পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করিতেছি
মোজাদ্দেদে জমান
আমি একটি লোক দেখিলাম। সে বসিয়া বসিয়া গান করিতেছে, কিন্তু লোকেরা তাহাকে পাগল বলিয়া থাকে। তখন আমি একটু খেয়াল করিয়া দেখিলাম, লোকটি যেন কোন চিন্তাশীল ব্যক্তি। প্রকৃত পক্ষে পাগল নয়। তাই নিকটে গিয়া বলিলাম, আপনি কি বলিতে চান একটু বুঝাইয়া বলুন আমি শুনিব। তখন তিনি গাহিতে লাগিলেন ঃ-
“আমি আসল কথা বলতে পারি না,
আসল কথা বলতে গেলে
জ্ঞানীদের গায় জ্বালা ধরে,
তারা সহ্য করতে পারে না।
তাই তো আমি আসল কথা বলতে পারি না।
আমি হলাম চাষার ছেলে,
কোন মৌলভী মৌলানা না,
তাই তো আমি আসল কথা বলতে পারি না।
এই দেখ যত মৌলভী মৌলানা
এরা হকিকতে আলেম না
হকিকতে আলেম হলে
হক কথা কেন ধরে না?
তাই তো আমি আসল কথা বলতে পারি না।
আসল কথা ধরবে সেদিন
ঘোর তুফানে পড়বে যেদিন।
পাকিস্তানে ঘোর তুফান সেজে উঠেছে
তোমরা চিন্তা করে দেখ না,
আমি আসল কথা বলতে পারি না।
যুগ পরিবর্তন হবে,
খোদার কুদরত জাহির হবে,
এদেশে খোদায়ী আইন জারী হবে,
তখন কেউ আর বাঁধা দিতে পারবা না,
আমি আসল কথা বলতে পারি না।”
তারপর তিনি বলিলেন, দেখ, ইহা কোন চিন্তা প্রসূত গান বা কবিতা নয়। তারপর তিনি গাহিলেন ঃ-
“কবির কল্পনা নয় ইহা,
নয় ভাবুকের চিন্তা।
ইহার মূলেতে রয়েছে
বিশ্ব নিয়ন্তা।
কবির কল্পনা যথা করেনা গমন,
জ্ঞানীর জ্ঞান যথা না করে ভ্রমণ,
সেই দেশের কথা ইহা,
নাহি জান মিথ্যা কখন ॥
বিজ্ঞানের বলে মানব করে আকাশ ভ্রমণ,
সুদূর চীন ও জাপানে করে নিমিষে গমন।
কিন্তু সে দেশ কঠিন এমন রুদ্ধ দ্বার যার,
সাধ্য নাহিক কাহার সেদেশে যাবার।
তবে বিশ্ব প্রভু দয়াময় দয়া করে যারে,
জানান সে দেশের খবর কিঞ্চিত সে জানিতে পারে ॥”
অতঃপর আমি আরজ করিলাম, তাহা হইলে আপনার আসল কথা কী যাহা শুনাইবার লোক পান না, ইহা আমি শুনিব, আমাকে বুঝাইয়া বলুন। তখন তিনি বলিতে লাগিলেন, “দেখ, মুসলমান মাত্রই জানে যে, এই জগতে বহু নবী আসিয়াছেন। কিন্তু কেন আসেন, কোন্ সময় নবীর প্রয়োজন হয় তাহা কি জান? তবে শুন তাহার বিস্তৃত ব্যাখ্যা ঃ- যখন জগতে নবী আসেন তৎকালে জগদ্বাসী তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়া যায়। এক শ্রেণীÑ তাহারা দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিত ও জ্ঞানী; কিন্তু ধর্ম বিষয়ে অজ্ঞ। কাজেই তখন তাহারা স্রষ্টা মান্য করা ও উপাসনা করাকে বৃথা ও অন্ধবিশ্বাস মনে করতঃ উহা ত্যাগ করেন। দ্বিতীয় শ্রেণী Ñ তাহারা স্রষ্টা মান্য করে বটে, কিন্তু কাহারো মারফতে নয়। বরং মনগড়া ভাবে। তাহারা বলে যে, সৃষ্টিকর্তার হকিকত জানা এবং তাঁহার কথা শুনা ও তাঁহাকে দেখা যাইতে পারে না। তবে তিনি সকল জিনিস গড়িয়াছেন ও সকল জিনিসের মধ্যেই বিরাজ করিতেছেন। সুতরাং ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে যে কোন জিনিসের সামনে পূজা দিলেই উহা তিনি পান। তাই তাহারা গাছ, মাছ, নদী-নালা, জীব-জানোয়ার ও পাথর ইত্যাদির পূজা করিয়া থাকে। ইহারা মোশ্রেক। তৃতীয় শ্রেণী Ñ তাহারা আহ্লে কিতাব ও নবীর অনুসরণকারী। এই পর্যন্ত বলিয়াই তিনি পুনরায় বলিলেন, দেখ, এখানে একটি প্রশ্ন জাগে, যথা, যখন এক শ্রেণীর লোক আহলে কিতাব ও নবীর অনুসরণকারী থাকে, তখন আবার নবী আসার দরকার কী? তার উত্তর শোন Ñ প্রকৃত পক্ষে নবীগণ হন খোদার খলিফা বা প্রতিনিধি। উদ্দেশ্য এই যে, খোদার আদেশে খোদার পরিবর্তে নবীগণ শাসক হইয়া জগদ্বাসীকে শাসন করিবেন। কিন্তু শাসকের জন্য দুইটি জিনিসের একান্ত দরকার Ñ একটি যুক্তি, অপরটি শক্তি। কারণ, লোক দুই প্রকার। এক প্রকার Ñসরল লোক। তাহারা যুক্তিপূর্ণ ন্যায় কথা বিনা তর্কে মানিয়া লয়। অপর প্রকার Ñ বক্র স্বভাবের। তাহারা যুক্তিপূর্ণ ন্যায় কথার বিপক্ষে অযথা তর্ক করিয়া থাকে। তাহাদের জন্য শক্তির প্রয়োজন। সুতরাং নবীর যুক্তি হইল খোদা প্রদত্ত কালাম। আর নবীর শক্তি হইল খোদার কুদরত, যথা মোজেজা। কিন্তু উম্মতের শক্তি হইল একতার মধ্যে। যতদিন পর্যন্ত উম্মতের উলামাগণ একতাবদ্ধ থাকিয়া দ্বীন জারী করিতে থাকেন ততদিন নেচারিয়ান ও মোশ্রেকগণের মাথা নত থাকে এবং দ্বীনের কাজে বিশৃঙ্খলা ঘটিতে পারে না। তারপর যখন উলামাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় এবং ক্ষুদ্র-বৃহৎ বহুদলে বিভক্ত হয়, তখন স্রষ্টা অমান্যকারী ও মোশ্রেকগণের মধ্যে আর দ্বীন প্রচার করিবে কে? বরং নিজেদের মধ্যেই এক দল অপর দলের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে ও বাহাছ-মুনাজারা করিতে গিয়া বিভিন্ন প্রকার ফেতনা-ফাসাত সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে, নেচারিয়ান ও মোশ্রেকগণের প্রভাব বিস্তার লাভ করত জগদ্বাসীকে গোমরাহীয়াতের দিকে নিতে থাকে। কাজেই তখন জগতে ধর্ম যদিও বাকী থাকে, কিন্তু ব্যাপক দ্বীন প্রচার বন্ধ হইয়া যায়। এই কারণে খোদা-পাক নতুন একজন নবীর মারফতে নতুনভাবে হুকুমতে এলাহি কায়েম করিয়া থাকেন। যাহা হোক যখন নতুন রাসূল আসেন, তখন তিনি জগতের সমস্ত মানুষকেই ভুল পথের উপর পান। কিন্তু প্রত্যেকের ভুল সমান নয়। তাই স্রষ্টা অমান্যকারীদিগকে তিনি যুক্তি-প্রমাণ দিয়া তাহাদের ভুল বুঝাইয়া দেন এবং তাহার সঙ্গী হইতে ডাকেন। মোশ্রেকদের ভুলও বুঝাইয়া দিয়া নিজের দিকে ডাকেন। তারপর আহ্লে কিতাবীদের বলেন, দেখ, আমি কোন নতুন কথা বলি না যাহা তোমরা জান না, বরং সেই কথাই বলি যাহা তোমরাও বল। যেমনি তোমরা পূর্ববর্তী রাসূলগণকে খোদার প্রেরিত বলিয়া মান, আমিও তাহা স্বীকার করি এবং রাসূলের মারফতে যে খোদার আদেশ জারি হইয়াছে ইহা পালন করা অবশ্যই কর্তব্য বলিয়া আমিও স্বীকার করি। এই হিসাবে