পরম করুণাময় ও দয়াময় স্রষ্টার নামে
অবশ্যম্ভাবী মহাপ্লাবন ও তার তরী
(১)
(সকল প্রশংসা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র জন্যে এবং শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর মনোনীত ও নির্বাচিত সকল সংবাদ বাহকগণের উপর যাঁরা সমগ্র মানব জাতির পথ প্রদর্শক হিসেবে আশীর্বাদ স্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন; বিশেষভাবে আমার আধ্যাত্মিক নেতা হযরত বাবা মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ্ খানের উপর যাঁর প্রত্যক্ষ প্রেরণায় বক্ষমান সন্দর্ভটি লেখা সম্ভব হয়েছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তাঁকে দীর্ঘ জীবন দান করুন এবং সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করুন। আমিন!)
আমাদের মা ধরিত্রী যে সব বীভৎস চিত্র প্রদর্শন করছে তা দেখে দেখে ইতোমধ্যেই আমরা প্রায় সবাই মূর্ছারোগগ্রস্থ হয়ে পড়েছি। এর উপর আমাদের বিজ্ঞ চিন্তাবিদগণ অচিরেই আরো অধিক ভয়ঙ্কর বীভৎস চিত্রের মুখোমুখি হতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন। কিন্তু আমাদের হতভাগ্য পাঠকবৃন্দ! আপনারা কী উপলব্ধি করছেন? আপনারা কী উপলব্ধি করছেন তা আমি জানি না। কিন্তু আমি যা উপলব্ধি করছি তা হলো, আমরা সমগ্র পৃথিবীবাসী মানুষ সবাই একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির চূড়ায় বসে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করছি। আমরা প্রায় সবাই নূহ-এর সময়কার মহা প্লাবনের কথা শুনেছি। ঐরূপ আরেকটি মহা প্লাবন আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। এর আকৃতিটি আগেরটির মত নাও হতে পারে; কিন্তু এর ফলাফলটি হবে একই রূপ। এ আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণ অবশ্যই ঘটবে। কারণ এটা স্রষ্টার একটি পরিকল্পনা। (পাঠকদের কেউ কেউ হয়ত এ ধারণাকে অযৌক্তিক ভাবতে পারেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি অযৌক্তিক নয়। এ প্রবন্ধের দ্বিতীয় খ-ে আমি দেখিয়েছি যে এটা বর্তমান পৃথিবীর উপর সংঘটিত কর্মকা-ের একটি স্বাভাবিক পরিণতি)। একে প্রতিহত করার কোন উপায় আছে কি? না, আমাদের এমন কোন ক্ষমতা নেই যদ্বারা আমরা স্রষ্টার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করতে পারি। তবে আমরা নিজেদেরকে বাঁচাবার জন্যে চেষ্টা করে দেখতে পারি মাত্র। কি ভাবে? উদ্ধারকারী তরীতে আরোহণ করে। কিন্তু সে তরী আমরা কোথায় পাব? আপনারা যদি বিশ্বাস করতে পারেন তাহলে এ তরী আপনারা সর্বত্রই দেখতে পাবেন। আধুনিক জীবনের উদ্ধারকারী তরীটি হল বৈজ্ঞানিক ঐক্য। দয়া করে একে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সমার্থক ভাববেন না।
কেউ কেউ একে গুরুত্বহীন মনে করতে পারেন, কেউ একে হতাশাব্যঞ্জকও ভাবতে পারেন, আবার কেউ কেউ একে অতীত কালের নীতি বাক্যের আলাপচারিতাও মনে করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয় এটি (একতা) অর্জন করা মানুষের জন্য সবচাইতে কঠিন কাজ। আর যারা নিজেদেরকে শিক্ষিত, প-িত, বুদ্ধিজীবী মনে করেন এবং যারা টাকাওয়ালা, পদ ও মর্যাদার অধিকারী; এক কথায় যারা নিজেদেরকে “কেউকেটা” মনে করার মত সৌভাগ্যবান, তাদের পক্ষে একাজটি সম্পাদন করা মোটেও সম্ভব নয়।
দয়া করে আমাকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে দিন। মনে করুন, আপনারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন লোক কোন একটি জায়গায় অথবা কোন একটি আলোচনা সভায় কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে একত্রিত হলেন এবং সেখানে আপনারা আপনাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আপনারা কতখানি ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন তা একটি উদাহরণ দিলেই বুঝা যাবে। আমরা সবাই জানি যে, হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে গরু সংক্রান্ত একটি বিতর্ক বিদ্যমান। এক সম্প্রদায়ের কাছে গরুর মাংস উপাদেয় খাদ্য এবং অপর সম্প্রদায়ের কাছে গরু পূজনীয় বস্তু। তাই একজন মুসলমান, যিনি নিজেকে একজন প্রকৃত মুসলমান বলে মনে করেন তিনি অবশ্যই তার হিন্দু ভাইকে ঘৃণা করবেন। প্রকাশ্যভাবে ঘৃণা করতে না পারলেও কমপক্ষে অন্তরে অবশ্যই ঘৃণা পোষণ করবেন। একইরূপে মুসলমান ও খ্রীষ্টানদের মধ্যে, খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের মধ্যে এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান ঘৃণার উদাহরণ অতি সহজেই দেয়া যেতে পারে।
যখন আমাদের মনে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা বিদ্যমান তখন কিভাবে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি? তবুও কেউ কেউ যদি এরূপ কতক লোকের জটলাকে একতা বলে বিশ্বাস করেন তবে তা হবে সর্বৈব মিথ্যা, যার তুলনা হচ্ছে ক্যান্সারে আক্রান্ত রুগীর দেহে মলম লাগিয়ে নিরাময়ের চেষ্টা করা মাত্র। তবুও যদি বলেন যে আপনারা কিছু লোক কোন এক জায়গায় একত্রিত হয়েছেন কোন একটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে; সুতরাং সেখানে উদ্দেশ্যজনিত ঐক্য বর্তমান। আমি বলব, হ্যাঁ, আপনারা সেখানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন একটি স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। একটি উদাহরণের সাহায্যে এটি ব্যাখ্যা করছি। একদা এক হোটেল কক্ষে একজন যুবক ও একজন সুন্দরী বারবনিতা এক বিছানায় রাত্রি যাপন করল। রাতের অন্ধকারে তারা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। এক সময় মেয়েটি যুবকটিকে বলল, “আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমার দ্বারা পরিতৃপ্ত।” এবং সে যুবকটির প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করল। যুবকটি তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, “আমিও তোমাকে পেয়ে পরিতৃপ্ত এবং আমিও তোমাকে ভালবাসি।” তখন মেয়েটি বলল, “আমি সারা জীবনভর তোমাকে ভালবাসতে চাই এবং পরিতৃপ্ত করতে চাই একজন একান্ত সহধর্মিনী হিসেবে। দয়া করে আমাকে তোমার স্ত্রীরূপে গ্রহণ কর।” আমি নিশ্চিত, আপনারা সহজেই কল্পনা করতে পারছেন, মেয়েটির এ প্রস্তাবে যুবকটির প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। যুবকটি কি তাকে বিয়ে করবে? না। না, কেন? কারণ, যুবকটি ভাববে এতে তার সামাজিক অথবা ধর্মীয় সম্মান ক্ষুণœ হবে। যে মেয়েটিকে নিয়ে রাতের আঁধারে সে পরিতৃপ্ত, সেই একই মেয়ে দিনের আলোয় তার কাছে অবাঞ্ছিত। কেন? কারণ, সে স্বার্থপর। সে অশুভ শক্তির শিকার। যখন সে একজন বারবনিতার সাথে রাত্রি যাপন করে, এতে তার সামাজিক অথবা ধর্মীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্তÍ হয় বলে সে মনে করে না। কিন্তু যখনই একটি মেয়ে পাপের গহ্বর থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করার জন্য তাকে অনুরোধ করছে তখনই তার সামাজিক ও ধর্মীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্তÍ হবে বলে মনে করছে। এতে কি কেউ সত্যিই ক্ষতিগ্রস্তÍ হয়? চলুন, দেখি কে অথবা কি ক্ষতিগ্রস্তÍ হয়। পতিতাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করার অনেক ঘটনাই ঘটেছে। তাদের উপরে সমাজের আইন কতটুকু কার্যকর? ঐসমস্ত ব্যক্তি যদি ধনী ও মর্যাদাসম্পন্ন কেউ হন তবে সমাজ ও ধর্ম এ ব্যাপারে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে; অধিকন্তু তাদের প্রশংসা করা হয়; কারণ, সমাজ মনে করে মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু ঐ ব্যাক্তি যদি মর্যাদাহীন কেউ হয়, তবে তাকে সমাজে পতিত ঘোষণা করা হয়। তাহলে বর্তমান সমাজ, ধর্ম অথবা ব্যক্তির জন্য আইনগুলোর কার্যকারিতা কিরূপ? এর সব কিছুই শুধু স্বার্থপরতা। আমাকে মাফ্ করবেন! আমি বলছি না যে, আমরা সবাই কোন না কোন স্বার্থপর উদ্দেশ্যে এক জায়গায় একত্রিত হচ্ছি। বরং আমি প্রার্থনা করছি, প্রভু আমাদের সবাইকে আমাদের লক্ষ্য সম্পর্কে আন্তরিক ও সৎ হওয়ার জন্যে সাহায্য করুন! অধিকন্তু আমি কোন সমাজ, ধর্ম বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনরূপ ঘৃণা বা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। কিন্তু আমি চাচ্ছি, আমাদের রোগের যথার্থ কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা করতে, যাতে এ রোগের যথার্থ চিকিৎসা হয়।
এখানে আমি আরেকটি উদাহরণ দিতে চাই। একদা দু’ সম্প্রদায়ের দু’ ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বন্ধু কোন এক ক্লাবে একই টেবিলে বসে রাতের খাবার খেলেন, তারা একত্রে নেচে, গেয়ে মদ্য পান করে সুন্দরীদের নিয়ে রাতটি খুব ভালভাবে উপভোগ করলেন; খুব আন্তরিকভাবে নিজেদের আনন্দ, বেদনা এবং ব্যবসায়ের বিভিন্ন কলা-কৌশল নিয়ে পরস্পর ভাব বিনিময় করলেন। জাগতিক ব্যাপারে তারা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যখন তাদের একজন বললেন, “প্রিয় বন্ধু! আসুন, আমরা পরস্পর সত্যিকারের ভাই হয়ে যাই। আসুন, আমরা নিজেদের ধর্মীয় বিভেদের পোষাক ছিড়ে ফেলি এবং একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে যাই।” অন্য বন্ধুটি কি এ প্রস্তাবে সাড়া দিতে এগিয়ে আসবেন? না। কেন? বাহ্যতঃ তিনি তার সমাজ, সম্প্রদায় এবং নিকট আত্মীয়-স্বজনদের ভয় করছেন। যদিও সব ক্ষেত্রেই সমাজ অথবা ধর্মীয় আইন লঙ্ঘনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। সমাজ ও ধর্মের যারা রক্ষাকর্তা তারা নিজেরাই এসব আইন লঙ্ঘন করছেন। এমতাবস্থায় এরূপ বিশ্বাস করার কোন কারণ আছে কি যে তিনি তার সামাজিক ও ধর্মীয় আইনকে খুব ভয় পাচ্ছেন? প্রকৃতপক্ষে তিনি ভয় পাচ্ছেন তার ব্যক্তিস্বার্থকেই। কি সে স্বার্থ? আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, একজন ব্যক্তি সে নিজেকে ‘কিছু একটা’ মনে করছে। এটি নিজেকে সেই ‘কিছু একটা’ মনে করার স্বার্থ। একজন মুসলমান হিসেবে আমি নিজেকে একজন খ্রীষ্টান, হিন্দু অথবা ইহুদীর চাইতে উঁচু মনে করি। একজন খ্রীষ্টানও নিজেকে একজন ইহুদীর চেয়ে উঁচু মনে করে। একজন বৌদ্ধও নিজেকে একজন হিন্দুর চেয়ে উচু মনে করে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বেলায়ও ঠিক একই রূপ বিশ্বাস। প্রতিটি ধর্ম সম্প্রদায়ই আবার বহু দল ও উপ-দলে বিভক্ত। প্রতিটি দল উপ-দলই অন্যদের তুলনায় নিজেকে ‘কিছু একটা’ ‘শ্রেয়তর’ মনে করে। এমনকি একই গোত্রের অন্তর্ভূক্ত হয়েও এক এক ব্যক্তি তার শিক্ষা, সম্পদ, সম্মান ইত্যাদির বিচারে নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবে। এমনকি শ্রমিক শ্রেণী, বারবনিতা অথবা ভিক্ষুকদের মধ্যেও অন্যদের থেকে নিজেকে ‘কিছু একটা’ শ্রেয়তর মনে করার প্রবণতাই কার্যকর। আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেয় মনে করি তাহলে আমি কিভাবে নিজেকে অন্যদের মতই সমান এবং নিজেদেরকে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ ভাবতে পারব? পাঠকবৃন্দ! আপনারা কি ‘আমি শ্রেষ্ঠ’ এরূপ ধারণার উর্ধ্বে? আপনি কি শিক্ষা-দীক্ষা অন্য যে কোনভাবে নিজেকে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করছেন না? আমরা যতই মহৎ হই না কেন আমরা যদি নিজেদেরকে ‘কিছু একটা’ মনে করার প্রবৃত্তি ত্যাগ করতে না পারি, তাহলে আমরা নিজেদের যতই মহানুভব ভাবিনা কেন সংগ্রাম মুহূর্তে আমাদের পবিত্র অঙ্গীকারসমূহ সমুন্নত রাখতে অবশ্যই ব্যর্থ হব। ‘যুদ্ধ নয় চুক্তি’, ‘অনাক্রমন চুক্তি’, মৈত্রী চুক্তি’ প্রভৃতি নামে বহু চুক্তি অতীতে হয়েছে। কিন্তু প্রতিক্ষেত্রে সেগুলো আবার লঙ্ঘিতও হয়েছে। এর কারণ হলো যখনই আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক অথবা জাতীয়-যে কোন স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্তÍ হচ্ছে বলে মনে করি, তখনই আমরা পবিত্র অঙ্গীকার সমূহকে সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ হই।
এখানে আমি বৈজ্ঞানিক ঐক্যের একটি উদাহরণ দিচ্ছি। মনে করুন, অনেকগুলো লোহার আংটা একত্রিত করা হলো। এটিও এক ধরণের ঐক্য। কিন্তু লোহার এ আংটাগুলোকে একত্রিত করে কী ধরণের উপকার পাওয়া যাবে? কোন উপকারই পাওয়া যাবে না। কিন্তু লোহার আংটাগুলোকে যদি একটির ভিতরে আরেকটি গাঁথা হয়, তাহলে এগুলো একটি শক্তিশালী শিকলে পরিণত হবে। এ শিকল বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যাবে। এমনকি আমরা একটি বন্য হাতি অথবা একটি জাহাজকেও এ শিকলের সাহায্যে বেঁধে রাখতে পারি। কিন্তু এর এক প্রান্ত অবশ্যই বাঁধা থাকতে হবে অন্য কোন শক্ত গাছ অথবা শক্তিশালী খুঁটির সাথে। তা না হলে ঐ বন্য হাতি অথবা জাহাজটি শিকলটিকেই টেনে নিয়ে চলে যাবে। তাই, আমরা যদি বৈজ্ঞানিক ঐক্য চাই তবে অবশ্যই আমাদেরকে ঐ লোহার রিংগুলোর মত একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে। যখন আমাদের মধ্যে ঐরূপ ঐক্য হবে তখন আমাদের পক্ষে একটি পাহাড়কেও স্থানান্তরিত করা সম্ভব হবে। কিভাবে ঐ ঐক্য অর্জন করা সম্ভব? এর জন্য প্রয়োজন ‘আমি কিছু একটা’ অর্থাৎ অহমকে বিসর্জন দেয়া। সমষ্টির মাঝে ব্যষ্টিকে বিসর্জন দিয়ে একই বিশ্বাসের উপর ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
একই উদ্দেশ্যে সমস্ত মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া কি সম্ভব? আমরা কোটি কোটি মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করছি। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন হতে পারে যে, এত সব মানুষের উদ্দেশ্য এক হবে কিভাবে? আমি এর ব্যাখ্যা দিচ্ছি। আমার ব্যাখ্যা এও প্রমাণ করবে যে, সমগ্র জগত একই স্রষ্টার সৃষ্টি এবং তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তিনি এক মহা পরিকল্পনা নিয়েই মানুষ সৃষ্টি করেছেন। কী সে পরিকল্পনা? তাঁর পরিকল্পনা হল পৃথিবীতে মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে একটি শান্তি-পূর্ণ পরিবেশে জীবন যাপন করবে এবং একই সাথে মৃত্যুর পরে মুক্তিও পাবে। এ উদ্দেশ্যেই তিনি জীবন যাপনের জন্য আমাদের একটি বিধান দিয়েছেন। তাই হলো ধর্ম। ঠিক যেমন একজন ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক সঠিকভাবে ইঞ্জিন পরিচালনার জন্যে একটি নির্দেশিকা দিয়ে থাকেন। অতএব আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হলো এ পৃথিবীতে শান্তিতে জীবন যাপন করা এবং মৃত্যুর পর মুক্তি লাভ করা। এমন কোন ব্যক্তি আছেন কি যিনি আমার সাথে এব্যাপারে একমত নন? আমার বৌদ্ধ ভাইয়েরা, এটাই কি আপনাদের ‘নির্বাণ’ লাভের অর্থ নয়? আমার হিন্দু ভাইয়েরা, আপনারা কি এখানে আপনাদের পুনরুজ্জীবনের তত্ত্ব পাচ্ছেন না? মৃত্যুর পরে আমরা যে আকারই ধারণ করি না কেন, আমরা সবাই মুক্তি চাই। পাঠকদের মধ্যে কেউ কি এর বিরোধিতা করবেন? আমার মনে হয়, আপনারা কেউ এর বিরোধিতা করবেন না। তাহলে, আমাদের সবারই লক্ষ্য একটিই; অন্ততঃ একটি বিষয়ে আমরা ঐকমত্য হতে পারলাম ত? আর সে লক্ষ্য হলো, আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা এমনভাবে নির্বাহ করব যাতে এ পৃথিবীতে শান্তি পাওয়া যায় এবং মৃত্যুর পর মুক্তিও পাওয়া যায়। আমাদের এও মনে রাখতে হবে যে, মৃত্যুপরবর্তী জীবনকে বাদ দিয়ে শুধু পার্থিব জীবনের শান্তি অর্জন আমাদের উদ্দেশ্য নয়, তেমনি এ পৃথিবীর সব সম্পর্ক পরিত্যাগ করে শুধুমাত্র মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে মুক্তি লাভও আমাদের কাম্য নয়। আমরা শান্তি ও মুক্তি দুটোই চাই। তাহলে এটা এখন স্বীকৃত বিষয় যে, সমস্ত মানব জাতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এক এবং অভিন্ন, এতে কোন দ্বিমত নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রতিটি ধর্মেরই নিজস্ব বিধি-বিধান রয়েছে। আমরা যদি প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলি তবে প্রাত্যহিক জীবনে দ্বন্দ্ব দেখা দিবে, যদিও আমাদের সকলেরই লক্ষ্য এক। তাহলে আমাদের জীবন যাপন প্রণালী কেমন হবে? কোন্টি আমরা অনুসরণ করব?
