‘রব এবং রবগণ’
“ইমাম সাহেব! দেখছেন? ওই – ওই যে ভদ্রলোক! সেই কাদিয়ানি ভদ্রলোক আবারও এই মসজিদে নামাজ পড়তে এসেছেন!”
জোহর নামাজের চার রাকাত সুন্নত পড়ার পর মুছল্লীগণ যখন ফরজ নামাজ পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে কাতার সোজা করছিলেন এবং একজন এক্বামৎ বলছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তেই তরিকাপন্থী একজন পদস্থ অফিসার আমার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে উপরোক্ত কথাগুলো বলে অফিস মসজিদের ইমাম সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
অপর একজন মুছল্লী সাহেব আগে নামাজ শেষ করার জন্য বলাতে ইমাম সাহেব যথারীতি ফরজ নামাজ পড়া শেষ করলেন। নামাজবাদ ইমাম সাহেব মুছল্লীগণকে একটু বসতে বললেন।
নামাজ শেষে দেখা গেল অভিযোগকারী অফিসারটি মসজিদে নেই, অর্থাৎ আমি জামাতে নামাজ পড়াতে তিনি আমাদের সঙ্গে এক জামাতে নামাজ পড়েননি।
সে যাহোক, সবার নামাজ শেষ হলে পর ইমাম সাহেব বলতে লাগলেন, “পাকিস্তানে কাদিয়ানিরা সুবিধা করতে না পেরে তারা এখন বাংলাদেশের মুসলমানদের পথভ্রষ্ট করার জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করছে। এই অফিসের মধ্যেও কাদিয়ানি কিছু লোক আছে। তাদের লেখা বই পুস্তকের মধ্যে সবকিছুই কাদিয়ানি। আপনারা তাদের থেকে সাবধান হোন।”
ইমাম সাহেব আরো বললেন, “দেখুন আমাদের ইমান এমনিতেই খুব কমজোর। তাই অনুরোধ করছি, এখানে যদি কেউ কাদিয়ানি থেকে থাকেন, মেহেরবানী করে এই মসজিদে আসবেন না। আমাদের টুটা-ফাটা নামাজকে বরবাদ করবেন না। আমাদের এই সমজিদকে অপবিত্র করবেন না।”
তখন মুছল্লীগণের মধ্য থেকে জানতে চাইলেন, কে সেই কাদিয়ানি? আপনি যদি তাকে চিনেই থাকেন, তাহলে তার নাম কেন বলছেন না?
তখন ইমাম সাহেব বললেন, তিনি এই অফিসেরই একজন অফিসার। তিনি হচ্ছেন রশীদ সাহেব, তাকে আপনারা অনেকেই চেনেন।
তখন আমি দাঁড়ালাম এবং বললাম, আমি কি দু’একটি কথা বলতে পারি? মুছল্লীগণ অনুমতি দিলে আমি বললাম, “দেখুন, আমি নিজেকে কখনো কাদিয়ানি বলে মনে করিনা। আমি কাদিয়ানিদের কেউ নই। কাদিয়ানিরাও আমার কেউ নয়। তাদের সাথে আমার কোন সংশ্রব নেই। তবুও যদি আমাকে মসজিদে আসতে মানা করেন তা’হলে আমি আর মসজিদে আসব না। এই ব্যাপারে আপনাদের যা ইচ্ছা হয় তা-ই আমাকে বলে দিতে পারেন।”
তখন মুছল্লীগণের মধ্য হতে একজন সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, “দেখুন আপনাদের কাউকেই ত চেনার আমার আর বাকী নেই। আপনাদের কে কবে থেকে মুসলমান হলেন তাও তো দেখেছি। আর তের-চৌদ্দ বৎসর যাবৎ রশীদ সাহেবকেও দেখে আসছি। তিনি কোথায় কিভাবে কাদিয়ানি হলেন আমাদেরকে তা’ বুঝিয়ে বলুন।”
ইমাম সাহেব তখন জানালেন যে, তাদের লেখা বই-পুস্তক নিয়ে ফরিদাবাদ, বড়কাটরা, লালবাগ প্রভৃতি মাদ্রাসায় দেখানো হয়েছে। সেখানকার আলেম-ওলামাদের সবাই তাদের লেখাকে সাফ সাফ কাদিয়ানি মতবাদ বলেই ‘রায়’ দিয়েছেন।
তখন পূর্বোল্লিখিত মুছল্লী সাহেব বললেন, ……………. তাদের লেখা বই-পুস্তক এখানেই আছে। সেই সমস্ত লেখা দেখিয়ে বলুন কোন কোন জায়গায় কাদিয়ানির কথা লেখা আছে।
এ পর্যায়ে একটু উত্তেজনার ভাব পরিলক্ষিত হলে অপর একজন মুছল্লী সাহেব বললেন, দেখুন, এ নিয়ে মসজিদের ভেতর গ-গোল ভাল দেখায় না। আসুন, দেখি কিভাবে এর একটা ফয়সালা করা যায়।
এরপর তারা আমাকে আগামী দিন আমাদের লেখা বই-পুস্তক নিয়ে মসজিদে হাজির হওয়ার নির্দেশ জানালেন। ‘তথাস্ত’ বলে আমি চলে এলাম।
আমাকে এবং আমাদের লেখা বই-পুস্তক নিয়ে পূর্বেও এই মসজিদে কিছু কথা-বার্তা হয়েছিল। আমি সেগুলোকে মোটেই কোন গুরুত্ব দেইনি। এখনও দিচ্ছিনে। আমাকে যে যাই বলুক, আমি জানি এর বাদ-প্রতিবাদ করতে গেলে এক কথায় দুকথায় কারো ধৈর্যচ্যুতি হলে অপ্রীতিকর কিছু ঘটে যেতে পারে। আর যে ভদ্রলোক এতক্ষণ ইমাম সাহেবের সঙ্গে প্রতিবাদের সুরে কথা বলছিলেন, তিনিও আমাদের সংগঠনের কেউ নন। তিনি আমাদের অফিসেরই একজন অফিসার। তার সঙ্গে একই অফিসে প্রায় ১৩/১৪ বৎসর যাবৎ কাজ করে আসছি। তিনি আমাকে তখন থেকেই দেখে আসছেন, আমিও তাকে দেখে আসছি। আমাদের সংগঠনের কাজকর্ম ও বিশ্বাসের ব্যাপারে তার সাথে পূর্বেও অনেক কথা হয়েছে। তা ছিল সম্পূর্ণভাবে পরস্পর পরস্পরকে বুঝবার এবং বুঝাবার আন্তরিক চেষ্টা। কিন্তু আমাদের সে আলোচনায় কখনো কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছিল না।
কিছুদিন থেকেই আমি লক্ষ্য করছিলাম, নামাজের আগে তকরীর করার সময় আমি যদি উপস্থিত থাকতাম, তাহলে ইমাম সাহেব এমনভাবে তকরীর করতেন যে, সামান্য বোধ-জ্ঞান থাকলে যে কোন লোক বুঝতে পারতেন, তিনি এই তকরীর আমাকে লক্ষ্য করেই করছেন। এ সব ব্যাপারে আমি আমার মোর্শেদ সাহেবের আদর্শই অনুসরণ করে চলতে চেষ্টা করেছি, যদিও জানি আমার মত নগণ্য এক বান্দার পক্ষে যথাযথভাবে তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে চলা সম্ভব নয়। আমি অনেক সময় প্রত্যক্ষ করেছি, শিক্ষিত আলেম-ওলেমা তো দূরের কথা, নামাজের ছুরা-কালাম ঠিক মত পড়তে পারে না, এমন লোক তাঁকে নানা ভাবে উপহাস-বিদ্রƒপ ও কটাক্ষপূর্ণ বাক্যে জর্জরিত করা সত্ত্বেও নামাজের সময় হলে তেমন লোকের পিছনেও তিনি নামাজ পড়তে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করেন নি।
সুতরাং আমাকে কেউ কাদিয়ানি, বেদাতী, গোমরাহ, কাফের, বেদ্বীন বললেই কি আমি নামাজ পড়া ছেড়ে দেব? আর কোন কাফের, বেদ্বীন, কাদিয়ানি মসজিদে ঢুকলে মসজিদ অপবিত্র হয়ে যায়? এ কার কথা? এটা কি আল্লাহর কোন কালাম, রাছুল (দঃ)- এর কোন বাণী, না কোন সিদ্ধ পুরুষের বাক্য? এ প্রশ্নের জবাব মেহেরবানী করে জানালে অত্যন্ত বাধিত হব।
