে। এ-ই যখন অবস্থা তখন তিনারা যা বলেন তাকেই একেবারে অভ্রান্ত সত্য বলে মেনে নেওয়াই হচ্ছে শিরক। কারণ, অভ্রান্ত সত্য কথা একমাত্র আল্লাহ্ই বলতে পারেন। স্বয়ং তিনি যদি কাউকে কোন সংবাদ দেন তা অবশ্যই অভ্রান্ত সত্য রূপে মান্য করতে হবে। যদি কেউ তা মান্য না করে, তা হলে অবশ্যই সে হবে অবিশ¡াসী।
আর মনোনীত প্রেরিত পুরুষ ছাড়া কারো কাছে তিনি কোন সংবাদ দেন না। সুতরাং জনগণকে আল্লাহ্র সত্য কথা শোনানোর একমাত্র অথরিটি হলেন নবী-রছুলগণ। এই জন্যই দেখা যাচ্ছে, হজরত ঈসা (আঃ) পর্যন্ত আল্লাহ্র সত্য প্রচারের জন্য এক নবী শেষ হতে না হতেই আরেকজনকে আল্লাহ্ তাঁর নবী-রছুল করে পাঠিয়েছেন। কিন্তু হজরত রাছুলে করিম (দঃ)-এর পর এরূপ সরাসরি নবী রছুল মনোনয়ন বন্ধ। তবে হজরত রছুলে করিম (দঃ)-এর পর দুনিয়ার বুকে আল্লাহ্র প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নবী করিম (দঃ)-এর উ¤মতের মধ্য থেকে যাকে তিনি পছন্দ করেন তাকেই মনোনীত করেন। আল্লাহ্র এই মনোনীত ব্যক্তি হজরত রছুলে করিম (দঃ)-এর অনুসারী এবং তাঁরই মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত, যেরূপভাবে স্বয়ং হজরত রাছুলে করিম (দঃ) হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এরই অনুসারী এবং তাঁর মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর তাদের মর্যাদা বনী ইসরাইল নবীদেরই মর্যাদাভুক্ত।
এখন আমরা উ¤মতে মোহা¤মদী হিসাবে যে কাউকে আমাদের পছন্দ মত আল্লাহ্র মনোনীত খাস বান্দা রূপে মান্য করলেই বা হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক যে কাউকে আল্লাহ্র মনোনীত নবী করিম (দঃ)-এর নায়েব রূপে গণ্য করলেই যে তিনি সত্য সত্যই আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত হয়ে যাবেন, তার কোন নিশ্চয়তা নেই বা কোন দলিল প্রমাণও নেই; যতক্ষণ না আল্লাহ্ কর্তৃক মনোনীত হওয়ার কথা তারা নিজেরা প্রকাশ করবেন। আর আল্লাহ্ যদি কাউকে এরূপভাবে মনোনীত করেই থাকেন, তিনি কখনো তার এই মনোনয়নের কথা গোপন করে আল্লাহ্র অবাধ্যতা করতে পারেন না; আর যাকে আল্লাহ্ এরূপভাবে মনোনীত করেননি, সেও কখনো মনোনীত বলে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবেন না, যদিও ভক্তরা তাকে তদ্রƒপই মনে করুক না কেন।
এরূপভাবেই মনোনীত না হয়ে কেবল মাত্র স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষা লাভ করে কিছু ডিগ্রি লাভ করেই আল্লাহ্র ধর্ম ইসলাম এবং তাঁর কালাম সম্বন্ধে যা বলবেন তা সবই অভ্রান্ত সত্য হয়ে যাবে, তা হলে আল্লাহ্র মনোনীত খাস বান্দা ও আমাদের পছন্দ করা বান্দার মধ্যে পার্থক্য রইল কোথায়? যদি তাদের মধ্যে কোন পার্থক্যই না থাকবে, তা হলে তারা সবাই ত নবীরই সমতুল্য বলে গণ্য হয়ে যাবেন।