পরবর্তী আলোচ্য বিষয় হলো, একই বিশ্বাসের উপর আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বর্তমান বিশ্বে অনেক ধর্ম বিদ্যমান যাদের প্রচুর সংখ্যক অনুসারীও রয়েছে। তাহলে চলুন, দেখি, কিভাবে সবাইকে নিয়ে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব।
পাঠকবৃন্দ! আমি আবারো আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। কারণ, আমি এমন একটি ধারায় ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করতে যাচ্ছি এতে আপনারা সামান্য হলেও মর্মাহত হতে পারেন। একজন রুগীকে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করতে চাইলে একজন ডাক্তারকে যেমন একটু কঠোর হতে হয়, তেমনি ডাক্তারের এ অপরাধ সব সময় না চাইতেই ক্ষমা করেও দেয়া হয়। যদিও আমি ধর্মের একজন ডাক্তার হওয়ার ভান করছি না, তবুও আমার কোন ভাই যদি এ আলোচনা থেকে আঘাত পেয়ে থাকেন, আমি আশা করব, আমার অপরাধও ক্ষমা করা হবে। তবে কয়েকটি বিশ্ব ধর্মের উপর আমার আলোচনা হবে বিশ্লেষণমূলক। অবশ্যই তা হবে সহনশীল।
এখন আমি আলোচনা করব সত্য ধর্ম কী। আমি ইতোমধ্যেই উল্লেখ করেছি যে ধর্ম হল জীবন নির্বাহ করার বিধানাবলী যা স্রষ্টা কর্তৃক মানুষকে প্রদান করা হয়েছে যদ্বারা আমরা আমাদের জীবন এমনভাবে পরিচালিত করতে পারি যাতে আমরা পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করতে পারি এবং পরকালেও মুক্তি পেতে পারি। আমি ধর্মকে একটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে চাই যাতে সহজেই তা আমাদের মননে ধরা দেয়, আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করে আমাদের দেহ ও মনকে মোহাবিষ্ট করে এবং সর্বোপরি আমরা যেন চিৎকার করে বলতে পারি, “এ-ই ধর্ম! এ-ই সত্য”।
আমরা অনেক রকম প্রেম-উপাখ্যান শুনেছি। পারস্য ভাষায় লাইলি-মজনু, শিরী-ফরহাদ, ইউসুফ-জুলেখার প্রেম-উপাখ্যান আছে। যাহোক, পাঠকবৃন্দ! আপনাদের মধ্যে কেউ কি যৌবনে কখনো গভীর প্রেমে পড়েছেন? আমাদের মধ্যে যদি কারো এমন কোন প্রেমের অভিজ্ঞতা থেকে থাকে তাহলে আমি কী বলতে চাচ্ছি তার পক্ষে তা উপলব্ধি করা সহজ হবে। যে সব ব্যক্তি তাদের বল, শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন, যারা দুর্বল, নিস্তেজ, চেতনাহীন, পুরুষত্বহীন এবং বিভিন্ন ধরণের বার্দ্ধক্য রোগে ভুগছেন, যেকোন ধরণের তেজস্কর পানীয়ই তাদেরকে দেয়া হোক না কেন তারা কোন উদ্দীপনাই পাবেন না। কুমারী মেয়ের কোন সৌন্দর্যই তাদের আসক্তি বৃদ্ধি করতে পারবে না। সুতরাং আমি চাই আমার তরুণ ভাইদের, আমাদের তরুণ প্রজন্ম যাদের উপর ভবিষ্যৎ বিশ্ব-সভ্যতা নির্ভর করছে। তোমরা যতই অধঃপতিত হও না কেন, তোমরা আস, শোন এবং দেখ, তোমাদের প্রিয়তম স্রষ্টা তোমাদেরকে কী বলতে চাচ্ছেন এবং তোমাদের রূপবান স্রষ্টা তোমাদের কী রূপ দেখাতে চাচ্ছেন।
মনে করুন, একজন যুবক বহুদিন অপেক্ষার পর তার সুন্দরী যৌবনবতী প্রিয়তমার কাছ থেকে একটি প্রেমপত্র পেল। আমরা কি তার এ আনন্দের সীমা নির্ণয় করতে পারি? সে এ প্রেমপত্রটি নিয়ে কী করবে? সে ওই পত্রটিকে এমনভাবে চুমু খেতে থাকবে যেন ঐ পত্রটিই তার প্রিয়তমা। সে ওই পত্রখানা তার কপালে, চোখে, চিবুকে ছোঁয়াবে এবং বুকের সাথে চেপে ধরবে। সে চিঠির প্রতিটি শব্দ ধীর লয়ে গভীর মনোযোগের সাথে পড়তে থাকবে এবং প্রতিটি শব্দ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকবে, কত রকমের অর্থ হতে পারে তা বের করার চেষ্টা করবে। যতক্ষণ সে চিঠিটি পড়তে থাকবে তার প্রিয়তমার ছবিগুলো জীবন্তরূপ নিয়ে তার চোখের সামনে ভাসতে থাকবে। প্রতিটি মুহূর্তে প্রিয়তমার বিভিন্ন সৌন্দর্যচ্ছটা জীবন্ত হয়ে তার মানসপটে প্রতিবিম্বিত হতে থাকবে। কখনো সে দেখবে মেয়েটির কালো চোখের সৌন্দর্য, কখনো দেখবে তার রংধনুর মত ভ্রুদ্বয়ের মোহনীয় রূপ, কখনো দেখবে মুক্তার মত দাঁতের ঝলকানী, আবার কখনো দেখবে দীঘল কালো চুলের সৌন্দর্য। তার এই গভীর ভাবনার ফাঁকে কখনো কখনো সে বিস্ময়ে বলে উঠবে, “কত বড় কালো তোমার চোখ! কত নরম তোমার লাল চিবুক! কত আকর্ষণীয় তোমার পেলব ঠোঁট! কত সুন্দর তোমার বক্ষ! কি মিষ্টি তোমার হাসি! আমি তোমায় ভালবাসি প্রিয়তমা! আমি তোমাকে ভালবাসি! তুমি আমার ভালবাসা! তুমি আমার হৃদয়, তুমি আমার অন্তর! তোমাকে ভাবতে কত যে আনন্দ কত যে সুখ! ওগো আমার প্রেমিকা, ওগো আমার ভালবাসা।” এভাবে ভাবতে ভাবতে এক পর্যায়ে সে বাকরোধ হয়ে পড়বে। সে নিজেকেই ভুলে যাবে। সে ভুলে যাবে তার খাওয়া, ভুলে যাবে তার নাওয়া, ভুলে যাবে তার পোষাকের কথা, ভুলে যাবে তার দেহের সমস্ত চাহিদা। কিন্তু তার প্রেমিকার রূপের কথা মনে পড়তেই সে প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। বিরামহীনভাবে সে তার প্রেমিকার রূপের প্রশংসা করতে থাকবে, অবিরামভাবে সে তার প্রেমিকার রূপের কথা বর্ণনা করতে থাকবে। কখনো কখনো সে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে ছুটে যাবে তার প্রেমিকার রূপের কথা শুনাতে। এক কথায় বলতে গেলে, যখনই সে কিছু দেখে, সে তার প্রেমিকার রূপই দেখে, যখন সে কিছু বলে সে শুধু তার প্রেমিকার রূপের কথাই বলে, যখন সে শোনে শুধুই তার প্রেমিকার মধুর সঙ্গীতের সুরই শোনে। যখন সে হাটে, তার প্রেমিকার পথেই হাটে; যখন সে নিঃশ্বাস নেয় সে তার প্রেমিকার নামই নেয়; যখন সে ঘুমায় তখন সে শুধু তার প্রেমিকার রূপই স্বপ্ন দেখে এবং যখন সে কোন কাজ করে সে তার প্রেমিকার নির্দেশেই করে থাকে। অর্থাৎ তার সব কিছুই তার প্রেমিকার সব কিছু।
একই ভাবে, প্রভু দয়া করে যাকে তাঁর রূপ দেখান এবং তাঁর পথে মানুষদেরকে ডাকার জন্য আদেশ দিয়ে থাকেন, তিনি তখন আর অলসভাবে বসে থাকতে পারেন না। তিনি অচেতন হয়ে থাকতে পারেন না। তিনি বুঝতে পারেন সমগ্র মানবজাতির দায়িত্ব তার কাঁধে ন্যস্ত। তিনি আপনাকে ভুলে যান। যাকে যখন যেভাবে পান তাকেই তিনি তার প্রভুর কথা বলেন, যখনই সুযোগ পান প্রভুর বার্তা ঘোষণা করেন। তিনি অনুভব করেন, তার হাতে যদি কোন উপায় থাকত, তাহলে সকল মানুষের নিকট তার প্রভুর রূপের প্রশংসা শোনাবার জন্যে আকাশ-পাতাল আন্দোলিত করতেন। তারপরও তার কোন বিশ্রামের প্রয়োজন হত না। তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ঐ কাজ করে যেতেন। তার অবস্থা ঠিক ঐ যুবকটিরই মত যার কথা আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি। অর্থাৎ স্রষ্টা যাকে তার সত্য প্রদান করেন তার এমন অবস্থা হয় যে সে যখন কিছু দেখে সে তার প্রভুর সৌন্দর্যই দেখে; সে যখন কিছু বলে তখন সে তার প্রভুর সৌন্দর্যের কথাই বলে; যখন সে কিছু শোনে সে তার প্রভুর সুরেলা আহ্বান ধ্বনিই শোনে; যখন সে চলে তখন সে তার প্রভুর পথেই চলে; যখন সে দম নেয় তখন সে তার প্রভুর নামই জপে; যখন সে ঘুমায় তখন সে তার প্রভুর সৌন্দর্যই স্বপ্ন দেখে; যখন সে কাজ করে তখন সে তার প্রভুর আদেশই কার্যকর করে। অর্থাৎ তার গতি-বিধিই তার প্রভুর গতি-বিধি। ইনিই তিনি যার মাধ্যমে প্রভু পৃথিবীতে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রভুর কাছ থেকে তার যুগের মানুষদের সুপথে পরিচালিত করার জন্য যে বিধি-বিধান পান তা-ই হল জীবন বিধান, একেই বলা হয় ধর্ম। কিন্তু সব চেয়ে দুঃখের বিষয় তার সময়কালে মানুষের কাছে তিনি খুব সহজে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারেন না; উপরন্তু তারা তার পথের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং তার উপর অমানবিক অত্যাচার, জুলুম ও নির্যাতন চালায়। কিন্তু সময়ের আবর্তনে মহান প্রভুর দয়ায় যখন সত্য প্রচ-ভাবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন মানুষ তাদের স্বজ্ঞানে ফিরে আসে, তারা তার নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং সত্যকে গ্রহণ করে। অবশেষে পৃথিবীর উপর সত্যের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমার হিন্দু ভাইয়েরা! আর্য সভ্যতা প্রতিষ্ঠাকারী! ধর্ম প্রচারের জন্য আজ আপনাদের সে লোকজন কোথায়? তারা কি পরম ব্রহ্মার সৌন্দর্যের কথা প্রচারের জন্য মানুষদের ডাকছেন? না। ব্রহ্মার বাণীপূর্ণ বেদ থেকে এখন আর আপনারা কোন আলো পাচ্ছেন না। জগদ্বাসী মানুষদের আলোকিত করার জন্য বেদকে যথেষ্ট বলে আপনারা আর মনে করছেন না। আর তাই আপনারাও ‘অচ্ছুত’ মানবগোষ্ঠীকে সঠিক পথ দেখাতে এগিয়ে আসতে পারছেন না। আপনারা কোন মুসলিম সম্প্রদায় অথবা খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে আপনাদের ব্রহ্মার সৌন্দর্য বর্ণনা করতে পারছেন না। কারণ, আপনারা নিজেরাই ব্রহ্মার সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছেন না। তাই ব্রহ্মা সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলার নেই। তাই আপনারা অন্যের কাছে যেতে পারছেন না। প্রকৃতপক্ষে, আপনারা হারিয়ে ফেলেছেন আপনাদের অন্তর্দৃষ্টি, স্পৃহা, উদ্দম, বলিষ্ঠতা, মনোবল এবং সর্বোপরি ধর্মীয় প্রেরণা। বর্তমানে আপনারা পরিপূর্ণ স্থবিরতায় ভুগছেন। কখনো কি ভেবে দেখেছেন যে ব্রহ্মা পাঁচ হাজার বছর আগে আপনাদের জন্য বার্তা প্রেরণ করেছিলেন, তিনি এখন কেন তা করছেন না? ব্রহ্মাও কি আপনাদের মত স্থবির হয়ে পড়েছেন? না। বরং আপনারাই ব্রহ্মাকে পুরোপুরি অন্ধ, বোবা এবং স্থবির করে রেখেছেন। তাই আমার হিন্দু ভাইয়েরা! যে ব্রহ্মাকে আপনারা নিজেদের বিশ্বাস দ্বারা মৃত বানিয়ে রেখেছেন, তাঁর থেকে আপনারা আর কখনও কোন আলো পেতে পারবেন না। আপনাদের সামনে এখন একটিই উপায় আছে, তা হলো আপনাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে, আপনাদের ব্রহ্মা এখনও জীবিত আছেন এবং আপনাদের প্রার্থনা তিনি এখনও শুনতে পান এবং ব্রহ্মা আপনাদের এই বলে আশ্বস্ত করছেন যে তিনি আপনাদের চরম দুর্দশার সময় আপনাদের সাহায্য করবেন। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি দাবী করেন যে, ব্রহ্মা তার সাথে কথা বলছেন এবং বর্তমান পৃথিবীর অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় তাকে জানিয়েছেন, তবে আমি হব তার সর্বপ্রথম আনুগত্য স্বীকারকারী।
আমার বৌদ্ধ ভাইয়েরা! আমার ধারণা মতে আপনারা সব চাইতে সংশয়বাদী লোক। আপনারা সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারে নির্বাক। কেন? কারণ, আপনারা সন্দেহের মধ্যে পড়েছেন। আপনারা কখনো জোর দিয়ে বলছেন না যে, সৃষ্টিকর্তা একজন আছেন। কারণ, আপনারা ভয় পাচ্ছেন এই ভেবে যে, সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ অস্তিত্ববান নাও থাকতে পারে। আবার তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকারও করছেন না এই ভেবে যে, সৃষ্টিকর্তা বলে কারো অস্তিত্ব থাকতেও পারে। আপনারা পূর্বে কিরূপ ছিলেন কিংবা ভবিষ্যতে কি হবেন তাও বলতে পারছেন না। আপনারা এও বলতে পারছেন না যে, বর্তমানে আপনারা কি আছেন। আপনারা সংশয়ের মধ্যে রয়েছেন যে, আদৌ আপনারা মানুষ, না মানুষরূপী কোন জানোয়ার। আপনারা অস্পষ্ট কিছু ধারণার উপর ভিত্তি করে আপনাদের জীবন নির্বাহ করছেন। আমার উপরের বর্ণনা যদি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে আপনারা আমাকে বলুন আপনারা কিভাবে মানুষ হলেন? সৃষ্টিকর্তা এবং ধর্ম এ দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয়। সৃষ্টিকর্তা যদি না থাকে, তাহলে ধর্মও নেই। তার মানে আপনাদের কোন সৃষ্টিকর্তা নেই; সুতরাং আপনাদের কোন ধর্মও নেই। আবার, যেখানে সৃষ্টিকর্তা থাকবেন সেখানে তাঁর সৃষ্টিও থাকতে হবে। তাহলে বলুন, আপনারা কী এবং কোথা থেকে এসেছেন? কিসের অভাবে আপনাদের দেহ মৃতদেহে পরিণত হয়? একে আপনারা কি জীবন বলবেন? জীবন বলতে কী বুঝেন এবং আপনি কোনটি? আপনার দেহটি আপনি, না আপনার জীবনটি আপনি? যদি আপনার দেহটি আপনি হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি মৃত্যু বরণ করেন কেন? পক্ষান্তরে, যদি আপনার জীবনটিই আপনি হয়ে থাকেন, তাহলে, বলুন, আপনি কেন দেহ ত্যাগ করেন এবং দেহ ত্যাগ করে কোথায় যাবেন? যদি আপনারা বলেন যে, আপনারা নিজের ইচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন না; তাহলে বলুন, কার ইচ্ছায় তা ঘটে? যদি বলেন যে, এর উত্তর আপনারা জানেন না তাহলে আপনাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে, আপনারা এ ব্যাপারে অনবহিত এবং আপনাদের উচিত হবে না ধর্ম নিয়ে কোন কথা বলা। এখনো আপনাদের ধর্ম বিষয়ে অনেক কিছু শিখার আছে। আবার যদি বলেন যে, কার ইচ্ছায় আপনাদের মৃত্যু ঘটে তা আপনারা জানেন না এবং কার ইচ্ছায় আপনারা মরেন তা কেউই জানে না; তবে বলতেই হবে যে, আপনারা অবশ্যই দ্বিগুণ মূর্খ। এখন আপনাদের বেত্রাঘাত করা উচিত; কারণ আপনারা অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন এবং অহিংসার নীতি লঙ্ঘন করেছেন। উপরন্তু যদি বলেন যে, আপনাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, মৃত্যু প্রাকৃতিক; সুতরাং প্রাকৃতিক নিয়মেই আপনারা মৃত্যু বরণ করেন। তাহলে আমার প্রশ্ন যখন আপনি জানতে পারলেন যে, মৃত্যুও প্রাকৃতিক; তাহলে আপনি জন্মগ্রহণ করলেন কেন? যদি বলেন যে, আপনার জন্মটাও প্রাকৃতিক; তাহলে আমি বলব, “আপনার জীবন কি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল?” যার অর্থ, প্রকৃতিই হচ্ছে আপনার সৃষ্টিকর্তা। যদি আপনি বলেন ‘না’, তাহলে আপনি বলুন, সেটি কোন ক্ষমতা যার ফলে প্রকৃতিকে মেনে চলে আপনি জন্মগ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন? যদি আপনি বলেন ‘হ্যাঁ’, প্রকৃতিই আপনার সৃষ্টিকর্তা; তাহলে আপনারা সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারে নিশ্চুপ কেন এবং প্রকৃতিকে আপনাদের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে স্বীকার করছেন না কেন? অতএব, সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারে আপনারা যতই নিশ্চুপ থাকুন না কেন, আপনারা আপনাদের অজ্ঞতাকেই স্বীকৃতি দিচ্ছেন। একজন অজ্ঞ ব্যক্তি কখনো কোন আলো প্রাপ্তির দাবী করতে পারে না। এখনও যদি আপনারা আলোর দাবী করে থাকেন তবে কেন আপনারা এ আলো দ্বারা অন্যদের আলোকিত করছেন না?
ইহুদি ভাইয়েরা আমার! আপনারা অনেক নবী-রাসুল এবং আসমানী কিতাবের উত্তরাধিকারী। জেকব থেকে শুরু করে ব্যাপ্টিষ্ট জন পর্যন্ত কতজন নবী-রাছুল আপনারা পেয়েছেন? ব্যাপ্টিষ্ট জনের তিরোধানের পর আপনাদের প্রভুর পরিকল্পনা কী? প্রভু কেন আপনাদের জন্য এত নবী-রাছুল প্রেরণ করেছিলেন এবং কেনইবা ব্যাপ্টিষ্ট জনের পর তা বন্ধ করে দিলেন? পৃথিবীর বর্তমান অশান্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য আমাদের প্রভুর কাছ থেকে আর কাউকে কি আমাদের দরকার নেই? আমরা দেখছি যে, আপনারা আপনাদের সম্পদ ও ক্ষমতার দম্ভে স্ফীত হয়ে আছেন। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না যে পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ মানুষ ধ্বংসের কিনারায় পড়ে গোঙ্গাচ্ছে। কিন্তু আপনারা দেখছেন আপনাদের প্রভু আপনাদের প্রতি খুবই সদয়, তাই তিনি আপনাদের প্রচুর সম্পদ ও ক্ষমতা দান করেছেন। তাই আপনারা কাউকে গ্রাহ্যই করছেন না। কিন্তু আপনারা কি কখনও ভেবে দেখেছেন, আপনারা কাদের অভিভাবকত্বাধীনে রয়েছেন? আপনারা কি একজন ‘জারজের’ অনুসারীদের অভিভাবকত্বাধীন নন? এটা কি আপনাদের অকৃতজ্ঞতা নয় যে আপনারা আপনাদেরই রক্ষাকর্তাদের প্রভু এবং ত্রাণকর্তাকে ‘জারজ সন্তান’ বলে অভিহিত করছেন? “আমরা নয়, বরং আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এরূপ বলত,” আপনারা যদি এরূপই বলতে চান, তাহলে আপনারা বলুন, আপনারা এখন তাকে কী হিসেবে বিবেচনা করছেন? তিনি কি একজন প্রেরিত দূত ছিলেন? যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন তাহলে আপনারা কেন যীশুখ্রীষ্টের ধর্ম গ্রহণ করছেন না? যদি আপনারা বলেন যে, তিনি প্রেরিত দূত ব্যতীত অন্য কিছু ছিলেন, তাহলে আমার প্রশ্নঃ যীশুখ্রীষ্ট নিজে যেখানে আপনাকে প্রভুর লোক হিসেবে দাবী করেছেন, সেক্ষেত্রে আপনারা এমন কে যে এর ব্যতিক্রম কিছু বলবেন? অন্যদিকে যখন আপনারা নিজেদেরকে আলোক প্রাপ্ত জাতি হিসেবেই বিবেচনা করে থাকেন, তাহলে অপরদের কেন আলোকিত করছেন না? যদি আপনাদের মাঝে কোন আলো বিদ্যমান থাকত তাহলে আপনারা অবশ্যই অন্যদেরও আলোকিত করতে আসতেন। ধর্মের সত্যতা সম্বন্ধে আপনাদের নিজেদেরই সন্দেহ রয়েছে; এজন্যই আপনারা অন্যদের নিকট আসছেন না।
খ্রীষ্টান ভাইয়েরা আমার! কোন কোন ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থাও ইহুদী ভাইদের মতই। আপনারা বিশ্বাস করেন আপনাদের প্রভু সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান এবং তিনি সর্বজ্ঞ। কিন্তু আপনারা তাঁকে এমনভাবে স্থবির করে রেখেছেন যেন তিনি যীশুখ্রীষ্টের পর আর কাউকে দূত হিসেবে পাঠানোর মত কোন ক্ষমতাই রাখেন না। যীশুখ্রীষ্টের পূর্বে যদি নবী-রাছুল আগমনের একটি নির্দিষ্ট ধারা অব্যহত থেকে থাকে তাহলে বর্তমানে আপনাদের প্রভু এভাবে স্থবির কেন? তাঁর যদি ক্ষমতা থেকেই থাকে, তাহলে তিনি কেন এই সুদীর্ঘ দুহাজার বছরেও কোন দূত পাঠালেন না? আপনারা হয়তো বলতে পারেন যে, আপনাদের প্রভু যে কোন সময় দূত পাঠানোর ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু তিনি কেন এখন তা করছেন না তা আপনাদের জ্ঞানের বাইরে। আপনারা কি তাঁকে কখনো তাঁর পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞাসা করেছেন? তিনি উত্তরে কি বলেছেন? প্রকৃতপক্ষে আপনারা তাঁকে এ ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন অনুভব করছেন না। আপনারা এত স্থবির কেন? যখন পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ ধ্বংসের কিনারায় উপনীত তখন তাঁর অনুকম্পা কেন আপনারা প্রার্থনা করছেন না? যদি বলতে চান যে, আপনারা দিন-রাত তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন, তাহলে বলুন, আপনারা তাঁর কী উত্তর পেয়েছেন? নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আপনারা তার কাছ থেকে কোন উত্তরই পাচ্ছেন না। কেন? কারণ আপনাদের সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই। যাদের সাথে প্রভুর সম্পর্ক থাকে না তারা প্রভুর সৌন্দর্য অবলোকন করা থেকে বহু দূরে। তারা প্রভুর সৌন্দর্যে অভিভূত হতে পারছেন না। অতএব আপনারা প্রভুর সৌন্দর্য সম্পর্কে কিছুই বলতে পারবেন না। যদিও বা আপনারা কিছু বলতে চান, তা হবে এক মৃত ব্যক্তির কিছু অলৌকিক কাহিনীর বর্ণনা মাত্র। আপনারা হয়ত বিশ্বব্যাপী মিশনারীদের কর্মতৎপরতা সম্বন্ধে বলতে পারেন। তারা কী করছেন? তারা কিছু নিঃস্ব দরিদ্র লোকের অসহায়ত্বের সুযোগ গ্রহণ করছেন। আমরা বাংলাদেশস্থ মিশনারী প্রধান কিছু ফাদারের সাথে কথা বলেছি। তারা তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন একারণে যে, তারা তাদের সমাজের বেতনভূক কর্মচারী ব্যতীত নন। বেতনভূক কর্মচারী হিসেবে সমাজের লোকদের সদ্ইচ্ছার উপর পরিবারের ব্যয়ভারের বোঝা নির্ভরশীল বলে যারা বিশ্বাস করেন তাদের কাছ থেকে অধিক আর কী আশা করা যায়?