আমি কোন ‘আলেম’ নই, তদ্রƒপ হওয়ার আমার কোন ইচ্ছাও নেই। কোরান-হাদিস সম্বন্ধে আমি একজন অজ্ঞ বই নই। আরবী-উর্দূ মোটেই জানা নেই। আমার যা কিছু জানা তা বাংলাা বা ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে। সুতরাং বাংলা বা ইংরেজীতে যা লেখা তা’তো আর ‘কেতাব’ নয়, বই-পুস্তক মাত্র। আর ইংরেজী-বাংলায় বই-পুস্তক পড়ে চীন, জাপান, জার্মান আমেরিকা, লন্ডন ঘুরে ডক্টর হলেও হতে পারেন কিন্তু ‘আলেম’ হতে পারবেন না। ‘আলেম’ হতে হলে আপনাকে যেতে হবে লালবাগ, ফরিদাবাদ, বড়কাটরা বা বক্সীবাজার।
মার্শাল ল’তেও বিবাদীর কথা বলার সুযোগ আছে, কিন্তু এসব জায়গা থেকে ‘রায়’ বা ফতোয়া দেয়ার সময় বিবাদীর কোন কথা শুনার বা তার উপস্থিতির কোন প্রয়োজন হয় না। এদের রায়ের বিরুদ্ধে আপীলেরও কোন ব্যবস্থা নেই। এখান থেকে রায় একবার ঘোষণা করা হলে তার প্রতিবাদ করার ক্ষমতা স্বয়ং প্রেসিডেন্টেরও আছে কিনা সন্দেহ।
এত দুর্দ- প্রতাপ যে রায়ের, সে ‘রায়’ কি বন্ধ করতে পারে দেশের সুদ-ঘুষ-মদ-জুয়া-হাউজি, লুট-অপহরণ-ধর্ষণ-হত্যা-রাহাজানি? না, এর কিছুই করতে পারে না। কারণ, এগুলো ত অনৈসলামিক কিছু নয়। অনৈসলামিক যদি কিছু হবে, তাহলে এ পর্যন্ত শুনেছেন এসব যারা করে তাদের বিরুদ্ধে কোন ফতোয়া? তবে তাদের ‘রায়’ বা ‘ফতোয়া’ যে একেবারে কিছুই করতে পারে না তা নয়। যা করে তা এই –
আমাকে তাদের মসজিদ ঘরে দেখলেই যদি পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বিষোদগারণ শুরু হয়, আমার জন্য যদি তাদের মসজিদ ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায় বা আমার সঙ্গে অবমাননাকর ব্যবহার অব্যাহত রাখা হয, তাহলে আমি কি নামাজ পড়া ছেড়ে দেব? তাদের সঙ্গে রাগ করে নামাজ পড়া ছেড়ে দেয়া তো আমাদের পক্ষে কখনো সম্ভব হবে না। নামাজ যখন পড়তেই হবে তখন আমি এবং আমার সঙ্গী-সাথীরা কি পৃথক জামাত কায়েম করতে বাধ্য হব না? এতে ফলটা কি হবে? এতে আরো একটা দল বেড়ে যাবে। এই দল বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী হবে কারা? তারাই নয় কি যারা আজ আমাদেরকে কাদিয়ানি, বেদ্বীন-কাফের বলে তাদের জামাত থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করছে? এমনিভাবেই কি মোহাম্মদী উম্মত আজ ৭৩ দলে বিভক্ত হয়ে পড়েনি এবং এভাবে দল সৃষ্টি করার মূলে কারা রয়েছে? তারাই নয় কি যারা আজ তাদের মসজিদ বা জামাত থেকে বের করে দিয়ে আমাদেরকে পৃথক জামাত সৃষ্টি করতে বাধ্য করছে? সুতরাং এ কাজটি তারা অতি সহজে ও অবলীলাক্রমে করে যাচ্ছে।
আমার বর্তমান অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বর্তমান আহম্মদী জামাত -কাদিয়ানি বলে যারা খ্যাত তারাও হয়ত একদিন আমারই মত তথাকথিত মুসলমানদের দ্বারা অপমানিত, লাঞ্ছিত ও বহিষ্কৃত হয়েই পৃথক জামাত করতে বাধ্য হয়েছে। এটা আমার অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যক্তিগত অভিমত।
পাকিস্তানের ভুট্টো সরকার যাদেরকে ‘অমুসলিম সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়” আখ্যায়িত করে আইন করেছে, এ আইন কি সারা মুসিলম জাহান কর্তৃক স্বীকৃত ও গৃহীত? অন্য কোন মুসলিম দেশ পাকিস্তানের এ আইনকে স্বীকৃতি না দিয়ে থাকলে সে দেশের অধিবাসীগণ কিরূপে পাকিস্তানের একটি আইনের ধুয়া তুলে দেশাভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক বিষ সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছে? আর যদি কোন দেশ এটাকে স্বীকৃতিই দিয়ে থাকবে তাহলে এ সম্প্রদায়ভুক্ত সকলের বেলায়ই কি তা প্রযোজ্য হবে না? নাকি এ সম্প্রদায়ভুক্ত কেউ নোবেল পুরষ্কার পেলে তার বেলায় এ ‘ধুয়া’ অপ্রযোজ্য হবে? এরূপ না হয়ে থাকলে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী অধ্যাপক সালামকে ঢাকায় এনে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী প্রথম মুসলমান হিসেবে ডক্টরেট সম্মানে ভূষিত করলেন কিরূপে? কই! সেদিন তো এ দেশের কোন মুসলমান এ কথা বলতে এগিয়ে আসলেন না যে অধ্যাপক সালাম প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক হতে পারেন, নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন, বৈজ্ঞানিক হিসেবে যে সম্মান প্রাপ্য তা তাকে দিতে পারেন, কিন্তু তাকে মুসলমান বলা যেতে পারে না, যেহেতু তিনি কাদিয়ানি সম্প্রদায়ভুক্ত বা তার সাফল্য মুসলমানদের সাফল্য নয়। কই! কেউ তো একথা বলার জন্য এগিয়ে আসলেন না! অধ্যাপক সালামকে অমুসলামন বলে পার পাওয়া যাবে না মনে করেই কি আপনাদের এ মৌনব্রত অবলম্বন? এখন অধ্যাপক সালামকে যদি অমুসলমান বলতে না পারেন, তাহলে তিনি যে সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত তাদেরকে অমুসলমান বলবেন কোন আইনে? যদি আপনাদের ঈমানের এত জোরই থেকে থাকে তাহলে বিশ্ব-মুসলিম ভাইদের একথা জানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে পারবেন কি? আপনাদের প্রতি এই চ্যালেঞ্জ, ইনশাল্লাহ আপনারা তা কস্মিনকালেও পারবেন না। সুতরাং তাকে যখন অমুসলমান বলে ঘোষণা করার সাহস আপনাদের নেই, তখন অবজ্ঞাত, অখ্যাত অফিসের এক কোণায় অনুষ্ঠিত নামাজের জামাতে ‘এরা মুসলমান নয়, কাদিয়ানি’ বলে রায় দিলেই কি ‘এরা’ ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে আপনাদের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়বে, না আপনাদের যুক্তিহীন ফতোয়ার কোন তোয়াক্কা ‘এরা’ করবে?