এখন বলুন, আমরা যদি উল্লেখিত হজরত মাওলানা সাহেবের বর্ণিত আদেশ-নিষেধকে নবীর বর্ণিত আদেশ-নিষেধের সমতুল্য মনে করি, তা হলে সেটা কি আমাদের শেরেকী হবে না? যদিও আমরা তাকে নবী মান্য করি না, কিন্তু কার্যত নবীর কথাকে আমরা যেরূপ সত্য বলে মান্য-গণ্য করি, তেমনিভাবে হজরত মাওলানা সাহেবদের কথাকেও নবীর কথার সমতুল্য বলেই বিশ¡াস করি এবং মান্য করি। আমাদের এরূপ কার্যের দ্বারা আমরা যা অভ্রান্ত নয় তাকেই আল্লাহ্র কালামের ন্যায় অভ্রান্ত মনে করে, যে মনোনীত খাস বান্দা নয় তাকে মনোনীত খাস বান্দা রূপে মান্য করে এবং যে নবী নয় তাকে নবীর ন্যায় মান্য করে প্রকৃতপক্ষে এসবকে আমরা আল্লাহ্র সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দাঁড় করাচ্ছি এবং তাদেরই পূজা-অর্চনা করছি। অথচ ভাবছি, আমরা ত একই আল্লাহ্র পূজা-অর্চনা করছি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘শতাব্দীর সূর্য’ পত্রিকার এপ্রিল-মে,‘৮১ সংখ্যায় বর্ণিত একটি হাদিসের পুনরুল্লেখ করছি, হাতিম তাইয়ের পুত্র বর্ণনা করেছেন যে, আমি একদা রাছুলুল্লাহ. (দঃ)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। আমার গলায় একটি সুবর্ণ ক্রুশ ঝুলছিল। রাছুলুল্লাহ্ (দঃ) বললেন, ‘হে আদী! তুমি এই ঠাকুরকে তোমার দেহ থেকে বিদূরীত কর।’ অতঃপর তিনি পাঠ করলেন, তারা তাদের উলেমা ও দরবেশদেরকে ‘বর’ হিসাবে ধরে নিয়েছে। হাতেম তাইয়ের পুত্র বলেন, আমি আরজ করলাম, ‘হে আল্লাহ্র রাছুল! আমরা তো তাদের এবাদত করি না।’ রাছুলুল্লাহ.্ (দঃ) বললেন, ‘তারা যখন তোমাদের জন্য হালাল ও হারামের নির্দেশ প্রদান করে তখন কি তোমরা তাদের সেই মৌখিক উক্তি বিনা বিচারে ও বিনা প্রমাণে শিরোধার্য করে লও না?’ আদী বললেন, ‘জ্বী হা।’ রাছুলুল্লাহ্ (দঃ) বললেন, ‘উহাই তাহা’ – অর্থাৎ তারা যাকে হারাম করল তাকেই হারাম রূপে ধরে লওয়ার অর্থই হল উলেমা ও দরবেশদেরে রব ধরা।
আল্লাহ্ ব্যতীত অপর কাউকে ‘রব’ ধরা হচ্ছে শেরেকীর অন্তর্ভুক্ত।
আমাদের বিশ¡াস, দুনিয়ার বুকে আল্লাহ্-পাকের পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত হল, তাঁর মনোনীত খাস বান্দার আগমন। আর হজরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দুনিয়াতে যত আলেম-ওলেমা এসেছেন, তারা মানুষদেরকে হারাম ও হালালের যত আদেশ নিষেধ দিয়েছেন, এর কোন কোনটির বিষয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে মতপার্থক্য থাকলেও একটা বিষয়কে হারাম করার ব্যাপারে অতি বিরল ব্যতিক্রম ব্যতীত তাদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য হয়েছে বলে কোন প্রমাণ আমার জানা নেই। তা হল দুনিয়ার বুকে আল্লাহ্র এই সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত – নবুওত ও রেছালতকে জগদ্বাসীর জন্য হারাম করা। দুনিয়ার বুকে আল্লাহ্র বিশেষ রহমত ব্যতীত কোন নবী-রাছুলকে আল্লাহ্ পাঠাননি। আর দুনিয়ার বুকে এমন কোন নবী রাছুল আসেননি যার উপর ঈমান আনাকে আলেম-ওলেমাবৃন্দ নিজেদের জন্য এবং কওমের জন্য হারাম না করেছে। যেমন আল্লাহ্ বলেছেন, “ইয়া হাসরাতান আলাল এবাদ মাইয়্যাতিহিম মির রাছুলেন ইল্লা কানু বিহি ইয়াসতা জেউন।”
-‘‘আমার বান্দাদের জন্য আফসোস্! এমন কোন রাছুল আসেননি যাকে তার কওমের লোকেরা ঠাট্টা-বিদ্রƒপ না করেছে।’’
