তিন ঠগ্ ও এক বামন ঠাকুর
পূজা পার্বণাদি সম্পন্ন করে এক বামন ঠাকুর দক্ষিণা পেয়েছেন একটা পাঁঠার বাচ্চা। পাঁঠার বাচ্চাটা কাঁধে করে তিনি বাড়ি ফিরছেন। তিন ঠগের মতলব, যে ভাবেই হোক ঠাকুর মশায়ের কাছ থেকে পাঁঠার বাচ্চাটা ছাড়িয়ে নিয়ে ভোগ করতে হবে। তিন ঠগ্ ফন্দি করে ঠাকুর মশাইয়ের বাড়ি যাওয়ার পথের তিন বাঁকে অবস্থান নিল।
প্রথম বাঁকে পৌঁছতেই প্রথম ঠগ তার অবস্থান থেকে বের হয়ে এসে ঠাকুর মশাইকে লম্বা এক প্রণাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে তারপর বলল, আপনার কাঁধের এই কুকুরের বাচ্চাটা কোত্থেকে আনলেন? ঠাকুর মশাই রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, হতচ্ছাড়া কোথাকার! চোখের মাথা খেয়েছিস? দেখতে পাচ্ছিস না? আমি আনলাম পাঁঠার বাচ্চা, আর তুই দেখছস্ কুকুরের বাচ্চা। বেটা অন্ধ কোথাকার! দূরহ বেটা নচ্ছার।
ঠগ্ – ঠাকুর মশাই। আপনি একি বলছেন। জলজ্যান্ত এই কুকুরের বাচ্চাটাকে আপনি পাঁঠার বাচ্চা বলছেন? নিশ্চয়ই আপনার চোখ খারাপ হয়েছে। আর চোখের কি দোষ, বয়স ত আপনার কম হয়নি। এই বয়সে এমন একটু আধটু ভুল ত হয়েই থাকে। ঠাকুর মশাই! আমি সত্যি বলছি, এটা কুকুরের বাচ্চা, পাঁঠার বাচ্চা নয়।
ঠাকুর- তোর কাছে কি আমার চোখের পরীক্ষা দিতে হবে নাকি, বেটা গর্দভ কোথাকার! মন্ত্র পড়তে এখনও আমার চশমা লাগে না। আর কুকুরের বাচ্চা চিনতে চশমা লাগবে, না? বেটা! দূর হত আমার সামনে থেকে।
ঠগ্ – ঠাকুর মশাই! আমার অপরাধ নেবেন না। কুকুরো বাচ্চা হোক, পাঁঠার বাচ্চা হোক- আপনি যা এনেছেন, তাই থাকবে। আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম, এটা আপনি কোত্থেকে এনেছেন। তা না বলে আমাকে যাচ্ছে তা বকে যাচ্ছেন। এতেও আমি অসন্তুষ্ট না। গুরুবাক্য শিরধার্য। তবে ঠাকুর মা যদি কুকুরের বাচ্চা নিতে বলে দিয়ে থাকেন, তা হলে এটা পেয়ে তিনি খুশিই হবেন। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন। আমি এবার আসি। প্রণাম, ঠাকুর মশাই প্রণাম!!
ঠাকুর মশাই রাগে গড় গড় করতে করতে লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনে পা বাড়ালেন। মনে মনে বিড় বিড় করতে লাগলেন। আর মাঝে মাঝে কাঁধ থেকে পাঁঠার বাচ্চাটা নামিয়ে চোখের সামনে ধরে পরখ করছেন, সত্যিই এটা পাঁঠার বাচ্চা, না কুকুরের বাচ্চা। মনে মনে ভাবতে লাগলেন এমন তরতাজা নাদুস নুদুস পাঁঠার বাচ্চাটাকে এ বেটা কুকুরের বাচ্চা বলল কেন? পাঁঠার বাচ্চাকে কি কেউ কুকুরের বাচ্চার মত দেখে নাকি? আমার দেখার কি ভুল হতে পারে? ষাট্, ভালাই ষাট্ আমার ভুল হতে যাবে কেন?
এরূপ ভাবতে ভাতে যখন দ্বিতীয় বাঁকে এসে পৌঁছলেন, তখন দ্বিতীয় ঠগ্ প্রথম ঠগের মতই লম্বা প্রণাম দিয়ে, কুশলাদি জিজ্ঞেস করে, তারপর বলল, ঠাকুর মশাই! এমন সুন্দর নাদুস-নুদুস কুকুরের বাচ্চাটা পেলেন কোথায়? যেই না প্রশ্ন অমনি কাঁধ থেকে পাঁঠার বাচ্চাটা নামিয়ে ঠগকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলছেন, দেখ, ভাল করে দেখ, বেটা নচ্ছার। এটা কি কুকুরের বাচ্চা, না পাঁঠার বাচ্চা? বেটারা সব চোখের মাথা খেয়েছিস? পাঁঠার বাচ্চাকে কুকুরের বাচ্চা বলছিস? এভাবে তোরা অন্ধ হলি কিভাবে?
২য় ঠগ্ – ঠাকর মশাই! এই অধমের দোষ নিবেন না। আপনি যখন বলছেন, তখন আমার দেখার ভুল হলেও হতে পারে। তবে আমার ভুল হলে তেমন কোন ক্ষতি হবে না। আমি একশ বার নাকখত দিয়ে অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারব। কিন্তু আপনার ভুল হলে, অবস্থাটা কেমন হবে? মা-ঠাকুরণ আপনাকে বাড়িতে ঢুকতে দিবেন ত?