আর আপনারা ত ইসলামী ধর্মীয় শাস্ত্র পাঠ করেই ‘আলেম’ হয়েছেন। কোন মুসলমান বা কাদিয়ানি মসজিদে ঢুকলে মসজিদ অপবিত্র হয়ে যায় – একথা ইসলামের কোন শাস্ত্রে আছে বলতে পারেন কি? নবী করিম (দঃ) স্বয়ং যদি ইহুদী ধর্মানুযায়ী মসজিদে-নববীতে ইহুদীদের ধর্মানুষ্ঠান পালন করার অনুমতি দিতে পারেন এবং তাতে যদি মসজিদে-নববী অপবিত্র না হয়ে থাকে, তাহলে একজন ‘কাদিয়ানি’ আপনাদেরই জামাতে সামিল হয়ে নামাজ পড়লে আপনাদের নামাজ বরবাদ হয়ে যাবে, আর আপনাদের মসজিদ অপবিত্র হয়ে যাবে – এ কোন ইসলামের বিধান?
ইমাম সাহেব! আপনারা আলেম মানুষ। ধর্মই আপনাদের প্রধান কর্ম। ধর্মশাস্ত্রের বিচার বিশ্লেষণ আপনাদের পক্ষেই সহজ ও সম্ভব। ইসলামের প্রতি অকুণ্ঠ দরদ আছে বলেই ইসলামের কোথাও কোন ত্রুটি বিচ্যুতি দেখলে আপনাদের পক্ষে তা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। আপনাকে ইসলামের একজন দরদী হিসেবেই আমি অনুরোধ করছি, আমাদের বই-পুস্তকগুলো ভাল করে একবার পড়ে দেখুন। আমাদের কোন লেখাটি কোরান, হাদিস অথবা যুক্তি বিরোধী হয়েছে তা একটু দেখিয়ে দিন। যদি কোথাও এরূপ হয়েছে বলে প্রম্ণা করতে পারেন, তাহলে প্রকাশ্য ময়দানে আমাদের ভুল স্বীকার করে তওবা করব। শুধু কাদিয়ানি ধুয়া তুলে আমাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা বৃথা।
ছোট সময় শুনতাম খ্রিষ্টান পাদ্রীরা মুক্তির সার্টিফিকেট মৃতের সাথে কবরে দিয়ে দিতেন। এ কথা শুনে খ্রিষ্টান ধর্ম সম্বন্ধে অত্যন্ত খারাপ ধারণা পোষণ করতাম। আর এখন! কে মুসলমান, আর কে মুসলমান নয়, অর্থাৎ মৃত্যুর পর আল্লাহ কাকে মুক্তি দিবেন আর কাকে শাস্তি দিবেন – এ সার্টিফিকেট দেয়ার খবরদারী পেয়ে গেছেন লালবাগ, ফরিদাবাদ, বড় কাটরা প্রভৃতি মাদ্রাসাগুলোর মুতাওয়াল্লী ও আলেমবৃন্দ!
দেশের আলেম-ওলামাবৃন্দ! দেশবাসী আপনাদের যথেষ্ট ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। সুতরাং আপনাদের দেয়া ফরমান অবনতশিরে পালন যোগ্য। আপনাদের দেয়া ‘রায়’ বা ‘ফতোয়া’ যথেষ্ট শক্তি ও সামর্থ রাখে বলে আপনাদের বিশ্বাস। তাই আপনাদের প্রতি আমাদের একটি প্রশ্ন, সুদ-ঘুষ-মদ-হাউজি, হত্যা-নাচ-গান, বেপর্দা, অপহরণ-ধর্ষণ, দলা-দলি, মারা-মারি, কাটাকাটি প্রভৃতি ফেতনা-ফাসাদে দেশ ছেয়ে গেছে। এ কথার স্বীকৃতি ওয়াজ-মাহফিলের মধ্যে আপনাদের মুখেও পাওয়া যায়। আপনারা ‘রায়’ বা ‘ফতোয়া’ দিয়ে এগুলো থেকে দেশকে উদ্ধার করছেন না কেন? না কি এসবের প্রচলন আপনাদের ইসলামে বৈধ? এতে আপনাদের ইসলামের কি কোন ক্ষতি হয় না? কই! এ সবের বিরুদ্ধে তো আপনাদের কোন ফতোয়া বা রায় দেখছি না? ইসলামের ক্ষতি কে কেবল তখনই হয় যখনই আপনাদের মতের সঙ্গে কারো মতের গড়মিল হয়? অর্থাৎ, আপনি যে কেউ হোন, সুদ-ঘুষ-মদ যতই খান, হত্যা-লুণ্ঠন-অপহরণ, ধর্ষণ যা ইচ্ছে করুন, নাচ-গান-সিনেমা যত ইচ্ছে দেখুন তাতে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ার কোন ভয় নেই। এতে বেদ্বীন, কাফের, গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার কোন ভয় নেই। ভয় কেবল যখনই কেউ আপনাদের মতের বাইরে কথা বলবে!
অর্থাৎ অসীম আল্লাহর অসীম জ্ঞান তথাকথিত আলেম-ওলেমাবৃন্দের অন্তকরণে অঙ্কিত হয়ে আছে। সুতরাং আল্লাহ, নবী, ধর্ম, ইসলাম প্রভৃতি সম্বন্ধে কোন তত্ত্ব বা তথ্য তো তাদের জ্ঞানের বাইরে থাকা বাঞ্ছনীয় নয়! সুতরাং যে কেউ কিছু বলুন তথাকথিত আলেমবৃন্দের মোহরাঙ্কিত না হলে তা নির্ঘাত খোদাদ্রোহী, ইসলামদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী হবে, তাতে আর সন্দেহ কি!
অসীম আল্লাহর অসীম জ্ঞান এবং আল্লাহর কালাম কোরানের পূর্ণ জ্ঞান কোন মানুষের অন্তকরণে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে, এ কথা আমরা মানতে রাজী নই, এতে আপনারা আমাদের বিরুদ্ধে কাদিয়ানি, কুফরী, বেদাতী বা গোমরাহী ফতোয়া যতই দিন না কেন।
আমরা আল্লাহকে অসীম, তাঁর জ্ঞানকেও অসীম বলেই বিশ্বাস করি এবং কোরান-পাকের জ্ঞানকেও আমরা অসীম বলেই বিশ্বাস করি। তবে আল্লাহ-পাক এ কোরান থেকে যাকে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই তাকে বুঝান। কিন্তু এ বুঝই যে শেষ বুঝ, তাও নয়। এর আরও অনেক বুঝ রয়েছে যা মানুষ এখনও জানতে বা বুঝতে পারেনি। আর আল্লাহ-পাক স্বয়ং যাকে বুঝান, সে বুঝই সত্য ‘বুঝ’ এ বুঝ মত যারা চলে তারা অবশ্যই সত্য পায়। এ বুঝের বিরুদ্ধে যারা চলে তারা সত্য পায় না। ১৪০০ বছর পূর্বে শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে অছাল্লামকে আল্লাহ-পাক সত্য বুঝই বুঝিয়েছিলেন।
সেই সত্য বুঝ বুঝেই তাঁর অনুসারীগণ পৃথিবীতে সত্যের হুকুমত কায়েম করেছিলেন। কিন্তু আজ আমরা সে বুঝ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েছি বলেই অসত্যের হুকুমত আমাদের ঘাড়ের উপর চেপেছে। তাই বর্তমানে আমরা এত অশান্তি, এত জুলুম-অত্যাচার ভুগছি।
কিন্তু আল্লাহ তো এখনও জীবিত আছেন। তিনি অন্ধ নন, নির্দয়-নিষ্ঠুর নন। তাঁর শক্তি, জ্ঞান ও হেকমত পূর্ণভাবে এখনও বিদ্যমান আছে। তাঁর সেরা সৃষ্টি মানুষের দুঃখ-কষ্ট, অশান্তি, জুলুম-অত্যাচার দূর করে দিয়ে তিনি কি পারেন না আমাদের জন্য শান্তির ব্যবস্থা করতে? আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তিনি অবশ্যই তা পারেন। তাঁর রহমত থেকে নিরাশ হওয়াকে আমরা কুফুরীতূল্য ভয় করি। সুতরাং এ ব্যাপারে আমরা তাঁর অসীম দয়া ও করুণার আশাধারী। আমাদের এ বিশ্বাস কিভাবে ‘কাদিয়ানি’ হলো, আমাদের এ বিশ্বাস কিরূপে ইসলাম বিরোধী বা খোদা বিরোধী হলো? আমরা তো আপনাদের দেয়া ফতোয়ার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ বুঝে উঠতে পারছি না।
এখানে আপনারা হয়ত বলতে পারেন যে, আপনারা একজন লোকের আবির্ভাব হওয়ার এবং প্রত্যাদেশ পাওয়ার কথা বলছেন, আপনাদের এ বিশ্বাসটিই কাদিয়ানি।
এর জবাবে আমাদের জিজ্ঞাসা, কাদিয়ানিদের সাথে আমাদের এ বিশ্বাসের কি সম্পর্ক? আমরা যখন সবাই আল্লাহর রহমত চাই, অশান্তি থেকে মুক্তি চাই, আল্লাহর এ রহমত আমরা কোথায় কিভাবে পেতে পারি?