নবী-রাছুলগণকে হারাম করার প্রধানতম কারণ হল – নবীর তিরোধানের পর নায়েবে-নবীরা ওয়ারেছুতুল আম্বিয়া হিসাবে তারা ত আল্লাহ্র স্থলাভিষিক্ত হয়ে কওমের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও স¤মান প্রতিপত্তি ভোগ করছেন। তাদের ভাবনা হল ঃ এখন যদি আবার কোন নবী-রাছুলের আগমন হয় ও তাঁর উপর ঈমান আনতে হয়, তা হলে আমাদের অবস্থাটা কেমন হবে? এত দিনকার শিক্ষা-দীক্ষা, ভক্তি-শ্রদ্ধা, স¤মান-প্রতিপত্তি আর কিভাবে অটুট রাখা সম্ভব? অর্থাৎ নবী-রাছুলের আগমন হওয়া ও তাদেরকে তদ্রƒপ বিশ¡াস করা মানেই হল নায়েব ও অয়ারেছ হওয়ার দাবীদারদের জন্য ইবলীশের মত ‘স্বর্গ’ হতে পতন। এত বড় পতন আর কিভাবে মেনে নেওয়া যায়! সুতরাং জীবন থাক আর যাক, কুছ্পরোয়া নেই। নবী রাছুলের আগমন যে ভাবেই হোক রোধ করা চাই। অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহ্র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। আর এরই ফলে উদ্ভব হয় দুটি দলের – হেজবুল্লাহ্ আর হেজবুশ শয়তান। এই যুদ্ধে তাদের প্রধান অ¯ত্র হল তাদের চিরকালের শিক্ষা ও সাধনালব্ধ মন্ত্রঃ ‘আর কোন নবী নেই’ জনগণকে সর্ব প্রথম এই মন্ত্রে দীক্ষিত করা।
পৃথিবীতে যত প্রেরিত পুরুষ এসেছেন, তাঁদের কওম তাঁদের বিরোধিতা করেছে। এই বিরোধিতার একমাত্র কারণ হল তাদের আলেম-ওলেমাদের দেওয়া শিক্ষা ‘আর কোন নবী নেই’ ম›ত্রকে সত্য আল্লাহ্র কালামের মতই ঈমান আকায়েদের প্রধান অঙ্গ হিসাবে দৃঢ় বিশ¡াস করা। এরই ফলে তারা ভাবে, এতদিন যে মন্ত্রকে ভিত্তি করে আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, ঈমান আমলের সৌধ গড়া হয়েছে, মিথ্যাবাদী, পাগল (আলেম-ওলেমাদের ভাষায়) ছাড়া কোন সভ্য-শান্ত রুচিবান মানুষ কি জগদ্বাসী সকল মানুষের শিক্ষা, ধর্ম, মত ও পথের বিরুদ্ধে এই ঐতিহ্যবাহী ইমারতকে ধ¡ংস করার চেষ্টা করতে পারে? সুতরাং এই ‘মিথ্যাবাদী পাগলকে’ যে ভাবেই হোক রুখ্তে হবে। তার হাত থেকে আমাদের এত সাধের তাহ্জিব তমদ্দুন সত্য সনাতন ধর্মকে যে ভাবেই হোক রক্ষা করতে হবে।
এরূপ ভেবেই তারা আলেম-ওলেমাদের নির্দেশানুযায়ী ‘মিথাবাদী পাগলের’ উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরই ফলে তাদের উপর নেমে আসে আসমানী গজব। আমরা আজ এই গজবেরই দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। তাই ত এত ওয়াজ-নছিহত, এত ধর্মীয় কেতাব-পুস্তক, এত প্ল্যান-প্রোগ্রাম, দান-খয়রাত আমাদের অবস্থার বিন্দুমাত্র পরিবর্তনও করতে পারছে না। বরং দিনে দিনে আমাদের অবস্থার অবনতিই হচ্ছে।
অধিকন্তু, একটা মূষিক একটা সিংহকে কানে ধরে উঠাচ্ছে বসাচ্ছে, গালে চপেটাঘাত করছে আর বুকে-পিঠে করছে পদাঘাত। আর এই সিংহ মাথা ‘উঁচু’ করে সমস্ত লজ্জা অপমান নীরবে সহ্য করছে, আর সাহায্যের আশায় এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না দেখে ব্যথা-বেদনায় দিশেহারা হয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে কামড়া-কামড়ি করে ইসলামী তাহ্জিব-তমদ্দুন, শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন করছে। এটাই নাকি শান্তির ধর্ম ইসলাম! দিন বা দিন তারা নাকি এর উন্নতিই দেখতে পাচ্ছে!