এবার আমি আমার সতীর্থ মুসলমান ভাইদের বলছি। আপনারা হয়ত নিজেদের কিছুটা গর্বিত বোধ করতে পারেন এই ভেবে যে, প্রধান চারটি বিশ্ব ধর্মকেই যখন স্থবির প্রমাণ করা হয়েছে তখন আপনারা খুব আশা করছেন এবার আপনাদের ধর্মটাকেই সত্য ধর্ম হিসেবে একমাত্র গ্রহণযোগ্য প্রতিপন্ন করা হবে। কিন্তু আমি দুঃখিত। আমি এতকিছু বললাম শুধুমাত্র আপনাদের প্রতি চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্যে। আমার লক্ষ্য আপনারাই। আপনারা পৃথিবীর সব চাইতে সফল ব্যক্তিত্বের অনুসারী হওয়া সত্বেও আপনারাই বর্তমানে সব চাইতে অসফল জাতি। আপনারা পূর্ব গোলার্ধের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে প্রভুত্ব করেছেন; কিন্তু বর্তমানে নিজের পরিবারের উপরই আপনাদের কোন প্রভুত্ব নেই। কেন? হিন্দু, খ্রীষ্টান অথবা ইহুদীদের মত আল্লাহ্ সম্পর্কে স্থবিরতার বিশ্বাসই আপনাদের উপর ক্রিয়াশীল। আপনাদের বিশ্বাস যে, পবিত্র কোরান অবতীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ্র সমস্ত কর্মকা- সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন আল্লাহ্র আর অধিক কিছু বলার নেই, অধিক কিছু করার নেই, অধিক কিছু শোনার নেই। আপনাদের বিশ্বাস এই যে, পবিত্র কোরান অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথেই সৃষ্টির সমস্ত কর্মকা- শুরু করার বোতাম আল্লাহ্ ‘অন’ করে দিয়েছেন। এখন থেকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত সৃষ্টির কর্মকা- স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলতে থাকবে। তাহলে কি আল্লাহ্ এখন ঘুমুচ্ছেন? যদি তা না হয়, তাহলে তিনি এখন কী করছেন? আমি জানি এব্যাপারে আপনারা নিশ্চিতভাবে কোন উত্তর দিতে পারবেন না। কিন্তু আমি জানি আল্লাহ্ এখন কী করছেন? তিনি এখন ‘কুফরি ফতোয়া’ (একজনকে কাফের বলার ধর্মীয় অনুমতি) লিখছেন এবং আণবিক বোমাতুল্য এসব ফতোয়া সতীর্থ ভাইদের বিরুদ্ধে নিক্ষেপ করার নির্দেশসহ মহানুভব ‘উলেমা’দের নিকট পাঠাচ্ছেন যাতে শেষ নবীর অনুসারীদের হত্যা করার মত মহা পাপ কোন অমুসলমান করতে না পারে। তাই নয় কি? যদি তা না হবে তবে এসব ‘কুফরি ফতোয়া’ আপনারা কেমন করে আপনাদের সতীর্থ ভাইদের উপর প্রয়োগ করছেন যারা আপনাদের মত একই ‘কলেমা’ পাঠ করেন এবং আপনাদের সাথে একই মসজিদে নামাজও পড়েন? যদি আল্লাহ্ আপনাদেরকে এ নির্দেশ না দিয়ে থাকেন তাহলে আপনারা কোন্ সাহসে এগুলো আপনাদের সতীর্থদের প্রতি প্রয়োগ করছেন? মুসলমানদের প্রধান দুটি বিভাগ রয়েছে – সুন্নী ও শিয়া। সুন্নীদের মতে শিয়ারা কাফের, আবার শিয়াদের মতে সুন্নীরা কাফের। তবে কারা প্রকৃত মুসলমান এবং কারা কাফের তা কে নির্ধারণ করবে? এখন আপনাদের জন্য একজন মধ্যস্থতাকারী দরকার। আপনাদের কেউই এ মধ্যস্থতাকারী হতে পারবেন না। কারণ, আপনারা উভয়ই সমস্যায় জড়িত। আবার মুসলমান সমাজের বাইরের কাউকেই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মানতেও আপনারা রাজি হবেন না। কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন যে, পবিত্র কোরানে এবং হাদিসে এ সমস্যার সমাধান আছে। যারা এরূপ বলেন তারা সবচাইতে অবাস্তব ব্যক্তি। আপনারা কি এমন কোন আইনী বই দেখেছেন যার কোন রায় ঘোষণা করার ক্ষমতা আছে? তাহলে কিভাবে আশা করছেন যে, পবিত্র কোরানে এ সমস্যার সমাধান আছে? রায় ঘোষণার জন্য অবশ্যই একজন তৃতীয় ব্যক্তি প্রয়োজন। এ তৃতীয় ব্যক্তিটি কে হবেন? কোন বহিরাগত ব্যক্তি যদি আপনাদের এ সঙ্কটপূর্ণ অবস্থার কথা জানতে পারেন, তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবে আপনাদের প্রতি করুণাই বোধ করবেন। আপনাদের উভয়েরই দাবি, আপনারাই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর সত্য অনুসারী এবং দয়াময় প্রভুর একমাত্র বিশ্বস্ত ভক্ত। তাহলে, আপনাদের সমস্যা নিয়ে আল্লাহ্রই নিকটে কেন আপনারা হাজির হচ্ছেন না? আপনাদের সমস্যাটি আল্লাহ্র উপর ন্যস্ত করার পূর্বেই আপনারা ইচ্ছা করছেন, আল্লাহ্ বলুক, তিনি কিভাবে এর সমাধান করবেন? অর্থাৎ আপনাদের ভাবনা এই যে, আপনারা যা জানেন আল্লাহ্ তা জানেন না; অর্থাৎ আপনারা ভাবছেন এটি এমনই এক জটিল বিষয় যার সমাধান করা আল্লাহ্র পক্ষে এত কঠিন যে, এ বিষয়ে আপনারা যেমন বুঝেন আল্লাহ্ তেমন বুঝেন না। আল্লাহ্ আমাদের ক্ষমা করুন! আল্লাহ্ সম্পর্কে আপনাদের ধারণা কত ভ্রান্ত! যাহোক, আপনারা নিজেরাই যখন একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং আপনাদের সমস্যা সমাধানে অপারগ, তখন অন্যদের আপনারা কোন্ পথ দেখাবেন? তার মানে, আপনারা যদি আল্লাহ্র সৌন্দর্য দেখতে না পান, তাহলে কেমন করে আপনারা স্রষ্টাকে এবং তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসবেন? অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, ধর্মের নামে আপনারা নিজেদের মধ্যে ঘৃণাই ছড়াচ্ছেন। একারণেই আপনাদের একই ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও আপনাদের মধ্যে কোন ঐক্য নেই। পরিণতিতে আপনারা হারিয়েছেন আপনাদের শক্তি, সাহস ও উদ্দীপনা। তাই আপনারা সর্বোতভাবেই স্থবির।
এবার আমি আহ্মদীয়া ভাইদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাচ্ছি। তাদেরকে লেখা আমার চিঠির উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমার মতামত সংরক্ষণ করতে চাচ্ছি। এপ্রিল ১৯৭৪-এ আমি আপনাদের বাংলাদেশের এক কেন্দ্রে চারটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম এবং ১৯৭৪-এর আগষ্ট মাসে একই চিঠির কপি পাঠিয়েছিলাম ভারতের কাদিয়ান কেন্দ্রে, ওয়াশিংটন আহম্মদিয়া মুসলিম মিশন এবং ল-নে অবস্থিত আহম্মদিয়া মুসলিম মিশনে। আজ পর্যন্ত কোথাও থেকে কোন উত্তর পাইনি। কেবলমাত্র ভারতের কাদিয়ান কেন্দ্র আমাদের পত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করেছে। এর দ্বারা কী প্রমাণিত হয়? আপনারাও কি স্থবির নন?
অতীতের গৌরব গাঁথা রোমস্থন করে কেউ গৌরবান্বিত হতে পারে না। গৌরব যা ছিল তা অতীত হয়ে গেছে। এখন আমাদের বর্তমানকে নিয়ে ভাবতে হবে। এটাই প্রগতিশীলতা। একটা বিষয় আমার কাছে খুব বিস্ময়কর মনে হচ্ছে, তা হল, পৃথিবী যখন প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে অগ্রসরমান রয়েছে, তখন বিশ্বাসের ব্যাপারে আমরা পশ্চাদপসরণ করে আধুনিক যুগ থেকে মধ্যযুগে এবং মধ্যযুগ থেকে প্রাচীন যুগে সরে যাচ্ছি। এ কারণেই যুগের সাথে ধর্মের দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। যখন কোন ধর্ম সময়ের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে পারে না তখন তা আর ধর্ম থাকে না। ধর্মভীরু লোকজন তখন আসমানী আলো নাজেল হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। কারণ, তারা এমন একটি ধর্ম অনুসরণ করে আসছেন যার প্রবর্তক, ধরুণ, দু’হাজার বছর আগে এসেছিলেন। তিনি এমন একটি ধর্ম প্রচার করে গেছেন যা তার সময়ের সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল। এখন যদি আমরা প্রথম শতকের আলোকে এ বিংশ শতকের কোন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি তাহলে কিভাবে তা সম্ভবপর হবে? তারা দু’হাজার বছরের পুরনো একটি ধর্ম অনুসরণ করছে। তিনি এমন এক ধর্মের প্রচার করেছেন যা তার সময়ের সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল। এখন আমরা যদি প্রথম শতকের আলোকে এ বিংশ শতকের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি তবে কিভাবে তা সম্ভবপর হবে, যে সময়ে এরূপ সমস্যার অস্তিত্বই ছিল না? তখন মানুষ কোন সমস্যারই সমাধান দিতে না পেরে সময়কে দোষারোপ করতে থাকে এবং তারাই যুগের সকল প্রকার প্রগতিশীল কর্মকা-ের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তারা চিন্তা চেতনায় একদম পশ্চাৎমুখী বা প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু স্রষ্টার আপন জন হিসাবে যখন একজন কেউ নতুন আলো নিয়ে পৃথিবীতে আসেন তখন তিনি তার সমসাময়িক সময়ের তুলনায় অন্ততঃ শত বছর এগিয়ে থাকেন। অর্থাৎ তাঁর চিন্তা-চেতনা থাকে পুরো একটা প্রজন্মের জীবন যাত্রা পরিচালনা করার লক্ষ্যে। এখানে কালটি থাকে স্রষ্টার প্রেরিত ব্যাক্তির প্রতিকুলে। এটিই হচ্ছে কাল ও ধর্মের দ্বন্দ্ব।
সুদীর্ঘ কাল ধরে কোন কিছু বিশ্বাস করে আসলেই তা ধর্ম হয়ে যায় না। ধর্ম হলো স্রষ্টার আলো। যে যুগে যতটুকু প্রয়োজন সে যুগের জন্য তিনি তা-ই প্রেরণ করেন। উপরের আলোচনা দ্বারা আমি এটা পরিষ্কার করতে চেয়েছি যে, এ মুহূর্তে আমাদের কেউই এমন দাবী করতে পারছি না যে, স্রষ্টার কাছ থেকে আমরা সরাসরি কোন আলো পাচ্ছি। আমাদের কারো ধর্মই আজ স্থবিরতা থেকে মুক্ত নয়। প্রতিটি ধর্মের মানুষই হাজারো সমস্যা, দুঃখ-কষ্ট ও সীমাহীন যাতনায় জর্জরিত। তারা এসব দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য যে পরিকল্পনা বা পদ্ধতিই গ্রহণ করুক না কেন, তা তাদের দুঃখ-কষ্ট আরো বৃদ্ধি করছে। আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থ, যেমন, কোরান, বেদ, ত্রিপিটক, বাইবেল প্রভৃতি যতই আলোকিত হোক না কেন এসব থেকে আমরা কোন আলোই আহরণ করতে পারছি না। সেগুলো থেকে আমরা যা আহরণ করছি তা বিষ ছাড়া আর কিছু নয়। আর এ বিষই আমাদের পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি কিন্তু বলছি না যে, আমাদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থগুলোই বিষাক্ত। বরং এটি হচ্ছে আমাদের সেই বিষাক্ত মন, যা নিয়ে পবিত্র গ্রন্থ বুঝতে যেয়ে আমরা মানব সভ্যতার জঘন্যতম স্তরে নেমে এসেছি। কী ভাবে? তা হচ্ছে আমরা বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পবিত্র গ্রন্থগুলো বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে যেয়ে একটি দেহের কোন একটি অঙ্গ আবিষ্কার করেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ‘পেয়েছি’ ‘পেয়েছি’ বলে চিৎকার করে উঠছি। তখন আমি বলি, “এ-ই সত্য”। আপনি বলছেন, ‘না, না। আমি যা বলছি এটিই প্রকৃত সত্য।’ আবার তিনি বলছেন, ‘না, না,। আপনারটা নয়। বরং আমি যা বলছি এটাই প্রকৃত সত্য।’ এভাবে ‘সত্য’ নিয়েই সত্যের মধ্যে হিংসার দ্বন্দ্ব অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আমি অত্যন্ত জোড় দিয়েই বলতে চাচ্ছি যে, আমরা বর্তমানে এমন এক সর্বনাশা অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছি যে, সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা পবিত্র ধর্ম গ্রন্থগুলোর উপর যত বেশী মনোনিবেশ করব আমরা সমাজে তত বেশী ঘৃণা ও মতভেদ সৃষ্টি করব। তবে আমি বলছি না যে, আপনারা এখন আর কোন ধর্ম গ্রন্থ পড়বেন না। বরং আমি বলব আপনারা যত বেশী পারেন তত বেশী ঐসব গ্রন্থ পড়ার চেষ্টা করুন। তবে আমার পরামর্শ হল, আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য অতিরিক্ত আর কোন মতবাদ প্রবর্তন করবেন না। কারণ ইতোমধ্যেই আমরা অসংখ্য মতবাদের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে আছি।
আমরা বর্তমানে এমন একটি বিশৃঙ্খল ও অব্যবস্থাপূর্ণ পৃথিবীতে বসবাস করছি এবং দেখতে পাচ্ছি গোটা পৃথিবীটাই ধ্বংসের চরম সীমার দিকে দ্রুত ধাবমান হচ্ছে যেখান থেকে ফেরার আর কোন উপায় নেই। উপরে আমি যেমনটি দেখিয়েছি, বর্তমানে কোন ধর্মেরই এমন কোন ক্ষমতা নেই যা এ পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এ মহা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো বৈজ্ঞানিক ঐক্য; উদ্দেশ্য এবং বিশ্বাসের ঐক্য। আমি উদ্দেশ্যের ঐক্য সম্পর্কে আলোকপাত করেছি। এখন আলোকপাত করব বিশ্বাসের ঐক্য সম্পর্কে। যখন কোন ধর্ম সময়ের গতির সাথে তাল রেখে চলতে পারে না, তখন স্বর্গ হতে এক নতুন আলো অর্থাৎ স্রষ্টার পক্ষ থেকে এক নতুন নির্দেশনার অপেক্ষায় আমাদের থাকতে হবে। এ নির্দেশনাটি কী? এ হলো স্রষ্টা আমাদের মধ্য থেকে একজনকে মনোনীত করবেন। স্রষ্টা তাঁর মনোনীত ব্যক্তির উপর তাঁর আশির্বাদ বর্ষণ করবেন; তাকে তাঁর অপার সৌন্দর্য প্রদর্শন করবেন। মনোনীত ব্যক্তি স্রষ্টার সরাসরি আলোকে আলোকিত হবেন। স্রষ্টার নিকট থেকেই তিনি সরাসরি জ্ঞান ও শক্তি লাভ করবেন এবং স্রষ্টা নিজেই তাকে মানুষদের স্রষ্টার দিকে আহ্বান করার জন্য অনুমতি দান করবেন। স্রষ্টার আদেশক্রমেই তিনি মানুষদের স্রষ্টার দিকে আহ্বান করবেন। তিনি সমস্ত পৃথিবীর দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিবেন। তিনি নির্ভীকভাবে ঘোষণা করবেনঃ “আমি তোমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য আমার স্রষ্টা কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট। সুতরাং তুমি যে কেউ হও না কেন, হতে পারো তুমি একজন অগ্নি-উপাসক, মূর্তিপূজারী; হতে পারো তুমি একজন হিন্দু অথবা বৌদ্ধ; একজন খ্রীষ্টান, ইহুদী বা একজন মুসলমান বা অমুসলমান। অথবা হতে পারো তুমি একজন বিপথগামী তরুণ বা একজন বারবনিতা; হৃতসর্বস্ব একজন দরিদ্র ব্যক্তি অথবা একজন রাজা বা প্রজা; একজন ন্যায়পরায়ণ সাধু অথবা একজন দুষ্কর্মী; হতে পারো তুমি একজন পাপী অথবা ধার্মিক- তুমি যে কেউ হওনা কেন- তুমি আস, তুমি প্রভুর অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে পাবে এবং তোমার সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে। তোমার সমস্ত পাপ মাফ করা হবে এবং তাঁর শান্তির গৃহে তোমাকে প্রবেশ করান হবে; কারণ, তোমার প্রভু তোমাকে ভালবাসেন। তিনি তোমাকে তোমার বাবা-মার চাইতেও বেশী ভালবাসেন। তিনি অবিরামভাবে তোমাকে তাঁর কল্যাণগৃহে প্রবেশের জন্য আহ্বান করছেন। তাই তুমি যে-ই হও, তুমি যত বড় পাপীই হয়ে থাকনা কেন, তুমি আস এবং দেখ তোমার প্রভু কত সুন্দর! তিনি কত মহান ও কত দয়াবান। এস, এস এবং জীবন্ত প্রভুর সাহচর্য উপভোগ কর। এস এবং করুণাময় প্রভুর সন্তুষ্টি উপভোগ কর। এস এবং প্রেমময় প্রভুর মধুর হাসি অবলোকন কর। তিনি তাঁর স্বর্গের দরজা খুলে দিয়েছেন এবং তোমার আগমনের প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছেন। তুমি যদি কোন অপবিত্র ও অচ্ছুৎও হও, তবু তুমি এস, তুমি বহু মূল্যবান রতেœ পরিণত হবে। কিন্তু আমি হলাম তোমার প্রেমময় প্রভুর সুখোদ্যানে প্রবেশের দ্বার। আমিই সেই দরজা। এস এবং প্রবেশ কর। যদি তুমি আস তবে কতই না ভাল হবে”! এটাই কি ধর্ম নয়? কোন জায়গায় যদি এরূপ ধর্ম পাওয়া যায় তবে এই ধর্মের মাধ্যমে আমরা কি ঐক্যবদ্ধ হতে পারি না? আমরা কি বিশ্বাসের এ শর্তে ঐকমত্য হতে পারি না? প্রভুর মনোনীত ব্যক্তির ডাকে সাড়া দেয়া এবং তাকে মান্য করাই হলো ধর্মের মূল কথা। অতএব হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ,খ্রীষ্টান, ইহুদী, আহমদীয়া, ইসমাইলিয়া ভাইয়েরা! রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ! শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী ভাইয়েরা, অসহায় দরিদ্র এতিম ভাইয়েরা, অধঃপতিত মা-বোনেরা, অচ্ছুৎ ও হরিজন ভাইয়েরা, শ্রমজীবী, বেকার অথবা সরকারী কর্মকর্তা ভাইয়েরা- আপনারা সবাই আমার ভাই। আমি আপনাদের সবাইকে একইভাবে ভালবাসি। আমরা কি আমাদের মধ্যকার সকল বিভেদের পর্দা ছিন্ন করে, ঘৃণা ও সন্ত্রাসের উর্ধ্বে উঠে এবং উঁচু-নীচু ভাব চূর্ণ-বিচূর্ণ করে আমাদের প্রিয় আত্মাকে অত্যাসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এক মানবিকতার ধর্মে প্রবিষ্ট হওয়ার লক্ষ্যে আমাদের ত্রাণকর্তা প্রভুর মনোনীত ব্যক্তিকে গ্রহণ করার জন্যে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি না?