আল্লাহর রহমত পাওয়ার ব্যবস্থাটি কি? আপনারা কি কোথাও দেখেছেন বা শুনেছেন যে অমুক সময় অমুক দেশে কোন গাছের ডালে আল্লাহর রহমত ঝুলছিল, দেশবাসী তা গাছ থেকে পেড়ে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে যে যার মত শান্তিতে কাল কাটিয়েছে। আপনারা কি কেউ কোন দিন শুনেছেন যে অমুক দেশের মাঠে বা সাগরের বুকে আল্লাহ তাঁর রহমত ঢেলে ছিলেন, দেশের লোক সেখান থেকে রহমত সংগ্রহ করে এনেছিল এবং সুখে-শান্তিতে কাল কাটিয়েছিল? আমাদের তো বিশ্বাস, এরূপ কোন নজির নেই। তাহলে আল্লাহর রহমত পাওয়ার তরিকা বা পন্থাটি কি?
আমরা যতদূর জানি, অবশ্যই তা আপনাদের মুখ থেকে বা আপনাদের লেখা পুস্তকাদি থেকেই জানা, কোন দেশ বা বস্তীতে মানুষ অন্যায়-অবিচার, জুলুম-অত্যাচার কবলিত হলে অতি কষ্টে জীবন যাপন করত, তখন তাদের উদ্ধারের জন্য আল্লাহ-পাক তাদের মধ্য থেকে একজনকে শুভসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী নিযুক্ত করতেন। এই শুভ সংবাদ দাতা ও সতর্ককারী ব্যক্তির মাধ্যমেই আল্লাহ তাঁর রহমত পাঠাতেন। যারা সেই প্রেরিত ব্যক্তির আনুগত্য করত তারাই রহমতের ভাগী হত, আর যারা তাঁর আনুগত্য অস্বীকার করত তারাই শাস্তি ভোগ করত। এ প্রেরিত ব্যক্তির মাধ্যমেই সত্য ও মিথ্যা পৃথক হত, সত্যের দলকে আল্লাহ বিজয় দান করতেন এবং মিথ্যার দলকে ধ্বংস করে দিতেন। পবিত্র গ্রন্থে এরূপ ঘটনার অনেক বর্ণনাই রয়েছে, আপনারা তা ভালভাবেই জানেন। অর্থাৎ এক একজন মানুষের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রহমত এ পৃথিবীতে পাঠিয়ে থাকেন। আমরাও এরূপই আশা করছি। আমাদের এ আশা কি কোরান বিরোধী হল?
এখন হয়ত বলতে পারেন, হজরত মোহাম্মদ (দঃ) এর পর আর ত কেউ আসবে না।
আপনাদের এ কথাটি সর্বৈব ভুল। কোরান এবং হাদিসে এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। পূর্ববর্তী সংখ্যায় এ বিষয় অনেক দলিলের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। সে দলিলগুলোর সত্যতা আপনারা যাচাই করে দেখে বলুন, এ দলিলগুলো সত্য কি মিথ্যা। সেগুলো মিথ্যা প্রমাণ করতে পারলে আমরা অবশ্যই আমাদের দাবী প্রত্যাহার করে নেব এবং তওবা করে আপনাদের সঙ্গে মত মিলয়ে চলব। আর যদি এগুলো মিথ্যা প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে আপনারা কি আমাদের মতের সঙ্গে এক মত হতে পারবেন?
এখন আপনারা যদি এর কোন একটিও মানতে রাজী না হোন, অধিকন্তু, আমাদের উপর চড়াও হয়ে মারধর করতে চান বা কাদিয়ানি, কাফের, বেদ্বীন বলে দোষারূপ করতে চান, তখন ‘লাকুম দ্বীনুকুম ওলেয়াদ্বীন’ বলে আপনাদের থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কি করতে পারি?
এবার আসুন দেখা যাক যে ঘটনা দিয়ে বক্তব্য শুরু করেছিলাম সে ঘটনার কিভাবে পরিসমাপ্তি লাভ করল।
পরের দিন সকালে আমার সেই সহযোগী বন্ধুটি যিনি প্রতিবাদের সুরে কথা বলছিলেন, আমাকে ডাকলেন। যেয়ে দেখলাম, তার পাশে উপবিষ্ট রয়েছেন তরিকাপন্থী আমাদের আরও একজন সহকর্মী। আমার লেখার মধ্যে তাদের যেখানে একটু সন্দেহ ছিল, সে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করাতে আমার লেখার সমর্থনে একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দেয়াতে তাদের যে সন্দেহ ছিল তা দূর হয়ে গেল। তখন তারা জানালেন যে এ ব্যাপারে তাদের আর কোন জিজ্ঞাস্য নেই। সে যাহোক পূর্ব দিনের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের বই-পুস্তক নিয়ে উপস্থিত থাকার জন্য আবারও তারা আমাকে তাগিদ দিলেন।
নামাজের বেশ পূর্বেই আমি আমার বই-পুস্তক নিয়ে মসজিদের এসে হাজির হলাম। ইমাম সাহেব যথারীতি তকরীর শুরু করলেন। তকরীরের মধ্যেই তিনি জানিয়ে দিলেন যে মসজিদের সেক্রেটারীর সঙ্গে আমাদের ব্যাপারে আলাপ হয়েছে। তিনারা আমার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা এইঃ
“রশীদ সাহেব কাদিয়ানি নন্ বলে মুখে মুখে যতই সাফাই গাউক না কেন তার কথা আমরা বিশ্বাস করতে পারিনে। রাছুল করিম (দঃ)-এর সময়েও অনেক লোক ছিল যারা নবী করিম (দঃ)-এর পিছনে নামাজ পড়ত এবং অন্যান্য ধর্মানুষ্ঠানও পালন করত; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ছিল মুনাফেক। রশীদ সাহেব যদি আমাদের পিছনে একতেদা করে নামাজ পড়তে চান; তাহলে তিনি তা করতে পারেন। তাকে নামাজ পড়তে আসতে বাধা দেয়া উচিত হবে না। এ নিয়ে এখানে আর কোন আলোচনা হতে পারবে না। তার সম্বন্ধে এই আমাদের শেষ সিদ্ধান্ত।”
এখানেই তক্রীর শেষ হল। তারপর নামাজ পড়ে চলে এলাম। এর পরদিন জানতে পারলাম আমার সেই সহযোগী অফিসার বন্ধুটি নাকি ইমাম সাহেবের নিকট জানতে চেয়েছিলেন; কে বা কারা কোথায় কিভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? কথা তো এরূপ ছিল না। কথা ছিল রশীদ সাহেবের বই-পুস্তক দেখে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তখন ইমাম সাহেব নাকি বলেছিলেন; “আমাদের ‘রায়ের’ বিরূদ্ধে রশীদ সাহেব তো কোন বাদ-প্রতিবাদ করেননি; বরং তিনি তা মেনে নিয়েছেন। আপনি কেন এর প্রতিবাদ করছেন?” ব্যাস; বন্ধুটি লা-জওয়াব হয়ে গেলেন। রশীদ সাহেবের জন্য তার কেন এত মাথা ব্যথা? সত্যই তো।
রশীদ সাহেব কেন বাদ-প্রতিবাদ করেননি-
‘রায়ে’ বলা হয়েছে ‘রশীদ সাহেব যদি আমাদের পিছনে একতেদা করে নামাজ পড়তে চান তাহলে তিনি তা করতে পারেন; তাকে নামাজ পড়তে আসতে বাধা দেওয়া উচিত হবে না।’
এখানে রশীদ সাহেবের বক্তব্য হলো; আপনারা কি কোন দিন দেখেছেন যে তিনি ইমামতি করার জন্য বা মসজিদের মুতাওয়াল্লী হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন? রশীদ সাহেব আপনাদের কাছে কোন দিন এরূপ আবদার করেননি। তাহলে ‘রশীদ সাহেব যদি আমাদের পিছনে একতেদা করে নামাজ পড়তে চান তাহলে তিনি তা করতে পারেন’ সিদ্ধান্তের এই শর্তটুকুর উল্লেখ এখানে বাহুল্য নয় কি?
