পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করিতেছি
একটি আলোচনা
– মানুষ ও পশুপ্রাণীতে প্রভেদ কি?
ধরুন, দশটি মোরগ মুরগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার দিয়া ছাড়িয়া দিলে দেখা যায় উহাদের মধ্যে যেটি প্রবল সেটি বাকী নয়টাকে চষ্ণুপ্রহারে তাড়াইয়া দেয় এবং সবগুলি খাবারই নিজের অধিকারে রাখিতে চায়, যদিও সবগুলি আহার গ্রাস করা তাহার পক্ষে সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে একশত জন মানুষকে কোথাও ‘জিয়াফত’ খাইতে হইলে যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ একশত জনের সামনে খাবার পৌঁছানো না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই খাবার বস্তু মুখে দেয় না। ইহাই মানুষের ভদ্রতা ও সভ্যতার প্রমাণ। তাই মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা। কিন্তু সেই মানুষ জাতির মধ্যে জন্ম গ্রহণ করিলেও কতক মানুষের স্বভাব পশুর চাইতেও অধম। যদি এরূপ মানুষ স্বাধীনভাবে চলিতে পায় তাহা হইলে বহু দুর্বল মানুষের মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়া পৃথিবীতে অশান্তি ঘটাইতে পারে। সেই জন্যই মানুষকে সমাজবদ্ধ হইয়া বাস করিতে হয়, যাহাতে কোন দুর্বলের প্রতি সবল ব্যক্তি জুলুম করিতে না পারে। আর যেহেতু সমাজ গঠন করিতে হইলে সমাজপতি নিযুক্ত করিয়া তাহার হাতে সমাজের নিয়ন্ত্রণ ভার অর্পন করিতে হয় এবং সর্বসাধারণকে স্বেচ্ছায় তাহারই নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকিতে হয়। এই ভাবেই দিন দিন পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটিয়াছে, তাই বর্তমান যুগে সমাজ ব্যবস্থার এত উন্নতি হইয়াছে যে, সমস্ত পৃথিবীটা এখন প্রায় এক সমাজের অধীনে আসিয়া গিয়াছে। তাই আজ বিশ্ব সমাজ বা জাতিসংঘের অস্তিত্ব বিদ্যমান। জাতিসংঘের মাধ্যমে সমস্ত জগতের মধ্যে বিভিন্ন দিক দিয়া নিবিড় যোগাযোগ সৃষ্টি হইয়াছে। কিন্তু মানব জাতির জীবনের সুখ শান্তির জন্য মূল বস্তু হইল ‘ইনসাফ’ এবং ‘ইনসাফ’ এর মাপকাঠি নির্ণয় করিবার ক্ষমতা কোন মানুষের হাতে নাই। উহা সেই মহান প্রভু যিনি জগত ও জগতবাসীকে সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহার হাতে রাখিয়াছেন। সুতরাং যত বড় সমাজই হউক বা যত বড় শক্তিশালী সমাজপতিই হউক না কেন তাহাকে সেই সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখিতে হয়। নতুবা সেই মানুষ কু-প্রবৃত্তির অধীন হইতে বাধ্য এবং কু-প্রবৃত্তি মানুষকে দিগ্ভ্রান্ত করিয়া দেয়, যেমনি রাত্রিকালে পথিককে ‘দিয়াভুলা’ বা ‘কানাওয়ালা’ পথভ্রষ্ট করিয়া দেয়। তদ্রƒপ যে মানুষ পূর্বদিকে চলিতেছে অথচ সে মনে করিতেছে যে, সে পশ্চিম দিকেই চলিতেছে। ঠিক ঐরূপ ক্ষমতাসীন সমাজপতি মানুষের জন্য যে ব্যবস্থা রচনা করিতেছেন, তিনি হয়ত ভাবিতেছেন যে ইহাতে পূর্ণ ইনসাফ কায়েম হইবে; কিন্তু আসলে উহাতে ‘বে-ইনসাফ’ কায়েম হইতেছে যাহার কারণে জগতে শান্তির পরিবর্তে অশান্তিই বৃদ্ধি পাইতেছে। যে কোন সমাজই গঠিত হউক না কেন উহাতে তিন শ্রেণীর মানুষ বিদ্যমান : দেশের সাধারণ মানুষ, কিছু বিশেষ ধরণের মানুষ, আর বিশেষ বিশেষ ধরণের মানুষ। বর্তমান জাতিসংঘেও উহার ব্যতিক্রম নাই।