এখানে মনে রাখতে হবে যে, প্রভুর মনোনীত ব্যক্তি কোন নতুন ধর্ম প্রচার করবেন না। বর্তমানে আমরা যেসব ধর্ম অনুসরণ করছি সেগুলো সবই নিষ্ক্রিয় ও স্থবির হয়ে আছে। কিন্তু আমাদের প্রভু তো নিষ্ক্রিয় নন। তিনি সর্বচৈতন্যময় ও সর্বপ্রাণচাঞ্চল্যময়। তিনি প্রাণচাঞ্চল্য ভালবাসেন। সুতরাং প্রভুর মনোনীত এ ব্যক্তি যে ধর্ম প্রচার করবেন তা সমস্ত অতীত ধর্মেরই এক নবজীবন লাভ। একজন হিন্দু এর মধ্যে বেদকে খুজে পাবেন, একজন বৌদ্ধ এর মধ্যে তার ত্রিপিটককে পুনর্জীবীত দেখতে পাবেন, একজন খ্রীষ্টান তার সত্য বাইবেলকে এর মধ্যে দেখতে পাবেন, একজন ইহুদীও তার সত্য ধর্মকে এর মধ্যে দেখতে পাবেন এবং একজন মুসলমানও কোরানের সত্য বাণী এর মধ্যে দেখতে পাবেন। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের সকলকে সৎ ও বিশ্বস্ত হতে হবে। তা না হলে কখনো প্রভুর কাছে যাবার রাস্তা খুঁজে পাবে না অর্থাৎ কখনো পাবে না শান্তি ও মুক্তির পথ।
আমি এখন আমার মুসলমান ভাইদের জন্য আরো কিছু কথা বলতে চাই। তারা হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন, আল্লাহর মনোনীত এ ব্যক্তির পরিচয় কী হবে? তিনি কি নিজেকে একজন দুত বা প্রচারক, নাকি নবী-রাছুল হিসেবে দাবী করবেন? না, তিনি তা করবেন না। কেউ যদি কখনও এরকম দাবী করেন, তবে আমাদের উচিত হবে না তাকে বিশ্বাস করা। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে, হজরত মুহম্মদ(দঃ) সর্বশেষ নবী এবং পবিত্র কোরান সর্বশেষ কিতাব। তাহলে ঐ মনোনীত ব্যক্তি কী করবেন? তার কাজ হবে একজন সংস্কারক হিসেবে যাকে ইসলামে “মুজাদ্দেদ” বা “ঈমাম” হিসেবে অভিহিত করা হয়। উনি তো আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি। অতএব, তিনি যেই হোন না কেন, তার ধর্ম-বর্ণ যা-ই হোক না কেন, আমাদের উচিত তাকে মান্য করে চলা। কারণ প্রভুর অনুগ্রহ পেতে হলে তাঁর প্রতিনিধিকে মান্য করতেই হবে।
প্রভুর অসীম দয়ায় যদি কখনো আমরা সেরকম কোন ব্যক্তিকে আমাদের মধ্যে পাই, তবে সেটি আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না অমঙ্গলজনক হবে? আপনারা অবশ্যই বলবেন, “হ্যাঁ, তা মঙ্গলজনকই হবে।” কিন্তু পরক্ষণেই আবার চিন্তা করবেন, “অসম্ভব! একেবারেই অসম্ভব? আমাদের প্রভু আমাদের জন্য একজন ত্রাণকর্তা পাঠাবেন? কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব? এও কি সম্ভব যে, সকল মানুষ একই বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ হবে? এ একেবারেই অসম্ভব।” সুতরাং কেউ কেউ আমার এ প্রস্তাবে রাজী না-ও হতে পারেন। বরং আমার আশংকা, কেউ কেউ হয়ত আমার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে থাকবেন; কারণ তারা এখনও ধর্মীয় বিষয়ে অন্ততঃ শত বছর পিছিয়ে আছেন। তাই, কেউ কেউ হয়ত এ ধর্মীয় পুনরুত্থান মেনে নিতে এগিয়ে আসবেন না যদিও তারা এর চেয়ে ভালো ও নিশ্চিত কোন রাস্তা দেখাতে পারবেন না যা আমি আমাদের মুক্তির জন্য পেশ করলাম। যদি আপনাদের কেউ আমাকে এমন কোন পথ দেখাতে পারেন, তাহলে আপনার মতকে সমর্থনকারী হিসেবে আমিই হব প্রথম ব্যক্তি। প্রভুর মনোনীত ব্যক্তি আসেন জগদ্বাসী মানুষের উদ্ধারের জন্য অথচ জগদ্বাসী মানুষ তাকে ধ্বংস করার জন্যেই প্রবল ভাবে দ-ায়মান হয়। কি নির্মম পরিহাস!
আমাদের ভাইদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত এখনও আমার প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছেন এবং মনে মনে ভাবছেন, গোটা বিশ্ব একই বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ হবে, এওকি সম্ভব? তা-ই যদি হবে তাহলে তো পৃথিবীটা স্বর্গে পরিণত হবে। ভাইয়েরা আমার, বিশ্বাস করুন, প্রভুর মনোনীত ব্যক্তি যখন আসেন তখন তিনি প্রভুর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য সর্বোতভাবে প্রস্তুত হয়েই আসেন। তিনি তার সাথে দুটি জিনিস নিয়ে আসেন- প্রভুর ক্রোধ এবং করুণা। যে তাকে বিশ্বাস করবে সে প্রভুর সন্তুষ্টি লাভ করবে। আর যারা তাকে বিশ্বাস করবে না তারা প্রভুর গজবে ধ্বংস হবে। প্রভুর যে গজব আমাদের জন্য অপেক্ষমান, এ হল সেই অনিবার্য মহা প্লাবন। এটা আমাদের অত্যন্ত সন্নিকটে। সুতরাং অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে আমাদের সতর্ক হতে হবে। আমাদের কারো পক্ষেই প্রভুর পরিকল্পনার বিকল্প কিছু করা সম্ভব নয়। আমেরিকা বা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, ব্রিটেনের রাণী বা চীনের চেয়ারম্যান অথবা পৃথিবীর যে কোন ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট, তারা যে কেউ হোন না কেন, প্রভুর গজব তাদের তৈরী এটম বোম বা হইড্রোজেন বোমার ভয়ে ভীত নয়। বরং যখন সময় হবে তখন একটি মুহূর্তও এদিক ওদিক হবে না। এছাড়া তাদের নিজ নিজ দেশের মানুষের অবিশ্বাসের দায় দায়িত্ব তাদের কাঁধেই বর্তাবে। সুতরাং তাদের সবারই উচিত প্রভুর সত্যকে গ্রহণ করার জন্য ব্যবস্থা করা। আর আপনাদের জন্য আর একটি খবর- যে রাষ্ট্র সর্বপ্রথম এ সত্য গ্রহণ করবে সে রাষ্ট্রই পুরো পৃথিবীর উপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হবে এবং যে ব্যক্তি দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে এ সত্য সর্বাগ্রে গ্রহণ করতে এগিয়ে আসবেন তিনি সবার উপরে মর্যাদা লাভ করবেন।
কেউ কেউ হয়ত এখনও সন্দেহ পোষণ করছেন, যদি এরূপ কিছু না-ই ঘটে অর্থাৎ প্রভুর মনোনীত ব্যক্তি যদি সত্যিই আবির্ভূত না হন তাহলে তো আমাদের এসব কর্মকা-ই বিফলে যাবে। তার আবির্ভাব সম্পর্কে আমি এতটা দৃঢ় বিশ্বাসী যে, আপনারা সবাই যদি তাকে গ্রহণ করার জন্য ব্যবস্থা নেন তবে অবশ্যই তাকে পাবেন; আর যদি তাকে না পান তাহলে আমাকে যে কোন শাস্তি দেয়ার অধিকার আপনাদের থাকল এবং এর বিরুদ্ধে আমার পক্ষ থেকে কোনই অজুহাত চলবে না। পক্ষান্তরে আপনারা যদি তাকে গ্রহণ করার জন্য ব্যবস্থা না নেন, তাহলে প্রভু তার সত্য গ্রহণ করার জন্য আমাদের বাধ্য করবেন। কারণ, এটি তাঁরই পরিকল্পনা এবং তিনি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যথেষ্ট ক্ষমতাবান।
এত সব জানার পর কোন কোন পাঠক হয়ত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এ প্রবন্ধের লেখক একজন পাগল বই নন। কিন্তু না, তিনি পাগল নন। তিনি স্বাভাবিক ভাবেই জীবন যাপন করছেন। পার্থক্যটা শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির। প্রভুর মনোনীত ব্যক্তি সেটিই দেখতে পান যা সাধারণ মানুষ দেখতে পায় না। আমাদের মধ্যেকার মহৎ ব্যক্তিগণও কিছু কিছু জিনিস দেখতে পান; তবে তাদের দর্শন ও প্রভুর মনোনীত ব্যক্তির দর্শনের মধ্যে পার্থক্য আছে। তাই মহৎ ব্যক্তি এবং প্রভুর মনোনীত ব্যক্তির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যেও কিছুটা স্তর ভেদ হয়ে থাকে। মহৎ ব্যক্তিগণ বস্তুর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে কোন একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন, কিন্তু প্রভুর মনোনীত ব্যক্তি যা কিছু বলেন তা তার প্রত্যক্ষ দর্শনের মাধ্যমে বলেন। যাহোক, আমি কোন মহৎ ব্যক্তিও নই বা প্রভুর মনোনীত ব্যক্তিও নই। প্রভুর মনোনীত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার সুবিধার্থে আমি শুধুমাত্র একটা বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করলাম। এতেই আপনারা আমাকে পাগল বলতে শুরু করেছেন! এখন আপনারা সহজেই অনুমান করতে পারছেন, প্রভুর মনোনীত ব্যক্তি যখন তার পরিচয় প্রকাশ করবেন তখন আপনারা তাকে কত সম্মানের সঙ্গে বরণ করতে পারবেন!
আমরা সবাই একটা পরিবর্তন চাচ্ছি। কিন্তু সে পরিবর্তনটা কি আপনা-আপনিই হয়ে যাবে? কিংবা আপনারা কি কোথাও এমন কোন ঘটনার কথা শুনেছেন যা নাকি যাদু-মন্ত্রের মত রাতারাতি ঘটে গেছে? না। বিরাট কোন পরিবর্তন ঘটাতে চাইলে তা করতে হবে অত্যন্ত সতর্ক, ধীর-স্থির, দৃঢ় এবং পরিকল্পিতভাবে এবং ধারাবাহিক ও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে আন্দোলন করে এবং এর জন্যে বৃহত্তর ত্যাগের মানসিকতা লালন করতে হবে। আর সে ত্যাগ হবে জীবন, রক্ত, সম্পদ বা আত্মসম্মান বিসর্জনের। সর্বোপরি আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে চলতে হবে। সেখানে একটি সুনির্দিষ্ট কার্য প্রণালীও থাকতে হবে এবং কিছু লোককে অবশ্যই তাদের জীবন, রক্ত, সম্পদ এবং সম্মান ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এত কিছু আমি বললাম শুধুমাত্র একটি পদ্ধতিকে বুঝানোর জন্য। (যদি কোন পাঠক এ নিয়ম ও কার্য প্রণালী সম্পর্কে বিশদভাবে অবগত হতে চান তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অথবা চিঠি লিখে যোগাযোগ করতে পারেন। তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে আমরা প্রস্তুত।)
আমরা যদি এ নিয়ম পালনে উদাসীন হই, তাহলে আমাদের লক্ষ্য অর্জনে অবশ্যই ব্যর্থ হব। কিন্তু আমাদের প্রভু উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য অর্জনে কখনও ব্যর্থ হন না। তিনি এতটাই ক্ষমতাবান যে, তিনি প্রয়োজনে আমাদের জায়গায় অন্য প্রজন্ম সৃষ্টি করবেন। সে প্রজন্ম এ রীতি মেনে নিয়ে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে, আর আমরা ধ্বংস ¯ুÍপের মাঝে মাথা গুঁজে পড়ে থাকব। ইহাই আমাদের সৃষ্টিকর্তার অপরিবর্তনীয় একমাত্র নিয়ম। এ নিয়ম অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। ইহা সার্বজনীন সত্য। কিন্তু মানুষ বাস্তব সম্পর্কে বড়ই উদাসীন। অতীতে তাদেরকে বারংবার সাবধান করা হয়েছে, কিন্তু তারা এ ব্যাপারে সজাগ হয়নি। তাই তাদেরকে অবশ্যম্ভাবী সর্বনাশ বা ধ্বংসকে বরণ করতে হয়েছে। এখনও তারা ভীষণ ভাবে অবাধ্যতাচরণ করে চলেছে। সুতরাং ধ্বংসই তাদের একমাত্র ঔষধ। প্রভু আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর সঠিক পথে পরিচালিত করুন এবং জগতের শান্তি ও পরকালের মুক্তি মঞ্জুর করুন। আমিন!
তারিখঃ ঢাকা,
২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ খ্রিঃ
অবশ্যম্ভাবী মহাপ্লাবন ও তার তরী-২
আমার ভাইদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন ধর্ম, রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন মতের অনুসারী, শিক্ষাবিদ, প-িত ও চিন্তাবিদ সবাইকে একই বিশ্বাসের অধীনে একই মঞ্চে আনয়নের উদ্দেশ্যে এক মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত করার যে পরিকল্পনা ও কার্যক্রম রয়েছে তা বাস্তবায়িত করা আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব কিনা।
এরূপ একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত করার পরিকল্পনা ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে আমি এর গুরুত্ব নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন কিছুর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে না পারব ততক্ষণ পর্যন্ত সে জিনিসের প্রতি আমাদের মনে কোন আকাঙ্খা জাগবে না। যখনই কোন জিনিসের প্রয়োজনীয়তা আমরা বুঝতে পারব তখনই যে কোন মূল্যে তা লাভ করার চেষ্টা করব। ধরা যাক, এমন একটি রাষ্ট্র যার সার্বভৌমত্ব এমন একজনের হাতে ন্যস্ত যিনি তার রাষ্ট্রের যেখানে যা কিছু ঘটুক তিনি তা দেখতে পান; রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের দীর্ঘশ্বাস তিনি শুনতে পান। প্রতিটি কাজই তিনি তার রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের মঙ্গলের জন্য করে থাকেন। তিনি কখনও তার নিজের অথবা মুষ্টিমেয় কিছু লোকের অথবা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের মঙ্গল চিন্তা করে কোন কাজ করেন না। তিনি সব কাজ রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের মঙ্গল-চিন্তা করেই করে থাকেন। এরূপ একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সম্ভাব্যতার প্রশ্ন মুহূর্তের জন্যে হলেও দুরে রেখে আসুন আমরা ভেবে দেখি যদি আমরা এরূপ একটি রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারি তাহলে এটা কি আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না অমঙ্গলজনক হবে। অবশ্য বেশীর ভাগ মানুষই এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে একমত হয়ে ‘হ্যাঁ’ বলবেন। কিন্তু আমি জানি তবুও কিছু মানুষ আমাকে বিদ্রƒপ করবে এবং মনে মনে বলবে, এরূপ একটি অসম্ভব ব্যাপারকে সম্ভব বলে চিন্তা করে কি লাভ? তারা দ্বিধাগ্রস্ত মানুষ। প্রকাশ্যভাবে কিছু বলার সাহস তাদের নেই। এ ধরণের লোক প্রকাশ্যভাবে তাদের সম্মতি প্রকাশ করে ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যতভাবে সম্ভব বিষাক্ত বীজ বপন করছে। তারা মনে করে তাদেরকে কেউ চিনতে পারছে না, কিন্তু তারা ভুলে যায় যে, সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে দেখছেন। যাহোক, বাস্তাবে যা অসম্ভব তা সম্ভব বলে মনে করার কি মূল্য এ বিষয়ে আমি আরো দুটি কথা বলছি। আমরা সবাই জ্যামিতি জানি। বিজ্ঞানের এ শাখাটি মূলতঃ ধারণার উপরই প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, বিন্দু এমনই একটি বস্তু যার কোন পরিমাপ নেই। এটি কি আমরা কল্পনা করতে পারি? আবার রেখা এমনই একটি জিনিস, যার কেবল দৈর্ঘ্য আছে, কিন্তু প্রস্থ বা বেধ নেই। এসব কি আমরা কল্পনা করতে পারি? এসবের কি কোন মূল্য নেই? বিশেষভাবে বলতে গেলে, পারমানবিক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মূলতঃ ধারণাকে ভিত্তি করেই। বৈজ্ঞানিকরা কখনও কোন পরমাণু কি বাস্তবে চোখে দেখতে পেরেছেন? না, দেখেননি। তবে পরমাণুর মূল্য ও গুরুত্ব তো আমরা সকলেই অনুধাবন করতে পারছি। এ পরমাণুকে কি ভয় পান না আমেরিকা বা রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি? হ্যাঁ, অবশ্যই তাঁরা ভয় পান। কিন্তু যারা ভ- ও কপট, তারা কোন কিছুকেই ভয় পায় না। কিন্তু এখন সময় এসে গেছে- আমাদের সবাইকে খুবই সতর্ক হতে হবে এবং আমাদের জন্য কি পরিণাম অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
এখন দেখা যাক, আমি যে রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করেছি, তা কতদূর সম্ভবপর। ধরা যাক, একটি রাষ্ট্র এবং সেখানে শুধু একজন মানুষই বাস করেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অবশ্য তার উপরই ন্যস্ত হবে। তিনিই হবেন রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা। কিন্তু এ সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে তিনি কি ঐ রাষ্ট্রে একাকী বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন? না। খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি আশা করবেন তার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য মানুষজন তার রাষ্ট্রে বসবাস করুক। মনে করুন, তিনি এরূপ ঘোষণা করলেন, ‘‘আমার জীবনের একটা লক্ষ্য – তা হলো আমার সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন। আমার রাষ্ট্রে বসবাসকারী যাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এরূপ, তারা এসে আমার সঙ্গে একতাবদ্ধ হতে পারে। আমি তাদেরকে ভালবাসব। আমি তাদেরকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেব। কিন্তু তারা আমাকে আমার প্রভুকে পাওয়ার জন্য সুনিশ্চিত একটি পথ দেখাবে। অথবা যতদিন তারা আমাকে একটি উত্তম পথ দেখাতে না পারবে ততদিন আমার পথটিই অনুসরণ করে চলবে।’’ তিনি আরো ঘোষণা করলেন -‘‘আমার এ ঘোষণা শোনার পরও কেউ যদি আমার ডাকে সাড়া না দেয় বা আমাকে তাদের সুনিশ্চিত পথের দিকে না ডাকে বা আমার পথ সম্বন্ধে জানতে এগিয়ে না আসে, তা হলে তাদের সবাইকে আমার প্রভুর নিকট দায়ী করব; যদি তারা কোন সত্য পথের উপর থেকেও থাকে সেই সত্য পথের দিকে আমাকে না ডাকার কারণে; অথবা আমার পথটি অনুসরণ না করার কারণে, যদি তারা বিশ¡াস করে থাকে যে তারা নিজেরা সত্য পথের উপর নেই। (এরূপ ঘোষণার পর) তার জন্য কি সমস্ত মানুষ তাদের প্রভুর সম্মুখে দায়ী হবে না ?’’ এরূপ ঘোষণা দেয়ার পর কেউ যদি তাকে সংশোধন করার জন্য তার দিকে এগিয়ে না আসে, আর সে যদি কোন ভুল পথও অনুসরণ করে থাকে, এমতাবস্থায় সঠিক পথে চলা লোকদের সঙ্গে বিচারের জন্য প্রভুর দরবারে তাকে যদি হাজির করা হয়, তার সম্বন্ধে বিচারের রায় কি হবে? সে কি তার ভুল কাজের জন্য নরকে নিক্ষিপ্ত হবে? প্রভু কি এ লোকটিকে সংশোধন না করার জন্য সমস্ত ভাল লোকদের দায়ী করবেন না? অপর পক্ষে যদি এ লোকটিকেই সঠিক পথের অনুসারী পাওয়া যায় এবং যদি প্রভু তাকে পুরস্কার প্রদান করেন অর্থাৎ স্বর্গ দান করেন; আর যদি তথাকথিত ভাল লোকদেরকেই ভুল পথের অনুসারী রূপে পাওয়া যায় এবং তাদেরকে শাস্তি প্রদান করা হয় অর্থাৎ নরক প্রদান করা হয়, তখন তারা কি কোনও ওজর-আপত্তি পেশ করতে পারবে? যে কোন ভাবেই হোক, এ ঘোষণা শোনার পর কেউ নিজেকে বা সে লোকটিকে সংশোধনের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবে না। প্রত্যেককেই তার নিজের সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এখন প্রত্যেকেরই চিন্তা-ভাবনা করে দেখা উচিৎ সে নিজে কি সঠিক না অঠিক। বিচার-বিবেচনার পর যদি কেউ নিজেকে সঠিক পথের অনুসারী হিসেবেই দেখতে পায় তা হলে ঘোষককে তার নিজের সৎ পথের দিকে আহ্বান করা উচিৎ এবং সে যদি নিজেকে অঠিক পথের উপর পায়, তাহলে তার নিজের সংশোধনের জন্য ঘোষকের নিকট যাওয়া প্রয়োজন। এ-ই হচ্ছে সততা ও বিশ¡স্ততা। অবশ্য পৃথিবীতে এখনও কিছু সৎ ও বিশ¡স্ত লোক বসবাস করছেন। যখন তারা কোন আহ্বানকারীকে এরূপ ভাবে আহ্বান করতে শুনবেন তখন অবশ্যই তার আহ্বানে সাড়া দিবেন। তারা অবশ্যই আহ্বানকারীকে তাদের সত্য দেখাবার জন্যে অথবা আহ্বানকারীর সত্য গ্রহণ করার জন্য তার কাছে আসবেন। মনে করুন, এরূপ ঘোষণা শোনার পর পাশর্¡বর্তী দেশ হতে একজন সৎ লোক শুধুমাত্র সত্যের খাতিরে তার নিকট এলেন। ঘোষকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর আগন্তুক আহ্বানকারীকে নিজের চাইতে অধিক বিজ্ঞ ও ন্যায়সঙ্গত পেলেন। তারপর শুধুমাত্র সত্যের জন্য তিনি নিজেকে আহ্বানকারীর নিকট সমর্পন করলেন। এরা দুজন এখন যথার্থই ভাল বন্ধুতে পরিণত হলেন। কিছুকাল পরে অপর এক দেশ হতে অপর এক আগন্তুক তাদের কাছে এলেন। তিন জনের মধ্যে আলোচনার পর নতুন আগন্তুককে অধিক বিজ্ঞ এবং অধিক ন্যায়সঙ্গত পাওয়া গেল। তখন আহ্বানকারী তার সার্বভৌম ক্ষমতা নতুন আগন্তুকের নিকট অর্পন করলেন। আহ্বানকারী ও পূর্বের আত্মসমর্পনকারী ব্যক্তি মিলে এ নতুন আগন্তুকের নিকট আত্মসমর্পন করলেন এবং তারই নির্দেশ মোতাবেক এ তিন জন একত্রে কাজ করে যেতে লাগলেন। শুধু সত্যের জন্য এবং শুধুমাত্র জীবনের চরম লক্ষ্য অর্জনের জন্য অর্থাৎ প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এ তিন জন এখন দৃঢ় ভাবে ঐক্যবদ্ধ হলেন। এখন এ তিন জনের কাউকে কি কারো কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন বলা যাবে? দৈহিক ভাবে যদিও তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন, কিন্তু আত্মিকভাবে তারা সবাই এক। এভাবে কালক্রমে আরো অনেক মানুষ তাদের কাছে আসলেন এবং একই ভাবে ঐক্যবদ্ধ হলেন। যদিও তাদের সংখ্যা ক্রমান¡য়ে বৃদ্ধি পেতে থাকবে; কিন্তু মনে-প্রাণে ও লক্ষ্যে তারা এক এবং অভিন্ন। তারা পরস্পর পরস্পরের জন্য কি উপলব্ধি করবেন? তারা পরস্পর পরস্পরকে একই কাজ করতে দেখবেন। তারা দেখবেন যে, তাদের অন্য ভাইয়েরাও এমন কার্যে ব্যস্ত যা তাদের পরস্পরের জন্য মঙ্গলজনক। তাদের অবস্থা তখন এমন হবে যে, তাদের মধ্যে কোনও একজন ভীষণ দুঃখে পতিত হলে তিনি এমনভাবে দীর্ঘশ¡াস ফেলবেন যাতে অন্য কেউ তা টের না পান। যদি অন্যরা তার দীর্ঘশ¡াস সম্বন্ধে টের পেয়েই যায়, তখন সবাই একসঙ্গে দীর্ঘশ¡াস ফেলতে থাকবেন এবং তাকে দুঃখ-মুক্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। যদি প্রতিটি মানুষ তার কাজে ও লক্ষ্যে বিশ¡স্ত এবং সৎ হন, তাহলেই এ সম্ভব হবে। কিন্তু এমন একটি রাষ্ট্রের কথা কল্পনাও করা যায় না যেখানে প্রত্যেকটি নাগরিক সৎ এবং বিশ¡স্ত হবে। আমাদের প্রভুর পরিকল্পনাও এরূপ নয় যে, একটি দেশের সমস্ত মানুষই সৎ ও সাধু হবে। তা হলে আলোচিত রাষ্ট্র ও বর্তমান রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পার্থক্য কি? একটি রাষ্ট্র যত আদর্শবানই হোক না কেন তাতে কিছু লোক অবশ্যই থাকবে যারা অসৎ এবং অবিশ¡স্ত। তাদের অবস্থা কেমন হবে? তাদের কাজ হবে অন্য লোকদের মাঝে ঘৃণা, সংশয় এবং বিভেদ ছড়ানো। কিন্তু যেহেতু রাষ্ট্রের কর্ণধার হবেন একজন সৎ ব্যক্তি তাই ঐসব অসৎ ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য কখনই সফল হবে না। এমন ব্যক্তিদেরকে সব সময়ই কড়া নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে। আমি জানি, আমার ভাইদের মধ্যে কেউ কেউ বলবেন, ‘‘এমন একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কখনোই সম্ভবপর নয়।’’ তাহলে আমাকে দয়া করে বলবেন কি, কোন্টি সম্ভব? আপনারা কি বলবেন যে, আমেরিকা, রাশিয়া, বৃটিশ, ফরাসী বা আরবদের মত সরকারই সম্ভব? আপনারা কি বলতে চাইছেন যে, জগতের সমস্ত সুখ কেবল আমেরিকান, রাশিয়ান, বৃটিশ, ফরাসীরা বা আরবরাই ভোগ করছেন? যদি এরূপই বলেন, তা হলে বলব যে, আপনারা অন্ধকারে নিমজ্জিত আছেন। আপনারা খোলা চোখ দিয়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। দুনিয়ার প্রচলিত অবস্থার প্রতি আপনারা সম্পূর্ণ অন্ধ। পৃথিবীর সর্বত্রই অশান্তির বাতাস বইছে। কোথাও কম আর কোথাও বেশী – এই যা পার্থক্য। তবে এতক্ষণ যে রাষ্ট্রের কথা বলা হলো তা যদি পৃথিবীর কোন প্রান্তে থেকে থাকে তবে তা হবে অবশ্যই প্রচুর মর্যাদার অধিকারী। যদি কোন ব্যক্তি এরূপ একটি রাষ্ট্রের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে তবে তার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে কি বলা যাবে? তার উদ্দেশ্য কি ভাল না মন্দ? এমন ব্যক্তিকে কি আপনারা পাগল বলবেন? তা হলে আপনারাই আমাকে দেখিয়ে দিন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বা চরম ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বা পৃথিবীর বর্তমান বিষাক্ত আবহাওয়া থেকে উদ্ধারের জন্য আপনি কি কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন? আপনারা হয়ত বলতে পারেন যে, আপনারা বিভিন্নভাবে কত ভাল ভাল কাজ করে যাচ্ছেন, যেমন কেউ হয়ত দুর্গতদের সেবায় থলের অর্থ ব্যয় করছেন; কেউ আবার হাসপাতাল কিংবা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, প্রভৃতির জন্য অর্থ- সম্পদ দান করছেন। আমি জানি আপনারা সমাজের উন্নতির জন্য হাজার হাজার ভাল কাজ করছেন। কিন্তু এর সার্বিক ফলাফলটা কি? দিনে দিনে কি অশান্তি বাড়ছে না? অনেকে হয়ত বলবেন, ‘‘সমাজ এবং দেশের উন্নতির জন্য আমরা আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি তা সত্বেও যদি আমাদের দেশ ও সমাজ উন্নতি লাভ না করে, তা হলে এর বেশী আমরা আর কি করতে পারি? আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, এ আমাদের দূর্ভাগ্য। আমরা আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি না। আমরা যা করেছি তাই নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।’’ এব্যাপারে আমি বলব ‘‘না, আমরা আমাদের সর্বশেষ চেষ্টাটি করিনি, আমাদের করার মত হয়ত আরো অনেক কিছু বাকী আছে। আমরা যা কিছু করেছি তা নিয়ে হয়ত আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি। কিন্তু আপনি কি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবেন যে, আমাদের কাজে সৃষ্টিকর্তা সন্তুষ্ট? আপনি হয়ত বলবেন, আমরা যখন যাবতীয় ভাল কাজগুলোই করছি তখন সৃষ্টিকর্তা আমাদের কাজে সন্তুষ্ট হবেন না কেন? অবশ্যই তিনি আমাদের উপর সন্তুষ্ট।’’ এব্যাপারে আমি বলব, ‘‘এ শুধু আপনার অনুমান মাত্র। তিনি আমাদের কাজে সন্তুষ্ট নাও হতে পারেন। এমনও হতে পারে যে, সৃষ্টিকর্তা আমাদের কাছে অন্য কিছু চাচ্ছেন।’’ আপনাদের অনেকে এ যুক্তি দেখাতে পারেন যে, ‘‘আমাদের পবিত্র গ্রন্থে ভাল কাজের বর্ণনা দেয়া আছে এবং আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থের বিধান মোতাবেকই আমরা সব কাজ করে যাচ্ছি। তা হলে কেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদের কাজে সন্তুষ্ট হবেন না?’’ এখানে আমি একটি উদাহরণ দিতে চাই ঃ আমরা সবাই জানি যে, পানি এবং সার উভয়ই গাছ বৃদ্ধির জন্য জরুরী। আমরা যদি গাছে পানি এবং সার প্রয়োগ করি, তাহলে আমরা কি বলতে পারব যে, সব ক্ষেত্রে গাছের বৃদ্ধি হবেই এবং আমাদের ফল দিবে? না, সর্বক্ষেত্রে তা সত্য নয়। গাছের প্রধান মূলটি যদি কেটে ফেলা হয় বা পঁচে গিয়ে থাকে, তা হলে পানি বা সার যতই প্রয়োগ করি না কেন গাছের বৃদ্ধি বা ফল কোনটিই আমরা আশা করতে পারি না। যখন আমরা দেখি যে, নিয়মিত পানি বা সার প্রয়োগ করা সত্ত্বেও গাছের বৃদ্ধি বা ফল হচ্ছে না, তখন এর প্রতিকারের জন্য একজন বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করা প্রয়োজন। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে আমাদের একজন উদ্ভিদতত্ত্ববিদের সাথেই আলোচনা করা উচিত। কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপারে আমরা কার সাথে আলোচনা করব? যখন আমরা দেখছি যে, ভাল কাজ করা সত্ত্বেও আমাদের সমাজ বা দেশের উন্নয়নে ব্যর্থ হচ্ছি, তখন কি ব্যর্থতার আসল কারণ অনুসন্ধান করা আমাদের উচিৎ নয়? তখন কি আমরা নিশ্চেষ্টভাবে বসে থাকতে পারি বা আমাদের কি তখন সন্তুষ্ট থাকা উচিত যে, আমরা আমাদের কাজ সঠিকভাবেই সুসম্পন্ন করেছি? এ ব্যাপারটি নিয়ে আমাদের কি গভীর ভাবে চিন্তা করা উচিত নয়? এ বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করা আমদের উচিত নয় কি? আমাদের এখন কি করা উচিত? আমি বিনয়ের সাথে আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি যে, যদি আপনাদের কাছে এসমস্ত সমস্যার পরিপূর্ণ সমাধানের কোন পরিকল্পনা বা কর্মসূচী থেকে থাকে, তা হলে দয়া করে আমাদের তা দেখান। আর যদি আপনার কাছে তা না থাকে, তা হলে আমাদেরটা দেখুন।
আমাদের পরিকল্পনা এবং কর্মসূচী সফলতার সঙ্গে কিভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব এর প্রধান দিকটি নিয়ে এখানে আমি আলোচনা করব। আমরা অনেক সম্মেলনের কথা শুনে আসছি; যেমন, ইসলামী সম্মেলন, বিশ¡ শান্তি সম্মেলন, বিশ¡ ধর্মীয় সম্মেলন প্রভৃতি। কিভাবে এবং কেন এগুলো হচ্ছে? এগুলো সংঘটিত হচ্ছে এ জন্যে যে, পৃথিবীতে কিছু সৎ ও সাধু লোক বসবাস করছেন যারা আন্তরিকভাবেই লোকজনের দুঃখ-বেদনা উপলব্ধি করছেন এবং তারা চেষ্টা করছেন লোকজনের দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য তাদের এ প্রচেষ্টার সার্বিক ফলাফল আমাদের গোচরিভূত. অর্থাৎ ফলাফল শূণ্য। যাহোক, এখানে আমার আলোচনার উদ্দেশ্য তাদের গুরুত্ব কমানোর জন্যে নয়, বরং এগুলো আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পক্ষে সরাসরি প্রেরণা দান করছে। যদি বিভিন্ন জাতীয় লোকজন পরস্পরের স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যে এক সাথে বসতে পারেন এবং অভিন্ন মতামত গ্রহণ করতে পারেন তা হলে মানুষের জীবনের জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে আলোচনা করার জন্যে একসাথে বসা এবং সর্বসম্মতভাবে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কেন সম্ভব হবে না? সকল মানুষের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ধর্মীয় বিভেদ যদি একটি বড় বাধা হিসেবে গণ্য না হয়, তা হলে এ বাধা ধ্বংস করতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? যখন আমরা সমস্ত মানুষের ঐক্যই চাই তখন আমরা কেন বিভেদের এ পোষাক আমাদের কাঁধে বহন করে চলেছি? যদি আপনি বলেন যে, সব ধর্মের প্রধান প্রধান মূল নীতিগুলো একই, তা হলে ছোট-ছোট নীতিগুলো কেন আমরা এত শক্ত করে আঁকড়ে রেখেছি? ধর্ম যদি শান্তির জন্য কোন শর্তই না হবে, যদি আমরা ধর্ম ছাড়াই শান্তি পেতে পারি, তা হলে আমরা ধর্মীয় আবরণ কেন ধারণ করে থাকব? শান্তির জন্য ধর্মীয় বিভেদ যদি বাঁধা হিসেবে বিবেচ্য না হয়, তা হলে ধর্মকে একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দিতে এত ভয় কেন? প্রকৃতপক্ষে আমরা সবাই আমাদের নিজ নিজ ধর্মকে অত্যধিক ভালবাসি; কিন্তু বাস্তব ঘটনা হল, সত্য ধর্ম কি তা আমরা জানি না। এ কারণেই যখন প্রভুর পক্ষ থেকে কোন এক ব্যক্তি ধর্মের সত্য চিত্রটি তুলে ধরেন, আমরা ভাবি এ লোক আমাদের ধর্ম ধ্বংস করতে এসেছে; তখন স্বাভাবিকভাবেই আমরা সে সত্য ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাই। যাহোক, সত্য ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা এখানে আমার লক্ষ্য নয়; কিন্তু আমাদের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা কতদূর সম্ভব তা দেখানই আমার লক্ষ্য। আমি আগেই অলোচনা করেছি যে, কিছু সৎ এবং কিছু সাধু লোক সারা বিশ¡ জুড়ে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ উদ্দেশ্যে যদি প্রয়োজন হয় তারা তাদের জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত।
আমাদের পরিকল্পনা এবং কর্মসূচী কী? এ কর্মসূচীর লক্ষ্য কী? এর কোন মূল্য আছে কি? এর গুরুত্ব কতখানি? আমাদের প্রথমে তা জানা উচিত। আমাদের লক্ষ্য এই যে, আমরা আমাদের জীবনে শান্তি চাই এবং মৃত্যুর পরে মুক্তিও চাই। কে তা চায় না? আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে রাস্তার ভিখারী পর্যন্ত প্রত্যেকেই তা চায়। তা হলে সর্ব প্রথম তা অর্জন করাই হচ্ছে অত্যাবশ্যক বিষয়। এখন এ পৃথিবীতে শান্তি দেয়া এবং মৃত্যুর পর মুক্তি দেয়ার মালিক কে? অবশ্যই এর উত্তর – আমাদের সৃষ্টিকর্তা। বর্তমান জীবনে আমরা কেন শান্তি পাচ্ছি না এবং কেন তিনি আমাদের শান্তি দিচ্ছেন না এবং দুঃখ দুর্দশা দূর করছেন না? উত্তর হচ্ছে – আমরা তাঁর আইন-কানুন মেনে চলছি না। তাঁর আইন-কানুন কী এবং আমরা কেন তা মেনে চলছি না? উত্তর হচ্ছে, আমাদের সরকার সৃষ্টিকর্তার আইন-কানুন ব্যাখ্যা করছে না, আবার কার্যকরও করছে না। অধিকন্তু আমরা সৃষ্টিকর্তার বিধি-বিধান সম্বন্ধে বেশি কিছু জানিও না। ধর্মের বাস্তবতা নিয়েও আমরা সংশয়পূর্ণ। আমরা জানিনা কোনটি সত্য। ইসলাম সত্য না খ্রীষ্ট ধর্ম সত্য? হিন্দু ধর্ম সত্য না বৌদ্ধ ধর্ম সত্য? যদি একটি সত্য হয় এবং বাকী সবগুলো ভ্রান্ত হয়, আর যেহেতু সত্য ধর্ম ও মিথ্যা ধর্মগুলোর সঙ্গে একই মত আচরণ করা হচ্ছে, তা-হলে অসৎ মানুষগুলোর সঙ্গে সৎ মানুষগুলোকেও কেন শাস্তি দেয়া হচ্ছে না এবং তাদেরকেও কেন কয়েদখানায় প্রেরণ করা হচ্ছে না বা অসৎ লোকগুলোকেও কেন সৎ লোকগুলোর সঙ্গে সমান আচরণ করা হচ্ছে না এবং মুক্তি দেয়া হচ্ছে না? তা হলে সত্য ধর্ম কি ভ্রান্ত ধর্মের সমতূল্য? অন্যদিকে সব ধর্মই যদি সত্য ধর্ম হিসেবেই বিবেচ্য হয়, তা হলে আমাদের ধর্ম ভিত্তিক আলাদা আলাদা রাষ্ট্র নেই কেন বা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক পৃথক রাষ্ট্রীয় আইন নেই কেন, যদি আমাদের সৃষ্টিকর্তাই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক পৃথক ধর্মীয় বিধি-বিধান জারি করে রেখে থাকেন বা আলাদা আলাদা আইন এবং বিধান দিয়েছেন বিশ্বাস করা হয় এক রাষ্ট্রে বিভিন্ন লোকজনের জন্য আলাদা নিয়ম এবং আলাদা সরকার থাকা অচিন্তনীয়। তা হলে এক সৃষ্টিকর্তার রাজ্যে বিভিন্ন মানুষের জন্য বিভিন্ন নিয়ম থাকা কি চিন্তনীয়? আমাদের সরকার যদি সার্বভৌমত্বের বিরোধী বলে একই রাষ্ট্রে বসবাসকারী বিভিন্ন নাগরিকদের জন্য একাধিক সরকার বা একাধিক সংবিধানের অস্তিত্ব সহ্য করতে না পারে, তা হলে আমাদের সৃষ্টিকর্তা কি তাঁর একই রাজ্যে বসবাসরত মানুষের জন্য একাধিক স্রষ্টা বা বিধানের অস্তিত্ব সহ্য করবেন? তা কি তাঁর সার্বভৌমত্বের বিরোধী হবে না? আমাদের সরকার ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে যদি রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে; তা হলে আমাদের সৃষ্টিকর্তা কি ক্ষুব্ধ হবেন না যদি কেউ সৃষ্টিকর্তার নীতির বিপরীতে কোন নীতি প্রয়োগ করে? আমাদের সরকার ক্ষুব্ধ হবে যদি কোন ব্যক্তি সরকারের উদারতাকে দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করে; তা হলে আমাদের সৃষ্টিকর্তা কি ক্ষুব্ধ হবেন না যদি কোন ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার উদারতাকে দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করে? প্রত্যেক সরকারই তার প্রতিদ্বন্দ¡ীকে ধ্বংস করতে দৃঢ়-সংকল্প, তা হলে আমাদের সৃষ্টিকর্তা কি তাঁর প্রতিদ্বন্দ¡ীকে ধ্বংস করতে দৃঢ়-সংকল্প নন? কে বেশী ক্ষমতাধর? আমাদের সরকার না সৃষ্টিকর্তা? এখনও কি কোন সরকার সৃষ্টিকর্তাকে দ্বন্দ¡ যুদ্ধে আহ্বান করতে সাহস করছে? এখনও কি কোন সরকার তাদের সৃষ্টিকর্তার কশাঘাত দেখার সাহস করছে? কশাঘাত এ পর্যন্ত তারা যা ভোগ করেছে এতেই কি তারা সন্তুষ্ট নয়? কোন্টি সঠিক বা কোন্টি ভ্রান্ত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমাদের সরকার কি এখনও এগিয়ে আসবে না? আমার ভাইয়েরা! এ পরিকল্পনা এবং কর্মসূচী কি আমাদের যে এর বাস্তবায়ন করা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে? এ পরিকল্পনা ও কর্মসূচী যদি আমাদের সৃষ্টিকর্তার হয়ে থাকে, তা হলে তিনি কি তাঁর পরিকল্পনা এবং কর্মসূচী বাস্তবায়নে যথেষ্ট শক্তিশালী নন? এক্ষণে আমাদের অনুরোধ, বিশে¡র সমস্ত রাষ্ট্রের সরকারসমূহ রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিদ, প-িত, বুদ্ধিজীবীগণ এগিয়ে এসে মীমাংসা করবেন কোন্টা সঠিক এবং কোন্টা অঠিক এবং যা সঠিক তা গ্রহণ করবেন। সময় খুবই সংকীর্ণ। সৃষ্টিকর্তার চাবুক আমরা ইতোমধ্যেই অবলোকন করছি। এখন কেবল আঘাত শুরু করা বাকী। এ আঘাত থেকে কারো রেহাই নেই। কারণ, আমরা সবাই আমাদের বিশ¡াস এবং কাজের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, কোন না কোনভাবে ভীষণ অপরাধ করে ফেলেছি। সৃষ্টিকর্তার কাছে আজ আমরা মহাপাপী। সুতরাং সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সবাইকে খুবই তৎপর হতে হবে। অর্থাৎ কোন্টি সঠিক আর কোন্টি বেঠিক সে বিষয়ে বিচার-বিবেচনা করা এবং যা সঠিক তা গ্রহণ করা, যদি আমরা সবাই সৃষ্টিকর্তার কশাঘাত থেকে আমাদের প্রিয় আত্মাকে আদৌ বাঁচাতে চাই। আমরা যত ভাল কাজই করে থাকি না কেন, যদি আমরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি, সরকার যদি ন্যায় বিচারক হয়, তা হলে সে বিদ্রোহীদের শাস্তি প্রদান করবেই; বিদ্রোহীর কোন ভাল কাজই ভাল হিসেবে ধরা হয় না। তেমনি ভাবে, আমরা যতবড় সাধুই হয়ে থাকি না কেন এবং যত ভাল কাজই করি না কেন, আমরা যদি সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ করি বা অপর কাউকে এরূপ করতে সহায়তা করি; অর্থাৎ আমরা এমন সব আচরণ করি যাতে প্রভু বলতে যে একজন আছেন আমরা তার কোন তোয়াক্কাই না করি বা অপর কাউকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার করতে বাধা না দেই, তা হলে আমাদের প্রভু কি আমাদের শাস্তি দিবেন না? এতদিন আমাদের দয়াল প্রভু অত্যন্ত ধৈর্যশীল ছিলেন, কিন্তু এখন যখন মানুষের একটি দল স্রষ্টার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করে ফেলেছে এবং অপর দলটি এ হস্তক্ষেপে নীরব সমর্থন দিয়ে আসছে; এভাবে আমরা উভয়েই স্রষ্টার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করার অপরাধে অপরাধী। সুতরাং আমরা সৎ এবং অসৎ সবাই মহাপাপে পাপী। আমাদের অপরাধ যেমন ভীষণ, তেমনি ভীষণ শাস্তিই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এক্ষেত্রে আমদের কার্যক্রম হল লোকজনদের সঠিক ও অঠিক নির্ণয়ে সাহায্য করা, যাতে আমরা ইহকাল ও পরকালের শাস্তি থেকে আমাদের নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারি। এতে কি বুঝা যাচ্ছে না আমাদের পরিকল্পনাটির কোন মূল্য আছে কি নেই? আমার ত মনে হয়, এ-ই হচ্ছে সব চাইতে দরকারী বস্তু যা আমাদের সর্ব প্রথম পাওয়া প্রয়োজন এবং এ-ই হচ্ছে আমাদের সর্ব প্রধান কর্তব্য যা আমাদের এই মুহূর্তে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। সুতরাং সত্য ও মিথ্যা নির্ণয় করা এবং সত্য জানার পর তা সমর্থন করার জন্যে এ মুহূর্তে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের বিশ¡াস, আমাদের বাংলাদেশ সরকার আমাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সত্য ও মিথ্যা নির্ণয় করা এবং সত্য জানার পর তা উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য যদি আমাদের সরকার স¤মুখে এগিয়ে আসে এবং স্রষ্টার শাস্তি থেকে আমাদেরকে বাঁচাবার চেষ্টা করে – এরূপ করা কি তাদের জন্য সহজ হবে না যদি তা তারা আদৌ করতে চায়? তা হলে আমরা কেন ভাবব এ কাজ করা আমাদের জন্য কঠিন? আমাদের উপলব্ধি ত এরূপ যে, স্রষ্টার শাস্তি থেকে আমাদের রক্ষা করা সরকারেরই দায়িত্ব এবং এ উদ্দেশ্যে সরকার কোন পদক্ষেপ নিলে আমাদের উচিত তাকে সাহায্য করা। সুতরাং আমরা আমাদের সরকারকে অনুরোধ করছি স্রষ্টার সে শাস্তি যা অত্যাসন্ন এবং যে শাস্তি আমরা কখনো দেখিনি তা থেকে রক্ষা করতে।