দ্বিতীয়তঃ একদিন পূর্বে যার উপস্থিতিতে নামাজ বরবাদ হয়ে যাওয়ার এবং মসজিদ অপবিত্র হওয়ার কারণ ছিল, একদিন পরেই সে কিরূপে এই কারণ থেকে মুক্ত হয়ে গেল?
একজন ধর্মজ্ঞ আলেম হিসেবে তার আগের দিনের ফতোয়ার সঙ্গে পরের দিনের ফতোয়ার মিল থাকা কি বাঞ্চনীয় ছিল না? রশীদ সাহেব কি তাঁর কাছে আপীল করেছিলেন, ‘আমাকে মেহেরবাণী করে আপনাদের পিছনে একতেদা করে নামাজ পড়ার অনুমতি দিন?’ কে ইমাম সাহেবকে নিষেধ করতে বলেছিল, আবার কে-ই বা তাকে অনুমতি দিতে বলেছিল? আমি তো তাকে বলিনি এবং আমার পক্ষ থেকে কাউকে উকিলও নিযুক্ত করিনি। পূর্বেও যেমন মসজিদে এসে নামাজ পড়তাম, এখনও তেমনি পড়ছি। তাহলে মধ্যখানে এরূপ তোলপাড়া সৃষ্টি করার কারণটি কি? নিশ্চয় এটা তাঁর অগাধ এলেমের হেকমত!
এ পর্যন্ত যতটুকু আলোচনা হলো এতে কি প্রমাণ হচ্ছে ? সামান্য একটু মতের গড়মিল হওয়াতে যা কিনা খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে অতি সহজেই সুরাহা করা যেত এবং আমি ইমাম সাহেবকে একদিন বলেও ছিলাম যে ‘হুজুর আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। আপনার অবসর সময় একটু আসবেন।’ তিনি একই ফ্লোরে নামাজ পড়তে আসতে পারেন অথচ আমার সঙ্গে একটু আলাপ করতে আসতে পারলেন না। কিন্তু এর পরিবর্তে একটা কোন্দল সৃষ্টি করতে পারলেন। এ কোন্দল সম্বন্ধেই আল্লাহ্ বলছেন, “আল ফেতনাতু আসাদ্দু মিনাল কাতলে – অর্থাৎ ফেতনা-ফাছাদ সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও জঘণ্য।” তিনি কি এই কোন্দল সৃষ্টিকারী নন?
দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ্-পাক কোরানে বলছেন, “তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা করতে পার না? এরূপ করা আল্লাহ্র নিকট অত্যন্ত জঘণ্য অপরাধ।” কাদিয়ানির উপস্থিতিতে নামাজ বরবাদ হওয়ার এবং মজসিদ অপবিত্র হওয়ার সমর্থনে তিনি কোন দিন কোন দলিল-প্রমাণ দেখাতে পারবেন? সুতরাং তিনি এমন কথাই বলে ফেলেছেন যা তিনি সারা জীবনেও কার্যকরী করতে পারবেন না।
আল্লাহ্র কালাম যার বিরুদ্ধে সাক্ষী; আমার পক্ষে তার কথার প্রতিবাদ করার আর কি প্রয়োজন? বরং আল্লাহ্ই তার প্রতিবাদ করছেন।
আসলে আমি তো এখানকার কাউকেই আমার হাকিম বলে স্বীকার করিনি, তাদের দেওয়া ফতোয়ারও কোন পরোয়া করিনি। আমার বিরূদ্ধে দেওয়া তাদের রায়ের কোন কানাকড়ি মূল্যও দিইনি। সুতরাং তাদের রায়ের বিরূদ্ধে আমার বিন্দুমাত্র বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হয়নি। সে জন্য আমার পক্ষ থেকে কোন বাদ-প্রতিবাদ উঠেনি।
এখানে প্রশ্ন হতে পারে, যখন তাদের রায় বা ফতোয়ায় আপনার কোন প্রতিক্রিয়াই হয়নি, তখন এই সামান্য ঘটনার এত বড় লম্বা ফিরিস্তি কেন বর্ণনা করছেন?
উত্তর – এই সামান্য ঘটনা থেকে যে বিরাট তত্ত্ব উদ্ঘাটিত হয়েছে, এখানে সেই তত্ত্বটির কথাই কিছু বলতে চেয়েছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল এ লেখাটি অতি সংক্ষেপে শেষ করব; কিন্তু ঘটনা পর¤পরায় এটা ক্রমেই দীর্ঘতর হয়ে যাচেছ। সেজন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচিছ।
আমি লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম – আমাকে আসামীর কাঠ গড়ায় দাঁড় করিয়ে বাদী পক্ষ একতরফাভাবে আসামীর বরবাদীর কাহিনী অবলীলাক্রমে বলে যাচেছ; কিন্তু কেউ বলতে সাহস পাচেছ না যে আসামী যখন হাজিরই আছে; তার কোন বক্তব্য আছে কি না; থাকলে তা তাকে বলতে দেওয়া হোক। আমরা তা শুনতে চাই। কেননা একতরফাভাবে কিছু করা বা বলা ইন্সাফ নয়।
ঘটনার যেদিন সূত্রপাত হয়; অর্থাৎ প্রথম যেদিন আমার বিরুদ্ধে তকরীর করা হয়; দ্বিতীয় দিনে আমি তাদের অভিযোগের জবাব দিয়েছিলাম এবং ভেবেছিলাম এখানেই এ প্রসঙ্গের শেষ হবে। কিন্তু তৃতীয় দিন আবারও যখন আমার বিরুদ্ধে তকরীর করা হলো তখন যেইমাত্র আমি কিছু বলার জন্য সামনে এগিয়ে যাই অমনি উল্লিখিত অভিযোগকারী পদস্থ অফিসারটি এবং আরো একজন সহকর্মী এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে চেচিয়ে উঠলেন না, না, আপনাকে আর একটা কথাও বলতে দেওয়া হবে না। এই বলে আমাকে সামনে রেখেই নামাজ পড়তে শুরু করে দিলেন। এ ঘটনার পর ইমাম সাহেব অবিরাম আমাদের বিরুদ্ধে তকরীর করে যেতে লাগলেন। আমিও নির্বিবাদে শুনে যাচিছলাম। আমি আর এক দিনও তাদের কথার প্রতিবাদ করতে সাহস পাইনি। এর কিছু দিন পরেই উল্লিখিত ঘটনাটি ঘটে। সুতরাং আমার প্রতিবাদ করার মুখ ত জোর করেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং আমার পক্ষে প্রতিবাদ করার সুযোগ কোথায় ছিল? কিন্তু অন্যান্য মুছল্লীগণের মুখ বন্ধ কেন? তাদের মুখ তো জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়নি!