মূষিকের মোকাবেলায় সিংহের কেন এ অসহায় অবস্থা? কারণ, সে আল্লাহ্র সর্বশ্রে®ঠ রহমত নবুওত ও রেছালতের প্রবহমানতাকে অস্বীকার ও ঘৃণাভবে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহ্কে অকর্মণ্য, অথর্ব ও পঙ্গু এবং তাঁকে নিজেদের কল্পনার দাস প্রমাণ করছে।
আল্লাহ্র এই মহা দানকে যারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে পারে এবং তাঁর জাত ও ছেফাতকে খর্ব ও সীমাবদ্ধ করতে পারে, দুনিয়াতে এমন কে আছে যে আল্লাহ্র ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে? বরং তাদের উপর অভিশাপ আল্লাহ্র, তাঁর ফেরেশতার এবং কুল মাখলুকাতের। যতদিন তারা আল্লাহ্র এই দানকে গ্রহণ করতে এগিয়ে না আসবে, ততদিন তাদের উপর এই অভিশাপ উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেতে থাকবে, যদি না আল্লাহ্-পাক অন্য রকম কিছু করতে ইচ্ছা করেন।
আর আমাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী ‘হাজা রাব্বী’র ভূত পূজা।
আমরা যদি সত্যিকার ভাবেই আমাদের অবস্থার পরিবর্তন চাই এবং আমাদের উপর আপতিত গজব থেকে উদ্ধার পেতে চাই, তা হলে আমাদেরকে ‘হাজা রাব্বী’র ভূত পূজা থেকে মুখ ফিরিয়ে একনি®ঠভাবে ইবরাহীমের রবের দিকেই মুখ করতে হবে।
কিন্তু কেউ কাউকে না চিনে বা না জেনেই কি কারো দিকে মুখ করতে পারি? সুতরাং ইবরাহীমের এক সত্য রবের দিকে মুখ করতে হলে, সর্বাগ্রে প্রয়োজন তাঁর রবকে চেনা এবং জানা। কিন্তু ইবরাহীমকে অস্বীকার করে কেউ কি তাঁর রবকে চিনতে-জানতে পেরেছিল? ইবরাহীমকে অস্বীকার করে ইবরাহীমের রবকে চেনা-জানা এবং সেদিকে মুখ করা কারো পক্ষে ক¯িমনকালেও সম্ভব নয়। সুতরাং ইবরাহীমের রবকে চিনতে-জানতে হলে ও সেদিকে মুখ করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ইবরাহীমকে চেনা এবং জানা। কিন্তু ইবরাহীমকে কে চিনতে ও জানতে পেরেছিল? নমরূদ ও তার সভাসদবৃন্দ, আমির-ওমরাহ, পাদ্রী-প-িত, পীর-পুরোহিত, আলেম-ওলেমা, অলী-দরবেশ, ইমাম-বুজুর্গ যারা আকাশের চন্দ্র-সূর্য-তারকার ন্যায় ঝলমল করে জ্বলছিল এবং প্রবল বিক্রমে পৃথিবী শাসন করছিল তাদের কেউ কি ইবরাহীমকে চিনতে-জানতে পেরেছিল? ইবরাহীমকে যদি কেউ চিনতে ও জানতেই পারত, তাহলে নমরূদের অগ্নিকু-ে একা ইবরাহীমকেই কি যেতে হত? কই! ১৪শ’ বছর পরে আজ যারা মোহা¤মদের প্রেমে জান্নেছার, তারাই না নমরূদের সঙ্গে এক জোট হয়ে ইবরাহীমকে অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করেছিলেন? আপনাদের কেউ কি বাঁধা দিয়েছিলেন? আপনারাই না ১৪শ’ বছর পূর্বে