সে যাহোক, আমাদের সরকারকে এ উদ্দেশ্যে সাহায্য করার জন্য আমরা কিছু পরামর্শ দিচ্ছি। কোন সরকার এটাকে যত সহজই মনে করুক না কেন বাস্তবে তা এত সহজ নাও হতে পারে। বিশে¡র সমস্ত দেশেই বহু ধর্মমত প্রচলিত আছে এবং প্রত্যেক ধর্মের বহু অনুসারীও রয়েছে, আবার প্রত্যেক ধর্মেই ভিন্ন ভিন্ন মতের বহু দল-উপদল রয়েছে। আর যেহেতু আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে, সেহেতু ইচ্ছা করলেই এক্ষণে কেউ নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। আবার কোন দেশের সরকার, উদাহরণ স্বরূপ, ভারতের সরকার, যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক যেখানে হিন্দু, সে হিসেবে হিন্দুকেই যদি রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং বাংলাদেশ সরকার যেমন এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমান, সেহেতু এখানে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে, ভারতের মুসলমান এবং বাংলাদেশের হিন্দু নাগরিকবৃন্দ সংখ্যালগিষ্ঠ হওয়ার কারণে হীনমন্যতার জটিলতায় ভুগবে। সুতরাং ভারত সরকার কর্তৃক হিন্দুকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা বা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করলেই পৃথিবীতে শান্তি এসে যাবে না, বরং রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, মানুষের সঙ্গে মানুষের পূর্ব হতেই বিদ্যমান হিংসার আগুনকে আরো উস্কিয়ে দেয়া হবে। সুতরাং ইহা কোন সমাধান নয়; বরং এতে সমস্যা আরো বৃদ্ধিই পাবে। আবার এক ইসলামের মধ্যেও বহু মতবাদ বিদ্যমান, যেমন – শীয়া-সুন্নী, আহ্মদী, মাযহাবী, লা-মাযহাবী বিভিন্ন তরিকার পীর-ফকির-দরবেশ, মাজার পূজারী, বাতেনী, মারেফাতী, দরবেশী, তাবলীগঃ, প্রভৃতি। আমরা কিছু-কিছু ইমাম মেহদীকেও লক্ষ্য করছি যারা মাথা জাগাচ্ছে। সুতরাং ইহা যত সহজ ধারণা করা হয়েছিল আসলে তা এত সহজ নয়। আবার কোন একটা মতবাদকে মর্যাদা দিয়ে বাকী সব মতবাদগুলোকে যথাযথভাবে বিবেচনা না করেই একেবারে বাতেল গণ্য করাও সংগত বা ন্যায়নিষ্ঠ হবে না। ইহা গণতান্ত্রিক নীতি-রীতির বিরোধী। সুতরাং ন্যায় বিচারের স্বার্থে প্রত্যেককেই তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে এবং জগদ্বাসী মানুষের উদ্ধারের জন্য তারা কি করতে চান তাও আমাদের জানা প্রয়োজন। তা হলে আমাদের সরকারগুলো কি করবে?
এ বিষয় আলোচনা করার পূর্বে আমাদের রাষ্ট্রগুলোর বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করছি। আমি উপরে আমদের স্রষ্টার রাজত্বে তাঁর একটি মাত্র সরকারী প্রশাসন এবং একটি মাত্র কানুন বা একক বিধানের কথা আলোচনা করেছি। স্রষ্টা মাত্র একজন, রাজত্বও একটি এবং তার বিধানও একটিই; কিন্তু বাস্তবে শত শত রাষ্ট্র, শত শত সরকার এবং শত শত বিধান দেখতে পাচ্ছি। বাস্তবে এটা কি? বিশে¡র প্রত্যেকটি সরকারই নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতার কথা বলছে। প্রকৃতপক্ষে তারা কি সার্বভৌম? তা হলে, আমাদের জাতিসংঘ করছেটা কী? আমাদের রাষ্ট্রগুলো কি জাতিসংঘের অন্তর্ভূক্ত রাষ্ট্র নয়? রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কি প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা দিয়ে বলতে পারবেন যে, জাতিসংঘ তাদের অধীন? প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের অভ্যন্তরস্থ রাষ্ট্র তারাও। অবশ্য পৃথিবীর বর্তমান অবস্থায় তারা জাতিসংঘকে কোন না কোন ভাবে প্রভাবানি¡ত করছে মাত্র। যদি তারা কখনও এরূপ করেও থাকে, তবে তারা তা অন্যায় করছে। সুতরাং আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব সম্বদ্ধে যা-ই বলি না কেন, প্রকৃত অর্থে আমরা কেউই সার্বভৌম নই। একটি বিষয় আমি এখানে যোগ করতে চাচ্ছি – একদিকে কোটি কোটি মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে, আর অপরদিকে আমরা নিরস্ত্রীকরণ আলোচনা এক কনফারেন্স টেবিল থেকে আরেক কনফারেন্স টেবিলে স্থানান্তর করে বছরকে বছর দীর্ঘায়িত করেই চলেছি। কিন্তু আমরা কি চিন্তা করে দেখেছি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য আমরা কত ব্যয় করছি এবং এদের জীবন ধ্বংসের জন্য কত ব্যয় করছি? সমস্ত বিশ¡কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সর্বাত্মক ক্ষমতা দিয়ে যদি জাতিসংঘকে একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারে পরিণত করা হয়, সমস্ত যুদ্ধ-সামগ্রী উঠিয়ে নেয়া হয় এবং জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তর করা হয় বা নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয় বা মানব জাতির কল্যাণের জন্য ব্যবহার করা হয় এবং শুধুমাত্র একটি শান্তি বাহিনী রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য যৎসামান্য ব্যয় বরাদ্দ ছাড়া এ খাতে ব্যয় বরাদ্দ শূণ্য রাখা হয়, তা হলে কি লক্ষ লক্ষ অনাহারক্লিষ্ট মানুষদের রক্ষা এবং সমগ্র মানব জাতির অধিকতর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে আমরা সক্ষম হব না এবং তা কি সম্ভব নয়? আমরা কি কোন না কোন ভাবে আমেরিকা বা রাশিয়া রাষ্ট্র দুটির প্রভাবাধীন নই? তাদের কেউ কি সমস্ত বিশ¡কে শাসন করতে সক্ষম নয়? খ্রীষ্ট-পূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে যদি মহাবীর আলেকজা-ার সুদূর গ্রীক থেকে হিন্দুস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখ-ের উপরর রাজত্ব কায়েম করতে পারেন, খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে যদি মুসলমানরা আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখ-ের উপর শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়ে থাকেন, খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে যদি মহামতি আকবর এবং আলাউদ্দিন খিলজী এ উপমহাদেশ শাসন করতে সক্ষম হয়ে থাকেন, তা হলে সর্বশেষ আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে সুসজ্জিত একক সরকারের বিধি-বিধান দ্বারা পৃথিবী শাসন করা কি অসম্ভব কিছু? যদি আমরা মনে করি যে এ অসম্ভব, তা হলে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, আমরা মধ্যযুগেরও পশ্চাতে অবস্থান করছি। যে বৈজ্ঞানিক যুগের জন্য আমরা গর্ব করছি আমরা সে যুগে বসবাস করছি না। আমাদের স্রষ্টা অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে একটা অত্যাধুনিক মস্তিষ্ক দান করেছেন যদ্বারা আমরা মা ধরিত্রীর সীমা অতিক্রম করে মহা বিশ¡কে জয় করতে সমর্থ হয়েছি, তা হলে আমরা অবশ্যই একটি মাত্র সরকারের একই বিধান দ্বারা সারা বিশ¡ শাসন করতে সক্ষম হব যদি সরকার পরিচালনার ভার একজন পরিশুদ্ধ ব্যক্তির হাতে থাকে। এই হল আমাদের সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা।
অনেকে হয়ত প্রশ্ন উত্থাাপন করতে পারেন, এক জাতির লোক অন্য জাতির শাসন সহ্য করতে পারে না। সুতরাং সমস্ত বিশে¡ একটি মাত্র সরকার একটি মাত্র বিধি-বিধান দ্বারা বিশ¡ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তারা করবেটা কি? তারা কি পরস্পর যুদ্ধ করবে? যুদ্ধের জন্য তারা অস্ত্র-শস্ত্র পাবে কোথায়? পরস্পর যুদ্ধ করার জন্য কোন অস্ত্রই ত ফেলে রাখা হবে না। সুতরাং তাদের এ যুদ্ধাবস্থা মারাত্মক কিছু নয়। কিছু সময়ের জন্য হয়ত তারা মল্ল যুদ্ধ করবে এবং কিছু আমোদ-স্ফুর্তি ভোগ করবে। কিছুক্ষণ পরেই তারা আবার বন্ধু হয়ে যবে। কিরূপে? যদি আমরা কখনও এরূপ চিন্তা করি যে, আমি একজন বাঙ্গালী, সে একজন পাকিস্তানী, সে একজন হিন্দুস্তানী এবং এরূপ আরো অনেক। এরূপ ভাবে চিন্তা-ভাবনা করলেই কেবল পরস্পরের মধ্যে ঘৃণা বা বিভেদের সৃষ্টি হতে পারে। যদি আমরা এরূপ চিন্তা-ভাবনা না করি, তা হলে আমাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকবে কি? না। আমরা কি তখন পরস্পর পরস্পরকে ভাই হিসেবে মনে করতে পারব না? প্রকৃতপক্ষে আমরা সবাই পরস্পর পরস্পরের ভাই, কিন্তু বিতাড়িত শয়তানই এতকাল যাবৎ আমাদের উপর পরিপূর্ণ কৃতিত্বের সঙ্গে শাসন করে আসছে।
কিন্তু এখন সময় এসে গেছে। সত্য প্রকাশিত হবে, মিথ্যা দূরীভূত হবে। স্রষ্টা পরিকল্পনা করেছেন, তিনি পৃথিবীতে তাঁর অস্তিত্ব বিকশিত করবেন। সুতরাং শয়তান আর বেশীক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু চলে যাওয়ার পূর্বে টিকে থাকার জন্য সে তার শেষ চেষ্টা করবে- এমন একটা মরণ কামড় দিবে যার তীব্রতা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারি না।
এখানে অনেকে বলতে পারেন যে, নিউক্লিয়ার অস্ত্রধারীদের কেউ জাতিসংঘের কাছে তাদের হস্তান্তর করতে রাজি হবে না বা সে গুলো অকার্যকর করতেও রাজি হবে না। কেন? তারা নিজেরা কি শান্তি চায় না এবং বিশে¡র শান্তির কথা বলে না? হ্যাঁ, তারা শান্তির কথা অতি উচ্চস্বরেই বলে এবং একই সাথে তারা বাজেটের বড় অংশটি ব্যয় করছে অস্ত্র তৈরীতে ও ঐসবের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। কি পরিহাস! তারা যখন কথা বলে, মিথ্যা কথা বলে। কাজ কর্মেও তারা আন্তরিক নয়। তারা মতলববাজ। তারা অপরাধী। তারা তাদের নিজেদের দোষ দেখে না। তারা কথা চালাচালি করে বছরের পর বছর পার করে দিতে পটু; কিন্তু কোন দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে পৌঁছতে অসমর্থ। তারা এক হাতে শান্তির জন্য হিতোপদেশ বিতরণ করছে অপর হাতে বিশে¡ উত্তেজনা ও নৈরাজ্য বৃদ্ধির জন্য অস্ত্র তৈরীতে ব্যস্ত। কত হাস্যকর! অথচ শান্তির জন্য বিশ¡ তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে! কত নির্বোধ আমরা! আমরা তাদের কাছ থেকে এক বিন্দু শান্তিও আশা করতে পারি না। আপাতঃদৃষ্টিতে তাদেরকে লোভনীয় দান-বাক্স নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা যাবে, কিন্তু দান-বাক্সটি খুলতেই দেখা যাবে এ মাকাল ফলে পূর্ণ। আমি আপনাদের বলছি যে, তারা অপরাধী. সুতরাং তাদের পক্ষে বিবাদের মীমাংসা করা সম্ভব নয়। তাদের বিবাদের মীমাংসার জন্য একটি তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন। তা হলে এ তৃতীয় পক্ষটি কে? এরা হচ্ছেন বিশে¡র সৎ এবং সাধু ব্যক্তি যারা সত্যের জন্য নিজের ব্যক্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিতে সর্বদা প্রস্তুত; এরা হচ্ছেন সৎ এবং সাধু ব্যক্তি যারা বিশে¡র শান্তির জন্য এবং মৃত্যুর পর মুক্তির জন্য তাদের সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত; অর্থাৎ তাদের মহান প্রভুর সর্বোচ্চ সন্তুষ্টির জন্য তারা তাদের জীবন উৎসর্গ করতে সর্বদা প্রস্তুত। তারা সবাই অবশ্য একই দেহে লীন। তারা অবশ্যই একই দেহে পাহাড়ের মত ঐক্যবদ্ধ; না, পাহাড়ের চাইতেও বেশী ঐক্যবদ্ধ। এ একতা ভাঙ্গার ক্ষমতা কোন এটম বোমারও নেই। কারণ, তারা এটমের চেয়েও বেশী সূক্ষ¥। একটি এটম যত সূক্ষ¥ই হোক, এটা এ বিশে¡রই পদার্থ। কিন্তু সৎ এবং সাধু ব্যক্তিদের ঐক্য এমনই সূক্ষ¥ যে, তা এ বিশে¡র কোন বন্তুই নয়, বরং তা হচ্ছে এ দুনিয়ার বুকে তাদের প্রভুর জ্যোতি বিকিরণকারী এক একটি আণবিক রশ্মি। সুতরাং দুনিয়ার কোন আণবিক বোমা প্রভুর এ জ্যোতি কী ভাবে ধ্বংস করবে? এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ একতা কী ভাবে অর্জন করা সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পূর্বে আমি আমার মনুষ্য ভাইদের জিজ্ঞাসা করতে চাই, এ জাতীয় একতা আপনারা পছন্দ করেন কি না? এটা আপনি পছন্দ করবেন কি করবেন না তা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যাহোক, আমি উপরে তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেইনি – একটি হচ্ছে আমি সরকার বা প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে বিভিন্ন মতবাদের বেড়াজালের মধ্যে ফেলে রেখে এসেছি; এ বেড়াজাল থেকে বের করে আনতে আমাকে তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমি আমার মনুষ্য ভাইদেরকে শয়তানের প্রভাবাধীনে ভূতাবিষ্ট করে ফেলে এসেছি; এ ভূতাবেশ অবস্থা থেকে তাদেরকে মুক্ত করার জন্য আমাকে আমার মন্ত্র পাঠ করতে হবে। তৃতীয়টি হচ্ছে, আণবিক বোমার সাথে যুদ্ধ করতে সমর্থ হওয়ার জন্য কী ভাবে পাহাড়ের মত দৃঢ় ঐক্য অর্জন করা যায়, আমাকে তা দেখাতে হবে।
এখানে আমি দ্বিতীয় প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করব; অর্থাৎ কী ভাবে আমরা সবাই সত্যিকারের ভাই ভাই ঃ আপনি কে? আমি মিঃ এক্স যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এবং আপনি? আমি মিঃ ওয়াই, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। এবং আপনি? আমি মিঃ জেড, সৌদি আরবের বাদ্শাহ। আর আপনি? আমি মিঃ ডব্লিউ, ইরানের শাহেন শাহ্। (আমি এখানে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, সৌদি আরবের বাদশাহ্ এবং ইরানের শাহেন শাহ্-এর কথা উল্লেখ করেছি ক্ষমতা ও অর্থের প্রতীক হিসেবে, অন্য কোন ভাবে বিশেষায়িত করার জন্য নয়) আর আপনি কে? হে আমার ক্ষুদ্রকায় নগ্নপ্রায়, শীর্ণ কাঁধের উপর বোঝার ন্যায় ভারী মাথা নিয়ে, মোটা মোটা জোড়াযুক্ত আরো অধিক ক্ষীন এবং কৃশকায় কাল রং-এর পায়ের উপর ভর করে শূন্যের মাঝে হাত বাড়িয়ে পরস্পর বিচ্ছিন্ন পঞ্জরাস্থি বের করে দ-ায়মান, আপনি কে? আমি একজন আফ্রিকান, আমি একজন এশিয়ান, আমি একজন ল্যাটিন আমেরিকান। আপনি কি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মিঃ এক্স, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মিঃ ওয়াই, সৌদি আরবের বাদশাহ্ মিঃ জেড, ইরানের শাহেন শাহ্ মিঃ ডব্লিউ-কে চিনেন? না। কেন আপনি তাদের চিনেন না? এর উত্তর হচ্ছে, ‘‘তাদের চিনে কী লাভ?’’ আপনি কি তাদেরকে ভয় পান না? উত্তর হচ্ছে, ‘তাদেরকে আমি কেন ভয় পাব?’ আপনি তাদেরকে ভয় পাবেন, কারণ তাদের কারো কাছে এটম বোমা, কারো কাছে হাইড্রোজেন বোমা এবং কারো কাছে প্রচুর অর্থ-সম্পদ আছে। তারা পৃথিবীতে যেমন ক্ষমতাশালী তেমনি প্রভাবশালী। সুতরাং তাদেরকে আপনার ভয় করা উচিত। উত্তর হচ্ছে, ‘তারা তাদের এটম বোম বা হাইড্রোজেন বোম অথবা সম্পদ দিয়ে আমার কী ক্ষতি বা উপকার করতে পারবেন?’ অধিকন্তু তারা তাদের এটম বোম বা হাইড্রোজেন বোম আমার দিকে নিক্ষেপ করবেন না, কারণ এগুলো আমার জীবনের চাইতেও বেশী দামী। তারা তাদের টাকার থলে আমার দিকে নিক্ষেপ করবেন না, কারণ তা আবার তাদের নিজেদের জীবনের চেয়ে বেশী দামী। তা হলে কেন আমি তাদের ভয় করব এবং তাদেরকে জানার জন্য কষ্ট করব? হ্যাঁ, তাদেরকে ভয় করবে তাদের ‘পোষা কুকুর’; কারণ তারা তাদের অনুগ্রহের উপরই বেঁচে আছে। তারা যদি তাদেরকে ভয় না করে বা না চিনে তা হলে তাদের প্রভুগণ তাদের উপর থেকে অনুগ্রহ তুলে নিতে পারেন। তাদের ‘পোষা কুকুররা’ যে অনুগ্রহ পাচ্ছে তা থেকে আপনারা কেন বঞ্চিত হচ্ছেন? এর জবাব – ‘আমরা তাদের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত এ জন্যে যে, আমরা তাদের কুক্কুরীদের বাচ্চা নই। এবং আমাদের অপরাধ এই যে আমরাও তাদের মত একই পিতা-মাতার পুত্র-কন্যা। এটাই হচ্ছে পার্থক্য।’ হায় প্রভু! আমাদের রক্ষা করুন! আমরা কী ভয়ঙ্কর মনুষ্য শ্রেণী! প্রভু আমাদের! আমাদের রক্ষা করুন!
আমরা সকল মানুষই – একই পিতা-মাতা – আদম-হাওয়ার পুত্র কন্যা। আমরা তা নই কি? ‘‘হ্যাঁ’’, তা হলে একজন আমেরিকান ও একজন আফ্রিকানের মধ্যে, একজন ইউরোপিয়ান ও একজন এশিয়ানের মধ্যে পার্থক্য কী? প্রকৃতপক্ষে, মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। অধিকন্তু, আপনার আমার এবং সমস্ত মানব জাতির সাধারণ উপাদানটি হচ্ছে আমাদের অবিচ্ছিন্ন, অবিভাজ্য এবং অবিনশ্বর আত্মা বা মন। সমস্ত বিশ¡ জুড়ে কেবল দু’শ্রেণীর বস্তু বিদ্যমান যার একটি হচ্ছে মনের আকাঙ্খিত বস্তু এবং অপরটি হচ্ছে মনের অনাকাঙ্খিত বস্তু। যে সব বস্তু দ্বারা আপনি আনন্দ পান আমিও সেগুলোতে আনন্দ পাই। যে সব জিনিস দ্বারা আপনি দুঃখ পান, সে সব জিনিসে আমিও দুঃখ পাই। যে রূপ আপনাকে মুগ্ধ করে তা আমাকেও মুগ্ধ করে। যে দুর্গন্ধ আপনার মনে অসন্তুষ্টি ঘটায় তা আমার মনেও অসন্তুষ্টি ঘটায়। তা হলে আপনি একজন আমেরিকান এবং আমি একজন আফ্রিকান, এর মধ্যে পার্থক্যটা কী? আমাদের মধ্যে পার্থক্যটা কি এ জন্যে যে আপনার জন্ম আমেরিকার মাটিতে এবং আমার জন্ম আফ্রিকার মাটিতে? আমাদের জন্মটা কি দৈব ঘটনা নয়? আপনি কি বলতে পারেন যে, আপনার ইচ্ছানুযায়ীই আপনার জ›ম আমেরিকার মাটিতে হয়েছে? না। আপনি বলতে পারেন না যে মানুষ তার ইচ্ছানুযায়ী যে কোন দেশে জ›ম লাভ করতে পারে। অতএব, আপনি কি দৈবক্রমেই একজন আমেরিকান নন, যেমন আমিও দৈবক্রমেই একজন আফ্রিকান? তা হলে দৈবক্রমে সংঘটিত একটি বিভাজনকে আমরা এত বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছি কেন? আপনার দেশের চারপার্শ্বে কি এমন কোন প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক রয়েছে যা একজন আফ্রিকান অতিক্রম করতে পারে না? না, কোন দেশেই এমন কোন প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা নেই। তা হলে আপনার এবং আমার মধ্যে এমন কি অনতিক্রমনীয় অজেয় বা অলংঘনীয় প্রভেদ রয়েছে যে জন্যে আমার দিকে এত ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন? এ কি আপনার জাতীয়তাবোধ বা ধর্মীয় অনুভূতি যা এ বিভেদ সৃষ্টি করছে? আমরা জানি, আপনার কোন ধর্মীয় স্বার্থ নেই; কারণ কোন ধর্মই একটি দেশের চার সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়। ইউরোপের দেশগুলোতে কোটি-কোটি খ্রীষ্টান বসবাস করছেন তাদের প্রতি আপনার আকর্ষণ তত নয় যতটা আমেরিকানদের প্রতি রয়েছে। তা হলে চুড়ান্ত বিশ্লেষণে ইহা স্পষ্ট যে, আমাদের জাতীয়তাবোধই আমাদের বিভেদ ঘৃণা এবং ঝগড়ার মূল কারণ। সুতরাং আমাদের উচিত সর্ব প্রথম ইহা দূর করা। আমি আপনাদের আগেই দেখিয়েছি যে, সব পুরুষ এবং নারী একই পিতা-মাতা থেকে উদ্ভুত, একই অনুভূতি সম্পন্ন এবং একই মনের অধিকারী। প্রকৃতপক্ষে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই, ভেদাভেদ যা কিছু আছে তা প্রকারে নয়, শুধু আকারে মাত্র। তাহলে, একজন মানুষের বর্তমান অবস্থা যা-ই হোক না কেন তাতে কি আমরা আমাদের পোষা কুকুর থেকে বেশী ভালবাসব না? আমাদের কি উচিৎ নয় যে, যা আমরা আমাদের নিজেদের জন্য পছন্দ করব তা অন্য ভাইদের জন্যও পছন্দ করব? আমাদের কি উচিত নয় যে, যা আমরা নিজেদের জন্য অপছন্দ করব তা আমাদের অন্য ভাইদের জন্যও অপছন্দ করব? উদাহরণ স্বরূপ, আপনি নিজে যেমন ক্ষুধার্থ থাকতে পছন্দ করেন না, বা আপনার পুত্র-কন্যা বা নিকট আত্মীয়রাও ক্ষুধার্থ থাকুক তা আপনি পছন্দ করেন না, তেমনি আপনি কি আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা অথবা এশিয়ায় বসবাসকারী অন্য ভাইদের ক্ষুধার্থ থাকা পছন্দ করবেন? আপনি কি ইহা পছন্দ করবেন যে, আপনার পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা মাটির পাত্র হাতে নিয়ে এক মুঠো খাবারের জন্য দরজায় দরজায় ভিক্ষা করে বেড়াক? তা হলে আপনি ইহা কিভাবে সহ্য করছেন যখন আপনি দেখছেন যে লক্ষ লক্ষ পুরুষ-মহিলা ও শিশুরা ক্ষুধার জ্বালায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে? আপনার কেমন লাগবে যখন আপনি দেখবেন যে, আপনার প্রিয় পুত্র-কন্যাগণ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে অযতেœ অবহেলায় ফুটপাতে পড়ে থেকে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আপনার তখন কেমন লাগবে, যখন আপনি দেখবেন আপনার পুত্র-কন্যাগণ হাসপাতালের বারান্দায় ঔষধপত্র ও চিকিৎসার সেবার অভাবে মারা যাচ্ছে? আপনার তখন কেমন লাগবে, যখন আপনি দেখবেন যে, আপনার প্রাণপ্রিয় সন্তান-সন্তুতিগণ শীতে কাঁপতে কাঁপতে কুকুরের লেজের ন্যায় কু-ুলী পাঁকিয়ে আকাশচুম্বি অট্টালিকার খোলা বারান্দার উপর জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে? আমরা লক্ষ লক্ষ মানুষ আপনার দেশের কুকুর বিড়ালের চাইতেও খারাপ অমানবিক অবস্থায় জীবন যাপন করছি। আমরা কি আপনাদের মতই মনুষ্য প্রজাতির বংশধর নই? তা হলে আমাদের যখন দেখেন তখন আপনাদের কী অনুভূতি হয়? আমরা কি আপনাদেরই মনুষ্য জাতির ভাই-বোন নই? আপনারা অবশ্যই বলবেন যে, মানবিক কারণে আপনারা কোটি কোটি ডলার মূল্যের অনুদান, সাহায্য, ঋণ বা ত্রাণ মঞ্জুরী দিয়ে আসছেন এবং এর বেশী আপনারা আর কী করবেন? হ্যাঁ, এ জন্য আমরা আপনাদের নিকট অতিশয় কৃতজ্ঞ। আপনাদের সরকার আমাদের সরকারকে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করে আসছে। আমাদের হিতৈষী সরকারও আপনাদের উপর খুবই সন্তুষ্ট। এদিক থেকে আপনি এবং আমাদের প্রেসিডেন্টের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি না। আপনারা উভয়েই পরস্পর সমান ভ্রাতা হিসেবেই আচরণ করছেন। কিন্তু আমরা দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, আপনাদের উপহার, অনুদান, ঋণ, সাহায্য প্রভৃতি আমাদের জন্য অত্যন্ত দামী খাদ্য এবং তা হজম করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। এরূপ দামী খাদ্য আপনারা যত বেশী বেশী দিবেন আমাদেরকে ততই বেশী বেশী সংখ্যায় দেখতে পাবেন। যদি সত্যিকার অর্থেই আপনারা আমাদের সাহায্য করতে চান, তা হলে আপনাদের দানের পদ্ধতিটা পরিবর্তন করতে হবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনি আমাদের যা-ই দান করুন না কেন, আমাদের প্রেসিডেন্ট তা হজম করতে পারবেন, কারণ তিনি আপনার বন্ধু, যেহেতু আমাদের দেশে তার অবস্থান আমেরিকায় আপনার অবস্থানের মত; কিন্তু এসব ‘দামী খাবার’ আমাদের হজমের জন্য কষ্টদায়ক। সুতরাং আপনি যদি আমাদের সাহায্য করতে চান, তা হলে আমাদের সবাইকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে রূপান্তরিত করতে হবে। এরূপ করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। তা হলে আপনার পক্ষে কী করা সম্ভব? আপনাকে আমাদের মত মানুষ হতে হবে। এর অর্থ আমি এ বোঝাতে চাচ্ছি না যে, আপনার সমস্ত অর্থ-সম্পদ ত্যাগ করতে হবে অথবা আমাদের মত অর্ধনগ্ন অবস্থায় থাকতে হবে অথবা আমাদের মত আপনাকেও না খেয়ে থাকতে হবে। কিন্তু আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা এই যে, আমাদের সাথে- একই পিতা-মাতা থেকে জ›মগ্রহণ করা ভাই-বোনের মত আচরণ করতে হবে। আমরা আপনার করুণা সাহায্য প্রার্থনা করছি না; ইহা আমাদের বিন্দুমাত্র কাজে আসবে না। আমাদের উপকারে যা আসবে তা হচ্ছে সমভ্রাতৃত্ব হিসেবে উপলব্ধি করা এবং আচরণ করা। ইহাই বিশ¡-ভ্রাতৃত্ব, ইহাই সত্যিকার অর্থে সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব। উঁচু-নীচু, গরীব ও ধনী এ সব বিভেদ পৃথিবী জুড়ে সব সময়ই থাকবে। কিন্তু সব মানুষেরই মানবতাবোধ থাকা প্রয়োজন। আপনি যত বড় ব্যক্তিই হোন না কেন আপনি যদি অপর সব মানুষের সঙ্গে আচার-আচরণে সমতা বজায় রেখে চলতে অক্ষম হন তা হলে আপনি আপনার সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে একজন বড় পাপী সাব্যস্ত হবেন। কারণ, আপনি বা আমি এ বিভেদ সৃষ্টি করিনি; বরং আমাদের সৃষ্টিকর্তাই আমাদের সবাইকে তিনি যেরূপ ইচ্ছা করেছেন সে রূপেই সৃৃষ্টি করেছেন। আমাদের সৃষ্টিকর্তা যদি ইচ্ছা করতেন, তা হলে আমার মত একজন ক্ষুধার্ত আফ্রিকানকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রূপে সৃষ্টি করতে পারতেন এবং তিনি যদি ইচ্ছা করতেন তা হলে আপনি মিঃ এক্স, আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে আফ্রিকার মরুভূমিতে ক্ষুধায় আর্তনাদরত একজন আফ্রিকান হিসেবে সৃষ্টি করতে পারতেন। তা হলে এখন কি আপনি আমাকে আপনার মতই সমান একজন ভাই হিসেবে বিবেচনা করতে পারবেন? সম্ভবতঃ আপনি বলবেন যে, একই মনুষ্য সমাজের অন্তর্ভূক্ত সমস্ত মানুষের সঙ্গে সর্বদা একইরূপ আচরণ করে আসছেন। আপনি হয়ত বলতে পারেন, আপনার নিজের ভাইয়ের প্রতি আপনার যেমন অনুভূতি তা পৃথিবীর সকল মানুষের প্রতিও একই রকম। তা হলে কাকে আপনার নিউক্লিয়ার অস্ত্রের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে গণ্য করছেন? কার বিরুদ্ধে আপনি আপনার নিউক্লিয়ার অস্ত্র মজুদ করছেন? কার বিরুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আপনার অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করছেন? এগুলো কি পৃথিবীব্যাপাী ঘৃণা ছড়াচ্ছে না? আপনি এসব করছেন অপরের উপর আপনাদের প্রাধান্য প্রমাণের জন্য। এগুলো কি আপনার মানবতার কোন চিহ্ন বা অনুভূতি বহন করে? আবশ্যই না। আপনারা সব পরাশক্তিধররা মত্ত আছেন ঠা-া লড়াইয়ে, একে অন্যকে হারানোর চিন্তায়। কিন্তু আপনারা যদি নিজেদেরকে জ্ঞানী, বিবেচক এবং ন্যায়সঙ্গত মনে করতেন, তা হলে অবশ্যই আপনারা আপনাদের সৃষ্টিকর্তাকে নিজেদের চাইতেও অনেক অনেক বেশী শক্তিশালী মনে করতেন। তাঁর সামনে আপনারা একটি মশার ডানার চাইতে কি অধিক কিছু ? অতএব, অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য যে সব অস্ত্র-সস্ত্র আপনারা মজুদ করেছেন, সে সব আপনাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করার জন্যে আপনাদের প্রতিপালক আরও বেশী ক্ষমতাশালী। সুতরাং আপনাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যেই আরও বেশী সতর্ক থাকা উচিৎ এবং এ মুহূর্ত থেকেই অন্যের নিরাপত্তার কথা ছেড়ে দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করাই বেশী জরুরী। কারণ, পৃথিবীর সব কিছু থেকে আপনারা নিজেদেরই বেশী ভালবাসেন। প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের আত্মাকে পৃথিবীর সবকিছু থেকে বেশী ভালবাসে। কিন্তু বেশীর ভাগ লোকই তা উপলব্ধি করতে পারছে না। যখন সে দেখে যে মৃত্যু-দূত তার মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত, তখনই সে তা উপলব্ধি করতে পারে; কিন্তু তখন ত শোধরানোর বা অনুতাপের আর সময় থাকে না। তখন কোন ধরণের জাতীয়তাবোধক অনুভূতি বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ কোন দান আপনার কোন কাজে আসবে না; শুধুমাত্র ন্যায়ের জন্য যা কিছু করেছেন অর্থাৎ আপনি আপনার প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আন্তরিকভাবে যা কিছু করেছেন তা ছাড়া আর কোন কিছুই আপনার সাহায্যে আসবে না।
আমরা মানব ইতিহাসের ভীষণ এক সঙ্কটকাল অতিবাহিত করছি। আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে অতিমাত্রায় উদাসীন। আমাদের উদ্ধতপূর্ণ আচরণ-বিচরণ এবং কথা-বার্তা প্রমাণ করে না যে আমরা স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। সুতরাং তিনি পরিকল্পনা করেছেন, তার অস্তিত্ব তিনি এমন প্রচ-ভাবে প্রকাশ করবেন যার সামনে কোন বাঁধাই দাঁড়াতে পারবে না, শুধু মাত্র তাঁর বিশেষ দয়া প্রাপ্ত ব্যক্তিগণ ছাড়া। এ সময়েই তিনি পৃথিবীতে তার একত্ববাদ এবং ঐশ্বরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করবেন। আমি আপনাকে এ সংবাদ দিচ্ছি আমার নিজের লাভের জন্য নয়, আপনার নিজের লাভের জন্যও নয় অথবা পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের লাভের জন্যও নয়; বরং সারা পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের লাভের জন্য এ শুভ সংবাদ। এবং যারা তাদের প্রভুর এ পরিকল্পনার সাথে ঐকমত্য পোষণ করবে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবে তারা সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদ লাভ করবে; আর যারা এ পরিকল্পনার সাথে ঐকমত্য পোষণ করবে না এবং বাস্তবায়নে বাঁধা দিবে তারা অবশ্যই তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ভীষণ শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য হবে। সুতরাং আমাদের সবাইকে খুবই সতর্ক হতে হবে। সময় অতি সংকীর্ণ। এ মুহূর্ত থেকেই আমাদের প্রত্যেককে নিজেদের আত্মাকে বাঁচানোর জন্য উঠে-পড়ে লাগতে হবে। সময় খুবই কম। আপনি নিশ্চিত দেখতে পাবেন, ‘আমাকে বাঁচাও’, ‘আমাকে বাঁচাও’ বলে সবাই চিৎকার করছে। এসময় কি আমাদের জাতীয়তাবোধের উর্ধ্বে উঠা উচিত নয়? এসময়ে কি একজন আমেরিকান ও একজন আফ্রিকান, একজন ইউরোপিয়ান ও একজন এশিয়ান এবং মানুষে মানুষে বিরাজমান কৃত্রিম বিভেদ সমূহ আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়? এসময় কি আমরা সবাই এক মানব জাতি এবং আমরা সবাই একই পরিবারের ভাই ও বোন, এ মতবাদ উর্ধ্বে তুলে ধরা উচিত নয়? আপনি কি এখনো অনুভব করছেন যে, মানুষে মানুষে সত্যিকার কোন প্রাকৃতিক বাঁধা আছে? অতএব, একজন মানুষ, সে যে-কেউ হোক, পৃথিবীর বুকে সে যদি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে আসে আমরা কি তাকে এবং তার ন্যায়ের শাসন সহ্য করতে পারব না? এখনো কি আমাদের মনে জাতীয়তাবোধকে উস্কে দেবে? না। যদি কোন ব্যক্তি এরূপ মনে করে, তবে সে তার প্রভুর ক্রোধভাজন হবে, কারণ এ হচ্ছে তার প্রভুর ন্যায় বিচারের পরিপন্থী।
এবার আমি প্রথম প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করব। যে সমস্যার আবর্তে আমাদের সরকারকে ফেলে এসেছিলাম; তা হচ্ছে বিভিন্ন মতামত সম্বন্ধে। এখন আমাদের সরকারের কী করা উচিত। যেহেতু আমি সব আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছি, সেহেতু আমি মনে করছি, জাতিসংঘ কর্তৃক বিবেচনার জন্যে আমাদের সরকার কর্তৃক সর্ব প্রথম একটি প্রস্তাব তৈরী করা। প্রস্তাবটি হবে এরকম: ‘‘এ জগতে আমরা সবাই শান্তি চাই এবং পরজগতে মুক্তি চাই। কিন্তু এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন রকম কথা বলছেন। আমরা যদি স্বেচ্ছায় একজনের মতামত গ্রহণ করি তা হলে এটা অন্যদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং তা মানুষজন এবং জাতি সমূহের মধ্যে অরো বেশী ঘৃণা এবং ঝগড়া-বিবাদের জ›ম দিবে। কিন্তু যেহেতু আমাদের উদ্দেশ্য সবার জন্য ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং কারো প্রতি অবিচার না করা, তাই আমরা ইহা জাতিসংঘ কর্তৃক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপস্থাপন করছি। জাতিসংঘ যে সিদ্ধান্ত দিবে আমরা তা মেনে নেব। জাতিসংঘ যদি এ প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্যে এগিয়ে আসে তা হলে যে সাধারণ সভা করার কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি, তা অনুষ্ঠিত করার দায়িত্ব থেকে আমাদের সরকার অব্যাহতি পাবে। যদি জাতিসংঘ এ প্রস্তাব গ্রহণ না করে তা হলে আমাদের সরকারের দায়িত্ব হবে পৃথিবীর সকল সরকার এবং জনগণের আন্তরিক সহযোগিতা প্রার্থনা করে একটি সভার আয়োজন করা। যদি কোন রাষ্ট্র বা তার জনগণ আমাদের সরকারকে সহযোগিতা করে তবে ভাল আর যদি তারা সহযোগিতা করতে না আসে, তা হলে আমাদের সরকারকেই জনগণের সহযোগিতায় এ সভার আয়োজন করতে হবে।’’