তারা কেন চুপ? –
হজরত মোহাম্মদ (দঃ) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। মুসলমানের ঘরে জন্ম গ্রহণকারী প্রত্যেকটি মানুষেরই নিকট তিনি তর্কাতীত মহামানব। তাঁর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধাও প্রশ্নাতীত। তাঁর প্রতি আমাদের অবিচল ভক্তি ও শ্রদ্ধার কারণেই তাঁর প্রবর্তিত সুন্নাতের প্রতিও আমাদের অবিচল ভক্তি ও শ্রদ্ধা রয়েছে।
মাথায় টুপী পরিধান করা তাঁর একটি সামান্য সুন্নত। তা সত্বেও একজন টুপীধারী লোকের সঙ্গে মোকাবিলা হওয়া মাত্র আমরা যত বড় দুশ্চরিত্রই হই না কেন; স্বাভাবিক প্রেরণাতেই আমরা তার সম্মান করে থাকি। এই টুপী ছাড়াও যদি তার গায়ে আবার সুন্নতি লম্বা কোর্তা ও পায়জামা থাকে; তেমন ব্যক্তি যদি অজ্ঞ মুর্খও হয়; তবুও নবী করিম (দঃ)-এর খাতিরে তার প্রতি আমাদের ভক্তি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায়। এরও উপর যদি তার মুখে দাঁড়ি থাকে তাহলে তেমন ব্যক্তিকে আমরা নবী করিম (দঃ)-এর সাক্ষাৎ নায়েবরূপেই ভক্তি শ্রদ্ধা করি এবং তা করা উচিতও। যাদেরকে আমরা এরূপ অকৃত্রিম ভক্তি ও শ্রদ্ধা করি; আমরা কি কখনো কল্পণাও করতে পারি যে তেমন লোক যা বলেন তা মিথ্যা বা ভুল হতে পারে? আবার ঐরূপ দশজন লোক যদি একই কথা একই রূপে বর্ণনা করেন; তখন আমাদের কারো সাধ্য হবে কি যে আমরা বলতে পারি; এই দশজন সাক্ষাৎ নবীর নায়েব যা বলছেন তা মিথ্যা বা ভুল বা কোরান-হাদিস-যুক্তির বাইরে কিছু বলছেন? এরূপ ক্ষেত্রে আমাদের ধারণা সাধারণতঃ এরূপঃ আমরা তো কোরান-হাদিস জানি না। সুতরাং আমাদের অন্তরের অকৃত্রিম ভক্তি ও শ্রদ্ধার পাত্র দশ জন যা বলছেন, তার কাছে আবার কোরাণ হাদিস কি! তাদের কথা ত সাক্ষাৎ আল্লাহরই কথা। সুতরাং তেমন ব্যক্তি কোন কিছু বললে, তা যতই যুক্তিহীন হোক না কেন তার প্রতিবাদ আমরা কিভাবে করতে পারি?
কিন্তু ইতিহাস বলে, রাছুল (দঃ)-এর কথাও যুক্তি বিরুদ্ধ হলে সাহাবীগণ বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইতেন, হুজুর! এটা কি আপনার কথা, না ওহী? যদি বলা হত, এটা আল্লহ্র কালাম-ওহী। তাহলে সাহাবীগণ আর কোন প্রতিবাদ করতেন না; অবনতশিরে তা মেনে নিতেন। কিন্তু যদি বলা হত, এটা আল্লাহ্র কালাম বা ওহী নয়; তখনই সাহাবীগণ নবী করিম (দঃ)-এর কথার উপর আপন আপন অভিমত ব্যক্ত করতেন।
আর আজ। ‘তিনারা’ কোন কথা বললে, তা যতই যুক্তিহীন হোক; যতই প্রকৃতি বা স্বভাব বিরুদ্ধ হোক, সে কথার প্রতিবাদ করার সাহস কি কারো আছে? নেই। ‘তিনাদের’ স্থান জনগণের কাছে আর রাছুল করিম (দঃ)-এরও অনেক উর্ধ্বে উঠে গেছে; অর্থাৎ ‘রবের’ পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেছে। এ বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে বুঝার জন্য এখানে একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিচিছঃ
হাতিম তাইয়ের পুত্র বর্ণনা করেছেন যে, আমি একদা রছুলুল্লাহ্ (দঃ)-এর নিকট উপস্থিত হলাম। আমার গলায় একটি সুবর্ণ ক্রস ঝুলছিল। রছুলুল্লাহ্ (দঃ) বললেন, ‘হে আদী, তুমি এই ঠাকুরকে তোমার দেহ থেকে বিদূরীত কর।’ অতঃপর তিনি পাঠ করলেন, “তারা তাদের উলেমা ও দরবেশদেরকে ‘রব’ হিসেবে ধরে নিয়েছে।” হাতিম তাইয়ের পুত্র বললেন, আমি আরজ করলাম, “হে আল্লাহ্র রছুল; আমরা তো তাদের এবাদত করি না।” রছুলুল্লাহ্ (দঃ) বললেন, “ তারা যখন তোমাদের জন্য হালাল ও হারামের নির্দেশ প্রদান করে তখন কি তোমরা তাদের সেই মৌখিক উক্তি বিনা প্রমাণে শিরোধার্য করে লও না?” আদী বললেন, “জ্বী হাঁ।” রছুলুল্লাহ্ (দঃ) বললেন, “ উহাই তাহা” – অর্থাৎ তারা যাকে হারাম করল তাকেই হারাম রূপে ধরে লওয়ার অর্থই হল উলেমা ও দরবেশদেরে “রব” ধরা। আল্লাহ্ ব্যতীত অপর কাউকে এরূপ “রব” ধরা হচেছ শেরেকীর অন্তর্ভুক্ত।
সুতরাং পবিত্র সুন্নতি লেবাছের আবরণে ‘তিনারা’ যখন ‘রবের’ স্থান দখল করেই নিয়েছেন, তখন তাদের মতের সাথে বা জ্ঞানের সাথে কারো মতের বা জ্ঞানের গড়মিল কেন হবে? গড়মিল হলেই বুঝতে হবে তা ‘রব’ বিরোধী, ‘রব’ বিরোধী হওয়া মানেই খোদাদ্রোহী, আর খোদাদ্রোহী হওয়া মানেই চির জাহান্নামী হওয়া। সুতরাং ‘রবদের’ কথার প্রতিবাদ করে চির জাহান্নামী হওয়ার ভয় কার না আছে? এই রবদের সম্মুখে তারা চুপ থাকবে নাতো কী? ‘রবেরা’ যখন বলেছেন অমুকে কাদিয়ানি, তখন সে কাদিয়ানি না হয়ে কি আর পারে? আর কাদিয়ানিরা যখন মুসলমান নয়, তখন সেও মুসলমান নয়। আর একজন অমুসলমান হয়ে কিভাবে আমাদের মসজিদে নামাজ পড়তে এল! ‘রবেরা’ যখন বলেছেন তার ভিতর কোন দূরভিসন্ধি আছে, কেননা ‘রবেরা’ তো আর মিথ্যা বলতে পারেন না, তখন ধর ব্যাটাকে ভাল করে শিক্ষা দিয়ে দেই।”
এই হল আমাদের ‘রবদের’ কীর্তি। এখন এই ‘রবদের’ বিরুদ্ধে আপনি যতই দলিল-প্রমাণ দেখান বা আপনি যতই সত্য কথা বলেন, তাদের ঈমানের জোশের তোরে আপনার দলিল-প্রমাণ সে মুহূর্তে কোথায় ভেস্তে যাবে! সঙ্গে সঙ্গে আপনার শিরটিও যে যাবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
এখানে পাঠকগণ হয়ত বলতে পারেন, আমার এই বর্ণনাটিতে একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে। আমি বলছি, তা মোটেও নয়। আপনাদের প্রতীতির জন্য তা হলে এখানে আরো একটি বর্ণনা দিচিছ। তা এই ঃ-