আমিও তোমাদের সাথে একমত। কিন্তু কতক বিষয়ে তোমরা মতানৈক্য সৃষ্টি করিয়া বহু দলে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছ এবং বিভিন্ন দলের বিভিন্ন নাম দিয়া উহাকেই হক পথ বলিতেছ। কাজেই আমি খোদার পক্ষ হইতে তোমাদের সকল দল ভাঙ্গিয়া তোমাদিগকে এক দলভুক্ত করার জন্য আদিষ্ট হইয়াছি। ফল কথা হইতেছে আমি “সালেস” হিসাবে তোমাদের মতবাদের মীমাংসা করিতে আসিয়াছি। কাজেই এই হিসাবে আমি তোমাদের কাহারো সাথে একমত নই। কেননা, আমি যে দলকেই সমর্থন করি না কেন তার বিপরীত দলের নিকট দোষী হইব। সুতরাং আমি খোদার আদিষ্ট”। এই পর্যন্ত বলিয়া পুনরায় বলিলেন, দেখত বর্তমান যুগের লোক কি সেই তিন শ্রেণীভুক্ত হয় নাই? অবশ্যই হইয়াছে Ñকতক স্রষ্টা অমান্যকারী, কতক মোশ্রেক, আর কতক দ্বীনি এলেম শিক্ষিত আলেম। কিন্তু যদিও আলেমগণ খোদা ও রাসূলের বাণী প্রচারক, তবুও তাহারা অমুসলমান তো দূরের কথা মুসলমান নামের উচ্চ শিক্ষিত স্বেচ্ছাচারী জাহেল ও বেদাতী পীর-ফকিরদের স্বেচ্ছাচারীতাকে বাঁধা প্রদান করিতে পারিতেছে না। বরং দিন বা দিন স্বেচ্ছাচারীতা বাড়িয়াই চলিয়াছে। ইহার একমাত্র কারণ এই যে, আলেমদের মধ্যে যুক্তি আছে, কিন্তু তাহাদের হাতে শক্তি নাই। আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বলিয়াছেন, বনী ইসরাইলগণ বাহাত্তর দলে বিভক্ত হইয়াছিল, আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হইবে। বর্তমানে তাহাই দেখা যায়। শিয়া, সুন্নি, খারেজি, কলন্দরি, ওহাবি, কাদরিয়া, মর্জিয়া ইত্যাদি বহু দলে বিভক্ত এবং এক দল অপর দলকে পথ ভ্রষ্ট বলিয়া ঘৃণা করিতেছে। এই কারণে আলেমদের মধ্যে পূর্ণ একতা নাই। এবং একতা না থাকার কারণেই তাহাদের শক্তিও ফিরিয়া পাইতেছে না। অথচ শক্তি অর্জন করা এবং উক্ত শক্তি বজায় রাখার পন্থা সম্বন্ধে কোরানে যে তাগিদ রহিয়াছে “অ তাছিমু বিহাব লিল্লাহি জামিয়া অলা তার্ফারাকু” এই কথা সকল দলের আলেমদেরই জানা আছে। তাহা সত্ত্বেও তাহারা একতাবদ্ধ হইতে পারিতেছে না। উহার কারণ এই যে, প্রত্যেক দলের আলেমগণই মনে করেন, আমাদের মতটাই ঠিক, সুতরাং আমাদের মধ্য হইতেই নেতা নির্বাচিত হউক। আর সব দলের উলামাগণ তাহাকে সমর্থন করুক। যেহেতু একতা ব্যতীত শক্তি অর্জন করা যায় না। আর একজন নেতা মান্য না করা পর্যন্ত একতা গঠিতও হইতে পারে না।
এই পর্যন্ত বলিয়া পুনরায় বলিলেন, দেখ, এই যে সমস্যা, ইহার সমাধান কোন মানুষই করিতে পারে না। কারণ, এই রকম ভাবে যুক্তি দিয়া বুঝাইবার শক্তি অনেক আলেমেরই থাকিতে পারে। কাজেই এই সমস্যা সমাধান করার জন্য খোদাপাক গায়েব হইতে বন্দোবস্ত করেন। “বান্দায় খাস কুনাদ লুতফে আমরা”। সেই যে এক বান্দাকে খাস করা হয় জগদ্বাসীর মঙ্গলের জন্য Ñ এই বান্দাই হন হাদিয়ে জমান বা মোজাদ্দেদে জমান।
********