মোহা¤মদকে গোরে-আবু তালেবে তিন বছর আহার-পানি বন্ধ করে দিয়ে বন্দী করে ছিলেন? তায়েফে ইট পাটকেল মেরেছিলেন, ওহুদে দান্দান মোবারক শহীদ করেছিলেন। ১৪শ’ বছর পরে এখন আবার সেই ইবরাহীম সেই মোহা¤মদের জন্য দেওয়ানা! আপনারা কি সত্যিই তাঁর জন্য দেওয়ানা? একদম পাগল পারা? আপনারা কতটুকু দেওয়ানা, কতটুকু পাগল পারা তা পরীক্ষা করার জন্যই আল্লাহ্-পাক বলেছেন, ‘‘মানব সমাজ এই ভেবেছে না কি যে তাদেরকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে, ‘কারণ তারা বলছে, আমরা ঈমান এনেছি,’ অথচ তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?’’ (২৯ঃ২) আল্লাহ্র এই পরীক্ষা ছাড়াই কি নবী প্রেমের পরীক্ষায় আপনারা উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন?
আপনারা যেমন ‘উঁচু’, আপনাদের লক্ষ্যটাও তেমনি অতি উঁচু অর্থাৎ একদম ‘মাকামে মাহ্মুদ’। এখন বলুন ত ‘মাকামে মাহ্মুদের’ সার্টিফিকেট অর্জনই যাদের লক্ষ্য, তখন আপনাদের পরীক্ষার জন্য আপনাদের কাছে একজন ‘মোহা¤মদকে’ পরীক্ষক নিযুক্ত না করে কোন পীর-দরবেশ, মুফ্তী ঈমাম সাহেবকে পরীক্ষক বানিয়ে পাঠাবেন কি আপনাদের মর্যাদার হানী করতে? আল্লাহ্ কি এমন বে-আক্কেল না কি? আর পীর-দরবেশ-মুফ্তী-ঈমাম সাহেব ত কতই এসেছেন। কাকে আপনারা কেয়ার (ঈধৎব) করেছেন? সবাই ত আপনাদের আঙ্গুলের ফাঁক দিয়েই ঝড়ে পড়ে গেছেন। একজন মানছে ত দশ জন এসেছে কাফের-বেঈমান বেদাতী-গোমরাহীর তীর বল্লম নিয়ে। সুতরাং আপনাদের স্বভাব এবং মর্যাদার দিকে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রেখেই মহান আল্লাহ্ আপনাদের জন্য পরীক্ষক নিযুক্ত করেছেন।
বিশ¡াস হয়?
কি সব আজে বাজে বেহুদা পাঁচালী গাইছেন?
অর্থাৎ আমাদের প্রতি অবিশ¡াস এ-ই তো?
এ কথা ত আমরা পূর্বেই বলেছি যে, আপনারা যদি বিশ¡াসই করতে পারতেন, তা হলে ইবরাহীম (আঃ)কে কি অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করতে পারতেন, মোহা¤মদ (দঃ)কে কি দেশান্তরী করতে পারতেন, তাঁর দান্দান মোবারক শহীদ করতে পারতেন? ইবরাহীম(আঃ)কে অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করে, মোহা¤মদ (দঃ)-কে দেশান্তরী করে, তাঁর দাঁত-মুখ থেতলে দিয়ে, আজ আবার সেই ইবরাহীম (আঃ) সেই মোহা¤মদ(দঃ)-এর জন্য দেওয়ানা! একদম পাগল পারা! কি সুন্দর, কি অনুপম আপনাদের এই নবী – মোহা¤মদ প্রেম! যদি দেখবার মত আপনাদের চোখ থাকত, শোনবার মত কান থাকত আর বুঝবার মত মন থাকত, তা হলে দুনিয়াতে এত নবী এত রাছুল, এত কিতাব এত পুস্তক পাঠানোর প্রয়োজন কি আর থাকত?