কিন্তু সব কিছু করার পূর্বে তাদের জানতে হবে যে, তারা কি করতে যাচ্ছে এবং তাদের উদ্দেশ্যই বা কী। আমি আবারো উল্লেখ করতে চাই যে, তাদেরকে উদ্দেশ্যের প্রতি আন্তরিক এবং সৎ হতে হবে এবং উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য তাদেরকে দৃঢ় এবং অটল থাকতে হবে। অন্যথায় নৈরাজ্য এবং গোলমাল বা বিশৃঙ্খলাই হবে তাদের কর্মের ফলাফল। সুতরাং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাদেরকে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন এবং বৈশিষ্ট্য ম-িত হতে হবে। তাদেরকে সব সময় মনে রাখতে হবে যে, সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এখানে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থ নয় বরং দেশ তথা বিশে¡র সমস্ত মানুষের স্বার্থ জড়িত। সৃষ্টিকর্তার এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যদি তারা এগিয়ে আসে তা হলে তা হবে সব দিক দিয়ে মঙ্গলজনক, আর যদি এতে তারা কর্ণপাত না করে, তা হলেও আমাদের সৃষ্টিকর্তা যাদের উপর সন্তুষ্ট তাদের দিয়ে তিনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন। সৃষ্টিকর্তা তাঁর উদ্দেশ্য সাধনে কখনই ব্যর্থ হন না।
যাহোক, আমি আশা করছি আমাদের বাংলাদেশ সরকার এবং বিশে¡র অন্যান্য কতিপয় দেশ শেষ পর্যন্ত ইহা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে। আমি সংক্ষিপ্ত আকারে কিছু পরামর্শ দিচ্ছি ঃ ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র প্রভৃতি সকল স্তরের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং যারা প-িত, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত এবং বড় বড় চিন্তাবিদ তাদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো এবং পাপাচার পূর্ণ পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা এবং আমাদের সম্মুখে যা সংঘটিত হতে যাচ্ছে তা থেকে আমাদেরকে বাঁচানোর জন্যে তাদের মধ্যে যদি কেউ প্রভুর নিকট থেকে কোন প্রেরণা পেয়ে থাকেন তাদের নাম জমা দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করা। এ আহ্বান রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজের মাধ্যমে বহুলভাবে প্রচার করা যাতে পৃথিবীর দূর-দূরান্তে তা পৌঁছে যায়। যারা সভার আয়োজন করবে তাদের সুবিধা মত একটি সময় সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে।
এখানে আমার কিছু ভাই হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন যে, তবে তিনি এখনই কেন তাঁর পরিচয় প্রকাশ করছেন না? এ প্রশ্নের উত্তরে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে উল্লেখ করতে চাই যে, এটি আমাদের সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা। তিনি বিশে¡র বুকে তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং যে শয়তান বর্তমানে পৃথিবী শাসন করছে সে শয়তানকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা হবে। শয়তান জেনে গেছে যে, তার সময় শেষ হয়ে এসেছে, তাই সে তার জীবাণু ছড়িয়ে দিয়েছে। এ জীবাণুগুলো আমাদের মধ্যে বিভেদ ও অবিশ¡াস সৃষ্টিতে খুবই ক্ষমতাধর। যে মুহূর্ত থেকে সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি তার পরিচয় প্রকাশ করবেন, এসব জীবাণুগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ পেয়ে যাবে এবং এদের প্রত্যেকেই সৃষ্টিকর্তার সত্য প্রতিনিধি হিসেবে দাবী করতে থাকবে। তখন সঠিক ও অঠিক-এর মধ্যে পার্থক্য করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়ে পড়বে। একই রকমের বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থা পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়বে। তখন শয়তানই শেষ পর্যন্ত সফলতা লাভ করবে। কিন্তু শয়তান যা জানে তা থেকে আমাদের সৃষ্টিকর্তা অনেক বেশী জানেন। অতএব তাঁর পরিকল্পনা এই যে, এসব জীবাণুকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করে দেয়া যাতে এগুলো আর উদ্গত হতে না পারে। সুতরাং এ পদ্ধতিটি সম্বন্ধে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে আমাদের সকলেরই ভালর জন্যে।
অনেকে বলতে পারেন যে, এটি একটি যুক্তিহীন তত্ত্ব। আমরা এজাতীয় যুক্তিহীন তত্ত্বে বিশ¡াস করতে পারছি না বলে দুঃখিত। সৃষ্টিকর্তা যিনি এ দীর্ঘ সময় তাঁর সৃষ্টি সম্বন্ধে নিশ্চুপ ছিলেন এখন কেন তিনি এমন একটি অবাস্তব মতবাদ যা তিনি সৃষ্টির পর আর কখনো করেননি তা প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা করবেন? আমরা এ ধরণের বিষয়ে বিশ¡াসী হতে পারছি না। হে আমার ভাইয়েরা! আমি কি এমন কোন অযৌক্তিক, অবাস্তব বা অবৈজ্ঞানিক কথা বলেছি? তা হলে এ কিভাবে যুক্তিহীন তত্ত্ব হল? যে পরিকল্পনা আমি আপনাদের সামনে পেশ করেছি, তা যদি বাস্তবায়িত হয়, তা হলে কি আমাদের সকলের জন্যই তা মঙ্গলজনক হবে না? তা হলে ইহা কিভাবে যুক্তিহীন তত্ত্ব হল? হে আমার ভাইয়েরা! আমি নতুন কোন কথা বলছি না। নূহ্-এর সময়ের লোকজনের কাহিনী কি শুনেননি? মহাপ্লাবনের পরে বিশ¡ কে শাসন করেছেন? তিনি কি আমাদের সৃষ্টিকর্তা নন? আদ এবং সামুদ জাতির ভাগ্যে কী ঘটেছিল? তাদের ধ্বংসের পর এ পৃথিবী কে শাসন করেছেন? নমরুদের লোকদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল? তাদের ধ্বংসের পর পৃথিবী কে শাসন করেছেন? লুতের লোকজনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল? ফিরাউনের লোকজনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল? তাদের ধ্বংসের পর পৃথিবী কে শাসন করেছিলেন? এখনও কি আপনি আমাকে একজন যুক্তিহীন তত্ত্ববাদী হিসেবে বিবেচনা করবেন? হায়! মানুষ বড় বিস¥ৃতি প্রবণ. কিন্তু আমি উপলব্ধি করছি, আমার প্রধান কর্তব্য আমার পৃথিবীবাসী মানুষকে স¥রণ করিয়ে দেয়া যে, অতীত কালে অবাধ্য উদ্ধতপূর্ণ আচরণের জন্য মানুষের ভাগ্যে কি ঘটেছিল এবং আমাদের ভাগ্যে কি ঘটবে যদি আমরা সতর্কবাণী উপেক্ষা করে একইরূপ উদ্ধতপূর্ণ আচরণ করি?
এবার আসা যাক, আলোচনার প্রধান বিষয় মহা স¤েমলন অনুষ্ঠানের বিষয়ে। আমরা সব চাইতে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছি এমন একজন পুরুষকে খুঁজে বের করার উপর যিনি বর্তমান বিশে¡র শোচনীয় অবস্থা থেকে আমাদের উদ্ধারের জন্যে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক অনুপ্রেরণা প্রাপ্ত হবেন। সুতরাং আমাদের জানার বিষয় হচ্ছে প্রেরণা প্রাপ্ত পুরুষটি, অন্য কেউ নন। অনুপ্রেরণা প্রাপ্ত ব্যক্তি, যিনি আমাদের উদ্ধারের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ আমাদের বিবেচ্য নয়; অথবা এমন সব ব্যক্তিও নন যারা একদা অনুপ্রেরণা প্রাপ্ত ছিলেন, কিন্তু এখন আর বিদ্যমান নের্ই এরাও আমাদের বিবেচ্য নয়। এপর্যন্ত আমাদের উপর যথেষ্ট পরিমাণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে, এবং আমরা এখনো আমাদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক নেতৃবৃন্দের এবং হিতাকাঙ্খীদের কঠোর পর্যবেক্ষণের মধ্যেই রয়েছি। কিন্তু আমাদের অবস্থা দিন বা দিন অত্যন্ত খারাপের দিকেই যাচ্ছে। সুতরাং চরম সংকটময় অবস্থায় পড়ে আমরা বাধ্য হয়েছি জ্ঞানী-গুণী, শিক্ষিত, দয়ালু, বুদ্ধিমান, উদার, ক্ষমতাবান নেতা, উপদেষ্টা, নীতি প্রণয়নকারী সরকারের পরিকল্পনাকারীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আমাদের পরম দয়াময় ও করুণাময় ক্ষমাশীল সৃষ্টিকর্তার দিকে মুখ করছি এবং অপেক্ষা করছি আমাদের প্রতি তাঁর কি সিদ্ধান্ত তা জানার জন্যে। এখানে অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন যে, আমরা কিভাবে বুঝব যে ইহা সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা। এর উত্তরে আমরা সরলভাবে জানাচ্ছি যে, আমাদের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে অপরিহার্য পরিণতি হিসাবে এ উপসংহারে উপনীত হয়েছি। আপনাদের কেউ কি এ উপসংহারটি ভুল প্রমাণ করতে পারবেন? আপনাদের কেউ কি দয়া করে এগিয়ে আসবেন এবং আমাদের দেখাবেন সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা কীরূপ হতে পারে বলে আপনারা ভাবছেন?
যাহোক, এ আহ্বান শুনার পর, আমরা বিশ¡াস করছি, কেউ কেউ অবশ্যই এ ডাকে সাড়া দিবেন এবং দাবী করবেন যে, তারা সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে প্রেরণা লাভ করেছেন। কারণ, যে মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে প্রেরণা লাভ করেন তার অবস্থা যা-ই হোক না কেন এবং তিনি যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, তিনি অলস ভাবে বসে থাকতে বা চুপচাপ বা লুকিয়ে থাকতে পারেন না যা এ লেখার প্রথমেই ব্যক্ত করেছি। তারা অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার বার্তা অপরের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে বেরিয়ে আসবেন। মানব গোষ্ঠীর যে অংশটি তাদের নিজস্ব মতামতের সমর্থনে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে কোন অনুপ্রেরণা প্রাপ্তির দাবী করবেন না তাদের মতামত অবশ্যই পরিত্যাজ্য হবে। তাদের অবশ্যই উচিত হবে স্বেচ্ছায় তাদের ঐসব মতামত পরিত্যাগ করে প্রেরণা প্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে একতাবদ্ধ হওয়া।
আমি আমাদের এক সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর এক রাজত্বে এক আইনী শাসন প্রতিষ্ঠার পদ্ধতির কথা বলেছি। সুতরাং আমাদের বিশ¡াস সৃষ্টিকর্তা তাঁর মনোনীত যে ব্যক্তির মাধ্যমে এক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবেন তিনি একজনই হবেন, একাধিক হবেন না। যদি মনোনীত ব্যক্তির দাবীদার একের অধিক হয়ে পড়েন তা হলে তাদের মধ্যস্থ এক জনের দাবী সঠিক হবে, বাকী সব হবে মিথ্যা। অতএব মিথ্যা দাবীদারদের মধ্য থেকে সঠিক দাবীদারকে বেছে বের করার জন্যে আমরা নিম্ন বর্ণিত পরীক্ষাগুলো প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছি ঃ-
(১) তাঁর বয়স ৪০ বৎসরের কম হবে না।
(২) স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং গুণাবলী সম্বন্ধে পূর্ণ পরিচয় দিতে হবে।
(৩) এ প্রত্যাদেশ অন্ততঃ ১২ বৎসর পূর্ব হতে পেয়ে থাকবেন এবং এ সময়ের মধ্যে প্রত্যাদেশ বিষয়ে তিনি কী কী কালচার করে এসেছেন, তাও দেখাতে হবে।
(৪) প্রত্যাদেশ প্রাপ্তির পূর্ব হতে তার উপর কী কী অবস্থা ঘটেছে তার কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে হবে।
(৫) প্রত্যাদেশ প্রাপ্তিকালে তার স¤মুখে অপর কোন লোক উপস্থিত ছিল কি না, থাকলে তারা এ বিষয়ে কতটুকু সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে পারে তার বর্ণনা দেয়া।
(৬) উক্ত দাবিদারের পরিচিত দেশবাসীগণকে তাঁর প্রতি তিনটি গুণের বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে। এ গুণ তিনটি হল – (ক) তার সত্যবাদিতা সম্বন্ধে, (খ) তার চরিত্রবান হওয়া সম্বন্ধে এবং (গ) তার জ্ঞানবান হওয়া সম্বন্ধে।
এ ছয়টি পরীক্ষা চালানোর পরও যদি একের অধিক মনোনীত ব্যক্তির দাবীদার থেকে যান, তা হলে সৃষ্টিকর্তার অলৌকিক নিদর্শনের মাধ্যমে সঠিক দাবীদার চিহ্নিত করা যাবে। যাহোক, যদি কারো মনে এ সব পরীক্ষা সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকে তা হলে তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কী ধরণের পরীক্ষা প্রয়োগ করতে চান তা আমাদের জানাবেন।
যখন আমাদের সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে তাঁর মনোনীত ব্যক্তির পরিচয় আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়ে যাবে, আমরা সবাই, যে যা-ই হই না কেন, আমাদের সকলকেই তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে হবে এবং আমাদের ব্যক্তি-পরিচয় বিসর্জন দিয়ে মনোনীত ব্যক্তির পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। আমরা আমাদের যাবতীয় কাজ-কর্মের জন্য তাঁর উপদেশ প্রার্থনা করব এবং আমাদের জীবন তাঁর উপদেশ এবং নির্দেশনা অনুসারে পরিচালনা করব, যেরূপ আমরা একটি আধুনিক রাষ্ট্রে করে থাকি। এ-ই হচ্ছে আমাদের সৃষ্টিকর্তার শাসন পদ্ধতি। এখন আমার কোন ভাই আমাকে হাস্য-বিদ্রƒপ করতে পারেন এবং আমার প্রস্তাবকে অবাস্তব এবং অসম্ভব বলে মনে করে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন; কারণ, তারা সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা এবং শক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ। সুতরাং আমরা যারা সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা ও শক্তি সম্পর্কে অত্যন্ত উদাসীন, তাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা ও শক্তি প্রদর্শন করা অতিশয় জরুরী হয়ে পড়েছে। সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা ও শক্তি প্রদর্শনের পূর্বেই তাঁর মনোনীত ব্যক্তিকে গ্রহণ করার জন্যে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অনুরোধ করছি। আমরা যদি এখনো তাঁর ক্ষমতা ও শক্তি দেখতে চাই, তা হলে মনে করতে হবে, আমরা অত্যন্ত ভয়াবহ এক পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছি। কারণ, তিনি যখন তাঁর ক্ষমতা দেখাবেন তখন তা আমাদের কোনই উপকারে আসবে না; বরং তা হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর অবলুপ্তি।
এখন আমি আলোচনা করব কিভাবে পাহাড়ের মত দৃঢ় ঐক্য অর্জন করা সম্ভব। যতদিন পর্যন্ত কোন দেশ বা জাতিসংঘ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে না আসবে ততদিন পর্যন্ত আমরা এ পরিকল্পনার কথা প্রচার করে যাব যা আমি পূর্বে বর্ণনা করেছি। যদি ইহা আমাদের দয়াময় সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে, অবশ্যই আমরা তা বিশ¡াস করি, আমরা অবশ্যই তাঁর দয়ায় সফলকাম হবই। পরিকল্পনার সার-সংক্ষেপ হচ্ছে ঃ আমরা পৃথিবীর সকল মানুষই গভীর পাপে নিমজ্জিত, ফলে আমাদের অবমাননাকর শাস্তির পাত্র কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আমরা সে পাত্র থেকেই অপমান লাঞ্ছনা গলাধকরণ করছি। এ অবমাননাকর অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্যে এক সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কোন কর্তা নেই। সুতরাং আমরা অনুভব করছি, এ মুহূর্তে তাঁর বিশেষ দয়াই আমাদের একমাত্র প্রয়োজন। অতীতে বহুবার পৃথিবী এরকম পরিস্থিতিতে পড়েছিল এবং প্রতিবারই সৃষ্টিকর্তা তাঁর মনোনীত ব্যক্তির মাধ্যমে মানুষের উপর তাঁর বিশেষ দয়া বর্ষণ করেছেন। হযরত মোহা¤মদ (দঃ) পর্যন্ত এসব মনোনীত ব্যক্তিদের নবী এবং রাছুল বলা হয়েছে এবং হযরত মোহা¤মদ (দঃ)-এর পর তাঁদেরকে ধর্মের সংস্কারক বলা হচ্ছে। এ সময়ও আমরা অশান্তিপূর্ণ অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্যে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে একজন মনোনীত ব্যক্তির আবির্ভাবের উপর বিশ¡াসী। আমরা এ মনোনীত ব্যক্তির দিকেই তাকিয়ে আছি। এক্ষণে আমরা আমাদের এ আহ্বান আমাদের সকল মানব ভাইদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছি, যারা তাদের উদ্ধারের জন্যে একজন মনোনীত ব্যক্তির আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন, তাদেরকে আমাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ও সহযোগিতা করার জন্যে অনুরোধ করছি। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি এ আহ্বান উ›মুক্ত। আমরা বিশ¡াস করি যে, যারা এই আহ্বান গ্রহণ করবেন এবং এই ডাকে সাড়া দিবেন তাদের উদ্দেশ্য একটাই অর্থাৎ তাদের প্রভুর সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জন এবং তারা সবাই বিশ¡াসে এক অর্থাৎ আমাদের সৃষ্টিকর্তার মনোনীত ব্যক্তির বিশ¡াসে বিশ¡াসী। আণবিক বোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এই মানুষগুলোই হচ্ছেন বৈজ্ঞানিক একতার কেন্দ্রবিন্দু এবং আমার ভাইয়েরা! আমাদের পরিত্রাণের জন্য সৃষ্টিকর্তার মনোনীত ব্যক্তির আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে যারা মনে করছেন না, আমাদের পরিত্রাণের জন্যে তাদের কাছে কী পরামর্শ আছে দয়া করে আমাদের তা জানাবেন কি?
আমাদের প্রভু তাঁর শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আমাদের শক্তি ও সাহস দান করুন এবং আমাদের বিজয় দান করুন! আমীন!
৩১ ডিসেম্বর, ১৯৭৪ খ্রিঃ
ঢাকা, বাংলাদেশ।