৪ এপ্রিল, শুক্রবার ১৯৮১ খ্রিঃ সন। জুম্মার নামাজ পড়তে যেয়ে একজন ইমাম সাহেবকে মসজিদের মিম্বরের উপর বসে বলতে শুনলাম। তিনি বিভিন্ন সুর করে বলতে লাগলেন, হযরত জোনায়েদ বোগদাদী (রঃ) আল্লাহ্র একজন জবরদস্ত আশেক ছিলেন। মৃত্যুর পর কবরে মুনকীর-নকীর ফেরেস্তাদ্বয় এসে তাঁকে প্রশ্ন করলেন; আপনার রব কে? হযরত জোনায়েদ বোগদাদী (রঃ) তাদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তোমরা কোত্থেকে এসেছ? এরূপ প্রশ্ন শুনে ফেরেস্তাদ্বয় তাজ্জব হয়ে থতমত খেয়ে যায়। প্রশ্নের উত্তর দিতে বিলম্ব হওয়ায় জোনায়েদ বোগদাদী (রঃ) তাদের একজনকে এমন জোরে চপেটাঘাত করলেন যে তাঁর চক্ষু খুলে মাটিতে পড়ে গেল। তখন তারা আল্লাহ্র কাছে হযরত জোনায়েদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। আল্লাহ্ তাদেরকে বললেন, জোনায়েদের ক্বলবে আল্লাহ্র প্রতি এশকের যে আগুন তার কণামাত্র যদি প্রকাশ করা হত তাহলে সারা দুনিয়া ভস্ম হয়ে যেত ইত্যাদি।
ঠিক এমনি ধরণের বর্ণনা লিখিতভাবে একটি কিতাবেও আছে এবং ওয়াজ মাহফিলেও শোনা যায়। তা হল হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) সম্বন্ধে। সে বর্ণানাটা একটু ভিন্ন ধরণের। কিন্তু প্রকৃতি একইরূপ।
মুখে পাকা দাড়ি; পরিধানে ঝল-মলে জুব্বা-কাবা; মাথায় পাগড়ী ও আরবী রুমাল। তিনি সুর করে বর্ণনা করে যাচ্ছেন আর শত শত লোক নির্বিকারভাবে শুনে যাচেছন। কেউ কেউ ‘ছোবহানাল্লাহ্’ ‘ছোবহানাল্লাহ্’ বলছেন।
পাঠকের আনেকেই হয়ত এরূপ বর্ণনা পূর্বেই শুনে থাকবেন এবং এর সত্যতায় কেউ কেউ বিশ্বাসও স্থাপন করে ফেলেছেন। ধর্ম সম্বন্ধে অধিক জ্ঞান না থাকলেও যারা একটু যুক্তি বুঝেন তাদের কাছে কি এর সত্যতা প্রমাণ করতে পারবেন?
প্রথমেই প্রশ্ন হবে; এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কে? মৃত্যুর পর কবরে কি হচেছ না হচেছ সে খবর তিনি পৃথিবীতে থেকেই কিভাবে পেলেন? নিশ্চয় তিনি ওহী মারফত এ ঘটনা জানতে পারেননি। যদি কিছু জেনে থাকেন, তা স্বপ্ন; কাশফ বা মোরাকাবার মাধ্যমেই জেনে থাকবেন। আর স্বপ্ন কাশ্ফ্ বা মোরাবাকায় দৃষ্ট-বিষয় কি কোন দলিলরূপে গৃহীত হতে পারে তা যদি আবার কোরাণ-হাদিস ও যুক্তি বিরোধী হয়? না তা কখনো হতে পারে না। বর্ণনাকারীর নাম-ধাম-পরিচয়; কোন্ সূত্রে প্রাপ্ত এসবের যখন কোন উল্লেখ নেই; তখন বিচারের প্রথম টেস্টেই আমরা এরূপ বর্ণনাকে নাকচ করে দিতে পারি। ধর্মের ব্যাপারে এরূপ প্রক্ষিপ্ত বর্ণনা ইসলামে বিষবৎ পরিত্যাজ্য। হাদিস সংগ্রহের বেলায় এরূপ বিচার-বিশ্লেষণের বিষয় সম্বন্ধে প্রত্যেকটি ইসলামের ছাত্রই খুব ভাল ভাবে পরিচিত। সে যাহোক, হযরত জোনায়েদ বোগদাদী (রঃ) সর্বজন স্বীকৃত একজন কামেল সিদ্ধ পুরুষ। তিনি আল্লাহ্র একজন বন্ধু ছিলেন। আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মুনকীর-নকীর ফেরেস্তাদ্বয় নূরের তৈরী এবং আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত কাজে নিয়োজিত। ফেরেস্তাদের নির্ধারিত কাজে কেউ বাঁধা দিতে পারে, এরূপ বিশ্বাস কি কোরান বিরোধী নয়? আল্লাহ্র একজন বন্ধু মানুষ আল্লাহ্র প্রেরিত ফেরেস্তাকে চপেটাঘাত করলেন কোন্ অপরাধে? জোনায়েদ বোগদাদী (রঃ) কি অন্তরে আল্লাহ্র এশ্ক লাভ করে খুব উদ্ধত অহংকারী ও বদ্ মেজাজী হয়ে পড়েছিলেন যে আল্লাহ্র দূতকে মারতে শুরু করে দিলেন? কয়েস মজনু তো লায়লীর প্রতি এশ্কে আত্মহারা হয়ে লায়লীর কুকুরকেই জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলেন। আর এখানে আল্লাহ্র একজন আশেক আল্লাহ্র প্রেরিত দূতকে চপেটাঘাত করে চক্ষু খুলে ফেলে দিলেন। মুনকীর-নকীর ফেরেস্তা কি আমাদের মত মাটির তৈরী দেহ নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন যে মাটির তৈরী একজন মানুষের চপেটাঘাতে তার চক্ষু খুলে পড়ে গেল?
বড় দুঃখ হয়, নবীর নায়েব বলে আখ্যায়িত, অথচ আল্লাহ্, রছুল; কবর, হাশর, ফেরেস্তা, ছওয়াল-জোয়াব মানে আধ্যাত্মিক জগত সম্বন্ধে যদি এদের কণা পরিমাণ সত্য ধারণাও থাকত! অথচ ‘বড় বুজুর্গ’ হিসেবে সকাল-সন্ধ্যায় সব সময়ই এদের কাছে লোকের ভীড় জমে থাকে।
হযরত বড়পীর (রঃ) সম্বন্ধে বলা হয়, মুনকীর-নকীর ফেরেস্তাাদ্বয় কবরে তাঁকে সালাম না করায় এবং মানব সৃষ্টিতে আল্লাহ্র ইচছার প্রতিবাদ করায় নাকি গোষ্ঠী শুদ্ধ সমস্ত ফেরেস্তাদের কাছ থেকে তওবা-নাকখত নিয়ে তবে ছাড়েন। এই বর্ণনার উৎসটিও কেউ বলতে পারে না। অথচ এ সমস্ত বর্ণনা দিয়েই ওয়াজ-নছিহত ও ছোয়াবের মাহ্ফিলগুলো গুলজার করে রাখা হয়। আল্লাহ্-ভক্তগণও এসব বর্ণনা শুনে জীবনকে সার্থক মনে করে। যাদের অছিলায় পূণ্যের খাতায় অসংখ্য ছোয়াব জমা হল তারা ‘রব’ না ত কি? রব না হলে তাদের কোরান-হাদিস যুক্তি বিরোধী বর্ণনার কি একটুও প্রতিবাদ হত না? অহরহ শুনতে শুনতে যে বিশ্বাস জনসাধারণের মনে একবার বদ্ধমুল হয়ে গেছে, সে বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আমি শত শত দলিল-প্রমাণ দিলেই কি সে বিশ্বাস থেকে তারা ফিরবে? বরং আমার বিরুদ্ধে তাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি হবে। তখন তারা বলবে, বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ ধরে যা শুনে আসছি, আর এত আলেম-বুজুর্গ থাকতে তারা কিছু বলছে না, আর আলেম নয়, সারা জীবন ইহুদী-নাছারাদের বই-পুস্তক পড়েই আজ এক নতুন কথা বলতে এসেছে! এরা আমাদের ধর্ম নষ্ট করার জন্যই ফন্দি-ফিকির করছে। তোমরা কেউ এদের কথা শোন না, বিশ্বাসও করো না। ব্যাস, তখন আমার সাধ্য কি যে আর একচুল এগুই!