দুনিয়ার বুকে ইলাহী হুকুমত কায়েমের জন্য যুগে যুগে, দেশে দেশে নূহ, ইবরাহীম, মুছা, ঈসা, মোহা¤মদ এসেছেন, এঁদের বিরোধিতা করার জন্য যুগে যুগে, দেশে দেশে তেমনি নমরূদ, ফেরাউন, আবু জাহেল, আবু লাহাবদেরও আগমন হয়েছে।
কিন্তু আজ ১৪শ’ বছর পরে মোহা¤মদ যেমন মোহা¤মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা, ছরওয়ারে কায়েনাত, ছরদারে দু’জাহান, হজরত রাছুলে করিম খাতামান্নাবীয়্যিন রূপে বিশে¡র বুকে দেদীপ্যমান হয়ে বিরাজ করছেন, ১৪শ’ বছর পূর্বে কি তিনি এরূপই ছিলেন? ১৪শ’ বছর পূর্বে তিনি ছিলেন নিঃস্ব-নিঃসম্বল-নিঃসহায়-ধন-জন-মানহীন, অক্ষর-জ্ঞানহীন একজন এতীম মাত্র। সেখানে আবু জাহেলই ছিল আবুল হেকাম ‘জ্ঞানের পিতা’ খেতাবে ভূষিত, ধনে-জনে-মানে, ধর্মে-শিক্ষায়, ভক্তি-শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ এক মধ্যাহ্ন সূর্য। ১৪শ’ বছর পরে আবু জাহেলকে শয়তানের গুরু ঠাকুর মনে করা, আর মোহা¤মদকে নূরুন্নবী রূপে পৃথক করা আমাদের পক্ষে যত সহজই হোক না কেন, ১৪শ’ বছর পূর্বে এত সহজ ছিল না। তখন মোহা¤মদ ও আবু জাহেলের মধ্যে কার কথা সঠিক ও মান্যকর, আর কার কথা অমান্যকর তা পৃথক করা মানুষের জন্য ছিল এক কঠিন সমস্যা। মোহা¤মদের কথা অধিকতর যুক্তিপূর্ণ ও বিশ¡াসযোগ্য ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যে অত্যন্ত দুর্বল, তাঁর না আছে কোন বিদ্যা, না আছে কোন প্রভাব-প্রতিপত্তি। অপরদিকে, আবু জাহেলের কথা যুক্তিপূর্ণ না হলেও তিনি যে ‘আবুল হেকাম – জ্ঞানের পিতা’ খেতাব প্রাপ্ত। তাছাড়া, সে ছিল অনেক ভক্ত-অনুরক্ত, শিষ্য-সাগরেদ, ধন-জন ও মানের অধিকারী। তার যুক্তিহীন কথাও যে ভক্ত জনগণের কাছে যুক্তিপূর্ণ বলেই মনে হত। যেমন আজও আমাদের কাছে মুফ্তী-ঈমাম-ওয়ায়েজীনদের ওয়াজ-নছিহত, উপদেশ-পরামর্শ অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ বলেই প্রতীয়মান হয়ে থাকে।
সে যা হোক, অনুরূপভাবে হজরত মুছা (আঃ) ও ফেরাউনের মধ্যে কে অধিককতর মাননীয় ও অনুসরণীয়, আর কে পরিত্যাজ্য ও অগ্রহণীয় – প্রজাসাধারণের জন্য এটা প্রভেদ করাও ছিল অত্যন্ত সমস্যাপূর্ণ। তেমনিভাবে, হজরত ইবরাহীম (আঃ) এবং নমরূদের মধ্যে কে সত্যবাদী আর কে মিথাবাদী – হাজার বছর পরে তা পৃথক করা আমাদের কাছে যত সহজই মনে হোক না কেন, তাদের জীবদ্দশায় তা নির্ণয় করা ছিল অত্যন্ত দুষ্কর। এইরূপ সমস্যাসঙ্কুল অবস্থায় সত্য ও মিথ্যা পৃথক করে সত্য পথের অনুসরণ করা মহিয়ান-গরিয়ান আল্লাহ্র অপার করুণা ছাড়া কোন প্রকারেই সম্ভব নয়। এমনি অবস্থায়, একান্ত মনে কায়মনবাক্যে খালেছভাবে একমাত্র আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য খাঁটি হেদায়েত প্রার্থনা করা ছাড়া সত্য ও সঠিক পথ পাওয়ার দ্বিতীয় কোন উপায়ই নেই। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে তাঁর মনোনীত পথে পরিচালিত করুন! আমীন!
সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি লোকের ধর্মাধিপতি বা রাজ্যাধিপতির প্রভাব-প্রতিপত্তি ও শান শওকতের বিরুদ্ধে দুর্বল, নিঃস্ব, নিঃসম্বল, নিরক্ষর, নিঃসহায় এক ব্যক্তির কথাই একমাত্র সত্য বলে মান্য করার মত কোন নিদর্শনই কি তাদের হাতে থাকে না? এরূপ কোন নিদর্শনই যদি তাঁরা না দেখাতে পারবেন তাহলে কে আর তাঁদের কথা মান্য করবে? হ্যাঁ, থাকে, কিন্তু এটা মুছার আশাও নয়, ইবরাহীমের কুঠারও নয়। এটা হল আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তাঁদের প্রতি অবতীর্ণ অকাট্য যুক্তিপূর্ণ আল্লাহ্র কালাম। শক্তির বলে ধর্মাধিপতি বা রাজ্যাধিপতিগণ তাঁদের কাউকে অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করতে পারে, কাউকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারে, কাউকে সাগরের অতল জলে নিক্ষেপ করতে পারে, কাউকে করাত দিয়ে চিরে ফেলতে পারে, কাউকে শূলে দিয়ে হত্যাও করতে পারে, কিন্তু তাঁদের যুক্তি বা হেকমতকে কেউ খ-াবে এমন শক্তি কারো থাকে না। এই যুক্তি বা হেকমতই হলো আল্লাহ্র মনোনীত প্রেরিত পুরুষদের একমাত্র শক্তি।
হজরত মুছা (আঃ)-এর হাতে এই শক্তির প্রতীক হলো তাঁর হাতের আশা এবং হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর হাতে এই শক্তির প্রতীক হলো তাঁর হাতের কুঠার। আল্লাহ্ বলেছেন, ‘যুক্তি প্রমাণে যে হেরে যায়, যথার্থই সে পরাজিত।’ হজরত মুছা (আঃ) যা দিয়ে ফেরাউনকে পরাজিত করেছিলেন, তা তাঁর আশা নয় বরং তা ছিল তাঁর যুক্তি বা হেকমত। হজরত ইবরাহীম (আঃ) যা দিয়ে নমরূদের মস্তক অবনত করেছিলেন, তা তাঁর লোহার কুঠার নয় বরং তা ছিল যুক্তি বা হেকমত। সারা দেশময় যেখানে মূর্তি বা ভূত পূজার ছড়াছড়ি, সেখানে লোহার কুঠারের আঘাতে কয়টা মূর্তিই বা ভাঙ্গা সম্ভব? আর মাটির মূতি ভেঙ্গে ভূত পূজার মূলোৎপাটন করা কি কখনো সম্ভব? আর কুঠারাঘাতে মাটির মূর্তি ভাঙ্গা সহজ হলেও জীবন্ত ভূতের মস্তক ছেদন করা সহজ নয়। কিন্তু হজরত ইবরাহীম (আঃ) এমন কুঠারই ব্যাবহার করেছিলেন, যার আঘাতে একটা কালের, একটা দেশের, একটা জাতির, ‘জীবন্ত ভূতের’ সমস্ত মস্তকই অবনমিত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি লোকের ধর্মাধিপতি বা রাজ্যাধিপতির পরাক্রম-বিক্রমের বিরুদ্ধে নিঃস্ব, দুর্বল, নিরক্ষর, নিঃসম্বল, নিঃসহায়, এক ইবরাহীমকে চেনা-জানার উপায় হলো তাঁর হাতের এই কুঠার, যার দ্বারা তিনি গিরি-শৃঙ্গের ন্যায় উঁচু নমরূদের শিরকে অবনমিত করে দিয়েছিেিলন।