বিশ্বের যতগুলি দেশ লইয়া জাতিসংঘ গঠিত হইয়াছে উহাদের সকল দেশেই নিম্ন শ্রেণীর সাধারণ লোক আছে এবং প্রত্যেক দেশেই কিছু বিশেষ ধরণের লোক আছে যাহারা সাধারণের প্রতিনিধি এবং জাতিসংঘে কিছু কিছু বিশেষ বিশেষ ধরণের লোক আছে যাহারা আপন প্রভাব ও প্রতাপের বলে সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন। সুতরাং যে কোন দেশের সাধারণের সুখ এবং দুঃখ জানাইবার জন্য আপন দেশের প্রতিনিধি দল জাতিসংঘে কোন প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং জতিসংঘের প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন ব্যক্তিগণ উহা বিবেচনা করেন। কিন্তু যদি উক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করিলে ক্ষমতাসীনদের কাহারো ব্যক্তিগত স্বার্থের বা দলীয় স্বার্থের অথবা আঞ্চলিক স্বার্থের কোন ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা থাকে তাহা হইলে উক্ত প্রস্তাব বাতিল করিয়া দিবার অধিকার তাহাদের আছে এবং করিয়াও থাকে। কাজেই দেশীয় প্রতিনিধিগণ তখন বিভ্রাটে পড়ে। যেহেতু ন্যায়সঙ্গত দাবী পাস করাইয়া সাধারণের শান্তির ব্যবস্থা করিতে না পারিলে আপন প্রতিনিধিত্ব রক্ষা করিবে কিরূপে? পক্ষান্তরে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে হাত মিলাইয়া না চলিলেও চলে না। কারণ তাহারা দুর্বলেরও প্রতিনিধি আবার সবলেরও প্রতিনিধি। অতএব কারণে তাহাদিগকে সবলের পরামর্শ লইয়াই কাজ করিতে হয়। ক্ষমতাসীনগণ আধুনিক কূটনীতি ও কৌশলাদিতে পারদর্শী। তাই ক্ষমতা রক্ষা করিবার জন্য যে কূটকৌশল শিখাইয়া দেওয়া হয় প্রতিনিধিগণ আপন দেশের সাধারণকে সেই মতেই চালিত করেন।
যাহা হোক, ঠিক এমনি অশান্তির যুগে পৃথিবীতে পুনঃ শান্তি কায়েম করিবার ক্ষমতা সসীম মানুষের হাতে থাকে না। তাই অসীম ক্ষমতাশালী প্রভু তাঁহার নিজ দয়া গুণে পৃথিবীতে শান্তির ব্যবস্থা করিয়া তাঁহার দুঃখী, তাপী দাসদিগকে রক্ষা করেন। যেহেতু তিনি কোন প্রভাবশালীকেই পরোয়া করেন না। ‘ইনসাফ’ কায়েম করিতে কাহারো মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিতে হয় না। কেন থাকিবেন? যেহেতু সকল ক্ষমতাসীনকে তিনি এই ভাবেই সৃষ্টি করিয়াছেন, যথা-অতি ঘৃণিত বীর্য দ্বারা দেহ গড়িয়াছেন এবং তাঁহার একটি আদেশ বা বাক্য দ্বারা আত্মা সৃষ্টি করিয়া সেই আত্মা দ্বারা নির্জীব দেহকে সজীব করিয়া দিয়াছেন। অতঃপর মাতৃগর্ভে একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত রাখিয়াছেন, এরপর অসম্ভব এক পথে এই পৃথিবীতে আনিয়াছেন। এত সবের পর যৌবনশক্তি, জ্ঞানশক্তি, ধনশক্তির দ্বারা ক্ষমতাশালী বানাইয়াছেন। এর পরও সমস্ত শক্তি থাকা সত্ত্বেও, হাতে শক্তিশালী অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও, দেহরক্ষী অস্ত্রধারী প্রহরী থাকা সত্ত্বেও সেই প্রভু তাঁহার দেওয়া আত্মা কাড়িয়া নিতে সর্বদা সক্ষম।