ঠাকুর – মা ঠাকুরণ, মা ঠাকুরণ! আমি তোদের মা ঠাকুরণকে কি খুব পরোয়া করি নাকি? হলোই বা কুকুর ছানা, তাকে কি হবে? ঠাকুর বাড়িতে কি কুকুর থাকতে নেই? কিন্তু মুখে একথা বললেও, মনে মনে খুব ভয় করছেন। ব্রাহ্মণী যেমন শুচীবাইগ্রস্ত! এটা যদি পাঁঠার বাচ্চা না হয়ে কুকুর ছানাই হয়, তা হলে, কচুরী পানা ভরা ডোবার জলে আমাকে সাতবার চুবিয়ে তবে ছাড়বে। কিন্তু বাইরে খুব গর্জাতে গর্জাতে বললেন, বলত, আমার এমন ভক্ত যজমান! পূজা পার্বণ শেষে দক্ষিণাস্বরূপ এই পাঁঠার বাচ্চাটি দিল। কেউ কি কুকুরের বাচ্চা দক্ষিণা দিতে পারে?
ঠগ্ – ঠাকুর মশাই! আমি বলছিনা যজমান আপনাকে ঠকিয়ে পাঁঠার বাচ্চার বদলে কুকুর ছানা দিয়েছে। সে হয়ত আপনাকে পাঁঠার বাচ্চাই দিয়েছিল, কিন্তু কোন ফাঁকে ভুল করে হয়ত আসার সময় পাঁঠার বাচ্চার বদলে আপনি কুকুর ছানাটি নিয়ে এসেছেন।
ঠাকুর – না, আ, এমন হতেই পারে না। আসবার সময় যজমান কত বিনয় ভাবে আমার হাতে এই পাঁঠার বাচ্চাটা তুলে দিল, তা কি ভুল হতে পারে?
ঠগ্ – ঠাকুর মশাই! আমার ভুল আমি মেনে নিলাম। বাড়িতে গেলেই বুঝতে পারবেন। এবার আমি বিদায় নিচ্ছি। প্রণাম, ঠাকুর মশাই প্রণাম।
দ্বিতীয় ঠগের কথার পর ঠাকুর মশাই খুব দুর্বল হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, আমার ভুল হতেও পারে। মনে মনে এই ভেবে পাঁঠার বাচ্চাটি কাঁধ থেকে নামিয়ে এনে চোখের সামনে ধরে আবারও পরখ করতে লাগলেন, এটা কি কুকুরছানা! কুকুর ছানা যদি এরূপ হয়, তা হলে পাঁঠার বাচ্চা কেমন হবে?
এরূপ ভাবতে ভাবতে তৃতীয় বাঁকে এসে পৌঁছতেই তৃতীয় ঠগ লম্বা প্রণাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে তারপর বলল, ঠাকুর মশাই“ এমন সুন্দর কুকুর ছানাটি কোথায় পেলেন?
ঠাকুর – (তিনি এবার আর রাগ করলেন না) হ্যাঁ, বাড়িতে খুব বিড়ালের উৎপাত। তাই ভাবছি, কুকুর ছানাটি বড় হলে এই উৎপাত থেকে বাঁচা যাবে। এই জন্যই এই কুকুর ছানাটি এনেছি।
এরপর তৃতীয় বাঁক থেকে একটিু সামনে বেড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে পাঁঠার বাচ্চাটি কাঁধ থেকে সেখানেই আস্তে করে নামিয়ে দিয়ে বাড়ির দিকে চললেন। ঠগেরা ত এরই অপেক্ষা করছিল।
ঠাকুর মশাইয়ের এমন অবস্থা কেন হলো? কারণ, আত্মবিশ্বাসের অভাব। নিজের উপর আত্মবিশ্বাসের অভাবের জন্যই, নিজের চোখে দেখে-শুনে, হাত দিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখার পরও নিজের বোধ-জ্ঞান সর্ব ইন্দ্রিয় দ্বারা বুঝা সত্ত্বেও তিন ঠগের পাল্লায় পড়ে শেষ পর্যন্ত পাঁঠার বাচ্চাকে কুকুর ছানা বুঝতে বাধ্য হলেন।
ধর্মের ক্ষেত্রেও যুক্তি প্রমাণ বুদ্ধি বিবেক হারিয়ে প-িত-পুরোহিতদের মুখে, পীর-দরবেশ শাস্ত্রজ্ঞদের মুখে একই কথা বার বার শুনে শুনে অযৌক্তিক-অশাস্ত্রীয় কথাকেই যৌক্তিক ও শাস্ত্রীয় বলে মেনে নিতে আমরা বাধ্য হই। বামণ ঠাকুরের মতই সত্য ও সুন্দরের বিনিময়ে মিথ্যা ও কুৎসিতকে গ্রহণ করে নিজেকে ধন্য মনে করি! এরও কারণ আমাদের নিজেদের উপর আত্মবিশ্বাসের অভাব। মহান প্রভু তাঁর সত্য পথ চেনা ও সে পথের উপর অটল থাকার জন্য আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিন। আমিন!
*********