সুতরাং যারা ইবরাহীমের হাতের এই কুঠারের ধার উপলব্ধি করতে সক্ষম, কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব ইবরাহীমকে চেনা এবং জানা। যারা ইবরাহীমকে চিনতে-জানতে সক্ষম, তাদের পক্ষেই সম্ভব ইবরাহীমের রবকে চেনা এবং জানা। ইবরাহীমের রবকে চেনা-জানার পরেই না সম্ভব ইবরাহীমের রবের দিকে মুখ করা। এই ভাবেই ইবরাহীমের রবকে চেনা-জানা ছাড়া তাঁর রবের দিকে মুখ করা, তাঁর পূজা-অর্চনা করা ‘মা-কালির’ পূজা-অর্চনা করা এক সমতুল্য।
এখন বলুন, যারা ‘ইন্নি অজ্জাহ্তু অজ্হিয়া লিল্লাজী’ পাঠ করে ‘আল্লাহ্র দিকে মুখ করলাম’ বলে থাকেন, তারা কি সবাই হজরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ‘কুঠার’ দেখতে ও চিনতে পেরেছেন? তাঁর কুঠারই যদি দেখতে-চিনতে না পারবেন, তাহলে ইবরাহীমকে কিভাবে দেখলেন? অর্থাৎ ‘মাকামে ইবরাহীমে’ পৌঁছে হজরত ইবরাহীম (আঃ)কে না দেখে ও না চিনে, তাঁর রবের দিকে মুখ করার কথা বলা কি কল্পনার ভূত বা মা-কালীর পূজা নয়?
সুতরাং যতক্ষণ আমরা এই ‘মা-কালীর’ পূজা-অর্চনাই করব, ততক্ষণ মূষিক আমাদেরকে কানে ধরে ঘুরাবে, এতে আশ্চর্য হবার কি আছে? কারণ, মূষিক তো আর ‘মা-কালীর’ চাইতে দুর্বল নয়।
প্রিয় পাঠক! আমরা কে কোন্ রবের পূজা-অর্চনা করছি, তা বুঝতে এখনো কি আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে?
প্রিয় পাঠক! এতক্ষণ আপনারা যা পাঠ করলেন, এর কোথাও কি কোন নবী-রাছুল, কোরান-হাদিস, আল্লাহ্, ধর্ম, ইসলাম, যুক্তি প্রমাণ প্রভৃতি কোন একটিরও বিরোধী বা কোন একটির প্রতিও বিন্দুমাত্র অবমাননাকর কোন কথা দেখতে পেয়েছেন? তবুও অনুরোধ করছি, কোন মানুষই যেমন ভুলের উর্ধ্বে নয়, আমরাও ভুলের উর্ধ্বে নই। আমাদের ভুল-ত্রুটি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই যদি কোথাও কারো নজরে আমার কোন ভুল-ত্রুটি ধরা পড়ে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাকে তা জানালে আমি অত্যন্ত বাধিত হব। আমার ভুলের কথা জানতে পারলে অবশ্যই আমি তা থেকে তওবা করব ইন্শা-আল্লাহ্।
আল্লাহ্-পাক আমাদের সবাইকে তাঁর সত্যের সন্ধান দিন এবং সত্য পথে চলার তৌফিক দান করুন এবং মিথ্যাকে চেনার ও তা থেকে সর্বতোভাবে দূরে থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন!
অ আখেরে দাওয়ানা আনেল হামদু লিল্লাহে রাব্বিল আলামিন!