সে যাহোক; এ বর্ণনা দুটিকে আমরা কোরানের আলোকেও খ-ন করতে পারি। যেমন ধরুন, হযরত বড়পীর (রঃ) সাহেব এবং জোনায়েদ বোগদাদী (রঃ) যখন ফেরেস্তাদের উপর বর্ণিতভাবে জুলুম করলেন, তখন তারা গিয়ে আল্লাহ্কে বললেন, “কেমন! আমরা বলেছিলাম না যে আদম সৃষ্টি করবেন না, তারা গিয়ে দুনিয়াতে ফেৎনা-ফাছাদ, রক্তা-রক্তি করবে? এবার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলেন ত? দুনিয়াতে ত এরা ঝগড়া-ফাছাদ, মারা-মারি, রক্তা-রক্তিতে লিপ্ত আছেই, আজ কবরে এসেও সেই ¯¦ভাব এরা ছাড়তে পারেনি। আমরা আপনারই হুকুমে আপনারই কাজে গিয়ে একজনের তো ঘাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল প্রায়! বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ গিয়ে তওবা-তিল্লা করে নাকে খত দিয়ে তবে ছাড়া পেয়েছে। আর একজনত চোখই হারিয়ে ফেলল। হে আমাদের রব! এবার হল ত? আমাদের অনুমান সত্য হল কি না? আপনি না বলেছিলেন, আপনি যা জানেন আমরা তা জানি না? এখন কার কথা ঠিক হলো? আর আপনি যদি জেনেই থাকবেন তা হলে আমাদেরে কেন তাদের কাছে পাঠালেন, যে জন্য আজ আপনার কাজ করতে যেয়ে বিনা দোষে আামদের কারো ঘাড় ভাঙ্গা যায়, কারো বা চোখ খোয়া যায়?”
এবার বলুন যে সব কাহিনী বর্ণনায় আল্লাহ্র এরূপ অসহায় অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তেমন বর্ণনা কি কখনো সত্য হতে পারে? না। আল্লাহ্ সম্বন্ধে এরূপ ধারণা থাকলে কি আমরা কখনো ঈমানদার হতে পারব? সুতরাং এসব বর্ণনা সম্পূর্ণরূপে খোদাদ্রোহীতা। আর মুসলমানদের মুখে এরূপ যুক্তি প্রমাণহীন বর্ণনা শুনেই যুক্তিবাদী ইহুদী-নাছারা ও নাস্তিকরা বুঝে নিয়েছে যে ইসলাম আজ অন্তঃসারশূণ্য। সুতরাং যত পার চাপাও। আর যারা এই সমস্ত কাহিনীগুলোকেই ইসলাম বলে বিশ্বাস করে নিয়েছে এবং এগুলোকে পূঁজি করেই ধর্মগুরু সেজেছেন তাদের প্রতি কি আল্লাহ্র কোন দয়া বা রহমত থাকতে পারে? আমাদের উপর আল্লাহ্র দয়া বা রহমত নেই বলেই কি আজ আমরা এমন দুর্দশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছি না? আমাদের খোদাদ্রোহীতা যেমন চরমে পৌঁছেছে। ঘরে-বাইরে আমাদের অপমান-লাঞ্ছনা; দুর্গতিও তেমনি চরমে পৌঁছেছে। আর তাদেরকে ‘রব’ হিসেবে ধরে না নিয়ে থাকলে তাদের কোরান বিরুদ্ধ কথা আমরা কিরূপে বিশ্বাস করতে পারি? ওলেমাদেরকে আমরা ‘রব’ হিসেবে ধরে নিয়েছি বলেই তাদের মুখে শুনতে শুনতেই কোরান-হাদিস বিরোধী অনেক বিষয়েই আমরা দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে রয়েছি। যেমন ধরুন, হযরত ইছা (আঃ)-এর পুনঃআগমনের প্রতি আমাদের বিশ্বাস।
আল্লাহ্-পাক কোরান শরীফে বলছেন, হযরত মোহাম্মদ (দঃ) খাতামুন্নবী অর্থাৎ তারপর সরাসরি কোন নবী নেই। অথচ আমরা বিশ্বাস করে বসে আছি যে হযরত ইছা নবী (আঃ) আবার আসবেন। হযরত ইছা নবী (আঃ) যদি এখন আসেন তাহলে তিনিই কি শেষ নবী হবেন না? এ অবস্থায় হযরত মোহাম্মদ (দঃ) কিরূপে শেষ নবী হবেন?
আল্লাহ্-পাক কোরান শরীফে বলছেন যে, নবীদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই এবং বিশ্বাসীদের চারটি শ্রেণীর মধ্যে সর্বোচ্চ শ্রেণী হল নবীদের অর্থাৎ কোন নবী উম্মতের মর্যাদায় নেমে আসতে পারেন না, আবার কোন উম্মতও নবীর মর্যাদায় উন্নীত হতে পারে না। অথচ আমরা বিশ্বাস করে বসে আছি যে ইছা (আঃ) খোশে নবীর পদ ছেড়ে দিয়ে উম্মতের পদে নেমে আসবেন। অর্থাৎ এক নবী আরেক নবীর উম্মত হবেন। এরূপ হলে কি নবীদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা হলোনা?
কোরান-পাকে আল্লাহ্ বলছেন, হযরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর পূর্ববর্তী নবীগণ মৃত্যুবরণ করেছেন; অথচ আমরা এখনও বিশ্বাস করছি হযরত ইছা (আঃ) দুই হাজার বছর পরও সশরীরে জীবিত আছেন। আমাদের এই অদ্ভুত বিশ্বাসের কারণ কি? কারণ মাত্র একটিই এবং তা হলো ওলেমাদেরকে আমরা যথার্থই ‘রবের’ পদে বসিয়েছি। কোন কোন স্থলে নবীর কথা বিশ্বাস করতে না পারলেও ‘রব শ্রেণী’ উলেমাদের কথা আমরা বিশ্বাস না করে পারি না।
এই ওলেমাবৃন্দ যতদিন পর্যন্ত সত্য ও সঠিক পথের নির্দেশ দেন ততদিন উম্মত সত্য ও সঠিক পথে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করতে পারে। কিন্তু যে মুহূর্ত থেকে এই উলেমাবৃন্দ সত্য ও সঠিক পথের নির্দেশ দিতে ভুল করে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই উম্মতের অধঃপতন শুরু হয়। অধঃপতনের চরম সীমায় পৌঁছলে মানুষের ‘রব’ অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে সঠিক পথের নির্দেশ দিয়ে পুনঃ এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন।
এ সম্বন্ধে আল্লাহ্-পাক বলছেন, অতঃপর আমার তরফ থেকে যখন কোন হেদায়েত তোমাদের কাছে পৌঁছবে, তখন আমার সেই হেদায়েতের অনুসরণ করবে যারা, কোন ভয় নেই তাদের, আর (কোন প্রকার) সন্তাপগ্রস্থও হবে না তারা। কিন্তু সে হেদায়েতকে অমান্য করবে যারা ও আমার আয়াতগুলোকে মিথ্যা বলে বেড়াবে যারা, তারাই হবে জাহান্নামের অধিবাসী, তাতে তারা হবে চিরস্থায়ী। (২ঃ৩৮-৩৯)
সুতরাং যতদিন না তথাকথিত আলেম-ওলেমাদেরকে ‘রবের’ স্থান থেকে অপসারণ করে এক রবের স্থান নিষ্কণ্টক করতে পারা যাবে ততদিন পর্যন্ত মানুষ কিছুতেই আল্লাহ্র কালামে উল্লিখিত হেদায়েত লাভ করতে পারবে না এবং তাদের জন্যই রয়েছে চিরস্থায়ী জাহান্নাম।
আল্লাহ্-পাক আমাদের সবাইকে তাঁর হেদায়েত নছিব করুন। আমিন! অ আখেরে দাওয়ানা আনেল হামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামিন।