পরম দয়ালু ও করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করছি
ভ্রম – ভঞ্জণ
“এবার ঘুম ভাঙবে
আবার জাতি জাগবে।”
আজ সকল মানুষের মুখে একই কথা, পৃথিবীতে কোথাও শান্তি নাই। কিন্তু কোন্ পথে শান্তি ফিরে পাওয়া যাবে তার সঠিক সন্ধান কেউ দিতে পারছেন না। জানা দরকার যে শান্তি ও অশান্তি যেমন বিপরীত দুটি জিনিস,উহাদের মূলও বিপরীত দুটি জিনিস। একটি সাম্য অন্যটি বৈষম্য, একটি ঐক্য অপরটি অনৈক্য। সুতরাং শান্তির মূল হল একতা কায়েম করে ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা, আর অশান্তির মূল হল অনৈক্য সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি করা। একতা নামক বৃক্ষে শান্তির ফল ফলে। পক্ষান্তরে সাম্প্রদায়িকতা বা অনৈক্যের বৃক্ষে অশান্তির ফল ফলে। কাজেই শুধু মুখে বুলি কপচাইলেই কখনো শান্তি আসতে পারে না। শান্তির গাছ প্রথম রোপন করতে হবে। আরো জানা দরকার যে শুধু সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একতা কায়েম করলেই প্রকৃত শান্তি আসতে পারে না, বরং সকল ধর্মের ধর্মীয় বিভেদ ভেঙ্গে ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে পারলেই প্রকৃত শান্তি আসতে পারে। কাজেই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান তথা সর্ব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একতা ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। এখানে অনেক ভাই হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন, হিন্দু – মুসলিম কি আর এক হবে? তার উত্তর শুনুন, সর্ব প্রথম জানা দরকার যে আমরা যে শান্তি চাই সেই শান্তি দিবেন কে? জগতে এমন কোন মানুষ নেই যে সে তার নিজের শান্তি নিজে সংগ্রহ করতে পারে। অর্থাৎ পৃথিবীতে এমন কোন মানুষই নেই যে, সে তার নিজের জীবন ও মরণের মালিক হতে পারে। অতএব মানুষের জীবন দাতা যিনি জীবনের শান্তি দাতাও তিনিই। কাজেই ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক মানুষকেই সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্বন্ধকৃত হতে হয় ও তাঁর আদেশ নিষেধ পালন করে জীবনে শান্তি পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। এই বিশ্বাস সর্ব ধর্মাবলম্বীদেরই আছে এবং সকলেই স্বীকার করেন যে সাধু ও চরিত্রবান মানুষই সৃষ্টিকর্তার প্রিয়পাত্র হয়ে থাকেন। আরো জানা দরকার যে, সাধু ও চরিত্রবান হওয়ার লক্ষণ এই যে সে (১) সত্যবাদী (২) সরল (৩) অহিংসুক ও (৪) প্রেমিক হবে। এই চার গুণ বিশিষ্ট মানুষ যে হবে সে যে কোন ভাষাভাষী বা যে কোন ধর্মমত পোষণকারী হোক না কেন তার হৃদয়ে এক আলো পায় যদ্দ¦ারা সে নিজে শান্তি পায়। আর এর বিপরীত অর্থাৎ কেউ (১) মিথ্যাবাদী, (২) কপট, (৩) হিংসুক ও (৪) নিষ্ঠুর- এই চার দোষ বিশিষ্ট হলে সে অসৎ ও অসাধু হয়। সুতরাং সাধুতে সাধুতে মিলন হওয়া স্বাভাবিক। তাই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের মধ্যস্থ সকল সাধু ও চরিত্রবানদের একতাবদ্ধ হওয়ার খুবই সম্ভাবনা আছে। কিন্তু শুধু মুসলমান সাধু ও মুসলমান নামধারী অসাধুতে মিলন হওয়ার কোনই সম্ভাবনা নেই। এইরূপ হিন্দু, খ্রিস্টান প্রভৃতি সকল ধর্মেই সাধু ও অসাধু লোক আছে, আপন সম্প্রদায়ের মধ্যেও যাদের মিলন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, সরল ও গড়ল কখনো এক হতে পারে না।
যাহোক, বক্তব্যের সার বস্তু এই যে মানব জাতির শান্তি দাতা একজন-যিনি জীবন দাতা। শান্তির উপকরণ তিনিই দিয়েছেন-তা হল একতা। সুতরাং আমাদের মধ্যে একতা গড়তে হবে। কিন্তু প্রথম আমাদিগকে চরিত্রবান হতে হবে। আর মুখের কথায় বা উপদেশেই কেউ চরিত্রবান হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মহৎ লোকের সংস্পর্শে এসে তার আদর্শ ও উপদেশ গ্রহণ না করে। আর মহৎ কেউই নিজস্ব শক্তি দ্বারা হতে পারে না। যাকে মহান প্রভু দয়া করে নিজের করে নেন, কেবল তিনিই মহৎ হতে পারেন। সাধুতার বিশেষত্ব কি? যেমন মাটি দ্বারা ইট তৈরী হয়, কিন্তু কাঁচা ইটে কখনো দালান হয় না যতক্ষন পর্যন্ত না ঐ ইট পুড়িয়ে পাকা করা হয়। ঐ রকম মানুষ প্রথম কাঁচা ইটের মত থাকে। মহৎ লোকের আদর্শ গ্রহণ করে পাকা ইটরূপ সাধু হয়। কিন্তু একখানা ইট কোন কাজেরই নয় যতক্ষন পর্যন্ত না বহু ইট একত্র মিলিত হয় এবং এক একটি ইট মিলিত হয়ে দালান হয়। তদ্রƒপ কোন সম্প্রদায়ে শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক সাধু লোক থাকলেই গোটা জগতে শান্তি আসতে পারে না; বরং গোটা জগতের সমস্ত সাধু ও সৎ লোকদের একত্রে মিলতে হবে। আর সকল ধর্মপ্রাণ সাধু ব্যক্তিরই উপাস্য প্রভু একজন। তিনিই সকলের জীবন দাতা ও জীবনের বিধান দাতা।
এখন হয়তো অনেকেই বুঝতে পারছেন যে সকল মানুষেরই ঐক্য বা মিলন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তবু কেন একতা গড়ে উঠছে না? তার কারণ, একতা কায়েম করতে হলে একজনকে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে মিলতে হবে। কিন্তু এখানে আমরা কার সাথে মিলিত হব? হিন্দু মুসলমানের সাথে মিলিবে? না, মুসলমান হিন্দুর সাথে মিলিবে? যদি বলা হয়, যে ধর্ম সত্য তার সাথে মিলিত হলে একতা গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু তাও হবে না; কারণ সকল ধর্মেরই সত্যতা প্রমাণ করার লোক আছে। এতে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ে ছাড়া কমে না। যদি বলা হয় যে, ধর্মনিরপেক্ষ থাক-তবে তাতেও কোন দিন শান্তি আসতে পারে না; যেহেতু আমাদের বর্তমান সর্ব ধর্মেই যে সৎ ও অসৎ, সাধু ও অসাধুতে সমাজ গড়া রয়েছে। এই সমাজ হতে সাধু ও অসাধুদেরে বেছে বের করার ক্ষমতা কার আছে? আমাদের এই বিপদ কালে বিপদের বন্ধু যিনি তিনিই ইহার সুব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আর ইহা অতি সত্য কথা যে তিনি যাকে মনোনীত করেন তিনি তাঁর প্রিয় পাত্রই হবেন। আর সৃষ্টিকর্তার প্রিয় পাত্রের আনুগত্য স্বীকার করাতে আমাদের জন্য মঙ্গল নিহিত আছে। যখন আমরা এই ব্যবস্থা অবলম্বন করব কেবল তখনই পৃথিবীতে পুনরায় শান্তি আসতে পারে। ইহার আগে নয়। আর এই উপায়েই সৃষ্টিকর্তা জগতে সত্য ও অসত্যের প্রভেদ করেছেন। সত্যের ডাক শুনে যারা স্বেচ্ছায় সাড়া দেয় ও একতাবদ্ধ হয় তারাই সহজ, সরল ও সাধু ব্যক্তি। আর যারা ইহাকে অবিশ্বাস করে দূরে সরে যায় তারাই কপট-অসৎ ও অসাধু বলে প্রমাণিত হয়। অতএব, সমাজের অসৎ ও অসাধুদেরে বেছে বের করতে কারো মাথা ঘামাতে হয় না। অতঃপর এই বিশ্বাসীদের নিয়ে উক্ত মহৎ ব্যক্তি যে সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন সেই ব্যবস্থায়ই পৃথিবীতে ফিরে আসে মানব জাতির শান্তি ও শৃঙ্খলা। আমি আশা করি এই আলোচনায় সকল শ্রেণীর ভাইদের ভুল বুঝাবুঝির অবসান হবে এবং সকল সম্প্রদায় ও সকল শ্রেণীর সকল সাধু ব্যক্তিদের একতাবদ্ধ হওয়ার পথ সুগম হবে। ইতি-
তারিখÑ ৮ চৈত্র, ১৩৮০ বাংলা সন,
২২ মার্চ, ১৯৭৪ খ্রিঃ সন
রোজ শুক্রবার।
লেখার স্থান ঃ খুলনা হার্ডবোর্ড মিলস্ লিঃ।