যাহা হোক, বর্তমান পৃথিবী যেহেতু যোগাযোগের দিক দিয়া বহু উন্নতি করিয়াছে, সেহেতু শান্তি কায়েম হওয়াও খুব সহজ হইবে বলিয়া আশা করা যায়। বর্তমান পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নাই যাহারা জাতিসংঘকে জানেনা বা জাতিসংঘও যাহাদের জানে না। বর্তমান জগতে যতগুলি প্রসিদ্ধ ধর্মমত সমগ্র দুনিয়াতে ছড়াইয়া আছে, উহাদের অনুসারীগণ সকলেই বিশ্বাস করেন যে সমস্ত সৃষ্টির একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং যে যেভাবেই পূজা বা উপাসনা করিয়া থাকুন না কেন তাহা কেবল সেই একক ও অদ্বিতীয় প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই করিয়া থাকেন। তাহারা ইহাও বিশ্বাস করেন যে, সেই প্রভুর ইচ্ছায়ই আমাদের মৃত্যু হয় এবং আমাদিগকে তিনিই মর জগত হইতে অমর জগতে নিয়া পুনরায় সৃষ্টি করিবেন। তাহারা ইহাও বিশ্বাস করেন যে, সেই প্রভুতে বিশ্বাসীগণ পরজগতে মুক্তি লাভ করতঃ সর্বসুখ ভোগ করিবেন। আর অবিশ্বাসীরা প্রভুর কোপানলে পতিত হইয়া নরক যন্ত্রণা ভোগ করিবে।
আর যথার্থভাবে সকলেই স্বীকার করিবেন যে, পৃথিবীর সকল মানুষ একই জাতীয়, যেহেতু সকল মানুষই পাঁচ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট এবং সকলের ইন্দ্রিয়ানুভূতি একই প্রকার। সুতরাং সকল মানুষের একতাবদ্ধভাবে জীবন যাপনের মধ্যেই পৃথিবীর শান্তি। আর একতাবদ্ধ হইতে হইলে একজনকে কেন্দ্র করিয়া তবে একতা গঠিত হইতে পারে। কাজেই সকল মানুষের প্রভু যিনি সেই পরম পরাক্রমশালী মালিকের সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করিয়া একতা গঠন করাই সরল পথ। তাই এই যুগে তিনি তাঁহার এক মনোনীত দাসের মাধ্যমে জগত বাসীদের একতা কায়েম করিবার জন্য আহ্বান জানাইতেছেন। আর উহা কার্যকরী করিবার ব্যবস্থা যাহা “অশান্তির জগতে শান্তির বার্তা” নামক প্রবন্ধে দেখান হইয়াছে। উহাই একমাত্র সঠিক পন্থা। তবে উক্ত সাধারণ সভা জাতিসংঘের ভিতরে হইতে হইবে। আর উক্ত প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তি তিনি পৃথিবীর যে কোন দেশ বা যে কোন ভাষাভাষীর মধ্য হইতেই হউন না কেন, তাহাকে নির্দিষ্ট ছয়টি শর্ত পূরণ করিতেই হইবে। এই ব্যাপারে আমি অটল বিশ্বাসী যে, সমস্ত পৃথিবীতে এইরূপ মানুষ একজনই আছেন যাহাকে প্রভু মনোনীত করিয়াছেন। আর আমাকে জামানত রাখার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছে উহ জাতিসংঘের জন্য ঠিক থাকিবে।
********